আকাশ পাতাল – ১২

১২

মানুষের মধ্যে আমি মাংসাশী শ্রেণীভুক্ত। চোয়ালের দু’ ধারের দিকে যে চ্যাপ্টা, চেরা জোরালো দাঁতগুলি থাকে—আমার সেগুলি অটুট। এবং বারট্রাণ্ড রাসেলের মতে মানুষের এই মাংস-ছেঁড়া কুকুরদাঁতগুলি ক্রমশই নাকি শক্ত ও দীর্ঘ হয়ে উঠছে।

যখনই কলকাতা ছেড়ে তিন-চারজনে মিলে বেড়াতে যাই, স্টেশনে নেমে মালপত্র রাখতে-না-রাখতে খোঁজ শুরু হয়ে যায়, এখানে মুরগি পাওয়া যায় তো? দামে সস্তা তো? বাড়িঘর তুচ্ছ, আকাশে মেঘ জমেছে না ফটফট করছে নীল রং কোন বিখ্যাত ঝর্না আছে না দেবমন্দির—এসবকিছুতেই কিছু যায় আসেনা, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, মুরগি আছে তো? মুরগি? আমার এক সমুদ্র-পাগল বন্ধু কোনদিন আর দীঘায় যাবেননা বলেছেন, কারণ সেখানে মুরগি পাওয়া যায়না। বিশাল সমুদ্রও মুরগির তুলনায় কিচ্ছু না! বরং তিনি খানাডোবার পাশে বসেও মুরগি পেয়েও তৃপ্ত। চম্পাহাটিতে আমাদের এক বন্ধু বাড়ি তৈরি করেছেন, একদিন আমাদের বললেন, চল না আমার নতুন বাড়িতে একদিন বেড়িয়ে আসবি, সারাদিন, থাকবি, বেশ চমৎকার। সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের সমস্বরে প্রশ্ন, মুরগি পাওয়া যায় তো?

কলকাতা শহরে থেকে যে-যুবা কোনদিন বাজার করতে যায়নি সেও রাঁচী—দেওঘর-মধুপুরে বেড়াতে গিয়ে প্রত্যেক সকালে বাজারে ছুটে যায়। বাজারের বাহিরের দিকে বসা সারি-সারি মুরগিওলা, সাদা-কালো-হলুদছিটে জ্যান্ত পাখিগুলো পা-বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে মুখ থুবড়ে, ডানা ধরে হিঁচড়ে এক-একটাকে তুলে মনে-মনে ওজনটা বুঝে নেবার চেষ্টা, পেটের দিকের ছোট পালকগুলো ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দেখে নেওয়া যে চর্বি ঠিক মতো আছে কিনা। তারপর দরদাম, কথা বলার সময় হাতের দামি সিগারেট পুড়ে যাচ্ছে একটার পর একটা, কিন্তু সামান্য চারআনা দাম কমাতে পারলেও অভূতপূর্ব আনন্দ!

বছর সাতেক আগে, আমরা চারজন মধুপুর স্টেশনে পা দিয়েছি সকাল এগারোটা আন্দাজ। সারা ট্রেনে হৈ-হল্লা করতে-করতে এসেছি, মাথার ওপর গনগন করছে রোদ, খিদে পেয়েছে সমান পাল্লায়। এক বন্ধুর বাড়ি ছিল মধুপুরে, সেই বাড়ির মালি এসেছে স্টেশনে, প্রথমেই খবর দিল যে আমাদের জন্য রান্না তৈরি। ছুটোছুটি করে স্নান সেরে আমরা খাবার টেবিলে বসেছি তরকারিফরকারি কীসব ছিল—কিন্তু কে সেকথা মনে রাখে? এছাড়া ছিল উত্তম বড় জাতের চিংড়ি ও কনুই-ডোবা বড়-বড় জামবাটিতে উত্তম খাসির মাংস। সে তো খাওয়া নয়—যেন ব্যালে নাচ, চারজনের হাত সমান-সমান তালে উঠছে-নামছে, কড়মড় শব্দ, তাল রাখার জন্য মাঝে-মাঝে অট্টহাস্য। তখনো খাওয়া শেষ হয়নি, এমন সময় বাগানের গেট ঠেলে দুজন সাঁওতাল স্ত্রীলোক। ওরা খবর পেয়েছে যে, এ বাড়িতে বাবুরা এসেছে, বাবুদের কাছে ওরা মুরগি বিক্রি করতে এসেছে।

মুরগি! মুরগি! এঁটো হাতে আমরা ছুটে এলাম বাইরে—টেবিলে খাসির মাংস ফেলে রেখে। কই দেখাও মুরগি, ক’টা আছে, দাম কত? গুটিকতক দেশি মুরগি, রোগা, করুণ, জলে-ডোবা মানুষের মতো চোখ। পায়ে দড়ি বেঁধে সাঁওতাল মেয়েদুটি ওদের কাঁধে ঝুলিয়ে এনেছে, এবার মাটিতে নামিয়ে রাখল। সবশুদ্ধ পাঁচটা, তার মধ্যে চারটেই সমান ছোট—প্রায় হাতের মুঠোর সাইজ; আর একটা একটু বড়ো তেজি, অহংকারী ঘাড়। এক বন্ধু বললেন, এঃ! এত ছোট-ছোট —এগুলো কী খাব—এ তো এক-এক গ্রাসে! অপরবন্ধু মুখ ফিরিয়ে বললেন ইংরাজিতে (যাতে বিক্রেতারা না-বুঝতে পারে) না, না, এই দেশি মুরগিরই স্বাদ ভালো—লেগহন, রোড আয়ল্যাণ্ডের চেয়ে এগুলো অনেক বেশি টেস্টফুল। সাঁওতাল মেয়েদুটো কী বুঝল কে জানে, সারা শরীরময় হাসি জাগিয়ে পিজিন বাংলায় যা বলল, তার ভাবার্থ, এই কুঁকড়োগুলো দেখতে ছোট হলেও ওজনে ভারী। দেখতে খারাপ কিন্তু কাজে ঠিক!— এই বলে হাত দিয়ে ঠোনা মারল সেই পিট-পিট করে চেয়ে-থাকা কৃষ্ণের জীবগুলিকে। সেগুলো কক্-ক্-কক্ করে উঠল। আমাদের এক বন্ধু সেদিকে তাকিয়ে মুখে ঝোল টানার মতো শব্দে বললেন, আঃ! এগুলোকে আজরাত্রে আমি নিজের হাতে রোস্ট করব। দেখবি, আমার রান্না একবার খেলে জীবনে আর ভুলতে পারবিনা।

তখনো আমাদের এঁটো হাত, এবেলার খাওয়া শেষ হয়নি। আমরা সাঁওতাল মেয়েদুটিকে অবলীলাক্রমে ঠকিয়ে চমকপ্রদ সস্তায় মুরগিগুলো কিনে কয়লা রাখার ঘরে রেখে দিলাম। তারপর খাওয়া শেষ করে ডুবে গেলাম তাস খেলায়।

সূর্য ডুবে যাবার পরও আকাশে আলো ছিল, বাগানে চেয়ার পেতে আমরা বসে চা খাচ্ছি। মধুপুর জায়গাটার একটা সবচেয়ে বড় গুণ এই যে—কোন দর্শনীয় স্থান নেই সেখানে। কোন প্রাচীন মন্দির কিংবা ছোট পাহাড় নেই কাছাকাছি—তাহলে আমরা সেগুলো দেখতে যেতে বাধ্য হতাম। কোথাও বেড়াতে গেলে এইসব দেখতে যাওয়াই নিয়ম, না-যাওয়া পর্যন্ত সারাক্ষণ অস্বস্তি থাকে—একমাত্র মধুপুরেই শুধু বাগানে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকলে কোন আত্মগ্লানি আসেনা। একমাত্র অসুবিধে, ওখানকার আকাশটা বড্ড বড়, বিকটরকমের বিশাল—তার নিচে খুব ছোট হয়ে বসে থাকতে হয়।

অন্ধকার নামতেই, আমাদের রন্ধনবিদ বন্ধু বললেন, এবার মুরগিগুলো কাটা যাক। ছুরি নিয়ে আয়।

আমি বাড়ি থেকে দুটো বড়ো চকচকে ছুরি নিয়ে এলাম। একটা তাকে দিয়ে আর-একটা নিজের হাতে। কয়লাঘর থেকে মুরগীগুলো বার করে ঝুলিয়ে এনে ছুঁড়ে দিলাম মাটিতে! তারপর একটার পায়ের দড়ি কেটে দিলাম। বন্ধু বললেন, সাবধান, দেখিস পালায় না যেন। আমি বললুম, না, না, তোকে অত সর্দারি করতে হবেনা! কিন্তু যা ভুল করার আমি করে ফেলেছি। বন্ধু চেঁচিয়ে ধমকে উঠলেন, এই নীলে, তুই কীরকম উল্লুকের মতো কাজ করলি দেখ তো? আমি বুঝতেই পারিনি, একটা দড়ি দিয়েই পাকিয়ে-পাকিয়ে সবগুলোকে বাঁধা ছিল, দড়ি কাটতেই সবগুলো একসঙ্গে ছাড়া পেয়েছে। তিনটেকে তক্ষুনি খপ্‌খপ করে ধরে ফেলা হল, বাকি দুটো একটু দূরে গিয়ে ডানা ঝাপটাতে লাগল। অবিকল মেয়েদের চুল ঝাপটা দেওয়ার ভঙ্গি ওদেরও। লঘু পায়ে তির-তির করে ঘুরতে লাগল সেই বড়টা আর সবচেয়ে ছোটটা। আমরা গুটি মেরে এগিয়ে ওদের ধরার চেষ্টা করতেই কক্কক্ করে উড়ে একটু দূরে চলে গেল। আমাদের দলপতি বললেন, দাঁড়া পালাবি কোথায়, এক্ষুণি তোদের জান নিয়ে নেব। এই, বাগানের গেট বন্ধ কর, টর্চ নিয়ে আয়!

তারপর শুরু হল আমাদের অভিযান। বুক সমান উঁচু দেয়ালঘেরা বাগান তার মধ্যে আমরা চারজন যুবা, হাতে টর্চ ও ছুরি, যেন একটি দস্যুদল—তাড়া করতে লাগলাম সেই দুটো মুরগিকে। মুখে আমাদের হা-হা চিৎকার, টর্চের আলোয় ঝলসে উঠছে ছুরি, আমাদের ছুটোছুটি সারা বাগান জুড়ে, কিছুতেই ওদের ধরতে পারিনা। চারজনে চারদিকে দাঁড়িয়ে, মাঝখানে ওরা দুজন নিরস্ত্র, আমরা আস্তে—আস্তে গোল করে ওদের দিকে এগিয়ে যাই, সাবধানে, আমাদের হাতের মুঠো খোলা, ঠিক ঝাঁপিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে ওরা পরস্পর চোখের ইশারা করে নিয়ে উড়াল দেয়, আমাদের মাথা ছাড়িয়ে চলে যায় অন্যদিকে। ওরা দুজনে ছিটকে যায় দুদিকে, আবার ওরা কাছাকাছি চলে আসে, হিলতোলা জুতো পায়ে হাঁটার ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক যায়, অন্যপাশে বাঁধা বাকি তিনটে মুরগি চিৎকার করে বোধহয় ওদের সাবধান করে দেয়।

আধঘণ্টা ছুটেও ধরতে পারিনা, আমাদের তখন রক্তচক্ষু মাথায় খুন চেপে গেছে। একবার ছোট মুরগিটা একটু কাছাকাছি আসতে একজন সারা শরীর নিয়ে সটান ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। মুরগিটা ওর দেহের ভারে চেপটে গিয়ে মারা পড়লো তখুনি। আমরা উল্লাসে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলাম। বড়টা তখনো অকুতোভয়, ঘাড় উঁচিয়ে আমাদের খেলাতে লাগল। সে একবার সটান উড়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে, যেন চোখ খুবলে নেবে—কিন্তু মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। আমাদের দলপতির মুখ তখন ভয়ংকর হিংস্র, মুরগিটার দিকে দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে ছুরি তুলে কর্কশ স্বরে বলল, আজ তোরই একদিন কী আমারই একদিন! তারপর ছুরিটা টিপ করে ছুঁড়ে মারল ওর দিকে। সোজা লাগল গিয়ে সেই উঁচু—করা গলায়, মুরগিটা মাত্র দু-তিনবার ছটফট করেছিল। আমাদের বিজয় সম্পূর্ণ হল।

সেই রাত্রে একবন্ধু খাবার সময় বমি করে ফেলে। তারপর থেকে সে আর মাংস খায়না। আমি অবশ্য মাংস ছাড়িনি, মাংস আমার প্রিয় খাদ্য, মুরগি তার মধ্যে পরম প্রিয়। কারণ, এই মাংস আমার ভালো লাগে—আর যা ভালো লাগে, তা পাবার জন্য এরকম ছোটখাটো চক্ষুলজ্জা থাকলে চলেনা।

খেতে ভালো লাগে, এইটাই আমার নিজস্ব যুক্তি। এছাড়া, সভ্যতা আমাকে আরো যুক্তি শিখিয়েছে। প্রোটিন! মুরগির মাংসে যে প্রোটিন আছে, তা আমাদের শরীরের পক্ষে খুবই জরুরি! এমন অনেক রুগী আছে, মুরগির জুস খাওয়াতে না-পারলে তাদের বাঁচানোই নাকি মুস্কিল। একটা কথা আমার এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, মুরগিদেরও তো খুব অসুখ করে! মানবশিশুর পক্ষে গরম দুধ না হলে চলেই না, অথচ গরুর বাচ্চারা দুধ না-খেয়ে কী করে বেঁচে থাকে, কে জানে! আমাদের যুক্তি আছে, পশুদের যুক্তি নেই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *