অনির্বাণ অমিতাভ – ৬

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

বুদ্ধদেব পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছেন। আশেপাশের ছোট বড় সব রাজ্যের প্রজারা তাঁর কাছে আসতেন। বুদ্ধদেব তাঁর যাতায়াত কালে কোনও সময়েই শিবিকা বা অন্য কোনও যানবাহনের ব্যবস্থা করেননি। তিনি পদব্রজেই এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে যেতেন। তিনি সবচেয়ে বেশি যে স্থানে বসবাস করেছিলেন সেটি হল রাজগৃহের নিকট অবস্থিত বেণুবন। এই স্থানটি রাজা বিম্বিসার তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। আর একটি স্থানেও তিনি বহুদিন বসবাস করেছিলেন সেটি অনাথ পিণ্ডিক প্রদত্ত মেটাবন। এই মেটাবন ছিল শ্রবস্তী নগরীর কাছাকাছি। এই দীর্ঘ সময় ধরে বুদ্ধদেব কঠোর পরিশ্রম করে তাঁর ধর্মপ্রচার করেছেন। তিনি ভোর হওয়ার আগেই শয্যাত্যাগ করতেন এবং এরপর তিনি স্নান করে সমাধিতে বসতেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল লোকেদের স্বভাব এবং চরিত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। যদি তিনি বুঝতেন কোনও ব্যক্তি সানন্দে এবং সাগ্রহে তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে তখন তিনি তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে দীক্ষা দিতেন। দিন শুরু হলে বুদ্ধ তাঁর পোশাক পরে নিতেন। তাঁর হাতে থাকত ভিক্ষাপাত্র। স্থানীয় জনসাধারণের কাছ হতে তিনি ভিক্ষা গ্রহণ করতেন। এই সময়ে তিনি কখনও একা যেতেন আবার কখনও অন্যান্য ভিক্ষুদের সঙ্গে সদলে যেতেন। সকল ভিক্ষুদের হাতেই ভিক্ষাপাত্র থাকত। তাঁরা শান্তি এবং সৌন্দর্য বজায় রেখে এক বাড়ি হতে আর এক বাড়ি ভিক্ষা অন্ন সংগ্রহের জন্য যেতেন। কখনও কখনও বাড়ির লোকজন বুদ্ধ এবং তার সঙ্গীদের তাঁদের বাড়িতে এসে আহার গ্রহণের জন্য অনুরোধ করত। বুদ্ধ কখনও কখনও এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করতেন। গৃহকর্তা বুদ্ধকে বসার আসন দিতেন, তাঁর সামনে অন্নপাত্র রাখতেন এবং বাড়িতে প্রস্তুত সবচেয়ে ভালো খাদ্যসামগ্রী তাঁকে পরিবেশন করতেন। খাওয়ার পরে বুদ্ধ হাতমুখ ধুতেন এবং তাঁদের সামনে খুব সহজ ও সরল ভাষায় বলতেন যে কাউকে সুখ দিলে বিনিময়ে সুখ পাওয়া যায়, পক্ষান্তরে কাউকে দুঃখ দিলে মনে দুঃখই আসে। তিনি আরও বলতেন তাঁরা যেন নিষ্ঠার সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের নিয়ম নীতিগুলি মেনে চলে। এর পর তিনি বিহারে ফিরে যেতেন। সেখানে তিনি কখনও গাছের তলায়, কখনও বেদিতে বসে থাকতেন। অপেক্ষা করতেন কখন সব ভিক্ষুরা ভিক্ষা শেষ করে বিহারে ফিরে আসবেন। সকলে এলে তাদের সামনে তিনি ধর্ম উপদেশ দিতেন। এই সময় কোনও কোনও ভিক্ষু আরও বেশি জানার জন্য বুদ্ধকে তাঁর উপদেশগুলি ব্যাখ্যা করে দিতে বলতেন। বুদ্ধ তখন ভিক্ষুদের জ্ঞান গ্রহণের সামর্থ্যের উপর ভিত্তি করে তাঁর ধর্ম উপদেশগুলি তাঁদেরকে বুঝিয়ে দিতেন। এ সময়ে আশেপাশের গ্রামগুলি থেকে অনেকে আসত। তারা সঙ্গে নানান উপটৌকনও নিয়ে আসত। সুন্দর প্রাঞ্জল ভাষায় এবং অপূর্ব শিক্ষাদান পদ্ধতির মাধ্যমে বুদ্ধ আগত ভক্তবৃন্দের সমস্যা দূর করতেন। বুদ্ধ তাঁদেরকে বলতেন ধর্ম জ্ঞানেরই শুধু বিষয় নয়, আচরণেরও বিষয়। সবশেষ করে বুদ্ধ বিহারের স্নানাগারে স্নান করতেন কিংবা কাছে কোনও নদী থাকলে সেখানে গিয়েও স্নান করতেন। স্নানের শেষে তিনি সমাধিতে বসতেন। এর পরেও তাঁর কাছে আরও লোকজন যারা আসত বুদ্ধদেব তাদের সব সমস্যা শুনতেন এবং তাদের সমস্যার সমাধানও করে দিতেন। এই সব করতে করতে কখনও কখনও ভোর হয়ে যেত। তখন ক্লান্তি দূর করার জন্য তিনি ইতস্তত হাঁটতেন। গভীর রাত্রিতে তাঁর কাছে রাজা এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রাজকর্মচারীরাও আসতেন। তাঁরা বুদ্ধদেবের সঙ্গে আলোচনার শেষে সন্তুষ্ট চিত্তে আপন আপন আবাসে ফিরে যেতেন। এই সময় তিনি যদি একটু ঘুমানোর সুযোগ পেতেন তাহলে তিনি ডান কাত হয়ে শুতেন, এই সময় তাঁর পা দুটি সামান্য ভাঁজ করা অবস্থায় থাকত। তিনি ভোর হওয়ার আগেই শয্যা ত্যাগ করতেন এবং সমাধিতে বসতেন। এই সময় তিনি পরের দিনের জন্য সম্ভাব্য আলোচনা ইত্যাদির একটি মানসিক পূর্ব পরিকল্পনা করে নিতেন। তিনি কঠোর পরিশ্রম করতেন তবুও তিনি ধর্ম উপদেশ দানে কোনওদিন শৈথিল্য প্রদর্শন করতেন না। যেসব দিন তিনি বাইরে যেতেন না সেসব দিন লোকজন তাঁর সামনে এসে জমা হত। অগাধ জ্ঞান এবং স্নিগ্ধ আচরণে তিনি সকলের মন জয় করে নিতেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর সুঠাম সুন্দর দেহসৌষ্ঠবও তাঁকে একটি উচ্চ আসনে বসিয়ে রাখত। যারা আসত তাদের কেউ কেউ প্রকৃত অনুসন্ধিৎসা নিয়ে আসত আবার কেউ কেউ অযথা প্রশ্নবাণে তাঁকে উত্ত্যক্ত বিরক্ত করার জন্যও আসত। যারা প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের জন্য আসত তারা তাদের প্রার্থনা মতো জ্ঞান অর্জন করতে পারত। আর যারা তাঁকে সামান্য জন প্রমাণ করার জন্য আসত তারা সকলেই শেষ পর্যন্ত তাঁর পাণ্ডিত্যের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হত।

পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে পরিভ্রমণ, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ধর্ম উপদেশ দান করতে করতে তিনি আশি বছর বয়সে উপনীত হলেন। তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন যে তাঁর শারীরিক সামর্থ্য তিনি ক্রমশ হারিয়ে ফেলছেন। যদিও তাঁর মানসিক শক্তি আগের মতোই প্রবল আছে। তিনি আরও অনুভব করতে পারলেন যে তাঁর পরমায়ু ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে। এই পৃথিবীতে তিনি আর বেশিদিন থাকতে পারবেন না। তাঁর এই সময় মনে হল তাঁর বাল্যকালের সুপরিচিত হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত নিজের জন্মস্থানের দিকে তিনি ক্রমশ এগিয়ে যাবেন। তাঁর মনের অভিপ্রায় ছিল সেখানে গিয়ে তিনি নির্বাণ লাভ করবেন। এ কারণে তিনি আনন্দ ও আর একদল ভিক্ষুকে নিয়ে রাজগৃহ ত্যাগ করলেন।

পরে উত্তরদিকে যাওয়ার পথে বুদ্ধ রাজধানী পাটলি এবং তার পরে আরও উত্তরে বৈশালী অতিক্রম করলেন এর আগে তিনি বৈশালীতে কিছুদিন ছিলেন। এই স্থানে তিনি বারবিলাসিনী আম্রপালীর নিকট হতে অমরাবন উদ্যান দান হিসাবে পেয়েছিলেন, এই আম্রপালী অনেক রাজা ও রাজপুত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বুদ্ধকে উপটৌকন দান করতেন। বুদ্ধদেব যখন বেণুবন গ্রামে উপস্থিত হলেন তখন তিনি সঙ্গী ভিক্ষুকদের আগত বর্ষা ঋতুর কারণে সেখানেই কিছুদিন বিশ্রাম নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। এই সময় বুদ্ধদেব হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অবশ্য এই অসুস্থতা তাঁর সম্পূর্ণ কেটেও গেল।

একদিন দুপুরবেলা আনন্দ বুদ্ধদেবের জন্য একটি গদি তৈরি করলেন যাতে তিনি বিহারের ছায়া স্নানে বসে আরাম করতে পারেন। তিনি বুদ্ধকে বললেন, ”আপনি সুস্থ হয়েছেন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি সর্বদাই চেয়েছি আপনি বেঁচে থাকুন। ততদিন বেঁচে থাকুন যতদিন না সব ভিক্ষুরা আপনার নিকট হতে যা জ্ঞান লাভ পাওয়ার পেয়ে যাচ্ছে।” বুদ্ধ বললেন, ”আনন্দ, আমার নিকট হতে ভিক্ষুরা আরও কী চাইছে? ধর্ম সম্বন্ধে যা কিছু বলার আমি তো তাদের বলে দিয়েছি। বলার মতো আমার তো আর কিছু নাই। এখন ভিক্ষুদের কাজ হবে তারা যে শিক্ষা পেয়েছে সেটা অনুশীলন করে যাওয়া। এই অনুশীলনের পর অবশ্যই তারা নির্বাণ লাভে অধিকারী হবে। আমি গোপন কিছু রাখিনি। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি। তোমাদের সকলের কল্যাণ হোক। আনন্দ আমি এখন বৃদ্ধ হয়েছি। আমার শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই আমার মৃত্যু ঘটবে। ইতিমধ্যেই আমার আশি বছর উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখন তোমরা নিজেদের উপরই শুধু নির্ভর কর। কেননা মানুষ মাত্রেরই কর্তব্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া। শুধুমাত্র অপরের উপর নির্ভর করে থাকা যায় না। ধর্মের উপরেই তোমাদেরকে নির্ভর করতে হবে। কারণ ধর্মই হল তোমাদের মনের মূল।” এরপর বুদ্ধ আরও বললেন, ”আনন্দ যে ভিক্ষু ধর্ম অনুশীলন করতে চায় সে সংঘের একজন উপযুক্ত সদস্য।” পরদিন ভোরে বুদ্ধ সুস্থ হয়ে উঠলেন এবং বৈশালী নগরের পথে ভিক্ষার জন্য বেরোলেন। ভোজনের পর তিনি পাবা স্তূপের দিকে রওনা হলেন। আনন্দকে বললেন গদিটি সঙ্গে নিয়ে যেতে যাতে তিনি দুপুর বেলা আরামে বিশ্রাম করতে পারেন। বুদ্ধ একটি গাছের নিচে বসলেন আর ভাবতে লাগলেন কীভাবে তাঁর মৃত্যুর ক্ষণটি কাটবে। আর মনস্থির করলেন তিনমাস পরে তিনি নির্বাণ লাভ করবেন। যখন আনন্দ তাঁর কাছে এলেন তিনি বললেন, ”আনন্দ, বৈশাখ মাসের পনেরো তারিখে আমি নির্বাণ লাভ করব। আর মাত্র তিনমাস বাকী আছে।” আনন্দ অনুনয় বিনয় করে তাঁকে জানালেন ”দয়া করে নির্বাণে যাবেন না। আপনি জীবিত থাকুন এবং জনসাধারণকে কষ্ট হতে ত্রাণ পাবার উপায় বলে দিন।” বুদ্ধ বললেন, ‘আনন্দ, বুদ্ধ কোনও অসাধারণ মানুষ নন। তিনিও জন্ম মৃত্যুরই অধীন। আমার মৃত্যু একদিন হবেই। কিন্তু এখন এসব কথা ভাবার প্রয়োজন নাই। চলো আমরা মহাবনে যাই। সেখানে বিহারে বৈশালীর সকল লোককে আসতে বলো।’ বুদ্ধের নির্দেশে আনন্দ বেরিয়ে গেলেন। ভিক্ষুরা যখন মহাবনে সমবেত হলেন আনন্দ বুদ্ধকে এই সংবাদ দিলেন। বুদ্ধ সকলকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপদেশ দিলেন। তাদেরকে বললেন তারা যেন বুদ্ধর নির্দেশগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। তাদের আচরণ যেন এমন হয় যে পৃথিবীর সকলে তাদেরকে আদর্শ হিসাবে মনে করে। তিনি আরও বললেন পৃথিবীর সবই নশ্বর এবং সবই মায়া, বিভ্রান্তি। তোমরা তোমাদের নিজেদের উৎকর্ষ বজায় রাখবে। মনকে সংযত করবে। কোনও সময়ে অসাবধান হবে না। কেবলমাত্র তখনই তোমরা কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পাবে। তখনই তোমরা জন্মমৃত্যুর চক্র হতে মুক্তি লাভ করবে।

একদিন সকালে তিনি বৈশালী শহরকে শেষ বারের মতো দেখে নিতে চাইলেন। তিনি এবং আনন্দ ভিক্ষার জন্য সেখানে গেলেন। আনন্দকে বললেন, ”আনন্দ আমি শেষবারের মতো বৈশালী শহরকে দেখছি। চল আমরা ভণ্ডগ্রামে যাই।” সেখানে তিনি কিছুক্ষণের বিশ্রাম করলেন। পরে সেখানকার লোকজনদের ধর্ম শিক্ষা দিলেন। এর পরে তিনি শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে হাত্থি, অম্বা, জাম্বু এবং সবশেষে ভোগ শহরে উপস্থিত হলেন, সেখানে তিনি আনন্দ স্তূপে এসে দাঁড়ালেন। সেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের বললেন বুদ্ধধর্ম শিক্ষার চারটি পথ আছে। এরপর তিনি গেলেন পাবা শহরে। সেখানে একজন স্বর্ণকারের পুত্র কুন্ডার আম্রকুঞ্জে হাজির হলেন। তিনি কুন্ডা এবং তার পরিবারের সদস্যদের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দিলেন। এরপর কুন্ডার নিমন্ত্রণে তিনি তাঁর বাড়িতে গেলেন। কুন্ডা তাঁদের জন্য যে আহার প্রস্তুত করেছিলেন তার মধ্যে চন্দন গাছে গজিয়ে ওঠা কিছু ছত্রাক ছিল। এটা খাওয়ার পর বুদ্ধর আগের অসুস্থতা আরও বেড়ে গেল। তাঁর অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল তবুও এই কষ্ট তিনি তাঁর সব শক্তি দিয়ে সহ্য করছিলেন। তাঁর হাঁটার বিরাম তিনি দেননি। তাঁর আশা ছিল তিনি কুশীনগরে পৌঁছবেন।

পথে বিশ্রাম নিতে নিতে তিনি কুশীনগরের দিকে এগিয়ে চললেন। পথে এক জায়গায় তিনি এক গাছের নীচে বসেছিলেন। সেখানে মাল্ল উপজাতির এক রাজপুত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য এলেন। তিনি ছিলেন বৃদ্ধ সন্ন্যাসী আরাদা কালামের একজন শিষ্য। বুদ্ধ তাঁকে ধর্ম এবং সংঘ সম্পর্কে কিছু বললেন। তিনি বুদ্ধকে সোনালি রঙের সুন্দর দুটি বস্ত্র উপহার দিলেন। বুদ্ধ একটি মাত্র বস্ত্র নিলেন এবং অন্যটি আনন্দকে দিতে বললেন। এরপর বুদ্ধ কাকুঠ্যা নদী পার হলেন। এরও পরে তিনি এলেন হিরণ্যাবতী নদীর তীরে। এই নদীটি কুশীনগরের সীমানার মধ্যেই ছিল। হিরণ্যাবতী নদীটি পার হয়ে তাঁরা হাজির হলেন শালবনে। এটি কুশীনগর শহরের ঠিক বাইরে অবস্থিত ছিল। এখানে মল্ল উপজাতির রাজ পরিবারের লোকজন অবসর সময় কাটাতেন। তিনি আনন্দকে বললেন, ”দুটি শালগাছ কেটে আমাকে শোয়ার ব্যবস্থা করে দাও। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।” আনন্দ বুদ্ধের বড় বস্ত্রখণ্ডটি চার ভাঁজে ভাঁজ করে দুটি শাল গাছের মধ্যের বিছানায় পেড়ে দিলেন, সেখানে বুদ্ধ উত্তর দিকে মাথা করে শুলেন। বুদ্ধ কিন্তু ঘুমোলেন না। তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। যন্ত্রণা ও ক্লান্তি লাঘব করার জন্য তিনি বিশ্রাম করতে চেয়েছিলেন। যন্ত্রণা ও ক্লান্তি সত্ত্বেও তাঁর মানসিক প্রশান্তি কিন্তু অক্ষুণ্ণ ছিল। আনন্দ বুঝতে পারছিলেন তাঁর গুরু বুদ্ধ এবার সত্যি সত্যিই দেহ ত্যাগ করতে চলেছেন। শোকে দুঃখে তিনি অধীর হয়ে উঠেছিলেন। তিনি একটু দূরে সরে জঙ্গলের আড়ালে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি মনে মনে নিজেকে বললেন, ”আমি এখনও অর্হন্ত হয়ে উঠতে পারিনি। আমার শেখা ও জানার অনেক বাকি আছে। কিন্তু আমারগুরু বুদ্ধ তো দেহত্যাগ করতে চলেছেন। তিনি চলে গেলে আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে না। আর আমি আমার দয়ালু প্রভুকে চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলব।” তাঁর চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছিল।

বুদ্ধ চোখ খুললেন। চারপাশে দেখলেন, কিন্তু আনন্দকে দেখতে পেলেন না। তাঁর পাশে আর যারা ভিক্ষু ছিল তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ”আনন্দ কোথায় গেল?” তারা বলল, ”আনন্দ এক নির্জন জায়গায় গিয়ে কাঁদছেন। তিনি ভাবছেন তাঁর তো এখনও অর্হন্ত হওয়া হয়নি। অথচ তাঁর গুরু বুদ্ধ যদি দেহত্যাগ করেন তাহলে তাঁর শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” বুদ্ধ বললেন, ”ভিক্ষু তুমি যাও। আনন্দকে নিয়ে এসো। তাকে বল আমি তাকে ডাকছি।” একজন ভিক্ষু আনন্দকে ডেকে নিয়ে এল। আনন্দ মাথা নীচু করে উপস্থিত হলেন। বুদ্ধ তাকে সদয় এবং সহানুভূতির সুরে সান্ত্বনা দিলেন। অন্যান্য ভিক্ষুদের সামনে তিনি আনন্দের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। বললেন, ”অতীতের সকল বুদ্ধরাই অতি উত্তম একজন সহচর পেয়েছিলেন কিন্তু তাদের কেউই আনন্দের সমকক্ষ ছিলেন না। আনন্দ আমার জন্য যা করেছে তারা কেউই তা করতে পরেনি। ভবিষ্যতে যে সব বুদ্ধ আসবেন তাদেরও এত ভালো অনুচর হবে না। আনন্দ আমার সবচেয়ে ভালো ও বিশ্বস্ত পার্শ্বচর। আনন্দ জানে কীভাবে অতিথিদের সঙ্গে আমাকে দেখা করাতে হয়। এইসব অতিথিদের সঙ্গে আনন্দ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কথা বলেছেন। অতিথিরা সকলেই আনন্দের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যেত। যখনই আনন্দ শান্ত কণ্ঠে কারও সঙ্গে কথা বলত সেই ব্যক্তি খুব খুশি হত। আনন্দের কথায় সকলে বিশ্বাস করত। আনন্দ আমার সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গী।” এরপর আনন্দ বললেন, বুদ্ধ দয়া করে এখন নির্বাণ নেবেন না। এ জায়গাটা নির্জন। এখানে লোকজন কম। অনুগ্রহ করে অনুমতি দিন আমরা আপনাকে রাজগৃহ, শ্রাবস্তী, বৈশালীর মতো বড় শহরে নিয়ে যাব এবং সেখানেই আপনি নির্বাণ লাভ করবেন। ওই সব শহরে আপনার অনেক প্রভাবশালী ও শক্তিশালী শিষ্য আছেন। তাঁরা আপনার শেষ কৃত্য উপযুক্ত মর্যাদার সঙ্গে করবেন। বুদ্ধ বললেন, ”আনন্দ তুমি এরকম কথা বল না। এ কথা বল না যে এই স্থানটি কোনও গুরুত্বপূর্ণ স্থান নয়। অনেকদিন আগে এখানে বিশাল এক শহর ছিল। এই শহরে বসবাস করতেন একজন চক্রবর্তী রাজা। আনন্দ, তুমি কুশীনগরে গিয়ে রাজাকে বল আজ রাত্রিরে শেষ প্রহরে বুদ্ধ এই বার নির্বাণ লাভ করবেন। যদি তাঁদের মনে হয় তাঁরা যেন তার আগেই এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন।” আনন্দ বুদ্ধের নির্দেশ অনুযায়ী কুশীনগরে গেলেন, আরও কয়েকজন ভিক্ষুও তাঁর সঙ্গে গেলেন এবং রাজা মল্লকে এবং তার লোকজনদেরকে বুদ্ধের সব কথা জানালেন।

যখন রাজা এবং তাঁর লোকজন আনন্দের কাছে শুনলেন যে বুদ্ধ নির্বাণ গ্রহণ করতে চলেছেন তাঁরা সকলেই শোকে অধীর হয়ে উঠলেন। অনেকে কাঁদতেও শুরু করলেন। তাঁরা বললেন, ”বুদ্ধ এত আগে কেন আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন? তাঁর নির্বাণের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর সব আলোও যে নির্বাপিত হবে।” স্ত্রী পুরুষ এবং শিশুরাও কাঁদতে কাঁদতে শালবনে এসে উপস্থিত হলেন। বুদ্ধ শান্তভাবে শুয়ে ছিলেন। তিনি চাইছিলেন যেন তাঁর নির্বাণের আগে তাঁর সকল ভক্ত তাঁকে দেখতে পারেন। সকলেই শৃঙ্খলা মেনে এবং নীরবে সেখানে বসে রইলেন। বুদ্ধকে ছেড়ে কারোরই সেই স্থান ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করছিল না।

ভিন্ন ধর্মাবলম্বী একজন যাযাবর তরুণ সেই সময় কুশীনগরে উপস্থিত ছিল। তার নাম সুভদ্র। সে যখন শুনল বুদ্ধ দেহত্যাগ করতে চলেছেন তখন কিছু জানবার জন্য সে বুদ্ধের কাছে এল। প্রশ্নগুলো অনেকদিন ধরেই তার মন আকুল করে তুলেছিল। সে ভেবেছিল একমাত্র বুদ্ধই তার প্রশ্নটগুলোর উত্তর দিতে পারবেন এবং তার প্রশ্নের সমাধান ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে পারবেন। শালবনে এসে সে আনন্দের কাছে অনুমতি চেয়ে বুদ্ধের কাছে যেতে চাইল। আনন্দ কিন্তু রাজি হচ্ছিলেন না। কারণ বুদ্ধ সে সময় ক্লান্ত এবং অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন। সুভদ্র কিন্তু বারবারই আনন্দকে অনুরোধ করে চলেছিলেন আর আনন্দ বারবারই তাকে প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছিল। এই বাদানুবাদ বুদ্ধের কানে পৌঁছালে বুদ্ধ আনন্দকে বললেন, ”ওকে বাধা দিও না। আমার কাছে আসতে দাও। সে কি জানতে চায় তার সমস্যাগুলি কি আমি শুনি। এটা স্পষ্ট সে বৌদ্ধধর্ম অনুশীলন করে। অকারণে সে আমার কাছে অসেনি।” অগত্যা আনন্দ সুভদ্রকে অনুমতি দিলেন। আর বুদ্ধ প্রশান্ত চিত্তে তার সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। এই সুভদ্রই হল বুদ্ধের সর্বশেষ শিষ্য যাকে বুদ্ধ ভিক্ষু হিসাবে বৌদ্ধধর্মে মান্যতা দিলেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় কৌনদিন্য ছিলেন বুদ্ধদেবের প্রথম শিষ্য যাকে বুদ্ধ মৃগদাভতে দীক্ষা দিয়ে ছিলেন। নিষ্ঠাবান সুভদ্র অল্প কয়েকদিনের মধ্যে অর্হন্তে পরিণত হলেন।

বুদ্ধ এবার অন্যান্য ভিক্ষুদের প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে চাইলেন। তিনি বললেন, ”আমার নির্বাণের আগে তোমাদের শেষ প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি দিতে চাই। তোমরা জানো তোমাদের সকল কাজকর্মই অচিরস্থায়ী এবং তোমরা সেগুলির প্রতি কখনওই নজর দিও না, সেগুলি থেকে তোমরা সম্পূর্ণরূপে পৃথক হয়ে থেকো।”

এরপর বুদ্ধ সমাধি মগ্ন হলেন এবং ধ্যানের নবম স্তরে পৌঁছে গেলেন। নবম এই স্তর থেকে তিনি ধ্যানের চতুর্থ স্তরে আবার ফিরে এলেন। এরপর তিনি নিজেকে পঞ্চবন্ধন হতে বিযুক্ত করে নিলেন। এই পঞ্চবন্ধন মানুষকে জন্ম মৃত্যু চক্রে বদ্ধ করে রাখে। এই প্রচেষ্টার ফলে তিনি নিজেকে জন্ম মৃত্যু চক্রের হাত থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করলেন। এরপর আর তাঁকে পৃথিবীতে কিংবা বিশ্বে অন্য কোথাও জন্মগ্রহণ করতে হবে না। এই ভাবে কুশীনগরে আর এক বৈশাখী পূর্ণিমায় দিব্যজ্ঞানপ্রাপ্ত বুদ্ধ আশি বছর বয়সে ইহজগতের বন্ধন ছিন্ন করলেন। প্রজ্বলিত আলোর দীপ নিভে গেল কিন্তু ধর্মের প্রদীপ অনির্বাপিত রয়ে গেল। বুদ্ধর নির্বাণে তাঁর ধর্ম হাজার হাজার লোকের মনের মধ্যে এক অনির্বাণ জ্যোতি প্রজ্বলিত করে গেল। এই ধর্ম জীবন মৃত্যু চক্র হতে নির্বাণ লাভের পথ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *