অনির্বাণ অমিতাভ – ২

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

সেই সময় ভারতবর্ষের সকালই কৃষিকার্যকে তাদের প্রধান জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তারা বিশ্বাস করত একমাত্র মাটিই এই বিশ্বে খাঁটি। কারণ ফসল যা ফলে তা মাটিতেই ফলে। আর যারা চাষবাসের কাজ করে সেই কৃষকেরা মানুষের পরম মিত্র। সেই সময় রাজারাও একদিন অন্তত একটি উৎসবে মাঠে যেতেন এবং সভাসদসহ রাজা স্বয়ং কৃষিকাজে হাত লাগাতেন। বিশেষ করে বীজ বপনের সময় একটা উৎসবের আয়োজন করা হত। বছরের একটি বিশেষ দিনে এই উৎসবটি অনুষ্ঠিত হত। রাজপ্রাসাদের সকল লোকজন এমনকি রাজপরিবারের সকলেও এ কাজে যোগদান করে সাধারণ প্রজাদের সঙ্গে একাত্ম হতে চাইতেন। তাদের বোঝাতে চাইতেন কৃষি ও কৃষ্টি এ দুটিই গৌরবময় কাজ। এই কাজ কোনও নীচ কাজ নয়।

কপিলাবস্তুতে গ্রীষ্মের অবসানে শুরু হত জমিতে লাঙল দেওয়ার কাজ। রাজা শুদ্ধোদন একটি উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নগরবাসীদের প্রোৎসাহিত করতেন। এটি ছিল রাজকীয় কৃষি উৎসব। এটি ছিল একটি বড় ও শুভ উৎসব। সকল প্রজারা এসে দেখত রাজা স্বয়ং জমিতে লাঙল দিচ্ছেন। এই উৎসবের পর অবশ্য একটি ভোজেরও আয়োজন হত।

এই অনুষ্ঠানে রাজপুত্র সিদ্ধার্থও পিতা শুদ্ধোদনের সঙ্গে আসতেন। রাজা স্বয়ং জমিতে লাঙল দেওয়ার কাজ শুরু করতেন। এই লাঙলটি ছিল সোনার তৈরি আর বিবিধ মণিমাণিক্য দ্বারা শোভিত। একদল রাজকর্মচারী তাঁর পিছনে থাকত। তারা সকলেই রুপার তৈরি লাঙল দিয়ে এই মাটি চাষার কাজটি করত। এর পর আসত আসল কৃষকেরা তাদের নিজস্ব লাঙল নিয়ে। লাঙল দেওয়ারপর উর্বর মাটি আলগা হয়ে বীজবপনের উপযুক্ত হয়ে উঠত।

যখন খাওয়ার সময় এল তখন রাজপুত্র সিদ্ধার্থের সঙ্গী সাথীরা সকলেই খাওয়ার জন্য গেলেন। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ কিন্তু তাদের সঙ্গে গেলেন না। তিনি একা রয়ে গেলেন সেই কৃষিক্ষেত্রে। রাজপুত্র এই সময় একটি জামগাছের নীচে বসলেন। তাঁর মনে নানান ধরনের ভাবনা চিন্তা খেলা করছিল। তিনি সমস্ত কুচিন্তাকে মনে হতে দূর করার চেষ্টা করছিলেন। মনকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি রাজা, তাঁর অনুচরবৃন্দ এবং কৃষকেরা সকলেই তো ভোজসভায় আহার্য গ্রহণ করেছেন তারা ক্ষুধার্ত এবং এই ভোজসভায় তাঁরা নিশ্চয়ই আনন্দ উপভোগ করছেন। কিন্তু এই গোরু যারা অধিকতর পরিশ্রম করেছে এবং অবশ্যই ক্ষুধার্থ হয়েছে তাদের আহারের কোনও ব্যবস্থা নাই কেন? এদেরকেও শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে লাঙল টানতে হয়েছে। অথচ এদের ক্ষুধা নিবৃত্তির কোনও ব্যবস্থা কেউ তো করছে না। এরা তো এখনও হাঁপাচ্ছে নিশ্চয়ই, এরা কেউই সুখী নয়। অথচ কম শ্রম করেও অন্যান্য লোকজনরা খাদ্যসুখ গ্রহণ করছে। এই সব গোরু কৃষিকাজকালে মাঝে মাঝেই তাদের প্রভুদের হাতে কঠোর নির্যাতন সহ্য করেছে। কারণ হয়তো তাদেরপ্রভুদের ইচ্ছামতো তারা লাঙল টানতে পারছিল না। তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে কষাঘাত করা হয়েছে।

সিদ্ধার্থ আরও অনেক জীবজন্তুদের চলাফেরার দিকেও লক্ষ রাখছিলেন। এই সব জীবজন্তু তাঁর আশপাশেই অবস্থানরত ছিল। তিনি দেখলেন একটি টিকটিকি তার ওল্টানো জিভ দিয়ে নানা পোকামাকড় ধরে ধরে খাচ্ছে, কিছু পরেই একটি সাপ এসে টিকটিকিটাকে ধরে ফেলল এবং তাকে গিলে নিল। এর পরেই একটি প্রকাণ্ড বাজপাখি হঠাৎ এসে সাপটাকে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলল।

রাজপুত্র এসব দেখে আরও গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন। সিদ্ধার্থ নিজেকেই প্রশ্ন করে চললেন, ”এরকমই যদি চলতে থাকে তবে আমরা যাকে সুন্দর বলি তার আড়ালেও একটা কুৎসিত কিছু লুকানো আছে। এখন তিনি হয়তো সুখী। তবে এ সুখের আড়ালে একটা দুঃখও আছে লুকিয়ে। সকল প্রাণীর মধ্যে এই দুঃখ আছে।” সিদ্ধার্থ তখন বালকমাত্র কিন্তু তখন হতেই তাঁর মনে এই ধরনের চিন্তাভাবনা আসতে শুরু করেছে। এটাই হল তাঁর প্রথম ধ্যান।

রাজকীয় কৃষি উৎসব এবং ভোজসভা শেষ হয়ে গেল এখন রাজার অনুচরেরা রাজকুমার সিদ্ধার্থের কথা ভাবতে শুরু করল। সত্যিই তো রাজকুমারকে অনেকক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কোথায় গেলেন যুবরাজ সিদ্ধার্থ? এদিক—ওদিক অনেকক্ষণ খোঁজার পর তাঁরা যখন তাঁকে দেখতে পেলেন তখন তিনি নিস্পন্দ, তাঁর দেহের কোনও সাড়া নাই। জামগাছের নীচে যেন এক প্রস্তর মূর্তি অবস্থান করছে। অনুচরেরা তাঁকে জাগিয়ে দিলেন বললেন রাজা তাঁকে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছেন। এখন প্রাসাদে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। রাস্তাতেও নীরব রইলেন সিদ্ধার্থ। সকল প্রাণীর শোকে তিনি যেন পাথর হয়ে পড়েছেন। তিনি ভাবছেন প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীকে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন কী নিদারুণ পরিশ্রমটাই করে চলতে হচ্ছে। কত যন্ত্রণা আর কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে।

রাজা শুদ্ধোদন যখন বুঝতে পারলেন যে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ চূড়ান্ত সত্যকে জানবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠছেন তখন তিনি বড় কাতর হয়ে পড়লেন। তিনি আশঙ্কা করলেন রাজপুত্রের মন হতে যদি এই ইচ্ছাটা দূর করা না যায় তবে রাজপুত্র সম্ভবত প্রাসাদ ছেড়ে, দেশ ছেড়ে সুদূরে সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়বেন। তখন তাঁর এই রাজ্যের শাসনভার তিনি কার হাতে দিয়ে যাবেন? রাজা আরও বুঝতে পারলেন যে রাজপুত্রের মনের পরিবর্তন আনবার জন্য প্রাসাদে আরও আমোদ—প্রমোদের ব্যবস্থা করা দরকার। এজন্য তিনি তিনটি সুন্দর প্রাসাদ তৈরি করার ব্যবস্থা করলেন। এই তিনটি প্রাসাদ হবে অতি চমৎকার।

প্রথম প্রাসাদটি তৈরি করা হল সুগন্ধী কাঠ দিয়ে। এর ভিতরে বাতাস সুখপ্রদ এবং আরামদায়ক। ভিতরের আসবাবপত্র সবই স্বাচ্ছন্দ্যদায়ক। এই প্রাসাদটি কুমার সিদ্ধার্থের শীতকালের বাসস্থান। দ্বিতীয় প্রাসাদটি হবে সিদ্ধার্থের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ। এটি তৈরি হবে পালিশকরা মার্বেল পাথর দিয়ে। তৃতীয় প্রাসাদটি হবে পোড়া ইটের তৈরি। এর ছাদটি হবে সবুজ টালের। এই প্রাসাদে সিদ্ধার্থ থাকবেন বর্ষাঋতুতে। তিনটি প্রাসাদ ঘিরে থাকবে সুন্দর ফুলের বাগান। এ ছাড়াও স্নানের জন্য থাকবে সুন্দর সুন্দর পুষ্করিণী। এই পুষ্করিণীর মধ্যে কয়েকটিতে ফুটবে নানান রঙের সুন্দর সুন্দর পদ্মফুল। রাজকুমার ঘোড়ায় চড়ে যেখানে ভালো লাগে সেখানেই যেতে পারবেন।

দ্রুত সময় অতিক্রান্ত হতে লাগল। ধীরে ধীরে রাজপুত্র যুবক হয়ে উঠলেন। তাঁর জন্য রাজা পার্থিব যে সব সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করেছিলেন সেগুলি সত্যি সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর। রাজা শুদ্ধোদন ভাবতে শুরু করলেন হয়তো রাজপুত্রের মতিপরিবর্তন হচ্ছে। ভবিষ্যতের কথা রাজা কীভাবে ভাববেন?

এরপর রাজা তাঁর সব মন্ত্রীদের একটি সভায় আহ্বান করলেন। তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন রাজপুত্রের ভবিষ্যতের কথা এবং এ সম্পর্কে তাঁদের চিন্তাভাবনার কথা। রাজপুত্র কি এই সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জীবন বেছে নেবেন? কিংবা সংসার ত্যাগ করার পথই পরবর্তী সময় বেছে নেবেন? কেন—না অসিত এরকমই একটি ভবিষ্যদ্বাণী আগে করেছিলেন। সভাসদরা তাঁদের মতামত রাজাকে একে একে জানাতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা একমত হয়ে বললেন তার মোদ্দা কথাটা হল এই—চারদিকে খোঁজখবর নিয়ে রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী এবং কুলশীল মানে শ্রেষ্ঠ কোনও মেয়ের সঙ্গে রাজকুমারের বিয়ে দেওয়া। রাজপুত্র যদি একবার পত্নীপ্রেমের অভিজ্ঞতা লাভ করেন তবে অবশ্যই তাঁর মনের পরিবর্তন হবে। বিবাহিত জীবন এবং সুন্দরী—স্ত্রীর ভালোবাসা অবশ্যই তাঁকে সংসারে বেঁধে রাখতে পারবে। একমাত্র এ ভাবেই রাজা শুদ্ধোদনের ইচ্ছা পূরণ হবে এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নিয়ে তাঁর সমস্যাটা মিটবে। ভবিষ্যতে সিদ্ধার্থই রাজত্বের রাশ করবেন। সভাসদদের এই প্রস্তাবটি রাজা শুদ্ধোদনের মনঃপূত হল। তিনি তখন নির্দেশ দিলেন রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী কুমারী মেয়ের খোঁজ করা হোক। অনুসন্ধানের পর যে সব কন্যাকে উপযুক্ত মনে করা হবে তাদের সকলকে কপিলাবস্তু নগরে নিয়ে আসা হবে। এদের সকলকেই একে একে রাজপুত্রের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। তাঁদেরকে রাজপুত্রের হাত হতে একটি করে উপহার গ্রহণ করতে হবে এছাড়াও ঘটনাস্থলে রাজ্যের বুদ্ধিমান কিছু অমাত্য উপস্থিত থাকবেন। তাঁর তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে নজর রাখবেন ঠিক কোন তরুণীকে রাজবকুমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ করছেন।

সুন্দরী কন্যাদের এই প্রতিযোগিতার দিনে কুমারীকন্যারা একে একে সকলে রাজপুত্রের সামনে দিয়ে হেঁটে চলতে লাগল। তারা সকলেই ছিল অসামান্যা সুন্দরী। এঁদের সকলেই রাজপুত্রের হাতে সাক্ষাৎ পুরস্কার গ্রহণ করল। এই সব কিশোরী কন্যারা খুবই আনন্দিত হয়ে উঠেছিল। কারণ রূপবান রাজপুত্র স্বয়ং তাদের পুরস্কার দিচ্ছিলেন। তবে ফেরার পর এরা সকলেই আশঙ্কা করছিল হয়তো রাজপুত্র তাদের পছন্দ করলেন না। হয়তো তারা সে রকম সুন্দরী নয় যা রাজপুত্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বা তাঁর মধ্যে একটা সামান্য হলেও আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে।

তাঁরা কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন রাজপুত্র সিদ্ধার্থ কিন্তু তাঁর বয়সি অন্যান্য যুবকদের মতো নন। তিনি আগত সুন্দরী তরুণীদের প্রতি আদৌ দৃষ্টিপাত করেননি। এটা ঠিক তিনি তাদের প্রত্যেকের হাতে উপহার তুলে দিচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর মন যেন সুদূর কোনও একটা লক্ষ্যের প্রতি নিবদ্ধ ছিল। এই লক্ষ্যের সঙ্গে আগত সুন্দরীদের যৌবনসুলভ মাধুর্যের কোনও মিল ছিল না। এই মনোভাব কোনও কোনও সুন্দরীর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তাঁরা স্পষ্টই বলে ফেলেছিলেন রাজপুত্র কোনও সাধারণ যুবক নন। তিনি যেন অনেক দূরের এক স্বর্গীয় সত্তা। নারীর যৌবন ও শরীর তাঁর কাছে আদৌ কোনও আকর্ষণের বস্তু নয়।

এই সুন্দরীদের পঙক্তি প্রায়ই শেষ হয়ে গেল। এদের কাউকেই কি রাজপুত্রের পছন্দ হল না? রাজপুত্র শান্ত প্রস্তরমূর্তির মতো স্থির হয়ে বসেছিলেন। শেষ সুন্দরী এল এবং রাজপুত্রের হাত হাতে উপহার গ্রহণ করল। এই সময় হঠাৎই একজন অতি সুন্দরী এক যুবতী সভাস্থলে প্রবেশ করল। সে প্রায় দৌড়োচ্ছিল। আসলে তার সভায় আসতে বিলম্ব হয়েছিল। উপস্থিত গুণীজনেরা দেখলেন রাজপুত্র যেন কিছুটা চঞ্চল হয়ে পড়েছেন। অন্যান্য তরুণীদের মতো নবাগতা তরুণীও রাজপুত্রের সম্মুখে এসে পুরস্কার গ্রহণের জন্য দাঁড়িয়ে পড়লেন। লাজুক মুখে মাথা নীচু করে রাজপুত্রকে অভিবাদন জানালেন। এরপর চলে যেতে যেতে এই তরুণী হাসিমুখে প্রশ্ন করলেন, ”আমার জন্য কোনও উপহার নেই রাজপুত্র?” রাজপুত্র উত্তর দিলেন, ”সত্যিই আমি খুব দুঃখিত কন্যা। কিন্তু আর তো আমার কাছে কোনও উপহার নাই কিন্তু একটু দাঁড়াও তুমি এই উপহার গ্রহণ কর।” এরপরে রাজপুত্র তাঁর কণ্ঠ হতে বহুমূল্যবান সোনার হার খুলে নিয়ে সেই তরুণীকে দিলেন। ব্রীড়া ভরে সেই রূপবতী রাজপুত্রের দেওয়া হারটি হাতে নিলেন।

সমাগত পণ্ডিতগণ, যাদের রাজা নিযুক্ত করেছিলেন রাজপুত্রের সকল প্রতিক্রিয়া তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে দেখতে তাঁরা খুব আনন্দিত হলেন। তাঁরা সমাগতা সেই সুন্দরীর পরিচয় জানতেন। এই তরুণী শুধু যে পরম রূপবতী ছিল তাই না সে ছিল রাজা সুপ্পাবুদ্ধর কন্যা যশোধরা। তাঁরা খবরটি রাজা শুদ্ধোদনের কাছে পাঠালেন। রাজা শুদ্ধোদন রাজা সুন্ধবুদ্ধর কাছে রাজদূত প্রেরণ করলেন। প্রস্তাব দিলেন তিনি যেন রাজপুত্র সিদ্ধার্থের সঙ্গে তাঁর কন্যা যশোধরার বিবাহ স্বীকার করে নেন। সে যুগে হিমালয়ের পাদদেশে বসবাসকারী লোকেরা যেমন সাহসী তেমনি বীর ছিল। তারা সুগঠিত দেহ এবং প্রবল পরাক্রান্ত ও সাহসী ছিল। শাক্যজাতির লোকেদের একটা প্রথা ছিল। যখন কোনও তরুণ রাজপুত্র বিবাহ করতে যাবে তখন তাকে সর্ব বিষয়ে পারদর্শিতা দেখাতে হবে। এই বিষয়গুলি হল—অশ্বারোহণ, শরনিক্ষেপ, তরবারি চালনা, মল্লযুদ্ধ এবং বুদ্ধি প্রয়োগ। এই সব বিষয়ে অন্যান্য তরুণদের চেয়ে অনেক আগে থাকতে হবে। এই প্রথাকে মান্য করে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ সকল তরুণদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করলেন। এই প্রতিযোগিতা হবে কপিলাবস্তুতে। এরকমই স্থির হল।

প্রতিদ্বন্দ্বী সব তরুণই অশ্বারোহণ, ধনুর্বিদ্যা এবং তরবারি চালনায় অত্যন্ত সুদক্ষ ছিল। এদের সকলেই রাজা, সভাসদ এবং জমায়েত অন্যান্যদের সামনে নিজ নিজ নৈপুণ্যের পরিচয় দিলেন। তাঁর শ্বেত অশ্ব কণ্টকায় চড়ে রাজপুত্র সিদ্ধার্থও এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলেন। এবং দেখা গেল অন্যান্য সকল অংশগ্রহণকারীদের তুলনায় তিনিই শ্রেষ্ঠ। তির নিক্ষেপে তিনি জ্ঞাতিভাই দেবদত্তের চেয়ে অনেকটা দূরে তির পাঠালেন। সেই সময় এই দেবদত্ত দেশের সবচেয়ে ভালো তিরন্দাজ হিসাবে পরিচিত ছিলেন।

তরবারি চালনায় এক আঘাতে সিদ্ধার্থ একটি গাছকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেললেন। একটা আশ্চর্য ঘটনা কিন্তু সকলে প্রত্যক্ষ করল। তরবারির আঘাতে কিন্তু গাছটা দাঁড়িয়েই ছিল। পড়ে যায়নি। কিন্তু যখন হাওয়া দিল আর বাতাস বইল দেখা গেল গাছটি আস্তে আস্তে পড়ে যাচ্ছে। মনে হয়েছিল যেন রাজপুত্র মাখনের ভিতর দিয়ে তরবারি চালিয়েছেন। অসি যুদ্ধেও রাজপুত্র অনেক সম্মান নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে গেলেন। এর আগে পর্যন্ত সকলের জানা ছিল সিদ্ধার্থের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা রাজপুত্র নন্দ অসি যুদ্ধে অত্যন্ত পটু ও দক্ষ।

এর পর শুরু হল অশ্বারোহণ প্রতিযোগিতা। রাজপুত্রের সাদা রঙের ঘোড়া কণ্টক এত জোরে ছুটল যে অন্যান্য অশ্বারোহীরা অনেকটাই পিছিয়ে থাকল। সকল প্রতিযোগীরা এবার প্রতিবাদ জানিয়ে বলল এতে রাজপুত্র সিদ্ধার্থের কোনও নৈপুণ্য নাই কেননা কণ্টকই সবচেয়ে দ্রুতগামী অশ্ব। এটা সকলেই জানে। যেই কণ্টকে চড়ে প্রতিযোগিতা করবে সেই জিতবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। পক্ষান্তরে একটা অদ্ভুত কালো রঙের যে ঘোড়া আছে তাতে যেই চড়ে প্রতিযোগিতা করুক না কেন সে অবশ্যই পরাস্ত হবে।

তাই এবার ঘোড়া বদল করা হল। সকলেই চেষ্টা করল ভয়ঙ্কর সেই কালো ঘোড়ার সওয়ার হতে। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর কালো ঘোড়াটি কাউকেই তার পিঠে উঠতে দিল না। সকলেই মাটিতে পড়ে গেল এবং অল্পবিস্তর আহত হল। এবার রাজপুত্র অনিরুদ্ধর পালা। রাজ্যের সবচেয়ে ভালো অশ্বারোহী হিসাবে পরিচিত অনিরুদ্ধ অল্প আয়াসেই ঘোড়ায় উঠে পড়লেন। এরপর তিনি সজোরে কষাঘাত করে ঘোড়াটিকে চালানোর চেষ্টা করলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল ঘোড়াটিতে সওয়ার হয়ে সারা মাঠটা একবার প্রদক্ষিণ করবেন।

কিন্তু রাজপুত্র অনিরুদ্ধর সাধনা মাত্র কয়েকমুহূর্তের জন্য স্থায়ী হয়েছিল। সেই অশিক্ষিত ভয়ংকর ঘোড়াটি ঘাড় ঘুরিয়ে রাজপুত্র অনিরুদ্ধর পায়ে কামড় দিল। এর পর সেটা অনিরুদ্ধকে পিঠ হতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। রাজকুমার অনিরুদ্ধর ভাগ্য ভালো বলতে হবে কারণ অনুচরেরা সঙ্গে সঙ্গে এসে তাঁকে ঘিরে দাঁড়াল এবং নিরাপদ আশ্রয়ে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেল। তা না হলে সেই ক্ষিপ্ত ভয়ংকর ঘোড়াটি অবশ্যই তাঁকে হত্যা করত। এরপর এল রাজপুত্র সিদ্ধার্থের পালা। সকলে ভাবছিল বংশের সবচেয়ে ভালো অশ্বারোহী অনিরুদ্ধ যখন ঘোড়াটিতে চড়তে ব্যর্থ হয়েছেন তখন সিদ্ধার্থ কোনও মতেই এই ঘোড়ায় উঠতে পারবেন না। হয়তো এরকমটাই হত। কিন্তু রাজপুত্র সিদ্ধার্থ লক্ষ্য করছিলেন ঘোড়াটির একটা অসুবিধে অবশ্যই হচ্ছে। তা না হলে সেটা এরকম বন্য হিংস্র ব্যবহার কেন করবে? রাজপুত্র সিদ্ধার্থ অতিসন্তর্পণে ঘোড়াটির কাছে এগিয়ে গেলেন। একটা হাত তার ঘাড়ে আলতোভাবে রাখলেন। অন্য হাত দিয়ে এর নাকটা নরম হাতে ঘষতে লাগলেন। অস্পষ্ট স্বরে তার কানে কানে তিনি কী যেন বলতে লাগলেন। ঘোড়াটি পাঁজরাতে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।

সকলে অবাক হয়ে গেল। এই ভয়ংকর ঘোড়াটি যেন মন্ত্রমুগ্ধর মতো নরম ও শান্ত হয়ে পড়েছে। রাজপুত্র সিদ্ধার্থকে পিঠে উঠতে সে নম্রভাবে কেমন যেন সহযোগিতা করল। এবং সিদ্ধার্থের নির্দেশমতো সে সামনে বা পিছনে চলতে লাগল। সমবেত দর্শকমণ্ডলী স্পষ্টই বুঝতে পারল যে ঘোড়াটি সম্পর্ণরূপে রাজপুত্র সিদ্ধার্থের বশীভূত হয়ে পড়েছে। রাজপুত্রর ইচ্ছা অনুযায়ী সে ঘোরাফেরা করছে। এই প্রথম কোনও মানুষ ঘোড়টির নিয়ন্ত্রণ এতক্ষণ নিয়ে রাখতে পেরেছে। এর আগে এই অহংকারী ঘোড়াটি কাউকে তার কাছে ঘেঁষতেই দেয়নি।

শেষ পর্যন্ত সকলেই এ ব্যাপারে সহমত হল যে রাজপুত্র সিদ্ধার্থই দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অশ্বারোহী এবং তিনিই রাজকন্য যশোধরার পক্ষে সবচেয়ে ভালো পাত্র। রাজা সুপ্পাবুদ্ধ খুব খুশি হলেন। আনন্দে তিনি কন্যা যশোধরাকে রাজপুত্র সিদ্ধার্থর হাতে সঁপে দিতে রাজি হলেন। কেননা তাঁর মনে হয়েছিল রাজপুত্র সবচেয়ে সাহসী ও বীর যোদ্ধা।

রাজপুত্র সিদ্ধার্থ এবং রাজকুমারী যশোধরার বিবাহ অনুষ্ঠান খুবই জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হল। সমস্ত প্রজা সাধারণ এই বিবাহ অনুষ্ঠানে সানন্দে যোগদান করল। নববিবাহিত দম্পতি বিশেষ ভাবে নির্মিত একটি প্রাসাদে বসবাস শুরু করলেন। এই প্রাসাদে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এবং উপভোগ করার মতো সবরকম ব্যবস্থায় রাখা ছিল। এতদিনে রাজা শুদ্ধোদন বোধহয় স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচলেন। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ এবার অন্তত সন্ন্যাসী হবার চিন্তাটা ছাড়ছেন। ঘর ছেড়ে তিনি আর বাইরে নিশ্চয়ই যাবেন না।

রাজা শুদ্ধোদন সকল কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়ে রাখলেন কেউ যেন রাজপুত্রের কাছে এমন কোনও আলোচনা বা কথাবার্তা না বলে যাতে রাজপুত্রের মন সংসার বিতৃষ্ণা জাগতে পারে বা তাঁর মনে সংসার ত্যাগের বাসনা জাগতে পারে। শোক, দুঃখ, জরা, মৃত্যু এবং কোনওরকম অশান্তিসূচক কোনও কথাবার্তাই যেন রাজপুত্রের কাছে না পৌঁছায়। রাজপুত্রকে সকল অনুচরদের কড়া নির্দেশ দেওয়া হল যেন তারা সব সময়েই রাজপুত্রকে সঙ্গীত, নৃত্য এবং বিনোদনসূচক অনুষ্ঠানের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। রাজপুত্রের সামনে যেন কখনও কোনও ক্লান্তির ভাব না দেখায়।

এ ছাড়াও রাজপুত্রের আবাস প্রাসাদ ঘিরে উঁচু প্রাচীর তুলে দেওয়া হল। এই প্রাসাদে ঢুকবার অনুমতি দেওয়া হল শুধু সুন্দরী এবং যুবতী মেয়েদের। এ ছাড়া প্রাচীরের বাইরে হতে আর কারও প্রবেশাধিকার থাকল না। যদি প্রাসাদের কেউ কখনও অসুস্থ বা আহত হয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে রাজপুত্র সিদ্ধার্থের অগোচরে তাদের প্রাসাদের বাইরে নিয়ে আসতে হবে যাতে রাজপুত্র কোনওরকম অসুস্থতা বা আঘাত সম্পর্কে কিছু জানতে না পারেন। সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভের পরই সে প্রাসাদে আবার প্রবেশ করতে পারবে। প্রাসাদের প্রধান দরজা এবং অন্যান্য প্রবেশ পথেও কড়া পাহারা বসানো হল। রাজপুত্রকে যেন কোনওমতেই বাইরে বেরোতে না দেওয়া হয়। একমাত্র রাজার অনুমতিক্রমেই রাজপুত্র প্রাসাদের বাইরে যেতে পারবেন। যদিও রাজার অনুচরেরা সকলেই রাজার নির্বাচিত লোকজন যারা কোনওমতেই রাজপুত্রকে কোনও পীড়াদায়ক সংবাদ বা দৃশ্যও দেখাতে পারবে না এরকমটাই স্থির ছিল। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ এই বন্দিদশাটা কিন্তু পছন্দ করছিলেন না। তিনি বাইরের পৃথিবীর সুখ ও আনন্দপূর্ণ দৃশ্যগুলি স্বয়ং দেখতে চাইছিলেন এবং উপভোগ করতে চাইছিলেন। তিনি রাজপুত্র রাজা ও রাজপরিবারের লোকজন ছাড়া বাইরে সাধারণ লোকের কীভাবে জীবন কাটচ্ছে কী কাজ তাঁদের করতে হচ্ছে—এসব জানতে খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। মাঝে মাঝেই তিনি তাঁর পিতাকে বলতেন বাইরে পৃথিবী এবং সেখানকার লোকজনের জীবনযাত্রা তিনি জানতে চান।

পিতা শুদ্ধোদন রাজপুত্রকে প্রাসাদ বদ্ধ করে রাখা সম্পর্কে কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে পারছিলেন না। অবশেষে তিনি রাজপুত্রের একান্ত অনুরোধ এড়াতে পারলেন না। অবশেষে তিনি সম্মতি দিলেন। অবশ্য এই সঙ্গে তিনি রাজ্যময় ঘোষণা করে দিলেন যে দিন রাজপুত্র বাইরে বেরোবেন সেদিন রাস্তাঘাট লোকজন বাড়িঘর সবই যেন তক তক করে রাখা হয়। সকল প্রজা যেন হাসিমুখে থাকে। রাস্তার দুপাশে রঙিন পতাকা আর ফুল ইত্যাদি দিয়ে সাজানো থাকে। রাস্তায় যেন কর্মরত লোকজন না দেখা যায় যারা ঘর্মাক্ত দেহে পরিশ্রম করছে আর খেদোক্তি করছে। অন্ধ, বৃদ্ধ, রোগাক্রান্ত এবং কুষ্ঠী যারা তারা ঘরের ভিতরে থাকবে যে পর্যন্ত না রাজপুত্র সিদ্ধার্থের রথ পথ অতিক্রম করে চলে যায়। সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। রাজপুত্র চমৎকার একটি রথে আরোহণ করে পথে বেরোলেন। তিনি নগর পরিক্রমা শুরু করলেন। রাস্তার দুপাশ দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন সকলে হাসিমুখে তাঁকে সাদর সম্ভাষণ জানাল। আনন্দচিত্ত মানুষের স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর জয়ধ্বনি দিতে লাগল। ”রাজপুত্র সিদ্ধার্থ দীর্ঘজীবী হোন” সর্বত্র শোনা যেতে লাগল এই হর্ষধ্বনি। রাজপুত্রকে সকলেই অভ্যর্থনা জানাতে শুরু করল সানন্দ অন্তঃকরণে। অনেকে রথের কাছে এসে পুষ্পবৃষ্টি করল রথের ওপরে এবং পথে। রথ পথে ছড়িয়ে থাকা পুষ্পের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলল।

হঠাৎ অন্য এক ঘটনা ঘটল। সাদা চুলের একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি খোঁড়াতে খোঁড়াতে একটা বাড়ির ভিতর হতে বেরিয়ে এল। তার হাত পা দুর্বলতার কারণে কাঁপছিল। অনুচরের বাধা দেওয়ার আগেই সে একেবারে রাজপুত্রের রথের সামনে চলে এল। তার সারামুখে কী সব ছাপছোপ আর চামড়া কুঁচকানো। তাঁর গোটা মুখে মাত্র একটিই দাঁত। বয়সের ভারে সে কুঁজো হয়ে গেছে। কোনও মতে একটা লাঠিতে ভর করে সে হাঁটতে পারছে। সে চীৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে আসছিল। দেখে মনে হচ্ছিল কোনও খাদ্য না পেলে সে হয়তো এখনই মারা যাবে।

বৃদ্ধের এই সাহস দেখে সকলে হতবাক হয়ে গেল। রাজপুত্র এই প্রথম নগরের পথে বেরিয়েছেন। আর রাজা ইতিপূর্বেই কঠোর নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন কোনও অন্ধ বৃদ্ধ আতুরজন যেন পথে না বেরোয়। অনুচরেরা ছুটে গিয়ে তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। তাকে তাঁরা বাড়ি চলে যেতে বলল। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাজপুত্র লোকটিকে দেখে ফেলেছেন। অনুচরদের আর কিছু করার ছিল না।

এই অদ্ভুতদর্শন রুগ্ন বৃদ্ধকে দেখে রাজপুত্র খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন। অবাকও হলেন। একে তিনি ভালো করে দেখতে পারছিলেন না। তিনি তাঁর সারথি ছন্দককে জিজ্ঞাসা করলেন, ”ছন্দক এ কে? এ কি একজন মানুষ! এ এত কুঁজো হয়ে আছে কেন? কেনই বা তার হাত পা এ রকম কাঁপছে। তার চুলই বা এত সাদা কেন? তার চোখে কী হয়েছে? তার দাঁত কই? এ কি এই ভাবেই জন্মেছিল? ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলো ছন্দক।”

ছন্দক বললেন, ”রাজপুত্র এ একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি। এ রকম ভাবে সে জন্মায়নি। স্বাভাবিক আর সব মানুষের মতোই সে একদিন জন্মেছিল। যৌবনে এও ছিল শক্তিশালী যুবক। তার মাথার চুল ঘন কৃষ্ণবর্ণ ছিল। তার চোখ ছিল উজ্জ্বল ও ঝকঝকে। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। তার দেহের পরিবর্তনগুলি আস্তে আস্তে ঘটেছে। এ সব নিয়ে ভাববেন না রাজপুত্র। দুঃখও পাবেন না। বুড়ো মানুষেরা এরকমই হয়।”

”কী বলছ তুমি ছন্দক এ সবের অর্থ কী?” রাজপুত্রের প্রশ্ন শেষ হয় না, ”কী বলছ তুমি এরকমটাই হয় মানে এটাই স্বাভাবিক দীর্ঘ সময় পরে সকলেরই এই দশা হবে। কী বলছ তুমি, আমিও এরকম কখনও দেখিনি। এ রকম কষ্টও কারও দেখিনি।”

ছন্দক উত্তর দিলেন, ”দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার পর সকলেরই এ রকম হয়। এই বার্ধক্য দশা এড়িয়ে যাওয়া যায় না।”

”তার মানে তুমি বলছ এ দশা সব মানুষেরই একদিন আসবে? তোমার আমার সকলেরই কি এরকম দশা হবে একদিন? আমার বাবা? আমার স্ত্রী? এমন একদিন কি আমাদের সকলেরই একদিন আসবে যেদিন আমাদের দাঁত থাকবে না, চুল পাকবে, কুঁজো হয়ে যাব হাঁটতে পারব না আর এ রকম কষ্ট পাব। আমাদের কি লাঠিতে ভর দিয়ে এ ভাবে চলতে হবে একদিন?”

ছন্দক বলল, ”অবশ্যই রাজপুত্র। তবে এখন মনে এত চিন্তা করছেন কেন রাজপুত্র? সে দিন আসতে এখনও অনেক বিলম্ব আছে আপনার। তবে এটা অবশ্য ঠিক এই বার্ধক্য বা জরা কেউই এড়িয়ে যেতে পারে না।” রাজপুত্র সিদ্ধার্থ ছন্দককে বললেন রথ ঘুরিয়ে প্রাসাদে ফিরে যেতে। এর কারণ তিনি বার্ধক্যের এই দশা দেখে খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন। তাঁর নগর পরিক্রমা করার ইচ্ছাটা একবারেই চলে গিয়েছিল। তিনি আসলে একটু একা থাকতে চাইছিলেন। গভীরভাবে ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবতে চাইছিলেন। এই ঘটনাটা তার মনে একটা গভীর প্রভাব বিস্তার করছিল। তিনি ভাবছিলেন যদিও তিনি একজন রাজপুত্র এবং শিগগির হয়তো তিনি একদিন সর্বশক্তিমান রাজা হয়ে উঠবেন। তবুও একদিন অন্যান্য প্রিয় প্রজাসাধারণ এবং আত্মীয়পরিজন সকলেই ভবিষ্যতে এ ধরনের অবস্থার সম্মুখীন হবেন। বার্ধক্যের এই কষ্ট হতে পরিত্রাণ কারও নেই। ধনী, নির্ধন, শক্তিমান কিংবা দুর্বল সকলেরই এই দশা আসবে।

সেই রাত্রে রাজকুমার সিদ্ধার্থ ঘুমাতেই পারলেন না। সবসময়ই এই চিন্তা তাঁকে তাড়া করছিল। তিনি এবং তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী এই বৃদ্ধের মতোই একজন বৃদ্ধে পরিণত হবেন। তিনি আরও ভাবছিলেন বয়সের ভার হতে মুক্তি পাওয়ার কথা এর আগে কোথাও কি কেউ ভাবেননি? আমি যদি গভীর ভাবে ভাবি তবে কি একদিন এই ধরনের সমস্যার সমাধান করতে পারব না?

রাজপুত্রের নগর পরিক্রমা হতে প্রাসাদ দূর না হওয়ার সংবাদ রাজার কানে পৌঁছাল। রাজা খুব দুঃখিত হলেন। তাঁর মনে একটা চিন্তাই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল রাজপুত্রের গভীর চিন্তা কীভাবে লাঘব করা যায়। কীভাবে রাজপুত্রের সব আশা ও সুখ ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না রাজপুত্রের মন ঘোরানো ব্যাপারটা ততখানি সহজ ছিল না। তবুও রাজপুত্র একদিন আবার তাঁর পিতার অনুমতি চাইলেন। তিনি আবার নগর পরিক্রমায় বেরোবেন। তবে এবার কাউকে না জানিয়ে কোনও নির্দেশ বা রাজ ঘোষণা না দিয়ে। তিনি দেখতে চাইছিলেন প্রকৃত অবস্থাটা কী? অর্থাৎ কীভাবে তাঁর প্রজা সাধারণ বসবাস করে? ঠিক যেমন ঠিক তেমনভাবেই তিনি তাদের দেখতে চাইছিলেন।

স্বাভাবিকভাবেই রাজা কখনও এই ভাবে রাজকুমারকে ছাড়তে চাইছিলেন না। তিনি খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ভাবছিলেন রাজপুত্র যদি সাধারণ লোকজনদের দেখেন তবে তাঁর সামনে হয়তো আরও এমন সব দৃশ্য আসবে যেগুলো তিনি সহ্য করতেই পারবেন না। কিন্তু অবশেষে তাঁকে অনুমতি দিতে হল। কারণ রাজপুত্রের কোনও অনুরোধ রক্ষা না করা তাঁর পক্ষে ছিল অসম্ভব।

এবার সিদ্ধার্থ পদব্রজে বেরোলেন। তিনি একজন ধনী যুবকের ছদ্মবেশ ধারণ করলেন। তাঁর সঙ্গে থাকলেন শুধু ছন্দক। ছন্দকও ছিলেন ছদ্মবেশে যাতে কেউ তাকেও চিনতে না পারে। রাজপুত্র দেখলেন বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম করছে। কামার যারা তারা লোহা গরম করে পিটোচ্ছে। তারা তৈরি করছে লাঙল, কাস্তে এবং গাড়ির চাকা প্রভৃতি।

রাস্তায় ধনী ব্যবসায়ীদের দোকান। শিল্পীরা রমণীদের ব্যবহারের জন্য নানান গয়না তৈরি করছে। কাপড়ের দোকানে নানান ধরনের কাপড়চোপড় বিক্রি হচ্ছে। খাবারের দোকানে নানান মিষ্টান্ন তৈরি হচ্ছে। রাজপুত্রের মন ক্রমশ আনন্দে ভরে উঠছিল। এই সব কর্মরত লোকজন দেখে তাঁর খুব ভালো লাগছিল। তিনি আনন্দ উপভোগ করছিলেন।

কিন্তু শিগগির আবার এক কদর্য দৃশ্য তাঁর সামনে চলে এল। রাস্তার পাশে একজন লোক রোগ যন্ত্রণায় কাতর চিৎকার করছিল। সে সকলের কাছ হতে সাহায্য চাইছিল। রাজপুত্র এগিয়ে গেলেন। দেখলেন একজন মানুষ রাস্তার পাশে শুয়ে আছে আর কাতর চিৎকার করছে। সে যন্ত্রণায় এ পাশ ও পাশ করছিল। তার চোখ দুটো যন্ত্রণায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তার চারপাশ দুর্গন্ধ ও বর্জ্য বস্তুর রাশ। সে উঠতে চেষ্টা করছে কিন্তু আবার মাটিতে ধপাস শব্দে পড়ে যাচ্ছে।

রাজপুত্র সিদ্ধার্থের মন দয়ামায়ায় পরিপূর্ণ। তিনি উদাসীন থাকতে পারলেন না। তিনি দ্রুত তার পাশে গেলেন। সেই রোগীকে তুলে ধরলেন। তার মাথাটা তাঁর হাঁটুর উপর রাখলেন। তিনি লোকটিকে একটু স্বস্তি দিতে চাইছিলেন। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে তোমার কেন এরকম করছ তুমি? কেনই বা তুমি উঠে দাঁড়াতে পারছ না? লোকটি অনেক কথা বলতে চেষ্টা করল। কিন্তু তার মুখে কোনও কথা সরছিল না। এবার ছন্দকও তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল। সে বলল, ‘রাজকুমার একে ছোঁবেন না। ওর অসুখ হয়েছে। ওর শরীরে বিষ ঢুকেছে। এই বিষ তার শরীরকে দুর্বল করে তুলছে। সে আর শ্বাস নিতে পারবে না। শীঘ্রই তার মৃত্যু ঘটবে।’ রাজকুমার প্রশ্ন করলেন, ‘সকল লোকেরাই কি এরকম হয় ছন্দক? সকলেই কি এ ভাবে কষ্ট পায়? আমারও কি একদিন এরকম দশা হবে?’ ছন্দক উত্তর দিল, ”ওকে ছুঁলে বা ওর কাছাকাছি গেলে এ অসুস্থতা তাঁকেও ধরে ফেলবে। রাজকুমার দয়া করে একে শুইয়ে দিন। একে আর যেন ছোঁবেন না। তা না হলে ওর দেহের বিষ আপনার শরীরেও ঢুকবে আর আপনাকেও পীড়াগ্রস্ত করে তুলবে। ওরই মতো আপনিও তখন কষ্ট পাবেন।

রাজপুত্র এবার প্রশ্ন করলেন, ‘এ ধরনের পীড়া কি আরও আছে ছন্দক? হ্যাঁ রাজকুমার পীড়া অনেক ধরনের হয়। আর কোনও কোনও ব্যাধি এর চেয়ে আরও বেশি যন্ত্রণাদায়ক।

”এই রোগ হতে মুক্তি পাওয়ার কোনও উপায় নাই ছন্দক?”

”রাজকুমার কার যে কখন পীড়া হবে সেটা আগে হতে বুঝে ওঠা বড় কঠিন।”

”সকলেই কি একদিন এরকম ব্যাধিগ্রস্ত হবে? তুমি কি বলো ছন্দক?”

”হ্যাঁ অসুস্থতার কথা কি কিছু নিশ্চয় করে বলা যায়? এমন একদিন আসতে পারে আমরা সকলেই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারি।”

”তা হলে আমিও একদিন অসুস্থ হয়ে পড়তে পারি?”

এ রকমটা হলে সকলকেই ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় প্রতিদিন। কেননা এ ধরনের অসুস্থতা ও এরকম যন্ত্রণা আদৌ কারও মনে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিতে পারে না। এনে দিতে পারে শুধু ভয় আর আতঙ্ক। আজ রাতে আমি সুস্থ হয়ে শুতে গেলাম কাল সকালে আমি এই ভয়ানক অসুখে পড়লাম। এ তো ভয়ানক কথা ছন্দক।”

”রাজকুমার আপনার অনুমান ঠিক।”

”অসুস্থতার পরের দশাটা কী হতে পারে?”

”কী আবার, হতে হতে মৃত্যু।”

”মৃত্যু কী ছন্দক? খুব আশ্চর্য কথা শুনছি মরণ বা মৃত্যু সেটা কি আরও ভয়ানক কিছু? আমাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দাও ছন্দক।”

”থামুন, রাজপুত্র ওদিকে একবার দেখুন।”

ছন্দকের কথা অনুযায়ী সিদ্ধার্থ তাকালেন। একদল মানুষ বিলাপ করতে করতে যাচ্ছে। আর চারজন একটা শবদেহ বহন করে নিয়ে চলেছে। শবদেহটি শক্ত হয়ে পড়েছে। তার দুচোখ কোটরে প্রবেশ করেছে। তাকে দেখে অত্যন্ত কুৎসিত মনে হচ্ছে। সেই দেহটি কোনও কথা বলতে পারছে না। সে বাহকদের যেন বলছে একটু সাবধানে চলতে তার শরীরে ব্যথা করছে।

কিছুদূর গিয়ে এই দলটি থেমে গেল। ওরাও শবদেহটিকে একটা কাঠের স্তূপের ওপর রাখল আর সেই কাঠস্তূপে আগুন ধরিয়ে দিল।

রাজকুমার এক অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠলেন, বললেন, ”ছন্দকও কিছু বলছে না। ওরা তো ওর শরীরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। আমার বড় কষ্ট হচ্ছে ছন্দক তুমি ওদের বারণ কর।”

”রাজকুমার ওই মানুষটি আর বেঁচে নেই। ওর কোনও অনুভূতিও নেই। আঘাত আগুন জ্বালা ওকে আর অনুভব করতে হবে না। ওর দেহে প্রাণ নেই।”

”ছন্দক এটাই তা হলে মৃত্যু। যার কথা আমি শুনেছি। কিন্তু সাক্ষাৎ দেখিনি। আমি রাজপুত্র মহান রাজবংশে আমার জন্ম। আমার বাবা শুদ্ধোদন অমিত শক্তি ধর আমারও কি মৃত্যু ঘটবে? আমিও এ মৃত মানুষটির মতো আগুনে পুড়ব?”

”রাজকুমার জন্মালেই মরণ হয়। কেউ চিরদিন বেঁচে থাকে না।”

রাজকুমার মৃত্যুর অমোঘ শক্তি দেখে ভীত হলেন। মৃত্যুর হাত হতে কারও নিস্তার নেই। তিনি নীরব হয়ে গেলেন আর কোনও কথা বললেন না। কোনও কথা বলার তাঁর ইচ্ছে ছিল না।

প্রাসাদে ফিরে এসে রাজকুমার সিদ্ধার্থ নিজের ঘরে গেলেন। তাঁর একাকী থাকতে ভালো লাগছিল। কোনও কথা বলতে তাঁর ইচ্ছা করছিল না। সব সময় মৃত্যুর ভয়াবহতার কথা তাঁর মাথায় আসছিল। মৃত্যু একদিন সকলেরই জীবনে আসবে এবং এর হাত হতে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। কী ভাবে মৃত্যুভয় হতে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। এই ভয়ই তো মানুষকে নিঃশেষ করে দেবে। তার আশা বাসনা কামনা সবই একদিন মৃত্যুর কাছে হার মানবে। তাঁকে কিছু করতে হবে। একটা পথ খুঁজে বের করলেই সেই পথে তিনি তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী তাঁর বাবা রাজা শুদ্ধোদন এবং আপামর প্রজাসাধারণ সকলেই মৃত্যুভয় হতে রক্ষা পেতে পারে। ব্যাধি, জরা এবং মৃত্যু মানুষের এই তিন প্রবল শত্রুর হাত হতে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে। তাঁর মাথায় এই চিন্তাই বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল। এ কাজটাকেই করতে হবে। একটা পথ তাকেই খুঁজে বের করতে হবে।

কয়েকদিন পরে রাজকুমার একদিন বাগানের পথ ধরে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল একজন সন্ন্যাসীর দিকে। তিনি অভিনিবেশ সহকারে সেই সন্ন্যাসীকে দেখতে লাগলেন। তাঁর যেন কেন মনে হল শান্তিতে তাঁর মন ভরে উঠছে। এক অপূর্ব আনন্দ শিহরন হচ্ছে তাঁর শরীরে ও মনে। তিনি ছন্দককে জিজ্ঞাসা করলেন এই যে সন্ন্যাসীকে দেখছ এঁর জীবনধারা কেমন তুমি কিছু জান?

”এ একজন সন্ন্যাসী রাজকুমার। এ তার গৃহ পরিবার সব ছেড়ে দিয়ে পথে বেরিয়েছে। এর কারণ জগতের শোকতাপ দুঃখ হতে সে মুক্তি পেতে চেয়েছে।”

এ কথাগুলো রাজপুত্রের মনে যেন অমৃতসুধা বর্ষণ করল। এই শ্রমণ বা গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী তাঁকে যেন সংকেতে এক নূতন দিক দেখিয়ে দিল। সে দিন তিনি সরাদিন সুখে এবং শান্তিতে বাগানে কাটালেন। তাঁর মনের মধ্যে একটা চিন্তা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল শ্রমণ, সন্ন্যাসী। এটাই কি সেই পথ যা তিনি এতদিন খুঁজে আসছেন? সন্ন্যাসী কি তাঁকে দিগদর্শন করবার জন্য এসেছিলেন? ঠিক এই সময় কে যেন এসে তাঁকে খবর দিল তাঁর স্ত্রী একটি সুন্দর শিশুসন্তান প্রসব করেছেন। কেন যেন রাজপুত্র সে রকম আনন্দ প্রকাশ করতে পারলেন না অন্যমনস্কভাবে তিনি বলে উঠলেন আমাকে ঘিরে ফেলবে। এরা সকলে আমাকে একটা আবেষ্টনীর মধ্যে আটকে ফেলতে চাইছে। এটা তিনি বললেন কেননা তাঁর পুত্রের নাম হল রাহুল। এই রাহুল কথাটির অর্থ হল আবেষ্টনী বা আংটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *