আকাশ পাতাল – ১৪

১৪

বন্ধু আর বন্ধুপত্নী রেস্তরায় ঢুকতে যাচ্ছিলেন। আমার সঙ্গে মুখোমুখী দেখা। আরেঃ, কী খবর! কতদিন পর দেখা…এসো একসঙ্গে চা খাই!

চায়ের আগে অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য, পরে নানান কথাবার্তা। এতদিন অন্ধকারের পর রাস্তার ইলেকট্রিকের আলো এখন দ্বিগুণ উজ্জ্বল। বন্ধুপত্নী প্রশ্ন করলেন, পুজোয় কোথাও বাইরে যাচ্ছেন?

উত্তর দেবার বদলে আমি ইহুদীদের কায়দায় পাল্টা প্রশ্ন করি, আপনারা?

শরৎকালে সব মেয়েরাই সুন্দরী হয়ে ওঠে। পুজোর ঠিক আগের কয়েকটা দিন এত সুন্দরী মেয়ে যে কলকাতার রাস্তায় কোথা থেকে আসে ভেবে পাইনা। কলকাতা শহরের পথ আমার কোনদিন একটুও সুন্দর লাগেনি, অথচ এই সময়টা সারা শহর উজ্জ্বল, ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়ে হঠাৎ সুন্দরী হয়ে উঠে পথ আলো করছে। প্রত্যেকের মুখে অস্পষ্ট নীল ছায়া। চোখে চকচক করে কৌতুক। পথের যে-কোন নারীর দিকেই তাকিয়ে আমি তাঁকে ‘বিশ্বসুন্দরী’ আখ্যা দিয়ে বসি মনে-মনে। এই বন্ধুপত্নীকে আমি কোনদিন উল্লেখযোগ্য ভাবিনি, অথচ আজ ওঁকে এমন রূপসী দেখাচ্ছে যে, অনেকক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। তিনি অভূতপূর্ব মধুর হাস্যে বললেন, আগে ঠিক ছিল কাশ্মীর যাব…। কিন্তু, জব্বলপুর যাচ্ছি!

—জব্বলপুর! কোথায় থাকবেন?

–বাঃ, আপনি জানেননা, আমার ছোট ননদের বিয়ে হয়েছে ওখানে…

বন্ধু বললেন, তুই তো চিনতিস আমার বোন ললিতাকে?

আমি অস্পষ্ট স্বরে বললাম, হুঁ! ওর বিয়ে হয়ে গেছে জানতামনা!

–ওর স্বামী ওখানকার গান-শেল ফ্যাক্টরির বিরাট অফিসার। চমৎকার কোয়ার্টার আছে, খাবার-দাবার এখনো ভালো পাওয়া যায় শুনেছি। মাংস আড়াই টাকা কিলো, আর নর্মদার মাছ—

বাঃ চমৎকার! আমি তাহলে আজ চলি!

আপনিও চলুন না আমাদের সঙ্গে জব্বলপুরে। জ্যোৎস্নায় মার্বেল রক দেখবেন। ললিতা খুব খুশি হবে।

—নাঃ! গেলে খুব ভালো লাগত নিশ্চয়ই, কিন্তু আমার অন্য জায়গায় যাবার কথা আছে। দুমকায় আমার এক বন্ধুর কাছে। হরিণের মাংস খাওয়াবে বলেছে!

—হরিণের মাংস এমন কিছু সুখাদ্য নয়।

দুমকায় আমার কোন বন্ধু নেই। হরিণের মাংস খাবার ইচ্ছে আমার সারাজীবনে হয়নি। যে-প্রাণী দ্রুত দৌড়োয় তার মাংস খেতে ভালো হয়না জানি। কিন্তু মেয়েদের সামনে আমি অনায়াসে অভাবনীয় মিথ্যে চট করে বানিয়ে বলতে পারি। দেখলাম, জব্বলপুরের তুলনায় আমার দুমকা ও হরিণের মাংসের সম্ভাবনা খুব খারাপ হয়নি, ওঁদের দুজনের মুখই আলতোভাবে ঈর্ষাকাতর।

ছোট মাসিমার ছেলের অসুখ, তাই নিয়মরক্ষার জন্য দেখতে গিয়েছিলাম। বিয়ে কিংবা অসুখ না-থাকলে আত্মীয়স্বজনদের মুখ দেখার সুযোগ হয়না। নিমকি ভাজা ও চা খেতে-খেতে মাসিমার ছেলের রোগ বিষয়ে খুবই দুশ্চিন্তা দেখালাম। ওঁরা কিন্তু সবাই পরশুদিন গোপালপুর যাবার বিষয়ে আলোচনা করছেন। গোপালপুর-অন-সী। মাসিমা বললেন, তুইও আয় না আমাদের সঙ্গে! সমুদ্রের ওপরেই খুব বড় বাড়ি ভাড়া নিয়েছি, রান্না করার জন্য ঠাকুরকে নিয়ে যাচ্ছি —চল, তোরও হাওয়া বদল হয়ে যাবে!

—নাঃ, গোপালপুরে কী যাব! বাজে জায়গা—কিছু দেখার নেই! খালি সমুদ্র আর সমুদ্র আর আঁশটে গন্ধ!

—সে কিরে! গোপালপুর চমৎকার জায়গা, ভিড় হয় না! পমফ্রেট আর গলদা চিংড়ি মাছ যা পাওয়া যায়!

—না ছোটমাসি। আমি জব্বলপুর যাচ্ছি। ওখানে জ্যোৎস্নায় মার্বেল রক দেখা, তার তুলনা হয় নাকি!

—জব্বলপুর যাচ্ছিস? থাকবি কোথায়?

—আমার বন্ধু ওখানে গান-শেল ফ্যাক্টরির বড় অফিসার। চমৎকার কোয়ার্টার আছে—ওর স্ত্রীকেও আমি আগে থেকে চিনতাম—খুব করে যেতে লিখেছে, না গেলে…

তিনজন লেখকবন্ধু যাচ্ছেন কোনারক। রেলের একটা কী কনসেশন জোগাড় করেছে চারজনের—সুতরাং আর-একজন সঙ্গী খুঁজছেন তাঁরা। দুদিন ভুবনেশ্বরে থেকে কোনারকেই ওঁরা থাকবেন আরো পাঁচদিন। সকলেই অবিবাহিত! আমি বললুম, যত পাগলের কাণ্ড! কোনারকে কেউ থাকে নাকি? ওখানে লোকে সকালে দেখতে যায়, বিকালে ফিরে আসে। থাকার জায়গা পাবি কোথায়? ডাকবাংলোয় জায়গা পাওয়া যায়না, গভর্নমেন্টের একটা হোটেল আছে, তার একদিনের চার্জ পঁচিশ টাকা। আর কিচ্ছু নেই! মাঠে শুতে হবে, দেখিস।

—অত কাঁচা কাজ করি নাকি? ওখানকার মিউজিয়মে কাজ করে আমাদের বন্ধু অমুক। তার বাড়ি আছে। পুজোর সময় সে ফ্যামিলি নিয়ে কলকাতায় আসছে, তাকে আমাদের একজনের বাড়িতে থাকতে দেব। আর ওর ওখানে থাকব আমরা। ঐ সমস্ত বিখ্যাত মূর্তি বারবার দেখা হবে—সকাল, দুপুরবেলা, এমনকী রাত্তিরে, প্রত্যেকদিন—ভেবে দ্যাখ।

—না, ভাই, আমি যাচ্ছি গোপালপুর। সব ঠিকঠাক।

—গোপালপুর-অন-সী?

—হ্যাঁ! বাড়িভাড়া নেওয়া আছে। একা থাকব। তোমাদের ঐসব পাথরের মূর্তি সারাদিন দেখা আমার সহ্য হবেনা। আমি গোপালপুরে সারাদিন সমুদ্রে গা ডুবিয়ে পড়ে থাকব—পমফ্রেট আর চিংড়িমাছ খুব সস্তা—

কিন্তু কোনারকের পরিকল্পনাই আমার বেশি পছন্দ হল। না গিয়েই আমি কল্পনায় নিজেকে দেখতে পেলাম কোনারকের ভগ্ন মন্দিরের সামনে দাঁড়ানো, একজোড়া নরনারীর মূর্তির দিকে চেয়ে আছি। রাত্তিবেলা আবছা অন্ধকারে আমি যেন ঘুরছি মন্দিরের চত্বরে।…বাসে দেখা হল চন্দ্রনাথবাবুর সঙ্গে, পুজোর বাজার সেরে সপরিবারে ফিরছেন। আমাকে দেখে বললেন, কী হে, তুমি তো সেই বইটা নিতে আর এলে না? আমি তো আবার কালকেই চলে যাচ্ছি—

—কোথায়?

—মধুপুর। বাড়িসুদ্ধ সব। একমাস থাকব।

আমি মুখে একটা সূক্ষ্ম ব্যাঙ্গের হাসি ফুটিয়ে বললুম, মধুপুর! ওঃ!—চন্দ্রনাথবাবুর দুই মেয়ে মণিমালা আর রত্নাও বাবার সঙ্গে রয়েছে—আমি ওদের দিকেই চোখ ফেলে ওরকমভাবে মধুপুর কথাটা উচ্চারণ করি। অর্থাৎ আমার মুখে ফুটে ওঠে, ওঃ, মধুপুর, সেই কলকাতার ভিড়, সেই চেনা মুখ, যেখানেই যাও ঘুরে-ফিরে স্টেশনের কাছে হাজির হওয়া, দুধের সর পড়া চা-ওখানে আবার মানুষে যায়!

—তুমি কোথাও যাচ্ছ নাকি!

—হ্যাঁ, কোনারক।

-কোনারক? থাকার জায়গা আছে?

—হ্যাঁ। বন্ধুর বাড়ি আছে—টানা সাতদিন থাকব—মন্দিরটা খুব ভালো করে দেখব এবার, প্রত্যেকটা মূর্তি দেখে-দেখে নোট করে আনার ইচ্ছে আছে!

চন্দ্রনাথবাবু একজন শিল্পবিশারদ। কিন্তু মেয়েদের সামনে কোনারক বিষয়ে আর আলোচনা করতে চাইলেননা। শুধু বললেন, ইন্টারেস্টিং! আচ্ছা, ফিরে এসে দেখা ক’রো। শুনব!

বাস থেকে নেমে বাড়ির গলিটা অন্ধকার। কেউ নিশ্চয়ই বাল্ব চুরি করেছে। ঐটুকু পথ হাঁটতে-হাঁটতে আমি চকিতে বহু জাগয়া ঘুরে এলাম। হরিণভরা দুমকার জঙ্গল। জব্বলপুরের মার্বেল পাহাড়ে জ্যোৎস্না। গোপালপুরের সমুদ্র—রাত্রে ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাস জ্বলে। কোনারকের বিস্ময়কর মন্দির। এমনকী মধুপুরের লাল রাস্তায়ও একপলক হেঁটে এলাম।

আমি কোথাও যাবনা। আমি এই গলিতেই থাকব।

আমিও চলে গেলে, কলকাতা ছেড়ে যারা গেলনা, সেই সব সাময়িক বিশ্বসুন্দরীদের রূপের তারিফ করবে কে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *