তিন
জাফর সাহেবের গ্রামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা। উনি যখন মায়ের পেটে তখন তার বাবা সিদ্দিকুর রহমান মারা যান। ওঁর বাবা চাচারা দু’ভাই। ওঁদের বিষয় সম্পত্তি প্রচুর। সিদ্দিকুর রহমান মারা যাওয়ার পর বড় ভাই আব্বুর রহমান মনে করেছিলেন, ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে বিদেয় করে দেবেন এবং সমস্ত সম্পত্তির একা মালিক হবেন। কিন্তু যখন শুনলেন, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী আসিয়া বিবি অন্তঃসত্বা তখন খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ভাবলেন, মেয়ে হলে ভবিষ্যতে তাকে পূত্রবধূ করে নেবেন। তা হলে বিষয় সম্পত্তি আর ভাগ বাটোয়ারা হবে না। তারপর যখন আসিয়া বিবি পুত্র সন্তান জন্ম দিলেন তখন সে আশা পূরণ হবে না ভেবে চিন্তা করতে লাগলেন, কিভাবে মা ও ছেলেকে এখান থেকে বিদায় করবেন। তাই ভাইপো জাফর যখন এক বছরের হল তখন ছলে বলে ও কৌশলে আসিয়া বিবিকে ছেলেসহ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেন।
ঘটকের মুখে আসিয়া বিবির রূপ-গুণের কথা শুনে সিদ্দিকুর রহমান নিজে খোঁজ-খবর নিয়ে গরিবের মেয়ে জেনেও তাকে বিয়ে করেছিলেন। আসিয়া বিবির মা-বাবা আগেই মারা গিয়েছিলেন। ভাইয়েরা তার বিয়ে দেয়। আসিয়া বিবি চার ভাইয়ের এক বোন। তাদের কারো আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। বিয়ে শাদী করে যে যার আলাদা সংসার করেছে। ক্ষেত-খামারে কাজ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। তাই আসিয়া বিবিকে ছেলেসহ তার ভাসুর তাড়িয়ে দিয়েছে শুনে যেমন সবাই অসন্তুষ্ট হল, তেমনি টাকার অভাবে তার ভাসুরের অন্যায় অবিচারের কথা শুনেও কোনো প্রতিকার করতে পারে নি।
আসিয়া বিবি প্রত্যেক ভাইয়ের সংসারে একমাস করে থাকতেন আর তাদের সংসারের কাজ-কর্ম করতেন। বড় ও ছোট ভাবির কাছে একটু ভালো ব্যবহার পেলেও মেজ ও সেজ তাকে মোটেই দেখতে পারত না। সংসারের সব কাজ তাকে দিয়ে করালেও তার প্রতি এতটুকু খুশী ছিল না। কোনো কাজ একটু এদিক ওদিক হলেই নানান কটুক্তি শুনতে হত। গালাগালিও করত। ভাইয়েরা আসিয়া বিবির আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তিনি ছেলের ভালোমন্দ চিন্তা করে রাজি হন নাই। ফলে ভাইয়েরা অসন্তুষ্ট হয়ে বোন ও বোনের ছেলের ভালোমন্দের দিকে লক্ষ্য রাখত না। ভাইয়েদের অবহেলা ও ভাবিদের অত্যাচার ও লাঞ্ছনা গঞ্জনা খেয়ে চোখের ও নাকের পানি ফেলতে ফেলতে দিন কাটিয়েছেন, আর ছেলেকে মানুষ করেছেন। জাফর যত বড় হয়েছে, তত মায়ের প্রতি মামা-মামিদের অবহেলা ও অত্যাচার দেখে শুনে তার কান্না পেত। কতদিন না খেয়ে থেকেছে। কিশোর বয়সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ভালোভাবে লেখাপড়া করে মানুষ হয়ে মায়ের দুঃখ ভুলিয়ে দেবে। ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছিল, তার বাবার সম্পত্তি অনেক। বাবা মারা যাওয়ার পর তার বড় চাচা সেসব দখল নিয়ে তাকে ও তার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
এইচ. এস. সি. পাশ করার পর জাফর একদিন মাকে বলল, পৈতৃক সম্পত্তি অধিকার করার জন্য আমি কেস করব।
আসিয়া বিবি বললেন, এখনও তোর সে সময় হয় নি। আরো লেখাপড়া করে রুজী-রোজগার কর, তারপর কেস করবি। কেস করে সম্পত্তি পেতে হলে অনেক টাকা লাগবে। সেই টাকা এখন তুই কোথায় পাবি?
জাফর মায়ের কথা শুনল না। বড় মামার এক শালা জলিল যশোহর। কোর্টের পেশকার। জাফর মায়ের অগোচরে জালালকে ধরে পৈত্রিক সম্পত্তি। উদ্ধারের জন্য বড় চাচার কাছে উঁকিলী নোটিশ পাঠাল।
আব্বুর রহমান তখন চুয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। উঁকিলী নোটিশ পেয়ে মান-সম্মান বাঁচানোর জন্য তিনি এক উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে জাফর ও তার মাকে ডেকে পাঠালেন।
জাফর মাকে সে কথা জানিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে বড় চাচার কাছে আসে। আসার পর আব্বুর রহমান গ্রামের দশজনকে নিয়ে একটা আপোষ মীমাংসার ব্যবস্থা করলেন। গ্রামের যারা এসেছেন, তারা চেয়ারম্যান আব্বুর রহমানেরই লোক। আগেই তাদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে রেখেছিলেন। তারা মা ও ছেলের হাতে দশলাখ টাকার সম্পত্তির বদলে এক লাখ টাকা দিয়ে স্ট্যাম্পে না দাবি লিখিয়ে সই করিয়ে নিলেন।
জাফর প্রথমে রাজি হয় নি। আসিয়া বিবি জানতেন, ভাসুরের সঙ্গে মামলা করে সম্পত্তি ফেরাতে যেমন অনেক সময় লাগবে, তেমনি প্রচুর টাকা পয়সা লাগবে। গ্রামের লোকের সাহায্যও লাগবে। তা ছাড়া ভাই-ভাবিদের সংসারে দিন দিন তিনি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তাই ছেলেকে সেসব কথা বলে রাজি করান। সেই এক লাখ টাকায় বড় মামার শালা জালালের সাহায্যে জাফর কুয়েত চলে গিয়েছিল। তার তক্বদির খুব ভালো। কুয়েতে গিয়ে ভালো বেতনের চাকরি পায়। মায়ের খরচের জন্য দু’এক মাস অন্তর কিছু কিছু টাকা পাঠাত। একটানা দশ বছর চাকরি করে প্রচুর টাকা নিয়ে আসে। দেশে ফিরে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে মাকে নিয়ে চলে আসে। তারপর ব্যবসা শুরু করে। এখন তিনি ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীদের একজন। পরীবাগে জমি কিনে বাড়ি করার পর মায়ের কথামতো। তারই পছন্দ করা মেয়ে হামিদা বেগমকে বিয়ে করেন।
হামিদা বেগমের বাবা সরকারি উচ্চপদে চাকরি করেন। তিনি ঝিনাইদহের লোক। খুব সৎ ও ধার্মিক। তাই দীর্ঘ বিশ বছর উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার হওয়া সত্ত্বেও ঢাকায় জায়গা কিনে বাড়ি করতে পারেন নি। আজ ও সরকারি কোয়াটারে থাকেন। ঘটকের কাছে হামিদা বেগমের ফটো দেখে ও তার গুণাগুণ শুনে আসিয়া বিবি তাদের বাসায় গিয়ে সবকিছু যাচাই করে পছন্দ করেন। বিয়ের পাঁচ বছর পর হামিদা বেগম এক কন্যা সন্তান প্রসব করেন। সদ্য প্রসূত নাতনির রূপ দেখে হামিদা বেগম তার নাম রাখেন জুলায়খা বিবি। এরপর হামিদা বেগমের আর কোনো সন্তান হয় নি।
মায়ের প্রতি মামা-মামিদের অমানবিক ব্যবহার ও স্বার্থপর ও লোভী চাচার ব্যবহারে জাফর সাহেব তাদের কাউকেই বাসায় ঢুকতে দেন না। আসিয়া বিবি অনেকবার আত্মীয়দের সঙ্গে এরকম করতে নিষেধ করেছেন। জাফর সাহেব মায়ের পা জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলেছেন, “জীবনে কখনও তোমার কোনো কথার অবাধ্য হই নি, কিন্তু তোমার এই কথা আমি রাখতে পারব না। যে চাচা আমার বাবার সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য আমাকে এক বছরের সময় তোমার কোলে দিয়ে বের করে দিয়েছে, যে মামা-মামিরা একমুঠো ভাতের জন্য তোমাকে চাকরানীর মতো খাঁটিয়েছে, তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে মামারা আমাদের জন্য যতটুকু করেছেন, সেজন্যে তাদেরকে মাঝে মাঝে কিছু কিছু টাকা পয়সা পাঠিয়ে সাহায্য করব।
.
জাফর সাহেব একবিঘে জমির পূর্ব দিকে খুব সৌখিন প্যাটার্নের দোতলা বাড়ি করেছেন। নিচতলা ও দোতলার চারদিকে বারান্দা। ফাঁকা জায়গার উত্তর দিকে ফুলের বাগান। পশ্চিম দিকের অর্ধেক ও দক্ষিণ দিকের অংশটা ফাঁকা। সেটাই খেলার মাঠ। শুধু গেটের পাশে দারোয়ানের থাকার জন্য একটা রুম।
ইউসুফ পড়াতে শুরু করার পর জুলায়খার এনার্জি খুব বেড়ে গেল। আগে রাত নটা পর্যন্ত পড়ত। এখন এগারটা পর্যন্ত পড়ে।
কয়েদিনের মধ্যে তার পড়ার উন্নতি দেখে রবিউল স্যার একদিন জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার বলতো জুলায়খা? ক্লাসের সব সাবজেক্ট রাতেই পড়ে ফেল দেখছি?
ইউসুফ যে জুলায়খাকে পড়াচ্ছে, সেকথা রবিউল স্যারকে বলতে নিষেধ করেছিল। তাই স্যারের কথা শুনে জুলায়খা বলল, আব্বা এ বছর রোল নাম্বার এক করতে বলছেন, সে জন্যে আগের থেকে অনেক রাত পর্যন্ত পড়ি।
রবিউল স্যার খুশী হয়ে বললেন, এভাবে পড়লে আশা করি, তোমার আব্বার ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে।
পরের মাসে দু’তারিখে পড়ান শেষ হওয়ার পর আসিয়া বিবি এসে একটা খাম ইউসুফের হাতে দিয়ে বললেন, এটা এখন পকেটে রাখ, বাসায় গিয়ে দেখবে।
ইউসুফ আসিয়া বিবিকে জুলায়খার মতো দাদিআম্মা বলে। খামটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, এতে কি আছে দাদিআম্মা?
যাই থাকুক, বাসায় গিয়ে দেখ। এখন খেলতে যাও।
মাফ করুন দাদিআম্মা, না বললে নিতে পারব না।
এক হাজার টাকা আছে। তুমি জুলায়খাকে পড়াচ্ছ, তাই প্রতি মাসে তোমাকে এই টাকা দেব।
টাকার খামটা টেবিলের উপর রেখে ইউসুফ বলল, আবার মাফ চাইছি, ওকে পড়িয়ে টাকা নিতে পারব না।
এতটুকু ছেলের আত্মসম্মান জ্ঞান দেখে আসিয়া বিবি অবাক হলেন। বললেন, তোমাকে তো আমরা দয়া করছি না, এটা তোমার শ্রমের সম্মানী।
জুলায়খা আমার খেলার সাথি। ভালো রেজাল্ট করার জন্য সে আমার কাছে সাহায্য চেয়েছে, আমি সাহায্য করছি। সেজন্যে কিছুতেই টাকা নিতে পারব না। তারপর বুয়াকে চা নিয়ে আসতে দেখেও চলে আসতে লাগল।
জুলায়খা ছুটে এসে তার পথ আগলে বলল, চলে যাচ্ছ কেন? চা খাবে না?
না।
এবার জুলায়খা মুখ ভার করে বলল, খেলবেও না?
ভালো লাগছে না, যাই বলে ইউসুফ বেরিয়ে এল।
জুলায়খা তার দিকে তাকিয়ে রইল। গেট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ফিরে। এসে মাকে দেখে বলল, জান আম্মু, আমাকে পড়ার জন্য দাদিআম্মা ইউসুফ ভাইকে এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ও টাকা না নিয়ে রাগ করে চলে গেল। চাও খেল না।
হামিদা বেগমই শাশুড়ীর হাতে টাকাটা দিয়েছিলেন ইউসুফকে দেওয়ার জন্য। তিনি এতক্ষণ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলেন। মেয়ের কথা শুনে বললেন, রাগ করে যাবে কেন? আজ হয় তো ওর চা খেতে ইচ্ছা করছিল না। তাই চলে গেল।
ছলছল চোখে জুলায়খা বলল, আজ কার সঙ্গে খেলব?
হামিদা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, একদিন না খেললে কী হয়? কাল খেলবি।
পরের দিন বিকেলে শুধু ড্রাইভার ফিরে এলে জুলায়খা জিজ্ঞেস করল, ইউসুফ ভাই আজ স্কুলে আসে নি?
ড্রাইভার বলল, এসেছে। আমাকে দেখে বলল, “আমি আর ঐ বাসায় যাব না। আপনি আমাকে নিয়ে যেতে আসবেন না।”
কথাটা শুনে জুলায়খার কান্না পেল। দাদিআম্মার কাছে গিয়ে মুখ ভার করে বলল, ড্রাইভার ফিরে এসেছে, ইউসুফ ভাই আসে নি। বলেছে, সে আর কোনোদিন আমাদের বাসায় আসবে না। আপনি টাকা দিতে গেলেন কেন? বন্ধুকে পড়িয়ে কেউ টাকা নেয় বুঝি? এখন আমি কার সঙ্গে খেলব? পড়াশোনায় কে আমাকে সাহায্য করবে?
নাতনির মন খারাপ দেখে ও তার কথা শুনে আসিয়া বিবিরও মন খারাপ হয়ে গেল। অল্পক্ষণ চিন্তা করে বললেন, তুমি ওদের বাসা চেন?
না, ড্রাইভার হয়তো চেনে।
ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল। আমি ওকে নিয়ে আসতে যাব।
আনন্দে উফুল্ল হয়ে জুলায়খা বলল, সত্যি যাবেন দাদিআম্মা?
হ্যাঁ, সত্যি যাব।
আমিও যাব আপনার সঙ্গে।
ড্রাইভারকে বলে এসে তুমি তৈরি হয়ে নাও।
.
ইউসুফ স্কুল থেকে বাসায় এলে নূরজাহান বেগম জিজ্ঞেস করলেন, কীরে, আজ জুলায়খাদের বাসায় গেলি না যে?
জুলায়খার দাদির এক হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলে ইউসুফ বলল, ড্রাইভার নিয়ে যেতে এলে তাকে বলেছি, ওদের বাসায় আর যাব না।
এটা বলা তোর উচিত হয় নি। টাকা না নিয়ে ভালো কাজ করেছিস। তাই বলে তাদের বাসাতেই যাবি না, এ কেমন কথা? তুই-ই তো বলেছিলি, জুলায়খার কোনো খেলার সাথি নেই। তা ছাড়া তার মা ও দাদি তোকে খুব স্নেহ করেন। না গেলে সবাই মনে কষ্ট পাবেন।
ইউসুফ কিছু না বলে চুপ করে রইল।
কীরে, চুপ করে আছিস কেন? নাস্তা খেয়ে ওদের বাসায় যা।
এমন সময় স্বামীকে ফিরতে দেখে ছেলেকে আবার বললেন, কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তার টেবিলে আয়, তোর আব্বর সঙ্গে নাস্তা খাবি।
ইউসুফ যে জাফর সাহেবের মেয়েকে পড়ায় ও তার সঙ্গে খেলাধুলা করে, কয়েকদিন আগে ইয়াকুব সাহেব স্ত্রীর কাছে শুনেছেন। তাই নাস্তার টেবিলে তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আজ খেলতে যাস নি?
ইউসুফ মায়ের দিকে তাকাল।
নূরজাহান বেগম জুলায়খার দাদির টাকা দেওয়ার কথা বলে বললেন, ও আর ওদের বাসায় যাবে না বলছে।
ইয়াকুব সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, টাকা না নিয়ে খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছিস, তবে তাদের বাসায় না গিয়ে বোকার মতো কাজও করেছিস। তোর মায়ের মুখে শুনেছি, ঐ বাসার সকলে তোকে খুব ভালোবাসে। না গেলে ওঁরা তোকে অহঙ্কারী ভাববেন।
এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠতে শাকেরা বেগম কাজের বুয়াকে ডেকে বললেন, দেখতে কে এল?
একটু পরে কাজের বুয়া ফিরে এসে বলল, একজন বুড়ীমতো মহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। সঙ্গে একটা ছোট মেয়েও আছে। ওনাদের ড্রইংরুমে বসিয়েছি।
নূরজাহান বেগম বললেন, ঠিক আছে, তুমি যাও আমি আসছি। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি খাওয়া শেষ করে এস। আমি গিয়ে দেখি কে এল।
ড্রইংরুমে এসে শাকেরা বেগম সালাম দিলেন।
আসিয়া বিবি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আপনি মনে হয় ইউসুফের মা? জ্বি, আপনি ঠিক ধরেছেন। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারছি না?
আসিয়া বিবি মৃদু হেসে বললেন, আমাকে তো দেখেন নি, চিনবেন কী করে? তার পর নাতনিকে দেখিয়ে বললেন, জুলায়খা, আমি ওর দাদি। ইউসুফ ড্রাইভারকে আমাদের বাসায় যাবে না বলেছে। কারণটা জানতে এলাম।
জুলায়খা সালাম দিল।
নূরজাহান বেগম এতক্ষণ জুলায়খাকে ভালো করে দেখেন নি। সালাম এর উত্তর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন। ছোট মেয়ে যে এত সুন্দরী হয়, তা আগে কখনও দেখেন নি। ওমা তাই নাকি বলে এগিয়ে এসে তার পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বললেন, আল্লাহ তোমাকে যেমন সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি তোমার নামটাও খুব সুন্দর। আল্লাহ তোমাকে হায়াতে তৈয়েবা দিক, তোমাকে সুখী করুক। তারপর আসিয়া বিবির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাদের কথা ইউসুফের মুখে অনেক শুনেছি। ও আজ যাইনি বলে কিছুক্ষণ আগে আমি ও ওর আব্বা রাগারাগি করছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, না গিয়ে ভালই করেছে। নচেৎ নাতনিকে নিয়ে আপনি আসতেন না।
আসিয়া বিবি বললেন, আমরাও ইউসুফের মুখে আপনাদের কথা অনেক শুনেছি। তাই তো সুযোগ পেয়ে চলে এলাম। আপনারাও যাবেন। গেলে সবাই খুশী হব।
নূরজাহান বেগম বললেন, ইনশাআল্লাহ যাব। তারপর জুলায়খাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, কতদিন হয়ে গেল ইউসুফ তোমাদের বাসায় যাচ্ছে, আমাদের বাসায় আসতে তোমার ইচ্ছা করে না?
জুলায়খা মুখ ভার করে বলল, আসতে খুব ইচ্ছা করে। ইউসুফ ভাই একবারও আসতে বলে নি। বললে নিশ্চয় আসতাম।
নূরজাহান বেগম বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে নিয়ে আসার জন্য ওকে বলে দেব।
এমন সময় ইয়াকুব সাহেব সালাম দিয়ে ঢুকলেন।
আসিয়া বিবি এতক্ষণ মুখের নেকাব খুলে কথা বলছিলেন। তাড়াতাড়ি নেকাব ঢাকা দিয়ে সালামের উত্তর দিলেন।
নূরজাহান বেগম বললেন, উনি ইউসুফের আব্বা। তারপর স্বামীকে বললেন, ইউসুফ যায় নি বলে জুলায়খা দাদিকে নিয়ে এসেছে। তুমি কথা বল, আমি আসছি বলে চলে গেলেন।
ইয়াকুব সাহেব জুলায়খাকে দেখে স্ত্রীর মতো যেমন অবাক হলেন, তেমনি খুশী হলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন; তুমি মন খারাপ করো না মা, কাল থেকে ইউসুফ তোমাদের বাসায় যাবে। তারপর তার দাদির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি এসেছেন, আমরা খুব খুশী হয়েছি।
ইউসুফ কেন জুলায়খাকে পড়াচ্ছে আসিয়া বিবি সে ঘটনা বলে বললেন, আমরা খুশী হয়ে ওকে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলাম; কিন্তু ও যে অপমান বোধ করবে, তা ভাবি নি।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, ইউসুফ খুব সেন্টিমেন্টাল ছেলে। অফিস থেকে ফিরে কথাটা শুনে ওকে বুঝিয়ে বলেছি। কাল থেকে নিশ্চয় যাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে কাজের মেয়ে চা-নাস্তার ট্রে নিয়ে এল। তার পিছনে ইউসুফ ও নূরজাহান বেগম এলেন।
ইউসুফ ঢুকেই সালাম দিয়ে বলল, দাদিআম্মা আপনি?
সালামের উত্তর দিয়ে আসিয়া বিবি বললেন, না এসে উপায় কী ভাই? কাল থেকে তোমার বান্ধবীর বকুনী খেতে খেতে পেট ফুলে গেছে। আজ যদি না আসতাম, তা হলে হয়তো পেট ফেটে মরেই যেতাম। তুমি যে ভাই এত রাগী, তা জানতাম না।
ইউসুফ লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে নিল।
আসিয়া বিবির কথা শুনে ইয়াকুব সাহেব ও নূরজাহান বেগম বুঝতে পারলেন, উনি নাতনির মতো ইউসুফকেও স্নেহ করেন।
বললেন, ও ছেলেমানুষ, আপনি ওকে মাফ করে দিন।
আসিয়া বিবি ইউসুফকে পাশে বসিয়ে বললেন, কী ভাই? কিছু বলছ না কেন? কাল থেকে গাড়ি ফিরিয়ে দেবে না তো?
ইউসুফ আরো বেশি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু অবস্থাতেই সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল।
নূরজাহান বেগম বললেন, আপনি না এলেও যেত। নিন খালাআম্মা, এবার কিছু মুখে দিন।
আমি ওসব কিছু খেতে পারব না বলে আসিয়া বিবি বললেন, দু’টো বিস্কুট খেয়ে চা খাব। তারপর নাতনির দিকে তাকিয়ে বললেন, ইউসুফ যায় নি বলে তুমি তো কিছু খাও নি, এবার খাও।
চা-নাস্তা খেয়ে জুলায়খা দাদিকে বলল, আপনি ইনাদের সঙ্গে কথা বলুন, আমি ইউসুফ ভাইয়ের রিডিংরুমটা দেখে আসি। তারপর ইউসুফের কাছে এসে বলল, কই চল।
ইউসুফ তাকে নিয়ে একটা রুমে এসে বলল, এটাই আমার বেডরুম ও রিডিংরুম। ছোট ভাই বোনেরা পাশের রুমে থাকে। ওখানেই ওরা পড়ে। রবিউল স্যার পড়াতে এলে এখানে এসে পড়ে।
জুলায়খা রুমের চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার ভাই বোনেরা কোথায়?
আব্বা আমাদেরকে বাইরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতে দেন না। এমন কি ভাড়াটিয়াদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও না। তাই ছাদের চারপাশ গ্রীল ও তার উপরে তারের জাল দিয়ে ঘিরে দিয়েছেন। ওখানে আমরা খেলা করি। ওরা ছাদে খেলছে।
বুক সেল্ফের পাশে একটা কাঁচের আলমারীতে অনেক বই দেখে জুলায়খা আবার জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী বই?
ধর্মীয়।
তুমি এগুলো সব পড়েছ?
ইউসুফ মৃদু হেসে বলল, না। ক্লাসের পড়াই শেষ করতে পারি না, ওগুলো পড়ার সময় কোথায়? আব্বু-আম্মু পড়েন। তবে ফাইন্যাল পরীক্ষার পর যখন ক্লাসের পড়া থাকে না তখন কিছু কিছু পড়ি।
জুলায়খা বলল, নামায পড়ার জন্য আমাদের একটা রুম আছে। সেখানেও ধর্মীয় অনেক বই আছে। আব্ব বলেছেন, “বড় হয়ে তুমি সব বই পড়বে।” তারপর বলল, চল ছাদে যাই।
বাড়িটা চারতলা। ছাদের দৈর্ঘ্য ষাট ফুট আর প্রস্থ পঞ্চাশ ফুট। সিঁড়িঘর ছাড়া পুরো ছাদটা ফাঁকা। একদিকে কার্ণিশের গায়ে বিশ ফুট বাই দশ ফুট শুধু বেড়া দিয়ে ঘেরা। সেখানে টবে করে ফুলের বাগান করেছে ইউসুফ। রঙ বেরঙের নানা জাতের ফুল ফুটে রয়েছে।
ছাদে উঠে জুলায়খা ফুলের সমারোহ দেখে সেদিকে ছুটে গেল। তাদেরও এর থেকে অনেক বড় ফুলের বাগান আছে। মেয়ের ফুলের প্রতি আকর্ষণ জেনে জাফর সাহেব বছর খানেক আগে বাগানটা করেছেন। অনেক দুষ্প্রাপ্য ও দামি দামি ফুলের গাছ কিনে এনে লাগিয়েছেন। ইউসুফ কাছে এলে বলল, তোমাদের এখানে এমন অনেক ফুলের গাছ আছে, যা আমাদের বাগানে নেই। আবার আমাদের বাগানে যেসব আছে, তা এখানে নেই।
বনি ইয়ামিন ও সালমা সিঁড়িঘরের পাশে কেরাম খেলছিল। প্রথমে তারা। কেউ তাদেরকে লক্ষ্য করে নি। বোর্ড শেষ হওয়ার পর বনি ইয়ামিন হঠাৎ ভাইয়ার সঙ্গে একটা খুব সুন্দর মেয়েকে ফুলবাগানের কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে সালমাকেও দেখাল। তারপর বলল, চলতো দেখি মেয়েটা কে?
কাছে গিয়ে বনি ইয়ামিন ভাইয়া বলে ডাকল।
ইউসুফ তাদেরকে দেখিয়ে জুলায়খাকে বলল, এরাই আমার ভাইবোন বনি ইয়ামিন ও সালমা। ওদেরকে বলল, এ জুলায়খা। প্রতিদিন এর সঙ্গে খেলতে যাই।
জুলায়খা তাদেরকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের রোল নাম্বার কত? দুজনে একসঙ্গে বলল এক। ইউসুফের দিকে তাকিয়ে জুলায়খা বলল, তোমরা সবাই খুব ভালো ছাত্র।
এমন সময় কাজের বুয়া এসে বলল, খালাআম্মা আপনাদেরকে নিচে যেতে বলেছেন।
বনি ইয়ামিন ইউসুফকে বলল, ভাইয়া, তোমরা যাও, আমরা খেলব। ইউসুফ জুলায়খাকে নিয়ে নিচে নেমে এল।
ওদেরকে দেখে আসিয়া বিবি দাঁড়িয়ে বললেন, এবার আমরা আসি। আপনারা একদিন আমাদের বাসায় আসবেন। তারপর সালাম বিনিময় করে বিদায় নিলেন।
ওরা দোতলায় থাকে। ইউসুফ তাদের সঙ্গে নিচে এসে গাড়িতে তুলে দিল।