আকাশ পাতাল – ১০

১০

মুনা আর বাবুই আমেরিকা যাচ্ছে, এয়ারপোর্টে বহু নারী-পুরুষ এসেছেন ওদের বিদায়ের হাতছানি দিতে

ডাকনাম শুনলে বোঝা যায় না, আসলে ওরা দুজন আধুনিক যুবক-যুবতী। মেয়েটির বয়েস কুড়ি-একুশ, হালকা ছিপছিপে চেহারা, ফর্সা মুখ জুড়ে আছে টলটলে দুটি চোখ—এখন সেই চোখদুটি একটু অস্থির, সিল্কের শাড়ির আঁচল সামলাতে-সামলাতে বারবার চঞ্চল পায়ে ঘুরছে এয়ারপোর্টের লাউঞ্জের এদিক থেকে ওদিক। ছেলেটিও বেশ রূপবান দীর্ঘ চেহারায় নিখুঁত পোশাক, কোট কাঁধের ওপর রাখা, মুখে একটা সূক্ষ্ম কৌতুকের হাসি। মুনা—অর্থাৎ অনুরাধা, বাবুই অর্থাৎ সিদ্ধার্থ, খবরের কাগজে প্রায় প্রতিদিনই ‘উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রা’ উপলক্ষে যেসব ছেলেমেয়েদের ছবি বেরোয়, ওদের ছবি না-দেখলেও বুঝতে পারলাম–ওরাও সেই দলেরই।

আমার এক কাকার বম্বে থেকে আসার কথা, আমি এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম তাঁকে আনতে। আমাদের পরিবারে ঐ একটিই কাকা, যাঁর মাঝে-মাঝে প্লেনে চড়ার সৌভাগ্য হয়, সুতরাং তাকে খাতির দেখাবার জন্য তাঁর আসার দিন কারুকে এয়ারপোর্টে যেতে হয়। বাড়ির মধ্যে আমি ছাড়া বেকার কেউ নেই—সুতরাং আমারই ওপর ভার পড়েছিল। গিয়ে শুনলাম, প্লেন আসবে তিনঘণ্টা পরে—এই দীর্ঘ সময় আমি কী করব, বেরিয়ে খানিকটা ঘুরেও আসতে পারতাম, কিন্তু আমি অপেক্ষাঘরেই গদিমোড়া আসনে বসে রইলাম পাখার নিচে। আমার হাতে একটা বই ছিল, কিন্তু বইতে মন দিতে পারলামনা—আমি এয়ারপোর্টের মানুষদেরই দেখতে লাগলাম, দেখতে আমার ভালো লাগল। এক সঙ্গে এত ভালো পোশাক পরা, সুন্দর চেহারার, আপাতসুখী মানুষ অন্য কোথাও দেখা যায়না। চারিদিকেই চকচকে রূপ, ঝকঝকে কথাবার্তা। আর কী সব চমকপ্রদ কথাবার্তা, রোম-প্যারিস—নিউইয়র্ক-লণ্ডন ইত্যাদি স্বপ্নের শহরের নাম কী অনায়াসে উচ্চারিত হয় মুখে—মুখে!

—লণ্ডনটা অতি বিশ্রী জায়গা—দুদিনের বেশি ওখানে থাকবনা ভাবছি!

—চৌধুরি, তুমি তো প্যারিসে থাকছ? সে হ্যালো টু ইফেল টাওয়ার ফর মি, উইল য়ু?

—গতবছর আমি যখন ফ্র্যাঙ্কফুর্টে ছিলাম এইসময়, এমন বৃষ্টি!

—রোমে গেলে কিন্তু ভিয়া ভেনেত্তো যেতে ভুলো না!

—বার্লিনে পৌঁছেই কিন্তু মেজো বউদির সঙ্গে দেখা করবে?

—মুনা, নিউইয়র্ক নামার আগেই কিন্তু এক্স-রে প্লেটদুটো হাতে নিয়ে নিও। আমার বেলায় এমন গণ্ডগোল—

—খোকন, প্রত্যেক সপ্তাহে একটা চিঠি দেবে—

—শোনো, জেনিভার একটা হোটেলের ঠিকানা আমি দিয়ে দিচ্ছি…—এই নিয়ে আমি চারবার ইংলণ্ড যাচ্ছি, আর ভালো লাগেনা!

আমার হাতে একটা রোমাঞ্চকর গোয়েন্দা গল্পের বই, কিন্তু তবু সেটায় মন দিতে পারছিনা, আমি অবাক হয়ে এইসব কথাবার্তার টুকরো শুনছি উদগ্রীবভাবে। দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি সবার মুখে-মুখে—কী অবলীলাক্রমে ঐসব উপন্যাসে পড়া শহরের নাম উচ্চারিত হচ্ছে এখানে। একটা বুলডগ চেহারার সাহেবের পাশে একটি বিড়ালমুখী মেমসাহেব দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে নিন্দে করছে কলকাতার পাঁউরুটির, জার্মান বউয়ের সঙ্গে এক ভেতো বাঙালি নাকিসুরে আদুরে গলায় রাজনীতি আলোচনা করছে, একটি গাউন-পরা গুজরাতি মেয়ে হেঁটে গেল শাকচুন্নীর মতো। একপাশে স্ট্রেচারের উপর শুয়ে আছে একটি যুবতী মেয়ে, মেয়েটি সম্ভবত খুবই অসুস্থ, এই অবস্থাতেই প্লেনে যাবে, কিন্তু মেয়েটির মুখে অসহায়তার বদলে আছে অদ্ভুত অহংকারের ছাপ।

আমি এসবই দেখছিলাম, কিন্তু আমার মনোযোগ বেশি আকর্ষণ করল আমার পাশেই দাঁড়ানো দলটি। মুনা আর বাবুই, আর ওদের বিদায় দিতে আসা আত্মীয়—পরিজন। আমি ওদের আগে কখনো দেখিনি, কিন্তু ইতিমধ্যেই ওদের ডাকনাম, ভালোনাম জেনে গেছি। কান পেতে শুনছি ওদের কথা।

আমি একসময় দাবা খেলতে খুব ভালোবাসতাম। এখন আর খেলিনা, এখন অন্য একটা অভ্যেস এসে গেছে। এখন অপরিচিত লোকজন দেখলেই মনে-মনে খেলা করি, কার সঙ্গে কী সম্পর্ক—এই নিয়ে। আমি বইয়ের আড়াল থেকে মাঝে—মাঝে চোরা চোখে তাকিয়ে—এই অনুমানের খেলা শুরু করে দিলাম। আজকের নায়ক-নায়িকা বাবুই আর মুনাকে আমি প্রথমেই চিনে গেছি—অন্য সকলের কথা শুনে। এখন সব কথাবার্তার কেন্দ্র ওরা। মেয়েটির মা কোথায়? মেয়ের মায়ের চেহারা আজ কী রকম হওয়া উচিৎ? করুণ, থমথমে, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-ভরা মুখ? না, সেরকম তো কারুকে দেখছিনা। স্পষ্ট বোঝা যায়, এ পরিবারে বিদেশ যাওয়া নতুন কিছু না। অনেকেই আগে ঘুরে এসেছেন। বিদেশ যাওয়াটা আমাদের একধরনের ছোঁয়াচে রোগ, এক পরিবারের একজনের পক্স হলে যেমন অন্য আর দু-একজনের না-হয়ে ছাড়ে না, বিদেশ যাওয়াটাও সেইরকম। এবং পক্সের মতোই বিদেশ ঘুরে আসার চিহ্নও অনেকের গায়ে-মুখে লেগে থাকে সারাজীবন। এই দলটি অবশ্য স্বাভাবিক, তবু বুঝতে পারলাম—কেউ-কেউ বিদেশফেরং।

যে-মহিলা হাসতে-হাসতে মেয়েটিকে বলছেন, ও কি মুনা, তুমি একটু হাসছ না কেন? বাঃ!—সেই মহিলাই নিশ্চয়ই মেয়েটির মা। ঐ সুন্দরী মেয়েটির রূপের আভাস আছে ঐ মহিলার মুখে, এখন সে রূপ শান্ত। হ্যাঁ, ঐ মহিলাই নিশ্চয় মা। আমি বাজি রাখতে পারি। কারণ মহিলাটি যদিও হাসছেন খুব, মুখে দুশ্চিন্তার চিহ্নমাত্র নেই—মনে হচ্ছে মেয়ের বিদেশ যাবার জন্য সত্যিই খুশি—ওঁর মুখে একটা সূক্ষ্ম দুঃখের পর্দা আমার চোখ এড়াতে পারেনি।

এবার ছেলেটির মা? ছেলেটির মাকে আমি ঠিক খুঁজে পেলাম না। মহিলাদের দিকেও বারবার তাকাতেও পারিনা। আরো পাঁচ-ছজন মহিলা ও যুবতী আছেন! কিন্তু ছেলেটির বাবাকে আমি খুঁজে পেলাম। দীর্ঘ চেহারার প্রৌঢ়, মুখে সবসময় একটি কৌতুকের হাসি। বুঝতে পারলাম, ছেলেটি তাঁর ঐ কৌতুকের হাসি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে। তাঁর পাশে আরেকজন সুঠাম চেহারার ভদ্রলোক নিশ্চিত মেয়ের বাবা। মুখের কোন মিল নেই, তবু আমার মনে হল। মেয়েটির বাবার মুখ একটু ক্লান্ত, একটু যেন চিন্তাক্লিষ্ট। সে চিন্তা মেয়ে চলে যাবার জন্যও হতে পারে—বা, যুদ্ধের সাম্প্রতিক খবরের জন্যও। কেননা, শুনলাম, তিনি একবার ভারী গলায় মেয়েটিকে বললেন, তোমার মুখ হাসিখুশি নয় কেন? নতুন দেশ দেখার একটা থ্রিল আছে, আমার এখনো মনে পড়ে—। একটু বাদে, পাশের একজনকে বললেন, ইন্দোনেশিয়া কী সত্যি পাকিস্তানকে সাহায্য করবে?

মুখে অল্প দাড়ি একটি সদ্য যুবক, ক্রিকেট খেলোয়াড়ের মতো চেহারা—এ খুব সম্ভবত মেয়েটির ভাই বা দেওর। যে-কোন একটা হতে পারে! সে বলল, তোমরা দু-বছর থেকে যাও, তারপর আমিও চলে আসছি! আমি গেলে আর ফিরবনা!

পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন যুবক-যুবতী, এরা কয়েকজন নিশ্চিত মেয়েটির বন্ধু, কয়েকজন ছেলেটির। এইসময় হন্তদন্ত হয়ে আরেকজন যুবক এল, শার্টপ্যান্টের সঙ্গে চটি পরা, একটু বেমানান, বোকা অথবা লাজুকের মতো মুখ। মেয়েটি, বলল, আরেঃ, মাস্টারমশাই? এমন রেগে গিয়েছিলাম—একবারও খোঁজ নিলেননা!

-কী করব, আমি তো কালকেই খবর পেলাম!

— ইচ্ছে করেই খবর দিইনি! আপনি একবার—

মাস্টারমশাই নামের যুবকটি কী বলল যেন, বোঝা গেলনা। মেয়েটি আর—একটি কালো চশমা পরা মেয়েকে ডেকে বলল, ছোটোমাসি, দেখো মাস্টারমশাই এসেছেন শেষপর্যন্ত! মেয়েটির স্বামী এসে বললে, যাক, তবু আপনার সঙ্গে দেখা হল! ছেলেটির বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আলাপ করিয়ে দিই, ইনি মাস্টারমশাই।

যুবকটি মৃদু স্বরে বলল, আমার নাম মাস্টারমশাই নয়, আমার নাম অমুক—। হঠাৎ কেউ একজন এসে বলল, এবার যেতে হবে, নাম ডেকেছে!

–আমাদের ফ্লাইট তো, ঠিক?

—ক্যারাভেল দিয়েছে, না জেট?

—উঃ, বম্বেতে যে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে?

দলটা আস্তে-আস্তে এগিয়ে গেল গেটের দিকে। আকাশ কালো করে মেঘ উঠেছে, প্লেন ছাড়ছে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে। গেটের মুখে-মুখে বালির বস্তা সাজানো। এসব বালির বস্তা দেখলে সত্যিই যুদ্ধের কথা ভেবে গা ছমছম করে! আমার কাকার প্লেন আসতে এখনো অনেক দেরি। এতক্ষণ ঐ দলটার কথা শুনতে-শুনতে—যেন আমিও ওদের দলে মিশে গেছি। এত দূর বিদেশে চলে যাচ্ছে—এই দুই নবীন স্বামী-স্ত্রী, ওদের দুজনের জন্য আমারই মন কেমন করতে লাগল। আবার কতদিন পর দেখা হবে বাবা-মার সঙ্গে—ওদের বাবা-মায়ের কী বুক গুরু-গুরু করছে না? কিন্তু কোথাও তো আমি কোন ভয় বা উৎকণ্ঠা বা দুশ্চিন্তার ছায়া দেখছিনা যেন মনে হচ্ছে, বিয়ের পর ওরা দুজন দার্জিলিং যাচ্ছে মধুযামিনীতে—সবাই এমন আনন্দ করে বিদায় জানাচ্ছে—অথচ আমেরিকা, পৃথিবীর উল্টোপিঠে যাচ্ছে ওরা। শেষমুহূর্তে কেউ কী কাঁদবে না? কারুর চোখের জল পড়বে না? শেষপর্যন্তও সকলের এমন মনের জোর থাকবে?

হঠাৎ আমি উঠে পড়ে ঐ দলটাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। আমার কী দরকার, আমি ওদের কারুকে চিনিনা, জীবনে আর কখনো দেখা হবে না, তবু আমার অসম্ভব কৌতুহল হতে লাগল শেষমুহূর্তে কারুর চোখের জল পড়ে কিনা দেখার জন্য। মানুষ কী আজকাল সত্যিই এমন আধুনিক হয়ে গেছে? জানি, বিমানযাত্রায় আজকাল কোন দুর্ভাবনা নেই, কিন্তু মেয়েরাও কী সেকথা মানবে? অকারণে, দুর্ভাবনা করাই যে মেয়েদের স্বভাব। আমিও ওদের দলের পিছনে দাঁড়িয়ে কৌতুহলী হয়ে সবার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কোথাও একফোঁটা চোখের জল দেখা যায় কি না।

গেট পেরিয়ে প্লেনের দিকে এগিয়ে যাবার আগে ছেলেটি সবার সঙ্গে করমর্দন করল, পিতাকে আলিঙ্গন করে বেশ সপ্রতিভভাবে বেরিয়ে গেল, মুখে তখনো সেই কৌতুকের হাসি। মেয়েটি কারুর সঙ্গে একটিও কথা বললনা, সুন্দর টলটলে চোখ মেলে শুধু তাকাল সবার দিকে, বুঝতে পারলাম একটি কথা বলতে গেলেই কান্না বেরিয়ে আসবে। এরকম আধুনিকা মেয়ে, যাবার আগে কাঁদলে যে ওকে একদম মানাবেনা। ক্রমে ওরা প্লেনের মধ্যে উঠে গেল—কী জানি কোন জানালার পাশে বসেছে, ওদের আর দেখা যায়না। মেয়ের মা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন প্লেনের দিকে। বাবা তখন সেই মাস্টারমশাই নামের ছোকরাকে জিজ্ঞেস করছেন, কী মনে হয়, চীন সত্যিই আবার আক্রমণ করবে?

কী কারণে প্লেন ছাড়তে দেরি করছে। বালির বস্তার পাশে দাঁড়ানো যায়না —এত ভীড়। অথচ প্লেন ছাড়বার আগে কেউ যাবেনা। এই দলের সকলে, হঠাৎ ওখান থেকে এসে বাইরের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালেন! ওখান থেকে প্লেনটা স্পষ্ট দেখা যায়। কী আশ্চর্য, আমিও ওদের সঙ্গে চলে এসেছি, তাকিয়ে আছি প্লেনের দিকে। কী ভাগ্যিস আমাকে কেউ এসে জিজ্ঞেস করবেনা, আপনার তো কোন চেনা লোক নেই এ প্লেনে—তবু আপনি কেন এখানে দাঁড়িয়ে। আমি কেন দাঁড়িয়ে? আমি কোথাও এক ফোঁটা চোখের জল দেখার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আমি সঙ্কোচ ভুলে, সমবেত মেয়েদের প্রত্যেকের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। দু-একজনের চোখ যেন চিকচিক করছে, আভাস এসে গেছে, এখন প্লেন ছাড়ার শুধু অপেক্ষা। এই সুন্দরী, সপ্রতিভা মহিলাদের চোখের জল আমি দেখে যাব।

দেখা হলনা। ঝুপঝুপ করে হঠাৎ বৃষ্টি এসে গেল। আমি সমেত দলের সকলকেই ভিজিয়ে দিল বৃষ্টি। এখন আর চোখের জল বোঝা যাবেনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *