আট
যে বছর জুলায়খা এইচ. এস. সি. পাশ করে ডিগ্রীতে এ্যাডমিশন নিল, সে বছর ইউসুফ একাউন্টিং-এ অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাশ করল। এতদিনে উভয় ফ্যামিলী আরো ঘনিষ্ট হয়েছে। সবাই জেনে গেছে তারা একে অপরকে ভালবাসে এবং ইউসুফ চাকরি পেলে তাদের বিয়ে হবে।
ইউসুফের ইচ্ছা মাষ্টার্স করবে। এরমধ্যে আমেরিকা থেকে তার ছোট খালা আফসানা বেগম ভাগ্নাকে সি. এ. পড়ার জন্য ডেকে পাঠালেন।
আফসানা বেগমের স্বামী আব্বুর রউফ আমেরিকায় সেটেল্ড। সেখানে ব্যবসা করে বাড়ি-গাড়ি করেছেন। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। বছর দুই আগে সবাই বেড়াতে এসেছিল। সে সময় আফসানা বেগম ইউসুফকে বলেছিলেন, অনার্স পাশ করার পর সি. এ. পড়ার জন্য আমার কাছে চলে আসবি। আর বড় বোন ও দুলাভাইকেও ঐ একই কথা বলে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন। বছরখানেক হল ইয়াকুব সাহেব ফোন নিয়েছেন।
জুলায়খা প্রায়ই দিন রাত এগারটায় ইউসুফকে ফোন করে। তাই এই সময় ইউসুফ ড্রইংরুমে ফোনের কাছে থাকে। আজ রিং বেজে উঠতে রিসিভার তুলে সালাম দিয়ে বলল, কে? জুলায়খা?
আমেরিকা থেকে ইউসুফের ছোট খালা আফসানা বেগম ফোন করেছেন। ইউসুফের কথা শুনে বললেন, এটা ইয়াকুব সাহেবের বাসা না?
ইউসুফ বুঝতে পারল, জুলায়খা নয়, অন্য কেউ ফোন করেছে। বলল, জ্বি। আপনি কে বলছেন?
আমি আফসানা আমেরিকা থেকে ফোন করেছি। তুমি কে?
ছোট খালা আমি ইউসুফ। তারপর সালাম দিয়ে বলল, আপনারা কেমন আছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে আফসানা বেগম বললেন, ফোন ধরেই জুলায়খার কথা জিজ্ঞেস করছিলি কেন! ঐ নামে তো কাউকে চিনি না।
ইউসুফ লজ্জা পেয়ে একটু সময় নিয়ে বলল, ওকে আমি পড়াই। মাঝে মধ্যে এই সময় ফোন করে। তাই সে ফোন করেছে মনে করে বলে থেমে গেল।
ঠিক আছে, তোর রেজাল্টের কী হল? ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি। ভেরী গুড। তা আমাদের জানাস নি যে? এই তো কয়েকদিন আগে রেজাল্ট বেরোল। তোর মাকে দে।
রিসিভার পাশে রেখে ইউসুফ মায়ের কাছে গিয়ে বলল, ছোট খালা ফোন করেছে।
নূরজাহান বেগম রিসিভার ধরে বললেন, আফসানা তোরা কেমন আছিস? আফসানা বেগম বললেন, ভালো। তোমরা সব ভালো আছ? হ্যাঁ, আল্লাহর রহমতে ভালো। তোদের খবরাখবর বল।
আমাদের খবর ভালো। ইউসুফ ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে শুনে খুশী হয়েছি। সি. এ. পড়ার জন্য ওকে পাঠাবার কথা যে বলে এলাম, তার কী করলে?
এই তো কয়েকদিন হল রেজাল্ট বেরোল, এ ব্যাপারে কারো সঙ্গে এখনো কোনো আলাপ হয় নি।
আলাপ আবার কার সঙ্গে করবে। ইউসুফ ও দুলাভাইকেও তো কথাটা বলেছিলাম। তোমরা ওকে পাঠাবার ব্যবস্থা কর। টাকা পয়সার দরকার হলে আমি দেব।
ঠিক আছে, তোর দুলাভাইয়ের সাথে আলাপ করে জানাব। দুলাভাইকে দাও। ওতো সাড়ে দশটায় ঘুমিয়ে পড়ে, সে কথা তো তুই জানিস। ইউসুফ পাশে আছে? থাকলে ওকে দাও।
ইউসুফ পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। নূরজাহান বেগম তার হাতে রিসিভার দিয়ে বললেন, তোকে চাচ্ছে।
ইউসুফ ফোন ধরে বলল, ছোট খালা, কি বলবেন বলুন। তুই আসছিস তো? এ ব্যাপারে আম্মু আব্ব যা বলবেন তাই হবে। তোর ইচ্ছা কী বলবি তো? চিন্তা ভাবনা না করে আমি কোনো কিছু বলি না ও করি না। খুব সেয়ানা হয়ে গেছিস না?
সেয়ানা বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছেন জানি না। তবে আমি যা, তাই বললাম। তা ছাড়া আজ পর্যন্ত আম্মু আব্বুর মতের বাইরে আমি কিছু করি নি। তুমি আমাকে ভুল বোঝ না ছোট খালা।
তুই তো দেখছি, সত্যিই বেশ সেয়ানা হয়ে গেছিস। যাক, তোর মাকে একটু দে।
ইউসুফ মায়ের হাতে রিসিভার দিয়ে বলল, কথা বল, তারপর সেখান থেকে চলে গেল।
নূরজাহান বেগম রিসিভার ধরে বললেন, আর কিছু বলবি? আফসানা বেগম বললেন, ইউসুফ আছে? না চলে গেছে? চলে গেছে।
ও যে খুব সেয়ানা হয়ে গেছে। তা কী তোমরা জান?
কেন রে? ও কি তোকে সে রকম কিছু বলেছে?
ও ফোন রিসিভ করেই জুলায়খা কিনা জিজ্ঞেস করল। মেয়েটা কে জিজ্ঞেস করতে বলল, ওকে না কি পড়ায়।
ওতো ঠিক কথা বলেছে।
দুলাভাই ভালো চাকরি করে। নিজেদের বাড়িতে থাক, ভাড়াও অনেক টাকা পাও, তবু ও ছাত্রী পড়ায় কেন?
তুই যা ভাবছিস তা নয়। জুলায়খার মা বাবার সঙ্গে আমাদের পাকা কথা হয়ে আছে, ভবিষ্যতে ও আমাদের বাড়ির বৌ হবে।
তাই না কী? তা মেয়ের বাবা কি করেন।
উনি বড় ব্যবসায়ী। ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি আছে। মেয়ের মা-বাবা খুব ভালো। জুলায়খা তাদের একমাত্র সন্তান।
ভালো হলেই ভালো। তবু বলব, এক্ষুনি এতটা এ্যাডভান্স হওয়া তোমাদের
উচিত হয় নি। যাকগে, ওকে পাঠাবে কিনা বল।
বললাম তো, তোর দুলাভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে জানাব।
ঠিক আছে, তাই জানিও। এবার রাখছি বলে আফসানা বেগম লাইন কেটে দিলেন।
.
পরের দিন সকালে নাস্তা খাওয়াবার সময় নূরজাহান বেগম স্বামীকে ছোট বোনের ফোনের কথা বললেন।
ইয়াকুব সাহেব কিছু না বলে নাস্তা খেতে লাগলেন।
কিছু বললে না যে?
ইউসুফ যেতে চাইলে আমার অমত নেই। তোমার মতামত কী?
আমারও ঐ একই কথা। তবে ডিসিসান নেওয়ার আগে জুলায়খার মা বাবার সঙ্গে আলাপ করা উচিত।
মনে হয় ওঁরাও অমত করবেন না।
যাওয়ার আগে ওঁরা যদি এঙ্গেজমেন্ট অথবা কাবিন করে রাখতে চান?
তা চাইতে পারেন, তবে এটা নির্ভর করছে ইউসুফের উপর। সে যাবে কি না কিছু বলেছে?
এখনো জিজ্ঞেস করি নি।
জিজ্ঞেস করে দেখ কি বলে। তারপর যা করার করা যাবে।
নূরজাহান বেগম এক সময় ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর ছোট খালা যে সি. এ. পড়ার জন্য তোকে যাওয়ার কথা বলল, সে ব্যাপারে কিছু ভেবেছিস?
ইউসুফ বলল, আব্বকে জানিয়েছ?
হ্যাঁ।
কি বলল?
তার অমত নেই।
তুমিও তাই চাও?
চাইব না কেন? ছেলে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যাবে, কোন মা না চায়?
ঠিক আছে, চিন্তা করে দেখি।
খালার কাছে থেকে লেখাপড়া করবি, এতে চিন্তা করার কী আছে?
তোমার কথা ঠিক, তবু দু’একদিন একটু চিন্তা করে দেখি।
নূরজাহান বেগম বুঝতে পারলেন, জুলায়খা ও তার মা বাবার সঙ্গে আলাপ করার জন্য সময় চাচ্ছে। বললেন, তোর আব্বা বলছিল, জুলায়খার মা-বাবার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করবে।
সেটা তোমাদের ব্যাপার বলে ইউসুফ সেখান থেকে চলে গেল।
আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিতে কে না চায়? ইউসুফেরও যাওয়ার খুব ইচ্ছা। ভাবল, জুলায়খার মা বাবাও নিশ্চয় খুশী হবেন। কিন্তু জুলায়খা কি যেতে দেবে? আর সেও কি তাকে এতদিন না দেখে থাকতে পারবে? হঠাৎ তার বিবেক বলে উঠল, বড় হতে হলে মনকে শক্ত করতে হয়। তুমি না পুরুষ ছেলে? জুলায়খা মেয়ে। তার মন নরম। সে হয়তো বাধা দেবে। তাই বলে নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা করবে না? তা ছাড়া জুলায়খার বাবা তোমার বাবার থেকে অনেক বেশি ধনী। তার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করতে হলে তোমাকেও সেরকম উপযুক্ত হতে হবে। এইসব চিন্তা করে বিকেলে জুলায়খাকে পড়াতে গেল।
জুলায়খা পড়তে এসে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় করে বলল, কী ব্যাপার ইউসুফ ভাই? আজ তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? শরীর কী খারাপ?
তুমি ঠিকই ধরেছ। তবে শরীর খারাপ নয়। একটা ব্যাপারে চিন্তিত আছি।
ব্যাপারটা আমাকে বলা যাবে না?
বলা যাবে না কেন? বরং ব্যাপারটা নিয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।
বেশতো বল।
আমার ছোট খালু আমেরিকায় সেটেল্ড। ফ্যামিলী নিয়ে সেখানে থাকেন। গতরাতে ছোট খালা ফোন করেছিলেন। আমার রেজাল্ট শুনে সি. এ. করার জন্য আমাকে যেতে বলেছেন। কথাটা বলে ইউসুফ তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল চেহারার কোনো পরিবর্তন হয় কিনা দেখার জন্য। দেখল, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার মুখটা রক্তশূন্য হয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ দুজন দুজনের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
এক সময় জুলায়খার মায়াবী চোখ দুটো থেকে পানি গড়িয়ে গন্ডদেশের ওড়নায় পড়তে লাগল।
ইউসুফ ভেবেছিল, তার আমেরিকা যাওয়ার কথা শুনে জুলায়খা আপত্তি করে হয়তো বলবে, “তোমার আমেরিকায় সি. এ. পড়তে যাওয়ার দরকার নেই। এখানেই পড়। আমি তোমাকে না দেখে থাকতে পারব না।” কিন্তু তা না করে এভাবে আপত্তি করবে, তা চিন্তাই করতে পারে নি।
বলল, তুমি …?
ততক্ষণে জুলায়খা সামলে নিয়েছে। তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে চোখ মুখ মুছে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, তুমি উচ্চডিগ্রী নিতে আমেরিকা যাবে, এটা তো খুব আনন্দের কথা। তারপর জিজ্ঞেস করল, খালাআম্মা খালুজী কী বললেন?
জুলায়খা হাসিমুখে কথাটা বললেও ইউসুফের কানে করুণ শোনাল। বলল, তুমি যা বললে, ওঁরা তাই বলেছেন। আরো বলেছেন, তোমার আম্মু আব্বর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করবেন।
এবার তোমার মতামত বল।
আম্মু আমার মতামত জানতে চাইলে বলেছি, দু’একদিন চিন্তা করে বলব।
তোমার ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য আল্লাহ হয়তো একটা পথ করে দিতে চান। এতে চিন্তা করার কী আছে?
তা আমিও মনে করি; কিন্তু কেন যেন ভয় হচ্ছে, আমেরিকা গেলে তোমাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলব।
যাতে না হারিয়ে ফেল, সে ব্যবস্থা করে তারপর যাও। কথাটা বলে ফেলে জুলায়খা লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে নিল।
মারহাবা মারহাবা বলে, ইউসুফ বলল, তোমার তো দারুণ বুদ্ধি? কথাটা আমার মাথায় আসে নি। তারপর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, তোমার লজ্জারাঙা মুখ দেখলে মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য একত্রিত হয়ে তোমার চেহারায় প্রতিফলিত হচ্ছে। আরো কিছুক্ষণ এই মুখ দেখলে সত্যিই আমি পাগল হয়ে যাব। তারপর চিবুক ধরে মুখটা তুলে বলল, সেই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বল আল-আমিনের দরবারে শত কোটি শুকরিয়া জানাচ্ছি, যিনি তোমাকে এত সৌন্দর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।
জুলায়খা আরো বেশি লজ্জা পেয়ে হাত সরিয়ে দিয়ে ছুটে পালাতে গেল। ইউসুফ বলল, এই পালাচ্ছ কেন? আরো কথা আছে।
জুলায়খা না থেমে যেতে যেতে বলল, এক্ষুনি আসছি। তারপর বারান্দায় এসে চোখে মুখে পানি দিয়ে একটু পরে ফিরে এসে বসল।
ইউসুফ মৃদু হেসে বলল, পানি দিয়ে ধুয়ে কি আর সৌন্দর্য কমান যায়? বরং আরো বাড়ে।
জুলায়খা লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বলল তুমি শুধু আমার সৌন্দর্য দেখ; কিন্তু তোমাকে যে আল্লাহ কত সৌন্দর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তা যদি জানতে, তা হলে বার-বার একই কথা বলে আমাকে লজ্জা দিতে না।
ইউসুফ বলল, ওসব কথা থাক, আমার যাওয়ার ব্যাপারে আলাপ করি এস। তুমি খুশী মনে অনুমতি না দিলে যাব না।
বারে, প্রথমেই তো অনুমতি দিলাম।
তা দিয়েছ; কিন্তু তার আগে তোমার চোখের পানি আমাকে যেতে নিষেধ করেছে।
ওটা মেয়েদের নরম দিলের বহিঃপ্রকাশ।
তোমাকে কাঁদিয়ে আমি এতটুকু শান্তি পাব না। তা ছাড়া আমারও যেতে মন চাচ্ছে না।
কেন?
তোমাকে না দেখে অতদিন থাকতে পারব না। আর তুমি ও কী পারবে?
জুলায়খার চোখে আবার পানি এসে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলল, গেলে খালাআম্মা খালুজান ব্যথা পাবেন।
তারা ব্যথা পাবেন কেন? সি. এ. পড়লে এখানেই পড়ব।
তা পড়তে পারবে; কিন্তু ওঁরা তো সেকথা বলেন নি। বরং আমেরিকায় পড়তে যেতে বলেছেন।
জানতাম, ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের দীল নরম; কিন্তু তোমাকে তার বিপরীত দেখছি। ভেবেছিলাম, তুমি খুব আপত্তি করবে। এখন দেখছি তোমার আগ্রহই বেশি।
এবার আর জুলায়খা চোখের পানি সামলাতে পারল না। ছলছল চোখে বলল, দীলের খবর আল্লাহ ভালো জানেন। তোমাকে ছেড়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হবে। তবু যেতে বলছি কেন শুনবে?
ইউসুফ মাথা নেড়ে শুনতে চাইল।
জুলায়খা চোখ মুছে বলল, তুমি আমেরিকা গেলে আমি যতটা কষ্ট পাব, আমার কারণে তুমি যাবে না, একথা কেউ বললে তার থেকে অনেক বেশি কষ্ট পাব। তাই বলছি তুমি যাও। তা ছাড়া একথা তুমিও জান, পিতা-মাতার মনে ব্যথা দিতে আল্লাহ কুরআন পাকে নিষেধ করেছেন?
আর তোমার আব্ব আম্মু যদি যাওয়ার অনুমতি না দেন?
আমার যতদূর ধারণা, আম্মু অনুমতি না দিলেও আব্ব দেবেন।
আর তোমার দাদিআম্মা?
মনে হয় উনিও অনুমতি দেবেন। তবে যাওয়ার আগে হয়তো আমাদেরকে একসূতায় বাধার কথা বলতে পারেন।
দেখা যাক, আবু আম্মু ওঁদের সঙ্গে আলাপ করার পর রেজাল্ট কি হয়? আজ আর পড়াতে ইচ্ছা করছে না বলে ইউসুফ সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
ইউসুফ চলে যাওয়ার পর জুলায়খা নীরবে অনেকক্ষণ কাঁদল। আযান শুনতে পেয়ে চোখ মুখ মুছে অযু করতে গেল।
নামায পড়ে মোনাজাত করার সময় অনেক্ষণ কেঁদে কেঁদে আল্লাহর দরবারে গুণাহখাতা মাফ চেয়ে নিজের কামনা বাসনা জানাল এবং সবর করার তওফিক চাইল। তারপর মশাল্লা তুলে রেখে রিডিংরুমে যাচ্ছিল। এমন সময় দাদির গলা শুনতে পেল, “দাদুভাই শুনে যাও।”
জুলেখা ফিরে এসে দাদির পাশে বসল।
আসিয়া বিবি কখনও নাতনিকে এতক্ষণ ধরে এভাবে মোনাজাত করতে দেখেন নি। আজ দেখে কারণ জানার জন্য ডাকলেন। বসার পর জিজ্ঞেস করলেন, কী দাদু? এতক্ষণ কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে কি চাইলে?
ইউসুফের আমেরিকা যাওয়ার কথা শোনার পর থেকে জুলায়খা মনে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছিল। ইউসুফ যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ কোনোরকমে সংযত ছিল। সে চলে যাওয়ার পর শুধু কান্না পাচ্ছে। তাই মোনাজাতের সময় দীর্ঘ সময় কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে মনের সবকিছু জানিয়ে সবর করার সাহায্য চেয়ে মনের ব্যথাটা একটু কমেছিল। দাদিআম্মার কথা শুনে ব্যথাটা আবার টনটন করে উঠল। সামলাতে না পেরে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
আসিয়া বিবি মনে করলেন, পড়াতে এসে ইউসুফ হয়তো এমন কিছু বলেছে, যেজন্য মনে ব্যথা পেয়ে কাঁদছে। বললেন, কাঁদছ কেন দাদু? ইউসুফ কি কিছু বলেছে?
জুলায়খা কান্নার দমকে মুখে কিছু বলতে পারল না। মাথা নেড়ে সম্পতি জানাল।
নিশ্চয় তুমি কিছু অন্যায় করেছিলে? তা না হলে সে তো সেরকম ছেলে নয়।
জুলায়খা তাকে ছেড়ে দিয়ে ওড়নায় চোখ মুখ মুছতে মুছতে বলল, আমি কিছুই করি নি। তারপর ইউসুফের আমেরিকা যাওয়ার কথা বলল।
আসিয়া বিবি হেসে উঠে বললেন, ও এই কথা? তা এতে কাদার কী হল? বিদেশে লেখাপড়া করতে যাবে, এতো ভালো কথা। তবে যাওয়ার আগে তোমাদের বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে বলব জাফরকে।
বিয়ের কথা শুনে জুলায়খা লজ্জায় কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ইউসুফ ভাইয়ের বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে ওর মা বাবা আপনাদের সঙ্গে আলাপ করতে আসবেন। ওকে বিদেশে যেতে দিতে আমার মন চাচ্ছে না। আলাপ করতে এলে না করে দেবেন। আরো পড়তে চাইলে এখানেই পড়ক। ইউসুফ ভাইয়েরও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। বলল, “যে পড়ার জন্য বিদেশ যাবে, তা এখানেই পড়া যায়। শুধু আব্ব আম্মু মনে ব্যথা পাবে ভেবে যেতে চাচ্ছে।”
আসিয়া বিবি বললেন, বিয়ে করে ইউসুফ যদি তোমাকেও সঙ্গে নিয়ে যায়, তা হলে কেমন হয়?
জুলায়খা লজ্জা পেলেও বলল, তা হলে তো কোনো কথাই নেই।
আসিয়া বিবি মৃদু হেসে বললেন, এবার যাও পড়তে বস। আমি তোমার আবু আম্মুর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলব।
জুলায়খা যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল, আল্লাহ, তুমি দাদিআম্মার ইচ্ছা পূরণ কর।
রাতে খাওয়ার পর আসিয়া বিবি ছেলে বৌকে ডেকে বললেন, ইউসুফকে তার মা বাবা আমেরিকায় পড়তে পাঠাবেন। তারা আমাদের মতামত হয়তো নিতে আসবেন। আমার ইচ্ছা, ইউসুফ বিদেশে না গিয়ে দেশেই পড়ুক। আর তারা যদি একান্ত বিদেশে পাঠাতে চান, তা হলে ইউসুফ জুলায়খাকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
জাফর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, একথা কে আপনাকে বলেছে?
বিকেলে ইউসুফ পড়াতে এসে জুলায়খাকে বলেছে, জুলায়খা আমাকে বলেছে।
আপনি যা চাচ্ছেন, তা হয় না আম্মা। ইউসুফকে এখানে পড়ার কথা অবশ্য বলা যায়। কিন্তু বিয়ে করে জুলায়খাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা ঠিক হবে না। সে তো চাকরি করতে যাচ্ছে না? যাচ্ছে পড়তে। দু’জনকে পড়তে পাঠান মানে অনেক টাকার ব্যাপার। ইয়াকুব সাহেবের আর্থিক অবস্থা আমি জানি। তার পক্ষে অত টাকা বহন করা সম্ভব নয়।
উনি বহন করবেন কেন? আল্লাহ তোমাকে অনেক টাকা দিয়েছেন। তুমি ওদের খরচ বহন করবে।
আম্মা আপনার কথা ঠিক, কিন্তু ইয়াকুব সাহেব যদি অপমান বোধ করেন?
এতে অপমান বোধ করবে কেন? তুমি তো তাদেরকে টাকা দিচ্ছ না, মেয়ে জামাইয়ের লেখাপড়ার জন্য খরচ করছ। বলেই দেখ, মনে হয় খুশীই হবেন।
জাফর সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কী বল?
হামিদা বেগম বললেন, আমি আম্মার সঙ্গে একমত।
.
এরমধ্যে ইউসুফের বড় চাচা ইলিয়াস সাহেব মা রোকেয়া বিবিকে নিয়ে ছোট ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে এলেন।
ইয়াকুব সাহেব এক সময় মা ও বড় ভাইকে ইউসুফের আমেরিকা যাওয়ার কথা বললেন।
ইলিয়াস সাহেব খুব হিসেবি লোক। টাকা পয়সা খরচ করে বিদেশে ছেলেকে পড়াতে পাঠান পছন্দ করেন না। ইউসুফ তার ছোট খালার বাসায় থেকে পড়বে এবং তারাই খরচপত্র দেবে শুনে আপত্তি করলেন না। বললেন, খুব ভালো কথা। তা কবে যাবে না যাবে কিছু ঠিক করেছ?
মাত্র কয়েকদিন আগে ইউসুফের খালা ফোন করে ওকে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নি।
নাও নি এবার নিয়ে ফেল।
কিন্তু একটা সমস্যা আছে।
সমস্যা আবার কী?
ইয়াকুব সাহেব জুলায়খা ও তার মা বাবার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কথা বলে বললেন, ব্যাপারটা আপনাকে জানাব জানাব করেও জানান হয় নি। আম্মা অবশ্য অনেক আগেই জেনেছেন। ওঁদের বাসায়ও একদিন গেছেন। জুলায়খাকে আমাদের সবার পছন্দ। আম্মারও পছন্দ। ওর মতো মেয়ে আজকালের যুগে নেই বললেই চলে। মেয়ের বাবার আর্থিক অবস্থা খুব ভালো। জুলায়খা তাদের একমাত্র মেয়ে।
ছোট ছেলে থেমে যেতে রোকেয়া বিবি বললেন, ইয়াকুব ঠিক কথা বলেছে। জুলায়খা খুব ভালো মেয়ে।
ইলিয়াস সাহেব বললেন, শুধু মেয়ে ভালো হলে তো হবে না। তার মা, বাবা ও বংশ দেখতে হবে। আজকাল অনেক ছোটলোকেরা অসৎ পথে বড়লোক হচ্ছে। বংশের রক্তের একটা তাসির আছে।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, আপনি কী মনে করেছেন, আমি তাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর না নিয়েই জুলায়খাকে বৌ করতে চাচ্ছি।
তা হলে তো কোনো কথাই নেই। আজকালের মধ্যে আমরা তাদের সঙ্গে আলাপ করে আসি চল। তবে মনে রাখবে, তারা যাই বলুক না কেন ইউসুফ লেখাপড়া শেষ করে ফিরে এসে চাকরি করার পর বিয়ে হবে।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, তাতো বটেই। এখন বিয়ের প্রশ্নই উঠে না। তবে এঙ্গেজমেন্টর কথা বললে আমাদের আপত্তি করার কিছু নেই।
ইলিয়াস সাহেব বললেন, তবু আমাদের আগে বেড়ে কিছু বলার দরকার নেই। তোমরা কেউ কিছু বলল না, যা বলার আমি বলব।