৭
ভদ্রতা-অভদ্রতার কতগুলো সূক্ষ্ম প্রশ্ন আছে, আমি সেগুলোর উত্তর কিছুতেই খুঁজে পাইনা। কারুর কাছে তো এসব জিজ্ঞেস করাও যায়না।
প্রথমে ঘটনাটা বলি।
আমরা দুই বেকার বন্ধু দুপুরবেলা রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরছিলাম। দুপুরবেলা সারা পাড়া জুড়ে শুধু মেয়েদের রাজত্ব থাকে, মহিলারা এ ছাদ থেকে ও ছাদে গল্প করেন কিংবা পা ছড়িয়ে ডাঁটা চিবোন, অনেকে ব্লাউজ খুলে আদুল গায় থাকেন —কলকাতায় বেশিরভাগ পাড়াই দুপুরে প্রমিলা-রাজত্ব—এসময় আমার মতন পুরুষ মানুষের বাড়িতে বসে থাকা মানায়না, তাই কাজ না-থাকলেও রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরি। সুবিমলও বেকার, সুতরাং দুজন সঙ্গী মাঝে-মাঝে কোন-কোন চাকরিঅলা বন্ধুর অফিসে যাই ঠিক টিফিনের একটু আগে। সেদিন সুবিমল আর আমি রণবীরের অফিসে যাব ঠিক করলুম।
রণবীর আমাদের দেখে খুশিই হয়েছিল। নিজের মামার ফার্মে রণবীর অফিসার হয়েছে, কাজকর্ম বিশেষ করতে হয়না, আমাদের পেয়ে আড্ডা দিতে উৎসুক হয়ে উঠল। আড্ডার মাঝখানে শুধু চা আনতে পাঠাচ্ছিল রণবীর, সুবিমল আমার দিকে চোখ টিপলে আমি তখন বলেই ফেললাম, শুধু চা কী? রণবীর সঙ্গে কিছু খাবার আনতে দে!
রণবীর ব্যস্ত হয়ে বলল, তোদের খিদে পেয়েছে? ক্যান্টিনে ডিমের চপ হয়েছে বোধহয়, দাঁড়া—। রণবীর দুটাকার ডিমের চপ আনতে দিতে আমরা অনেক নিশ্চিন্ত হয়ে আবার আড্ডা শুরু করলুম।
অফিসের বেয়ারাদের একটা স্বভাব এই চা আনতে পাঠালে তারা সোজা চলে যায় দার্জিলিং-এ, ডিম আনতে পাঠালে একেবারে মাদ্রাজ। খাঁটি জিনিশ আনতে হবে তো! সুতরাং, আমাদের আড্ডা ম্যারাথন রেসের মতন চলতেই লাগল, খিদেয় আমার পেট ছিঁড়ে ফেলছে একেবারে। এমন সময় দরজা ঠেলে ঢুকলেন, না, বেয়ারা নয়, পরেশবাবু, হাতে ফাইল। বুড়োমতন, নিরীহ এই লোকটিকে আমি আগেও রণবীরের অফিসে দেখেছি, লোকটি রণবীরের থেকে নিচু পোস্টে কাজ করেন। লোকটি একটু বেশি কথা বলেন এবং এক কথা দু—তিনবার না-বললে বোঝেননা। অন্যদিন লোকটি চলে যাবার পর রণবীর বলে, জ্বালাতন! এমন বকবক করে!
সেদিন পরেশবাবু ঢুকতেই রণবীর আমাদের বসতে বলে, তাড়াতাড়ি তাঁকে বিদায় করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। পরেশবাবু ফাইল খুলে বোঝাতে লাগলেন, শুনে মনে হল ব্যাপারটা খুব জরুরি, সেদিনই দিল্লিতে টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে —ইত্যাদি। রণবীর ফাইল দেখছে, এমন সময় বেয়ারা ঢুকল, হাতে কেটলি এবং একটা প্লেটে বেশ বড়বড়, বোধহয় রাজহাঁসের ডিমের চপ পাঁচটা। আমি আর সুবিমল কী নিয়ে যেন ফিসফাস করছিলাম, রণবীর বলল, নে, খা। আমরা দুজনে দুটো তুলে নিলাম, রণবীরও একটা তুলে কামড় বসিয়ে পরেশবাবুর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। এতবড় ডিম একটা খেলেই যথেষ্ট। সুবিমল তবু আর-একটা তুলে নিল। প্লেটে তখনো একটা পড়ে আছে—একটু বাদে রণবীর কথা থামিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, কি রে ওটা খাবিনা? রণবীরের চোখ একমুহূর্তে থমকে গেল, সেই চোখে আমি কী যেন একটা মারাত্মক বিপদের ইঙ্গিত দেখলাম, আমার আর চিন্তা করার সময় ছিলনা, আমি অতি দ্রুত বলে উঠলাম হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমি ওটা খাব। আমি খপ করে তুলে নিলাম।
পরেশবাবু সেইসময় ফাইল বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে, আমার হয়ে গেছে স্যার, আপনাকে বিরক্ত করলুম। আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম পরেশবাবুর গলাটা একটু-একটু কাঁপছে, যাবার সময় তিনি এক পলক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে গেলেন।
পরেশবাবু নিশ্চয়ই সারাজীবন আমাকে একটা বিষম লোভী এবং অতি বদ লোক ভাববেন। অতবড় রাজহাঁসের ডিম দুটো আমি বকরাক্ষসের মতো গপ্প করে গিলছিলাম ওঁর সামনে বসে। কিন্তু, প্রশ্নটা এই, আমার কী করা উচিত ছিল সেদিন? কোন্ ব্যবহারটাকে ঠিক ভদ্রতা বলা চলে? সেই সামান্য ঘটনাটা নিয়ে আমি বছরের পর বছর ভাবি।
পরেশবাবুকে প্রথমেই অফার করা উচিত ছিল রণবীরের। সে তা করেনি, যে কোনো কারণেই হোক। হয়তো রণবীরটা এমনই প্রচণ্ড স্নব যে অধঃস্তন কর্মচারীকে খাবার অফার করতে তার মানে বাধে। তাহলে কী আমার বা সুবিমলের উচিত ছিল অফার করা? সুবিমল পরেশবাবুর পাশে বসে ছিল, আমি ভেবেছিলাম সুবিমলই বলবে—কিন্তু সুবিমল বলেনি। ও হয়তো প্রতীক্ষায় ছিল, আমি বলব। আমি অনেক ভেবেচিন্তেই বলিনি, পাছে সুবিমল মনে করে ওর থেকে আমি বেশি ভদ্র সাজবার চেষ্টা করছি! (এরকম মনে করার কারণ আছে, একটু পরে সে ঘটনা বলছি।) খাবার অফার করার একটা সময় আছে, সেই সময়টা পেরিয়ে গেলে আর বলা যায়না। ভাবতে-ভাবতে সেই সময়টুকু পেরিয়ে গেল, আমি রণবীর, সুবিমল তিনজনেই চপে কামড় বসিয়েছি—তারপর পরেশবাবুকে খেতে বলা যেন অভদ্রতা। রণবীর আরো মারাত্মক কাণ্ড করতে যাচ্ছিল, যখন একটা পড়ে আছে—তখন রণবীর যে প্রশ্ন করল—সেসময় রণবীরের চোখ দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যদি আমি না-খাই—তাহলে ও পরেশবাবুকে অফার করবে! একজন মধ্যবয়স্ক প্রৌঢ়, বাড়িতে হয়তো তাঁর তিন-চারটি সন্তান আছে, আমার বয়সী কোন ছেলে থাকাও বিচিত্র নয়—শুধু একটা নিচু চাকরি করেন বলেই পড়ে—থাকা ডিমের চপ তাঁকে খেতে বলা হবে—এটা আমার কাছে একটা দারুণ অভদ্রতা মনে হয়েছিল। সেইজন্যই রণবীরকে বাঁচাবার জন্য সেটা আমি তুলে নিয়েছিলাম। অথচ, পরেশবাবু চলে যাবার পর, রণবীর আমাকে বলল, কী পেটুক হয়েছিস রে আজকাল? অতবড় একটা ডিম ফট করে মুখে পুরে দিলি? সুবিমল ফ্যাক—ফ্যাক করে হাসতে লাগল! আমি অপ্রস্তুত হয়ে ব্যাপারটা ওদের বোঝাবার চেষ্টা করলুম, বললুম, তোরাই তো অসভ্যের মতন…। রণবীর বলল, ভ্যাট বাজে বকিস না। অসভ্য আমি না তুই? লাস্ট চপটা পরেশবাবুকে দিলে উনি কী আবার মনে করতেন? কিচ্ছু না।
তাহলে আমারই ভুল? বুঝতে পারিনা। পরেশবাবু সত্যিই তাতে কিছু মনে করতেন না? কোনদিন এর উত্তর পাবনা। আমি তো ভেবেছিলাম, পরেশবাবু আমাকে লোভী ভাবেন ভাবুন কোন ক্ষতি নেই—আমার সঙ্গে তো আর দেখা হচ্ছেনা। নিজের অফিসের রণবীরকে যাতে অভদ্র বা রূঢ় না-ভাবেন সেজন্যই আমি…।
ভদ্রতা-অভদ্রতার ‘প্রশ্নে আমি দিশাহারা হয়ে যাই! অন্যের সামনে বেশি ভদ্রতা দেখানোও একধরনের অভদ্রতা কিনা বুঝতে পারিনা। এবার আগের ঘটনাটা বলি।
সুবিমল আর আমি একদিন বাসে করে ফিরছিলাম রাত্তিরবেলা। খুব বেশি ভিড় ছিল না, বসার জায়গা পেয়েছিলাম। লেডিস সীটের কাছাকাছি কী যেন একটা বচসা হচ্ছিল—আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। বাসের ঝগড়ায় সাধারণত কান দিইনা, কিন্তু লেডিস সীটের কাছে যখন, হয়তো কোন রসের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে—এই হিশেবে উৎসুক হয়েছিলাম। কিন্তু তাকিয়ে দেখি ব্যাপারটা বড়ই নীরস। একজন প্রৌঢ়া মহিলা ভাড়া দিতে পারছেন না, কণ্ডাকটর তাঁকে নামিয়ে দিতে চায়।
মহিলাটির চুল কদমছাঁটা, পরনের শাড়িটা মূল্যবান কিন্তু বেশ ময়লা, কথা শুনে মনে হল মহিলাটির একটু মাথার গোলমাল আছে। কাচুমাচু মুখে মহিলাটি বলছেন, কাল পয়সা দেব বাবা, আজ নেই বাবা, আমার মেয়ের বাড়িতে গেলেই টাকা পাব—তখন তোমার ডবল পয়সা দেব—। কণ্ডাকটার চেঁচিয়ে বলছে, নামুন, নেমে যান, রোজ-রোজ, নামুন।
–নামব কেন? মেয়ের বাড়িতে যাব, মেয়ে আমার কত যত্ন করবে——হাঁ, মেয়ে আপনাকে সিংহাসনে বসাবে! হেঁটে যান, আরো লেডিজ দাড়িয়ে রয়েছে, আর উনি জায়গা জুড়ে… রোজ-রোজ ভাল্লাগেনা…নামুন —
—ইস পয়সা দিইনি বলে বসবনা কেন? ওরা বসবে? ভারী আমার পয়সার গরম!
—ইস, এই পাগলীকে নিয়ে তো মহাঝঞ্ঝাট! ইনস্পেকটার এসে আমাকে ধমকাবে—এবার জোর করে নামিয়ে দেব বলছি…
মহিলাটিকে দেখে আমার একটু অন্যরকম লাগছিল। এলাহাবাদে আমার এক পিসিমা থাকতেন, তাঁর মুখের সঙ্গে মহিলাটির খুব মিল। আমার সেই পিসিমা অবশ্য দশ বছর আগে মারা গেছেন। কিন্তু মহিলাটিকে দেখে পিসিমার কথা হঠাৎ আমার মনে পড়ল, পিসিমা আমাকে একটা নীল সোয়েটার বুনে দিয়েছিলেন, যেবার এলাহাবাদে যাই, সেবার পিসিমা আমাকে….
হঠাৎ দেখলাম কণ্ডাকটর ঘটাং করে বেল বাজিয়ে থামিয়েছে এবং একরকম জেদের মাথাতেই সেই মহিলার হাত ধরে নামিয়ে দিতে যাচ্ছে। আমি আর কিছু ভাবিনি, জোরে চেঁচিয়ে বললুম এই যে, কণ্ডাকটর ওকে ছেড়ে দিন। ওর কত ভাড়া, আমি দিয়ে দিচ্ছি।
কণ্ডাকটর আমার দিকে ফিরে বলল আপনি ভাড়া দেবেন কেন? ভাড়ার জন্য নয়, জানেননা, রোজ এই সময়টাতে এমন ঝঞ্ঝাট করে—
আমার হঠাৎ অকারণেই রাগ হয়ে গেল। ধর্মকে বললুম, আপনার অত কথা তো আমি শুনতে চাইনি! ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি চুপ করে থাকুন। ভদ্রমহিলার গায়ে হাত দিয়ে….
কণ্ডাকটর টিকিট কাটল, মহিলাটি আমার উদ্দেশে বললেন, বেঁচে থাকো বাবা, রাজরাজেশ্বর হও…
কয়েকস্টপ পরে নামলাম। সুবিমল আমার দিকে তাকিয়ে হো-হো করে হেসে উঠে বলল, তুই সিনেমায় নেবে যা!
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কী ব্যাপার?
সুবিমল বলল, কীরকম বাসসুদ্দ লোকের সামনে হীরো সেজে গেলি — সেইটা দেখলাম। একেবারে বাংলা নভেল, উদার যুবক, আদর্শবাদী, আবার লেকচার…. সবাই তোর দিকে তাকিয়েছিল, তাই একেবারে গর্বে…
—মোটেই না। ভদ্রমহিলার হাত ধরে টেনে নামাচ্ছিল ও সময় কিছু একটা…
—তা বলে ওরকম অভদ্রের মতন চেঁচাবি? এই দ্যাখ—
সুবিমল হাত তুলে দেখাল, ওর হাতে একটা সিকি। বলল আমি নিজেই উঠে গিয়ে কণ্ডাক্টরকে টিকিটটা দিতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই তুই হীরো সাজরার ‘জন্য চেঁচিয়ে সরগরম করলি। আমার কথা ভুলেই গিয়েছিলি…আমার দিকে একবার তাকাসওনি।
আমি লজ্জিত হয়ে পড়লাম। বললাম, তা নয়, সুবিমল বুঝলি না, ভদ্রমহিলার হাত ধরে টানছিল, থাকতে না-পেরে, মানে, একটা ভদ্রতা-সভ্যতার ব্যাপার….
—ওকে ভদ্রতা বলেনা। পাশে বন্ধু বসে আছে, তার তুলনায় নিজে বেশি উদার কিংবা ভদ্র সাজার চেষ্টা এটাও একটা অসভ্যতা।
—অতটা ভাবিনি, জানিস, ওঁকে দেখে হঠাৎ আমার মনে পড়ছিল… সুবিমল আবার মাঝপথে কী ভেবে হেসে উঠল। আমার পিঠে একখানা বিরাট কিল মেরে বলল, হারামজাদা ওর জন্য টাকা ভাঙিয়ে টিকিট কাটলি দেখলাম। তাহলে আগে আমার টিকিট কাটিসনি কেন? সে বেলা বুঝি একটু উদার হওয়া যায় না, না?