পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বেশ কয়েক বছর পরে শুদ্ধোদন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এবার তাঁর অসুখটি ছিল বেশ বাড়াবাড়ি। বুদ্ধ অসুস্থ পিতাকে দেখবার জন্য কপিলাবস্তুতে ফিরে এলেন। বুদ্ধের প্রশান্ত সৌম্য মূর্তি এবং সুন্দর কথাবার্তা শুনে শুদ্ধোদনের বাঁচার ইচ্ছাটা যেন ফিরে এল। তিনি বাঁচতে চাইলেন কিন্তু তাঁর বার্ধক্য তাঁকে অনেকটা জীর্ণ করে ফেলেছিল। অসুখের বারবার আক্রমণ তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবনাবসান হল। প্রাসাদের সকলে শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন।
বুদ্ধের পালিকা মাতা এবং মাসি প্রজাপতি গৌতমী ছিলেন শুদ্ধোদনের অন্যতমা স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যুতে তিনি খুবই কাতর হয়ে পড়লেন। তিনি এতই শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন যে সংসার জীবনে আর থাকতে চাইছিলেন না। তিনি বুদ্ধের সঙ্গে থেকে পবিত্র সাধ্বীজীবন কাটাতে চাইছিলেন। তিনি আরও চাইছিলেন বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়ে তিনি সন্ন্যাসিনী জীবন কাটাবেন এবং বৌদ্ধ মঠে বসবাস করবেন। তিনি আরও কয়েকজন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধের কাছে এলেন। বুদ্ধকে অনুরোধ করলেন যেন তাঁদের বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনী হিসাবে তিনি স্বীকৃতি দেন। বুদ্ধ কিন্তু এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন না। পালিকা মাতা গৌতমী বারবার তাঁকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে তিনি সম্মতি দিলেন না। গৌতমী খুবই হতাশ হলেন। বহুবার বুদ্ধের কাছে গেলেন এবং তাঁর প্রার্থনা জানালেন। বুদ্ধ কিন্তু এ বিষয়ে কোনও মতেই সম্মতি দিলেন না। অসম্মতির কারণটাও স্পষ্টভাবে জানাতে চাইলেন না। এই অসম্মতিতে তাঁরা এতই ব্যথিতা হলেন যে সকলেই কাঁদতে শুরু করলেন। কান্নাই নাকি স্ত্রীলোকের বল।
রাজা শুদ্ধোদনের পারলৌকিক কাজকর্ম শেষ হল। বুদ্ধ কপিলাবস্তু ত্যাগ করলেন। তিনি স্থান হতে স্থানান্তরে ঘুরতে লাগলেন।
বুদ্ধের পালিকা মাতা গৌতমীও সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছিলেন। তিনি এবং তাঁর সঙ্গিনীরা কিন্তু পথশ্রমে অভ্যস্ত না থাকায় তাঁদের হাঁটতে বেশ দেরি হচ্ছিল। ইতিমধ্যে তাঁরা তাঁদের কেশ সব কেটেছিলেন এবং গৈরিক বস্ত্র পরে নিয়েছিলেন। সন্ন্যাসী—সন্ন্যাসিনীদের এই বস্ত্রের নাম দিল কাষায় বস্ত্র। প্রতিদিন তাঁরা অল্প দূরত্বই অতিক্রম করতে পারতেন। মহাবন বিহারে আসতে তাঁদের অনেকটা সময় লেগে গেল। বুদ্ধ তখন এই বিহারেই অবস্থান করছিলেন।
পথশ্রমে পরিশ্রান্ত এই মহিলারা বুদ্ধ সকাশে এলেন এবং ভিক্ষুণী হিসাবে দীক্ষা দেওয়ার জন্য বুদ্ধের অনুমোদন প্রার্থনা করলেন। বুদ্ধ কিন্তু একবাক্যে তাদের সঙ্ঘে প্রবেশানুমতি দিতে চাইলেন না তাঁদের ফিরে যেতে বললেন। এঁরা শেষ পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে ফিরে চললেন। পথে আনন্দের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হল। আনন্দ সব শুনলেন। বললেন, ‘আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমি বুদ্ধের কাছে যাচ্ছি আমি না ফিরে আসা পর্যন্ত আপনারা আমার জন্য অপেক্ষা করুন।’ আনন্দ ছিলেন বুদ্ধের জ্ঞাতিভাই, বুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগত জন আনন্দ পরম ভক্তি ভরে বুদ্ধ সকাশে এলেন। বুদ্ধকে তিনি সম্ভ্রান্ত এই সব মহিলাদের মর্মবেদনার কথা জানালেন। বুদ্ধ কিন্তু তাঁর আগের নির্দেশে অনড় রইলেন। আনন্দ বলেন, ‘হে বুদ্ধ এই সব মহিলাগণ যদি ধর্মের সব নীতিগুলি যথাযথভাবে পালন করেন আর সব নিয়মকানুন মেনে চলেন তাহলেও কী তাঁরা নির্বাণ লাভের অধিকারিণী হতে পারবেন না? বুদ্ধ ধৈর্য সহকারে আনন্দের এই যুক্তি অনুধাবন করলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আনন্দের যুক্তি মেনে নিলেন। এবং এ বিষয়ে তাঁর সম্মতি দিলেন। তিনি জানালেন যদি মহিলারা একনিষ্ঠ ভাবে ধর্ম আচরণ করেন এবং ধর্মপথে চলেন তবে এটা সম্ভব হতে পারে। আনন্দ সন্তুষ্ট হয়ে মহাপ্রজাপতি গৌতমীর কাছে ফিরে গেলেন এবং জানালেন বুদ্ধ তাঁদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। সেই মহিলা এবং তাঁর সঙ্গিনীরা সকলে প্রতিশ্রুতি দিলেন তাঁরা দৃঢ়ভাবে ধর্ম পথে চলবেন। কোনও রীতিনীতি ভঙ্গ করবেন না এবং ধর্ম নির্দিষ্ট জীবন যাপন করবেন যাতে তাঁরা পুরুষদের মতোই নির্বাণ লাভের অধিকারিণী হতে পারেন। বুদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যদি মহিলারা ভিক্ষুণী হন তবে বৌদ্ধধর্ম প্রচলনের সময় আরও পাঁচশত বছর কম হয়ে যাবে।
বুদ্ধের আর এক ভাই দেবদত্তও বৌদ্ধ ধর্মমত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বভাবে মন্দ বুদ্ধির কারণে তিনি সব সময় বুদ্ধের বিরোধিতা করতেন। অন্যান্য দুষ্ট লোকদের সাহায্য নিয়ে তিনি বৌদ্ধধর্ম এবং বৌদ্ধ সংঘারামগুলিকে কলুষিত করতে চাইতেন। তিনি বুদ্ধের সঙ্গে সহযোগিতা তো করতেনই না বরং সর্ব বিষয়ে তিনি তাঁর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতেন। তিনি সঙ্ঘকে পাপপথে নিয়ে যেতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন খুবই ক্রোধপরায়ণ ব্যক্তি, যেহেতু বুদ্ধ শাক্যবংশীয় না হওয়া সত্ত্বেও সারিপুত্র আর মৌদগালায়নকে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ শিষ্য বলে পরিগণিত করেছিলেন। এ কারণে তিনি আরও বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। প্রবল ক্রোধ নিয়ে তিনি একদিন রাজা বিম্বিসারের কাছে একাকী উপস্থিত হলেন। সেখানে অবশ্য রাজার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হল না। তবে যুবরাজ অজাতশত্রুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল। অজাতশত্রু তাঁকে সম্মান জানালে এবং তার সকল অভিযোগও শুনলেন। রাজপ্রাসাদের কাছেই একটি অপূর্ব সুন্দর সংঘারাম তৈরি হল এবং দেবদত্তকে সেই সংঘারামের দায়িত্ব ভার দেওয়া হল।
অনেকদিন পর বুদ্ধ আর একবার রাজগৃহে এলেন। দেবদত্ত তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন যেন বুদ্ধ তাঁকে নতুন একটি সঙ্ঘ গড়ে তোলার অনুমতি দেন। এই সঙ্ঘের দায়িত্ব নেবেন স্বয়ং দেবদত্ত। বুদ্ধ কিন্তু এই অনুরোধে রাজি হলেন না। কেননা এতে সঙ্ঘ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। কিন্তু অজাতশত্রুর সমর্থন পেয়ে দেবদত্ত একটি নতুন সঙ্ঘ গড়ে তুললেন। দেবদত্ত অজাতশত্রু মনকেও বিষিয়ে দিলেন। দেবদত্তের পরামর্শে অজাতশত্রু তাঁর বাবাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে স্বয়ং রাজসিংহাসনে রাজা হয়ে বসলেন। শুধু তাই নয় নিজের পিতার খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে তিনি তাঁকে উপবাসে মৃত্যু দিলেন। এই ঘটনা ঘটেছিল বুদ্ধের বুদ্ধত্ব লাভের সাঁইত্রিশ বছর পরে।
দেবদত্ত এবার তাঁর খেলা শুরু করলেন। তিনি অজাতশত্রুকে বললেন বুদ্ধকে হত্যা করা বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তাঁর পরামর্শে অজাতশত্রু একদল দক্ষ গুপ্ত ঘাতককে বুদ্ধকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন। কিন্তু এইসব গুপ্তঘাতকেরা বুদ্ধের করুণাঘন মূর্তি এবং সুন্দর কথাবার্তা শুনে গুপ্ত হত্যার কাজটা কিছুতেই করতে পারল না। শুধু তাই নয়, তারা বুদ্ধকে সব কথা খুলে বললেন। বুদ্ধ তাদের মার্জনা করলেন। তারা সকলেই বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করল।
তখন দেবদত্ত স্বয়ং বুদ্ধদেবকে হত্যা করবেন এরূপ মনস্থির করলেন। তিনি গৃধ্রকূট পাহাড়ে লুকিয়ে থাকলেন। এই পাহাড়ের নীচ দিয়ে বুদ্ধ প্রতিদিন যাতায়াত করতেন। এক সন্ধ্যায় বুদ্ধ যখন সেই পথ দিয়ে আসছিলেন সেই সময় দেবদত্ত উঁচু থেকে একটা বড় প্রস্তর খণ্ড তাঁর দিকে গড়িয়ে দিলেন। এই পাথরটি নীচে পড়ার আগে অনেকগুলি ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গেল। একটি মাত্র ধারালো টুকরা বুদ্ধের পায়ে এসে লাগল। বুদ্ধ আহত হলেন কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেলেন। বুদ্ধ সংঘারামে ফিরে গিয়ে সেখানকার বিখ্যাত চিকিৎসক জীবকের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলেন।
এভাবে দেবদত্তর সব ফন্দি ব্যর্থ হল। কিন্তু তিনি দমে যাওয়ার লোক ছিলেন না। আরও পরিকল্পনা তাঁর মাথায় ঘোরাঘুরি করতে লাগল। আর রাজা অজাতশত্রুকে তিনি ভালোমতোই বোঝাতে পেরেছিলেন যে বুদ্ধ তাঁর পিতা বিম্বিসারের একান্ত আপনজন ছিলেন। এবার দেবদত্ত পরিকল্পনা করলেন বুনো হাতি নালাগিরিকে বুদ্ধকে হত্যা করার জন্য ছেড়ে দেবেন। এইমতো বুদ্ধদেব যখন ভিক্ষায় বেরিয়েছেন সেই সময় হাতিটাকে ছেড়ে দেওয়া হল। কিন্তু আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটল। উন্মত্ত হাতিটি বুদ্ধদেবকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে পড়ল এবং করুণাময় বুদ্ধের পদতলে সে লুটিয়ে পড়ল। এরপর দেবদত্ত দেখলেন বুদ্ধকে হত্যা করা তার পক্ষে আর কোনও মতেই সম্ভব নয়।
দেবদত্ত বুদ্ধদেবের সংঘারামে ঢুকলেন। বুদ্ধের শিষ্যরা তখন বুদ্ধের কাছ থেকে উপদেশ শুনছিলেন। তিনি বুদ্ধকে বললেন যে বৌদ্ধ শিষ্যরা যেন কোনওমতেই মাংস গ্রহণ না করে কেননা মাংস হিংসারই আর এক রূপ। আসলে তিনি দেখাতে চাইছিলেন যে তিনি বুদ্ধের চেয়েও অহিংসা ধর্মে অধিকতর বিশ্বাসী। কিন্তু বুদ্ধ এতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সকলেই ভিক্ষু। একটাই নিয়ম শুধু এখানে প্রযোজ্য যে প্রতিটি বৌদ্ধকে ভিক্ষা করেই আহার্য গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও বললেন তাঁর শিষ্যরা স্বাধীনভাবে আপন আপন রুচি অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করবে। তিনি দেবদত্তকে সাবধান করে দিয়ে বললেন দেবদত্ত যেন কোনওমতেই সংঘের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে না দেন।
এরপর দেবদত্ত সেই স্থান ত্যাগ করলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংঘের তিনি নেতা হলেন এবং নিজের মতন করে ভিক্ষুদের জন্য নিয়মকানুন তৈরি করলেন। তখন বুদ্ধ বাধ্য হয়ে দেবদত্তের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি তাঁর সকল শিষ্যদের জানিয়ে দিলেন এবং এর ফলে দেবদত্তের সঙ্গে সকল ভিক্ষু তাঁর সংঘ ছেড়ে বুদ্ধদেবের সংঘে আবার ফিরে এল। দেবদত্ত শুনলেন সারিপুত্র এসে ভিক্ষুদেরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার বুদ্ধের সংঘেই নিয়ে গিয়েছেন। ক্ষোভে দুঃখে, অপমানে, রাগে দেবদত্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু তিনি তখন রুগ্ন হয়ে পড়েছিলেন তাই তাঁর অনুগত দু চারজনের বাহিত এক চেয়ারে সেই পলাতক ভিক্ষুদের কাছে গিয়ে দেখতে চাইলেন তাদের পলায়নের প্রকৃত কারণটি কী? পলাতক ভিক্ষুরা বুদ্ধকে জানালেন যে হয়তো দেবদত্ত তাঁকে হত্যা করার জন্য আসছে এবং তিনি যেন আত্মরক্ষার প্রয়োজনে কোথাও পালিয়ে যান। কিন্তু বুদ্ধ ভয় পাওয়ার লোক ছিলেন না। তিনি সারিপুত্রকে বললেন দেবদত্ত আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। ঘটনা আশ্চর্যজনকভাবে অন্যদিকে মোড় নিল, দেখা গেল যে দেবদত্তের শিবিকা বাহকেরা যখন পথিমধ্যে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটু থেমে ছিল তখন দেবদত্ত হঠাৎই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মারা গেলেন। সেই হতে সংঘ দিখণ্ডিত করার আর কোনও প্রচেষ্টা কেউ করেনি।