অমর প্রেম – ৯

নয়

একদিন বিকেলে ইউসুফ যখন বেরোচ্ছিল তখন নূরজাহান বেগম বললেন, তুই কী জুলায়খাকে পড়াতে যাচ্ছিস?

হ্যাঁ আম্মু। কেন? কিছু বলবে?

ওর মাকে বলিস, আমরা কাল আসব।

ঠিক আছে, বলব বলে ইউসুফ জুলায়খাদের বাসায় যাওয়ার জন্য বেরিয়ে এল। পড়ানো হয়ে যেতে ফেরার সময় বলল, কাল আমি আসব না।

জুলায়খা বলল, কেন? কোনো কাজ আছে বুঝি?

না, কোনো কাজ নেই। কয়েকদিন হল বড় চাচা ও দাদিআম্মা এসেছেন। আব্ব আম্মু তাদেরকে নিয়ে আমার আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে কাল আলাপ করতে আসবেন। তুমি কথাটা বাসায় জানিয়ে দিও। তারপর বিদায় নিয়ে চলে এল।

জুলায়খা দাদিআম্মার কাছে গিয়ে ইউসুফ যা বলতে বলেছিল বলল।

আসিয়া বিবি নাতনির মুখে এই ক’দিন হাসি দেখেন নি। কারণটাও জানেন। বললেন, মন খারাপ করছ কেন দাদু? আমি জাফরকে বলেছি, বিয়ে করে ইউসুফ যেন তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যায় সেই ব্যবস্থা করতে।

জুলায়খা দাদিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ও মাই গ্রেট গ্র্যান্ড মাদার! ইউর কমপেয়ার ইজ নান।

আরে দাদু ছাড়, ব্যথা পাচ্ছি তো।

জুলায়খা ছেড়ে দিয়ে বলল, সরি দাদিআম্মা, এক্সট্রিমলী সরি। প্লীজ, ইক্সকিউজ মী।

ইংরেজিতে কি সব বলছ কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

জুলায়খা বলল, সরি দাদিআম্মা। ধূৎ আবার ইংরেজি বলে ফেললাম। মানে, আপনাকে ব্যথা দেওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মাফ চাইলাম।

বলি বিয়ের কথা শুনেই যদি এরকম কর, বিয়ের পর কি করবে কি জানি।

যাই করি না কেন, তোমাকে ব্যথা দেব না বলে হেসে উঠে জুলায়খা ছুটে পালিয়ে গেল।

পরের দিন জুলায়খাকে ও তার কথাবার্তা শুনে ইলিয়াস সাহেব খুব অবাক হয়ে ভাবলেন, এই জামানায়ও তা হলে এত ভালো মেয়ে আছে। মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, সত্যি আম্মা, আপনার কথা ঠিক। এ রকম মেয়ে কখনও দেখি নি।

আপ্যায়নের পর আসিয়া বিবি ও হামিদা বেগম পর্দার সঙ্গে এসে সালাম দিয়ে নূরজাহান বেগমের পাশে বসলেন।

নূরজাহান বেগম সালামের উত্তর দিয়ে ইউসুফের আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার কথা বলে বললেন, আপনাদের কিছু বলার থাকলে বলুন।  

জাফর সাহেব বললেন, এটা খুব ভালো কথা। সব মা-বাবাই চান, ছেলে বিদেশ থেকে উচ্চডিগ্রী নিয়ে এসে ভবিষ্যৎ জীবনে উন্নতি করুক, সুখ শান্তিতে থাকুক। আমরাও চাই। তবে মুসলমান হিসাবে আমাদের মনে রাখতে হবে, সুখ-দুঃখ ও শান্তি-অশান্তি সবকিছু আল্লাহপাক প্রত্যেকের তকৃদিরে লিখে দিয়েছেন। তিনি কুরআন পাকে বলিয়াছেন, “যারা ঈমান আনার পর সৎ কাজ করে ও অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকে তাদেরকে তিনি স্বচ্ছলতা দান করিবেন এবং আখিরাতেও অনন্ত সুখের অধিকারী করিবেন।”

আমার কথায় আপনারা মনে কিছু নেবেন না। যা কিছু বলছি, আলাপ আলোচনার জন্য। জুলায়খা আমাদের একমাত্র সন্তান। ওরা একে অপরকে কিশোর বয়স থেকে ভালবাসে। আর এ কথাও জানে, উপযুক্ত বয়সে ও উপযুক্ত সময়ে তাদের বিয়ে হবে। ইউসুফ বিদেশে গেলে জুলায়খা খুব কান্নাকাটি করবে। তাই বলছিলাম, যে ডিগ্রী নেওয়ার জন্য আপনারা ওকে বিদেশে পাঠাতে চাচ্ছেন, তা এখানেও নেওয়া যায়। আর যদি একান্ত পাঠাতেই চান, তা হলে বলব, ওদের বিয়ে দিয়ে দুজনকে একসঙ্গে পাঠালে কেমন হয়? অবশ্য দু’জনের সব খরচপত্র আমিই বহন করব। তারপর চুপ করে গেলেন।

কেউ কিছু বলার আগে ইলিয়াস সাহেব বললেন, আপনি ভালো কথা বলেছেন। তবে কী জানেন, ছাত্রজীবনে বিয়ে দেওয়া মানে তার ভবিষ্যৎ জীবন নষ্ট করে দেওয়া। তা ছাড়া ইউসুফের এখনও বিয়ের বয়স হয় নি। তবে এঙ্গেজমেন্ট করে রাখা যায়। তারপর মা, ছোট ভাই ও তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা কী বল?

জুলায়খাকে রোকেয়া বিবির খুব পছন্দ। জাফর সাহেবের কথা শুনে খুশী হয়েছিলেন। বড় ছেলের কথা শুনে অসন্তুষ্ট হয়ে কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।

ইয়াকুব সাহেব ও নূরজাহান বেগম একই কারণে চুপ করে রইলেন।

ইলিয়াস সাহেব কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বললেন, কী ব্যাপার? তোমরা কিছু বলছ না কেন?

বড় ভাইকে ইয়াকুব সাহেব খুব সম্মান করেন। কখনও তার কথার উপর কথা বলেন না। তাই মা কি বলেন শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বড় ভাই তাগিদ দিতে বললেন, আপনি যা বললেন, তাতে আমার কোনো অমত নেই।

ইলিয়াস সাহেব মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি কিছু বলবেন?

রোকেয়া বিবি মনের ইচ্ছা চেপে গিয়ে বললেন, আমি আর কি বলব? তোমরা যা ভালো বুঝ করবে।

ইলিয়াস সাহেব এবার জাফর সাহেবকে বললেন, এঙ্গেজমেন্ট করে রাখতে আপনাদের নিশ্চয় আপত্তি নেই?

জাফর সাহেব মায়ের দিকে তাকালেন।

আসিয়া বিবি বেশি লেখাপড়া না করলেও খুব বিচক্ষণ মহিলা। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের মনের ভাব বুঝতে পেরেছেন। তার দৃঢ় ধারণা হল, ইউসুফের বড় চাচা না এলে এরা সবাই জাফরের প্রস্তাব মেনে নিতেন। ছেলে তার দিকে তাকাতে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, আমি আপনাদের সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। জাফর যা বলল, সেটাই আমাদের চূড়ান্ত মতামত। আপনারা চিন্তা-ভাবনা করে জানাবেন।

আসিয়া বিবির কথা শুনে সবাই আনন্দিত হলেন। ইলিয়াস সাহেবও হয়েছেন। তিনি গ্রামের মাতব্বর। ভিলেজ পলিটিক্স করেন। মেয়ের বাবা মেয়ে জামাইয়ের বিদেশে লেখাপড়ার খরচ দেবেন শুনে ভিলেজ পলিটিক্সের ফরমূলায় তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতাবার জন্য এঙ্গেজমেন্টের কথা বলেছিলেন। এখন মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, আপনি মুরুব্বী মানুষ। আপনার কথা না রাখলে বেয়াদবি হবে। ঠিক আছে, আমরা ভেবে চিন্তে জানাব। তারপর বিদায় নিয়ে সবাই ফিরে এলেন।  

বাসায় এসে ইলিয়াস সাহেব বললেন, যা বুঝতে পারছি, ওঁরা ইউসুফকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে চান।

ইয়াকুব সাহেব বললেন, আপনার কথা ঠিক মেনে নিতে পারছি না। প্রায় সাত আট বছর ওঁদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। সে ধরণের মানুষ ওঁরা নন।

তোমার কথা অবশ্য ঠিক ওঁরা খুব ভালো মানুষ। তবে সেই সঙ্গে খুব চালাকও। তোমরা ওঁদের চালাকি বুঝতে না পারলেও আমি পেরেছি।

বলুন কি বুঝতে পেরেছেন।

তোমরা দুজনেই খুব সরল সোজা। তাই ওঁদের চালাকি বুঝতে পার নি। তবে একথা ঠিক, ওঁদের মধ্যে কোনো ভণ্ডামী নেই। একটা কথা তোমরা চিন্তা করেছ কী? আমাদের থেকে অনেক বেশি ধনী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের ঘরে মেয়ে দিতে চাচ্ছেন কেন?

এতে চিন্তা করার কি আছে? ইউসুফের মতো ছেলে লাখে একটা আছে কিনা সন্দেহ।

হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক বলেছ। তাই তো ইউসুফকে জামাই করে ভবিষ্যতে সবকিছুর দায়-দায়িত্ব তার উপর দেওয়ার পরিকল্পনা জাফর সাহেব করেছেন।

সে রকম পরিকল্পনা যদি করেও থাকেন, তা হলে খারাপের কি আছে বুঝতে পারছি না।

খারাপের কিছু নেই। কিন্তু আমাদের বেনিফিট কী?

আমাদের বেনিফিটের কথা চিন্তা করব কেন? ছেলে, বৌ ও তাদের বংশধররা সুখ শান্তিতে থাকবে, এটাই তো আমাদের কাম্য।

তুমি চিরকাল সরল রয়ে গেলে ইয়াকুব। আরে বাবা, মা-বাবা ছেলেকে মানুষ করে তাদের কাছ থেকে সব রকমের সাহায্য পাওয়ার জন্য। জাফর সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করলে ইউসুফের কাছ থেকে সেরকম কিছু পাবে না। ইউসুফকে মানুষ করতে আমাদের কম টাকা খরচ হয় নি। সেই টাকা মেয়ের বাবার কাছে থেকে উসুল করে নিতে হবে না?

একথাটাও আমি মেনে নিতে পারলাম না। প্রথম কারণ হল, ইউসুফ আমাদের সাহায্য করবে না, এটা বিশ্বাস করি না। দ্বিতীয় কারণটা আপনি ও জানেন, বিয়ের সময় মেয়ের বাবার কাছ থেকে দাবি করে কিছু নেওয়া হারাম। তবু বলছেন কেন?

আমরা তো ইউসুফকে এক রকম বিক্রি করে দিচ্ছি। এটা দাবি হবে কেন?

ইয়াকুব সাহেব অবাক কণ্ঠে বললেন, বিক্রি করে দিচ্ছি মানে?

ইলিয়াস সাহেব বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, এতকিছু বলার পরও যদি বিক্রি করার মানে বুঝতে না পার, তা হলে আর বোঝার দরকার নেই। তোমাদেরকে এ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হবে না, যা করার আমিই করব। এখন শুধু এটুকু শুনে রাখ, জাফর সাহেবের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা আদায় করেই ছাড়ব।

বড় ভাইয়ের কথা শুনে ইয়াকুব সাহেব যেমন খুব অবাক হলেন, তেমনি অসন্তুষ্টও হলেন। বললেন, না বড় ভাই, এমন কাজ কখনও করবেন না। এটা সরাসরি হারাম। তা ছাড়া ওঁরা আমাদেরকে খুব ছোটলোক মনে করবেন। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আম্মা আপনি কিছু বলছেন না কেন?

রোকেয়া বিবি বড় ছেলের স্বভাব চরিত্র ও বুদ্ধিমত্তার কথা জানেন। বললেন, ইলিয়াস ঠিক কথা বলেছে। ওদের কোনো ছেলে সন্তান নেই। বিদেশ থেকে ফেরার পর ইউসুফকে ওরা ছাড়বে না, নিজেদের ব্যবসায় লাগাবে। অবশ্য ইউসুফই ভবিষ্যতে ওদের সবকিছুর মালিক হবে। তাই ইলিয়াস ওদের কাছ। থেকে নগদ কিছু নিতে চায়। এটা অন্যায় বলে আমার মনে হচ্ছে না। যাই হোক, এ ব্যাপারে তোমাদের কোনো চিন্তা ভাবনা করতে হবে না, যা করার। ইলিয়াসই করবে। তারপর বড় ছেলেকে বললেন, এখনই ফোন করে জাফর সাহেবকে টাকার কথা বলে জানিয়ে দে, আমরা ওঁর মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। আর টাকার ব্যাপারটা ইউসুফ যেন জানতে না পারে।

ইয়াকুব সাহেব কখন মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে তর্ক বা কথা কাটাকাটি করেন নি। তাই তাদের প্রতি খুব অসন্তুষ্ট হলেও সেসব কিছু না করে বললেন, জাফর সাহেব যদি ইউসুফকে জানিয়ে দেন, তা হলে হুলুস তুলুস কাণ্ড করে বসবে।

ইলিয়াস সাহেব বললেন, আমার যতদূর বিশ্বাস, জাফর সাহেব সেরকম ভুল করবেন না।

আর জুলায়খা যদি জানিয়ে দেয়?

সে সম্ভাবনাও খুব কম। জাফর সাহেব টাকার কথাটা সবার কাছে নিশ্চয় গোপন রাখবেন।

মা ছাড়া অন্য কেউ ছেলেমেয়ের স্বভাব-চরিত্র সম্পূর্ণ জানে না। নূরজাহান বেগম ও ইউসুফের নাড়ি নক্ষত্র চেনেন। বড় ভাসুর ও শাশুড়ীর কথা শুনে তিনিও ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছেন। চিন্তা করলেন, ইউসুফ যা স্পষ্টবাদী ছেলে, টাকার কথা জেনে গেলে হুলুস-তুলুস কাণ্ড তো করবেই, এমন কি বড় চাচা, দাদি কাউকেও ছেড়ে কথা বলবে না। শাশুড়ী থেমে যেতে বললেন, আমার কিন্তু খুব চিন্তা হচ্ছে, ইউসুফ যদি ঘুর্ণাক্ষরেও টাকার কথা জানতে পারে, তা হলে কি করবে, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।

রোকেয়া বিবি বললেন, তা আমিও জানি। তাই তো বললাম, সে যেন। টাকার কথাটা একদম জানতে না পারে।

.

আব্বা, আম্মা, বড় চাচা ও দাদিআম্মা জুলায়খাদের বাসায় রওয়ানা হওয়ার কিছুক্ষণ পর ইউসুফ বাসা থেকে বেরিয়ে সংসদভবনে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে এক কলেজ বন্ধুর সঙ্গে দেখা হতে সে তাদের বাসায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে ফেরার সময় মসজিদে এশার নামায পড়ে বাসায় এসে চিন্তা করল, কি কথাবার্তা হল কি জানি।

একটু পরে ছোট বোন সালমা এসে বলল, ভাইয়া, তুমি কি কিছু খাবে?

না রে, এক বন্ধুর বাসায় খেয়েছি, শুধু এক কাপ চা দে। সালমা চা নিয়ে ফিরে এলে জিজ্ঞেস করল, কি কথাবার্তা হল কিছু শুনেছিস কী?

বড়রা যখন কথা বলে বা কোনো বিষয়ে আলাপ করে তখন ছোটদের সেখানে যাওয়া উচিত নয়, সালমা তা জানে। সে এবছর এস. এস. সি পরীক্ষা দিয়েছে। অনেক কিছু বোঝার জ্ঞান হয়েছে। তাই সবাই যখন আলাপ করছিল তখন বারান্দার দিকের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনেছে। বড় চাচা ও দাদিআম্মার কথা শুনে তাদের উপর খুব অসন্তুষ্ট হয়ে আছে। ভাইয়াকে ফিরতে দেখে এখনই তাকে টাকার কথাটা জানিয়ে দেওয়া উচিত ভেবে তার কাছে এসে প্রথমে কিছু খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। চায়ের কাপ তার হাতে দিয়ে বলল, হ্যাঁ শুনেছি। তারপর যা শুনেছিল সব বলল।

শুনে ইউসুফ বড় চাচা ও দাদিআম্মার উপর ভীষণ রেগে গেল। তাদের হীন মনোবৃত্তির পরিচয় পেয়ে এতদিন যতটুকু ভক্তি শ্রদ্ধা করত, তা নিমিষে উধাও হয়ে গেল। ভাবল, বড় চাচা ইসলামের আইন কানুন জানা সত্ত্বেও কি করে টাকার দাবি করলেন? রাগে ও ক্ষোভে তার ফরসা চেহারা লাল হয়ে গেল। ঠোঁট কামড়ে রাগ সামলাবার চেষ্টা করল। এক সময় ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করল।

সালমা তার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে বলল, ভাইয়া, তুমি শান্ত হও। যা করবে ভেবে চিন্তে করো। তাকে বড় বড় চোখে তার দিকে তাকাতে দেখে আরো ভয় পেয়ে মিনমিনে গলায় বলল, তুমিই তো একদিন একটা হাদিস পড়ে শোনালে, “আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) বলিয়াছেন, ক্রোধ শয়তান হইতে উৎপন্ন এবং শয়তান অগ্নি দ্বারা তৈরি। অগ্নি পানির সাহায্যে নির্বাপিত করা যায়। যখন তোমাদের কাহারও মনে ক্রোধ উপস্থিত হয়, সে যেন অযু করে।” [বর্ণনায় : হযরত আতিয়্যাহ বিন আরওয়াহ (রাঃ)–আবু দাউদ]

হাদিসটা শুনে ইউসুফের রাগ কিছুটা কমল। বলল তুই যা, আমি অযু করছি। তারপর বাথরুমে গিয়ে অযু করে এসে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, গেলি না যে? আর কিছু বলবি?  

আমি যে টাকার কথাটা তোমাকে বলেছি, সে কথা কাউকে বলবে না।

ঠিক আছে, বলব না। এবার যা তো দেখি।

সালমা গুটি গুটি পায়ে চলে গেল।

ইউসুফ দু’রাকায়াত নফল নামায পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইল। তারপর ভাবল, এক্ষুনি প্রতিবাদ জানালে সালমার কথা গোপন থাকবে না। কাল সকালেই যা করার করবে। কিভাবে কি করবে চিন্তা করতে করতে তার তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। সালমার ডাকে তন্দ্রা ছুটে গেল। বলল, ডাকছিস কেন?

সালমা বলল, ভাত খাবে এস, সবাই খাচ্ছে।

তুই খেয়েছিস?

হ্যাঁ।

যা আমি আসছি বলে ইউসুফ চোখে মুখে পানি দিয়ে খেতে গেল। খেয়ে এসে একটা হাদিসের বই নিয়ে বসল। প্রায় আধঘণ্টা পরে বনি ইয়ামিন এসে বলল, ভাইয়া, তোমাকে ড্রইংরুমে আম্মু ডাকছে।

ইউসুফ হাদিসটা বন্ধ করে ড্রইংরুমে এসে দেখল, আম্মু, আব্ব বড় চাচা ও দাদিআম্মা রয়েছেন।

তাকে দেখে নূরজাহান বেগম বললেন, আয় বস। বসার পর বললেন, জাফর সাহেব চাচ্ছেন, আমেরিকা যাওয়ার আগে বিয়ের কাজটা মিটিয়ে ফেলতে। প্রথমে শুধু এই কথাটা বলতে ইলিয়াস সাহেব তাকে বলেছিলেন।

ইউসুফ বলল, আর কিছু বলেন নি?

নূরজাহান বেগম ভাসুরের দিকে তাকালেন।

ইলিয়াস সাহেব বললেন, হ্যাঁ বলেছেন। জুলায়খাকে তোমার সঙ্গে পাঠাবেন।

আর কিছু বলেন নি?

ইলিয়াস সাহেব মনে চমক খেলেন। ওকি কারো কাছে টাকার কথা শুনে ফেলেছে? একটু গম্ভীরস্বরে বললেন, মুরুব্বীদেরকে বার-বার প্রশ্ন করা যে বেয়াদবি, তা নিশ্চয় জান?

জ্বি জানি। কিন্তু এরকম একটা ব্যাপারে জানতে চাওয়া বেয়াদবি নয়। আমি তো মনে করেছিলাম, কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আম্মু সবকিছু জানাবেন। উনি যখন তা জানান নি তখন আমাকেই জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে।

ইলিয়াস সাহেব রেগে গেলেও তা প্রকাশ না করে বললেন, জাফর সাহেব তোমাদের দুজনের সব খরচও দেবেন বলেছেন।

আপনারা কিছু বলেন নি?

আমরা আবার কি বলব? উনি মেয়ে জামাইয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে খুশী মনে দিতে চাচ্ছেন। আমরাও তোমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে কিছু বলি নি।

এখন আমি বিয়ে করব না। আর আমেরিকায়ও যাব না। যা পড়ার এখানেই পড়ব।

ছেলে যে এরকম বলবে, ইয়াকুব সাহেব ও নূরজাহান বেগম আগেই অনুমান করেছিলেন। তাই কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।

ইলিয়াস সাহেব কিছুক্ষণ আগে টেলিফোন করে জাফর সাহেবকে জানিয়েছেন, “পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের প্রস্তাবে রাজি আছেন।” জাফর সাহেবও বিনা দ্বিধায় তা মেনে নিয়েছেন। ইউসুফ আমেরিকায় না গেলে টাকাটা হাতছাড়া হয়ে যাবে ভেবে বেশ রাগের সঙ্গে বললেন, কেন যেতে চাচ্ছিস না বলতো?

প্রথম কারণ, লেখাপড়া শেষ করে স্বাবলম্বী হব, তারপর বিয়ে করব। দ্বিতীয় কারণ, শ্বশুরের টাকায় পড়তে যাব না। ছোট খালা যেতে বলেছেন, আমার পড়ার খরচ দেবেন বলেছেন, সে কথা জানার পর থেকে চিন্তা করে ঠিক করেছি, তার কাছ থেকেও সাহায্য নেব না। আপনাদের সামর্থ থাকলে যাব, নচেৎ এখানেই পড়ব।

ইলিয়াস সাহেব রাগ হজম করে বললেন, তুমি এখন ছেলেমানুষ। ভবিষ্যৎ ভালো-মন্দের জ্ঞান তোমার এখনও হয় নি। আমরা বিবেচনা করে জাফর সাহেবকে জানিয়েছি। তার প্রস্তাবে রাজি আছি। তুমি যদি এখন এরকম কথা বল, তা হলে আমাদের মান উজ্জত ধূলোয় মিশে যাবে।  

বড় চাচার কথা শুনে ইউসুফ বুঝতে পারল, জুলায়খার বাবা নিশ্চয় পাঁচলাখ টাকা দিতে রাজি হয়েছেন। কথাটা চিন্তা করে নিজের কাছে খুব ছোট হয়ে গেল। ছিঃ ছিঃ, উনি নিশ্চয় আমাদেরকে ছোটলোক ও লোভী ভাবছেন। এরপর তাদেরকে মুখ দেখাবে কি করে?

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে ইলিয়াস সাহেব বললেন, আমি জানতাম, তুমি বংশের মান-ইজ্জৎ ডুবাবে না।

ইউসুফ আর রাগ সহ্য করতে পারল না। দাঁড়িয়ে উঠে দৃঢ়কণ্ঠে বলল, আপনার মুখে মান-উজ্জতের কথা মানায় না। আমার আব্বকে সহজ সরল পেয়ে দু’ভাইয়ের নামে জমি কেনার কথা বলে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজের নামে দলিল করেছেন। ছেলেকে বিদেশ পাঠাবার জন্য ভাইজীকে বৌ করে আব্বর কাছ থেকে একলাখ টাকা নিয়েছেন। গ্রামের অভাবগ্রস্থ লোকদের কিছু কিছু টাকা দিয়ে ন্যায্যমূল্যর থেকে অনেক কম মূল্য দিয়ে তাদের জমি নিজের নামে কিনেছেন। এখন আবার আমার বিয়ে দিয়ে জুলায়খার বাবার কাছ থেকে পাঁচ লাখ কামাতে চান। আমি জানি, আব্বুর ঐ টাকার উপর এতটুকু লোভ নেই। নিশ্চয় তিনি বাধা দিয়েছিলেন। আপনি তার বাধা না শুনে টাকাটা নিজে বাগাতে চান। সে আশা আপনার পূরণ হতে দেব না। আগে আমি ছোট ছিলাম, খন কিছু বুঝতাম না। তাই আর শিক্ষা মতো আপনাকে ভীষণ ভক্তি শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু বড় হয়ে আপনার আসল স্বরূপ যখন জানতে পারলাম তখন থেকে আপনাকে আর এতটুকু ভক্তি শ্রদ্ধা করি না। সবকিছু জানার পর একদিন আব্বুকে এসব কথা বলেছিলাম। উনি আপনাকে পীরের মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করেন। তাই আমাকে বকাবকি করে বললেন, “বড়দের দোষ ধরা মস্তবড় বেয়াদবি। আর বেয়াদবকে আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) ভালবাসেন না। আমাকে ঠকালেও তিনি আমার বড় ভাই। আব্বা মারা যাওয়ার পর তিনিই আমাকে মানুষ করেছেন। কেউ কাউকে ফাঁকি দিলেও আল্লাহ তকৃদিরে যা লিখেছেন তা কমবে না। তুমি এ ব্যাপারে তোমার বড় চাচার সঙ্গে একটা কথাও বলবে না।” আব্বুর কথামতো এতদিন চুপ করে ছিলাম; কিন্তু আজ জুলায়খার বাবার কাছে থেকে পাঁচ লাখ টাকা নেওয়ার কথা শুনে চুপ করে থাকতে পারলাম না। আব্বু আপনার ছোট ভাই, তিনি তার বড় ভাইয়ের ন্যায় অন্যায় সহ্য করলেও আমি করব না। তারপর রোকেয়া বিবির দিকে তাকিয়ে বলল, দাদিআম্মা, জানি আপনি। আব্বুর থেকে বড় চাচাকে বেশি ভালবাসেন। সেই ভালবাসায় অন্ধ হয়ে তার ন্যায় অন্যায়ের কোনো প্রতিবাদ করেন নি। এটা উচিত কিনা বুকে হাত দিয়ে চিন্তা করুন। আমরা মুসলমান হিসাবে বিশ্বাস করি, একদিন আমাদেরকে আল্লাহর দরবারে সবকিছুর হিসাব দিতে হবে।

ইয়াকুব সাহেব বড় ভাইকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করলেও তার কাজ কর্ম দেখে মনে মনে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাই ইউসুফ যখন তাকে তার কার্যকলাপের কথা বলছিল তখন বাধা দেন নি। কিন্তু যখন মাকে দোষারূপ করল তখন সহ্য করতে পারলেন না। ছেলেকে দাবড়ি দিয়ে বললেন; ইউসুফ চুপ কর। আর একটা কথা। বললে চাবকে তোমার পিঠের ছাল তুলে নেব। তুমি জ্ঞানী ছেলে হয়ে এটা জান না, সবার সামনে মুরুব্বীদের দোষ-ত্রুটি তুলে কথা বলা কত বড় বেয়াদবি ও অন্যায়?

ইউসুফ চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, জানি আব্বু জানি। আর এও জানি, কাউকে অন্যায় করতে দেখে প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকা আরো বড় অন্যায়। তারপর চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল।  

সে চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ পিন পতন নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল।

এক সময় ইয়াকুব সাহেব বড় ভাইয়ের দু’হাত ধরে বললেন, আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। বিশ্বাস করুন, সাংসারিক ব্যাপারে আমি ওকে কখনও একটা কথাও বলি নি। কার থেকে জেনেছে তাও জানি না।

ইলিয়াস সাহেব নির্বাক হয়ে মাথা নিচু করে ছিলেন। ঐভাবেই রইলেন।

ইয়াকুব সাহেব বড় ভাইয়ের হাত ছেড়ে দিয়ে মায়ের দু’পা জড়িয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, আম্মা, আপনি ওকে বদদোয়া করবেন না। ছেলে মানুষ কাকে কি বলতে হয়, সে জ্ঞান এখনো হয় নি। ওকে আপনি মাফ করে দিন।

নাতির কথা শুনতে শুনতে রোকেয়া বিবির দিলে পরকালের ভয় এসে গেছে। তিনিও চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, ইলিয়াসের প্রতি ভালবাসা সত্যিই আমাকে অন্ধ করে রেখেছিল। তোর ছেলে আজ আমার সেই অন্ধকার দূর করে দিয়েছে। তাকে বদদোয়া করার কথা বলছিস কী? বরং দোয়া করছি “আল্লাহ তাকে হায়াতে তৈয়েবা দিক, আমার মাথায় যত চুল অত বছর বাঁচিয়ে রাখুক। তাকে দ্বীন-দুনিয়ায় সুখশান্তিতে রাখুক।” কথা শেষ করে আঁচলে চোখ মুছতে লাগলেন।

মা থেমে যেতে ইলিয়াস সাহেব কান্না জড়িত স্বরে বললেন, জানেন আম্মা, ইউসুফ ভালো ছেলে জানতাম; কিন্তু এত ভালো জানতাম না। মা হয়ে এতদিনে আপনি যা পারেন নি, আজ আপনার নাতি কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তা করল। ও আমারও চোখ খুলে দিয়েছে। সারা জীবন অনেক অন্যায় করেছি, এবার সে সবের জন্য তওবা পড়ে আল্লাহর কাছে মাফ চাইব। যাদের সম্পত্তি কম দামে কিনেছি, তাদেরকে ন্যায্য দাম দিয়ে মাফ চেয়ে নেব। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, কাল সকালে আমি নিজে গিয়ে জাফর সাহেবের কাছে। মাফ চেয়ে টাকার কথাটা ফিরিয়ে নেব।

রোকেয়া বিবি বললেন, হ্যাঁ বাবা, তাই করিস। আর আমিও কাল সকালে ইউসুফকে সবকিছু জানাব।

এদিকে ইউসুফ রুমে এসে স্থির থাকতে পারল না। তার কেবলই মনে হতে লাগল, এক্ষুনি গিয়ে জুলায়খার বাবাকে নিজের মতামত জানান উচিত। কাল সকালে গিয়ে জানাবে ভাবল বটে, কিন্তু মনকে বুঝ মানাতে পারল না। তার মন। বার-বার যাওয়ার জন্য তাগিদ দিতে লাগল। শেষে ড্রেসচেঞ্জ করে কাউকে না। জানিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এল। ততক্ষণ সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই কেউ তাকে বেরোতে দেখল না।

ইলিয়াস সাহেবের ফোন পাওয়ার পর জাফর সাহেব চিন্তা করলেন, ইউসুফের বাবা কত ভালো মানুষ। আর তারই বড় ভাই যে এত লোভী তা। ভাবতেই পারছেন না। চিন্তা করলেন, টাকার কথাটা স্ত্রী ও আম্মাকে না জানানোই ভালো। তাদেরকে শুধু বললেন, ইউসুফের চাচা ফোন করে জানালেন, আমাদের প্রস্তাবে তারা রাজি।

আসিয়া বিবি বললেন, বিয়ে শাদির কাজে দেরি করতে নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা করে ফেল।

.

জাফর সাহেব টিভির কোনো প্রোগাম না দেখলেও প্রতিদিন রাত দশটার সংবাদ প্রচার দেখেন এবং এগারটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন।

ইউসুফ স্কুটার রিজার্ভ করে জুলায়খাদের বাসার গেটে এসে নক করল।  

গেটের পাশে দারোয়ানের থাকার রুম। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কেউ গেট নক করছে শুনে চিন্তা করল, এত রাতে তো কেউ কখনো আসে না। সাহেবকে জানাবে কি না ভাবতে লাগল। আবার নক হতে রুম থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, কে?

আমি ইউসুফ। বিশেষ দরকারে এসেছি। গেট খুলুন।

ইউসুফ এ বাড়ির ভাবী জামাই, তা দারোয়ান জানে। তাড়াতাড়ি গেট খুলে সালাম দিল।

ইউসুফ সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনি গেট লাগিয়ে অপেক্ষা করুন, বেশি দেরি করব না।

জাফর সাহেবের বাড়ির বারান্দা গ্রীল দিয়ে ঘেরা। বারান্দার দরজাও গ্রীলের। রাত দশটায় সেই দরজা ও গেট বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য বারান্দার দরজার পাশে কলিংবেলের বোতাম আছে। বাড়ির দু’পাশে দু’টো আড়াইশ ভোল্টের মারকারী বাল্বের আলোতে বাড়ির সামনেটা দিন হয়ে আছে।

ইউসুফ বারান্দার কাছে এসে বোতামে চাপ দিল।

জাফর সাহেব অভ্যাস মতো এগারটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছেন। হামিদা বেগম তখনও জেগে ছিলেন। কলিং বেলের শব্দ শুনে ভাবলেন, এ সময় কে আসতে পারে? আবার ভাবলেন, দারোয়ান যখন গেট খুলে দিয়েছে, নিশ্চয় জানাশোনা কেউ হবে। স্বামীর গায়ে হাত রেখে নাড়া দিয়ে বললেন, এই উঠ। কে যেন এসে কলিংবেল বাজাচ্ছে।

জাফর সাহেব একটা দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন। জেগে গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, কী হয়েছে?

দু’বার কলিংবেল বেজেছে।

তাই নাকী বলে জাফর সাহেব খাট থেকে নেমে জামা গায়ে দিতে দিতে। ওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, এত রাতে কে আসতে পারে? চোর ডাকাত নয় তো?

হামিদা বেগম হেসে ফেলে বললেন, চোর ডাকাতরা কলিংবেল বাজায় না, গ্রীল কেটে ঢোকে। বারান্দায় বেরিয়ে দেখ, অচেনা কেউ হলে কাল সকালে আসতে বলবে। তা ছাড়া দারোয়ান ও কোনো কারণে কলিংবেল বাজাতে পারে।

জাফর সাহেব আর কিছু না বলে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন।

জুলায়খা তখনও পড়ছিল। কলিং বেলের শব্দ শুনে বারান্দায় বেরিয়ে রেলিং ধরে ঝুঁকে ইউসুফকে চিন্তে পারল। চাবিটা নিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এসে সালাম দিয়ে গেট খোলার সময় বলল, কী ব্যাপার? এত রাতে?

ইউসুফ সালামের উত্তর দিয়ে ভিতরে ঢুকে বলল, তোমার আব্বর সঙ্গে কিছু কথা আছে। উনি কী জেগে আছেন?

জুলায়খা হাত ঘড়ি দেখে বলল, এখন তো বারটা বাজে। আব্লু তো এগারটার মধ্যে ঘুমিয়ে যায়। ঠিক আছে, এস আমার সঙ্গে।

জাফর সাহেব জুলায়খার গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এসে তার সঙ্গে ইউসুফকে দেখে খুব অবাক হলেন।

জুলায়খা দেখতে পেয়ে বলল, ঐ তো আব্ব আসছে।

ইউসুফ এগিয়ে এসে সালাম দিল।

সালামের উত্তর দিয়ে জাফর সাহেব বললেন, এত রাতে? কী ব্যাপার?

ইউসুফ কিছু বলার আগে জুলায়খা বলল, জান আব্বু, আমি পড়ছিলাম। কলিংবেলের শব্দ শুনে এত রাতে কে আসতে পারে দেখার জন্য বারান্দায় এসে দেখি ইউসুফ ভাই।

জাফর সাহেব বললেন, ঠিক আছে। তুমি যাও। তারপর ইউসুফকে নিয়ে ড্রংইরুমে এসে তাকে বসতে বলে নিজেও বসলেন।

হামিদা বেগমও স্বামীর পিছনে বেরিয়েছিলেন। ইউসুফকে নিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকতে দেখে তিনিও এসে বসলেন।

জাফর একবার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নিয়ে ইউসুফকে বললেন, বল কেন এসেছ?

আমার বড় চাচা আপনার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চেয়েছেন জানতে পেরে এলাম। আব্বা আম্মা এজন্য তার উপর খুব অসন্তুষ্ট। আপনি বড় চাচাকে টাকা দেবেন না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমেরিকায় পড়তে যাব না, এখানেই পড়ব। পড়াশোনা শেষ করে স্বাবলম্বী হয়ে বিয়ে করব। আর একটা কথা, যদিও কথাটা বলতে বিবেকে বাধছে, তবু বলছি, আমার ও জুলায়খার ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস না করে কোনো ফাইন্যাল ডিসিশান নেবেন না।

ঠিক আছে বাবা, তাই হবে। এ নিয়ে তুমি কোনো টেনসান ফিল করো না। তারপর বললেন, কথাগুলো কাল সকালে এসে বলতে পারতে। এত রাতে আসা তোমার ঠিক হয় নি। ড্রাইভারের দু’দিন থেকে খুব জ্বর। ভালো থাকলে পৌঁছে দিয়ে আসত।

আপনি চিন্তা করবেন না, আমি স্কুটার রিজার্ভ করে এসেছি। কোনো অসুবিধে হবে না।

তা হলে আর দেরি করো না বলে জাফর সাহেব তাকে সঙ্গে করে গেটের বাইরে এসে স্কুটারে উঠতে বলে ড্রাইভারকে বললেন, সাবধানে যেও।

আব্ব চলে যেতে বললে জুলায়খা রুমের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করল, এত রাতে ইউসুফ ভাই কেন এসেছে। তাদের সঙ্গে আম্মুকেও ড্রইংরুমে ঢুকতে দেখে এগিয়ে এসে দরজার বাইরে থেকে সবকিছু শুনছিল। আবু ইউসুফ ভাইকে যাওয়ার কথা বলতে নিজের রুমে এসে দু’রাকায়াত শোকরানার নামায পড়ল।

হামিদা বেগম অপেক্ষা করছিলেন। স্বামী ফিরে এলে বললেন, ইউসুফের বড় চাচা তোমার কাছে পাঁচ লাখ টাকা কখন চাইলেন? আলাপ হওয়ার সময় আমিও তো ছিলাম।

জাফর সাহেব বললেন, ন’টার দিকে ফোন করে বলেছেন।

হামিদা বেগম বললেন, ওঁর কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছিল, খুব চালাক ও স্বার্থপর। তুমি টাকা দিতে রাজি হয়েছ?

জুলায়খার সুখের জন্য পাঁচলাখ কেন, দশ লাখ চাইলেও রাজি হতাম।

টাকার কথা আমাকে জানাও নি, আম্মাকে জানিয়েছ?

না। তুমি ও আম্মা টাকার কথা শুনলে ওঁদেরকে খারাপ মানুষ ভেবে দুশ্চিন্তা করতে। তাই জানাই নি।

ইউসুফের মতো ছেলে হয় না। আর মা বাবাও খুব ভালো। চাচা খারাপ হলে তো আমাদের কি? জুলায়খাকে তো আর ওঁর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছি না?

হ্যাঁ, তোমার কথা ঠিক। ভবিষ্যতে উনি যেন আর কোনো প্যাঁচ খেলতে না পারেন, সে জন্য টাকা দিতে রাজি হয়েছিলাম।

ইউসুফের চেহারা দেখে মনে হল, টাকার ব্যাপার নিয়ে বাসায় খুব গোলমাল হয়েছে।

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়েছে। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে জাফর সাহেব বললেন। এ নিয়ে আর চিন্তা করো না। রাত অনেক হয়েছে। ঘুমিয়ে। পড়।

.

ইউসুফের স্কুটার যখন শাহবাগ পার হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউটের কাছে এল ঠিক তখনই পেছন থেকে আর একটা স্কুটার ওভারটেক করে তাদের গাড়ির গতিরোধ করল।তারপর তিনজন সন্ত্রাসী ঐ স্কুটার থেকে নেমে ইউসুফ ও ড্রাইভারকে বলল, যা আছে বের কর।  

ড্রাইভার তাগড়া জোয়ান। সারাদিনের রোজগার হাতছাড়া করতে চাইল না। বলল, আমি গরিব মানুষ, স্কুটার চালিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাই। আপনারা টাকা নিয়ে নিলে কাল ছেলে মেয়ে নিয়ে উপোষ থাকতে হবে।

তাদের একজন বলল, উপোষ থাকতে হয় থাকবি, যা আছে জলদি বের  

ইউসুফ ও শক্তিশালী শিক্ষিত যুবক। ভাবল, ওরা তিন জন, আমরা দু’জন কি ওদেরকে কাবু করতে পারব না? ড্রাইভারের কথা শুনে বলল, আপনি টাকা দেবেন না। তারপর বসে থেকেই বিদ্যুৎ গতিতে সামনের সন্ত্রাসীর তলপেটে সজোরে লাথি মেরে লাফ দিয়ে অন্য একজনকে জড়িয়ে ধরল।

লাথি খেয়ে সন্ত্রাসীটা বাবারে বলে কয়েক হাত দূরে সরে গেল।

তাই দেখে ড্রাইভারের সাহস বেড়ে গেল। সেও গাড়ি থেকে নেমে তার সামনের সন্ত্রাসীকে আক্রমণ করল।

ইউসুফ যাকে জড়িয়ে ধরল, তার কাছে ধারাল বড় ছুরি ছিল। সেটা সে তার পেটে কয়েকবার ঢুকিয়ে দিল।

ইউসুফ আল্লাহু আকবর বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ড্রাইভার যে সন্ত্রাসীকে আক্রমণ করেছিল ততক্ষণে তাকে মাটিতে ফেলে তার গলা টিপে ধরল। সে তখন মরণ যন্ত্রনায় হাত পা ছুঁড়তে শুরু করল।

ইউসুফ যার তলপেটে লাথি মেরেছিল, সে ততক্ষণে সামলে উঠেছে। তার কাছে রিভলবার ছিল। সঙ্গীর মুমূর্ষ অবস্থা দেখে ড্রাইভারের মাথায় দু’টো গুলি করল।

ড্রাইভার সন্ত্রাসীকে ছেড়ে দিয়ে তার পাশে লুটিয়ে পড়ল।

সন্ত্রাসীরা তাদের কাছে যা পেল, তাই নিয়ে কেটে পড়ল।

প্রায় আধঘন্টা পর টহলরত একটা পুলিশ ভ্যান এসে রাস্তার উপর স্কুটারের পাশে দু’জন লোককে পড়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর তিন চারজন। পুলিশ ভ্যান থেকে নেমে কাছে গিয়ে তাদের অবস্থা দেখে যা বোঝার বুঝে গেল। তাড়াতাড়ি নিজেদের ভ্যানে তুলে মেডিকেলে নিয়ে গেল।  

ডাক্তার পরীক্ষা করে ড্রাইভারকে মৃত ঘোষণা করলেন। আর ইউসুফ বেঁচে আছে জেনে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেন। অপারেশান করার পর তাকে অবজারভেশন বেডে রাখা হল।

ইউসুফ প্রতিদিন মসজিদ থেকে ফজরের নামায পড়ে পৌনে এক ঘন্টা মর্নিং ওয়াক করে। তারপর বাসায় এসে কুরআন তেলাওয়াত করে।

নূরজাহান বেগম সাতটা পর্যন্ত তার কোনো সাড়া না পেয়ে রুমে গিয়ে দেখলেন, নেই। ভাবলেন, আজ হয়তো কোনো কারণে ফিরতে দেরি করছে। ভাবলেন বটে, কিন্তু তার মনটা অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে রইল। ভোরের দিকে ইউসুফের উপর খারাপ স্বপ্ন দেখার সময় ফজরের আযান শুনে ঘুম ভেঙে যায়। সেকথা মনে পড়তে আরো শঙ্কিত হলেন। সাড়ে সাতটা বেজে যাওয়ার পরও যখন ইউসুফ ফিরল না তখন স্বামীর কাছে গিয়ে বললেন, ইউসুফ ফজরের নামায পড়তে গিয়ে এখনও ফেরে নি।

ইয়াকুব সাহেব বললেন, এতে চিন্তার কী আছে? মর্নিং ওয়াক করার সময় হয়তো কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হতে গল্প করছে।  

তা হতে পারে; কিন্তু কেন কি জানি আমার মনটা ওর জন্য বড় অস্থির লাগছে। জাফর সাহেবের বাসায় একবার ফোন করে দেখ না, ওখানে গেছে কি না।

স্ত্রীর কথা শুনে ইয়াকুব সাহেবের মনেও আশঙ্কা জেগে উঠল। এক্ষুনি করছি, তুমি আমার নাস্তা রেডি কর।

রোকেয়া বিবি নাতির সঙ্গে কথা বলার জন্য তার রুমে গিয়ে না পেয়ে ফিরে আসছিলেন। নূরজাহান বেগমকে দেখে বললেন, ইউসুফ কোথায়?

নূরজাহান বেগম বললেন, ওকে দেখতে পাচ্ছি না। তাই আপনার ছেলেকে জাফর সাহেবের বাসায় ফোন করতে বললাম।

রোকেয়া বিবি ড্রইং রুমে এসে দেখলেন, ইলিয়াস বসে আছে আর ইয়াকুব ফোনে কথা বলছে। তিনিও একটা সোফায় বসলেন।

.

ইউসুফ চলে যাওয়ার পর জুলায়খা আর পড়ায় মন বসাতে পারল না। অনেক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে লাগল, ইউসুফ ভালভাবে বাসায় পৌঁছাল কি না। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল খেয়াল নেই। একটা পেঁচা ডেকে উঠতে তার গা ছম ছম করে উঠল। সেই সাথে ইউসুফের রাস্তায় কোনো অমঙ্গল হল কি না ভেবে আতঙ্কিত হল। রুমে এসে দোয়া ইউনুস কয়েকবার পড়ে দোয়া করল, আল্লাহ তুমি ইউসুফকে হেফাজত করো। তারপর বাথরুম থেকে এসে শুয়ে শুয়ে তার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামায পড়ার পর হঠাৎ তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। চিন্তা করেও কারণটা খুঁজে পেল না। তার সাড়ে সাতটায় ক্লাস। একবার ভাবল, আজ কলেজে যাবে না। আবার ভাবল, আজ একটা ইমপর্ট্যান্ট ক্লাস আছে। তাই সাতটায় কলেজে চলে গেল।

জাফর সাহেব সাড়ে সাতটায় গোসল করছিলেন। রিং বেজে উঠতে হামিদা বেগম ফোন ধরলেন।

এটা কি জাফর সাহেবের বাসা?

জ্বি, আপনি কে বলছেন?

আমি মেডিকেল থেকে ডাক্তার বলছি। রাত দুটোর সময় টহল পুলিশ দু’জন লোককে নিয়ে আসে। তাদের একজন স্কুটার ড্রাইভার। অন্যজন প্যাসেঞ্জার। ড্রাইভার এখানে আসার আগেই মারা গেছে। অন্যজন বেঁচে ছিলেন। আমরা অপারেসন করে অভজারভেশন বেডে রেখেছি। অবস্থা খুব সিরিয়াস। তার পকেটে জাফর সাহেবের কার্ড পেয়ে ফোন করেছি। কার্ডের উল্টোপিঠে ইউসুফ ৩২ নাম্বার পুরানা পল্টন লেখা আছে। আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন। এই কথা বলে লাইন কেটে দিলেন।

হামিদা বেগমের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। রিসিভার রেখে তাড়াতাড়ি গিয়ে বাথরুমের দরজায় নক করলেন।

জাফর সাহেবের গোসল শেষ হয়েছে। দরজা খুলে বললেন, কী ব্যাপার?

মেডিকেল থেকে ডাক্তার যা বলেছিলেন, হামিদা বেগম সেসব বলে বললেন, শিঘ্রী তৈরি হয়ে নাও।

জাফর সাহেব চমকে উঠে বললেন, আল্লাহ উইসুফের উপর রহম করুক। তুমিও তৈরি হয়ে নাও।

এমন সময় আবার ফোন বেজে উঠতে জাফর সাহেব তাড়াতাড়ি সেদিকে গেলেন।

ইয়াকুব সাহেব যতবার ডায়েল করেন, ততবারই এঙ্গেজ সাউন্ড শুনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার ডায়েল করেছেন।

মেডিকেল থেকে ফোন আসায় ইয়াকুব সাহেব এঙ্গেজ সাউন্ড শুনেছেন। এবার রিং হওয়ার পর কেউ রিসিভার তুলতেই সালাম বিনিময় করে বললেন, এটা কী জাফর সাহেবের বাসা?

জ্বি, জাফর সাহেব বলছি। আপনি কে বলছেন?

ভাই সাহেব, আমি ইউসুফের বাবা। ইউসুফ কি এখন আপনার বাসায়?

জাফর সাহেব চিন্তা করলেন, এখন খবরটা দেওয়া ঠিক হবে না। বললেন, না আসে নি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ও বাসা থেকে কখন বেরিয়েছে।

তা আমরা জানি না। ভোর থেকে ওকে কেউ বাসায় দেখে নি। তাই আপনাদের বাসায় গেছে ভেবে ফোন করলাম।  

জাফর সাহেব বুঝতে পারলেন, ইউসুফ যে রাত বারটার সময় এখানে এসেছিল, ওদের বাসার কেউ জানে না। বললেন, একটু অপেক্ষা করুন আমি আসছি। তারপর লাইন কেটে দিয়ে স্ত্রীকে সংক্ষেপে ফোনের কথা বলে বললেন, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। ওঁদেরকে নিয়ে এক সঙ্গে মেডিকেল যাব।

হামিদা বেগম বললেন, তুমি ড্রাইভারকে একটা স্কুটার রিজার্ভ করে জুলায়খার কলেজে পাঠাও। জিজ্ঞেস করলে বলবে, “ইউসুফ এ্যাকসিডেন্ট করে মেডিকেলে আছে, তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে।”

জাফর সাহেব ড্রাইভারকে কথাগুলো বলে স্ত্রীকে গাড়িতে উঠতে বলে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসলেন।

.

জাফর সাহেব লাইন কেটে দেওয়ার পর ইয়াকুব সাহেব রিসিভার রেখে মা ও বড় ভাইকে যখন তার কথা বলছিলেন তখন নূরজাহান বেগম স্বামীর নাস্তা টেবিলে রেখে সেখানে এসে তিনিও শুনলেন।

ছেলের কোনো বিপদ হলে, মায়ের মন অস্থির হয়ে উঠে। স্বামী থেমে যেতে কান্নাজড়িতস্বরে বললেন, আমার মন বলছে, ইউসুফের কোনো বিপদ হয়েছে। তা না হলে জাফর সাহেব আসছেন কেন?

সবার মনেই ঐ একই রকম সন্দেহ জেগেছে। ইয়াকুব সাহেব স্ত্রীকে বোধ দেওয়ার জন্য বললেন, অস্থির হচ্ছ কেন? উনি এলেই জানা যাবে।’

কিছুক্ষণের মধ্যে জাফর সাহেব ইউসুফদের বাসার গেটের কাছে গাড়ি পার্ক করে নেমে স্ত্রীকে বললেন, তুমি গাড়িতেই থাক। আমি ওঁদেরকে নিয়ে আসি। তারপর দোতলায় উঠে এলেন।

বনি ইয়ামিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। দেখতে পেয়ে সালাম বিনিময় করে ড্রইংরুমে নিয়ে এল।

জাফর সাহেব ঢুকে সালাম বিনিময় করে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে ইয়াকুব সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি যখন ফোন করেছিলেন, তার একটু আগে মেডিকেল থেকে ফোন এসেছিল। ইউসুফ আহত হয়ে সেখানে আছে চলুন, দেরি না করে সবাই যাওয়া যাক।

তার কথা শুনে যে যা পরেছিল সেই অবস্থাতেই রওয়ানা দিলেন। মেয়েরা শুধু পরা কাপড়ের উপর বোরখা পরে নিল।

সবাইকে নিয়ে জাফর সাহেব যখন মেডিকেলে ইউসুফের বেডের কাছে পৌঁছালেন, ঠিক তখনই ইউসুফ মারা গেল।

ডাক্তার নাড়ি ধরে বসে ছিলেন, মারা গেছে বুঝতে পেরে নার্সকে অক্সিজেনের মাক্স খুলে দিতে বলে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, দুঃখিত, আমরা পেসেন্টকে বাঁচাবার যথা সাধ্য চেষ্টা করেছি; কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছার কাছে কারো কিছু করার নেই। উনি মারা গেছেন।

ডাক্তারের কথা প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে পারলেন না। সবাই বোবা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। “ ডাক্তার বললেন, সন্ত্রাসীরা ওঁর পেটে কয়েকবার ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। নাড়ি সেলাই করে রক্ত দিয়েও বাঁচান গেল না। এই কথা বলে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন।

এবার সবাই “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। নূরজাহান বেগম ছেলের লাশ জড়িয়ে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন।  

মেয়ের কথা চিন্তা করে হামিদা বেগম চোখের পানি ফেলতে ফেলতে স্বামীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, ইউসুফের লাশ দেখে জুলায়খার কি অবস্থা হবে ভেবেছ?

জাফর সাহেবের চোখ থেকেও পানি পড়ছিল। সেই অবস্থায় বললেন, চিন্তা করে আর কি করব? আল্লাহর যা মর্জি তাই হবে।

হামিদা বেগম বললেন, তাতো হবেই। তবু আমি চাই না, জুলায়খা ইউসুফের লাশ দেখুক। কথা বলতে বলতে স্বামীকে বাইরে নিয়ে এসে সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আবার বললেন, এতক্ষণে হয়তো জুলায়খা আসছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখলে আমি ওকে অন্য কিছু একটা বলে বাসায় নিয়ে যাব। তুমি ওঁদের সঙ্গে থাকবে।

ততক্ষণে জুলায়খা যে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছে তা ওঁরা জানতে পারলেন না। আর জুলায়খা ও মা-বাবা যে সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে, খেয়াল করল না। সে ইনকোয়ারীতে জেনে এসেছে, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠেই সামনের রুমটা অবজার্ভেশন রুম। সিঁড়ির শেষ ধাপ টপকে উপরে উঠেছে, এমন সময় একজন নার্সকে ঐ রুম থেকে বেরিয়ে তাকে পাশ কেটে যেতে দেখে বলল, প্লীজ, অবজার্ভেশান রুমে ইউসুফ নামে পেসেন্ট কেমন আছেন বলতে পারেন?

নার্স করুণস্বরে বললেন, উনি একটু আগে মারা গেছেন।

হামিদা বেগম মেয়ের গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসছিলেন; কিন্তু তার আগেই নার্সের কথা শুনে জুলায়খা আর্তচিৎকার করে উঠল, না …। তারপর সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে গড়াতে গড়াতে নিচে এসে নিথর হয়ে গেল।

হায় আল্লাহ, একি হল বলে কাঁদতে কাঁদতে হামিদা বেগম দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে লাগলেন।

জাফর সাহেবও ইয়া আল্লাহ, একি হল বলে তিনিও দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগলেন।

তাদের নামার আগে নার্স নেমে এসে জুলায়খাকে ধরে বুঝতে পারলেন, অজ্ঞান হয়ে গেছে।

হামিদা বেগম নেমে এলে নার্স বললেন, একে ধরুন, জ্ঞান হারিয়েছেন। আমি একজন ডাক্তার নিয়ে আসি। কথা শেষ করে দ্রুত চলে গেলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বললেন, উনি পড়ে যাওয়ার আগেই হার্টফেল করেছেন।

1 Comment
Collapse Comments

আমার চোখের কোনে পানি চলে আসছে.আমার জানার ইচ্ছা এটি কি বাস্তব কোন কাহীনি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *