আকাশ পাতাল – ১

বারোজন বৃদ্ধ আর একটি শিশু। রেলের কামরার একদিকের দুটো বেঞ্চ জুড়ে বসেছে ওরা, ছোট কামরায় যথেষ্ট ভিড়, আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। বারোজন বৃদ্ধ ও একটি শিশু মিলে ওরা একটি দল, ওরা হুমড়ি খেয়ে সবাই তাকিয়ে আছে জানলার বাইরে দ্রুত অপসৃয়মান নদী-নালা, গাছপালা, মাঠ-ঘাট দেখছে অতিশয় বাগ্রভাবে, ক্ষণে-ক্ষণে মুগ্ধ হয়ে উঠছে। ওদের মুখে ক্লান্তির চিহ্ন, কিন্তু চোখ আনন্দে উজ্জ্বল। বারোজন বৃদ্ধের এক সঙ্গে এই প্রকৃতিপ্রীতি দেখে আমার একটু অবাকও লাগল। বার্ধক্যে সবই পুরোনো হয়ে যায়, প্রকৃতিও কি পুরোনো হয়না? শিশুটি চুপ করে আছে, আর সেই বারোজন বৃদ্ধই মন্তব্যে মুখর। ‘যাওয়ার সময় তো এই খালে এত পানি দেখি নাই।’ ‘মাটির রং দেখো না বেশ কালচে মেরেছে—এবার ধান ভালো হবে! যাই বলো আর তাই বলো, এমন সবুজ ঘাস আর কোথাও দেখতে পাবেনা।’

আমি অতিশয় কৌতূহলে ওদের কথা শুনছিলাম। এমন সময় একজন বৃদ্ধ আমাকে বললেন, আপনি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন! আপনি বসুন বাবুমশাই, আমি দাঁড়াই!

শশব্যস্তে আমি বললুম, না, না, তা কি হয়! আমি ঠিক আছি, কোন অসুবিধে হচ্ছেনা, আপনি বসুন।

বৃদ্ধটি তখন সীটের তলা থেকে একটা পুঁটুলি বার করে নিজে তার ওপর বসে—আমাকে একটু জায়গা করে দিলেন। আমি ওঁদের মাঝখানে বসলুম। বৃদ্ধ বললেন কদ্দিন পর দেখছি এই দেশ, আর যে দেখব কখনো সে আশা তো নাই। তাই এত ভালো লাগতেছে।

জিজ্ঞেস করলুম, আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন?

প্রশ্নের অপেক্ষামাত্র, এক সঙ্গে অনেকে উত্তর দিলেন। কথা বলার জন্য ওঁরা সবাই টগবগ করছেন। বুকের মধ্যে জমা অফুরন্ত গল্প।

ঐ বৃদ্ধের দল মক্কায় হজ করতে গিয়েছিলেন। মক্কা-মদিনা ঘুরে প্রায় সাত—আটমাস বাদে আবার দেশে ফিরছেন—বাঁকুড়া জেলার এক গণ্ডগ্রামে। কী সরল বিস্ময়কর ওদের অভিজ্ঞতা। ঐ বারোজনের মধ্যে ন-জন আগে কলকাতা শহরই দেখেননি, নিজের গ্রাম ছাড়া শহর বলতে দেখেছেন বাঁকুড়া সদর, জমিজিরেত আর চাষবাসে কেটেছে সারাটা জীবন—বৃদ্ধবয়সে জীবনের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন তীর্থ দর্শনে। জীবনে প্রথম হাওড়া ব্রিজ দেখা, কলকাতা, তারপর বোম্বাই, তারপর জাহাজে সমুদ্র পেরিয়ে জেড্ডা বন্দর, মক্কা, সর্বতীর্থসার কাবাদর্শন, মদিনা—একসঙ্গে এতগুলো অভিজ্ঞতার বিহ্বলতা ওঁদের চোখে-মুখে। সারাটা জীবন একরকম কাটিয়ে গ্রামের ধুলো-কাদায়, অন্ধকারে কাটিয়ে হঠাৎ বাইরে সারা পৃথিবীর মাঝখানে এসে পড়ার চমক সত্যিই আন্দাজ করা শক্ত।

আমি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে ওঁদের অভিজ্ঞতার কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। কত টাকা লাগল? জাহাজ ভাড়া সাড়ে সাতশো টাকা! কিন্তু সব মিলিয়ে তিন হাজার টাকার মতন খরচ পড়েছে এক-একজনের। একজন গ্রাম্য চাষীর পক্ষে তিন হাজার টাকা খরচ করা কম কথা নয়। টাকা থাকলেও সবাই যেতে পারেনা—সরকারি হজ দপ্তরে আগে থেকে নাম লেখাতে হয় যাদের নাম আগে থাকে তারাই সুযোগ পায়। ওঁরা অনেকে জমিজায়গাও বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেছেন—বৃদ্ধ বয়েসে তীর্থযাত্রা, অচেনা দেশ আর সমুদ্রের পথ—পথে রোগশোকের সম্ভাবনা আছে। ফেরার ভরসা না-করেই বেরিয়েছিলেন—তীর্থের পথে কিংবা তীর্থস্থানে মৃত্যু—সে তো পরম পুণ্য। কিন্তু দলের কেউ মরেনি সবাই ঠিকঠাক বেঁচে আবার ফিরে এসেছে, এখন আবার দেখতে পাবে নিজের গ্রামখানি—এই এক অপ্রত্যাশিত আনন্দ।

ভারত সরকার প্রত্যেককে ৩০ কেজি চাল সঙ্গে করে নিতে দিয়েছে, দিয়ে দিয়েছে প্রতিষেধক ইঞ্জেকশান, মক্কায় ডাক্তার পাঠিয়েছে। মক্কায় লক্ষ-লক্ষ মানুষের ভিড়, সারা পৃথিবী থেকে এসেছে তারা, বাড়ি ভাড়া অগ্নিমূল্য, তাঁবুতে থেকেছে অনেকে, জলের সংকট, কুরবানির জন্য একেকটা ছাগলের দাম একশো—দেড়শো টাকা—কিন্তু এসব কষ্ট সহ্য না করলে তীর্থের ফল ফলবে কেন? মক্কায় খুব ভিড়—কিন্তু মদিনা—সে বড় দিব্য আনন্দের জায়গা। ওদের মুখ থেকে আমি শুনতে লাগলুম, মদিনায় কী শান্ত নিরালা ভাব, সেখানে গেলে মানুষের মন থেকে লোভ-হিংসা লোপ পায়—এমনকী ক্ষুধাতৃষ্ণাও কমে যায়। হজরত সাহেবের প্রিয় স্থান সেই মদিনা।

জিজ্ঞেস করলুম বড়মিঞা সেখানে গিয়ে কথাবার্তা বলতেন কী করে? আপনারা বাঙালিমুসলমান—আপনারা কী আরবি-ফার্সি জানেন?

মাথা নেড়ে বৃদ্ধ বললেন, না বাবুমশাই, ওসব আমরা জানিনা। বাংলা কথা জানি তাও লিখতে-পড়তে জানিনা। মুখ্যুসুখ্যু লোক আমাদের কালে কী আর এত পাঠশালা-মাদ্রাসা ছিল!

–তবে সেখানে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতেন কী করে?

—এই যে এই আঙুল দেখিয়ে। দোকানদার যদি দশটাকা দাম বলে তো দশটা আঙুল দেখায়—আমি বলি ছ-টাকার বেশি দেবনা আমি দেখাই ছ’আঙুল। বাংলাও বোঝে দু-চারজন।

-বাংলা বোঝে?

–হে’ সেই তো আশ্চর্যি! মাঝে-মাঝেই দু-একটা লোক বেশ দু’-চার কথা বাংলায় বলে! ফি বছরই তো যাচ্ছে আমাদের এই বাংলা দেশ থেকে অনেকে —শিখে নিয়েছে ওরা। একেকটা দোকানি আটটা-দশটা ভাষায় গড়গড়িয়ে বলে যায়—ইংলিশও জানে পর্যন্ত।

—অতদূর দেশে হঠাৎ বাংলা শুনে কেমন লেগেছিল?

–সত্যি কথা বলতে কী, নিজের দেশের কথা না-শুনে প্রাণটা জুড়োয়? ঐ আপনার বাংলা কথা আর যেদিন মাছ পেলাম—একটাকা-দেড়টাকা সেরের টাটকা মাছ—তখন যা আনন্দ হইছিল।

ছোট ছেলেটি জানলায় থুতনি রেখে সেই একদৃষ্টে চেয়ে আছে বাইরে। বছর নয়-দশ বয়েস, মিষ্টি মুখখানি। যে বৃদ্ধ আমার জন্য বসার জায়গা করে দিয়েছিলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলুম ঐটুকু ছেলেকেও আপনারা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন?

বৃদ্ধ সস্নেহ দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, উটি আমার নাতি। ওকে আর কোথায় রেখে যাব। ওর বাবা-মা মরেছে পিঠোপিঠি বছরে—আমি ছাড়া এ সংসারে ওর আর আপনজন নাই, ওরে আর কোথায় রেখে যাই কন্

তারপর আমার দিকে মুখটা এগিয়ে এনে গোপনকথা বলার ভঙ্গিতে বললেন ইচ্ছেটা কী ছিল জানেন? আর ফিরে আসবনা। আমার নাতি ঐ আলিজানকে আরো নিয়েছিলাম সেই জন্য। আমার তো দিন শেষ হয়ে এসেছে, শেষের দিনটা মক্কাতেই কাটিয়ে দেব। আমি মরলে আলিজানেরও তিনকূলে কেউ থাকবেনা ও ওখানেই থেকে যাবে।

—তাহলে ফিরে এলেন কেন?

— পারলামনা। সারাজীবনটা কাটল হেথায়—নতুন দেশে গিয়ে কী আর মন টেকে এখন? আলিজানও কান্নাকাটি করত। মনটা পোড়াত আমার। আমাদের এই দেশের নরম-নরম মাটি, গাছপালার কী সবুজ রং, মেঘ আসে আকাশ কালো করে—এসব ছাড়া আমাদের আর অন্যকিছুই ভালো লাগেনা। তাই মনে করলাম, তীর্থ করা তো হল, এবার মরব যখন তখন আমার হাড় ক’খানা বাংলা দেশের মাটিতেই যেন গোর পায়। নইলে মরার পরও শরীর জুড়োবেনা।

ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরের সবুজ রেখার দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ আবিষ্টভাবে বললেন, মক্কা-মদিনা দর্শন করে যত আনন্দ পেয়েছি, বাংলা দেশে ফিরে আসার আনন্দ তার চেয়ে কম নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *