আকাশ পাতাল – ২

মাতাল জমিদারের আদর্শবাদী ছেলে সেজেছে টুটু। বাগ্দীপাড়ায় কলেরার মড়ক লেগেছে, সেখানে রাত জেগে সেবা করতে যাবার আগে বাবার সামনে এক ভাবগর্ভ বক্তৃতা দিচ্ছে। ছেলেবেলা থেকেই টুটু একটু বোকা-বোকা, ঐরকম বোকা-বোকা মুখ-চোখ বলে সিনেমায় আদর্শবাদীর ভূমিকা বেশ মানায়। সবুজ পাঞ্জাবি পরে টুটু অনবরত ঘামছে, মাঝে-মাঝে কাট করে মেক-আপ ম্যানেরা এসে তার মুখের মেক-আপ ঠিক করে দিচ্ছে। পাড়াগাঁর জমিদার বাড়ির বাগানের সেট, কিন্তু ঝোপের আড়ালে টেবল্ ফ্যান ফিট করা। তবুও অসম্ভব গরম।

সুটিং দেখতে আমার একেবারে ভালো লাগেনা। একঘেয়ে ব্যাপার, দু—তিনটেমাত্র কথা তুলতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, লাইট্সম্যানরা আলো নিয়ে টালবাহানা করে অনবরত। কিন্তু আসতে হয়েছে মামাতো বোনেদের পাল্লায় পড়ে। মামাতো বোনেরা আগে আমাকে বিশেষ পাত্তাই দিতনা, হঠাৎ কোথা থেকে জানতে পেরে গেল, বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় অমুক কুমার ছেলেবেলায় আমার সঙ্গে ইস্কুলে একক্লাসে পড়ত। ব্যস, সেই থেকে মিলিতা আর নন্দিতার চোখে আমিও একটা ছোটখাটো হিরো।

ওদের পীড়াপীড়িতে এবং আমি যে সত্যিই অমুক কুমারকে চিনি এটা প্ৰমাণ করার জন্য টুটুকে একদিন ফোন করতেই হল শুটিং দেখার জন্য। টুটু আমার মান রেখেছে, উৎসাহের সঙ্গেই রাজি হয়েছে! কিন্তু অত্যন্ত বিচ্ছিরি সিনে সুটিং দেখতে এসেচি; শুধু বক্তৃতা আর বক্তৃতা। মামাতো বোনরা খুশি—একে তো টুটু অর্থাৎ অমুক কুমার রয়েছেই, তার সঙ্গে মাতাল জমিদার হিসেবে বিকাশ রায়। শুনলাম বাগ্দীর মেয়ে সেজেছে মাধবী মুখার্জি-আমার ভালো লাগত সেই সুটিং দেখলে।

সেদিনকার মতন টেক শেষ বলে, ধরাচূড়া ছেড়ে টুটু এল আমাদের সঙ্গে গল্প করতে। ইন্দ্রপুরী স্টুডিওর বাইরের মাঠে এসে বসলাম পা ছড়িয়ে। কিছুক্ষণ আমার মামাতো বোনদের গদগদ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে টুটু আমার দিকে ফিরে বললো, কিরে, কী করছিস আজকাল! তোর তো পাত্তাই পাওয়া যায়না!

সেদিনকার সেই বোকা টুটু, সিনেমার নায়ক হয়ে কী চালিয়াৎই হয়েছে। রংটা ফর্সা ছিল, চেহারাটা ছিল কার্তিক-কার্তিক, তাই এক পরিচালকের নজরে পড়ে যায়! শুনছি, শিগগিরই বোম্বে পাড়ি দেবে। আমি বললুম কিরে, খুব তো পিটছিস! টুটু উত্তর দিল, শুধু টাকাটাই দেখছিস, কত খাটতে হয় তা তো জানিসনা! টাকাও হাত থাকেনা—এ মাসেই তো ছোট ভাইকে একটা গাড়ি কিনে দিতে হল!

একটা প্রশ্ন অনেকক্ষণ থেকে আমার মনে ঘুরঘুর করছিল। আমি টুটুর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছিলুম। টুটু বলল, কিরে হাসছিস কেন? আমি মামাতো বোনদের দিকে তাকিয়ে বললুম, এই তোমরা একটু ওদিকে যাও তো—বিকাশ রায় কিংবা অন্যদের অটোগ্রাফ নিয়ে এসো। আমি টুটুর সঙ্গে একটু প্রাইভেট কথা বলব!

তালুতে থুতনি রেখে ঘাসের ওপর কনুই ভর দিয়ে আধ-শোওয়া হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলুম, হ্যাঁরে টুটু, তোর মনীষার কথা মনে পড়ে?

এখনো মেক-আপ ওঠায়নি, কৃত্তিম উজ্জ্বল মুখ টুটুর, অবিচলিতভাবে জিজ্ঞেস করল কোন মনীষা? টাইটল কী? আজকাল নিত্যনতুন এত মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে, সবার নাম মনে রাখা—

—বেশি চালাকি করবি তো পেছনে ক্যাৎ করে এক লাথি মারব! মনীষাকে তোর মনে নেই? সেই চন্দননগরের—

কথা শেষ হলনা। আরেকঝাঁক ছেলেমেয়ে এসে টুটুর সামনে অটোগ্রাফের খাতা খুলে ধরল। টুটু মুখে নায়কোচিত হাসি ফুটিয়ে সবার খাতাতেই স‍ই করল। তারপর তারা চলে যেতেই প্রোডাকশান ম্যানেজারকে ডেকে গরমভাবে বলল, দ্বিজেনবাবু আপনাকে বলেছি না, স্টুডিওর মধ্যে আমি কোন অটোগ্রাফ স‍ই করবনা! তবু এদের আসতে দেন কেন?

আমি বললুম টুটু, তুই এখনো বিয়ে করিসনি, নারে?

না ভাই! এত মেয়ে সবসময় ছেঁকে ধরে আছে—এদের মধ্যে থেকে কাকে বিয়ে করব ভেবে পাইনা। তাছাড়া, যতদিন বিয়ে না-করছি ততদিন মেয়েমহলে ইমেজ…যাগে, নীতীশ কেমন আছে? অনেকদিন দেখা হয়না পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে…তুইও তো—

মনীষাকে তোর মনে নেই বলতে চাস?

টুটু হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, কেন মনে থাকবে? যা-তা একখানা মেয়ে…গাল তোবড়ানো, পুরু ঠোঁট…ওসব মেয়ে এ-লাইনে একস্ট্রার পার্টও পায়না!

আমি সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাসতে লাগলুম। এখনো বেশ রাগ আছে দেখছি! টুটু অন্যমনস্কভাবে মাটি থেকে ঘাস টেনে-টেনে ছিঁড়তে লাগল।

টুটুর সঙ্গে অনেকদিন বাদে আজ দেখা হওয়ার পর, মনীষার কথা আমার বারবার মনে হচ্ছিল। নীতিশের বোন মনীষা, একসময় তাকে বিয়ে করার জন্য টুটু পাগল হয়ে উঠেছিল। সত্যিই দেখতে তেমন সুন্দরী ছিলনা মনীষা, কিন্তু পড়াশুনোয় খুব ভালো ছিল, রুচি ও ব্যক্তিত্ব ছিল স্পষ্ট। নীতিশদের বাড়িতে সন্ধেবেলা আমরা আড্ডা মারতে যেতুম, মনীষা আর তার দিদি রুচিরাও এসে যোগ দিত আমাদের সঙ্গে। রুচিরা আবার কম্যুনিষ্ট পার্টিতে নাম লিখিয়েছিল, প্রায়ই সাহিত্য আর রাজনীতি নিয়ে খুব তর্ক বাঁধত। একবার আমরা সবাই মিলে রিহার্সাল দিয়ে ওখানে একটা থিয়েটারও করেছিলাম, তাতে আমিও একটা মাঝারি ধরনের পার্ট পেয়েছিলাম, কিন্তু অতিরিক্ত লাজুক বলে টুটু পেয়েছিল এক সিনের প্রতিনায়কের বন্ধুর পার্ট।

মনীষা টুটুকে নিয়ে খুব ঠাট্টা-ইয়ারকি করত, ঝকঝকে চোখা চোখা কথা বলতে পারত মনীষা, টুটু খুব সরল আর লাজুক ছিল বলে কোনটারই ঠিক সময় উত্তর দিতে পারতনা শুধু ফর্সা চেহারায় লজ্জায় লাল হতো। দুর্বল আর অসহায়দের আঘাত করতেই তো মেয়েদের আনন্দ, টুটুকে আঘাত দেওয়ার ব্যাপারে মনীষার কোন ক্লান্তি ছিলনা। হয়তো রাজনীতি নিয়ে তর্ক হচ্ছে, টুটু যদি কখনো একটা কথাও বলত—মনীষা অমনি ধমকে উঠত, আপনি চুপ করুন। যে বিষয়ে কিছুই জানেননা—সে বিষয়ে কথা বলতে আসেন কেন? টুটুর পোশাক আর চেহারা নিয়েও ঠাট্টা করতে ছাড়তনা, দেখা হলেই বলত, কী, মেয়েদের মতন চোখে কাজল দিয়েছেন বুঝি? না সুর্মা?…এঃ, আপনার গা দিয়ে কী বিশ্রী গন্ধ বেরুচ্ছে! সেন্ট মেখেছেন বুঝি? কিংবা চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, কোনদিন কোন কাজকর্ম করেননা, শুধু দিনরাত আলস্য…। সবচেয়ে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছিল মনীষা—যেবার আমাদের বি.এ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলো। আমরা সবাই কোনক্রমে পাশ করে গেলুম, টুটু পারলনা–সেজন্য আমরা সবাই দুঃখিত, একমাত্র মনীষাই হেসে উঠে বলেছিল, জানতাম। আমি আগেই জানতাম।

সেই মনীষার প্রেমে পড়ে টুটু একেবারে হাবুডুবু খেয়েছিল। মনীষাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠল, আমাদের সাহায্য নিল, কাকাকেও পাঠাল মনীষাদের বাড়িতে, তার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। টুটুর তখনকার পাগলামি আমাদের সকলের কাছেই ছিল পরম উপভোগ্য ব্যাপার। টুটুর সঙ্গে দেখা হলেই আমরা বলতাম, টুটু মনীষা একটু-একটু এবার রাজি হয়েছে বোধহয়, কাল তোর কথা বলছিল, তুই চারদিন যাসনি ওদের বাড়িতে…খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে! টুটু উদ্ভাসিত মুখে বলত, তাই নাকি? সত্যি?

কথা নেই বার্তা নেই, দুমাসের মধ্যে দুম করে মনীষা বিয়ে করে ফেলল দীপঙ্করকে। দীপঙ্করের রোগা চেহারা, ধারালো নাক, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে ডিবেট করার খুব নাম ছিল। ঐ একটাই গুণ ছিল দীপঙ্করের—ধারালো কথা বলা! পৃথিবীর স্বকিছু নস্যাৎ করে দিতে পারত সে যুক্তিজালে। কারুকে কিছু না—জানিয়ে ওরা রেজিস্ট্রি বিয়ে করে ফেলল, তারপর দীপঙ্কর মনীষাকে নিয়ে চলে গেল বহরমপুরে এক কলেজে অধ্যাপনার চাকরি পেয়ে।

একদিন টুটুর ঘরে গিয়ে দেখলাম ঘরের দেওয়ালে লাল পেন্সিলে অসংখ্য দাগ কাটা। টুটু বলেছিল, আমি রোজ দেওয়ালে দাগ কাটি, একশো সতেরো দিন হয়ে গেল—মনীষাকে আমি আজও একটুও ভুলতে পারছিনা।

অন্যমনস্কভাবে ঘাস ছিঁড়ছে টুটু। সেদিন কেউ ভাবতেও পারেনি, আমাদের চন্দননগরের সেই টুটু হঠাৎ ফিল্মস্টার হয়ে যাবে—তার জন্য বাংলা দেশের হাজার —হাজার মেয়ে ব্যাকুল হবে—খোলামকুচির মতন টাকা নিয়ে খেলবে। টুটু এখন আর সেই বোকা ভালোমানুষটি নেই, এখন সে ক্যামেরাম্যান আর প্রোডাকশন ম্যানেজারদের ধমকায়, সাদা টাকা—কালো টাকার হিসেব ঠিক রাখে, প্রচারের কায়দা সম্পর্কে উপদেশ দেয়, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিত্যনতুন রকমের হাসি প্র্যাকটিস করে। অভাবিতভাবে অনেক কিছু পেয়েছে টুটু কিন্তু মনীষার মতো একটা সামান্য মেয়ের কাছে হেরে গেছে। আজ কত মনীষাকে সামান্য ইঙ্গিত করলেই…কিন্তু প্রথম যৌবনের সেই একজন তাকে অবহেলাই করেছে শুধু।

আর মনীষা? দীপঙ্কর বোধহয় চার-পাঁচশো টাকা মাইনে পায় ডিবেট কিংবা রাজনীতিও করেনা—সেই তেজি ছোকরাও সে আর নেই এখন, বোধহয় অতিরিক্ত একশো-দুশো টাকা আয়ের জন্য নোট লেখে কিংবা কোচিং ক্লাস নেয়। দুটি ছেলেমেয়ে ওদের!

টুটুকে জিজ্ঞেস করলাম, মনীষার সঙ্গে তোর আর দেখা হয়েছে?

—নাঃ, বহরমপুরের দিকে গিয়েছিলাম একমাত্র সুটিং-এ— গত বছর, একবার ভেবেছিলাম ও হয়তো আমার সঙ্গে এসে দেখা করবে—অন্তত ভাইপো-ভাইঝির জন্যে অটোগ্রাফ নেবার নাম করেও, অনেকেই তাই আসে।

মনীষা তোর অটোগ্রাফ নেবে? তুই তো ঝুড়িখানেক চিঠি লিখেছিলি তাতেই তো তোর সই…

—এখন আমার সই বদলে ফেলেছি। তাছাড়া মনীষা কী আর সেসব চিঠি রেখে দিয়েছে নাকি?

আমি আবার হাসলাম। টুটুকে আঘাত দিতে আমার ইচ্ছে হলনা। টুটুর হয়তো কিছু যায় আসে না ও অনেককিছুই পেয়েছে এখন—তবু মনীষার কথা ওকে আমার বলতে ইচ্ছে করলনা।

মনীষার সঙ্গে মাস ছয়েক আগেই আমার দেখা হয়েছিল। কলকাতায় বেড়াতে এসেছিল ওরা, আমার সঙ্গে ধর্মতলায় দেখা। চৌরঙ্গী দিয়ে দীপঙ্কর আর মনীষার সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে আমি একটা সিনেমা পোস্টারে টুটুর ছবি দেখিয়ে মনীষাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী চিনতে পারো?

মনীষা ভ্রুভঙ্গি করে বলেছিল না চিনে উপায় আছে। আজকাল তো যেদিকে তাকাই সেদিকেই ঐ ছবি। বাংলা হিন্দি—

–তুমি ওর বই-টই দেখেছ?

–না, একটাও দেখিনি, এবার একটা দেখে ফেলব ভাবছি। সিনেমা তো আমার দেখাই হয়না।

সিগারেটের দোকান দেখে দীপঙ্কর এগিয়ে যেতেই মনীষাকে চুপিচুপি বললুম, কী আজকাল একটু-একটু আপশোশ হয়না?

লঘুভঙ্গিতে ঝরঝর করে হেসে মনীষা বলল, একটু কেন, ভীষণ-ভীষণ আপশোশ হয়! ছবিটা দেখুন, আগে তবু একটু বোকা ভালো মানুষ চেহারা ছিল, এখন কীরকম ন্যাকার মতন দেখাচ্ছে! উঃ পুরুষ মানুষ হয়েও কেউ এত ন্যাকা সাজতে পারে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *