ছয়
ক্লাস এইটে উঠার পর জুলায়খা সাবালিকা হয়েছে। এ বছর নাইনে উঠেছে। রূপসীর রূপ আরো অনেক বেড়েছে। বড় চাদর দিয়ে মাথাসহ সারা শরীর ঢেকে গাড়িতে করে স্কুলে যায় আসে। এর মধ্যে যারা তার মুখ দেখে ফেলে তারা রূপ দেখে অবাক হয়।
আসিয়া বিবিও নাতনির রূপ দেখে অবাক হন। ইউসুফকে তার অনেক আগে থেকে পছন্দ। ভেবে রেখেছেন, নাতজামাই করবেন। তাই একদিন ছেলে বৌ-এর মতামত জানার জন্য তাদেরকে বললেন, তোমারা যে মেয়েকে ইউসুফের সঙ্গে মেলামেশা করতে দিচ্ছ, এটা কি ঠিক হচ্ছে?
স্বামী কিছু বলার আগে হামিদা বেগম বললেন, কথাটা তুলে ভালই করেছেন। ইউসুফকে আমার ও আপনার ছেলের খুব পছন্দ। আর ওর মা বাবাও খুব ভালো মানুষ। আল্লাহ রাজি থাকলে ভবিষ্যতে ওকে জামাই করতে চাই। কথাটা আপনাকে বলব বলব করেও বলা হয় নি।
স্ত্রী থেমে যেতে জাফর সাহেব বললেন, আপনার বৌমা ঠিক কথা বলেছে। আমি ওদের দেশের বাড়ির সব খবর নিয়েছি। খুব শরীফ বংশ। বিষয় সম্পত্তিও আছে। সবাই ধর্মকর্ম মেনে চলে।
আসিয়া বিবি বললেন, আমারও ইউসুফকে খুব পছন্দ। ওদের দুজনকে একসঙ্গে দেখলে পরানটা জুড়িয়ে যায়। তাই তো তোদের মতামত জানার জন্য কথাটা তুললাম। এখন কথা হল, এ ব্যাপারে ওর মা-বাবার সঙ্গে আলাপ করে রাখা ভালো বলে আমি মনে করি।
হামিদা বেগম বললেন, আমরাও ভেবেছি, ওঁদেরকে একদিন আসার জন্য ইউসুফকে বলব। তা না হলে আমরাই একদিন ওঁদের বাসায় গিয়ে কথা প্রসঙ্গে আলাপ করব।
আসিয়া বিবি বললেন, হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে।
.
ক্লাস সিক্স থেকে জুলায়খা স্কুল ড্রেসের উপর একটা বড় ওড়না গায়ে মাথায় দিয়ে স্কুলে যেত। এইটে উঠার পর একদিন ইউসুফ তাকে বলল, এবার বোরখা পরে তোমার স্কুলে যাওয়া উচিত।
জুলায় বলল, কেন? আমি তো বড় ওড়না দিয়ে মাথা ও সারা শরীর ঢেকে যাই। তা ছাড়া আমি তো জানি, বিয়ের পর মেয়েরা বোরখা পরে।
তোমার জানাটা ভুল। একটু বড় হলে, মানে সাবালিকা হওয়ার লক্ষণ মেয়েদের শরীরে ফুটে উঠলে বোরখা পরে বাইরে যাতায়াত করতে হয়। তুমি বড় ওড়না পরার কথা যে বললে, তাও চলে। তবে চোখ ছাড়া মুখও ঢেকে রাখতে হবে। আজকাল অনেক মেয়ে বোরখা পরলেও মুখে নেকাব দেয় না। এটা ঠিক নয়। কারণ পর পুরুষকে মুখ দেখানও ইসলামে নিষেধ। এই হুকুম বয়ঃপ্রাপ্ত কুমারী ও বিবাহিত সব মেয়েদের জন্য।
জুলায়খা বলল, এ কথা আমার জানা ছিল না। আজই আব্বুকে বোরখা কিনে দেওয়ার কথা বলব।
ক্লাস এইটের ফাইন্যাল পরীক্ষার পর একদিন ইউসুফ জুলায়খাকে বলল, তোমার পরীক্ষার রেজাল্টের কথা ভেবে কথাটা এতদিন বলি নি। আমি কিন্তু তোমাকে আর পড়াতে আসতে পারব না। তিন মাস পরে আমার ফাইন্যাল পরীক্ষা। বুঝতেই পারছ, কেন আসতে পারব না। অবশ্য পরীক্ষার পর আসব।
জুলায়খা বলল, তা পারছি; কিন্তু তুমি না এলে আমার যে খুব খারাপ লাগবে।
কেন? খারাপ লাগবে কেন?
ইউসুফকে প্রথম থেকে জুলায়খার খুব ভালো লাগত। তখন সে কিশোরী ছিল। এখন তরুণী। অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। তার তরুণী মনে ইউসুফ দাগ কেটেছে। তাকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছে। সাবালিকা হওয়ার পর নামাযের শেষে মোনাজাত করার সময় আল্লাহকে জানায়, ইউসুফের সঙ্গে যেন বিয়ে হয়। তার মনে হয়, ইউসুফের মতো ছেলে দুনিয়াতে আর কেউ নেই। তাই ইউসুফ যখন বলল, পরীক্ষার পড়ার জন্য তিন মাস আসতে পারবে না তখন মনের তাগিদে বলে ফেলল, “তার খুব খারাপ লাগবে।” কেন খারাপ লাগবে ইউসুফ জিজ্ঞেস করতে লজ্জায় আসল কথাটা বলতে না পেরে চুপ করে রইল।
ইউসুফ দাদির কাছে কুরআনের ইউসুফ জুলায়খার কাহিনী শোনার পর ভেবেছিল, কুরআনের তফসির পড়ে আরো ভালোভাবে তাদের কাহিনী জানবে। তারপর রবিউল স্যারের সঙ্গে গিয়ে যখন জুলায়খাকে দেখল এবং তার সঙ্গে মেলামেশা করতে শুরু করল তখন কুরআনের ইউসুফ জুলায়খার কাহিনী জানার আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠল। এইটের বাৎসরিক পরীক্ষার পর আলমারী থেকে কুরআনের অনুবাদ নিয়ে পড়ে। জুলায়খাকে দেখে ও তার সঙ্গে মেলামেশা করে যতটা না তাকে ভালো লেগেছিল, অনুবাদ পড়ার পর তা হাজার গুণ বেড়ে যায়। এতদিনে সেই ভালোলাগা গভীর ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। তাই জুলায়খা যখন বলল, তুমি না এলে আমার খুব খারাপ লাগবে তখন বুঝতে পারল, সেও তাকে ভালবেসে ফেলেছে। অনুমানটা কতটা সত্য জানার জন্য জিজ্ঞেস করেছে, “সে না এলে তার খারাপ লাগবে কেন?”
জুলায়খা লজ্জায় কিছু বলতে না পেরে একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
ইউসুফ তার মনের কথা বুঝতে পারল। বলল, আসব না বলতে মনে ব্যথা পেয়েছ, তাই না?
জুলায়খা চোখে ওড়না চাপা দিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
ইউসুফ তার ওড়নাসহ হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, আমার চোখের দিকে তাকাও।
জুলায়খা কম্পিত পাপড়ী খুলে তাকাল।
তুমি আমাকে খুব ভালবেসে ফেলেছ, তাই না?
ইউসুফ হাত ধরতে জুলায়খা লজ্জা পেয়েছিল। ভালবাসার কথা শুনে আরো বেশি লজ্জা পেয়ে তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখ বন্ধ করে মুখ নিচু করে নিল।
ইউসুফ চিবুক ধরে মুখটা তুলে বলল, আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না যে?
জুলায়খা চোখ বন্ধ করেই ফিস করে বলল, তুমি বুঝতে পার নি? তারপর হাত সরিয়ে দিয়ে পালাতে গেল।
ইউসুফ খপ করে তার একটা হাত ধরে বলল, আমি তোমাকে ভালবাসি কিনা জানবে না?
অনেক আগেই আল্লাহ আমাকে জানিয়েছেন বলে জুলায়খা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছুট দিল।
.
রাত্রে খাওয়ার সময় জুলায়খা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ইউসুফ ভাইয়ের তিন মাস পর এস. এস. সি পরীক্ষা। তাই এই তিন মাস পড়াতে আসতে পারবে না।
কেউ কিছু বলার আগে জাফর সাহেব বললেন, সে ভালো কথা বলেছে। তাকে এখন দিন রাত পড়তে হবে। তুই যদি চাস, অন্য একজন মাস্টার রাখার। ব্যবস্থা করব।
না আব্বু, তা করতে হবে না। রবিউল স্যারের কাছে তো সকালে পড়ি। ইউসুফ ভাই পরীক্ষার পর পড়ালেই চলবে। দরকার পড়লে মাঝে মাঝে আমি তাদের বাসায় যাব।
তা যেতে পারিস, তবে ঘন ঘন যাবি না। ওর পড়ার ডিস্টার্ব হবে। তা ছাড়া ওর মা বাবাও তোর উপর অসন্তুষ্ট হতে পারেন।
তুমি না বললেও ঘন ঘন যেতাম না। আর ওর মা বাবার কথা যে বললে, তা ঠিক নয়। ওঁরা আমাকে ভীষণ ভালবাসেন।
তা হয়তো বাসেন; কিন্তু ঘন ঘন গেলে ছেলের পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে অসন্তুষ্ট হবেন।
বললাম তো, তুমি না বললেও ঘন ঘন যেতাম না।
জাফর সাহেব আর কিছু না বলে খাওয়া শেষ করে চলে গেলেন। এবার আসিয়া বিবি বললেন, এই কটাদিন না গেলে কী হয়?
জুলায়খার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে গেল, দাদিআম্মা যেন কী? তিন মাসকে এই কটা দিন বলছেন। অতদিন ইউসুফ ভাইকে না দেখে থাকব কি করে। কথাটা বলেই বুঝতে পারল, মারাত্বক ভুল করে ফেলেছে। লজ্জায় লাল হয়ে ঝুঁটো হাতে ছুটে পালিয়ে গেল।
আসিয়া বিবি হাসতে হাসতে বললেন, কিছু বুঝতে পারলে বৌ মা?
হামিদা বেগম বললেন, জ্বি আম্মা, পেরেছি।
আসিয়া বিবি বললেন, আমি অনেক আগে ওদের মনের কথা জানতে পেরেছি। তাই তো তোমাদেরকে ইউসুফের মা বাবার সঙ্গে আলাপ করতে বলেছিলাম। ওঁরা খুশী মনে রাজি হয়েছেন শুনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি। আল্লাহর দরবারে সব সময় জানাই, “তিনি যেন আমাদের সবার মনের। ইচ্ছা পূরণ করেন।
.
ইউসুফের বড় বোন খাদিজা দু’দিন হল বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। সে জুলায়খাকে দেখে নি এবং তার সঙ্গে ইউসুফের সম্পর্কের কথাও জানে নি। এক বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। একটা বোরখা পরা মেয়েকে গাড়ি থেকে নেমে তাদেরই বিল্ডিং-এ ঢুকতে দেখে ভাবল, ভাড়াটিয়াদের কেউ হবে। একটু পরে কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে ঐ মেয়েটিকে দেখে খুব অবাক হল। জুলায়খা সিঁড়িতে উঠার সময় মুখের নেকাব সরিয়ে দিয়েছে। এত সুন্দর মুখ খাদিজা কখনো দেখে নি। সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কে আপনি? কাকে চান?
জুলায়খা সালাম দিয়ে বলল, আগে বলুন, আপনি কে? আপনাকে তো আগে কখনও দেখি নি।
খাদিজা বুঝতে পারল, এ মেয়ে আগে অনেকবার এসেছে। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমি এ বাড়ির বড় মেয়ে। দু’দিন হল শ্বশুরবাড়ি থেকে বেড়াতে এসেছি।
জুলেখা হাসি মুখে বলল, ও তাই না কী? আপনার কথা ইউসুফ ভাইয়ের মুখে অনেক শুনেছি। আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমি তো আপনার অনেক ছোট। চলুন ভিতরে বসে আলাপ করি।
খাদিজা আর কিছু না বলে তাকে নিয়ে ড্রইংরুমে এসে বসল। তারপর বলল, তোমার পরিচয় বল।
আমি জুলায়খা। ইনশাআল্লাহ এ বছর নাইনে উঠব। ইউসুফ ভাই আমার খেলার সাথি ও মাস্টার। বড় হয়ে গেছি বলে এখন আর খেলাধূলা করি না, শুধু পড়ি। ইউসুফ ভাইয়ের সামনে ফাইন্যাল পরীক্ষা, তাই এখন পড়াতে যায় না। পরীক্ষার পর আবার পড়াতে যাবে। আমার কোনো ভাই বোন নেই। তাই মাঝে মাঝে এখানে আসি। খালাআম্মা খালুজান কেমন আছেন?
খাদিজা বলল, ভালো আছেন।
নূরজাহান বেগম চা খাওয়ার জন্য খাদিজার খোঁজে ড্রইংরুমে এসে জুলায়খাকে দেখে বললেন, ওমা, তুমি কখন এলে?
জুলায়খা সালাম দিয়ে বলল, এই তো এলাম। আপাকে তো কখনও দেখি নি। তাই আলাপ করছি। ইউসুফ ভাই কোথায়?
সালামের উত্তর দিয়ে নূরজাহান বেগম বললেন, ওর রুমে পড়ছে। তুমি যাও, চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারপর খাদিজাকে বললেন, আয় চা খাবি।
ইউসুফের রুমের দরজার কাছে এসে জুলায়খা দেখল, তার গায়ে কিছু নেই। পাজামা পরে আছে। আলনা থেকে হাত বাড়িয়ে গেঞ্জি নিচ্ছে। খালি গায়ে তাকে কখনও দেখে নি। তন্ময় হয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার সুন্দর স্বাস্থ্যের দিকে তাকিয়ে রইল। ইউসুফ পড়তে পড়তে আসরের আযান শুনে মসজিদে নামায পড়তে গিয়েছিল। ফিরে এসে মাকে চা পাঠিয়ে দিতে বলে আবার বই নিয়ে বসল। কিন্তু পড়তে ভালো লাগল না। কেবলই জুলায়খার কথা মনে পড়তে লাগল। প্রতিদিন বিকেল হলেই তার কথা মনে পড়ে। তখন তাদের বাসায় যেতে ইচ্ছা করে। পরীক্ষার কথা চিন্তা করে মনকে প্রবোধ দেয়। আজও বোধ দিচ্ছিল; কিন্তু মন মানল না। আজ দশদিন জুলায়খাকে দেখে নি। দেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। ভাবল, আমার জন্য জুলায়খার কি মন ব্যাকুল হয় নি? নিশ্চয় হচ্ছে। তা হলে আসছে না কেন? সেদিন ভালবাসার কথা বলতে খুব লজ্জা পেয়েছিল। সেই জন্যেই কি আসে নি? আচ্ছা, পরীক্ষার জন্য আমি যে ওকে তিন মাস পড়াতে যাব না বলেছি, সে কথা কি ওর মা-বাবাকে বলেছে? মনে হয় বলেছে। তাই হয়তো আমার পড়ার ডিস্টার্ব হবে ভেবে ওঁরা আসতে নিষেধ করেছেন। তাই যদি হয়, তা হলে ওদের বাসায় থেকে একটু ঘুরেই আসি। এইসব চিন্তা করে পোশাক পাল্টাচ্ছিল। গেঞ্জির উপর জামা গায়ে দেওয়ার পর জুলায়খা সালাম দিল।
ইউসুফ চমকে উঠে তার দিকে তাকিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, স্বপ্ন দেখছি না তো?
স্বপ্ন কেন? আমি কি আগে কখনও আসি নি?
না, মানে এই কয়েকদিন তোমাকে না দেখে খুব খারাপ লাগছিল। তাই তোমার বাসায় যাব বলে তৈরি হচ্ছিলাম।
তা হলে এসে তো ভুল করে ফেললাম।
না-না ভুল নয়, ঠিকই করেছ। ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? ভিতরে এসে বস। তারপর জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ?
জুলেখা একটা চেয়ারে বসে বলল, আমার কথা থাক, তোমার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে বল।
মনে হচ্ছে, এই কয়েকদিন যাই নি বলে রাগ করেছ?
কী করে বুঝলে?
তোমার কথা শুনে?
রাগ করি নি, ব্যথা পেয়েছি। সহ্য করতে না পেরে চলে এলাম।
আমারও সেম কেস।
বুঝলাম না।
পড়াশোনার জন্য না হয় আমি যেতে পারি নি; কিন্তু তুমি তো আসতে পারতে? তাই আমিও ব্যথা পেয়েছি। সহ্য করতে না পেরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম।
প্রতিদিন আসার জন্য মন ছটফট করে। তোমার পড়ার ডিস্টার্ব হবে ভেবে আসি নি।
তুমি এলে আমার ডিস্টার্ব হবে, এটা তোমার ভুল ধারণা। বরং তুমি না এলে আমার পড়ার ক্ষতি হবে। তোমাকে দেখলে পড়ার এনাজী আরো বেড়ে যাবে। কারণটা তো সেদিন তুমি নিজেই বললে, আমি যে তোমাকে ভীষণ ভালবাসি, তা তুমি জান।
কথাটা শুনে জুলায়খা যেমন আনন্দিত হল, তেমনি লজ্জায় লাল হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। মুখ নিচু করে নিল।
তার লজ্জা কাটাবার জন্য বলল, কী? আসবে তো?
জুলায়খা মুখ নিচু করেই বলল, ঘন ঘন এলে খালাআম্মা ও খালুজী যদি তোমার পড়ার ডিস্টার্ব হবে ভাবেন? তা ছাড়া ঐ একই কথা বলে আব্বুও ঘন। ঘন আসতে নিষেধ করেছেন।
ওঁদের ভাবাটা ঠিক, কারণ ওঁরা তো আমাদের মনের অবস্থা জানেন না। তবে একথাও ঠিক, ইনশাআল্লাহ আমার রেজাল্ট দেখলে ওঁদের ধারণা ভুল। প্রমাণিত হবে। তারপর বলল, এখানে তো পর পুরুষ নেই, বোরখাটা খুলে ফেল না।
কয়েকদিন আগে দাদিআম্মা বললেন, যে চৌদ্দজনকে বিয়ে করা ইসলামে হারাম, তারা ছাড়া সবাই মুহাররম (পরপুরুষ)।
দাদিআম্মা ঠিক কথা বলেছেন। কথাটা আমার খেয়াল ছিল না। আল্লাহ মাফ করুক। এমন সময় কাজের বুয়াকে চা-নাস্তা নিয়ে ঢুকতে দেখে বলল, এস খাওয়া যাক।
খাওয়ার সময় ইউসুফ জিজ্ঞেস করল, আসবে কি না বললে না যে?
জুলায়খা বলল, আসব, তবে ঘন ঘন নয় সপ্তাহে দু’দিন।
এই কথায় দুজনেই হেসে উঠল।
খাদিজা মায়ের সঙ্গে এসে চা খেতে খেতে বলল, জুলায়খা তা হলে প্রায় আসে?
নূরজাহান বেগম বললেন, হ্যাঁ, আসে।
ওদের বাসা কোথায়?
পরীবাগে।
বড়লোকের মেয়ে বলে মনে হল।
হ্যাঁ, ওর বাবা বড় ব্যবসায়ীদের একজন। আমরা কয়েকবার ওদের বাসায় গিয়েছি। জুলায়খার মা, বাবা ও দাদি আমাদের বাসায় এসেছেন। ইউসুফ প্রায় তিন বছর ওদের বাসায় যাতায়াত করছে।
কিন্তু আম্মা, ইউসুফের এখন উঠতি বয়স। তা ছাড়া ওর সামনে ফাইন্যাল পরীক্ষা। এ সময় জুলায়খার আসাটা …।
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে নূরজাহান বেগম বললেন, তা আমরা জানি। আরো জানি, আর দশটা ছেলেমেয়ের মতো ওরা নয়। ওদের মেলামেশায় বাধা দিলে দু’জনেরই পড়াশোনার ক্ষতি হবে। তারপর কিভাবে ওদের দুজনের মেলামেশার সূত্রপাত হল, তা বলে বললেন, এ ব্যাপারে ওর মা বাবা এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। ওঁরা যেমন ইউসুফকে ভীষণ পছন্দ করেন, আমরাও তেমনি জুলায়খাকে পছন্দ করি। তাই আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে, উপযুক্ত বয়সে ও উপযুক্ত সময়ে ওদের বিয়ে দেব।
জুলায়খাকে দেখে ও তার সঙ্গে কথা বলে খাদিজারও ভালো লেগেছে। মায়ের কথা শুনে বলল, জুলায়খা আমার মনেও দাগ কেটেছে। তবু বলব, ইউসুফের পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত জুলায়খার ঘন ঘন আসা ঠিক নয়।
নূরজাহান বেগম বললেন, আমরা কিন্তু তা মনে করি না। আয় না দেখবি ওরা কি করছে বলে ইউসুফের রুমের দিকে এগোলেন।
খাদিজা মায়ের সঙ্গে এসে তাদের প্রথম দিকের কিছু আলাপ ছাড়া সবটাই শুনছে। কাজের বুয়া চা-নাস্তা দিয়ে চলে যাওয়ার পরও দাঁড়িয়ে রইল। যখন জুলায়খা ঘন ঘন নয়, সপ্তাহে দুদিন আসব বলার পর দুজনেই হেসে উঠল তখন মাকে ফিস ফিস করে বলল, তোমার কথা ঠিক। তুমি যাও, আমি ওদের কাছে যাচ্ছি বলে খাদিজা পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকল।
তাকে দেখে ইউসুফ ঈশারা করে জুলায়খাকে হাসতে নিষেধ করে বলল, এস আপা, তোমার সঙ্গে জুলায়খার পরিচয় করিয়ে দিই।
খাদিজা বলল, তার আর দরকার নেই।
ও যখন আসে তখনই পরিচয় হয়েছে। তা হ্যাঁরে, জুলায়খার সঙ্গে তোর অনেক দিনের সম্পর্ক, এখানে আসে, তুইও তিন বছর ধরে ওদের বাসায় যাতায়াত করছিস। এর মধ্যে আমি কতবার এলাম গেলাম, কই, একবারও তো ওর কথা বলিস নি?
ইউসুফ বলল, আমি মনে করেছি আম্মু তোমাকে বলেছে।
এবারে আসার দিন থেকে দেখছি, তুই সব সময় পড়ছিস। জুলায়খা গাড়ি নিয়ে এসেছে দেখলাম। যা-না কোথাও থেকে একটু বেড়িয়ে আয়।
ইউসুফ ঘড়ি দেখে বলল, আজ বেশি বেলা নেই। একটু পরে মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে যাবে। তারপর জুলায়খার দিকে তাকিয়ে বলল, তারচেয়ে বরং তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি চল। সেই সাথে সবার সঙ্গে দেখা করে আসব।
জুলায়খা কিছু বলার আগে খাদিজা বলল, তাই যা। তারপর জুলায়খাকে বলল, আবার যেদিন আসবে, সেদিন সবার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমিও যাব।
জ্বি আসব বলে জুলায়খা ইউসুফের সঙ্গে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল।