অমর প্রেম – ৪

চার

শ্রাবণ মাস। তিন চারদিন আকাশে মেঘের ঘনঘটা থাকলেও ঢাকায় বৃষ্টি হয় নি। তবে উত্তর ও উত্তর পূর্ব বাংলা ও দক্ষিণ বাংলায় প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। আজ দুপুরের পর থেকে ঢাকায় মুষলধারে বৃষ্টি নামল। মাঝে মাঝে কয়েক মিনিটের জন্য একটু কমলেও পরক্ষণে বৃষ্টির গতি বেড়ে যাচ্ছে। পলিথিন ব্যাগের যথেচ্ছা ব্যবহারে ড্রেনগুলো বার মাস ভর্তি থাকে। একটু জোরে বৃষ্টি হলেই ড্রেন উপছে রাস্তা ডুবে যায়। তখন রাস্তার উপর থেকে পানির স্রোত বইতে থাকে। পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করার জন্য পেপারে অনেক লেখালেখি হলেও সরকারের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সরকার টিভিতে জনকল্যাণমূলক অনেক কিছু প্রচার করেন। কিন্তু পলিথিন ব্যাগের সুষ্ঠ ব্যবহারের কথা মাঝে মধ্যে এক-আধবার প্রচার করলেও তেমন ঢালাওভাবে করেন না। কেউ যেন আবর্জনা ভর্তি পলিথিন ব্যাগ ড্রেনে অথবা মেনহোলে না ফেলে, সে কথা সরকার যদি টিভিতে ভালোভাবে প্রচার করত, তা হলে বৃষ্টির সময় রাস্তা দিয়ে পানির স্রোত বইত না।

স্কুলের ছুটি হয় সাড়ে চারটেয়। আজ বৃষ্টির কারণে এক পিরিয়ড আগে যখন বৃষ্টি কমল তখন ছুটি হয়ে গেল। কিন্তু ছুটি হওয়ার পর ছেলেরা যখন হুড় হুড় করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এল তখন আবার খুব জোরে বৃষ্টি শুরু হল।

যাদের বাসা কাছাকাছি, তারা ভিজে ভিজে ছুট দিল। আর যাদের বাসা দূরে, তারা ছুটে গিয়ে আশপাশের বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নিল। আবার অনেকে স্কুলের বারান্দায় ফিরে এল।

জুলায়খাদের গাড়ির অপেক্ষায় ইউসুফ বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। তাদের মহল্লার তিন চারটে ছেলে কাকভিজে হয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল।

গতকাল ইউসুফদের বাসা থেকে ফেরার সময় জুলায়খা ড্রাইভারকে বলে দিয়েছিল ইউসুফকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য। আজ চারটের সময় ড্রাইভার যখন গাড়ি বের করল তখন গাড়িতে উঠে বসল।

প্রায় পনের মিনিট জোরে বৃষ্টি হওয়ার পর ধরে এল। তবে গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে। এমন সময় একটা প্রাইভেটকার বারান্দার কাছে এসে থামতে সবাই সেদিকে তাকাল।

জুলায়খাকে গাড়িতে দেখে ইউসুফ মনে পুলক অনুভব করল। এগিয়ে এসে বলল, আমার সাথিদেরকেও লিফট দিতে হবে। দেখছ না, ভিজে গেছে। তা ছাড়া এক্ষুনি হয়তো আবার বৃষ্টি জোরে আসতে পারে। ওরা আমাদের মহল্লার ছেলে।

জুলায়খা পিছনের সিটে বসে ছিল। কিছু না বলে গাড়ি থেকে নেমে সামনের সিটে বসল।

ইউসুফ সাথিদের উঠতে বলে নিজেও উঠে বসল।

গাড়ি চলতে শুরু করার পর আব্দুল জাব্বার নামে এক সাথি ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটা জুলায়খা, তাই না?

আব্দুল জাব্বারের সাথে ইউসুফের অন্যদের থেকে একটু বেশি সম্পর্ক। ইউসুফ যে জুলায়খাদের বাসায় প্রতিদিন খেলতে যায় এবং তাদের গাড়ি তাকে নিয়ে যেতে আসে, তা আব্দুল জাব্বার জানে। ইউসুফ হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে ঠোঁটে একটা আঙ্গুল ঠেকিয়ে চুপ থাকার জন্য ঈশারা করল।

গাড়ি পরীবাগ মসজিদের কাছে পৌঁছাবার পর আব্দুল জাব্বার ড্রাইভারকে বলল, আমাদেরকে এখানে নামিয়ে দিন।

বাসায় পৌঁছে নাস্তা খাওয়ার পর ইউসুফ জুলায়খাকে ঘন্টা খানেক পড়াল। তারপর বলল, আজ তো বৃষ্টির জন্য মাঠ ভিজে, খেলা যাবে না, বাসায় যাই।

জুলায়খা বলল, তুমি কেরাম খেলতে জান?

জানি, তবে তত ভালো না।

আমিও তোমার মতো। এস, আজ কেরাম খেলি।

খেলতে শুরু করে ইউসুফ বুঝতে পারল, জুলায়খা বেশ ভালই খেলে।

প্রথম গেমটা ইউসুফ ইচ্ছা করে হেরে গেল। তারপর দু’টো গেম নীলে হারিয়ে দিল।

জুলায়খা লজ্জা পেয়ে বলল, তুমি আব্বর থেকে পাকা। আবু কখনও নীল গেমে আমাকে হারাতে পারে নি। ইচ্ছা করে প্রথম গেমটা হেরেছ, তাই না?

ইউসুফ মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ। হেরে দেখলাম তুমি কতটা ভালো খেলতে পার। অবশ্য তুমিও চেষ্টা করলে প্রতিপক্ষকে নীলগেমে হারাতে পারবে।

চেষ্টা ছাড়া কেউ খেলে বুঝি?

তা খেলে না। তবে কী জান, তুমি গুটি ভালো ফেলতে পারলেও পতিপক্ষকে বাধা দেওয়ার পরিকল্পনা না করে শুধু গুটি ফেলতে থাক। আজ আর সময় নেই। অন্যদিন খেলার সময় বুঝিয়ে দেব। এবার আসি বলে ইউসুফ চলে গেল।

.

দ্বিতীয় ষান্মাসিক পরীক্ষায় জুলায়খা চতুর্থ ও বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে সেভেনে উঠল। তার রেজাল্ট দেখে সবাই খুশী। জাফর সাহেব মেয়েকে বললেন, তুই তোর কথা রেখেছিস। তাই কিছু উপহার দিতে চাই। বল কী চাস?

জুলায়খা বলল, ইউসুফ ভাই আমাকে সাহায্য করেছে বলে এত ভালো রেজাল্ট করতে পেরেছি। তাকে কিছু দেবে না?

নিশ্চয় দেব; কিন্তু সে যে ধরনের ছেলে, কিছু নেবে বলে মনে হয় না। টাকা দেওয়ার ঘটনাটা তিনি স্ত্রীর কাছে শুনেছিলেন। তাই বললেন, তুই-ই বল, তাকে কি দেব?

আমি কিছুই চাই না, আর ইউসুফ ভাইকেও কিছু দিতে হবে না। একটা আব্দার করব, সেটা পূরণ করলে আমাদের উপহার পাওয়া হয়ে যাবে।

বেশ তো বল, কী তোর আব্দার?

একদিন ইউসুফ ভাইদের বাসার সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়াতে হবে।

জাফর সাহেব হেসে উঠে বললেন, এটা আবার কোনো আব্দার হল? ঠিক আছে, তাই খাওয়াব।

আরও একটা আব্দার আছে। কাল শুক্রবার আমরা সবাই সারাদিন চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াব। ইউসুফ ভাই ও তার ছোট দু’ভাই বোন আমাদের সঙ্গে যাবে।

এতো খুব ভালো কথা; কিন্তু কাল দুপুরে যে এক বন্ধুর বাসায় আমাদের সবার দাওয়াত। পরে না হয় যে কোনো একদিন যাওয়া যাবে।

না আব্বু, তোমরা দাওয়াতে যাবে যাও, আমি ইউসুফ ভাইদের নিয়ে চিড়িয়াখানা বেড়াতে যাব। কাল সকালে তাদেরকে আমি আসতে বলেছি।

জাফর সাহেব মেয়ের জীদ জানেন। কি করবেন চিন্তা করতে লাগলেন।

হামিদা বেগমও মেয়ের একরোখা স্বভাবের কথা জানেন। তবু বললেন, তুই তোর আব্বুর কথা রাখবি না?

আমি আব্বুর সব কথা রাখি। আব্ব আমার একটা কথা রাখবে না কেন? নিশ্চয় রাখবে, তাই-না আব্ব বলে জুলায়খা তার গলা জড়িয়ে ধরল।

জাফর সাহেব কিছু বলার আগে হামিদা বেগম বললেন, তুই গাড়ি নিয়ে গেলে আমরা দাওয়াত খেতে যাব কী করে?

তাই তো? এ কথাটা মাথায় আসে নি বলে জুলায়খা বলল, কাল না গেলেও চলত; কিন্তু ইউসুফ ভাইয়ের কাছে আমি খুব ছোট হয়ে যাব। তুমি একটা কিছু উপায় বের কর না আব্বু।

জাফর সাহেব মেয়ের মাথায় আদর দিয়ে পাশে বসিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তোরা আমাদের গাড়ি নিয়ে যাবি। আমি বন্ধুকে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলব।  

এই তো গুড বয়-এর মতো কথা বলেছ। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মাথায় একটুও বুদ্ধি নেই। আব্ব কি সুন্দর বুদ্ধি বের করে ফেলল।  

হামিদা বেগম বললেন, তোর আব্ব গুড বয়, তাই তার মাথায় বুদ্ধি বেশি। যে দিন তোর আব্বুর মতো গুড বয় হতে পারব, সেদিন আমিও বুদ্ধি বের করব।

জুলায়খা হেসে উঠে বলল, সেনটেন্সটা ভুল বললে আম্মু, তুমি মেয়ে, গুড বয় হবে কেন? গুড গার্ল হবে।  

হামিদা বেগম মৃদু হেসে স্বামীকে বললেন, মেয়েকে অত আস্কারা দিও না, পরে পস্তাতে হবে।

জুলায়খা মায়ের আস্কারা ও পস্তাতে হবে কথাটা বুঝতে না পেরে আব্বুকে বলল, আম্মু তোমাকে কি বলল বুঝিয়ে দাও।

জাফর সাহেবও মৃদু হেসে বললেন, ছেলেমেয়েদের ন্যায় অন্যায় সব আবদার মেনে নিলে ভবিষ্যতে মা-বাবাকে অনুশোচনা করতে হয়, এই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছে।

আমি কি অন্যায় কিছু আবদার করেছি?

তা করিস নি।

জুলায়খা মাকে বলল, তা হলে তুমি ঐ কথা বললে কেন?

আসিয়া বিবি এতক্ষণ কিছু না বললেও এবার বললেন, জুলায়খা, তুমি আমার কাছে এস।

জুলায়খা এসে দাদির পাশে বসল।

আসিয়া বিবি তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমাকে না বলেছি, বড়দের কথার প্রতিবাদ করবে না? বিশেষ করে মা-বাবার? তারা যা বলবে, তা সব সময় মেনে নেবে?

জুলায়খা লজ্জিতস্বরে বলল, ভুল হয়ে গেছে দাদিআম্মা। আর কখন আম্মু আব্বুর কথার প্রতিবাদ করব না।

.

পরের দিন সকাল আটটার সময় ইউসুফ ছোট ভাই বনি ইয়ামিন ও ছোট বোন সালমাকে নিয়ে জুলায়খাদের বাসায় এল।

জুলায়খা তৈরি হয়ে মা-বাবার সঙ্গে ড্রইংরুমে ছিল।

ইউসুফ ঢুকে সালাম দিল। বনি ইয়ামিন ও সালমা ভাইয়াকে অনুসরণ করল।

জাফর সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে ইউসুফকে জিজ্ঞেস করলেন, নিশ্চয় তুমি চিড়িয়াখানায় আগেও গেছ?

জ্বি, দু’বার গেছি। তারপর তাদের পোশাক দেখে বলল, আপনারা যাবেন না?

না বাবা, যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারছি না। একজনের বাসায় আমাদের দাওয়াত আছে। তোমরা যাও, ড্রাইভার আছে, তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।  

হামিদা বেগম বড় বড় দুটো টিফিন ক্যারিয়ারে দুপুরের খাবার ও ক্যানে। পানি ভরে রেখেছেন। ড্রাইভারকে ডেকে সেগুলো গাড়িতে তুলে নিতে বললেন।  

সবাই গাড়িতে উঠার পর জাফর সাহেব ড্রাইভারকে সাবধানে গাড়ি চালাতে ও তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখতে বললেন। তারপর জুলায়খাকে বললেন, সন্ধ্যার আগে কিন্তু ফিরবে। ইউসুফকে জিজ্ঞেস করলেন, নিশ্চয় কিছু টাকা পয়সা নিয়েছ?

জ্বি, আম্মা পাঁচশ টাকা দিয়েছেন।

জাফর সাহেব তার হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে বললেন, এটাও রাখ। বেড়াতে যাচ্ছ দরকার হতে পারে।  

গাড়ি গেট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রবিউল স্যারকে আসতে দেখে জাফর সাহেব দাঁড়িয়ে রইলেন।  

রবিউল স্যার কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বললেন, ওরা সব কোথায় গেল।

জাফর সাহেব বললেন, ভিতরে আসুন বলছি। ড্রইংরুমে এসে বসতে বলে। নিজেও বসে বললেন, ওরা চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে গেল।

জুলায়খার রেজাল্ট গতকাল বেরোবার কথা ছিল, বেরিয়েছে?

হ্যাঁ, ও ফাস্ট হয়েছে।

জুলায়খা যেভাবে পড়াশোনা করেছে, এই রকমই আশা করেছিলাম।

তা আপনি ঠিক বলেছেন। তবে এর পিছনে ইউসুফের কৃতিত্ব বেশি।

রবিউল স্যার অবাক হয়ে বললেন, ইউসুফের কৃতিত্ব? ঠিক বুঝতে পারছি না।

জাফর সাহেব হেসে উঠে বললেন, ছয় সাত মাস আগে থেকে ইউসুফ যে ওকে প্রতিদিন বিকেলে পড়ায়, সে কথা আপনি জানেন না?

তাই নাকি? তা তো জানি না।

আপনার সঙ্গে ইউসুফ যখন প্রথম এখানে আসে তখন ওকে দেখে জুলায়খা খেলার সাথি করার জন্য তার মাকে বলে। তারপর কিভাবে খেলার সাথি ও তাকে পড়াতে রাজি হয় জাফর সাহেব বললেন।

রবিউল স্যার শুনে খুব আনন্দিত হলেন। ভাবলেন, এভাবেই হয়তো একদিন। ওরা একে অপরের মনের কাছে পৌঁছে যাবে এবং ভবিষ্যতে ভালবেসে ফেলবে। আল্লাহর মর্জি থাকলে ওদের বিয়েও হবে।

এমন সময় কাজের বুয়া চা-নাস্তা নিয়ে এলে জাফর সাহেব বললেন, চুপ চাপ কী এত ভাবছেন? নিন, নাস্তা খান।

রবিউল স্যার নাস্তা খেয়ে যখন চা খাচ্ছিলেন তখন জাফর সাহেব বললেন, জুলায়খার মুখে শুনেছি, ইউসুফের বাবার ও আপনার নাকি একই গ্রামে বাড়ি?

জ্বি, ঠিকই শুনেছেন।

তা হলে তো আপনি ওঁদের সম্পর্কে সবকিছু জানেন। বলুন তো শুনি।

রবিউল স্যার চিন্তা করলেন, ইউসুফকে নিশ্চয় ওঁদের ভালো লেগেছে। তাদের সম্পর্কে সবকিছু বলে বললেন, ইউসুফের বড় চাচার থেকে ওর বাবা আরো ভালো মানুষ। তার মতো মানুষ আমি দেখি নি। তারপর কৌতূহল চেপে রাখতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ ইউসুফের বাবা চাচাঁদের কথা জানতে চাইলেন কেন?

জাফর সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ইউসুফকে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়েছে, খুব ভালো বংশের ও ভালো মানুষের ছেলে। তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি?

এবার তা হলে আসি বলে রবিউল স্যার সালাম বিনিময় করে চলে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *