অনির্বাণ অমিতাভ – ১

প্রথম পরিচ্ছেদ

কপিলাবস্তু ছোট রাজ্যগুলির মধ্যে একটি। এই রাজ্যটি রাপ্তি নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত ছিল। হিমালয়ের পাদদেশে এর অবস্থান। ছোট এই রাজ্যটির রাজা ছিলেন শাক্য গোষ্ঠীর রাজ্য শুদ্ধোদন। তাঁর পারিবারিক নাম ছিল গৌতম। তাঁর রানির নাম ছিল মহামায়া। একদিন রাত্রিতে রানি মায়া এক স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নটি খুবই আশ্চর্যজনক। তিনি দেখলেন একটি বিরাট শ্বেত হস্তী তাঁর ঘরে প্রবেশ করেছে। এই হস্তীটি একটি পদ্মফুলও ধারণ করে আছে। এই হস্তীটি তিনবার তাঁর বিছানা প্রদক্ষিণ করল। এটি বৃংহিত নাদ করছিল।

সকালে রাজা তাঁর সভার জ্ঞানীগুণীদের ডেকে পাঠালেন। রানির এই আশ্চর্য স্বপ্নের কারণ কি তা তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁরা একমত হয়ে রাজাকে বললেন, ‘হে রাজন রানি মায়ার একটি পুত্রসন্তান জন্মাবে। আর এই পুত্র হবে একজন মহানায়ক—মহান পুরুষ।’ রাজা ও রানি উভয়ই এই কথা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। কয়েক বছর পরে রানি মায়া অন্তঃসত্ত্বা হলেন। রানি রাজাকে অনুরোধ করলেন রাজা যেন তাঁকে তাঁর পিতৃগৃহে যাওয়ার অনুমতি দেন। তাঁর সন্তান জন্মাবে তাঁর পিতৃগৃহে। তাঁর এই পিতৃগৃহ ছিল দেবদর্শিতা নগরে। রাজা সানন্দে তাঁকে অনুমতি দিলেন। তিনি তাঁর অনুচরদের আদেশ দিলেন যেন রানির যাত্রাপথ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও বিপন্মুক্ত থাকে। রাস্তার দুপাশে যেন সুন্দর সুন্দর বৃক্ষরাজি থাকে। পথে যেন তাঁর প্রিয় মহিষীর কোনও অসুবিধা না হয়।

কপিলাবস্তু এবং দেবদর্শিতা এই দুই নগরের সংযোগস্থলে ছিল লুম্বিনী উদ্যান। প্রতি বৎসর গ্রীষ্ম ঋতুতে দুই নগরের অধিবাসীরা এই উদ্যানে জমায়েত হতেন। এখানে তাঁরা বিশ্রাম করতেন খেলাধুলা করতেন। এখানকার পত্রবহুল শালগাছের ছায়ায় তাঁরা বিশ্রামও করতেন। এ ছাড়াও এই উদ্যানে অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলও ফুটে থাকত। শোনা যেত পাখিদের মধুর কূজন আর মৌমাছিদের সুমধুর গুঞ্জন সুর। গাছের ডালে এরা বাসা করত। বড় শান্তিপূর্ণ এই পটভূমিতে রানি যেদিন হাজির হলেন সেদিনটিও ছিল ১৫ই জুন, শুক্রবার খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৭। এই জন্মদিনটি এখন অবশ্য মে মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উদযাপিত হয়ে থাকে। ক্রমে দুপুর সময় হতে চলল। প্রচণ্ড গরমে রানি বড় কাতর হয়ে পড়লেন। তিনি অনুচরদের থামতে নির্দেশ দিলেন। তিনি চাইছিলেন কিছু সময় বিশ্রাম নিতে। গাছের সুশীতল ছায়ায় তিনি আশ্রয় নিলেন। কিন্তু কিছু পরেই তাঁর গর্ভযন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। এই মনোরম সুন্দর দৃশ্য দেখার সুযোগ তাঁর বেশি সময় হল না। কিছু পরে পাখিদের কূজন এবং মৌমাছিদের সুন্দর গুঞ্জন শুনতে শুনতে তিনি এক পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। তাঁর সঙ্গে আগত প্রাসাদের দাসী ও পরিচারিকারা তাঁর ও নবজাতকের সেবাযত্ন করতে লাগল। তারা তাঁকে কপিলাবস্তুতে ফিরে যেতে অনুরোধও করল। রাজা শুদ্ধোদনও রানিকে ফিরে আসতে দেখে অতি আনন্দিত হলেন। ছেলেকে দেখে তাঁর মন আনন্দে ভরে উঠল। তিনি সকল দাসী ও পরিচারিকাদের নির্দেশ দিলেন রানির দিকে যেন সর্বদা খেয়াল রাখা হয়।

কপিলাবস্তুর অদূরে পর্বতের পাদদেশে অনেক সাধু সন্ন্যাসী বাস করতেন। এঁদের মধ্যে অতিবৃদ্ধ এক সন্ন্যাসী ছিলেন। তাঁর নাম ছিল অসিত। তাঁকে সকল লোক অতি সম্মান করত। এমনকি রাজা শুদ্ধোদনও তাঁকে খুব সম্মান করতেন। অসিত শুনলেন রাজা শুদ্ধোদন এক পুত্রসন্তানের পিতা হয়েছেন। তিনি ছুটে কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদে এলেন।

রাজপ্রাসাদে তাঁকে দেখে রাজা এগিয়ে গেলেন। তাঁকে যথোচিত সম্মান জানালেন। অসিত রাজাকে আশীর্বাদ জানালেন। বললেন যেন নবজাত রাজপুত্রকে বাইরে তাঁর কাছে একবার নিয়ে আসা হয়। রাজপুত্রকে বাইরে আনা হল। অসিত মনোযোগ সহকারে তাকে পর্যবেক্ষণ করলেন। বুঝলেন এই রাজপুত্র ভাবীকালে সত্য সত্যই একজন সুমহান ব্যক্তি হয়ে উঠবেন। অসিত ক্রমে চমৎকৃত ও উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন। তাঁর মুখে চোখে আনন্দ ও রোমাঞ্চ অনুভূতি ফুটে উঠল। চোখ ভরে গেল অশ্রুবিন্দুতে। রাজা শুদ্ধোদন কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়লেন। জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর চোখে জল কেন? অসিত উত্তর দিলেন, ”রাজপুত্র একজন মহান পুরুষ হয়ে উঠবেন। একদিন তিনি হবেন সমগ্র জগতের মুক্তিদাতা একজন মহাপুরুষ। তিনি মানুষ এবং দেবতা সকলেরই শিক্ষাদাতা হবেন। তিনি বোধি লাভ করবেন। সকলেই তাঁকে প্রভু বলে মেনে নেবে। আমার বার্ধক্যের কথা ভেবে আমি কাঁদলাম। কারণ এই শিশু যখন বোধিসত্ত্ব হয়ে উঠবেন তখন আর আমি জীবিত থাকব না। তাই এই মুক্তিদাতার হাত ধরে মুক্তি লাভের সুযোগ আমার আর হয়ে উঠবে না।” এর পর তিনি হাঁটুগেড়ে সেই শিশুকে প্রণতি জানালেন, সম্মান জানালেন। অজানিতভাবে রাজা শুদ্ধোদনও একই ভাবে তাঁকে অনুসরণ করে নিজ পুত্রকে প্রণতি জানিয়ে বসলেন।

রাজপুত্রের জন্মের পাঁচদিন পর রাজা শুদ্ধোদন তাঁর সভাপণ্ডিতদের ডেকে পাঠালেন। রাজপুত্রের কি নামকরণ করা যায় এটা তিনি তাঁদের কাছ হতে জানতে চাইলেন। তাঁরা একে অপরের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কিছু পরে তাঁরা একমত হয়ে স্থির করলেন রাজপুত্রের নাম দেওয়া হোক ‘সিদ্ধার্থ’। এর অর্থ হল সকল সাধনায় যিনি কৃতকার্য হয়েছেন। সকল লক্ষ্যই যাঁর করায়ত্ত হয়েছে। নামকরণের এই দিনে সভাপণ্ডিতেরা নবজাত রাজপুত্রের মুখমণ্ডল ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেলেন। তাঁরা একমত হয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করে বললেন যদি এই রাজপুত্র রাজার উত্তরাধিকারী হিসাবে রাজার সিংহাসনে বসেন তবে তিনি হবেন প্রবল প্রতাপান্বিত রাজচক্রবর্তী রাজা, কিন্তু তিনি যদি জ্ঞান অর্জনের জন্য গৃহত্যাগ করেন তবে তিনি হবেন ‘বুদ্ধ’ অর্থাৎ জ্ঞানপ্রাপ্ত বা জাগ্রত। সভাপণ্ডিতদের মধ্যে এক তরুণ পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর নাম কৌনদিন্য (Kaundinya)। তিনি কিন্তু দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘যখন রাজকুমার সিদ্ধার্থ বড় হয়ে উঠবেন তখন তিনি রাজসিংহাসন ত্যাগ করবেন। তিনি মহাজ্ঞান লাভ করার জন্য দূরে চলে যাবেন। বোধি লাভ করে তিনি বিশ্বের প্রথম মহাগুরু বোধিসত্ত্ব হবেন।’

অবশ্য রাজা চাহিতেন না যে রাজপুত্র সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করুক। তাঁর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে রাজ্যবাসীরাও চাইছিলেন রাজপুত্র যেন ভাবীকালে একজন রাজচক্রবর্তী রাজা হয়ে ওঠেন। রাজপুত্রের নামকরণ হওয়ার মাত্র দুদিন পরে রানি মহামায়া অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন। এই ঘটনায় সকলেই শোকার্ত হয়ে পড়লেন। রাজ্যে নেমে এল শোকের ছায়া। রাজা শুদ্ধোদন সবচেয়ে বেশি শোকার্ত হয়ে পড়েছিলেন। কারণ রানি মহামায়া ছিলেন উচ্চবংশীয়া রমণী। তিনি রমণীর সকল গুণের অধিকারিণী ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রাসাদের মধ্যে একজন ধর্মপ্রাণা মহিলা।

রানির মৃত্যুর পর রাজপুত্রের দায়িত্ব দেওয়া হল সিদ্ধার্থের এক মাসী মহাপ্রজাপতির উপর। এই মহিলা ছিলেন গুণবতী মহিলা। তিনি মায়ের স্নেহ নিয়ে মায়ের মতো করেই রাজপুত্রকে লালন পালন করতে লাগলেন। রাজকুমার তাঁর নিজের মাকে না পেলেও মাতৃহারার মতো বেড়ে উঠলেন না। সিদ্ধার্থ তাঁর মাসীর স্নেহ ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন। মহাপ্রজাপতি সবসময়ই রাজপুত্রের দিকে খেয়াল রাখতেন। তাঁর সুন্দর স্নেহ যত্নে ক্রমে রাজকুমার সুন্দর সুঠাম এক বালক হয়ে উঠলেন। রাজপ্রাসাদের মধ্যে সকলেরই প্রিয়পাত্র ছিলেন রাজপুত্র। সিদ্ধার্থের বয়স যখন আট বছর হল তখন রাজা শুদ্ধোদন চাইলেন বালক সিদ্ধার্থকে রাজপুত্রের মতো করে গড়ে তুলতে। তিনি সব বিষয়ের জন্য বিভিন্ন শিক্ষকদের নিয়োগ করলেন যাঁরা রাজপুত্রকে সর্ব বিষয়ে পারদর্শী করে তুলবেন। তাঁরা শেখাবেন সাহিত্য, তর্কবিদ্যা, গণিত, শিল্পকলা, ধনুর্বিদ্যা সহ অন্যান্য আরও বিষয়।

এইসব শিক্ষক সকলেই নিজ নিজ বিষয়ে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। তাঁদের তত্ত্বাবধানে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ সকল বিষয়েই পারদর্শী হয়ে উঠলেন। তুলনামূলকভাবে তিনি আর সব রাজপুত্রের চেয়ে সর্ব বিষয়েই অধিকতর পারঙ্গম হয়ে উঠলেন। বাবা, মাসি, শিক্ষকবৃন্দ অন্যান্য সকলের বিচারেই রাজপুত্র সিদ্ধার্থ বিদ্যার সকল বিষয়গুলিতেই অবাক করা পারদর্শিতা লাভ করেছেন এটা প্রতীয়মান হয়ে উঠল। রাজপুত্রের প্রতিভা এমন ছিল যে কোনও বিষয় শিখতেই তার কোনো অসুবিধা হয়নি। যথনই কোনো বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হত রাজপুত্র সহজেই নিজ দক্ষতা ও শ্রেষ্ঠতার প্রমাণ দিতে পারতেন। শেখা বিষয় তিনি কখনওই ভুলে যেতেন না। তার মেধা ছিল অতিপ্রবল। শেখার ব্যাপারে তিনি যেমন দক্ষ ছিলেন মনে রাখার ব্যাপারেও তিনি তেমনই পটু ছিলেন।

রাজপুত্র সিদ্ধার্থ তাঁর মেধা ও বুদ্ধির তীক্ষ্নতা বলে ”ভবিষ্যতের তিনি রাজা” এ ধারণা সত্ত্বেও তিনি কিন্তু অহংকারী ছিলেন না। শিক্ষকদের তিনি যথোচিত শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। রাজপুত্রের সুন্দর ব্যবহারে সব শিক্ষকরাও ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ। রাজপুত্র সকলকেই সমান শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্মান করতেন। এ ব্যাপারে তাঁর কোনো বৈষম্য দেখা যেত না।

একাধারে তিনি ছিলেন নম্র, ধৈর্যশীল ও জ্ঞানী; অপরদিকে প্রবল পরাক্রমী ও সাহসী যোদ্ধা। শারীরিক ক্রীড়াবিদ্যার প্রতিটি বিভাগেই তিনি শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ রেখেছিলেন। রথ চালনাতেও তার জুড়ি মেলা ভার ছিল।

একবার এক রথের দৌড় প্রতিযোগিতায় রাজপুত্র সে দেশের দক্ষ ও কুশলী রথ চালকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন। এই প্রতিযোগিতায় জয়লাভের জন্য অন্যান্য প্রতিযোগীরা তাঁদের ঘোড়াগুলির ওপরে অনেক নির্যাতন করেছিলেন। কেননা তাঁরা ভেবেছিলেন তা না হলে ঘোড়াগুলি দৌড়বে না। কিন্তু রাজপুত্র সিদ্ধার্থ তাঁর ঘোড়ার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করেছিলেন। বিনিময়ে ঘোড়াটিও তার সর্বশক্তি দিয়ে রথ টেনেছিল এবং শেষপর্যন্ত সিদ্ধার্থকে বিজয়ীর শিরোপা এনে দিয়েছিল।

একথা এখানে বলা দরকার যে, রাজপুত্র শুধু তার নিজের ঘোড়ার সঙ্গেই সদয় ব্যবহার করতেন এমন নয়। অন্যান্য সব জীবজন্তুর সঙ্গেই তাঁর আচরণ ছিল দয়াপূর্ণ এবং আন্তরিক। রাজপুত্র যুবরাজের আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন বলে তিনি কখনো দুঃখ ও কষ্ট ভোগ করেননি; দারিদ্র্য কাকে বলে তাও তিনি জানতেন না। কিন্তু তাঁর সহানুভূতিশীল আচরণ এবং মনোভাব তাঁকে সর্বদাই অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে দয়ালু আচরণ করতে বলত। তিনি সেই বয়সেই বুঝতে পেরেছিলেন যে মানুষের মতো অন্যান্য প্রাণীরাও সুখ—আনন্দ চায় এবং দুঃখ ও যন্ত্রণা ভোগ করতে চায় না।

আট বছর বয়সেই দেখা গিয়েছিল তাঁর চরিত্রের একটি অদ্ভুত লক্ষণ। সকল প্রাণীদের প্রতি তাঁর সদয় আচরণ সকলকে অবাক করে দিত। যে কোনও স্থানে যে কোনও অবস্থায় কোনও প্রাণী কষ্ট পেলে তাঁর কষ্ট দূর করার জন্য রাজপুত্র সচেষ্ট হতেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, একদিন রাজপুত্র দেখলেন তাঁর এক অনুচর লাঠি দিয়ে একটি সাপকে মারছে তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুচরকে এই নিষ্ঠুর কাজ করা হতে বিরত করলেন।

আর একদিন রাজপুত্র সিদ্ধার্থ তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে রাজপ্রাসাদের বাগানে খেলা করছিলেন। তাঁর সাথী বন্ধুরাও সেখানে উপস্থিত ছিল। এদের মধ্যে একজন ছিলেন রাজকুমার দেবদত্ত, রাজকুমার সিদ্ধার্থের একজন জ্ঞাতিভাই। দেবদত্তের চরিত্র ছিল সিদ্ধার্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর এবং ঈর্ষাপরায়ণ। তিনি জীবহত্যা করতে ভালোবাসতেন। সিদ্ধার্থের চরিত্র কিন্তু দয়া ও হিতৈষণায় পরিপূর্ণ ছিল। তিনি কখনও অন্যকে পীড়া দিতেন না এবং প্রায়ই উৎপীড়িতদের সাহায্য করতেন। এইদিন দেবদত্তের হাতে ছিল ধনুর্বাণ। তিনি খেলার ছলে উড়ন্ত রাজহাঁসদের লক্ষ্য করে বাণ ছুঁড়েছিলেন। ডানায় আহত হয়ে একটি রাজহাঁস মাটিতে পড়ে গেল। রাজহাঁসটি সাংঘাতিকভাবে আহত হয়েছিল এবং যন্ত্রণায় এটি কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

সিদ্ধার্থ ছুটে রাজহাঁসটির কাছে গেলেন এবং সেটিকে কোলে তুলে নিলেন। অতি সন্তর্পণে তিরটি তার ডানা থেকে বের করে আনলেন। সবুজ শীতল ঔষধ লতা দিয়ে সিদ্ধার্থ রাজহাঁসটির ক্ষতস্থান বেঁধে দিলেন যাতে রক্তপাত বন্ধ হয়। এবং খুব আস্তে আস্তে তার শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ক্রুদ্ধ দেবদত্ত ছুটে এসে রাজহাঁসটিকে তাঁর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইলেন। তিনি সিদ্ধার্থকে চিৎকার করে কটু কথাও বলছিলেন এবং রাজহাঁসটিকে ফেরৎ দিতেও বলছিলেন। সিদ্ধার্থ কিন্তু কোনও ক্রমেই আহত রাজহাঁসটিকে তাকে ফেরৎ দিলেন না, তিনি বললেন, ”রাজহাঁসটি যদি মারা যেত তাহলে সেটিকে তোমার হাতে তুলে দিতাম। কিন্তু যেহেতু সে এখনও জীবিত আছে তাই স্বাভাবিকভাবেই সেটি তার প্রাণদাতারই প্রাপ্য।” কিন্তু রাজপুত্র দেবদত্ত চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ”আমি রাজহাঁসটিকে তিরে বিদ্ধ করেছি তাই এটি আমার।” ঝগড়া যাতে অধিক দূর না গড়ায় সেজন্য রাজপুত্র সিদ্ধার্থ বললেন, ”তাহলে চলো আমরা রাজসভায় যাই এবং সেখানকার জ্ঞানীগুণীজনের কাছ থেকে এই বিতর্কের মীমাংসা প্রার্থনা করি।” এতে দেবদত্ত কিন্তু কোনও আপত্তি করলেন না।

রাজসভায় অনেক জ্ঞানীগুণীজন উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা রাজ্যের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিলেন। যেহেতু সিদ্ধার্থ যুবরাজ তাই রাজহাঁসটিও তাদের আলোচ্য সূচিতে তৎক্ষণাৎ স্থান পেল। তারা বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা করছিলেন এবং এই সমস্যার বিভিন্ন ধরনের সমাধানের ইঙ্গিত করছিলেন। কোনও কোনও সভাসদ বলছিলেন যেহেতু দেবদত্ত পাখিটিকে তিরের আঘাতে নীচে নামিয়ে এনেছে তাই আহত রাজহাঁসটি দেবদত্তেরই প্রাপ্য। অন্যরা বলছিলেন যেহেতু সিদ্ধার্থ পাখিটিকে জীবন দান করেছেন তাই এটি সিদ্ধার্থেরই প্রাপ্য। এইভাবে তর্কটি জটিল হতে জটিলতর হয়ে উঠছিল।

অবশেষে একজন তরুণ পণ্ডিত উঠে দাঁড়ালেন। নম্র এবং দৃঢ় স্বরে তিনি ঘোষণা করলেন, ”সমস্ত সজীব প্রাণীরা তাদেরই হয় যারা তাদের বাঁচায় এবং রক্ষা করে। যারা জীবনের ক্ষতি করে তারা কখনও জীবের মালিক হতে পারে না, বস্তুতপক্ষে এটাই যথার্থ যে আহত এই রাজহাঁসটি তার রক্ষাকর্তা রাজপুত্র সিদ্ধার্থেরই প্রাপ্য।”

সভায় সকলেই এই যুক্তিটি সমর্থন করলেন। সকলেই বললেন সেই আহত রাজহাঁসটির মালিক সিদ্ধার্থ ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না। কারণ রাজহাঁসটি তাঁরই সেবায় বেঁচে উঠেছে।

রাজপুত্র সিদ্ধার্থ যত্নসহকারে রাজহাঁসটির সেবা করতে লাগলেন। অবশেষে সেটি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করল। এরপর সিদ্ধার্থ সেটিকে আকাশে উড়িয়ে দিলেন। রাজহাঁসটি জঙ্গলে তার পরিজনদের সঙ্গে মিশে গেল। সেখানে সে স্বচ্ছন্দে ও সুখে কাল কাটাতে পারবে। এই ঘটনার পর থেকে দেবদত্ত সিদ্ধার্থের শত্রুতে পরিণত হলেন আর তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *