তৃতীয় পরিচ্ছেদ
রাহুলের জন্মগ্রহণের পর হতে দেখা গেল রাজকুমার সিদ্ধার্থের মানসিকতার কী যেন একটা পরিবর্তন ঘটে চলেছে। তিনি কেমন যেন বদলে গেছেন। কথাবার্তা কম বলছেন এবং সবসময়ই কী যেন চিন্তা করে চলেছেন। রাজা শুদ্ধোদন খুবই দুশ্চিন্তায় পড়লেন। তিনি বুঝলেন রাজপুত্রের মানসিক পরিবর্তন থামাবার বড় প্রয়োজন। তিনি বেশ কয়েকজন সুন্দরী নর্তকীকে আমন্ত্রণ জানালেন যারা তাদের লাস্য হাস্য ও ছলাকলা প্রয়োগ করে রাজপুত্রকে সংসারে আকৃষ্ট করে তুলবে। এই সব নর্তকীরা রাজপুত্রের প্রাসাদে বসবাস করবে। তারা সব প্রকারে রাজপুত্রের মনোরঞ্জন করবে যাতে রাজপুত্রের মতির পরিবর্তন ঘটে। প্রথম প্রথম রাজপুত্র এই সব নর্তকীদের নৃত্যগীত মন দিয়ে দেখছিলেন এর কারণ পিতা শুদ্ধোদনকে তিনি হতাশ করতে চাননি কিংবা তাঁর মনে কোনও কষ্ট তিনি দিতে চাননি। তিনি কিন্তু অপাঙ্গে একবার আধবার এই নাচগানে মন দিচ্ছিলেন। আসলে তিনি নিবিষ্ট হয়ে অন্য কী যেন ভাবছিলেন। এই ভাবনার মূল বিষয় ছিল কীভাবে নিজেকে এবং আর সকলকে জরা ব্যাধি মৃত্যুর বিভীষিকা হতে মুক্ত করা যায়। চিন্তা করতে করতে তিনি এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন। নর্তকীরাও তখন একটু বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশ পেল। একটু পরেই রাজকুমারের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি দেখলেন মেঝেতে নর্তকীরা সকলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাদের লাস্যভঙ্গি তখন আর ছিল না বরং তাদের শরীর ও ভঙ্গি খুবই কুৎসিত বলে রাজপুত্রের মনে হচ্ছিল। রাজপুত্রের চোখে তাদের কদর্য রূপটি স্পষ্ট হয়ে যেন দেখা দিল। তাদের রূপ যৌবন যেন হারিয়ে গিয়েছে আর তারা এখন কদর্যরূপে শুয়ে আছে। অতি সন্তর্পণে রাজপুত্র ওদের না জাগিয়ে ঘর হতে বেরোলেন। বাইরে বেরিয়ে তিনি ছন্দককে নির্দেশ দিলেন যেন তার ঘোড়া কণ্টককে জিন পরিয়ে তার সামনে হাজির করা হয়। এর পর রাজপুত্র গেলেন তাঁর স্ত্রী যশোধরার কাছে। বাইরে যাওয়ার আগে হয়তো তিনি তাঁর পুত্র রাহুলকে একবার দেখতে চাইছিলেন। সেখানে তিনি দেখলেন তাঁর স্ত্রী যশোধরা পুত্র রাহুলকে জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। তিনি জানতেন যশোধরা জেগে উঠলে তাঁর উদ্দেশ্যপূরণ হবে না। তাঁকে এখনি গৃহত্যাগ করতে হবে। তবে যদি কোনওদিন সত্যের উপলব্ধি ঘটে তিনি অবশ্যই পুত্র রাহুলকে দেখার জন্য আর একবার ফিরে আসবেন। ছন্দকের সাহায্য নিয়ে সকলের অজান্তে প্রাসাদ ছেড়ে বেরোলেন। তার অশ্ব কণ্টক তাঁকে চিনত। হয়তো সে তাঁর ইচ্ছার কথাও কোনও না কোনও ভাবে উপলব্ধি করতে পারছিল। রাজ্যের সীমানার বাইরে এসে সিদ্ধার্থ ঘুরলেন। শেষবারের মতো কপিলাবস্তুকে দেখে নিলেন। আকাশে তখন চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে কিরণ দিচ্ছিল। কিন্তু তাঁর মানসিক দৃঢ়তা শিথিল হল না।
ভোর হওয়ার পূর্বে তিনি অনোমা নদীর তীরে এসে উপস্থিত হলেন। ঘোড়া হতে নেমে এলেন তিনি। নদীতীরে দাঁড়ালেন। মূল্যবান রাজপোশাক খুলে ছন্দকের হাতে দিলেন। কণ্টক এবং এই পোশাক নিয়ে ছন্দক যেন কপিলাবস্তুতে ফিরে গিয়ে রাজা শুদ্ধোদনকে সব কিছু সংবাদ দেন। তখন শাক্যবংশীয় যুবরাজ সিদ্ধার্থের বয়স ছিল মাত্র ঊনত্রিশ বছর। তিনি পথে বেরিয়েছেন। শ্রমণ হওয়া তাঁর উদ্দেশ্য। আর তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য পৃথিবীর সকল মানুষের দুঃখকষ্ট দূর করা। এই দুঃখকষ্টকে জয় করা।
ছন্দক চলে যাওয়ার পর সিদ্ধার্থ অনোমা নদীর তীরে একটি আম্রকুঞ্জের নীচে আরও সাতদিন অপেক্ষা করলেন। এরপর তিনি দক্ষিণ দিকে চললেন। রাজগৃহে এসে উপস্থিত হলেন। এই নগরটি ছিল মগধ রাজ্যের রাজধানী। এই রাজ্যের নৃপতি ছিলেন বিম্বিসার। এখানে এক সকালে তিনি একটি নদীতে স্নান করলেন। এর পর পরে নিলেন শ্রমণের পোশাক। নগরে প্রবেশ করে তিনি ভিক্ষা শুরু করলেন। কেননা শ্রমণদের ভিক্ষাতেই উদরপূর্তি করতে হয়। সুপুরুষ সুদর্শন এই সন্ন্যাসীকে সকলে ভালো ভালো খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করতে লাগল।
দিনের খাদ্য খেয়ে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ রাজগৃহ ছেড়ে পাণ্ডব পাহাড়ের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। এদিকে সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পড়েছিল সুদর্শন এক তরুণ সন্ন্যাসী রাজ্যে প্রবেশ করেছেন যিনি কথা কম বলেন এবং যাঁর দেহ সৌন্দর্য অতুলনীয়। এ সংবাদ পৌঁছে গেল রাজা বিম্বিসারের কাছেও। তিনি তাঁর নিজপুত্রকে এই সন্ন্যাসীর খোঁজখবর নেওয়ার জন্য পাঠালেন। একথা অজানা রইল না এই সন্ন্যাসী আর কেউ নন শাক্যবংশের রাজকুমার এবং কপিলাবস্তুর ভাবী নৃপতি। কিন্তু তিনি রাজসিংহাসন ও রাজপ্রাসাদের মায়া কাটিয়ে পথে বেরিয়েছেন কারণ তিনি সমগ্র মানবজাতির দুঃখকষ্ট দূর করতে চান। জরা, পীড়া ও মৃত্যুর যন্ত্রণা হতে মানুষকে মুক্ত করতে চান।
বিম্বিসার এই সংবাদ পেলেন। তিনি পাণ্ডব পর্বতে গিয়ে সিদ্ধার্থকে তাঁর রাজধানীতে আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি জানালেন তাঁর রাজধানীতে সিদ্ধার্থের কোনও রকম কোনও অসুবিধা হবে না। কিন্তু সিদ্ধার্থ সবিনয়ে রাজার এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, ”লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমি কোনও এক জায়গায় বদ্ধ থাকতে পারব না।” বিম্বিসার তখন বললেন, ”তবে কথা দিন আপনার লক্ষ্য যখন পূরণ হয়ে যাবে তখন সর্বপ্রথম আপনি আমার রাজধানীতে আসবেন। কেননা আমি ও আমার প্রজারা সকলেই জ্ঞান লাভে ইচ্ছুক। এর পর সিদ্ধার্থ হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত আর এক স্থানে গেলেন। সেখানে অনেক মুনি ঋষিরা বসবাস করতেন। পথে দেখলেন ধুলোর কুহেলি। জানলেন একদল পশু ওই পথ ধরে চলেছে। তাদেরই ক্ষুরের ধুলোয় চারদিকে এই ধূলিজান। একটি ছোট মেষশাবক সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অতিকষ্টে পথ চলছিল। শাবকটির মা আগে আগে চলছে আর পিছন ফিরে চাইছে। শাবকের কথা ভেবে সে খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছে। শাবকটির পা হতে রক্ত ঝরছিল। সিদ্ধার্থের কোমল মন এই দৃশ্যে বিচলিত হয়ে উঠল।
তিনি মেষশাবকটিকে তাঁর কোলে তুলে নিলেন। আর পথ চলতে লাগলেন। তিনি রক্ষকদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই দুপুরে এদের নিয়ে কোথায় যাচ্ছ। সাধারণত সন্ধ্যার সময় তো এরা ঘরে ফেরে।’
মেষ রক্ষক বলল, ‘রাজার আদেশে এদের রাজধানীতে নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে এক বিরাট বলিদানের ও যজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছে।’ সিদ্ধার্থ বললেন, ”আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব, চলো।” মেষশাবকটিকে কোলে নিয়ে তিনি রাজধানীর উদ্দেশ্যে চললেন। মেষশাবক কোলে নিয়ে তিনি নগরে এসে পৌঁছলেন। এখানেই বিশাল যজ্ঞ ও পশু বলিদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যজ্ঞের আগুন জ্বলছিল। রাজা ও রাজপুরুষেরা সকলেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পুরোহিতেরা স্তব পাঠ করছিলেন।
বলিদানের জন্য প্রথম মেষকে যূপকাষ্টে তোলা হল আর ঘাতক তার খড়গ তুলল তখন সিদ্ধার্থ তাকে থামতে বললেন।
তিনি সমবেত রাজা ও রাজকর্মচারীদের এই নিষ্ঠুর প্রথা থামাতে বললেন। রাজা বিম্বিসারও উপস্থিত ছিলেন। তাঁকে উদ্দেশ্য করে সিদ্ধার্থ বললেন, ‘মহারাজ এই সব প্রাণী হত্যা করা হতে বিরত হন। প্রাণ মহামূল্যবান। সেই প্রাণ এইভাবে হত্যা করা উচিত নয়। যারা এই যজ্ঞ ও বলিদান দেখবে বলে সমবেত হয়েছিল তাদেরকে সিদ্ধার্থ বললেন, এই সব প্রাণীদেরও আপনাদের মতোই প্রাণ আছে। মানুষের প্রাণ আর এই অবোলা পশুদের প্রাণ একই। এই সব পশু নানাভাবে মানুষের উপকার করে। তবে কেন অকারণে এদের প্রাণ বধ করে আপনারা অধর্ম আচরণ করছেন। স্বাভাবিক ভাবেই দুঃখ পীড়া এবং মৃত্যু তাদের জীবনে আসে যেমন আপনাদের জীবনে আসবে আপনারা সকলে ভগবানের দয়া কামনা করেন। তবে আপনারা এদেরকে দয়া করছেন না কেন? যারা হত্যা করে একদিন তারাও নিহত হয়। কার্যকারণ সম্পর্কে এই কর্মফল ঘটে। এখন যদি না বোঝেন কবে আর বুঝবেন?
সিদ্ধার্থের প্রশান্ত সুন্দর আকৃতি আর তাঁর মধুর কণ্ঠস্বর রাজাকেও বিচলিত করে তুলল। রাজগৃহের অধিবাসীরা এমনিতেই সদয় হৃদয়। তাদের অন্তর স্পর্শ করল সিদ্ধার্থের সুন্দর বাণী। সিদ্ধার্থের কথায় রাজাও অভিভূত হয়ে পড়লেন। জমায়েত লোকজনও বিচলিত হল। রাজা এই নিষ্ঠুর কাজ বন্ধ করলেন। তিনি আবারও সিদ্ধার্থকে অনুরোধ করলেন তাঁর রাজধানীতে বসবাস করবার জন্য। তিনি থাকলে তাঁর রাজ্যের সকলে জীব প্রেম শিখবে। কিন্তু এবারও সিদ্ধার্থ বললেন তাঁর পূর্ণ কাল এখনও আসেনি। তিনি তাই এখন রাজধানীতে পাকাপাকিভাবে বাস করতে পারবেন না। তিনি রাজগৃহ ত্যাগ করলেন।
এরপর তিনি গেলেন সাধু আরাদা কালামের কাছে। এই সন্ন্যাসী ছিলেন সে যুগের একজন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি অনেক গুরু কুলের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে তিনি ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন। সিদ্ধার্থ এই পণ্ডিত ব্যক্তিদের কাছে বসবাস করতে শুরু করলেন। এই বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যক্তির কাছে সিদ্ধার্থ অনেক কিছু শিখলেন। তাঁর আগ্রহ ও মেধা দেখে গুরু অবাক হয়ে গেলেন। যখন আরাদা কালামের দেবার মতো জ্ঞান নিঃশেষ হয়ে গেল তখন গুরু তাঁকে বললেন, ”বৎস তোমাকে তো সবই দিলাম যা আমার ছিল। তোমার এই ধৈর্য আর পরীক্ষায় আমি মুগ্ধ। বল তুমি আমার কাছে কী আশীর্বাদ চাও। যদি এখানে আমার সহকারী হয়ে থাকো আর শিষ্যদের জ্ঞান বিতরণ কর আমি খুবই খুশি হব।”
সিদ্ধার্থ তখন প্রশ্ন করলেন, ”গুরুদেব সে শিক্ষা তো এখনও দেননি যে শিক্ষাতে মানুষ কষ্ট, পীড়া আর মৃত্যু যন্ত্রণা হতে মুক্তিলাভ করতে পারে। আরাদা কালাম নিরুত্তর রইলেন।
আরাদা কালামের কাছে শিখেছিলেন ধ্যান, সংযম, সকল চেতনা লুপ্ত চিত্তকে একমুখী করণ এবং পরম সুখানুভূতিদায়ক সমাধি। কিন্তু এই সব জ্ঞান তাঁকে তাঁর অনুসন্ধিৎসার বিষয়টি দিতে পারেনি। তাই এই জ্ঞান তাঁর কাছে শেষ জ্ঞান ছিল না। এই জ্ঞান দিয়ে জীবনে প্রাপ্য জ্ঞান পাওয়া যাবে না। সিদ্ধার্থকে তাই আবার পথেই পা রাখতে হল। জরা পীড়া ও মৃত্যুকে জয় করবার প্রথা প্রকরণ যে তখনও জানা হয়নি।
এর পর সিদ্ধার্থ গেলেন উদ্রাক রামপুত্রের কাছে। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মহাপুরুষ। সিদ্ধার্থ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। সেখানেও তিনি গুরু কৃপায় গুরুর সব কিছু আপন তীক্ষ্ন বুদ্ধি বলে আয়ত্ত করে নিলেন। উদ্রাক রাজপুত্রও সিদ্ধার্থকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি তাঁকে তাঁর কাছে থেকে যাওয়ার প্রার্থনা জানালেন। তাঁর পঠন—পাঠন কাজে তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করলেন।
উদ্রাক রামপুত্রের সান্নিধ্যে সিদ্ধার্থ একটা বিশেষ শিক্ষা পেলেন। এটি হচ্ছে ধ্যানে নিবিষ্ট চিত্ততা। এই ধ্যানে মানুষ আশপাশের সব কিছুকে ভুলে থাকতে পারে। ভাবনা অনুভূতি পারিপার্শ্বিক সব কিছুকে ভুলে সে ধ্যানে নিবিষ্ট থাকাতে পারে। এ ধ্যানের প্রাপ্ত মানসিক অবস্থায় কেউ ভাবতে পারে না সে আছে কিংবা নাই অর্থাৎ সে যেন একটা অনস্তিত্ব হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে জীবনের যে সমস্যা নিয়ে সিদ্ধার্থর এত মাথাব্যথা অর্থাৎ জরা ব্যাধি এবং মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তা রহিত হয়ে কীভাবে তিনি মানুষের দুঃখকষ্ট দূর করতে পারবেন? এ কারণে সিদ্ধার্থ উদ্রাক রামপুত্রের আশ্রয় ছেড়ে দিলেন। তিনি স্থির করলেন তাঁর সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি আর কোনও গুরুর খোঁজ করবেন না, এদিক—ওদিক ঘুরবেন না। নিজ প্রচেষ্টায় একমাত্র নিজ প্রজ্ঞা ও তপস্যাকে অবলম্বন করে তিনি সত্যের অনুসন্ধান করবেন এবং সমস্যার সমাধান করবেন।
সে যুগে অনেক সন্ন্যাসী ছিলেন। যাঁরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিলেন। এবং তাঁরা আপন আপন সংসার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে আপন আপন প্রয়োজন মতো সত্যকে অনুসন্ধান করতেন। তাঁদের কেউ কেউ ভাবতেন এইভাবে তপস্যা করে তাঁরা একদিন মারা যাবেন। কিন্তু তপস্যার প্রভাবে তাঁরা এর পর স্বর্গে বসবাস করার সুযোগ পাবেন। পুনর্জন্ম তাঁদের আর হবে না। তাঁরা স্বর্গের চিরস্থায়ী সুখ আনন্দ ও ঐশ্বর্যের মধ্যে সারা জীবন অতিবাহিত করতে পারবেন। অর্থাৎ তাঁরা কিন্তু নিজেদের স্বার্থের কথাই ভাবতেন। আপামর জনগণের কথা তাঁরা ভাবতেন না। তাঁরা ভাবতেন এ জন্মে তাঁরা যত কষ্ট ভোগ করে তপস্যা করবেন স্বর্গে তাঁরা ততোধিক পরিমাণে সুখ ভোগ করতে পারবেন। এ কারণে অনেক কষ্টসাধ্য সাধনা করতেন।
তাঁরা ক্রমে ক্রমে খাবার পর্যন্ত ত্যাগ করতেন। ক্রমে ক্রমে তাঁরা অস্থিচর্মসার হয়ে যেতেন। কেউ কেউ একপায়ে ভর দিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কেউ ঊর্ধ্ববাহু হয়ে তপস্যা করতেন। এ ভাবে হাতে রক্ত প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হত এবং সেই হাত বা পা অবশ হয়ে পড়ত। তাঁরা হাতের তালু এমন ভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে রাখতেন যে হাতের নখ বিপরীত দিকে ছিদ্র করে ফেলত। কেউ কেউ আবার তীক্ষ্ন পেরেকের তৈরি শয্যায় শুতেন। সিদ্ধার্থ এ রকম ভাবেই কষ্ট করতেন প্রথম প্রথম। ভাবতেন এইরূপ কষ্টের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করলে হয়তো তাঁর দিব্যজ্ঞান লাভ হবে। তিনি মগধের পথে উরুবিল্বে পৌঁছলেন। সেখানে একটি সুন্দর স্থান তাঁর মনে ধরল। অদূরে একটি নদী তার চারপাশে বৃক্ষরাজি তাঁকে আকর্ষণ করল। পাশেই ছিল একটি গ্রাম যেখানে প্রতিদিন ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করতে পারবেন আর আপন ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে পারবেন। তিনি এই স্থানে থেকে তপস্যা করবেন এবং বোধি পাবার প্রচেষ্টা করবেন। এখানে বিশেষ প্রক্রিয়া দ্বারা তিনি ধ্যান করতে মনস্থ করলেন।
সিদ্ধার্থর সঙ্গী আরও পাঁচজন ছিলেন। এঁরাও শ্রমণ ছিলেন। এঁরা হলেন কৌনদিন্য, ভদ্রিক, বাম্পা, মহানাম এবং অশ্বজিৎ। এঁরা পাঁচজনেই দৃঢ় বিশ্বাস করতেন যে সিদ্ধার্থ অবশ্যই একদিন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করবেন। কারণ সিদ্ধার্থর ক্ষমতা ও সামর্থ্য দুইই ছিল। এবং সিদ্ধার্থ যদি সিদ্ধিলাভ করেন তবে তিনি অবশ্যই তাঁদেরকেও শিষ্য হিসাবে বরণ করে নেবেন এবং এই ভাবে তাঁরাও বিশেষ ক্ষমতা অর্জন করতে পারবেন।
সিদ্ধার্থ প্রথমেই আহার প্রত্যাহার করতে শুরু করলেন এবং এক সময় তিনি আহার বন্ধ করে দিলেন। তিনি এত রোগা হয়ে পড়লেন যে চামড়ার আড়ালে তাঁর সকল অস্থি দৃষ্টিগোচর হল। এই অবস্থাতেও তিনি কিন্তু বিন্দুমাত্র নিরুৎসাহ হলেন না। একদিন তিনি এই দুর্বল অবস্থাতেও তপস্যা করছিলেন আর তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। এক মেষপালক বালক সেই পথ ধরে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারল সিদ্ধার্থর মৃত্যু আসন্ন। কারণ উপবাসে কাতর সিদ্ধার্থর প্রাণশক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া সে জায়গায় সকলেই জানত যে এই ধার্মিক ব্যক্তি অনেক দিন ধরে উপবাসী আছেন।
সেই বালকটি একটি ছাগীকে নিয়ে এল। এই ছাগদুগ্ধ পান করে সিদ্ধার্থর জ্ঞান ফিরল। তিনি এবার চিন্তা করলেন যদি কিছু না খেয়ে থাকি তবে আমার মৃত্যু ঘটবে। এই ছাগদুগ্ধ না খেলে তাঁর জ্ঞান ফিরত না আর তাঁর তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করাও হত না। তিনি বুঝলেন এই ছাগদুগ্ধ তাঁকে প্রাণ দান করেছে।
মেষপালক বালক সিদ্ধার্থর আশীর্বাদ নিয়ে ফিরে গেল। তার মনে খুব আনন্দ কারণ একজন পুণ্যাত্মা ব্যক্তির প্রাণ সে রক্ষা করতে পেরেছে। সিদ্ধার্থ কিন্তু সেই অবস্থাতেই বসে আবার তপস্যা শুরু করলেন। গোধূলি বেলায় তিনি দেখলেন একজন ব্যক্তি সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। একজন মেয়ে গান গাইছে, ”খুব শক্ত ভাবে বাঁধলে বীণায় সুর আসে না। আবার আলগা করে বাঁধলেও সেখানে সুর আসে না। শক্ত বাঁধনে আবার তার ছিঁড়ে যায়। তাই বীণায় তার শক্ত করে বেঁধো না আবার আলগা করেও বেঁধো না এ অবস্থায় বীণা খুব সুন্দর বাজবে।”
এই গান সিদ্ধার্থর মন ছুঁয়ে গেল। তিনি তাঁর জীবনেরতারকে খুব শক্ত করে বাঁধতে গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর সন্ধান যে স্তব্ধ হয়ে যেত। এত কষ্ট করা সবই হয়ে যেত অর্থহীন। তিনি জ্ঞানলাভের আগেই মারা যেতে চান? শরীরে পীড়ন করে নিশ্চয়ই দিব্যজ্ঞান লাভ করা যাবে না। তিনি তাই স্থির করলেন আর শরীরকে পীড়ন করবেন না। কেবলমাত্র তাঁর বুদ্ধি ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে সত্যকে অনুসন্ধান করবেন। সেদিন হতে আবার সিদ্ধার্থ প্রতিদিন ভিক্ষায় বেরোলেন আর ভিক্ষান্নে উদর পূরণ করতেন।
সিদ্ধার্থর স্বাস্থ্য অনেকটা ভালো হয়ে গেল। তাঁর দেহের বর্ণ হল কাঁচা সোনার মতো উজ্জ্বল। আগে যেমন তিনি সুশ্রী সুপুরুষ ছিলেন ঠিক সেই রকমই আবার হয়ে উঠলেন। সিদ্ধার্থ বুঝে উঠছিলেন বালি দিয়ে যেমন দড়ি পাকানো যায় না তেমনি শরীরকে কষ্ট দিয়ে জ্ঞানকে লাভ করা যায় না। তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা না শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনকেও ক্ষতবিক্ষত করে আর এই আহত মন নিয়ে তপস্যা করা যায় না। বোধি লাভ করা যায় না। কিন্তু অপর পাঁচজন শ্রমণ অন্যরকম ভাবনা ভাবছিলেন। তাঁরা ভাবছিলেন শরীরকে যন্ত্রণা না দিলে জ্ঞান ধরা দেয় না। সিদ্ধার্থ খাওয়াদাওয়া শুরু করলেন তাঁরা ভাবলেন সিদ্ধার্থ বুঝি ভোজনবিলাসী দৈত্য হয়ে উঠেছেন। তাই তাঁরা তাঁকে ত্যাগ করে চলে গেলেন মৃগদাভে (এখনকার সারনাথ) এই স্থানটি ছিল বারাণসীর (এখন বেনারস) কাছে।
একদিন নিকটের গ্রামের একজন তরুণী নাম তার সুজাতা সিদ্ধার্থের জন্য সুন্দরভাবে পায়েস তৈরি করে নিয়ে এলেন। এই সুস্বাদু পায়েস দিয়ে সুজাতা বললেন, ‘আমি চাই আপনার সাধনায় আপনি যেন সিদ্ধি লাভ করেন। এটাই আমার একান্ত প্রার্থনা এবং ইচ্ছা। আমিও আমার সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছি।” সিদ্ধার্থ এই পায়েস খেলেন। তাঁর মনে হল এই পায়েস খুবই উপকারী তাঁর শরীর ধারনের ক্ষেত্রে। এ ছাড়াও এই পায়েসের মধ্যে রয়েছে এমন এক উপাদান যা তাঁর মনকেও শক্তি দিচ্ছে।
সুজাতা এই ইচ্ছা প্রকাশ করলেন যেন তার গর্ভে এক পুত্র বা কন্যা জন্মায়। কৃতজ্ঞতা বশে তিনি সিদ্ধার্থকে এই পায়েস দিয়েছিলেন।
সেই রাত্রে সিদ্ধার্থ নিরঞ্জনা নদীতে স্নান করার জন্য গেলেন; সেখানে স্নান শেষ করে তিনি নদীতীরে একটি শালগাছের নীচে বসলেন। তিনি আশা করছিলেন নির্জন এই স্থানে নিস্তব্ধ রজনীতে তাঁর বোধি লাভ অবশ্যই ঘটবে। ভোরবেলায় তিনি এই শালবৃক্ষ ছেড়ে খানিক দূরে এক বিশাল বোধিবৃক্ষের নীচে গেলেন। এ গাছটির তলদেশে বসে তিনি তপস্যা করবেন এই ইচ্ছা তাঁর আগে থেকেই ছিল। রাস্তায় এক খড় বিক্রেতার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হল। এই লোকটির নাম ছিল সোদ্বিয়া (Sotthiya) তাঁর কাছে তিনি এক আঁটি খড় ভিক্ষা করে নিলেন। এই খড়ের আসন বসে তিনি তপস্যা করতে চেয়েছিলেন এর পর সেই বোধিবৃক্ষের নীচে তিনি তপস্যায় বসলেন। তপস্যায় বসার আগে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যে পর্যন্ত না তাঁর প্রকৃত জ্ঞান লাভ হয় তিনি সেই আসন ত্যাগ করবেন না এতে যদি অস্থিচর্মসার হয়ে তাঁকে মৃত্যুও বরণ করতে হয় তাতেও তিনি প্রস্তুত আছেন। তাঁর তপস্যা শুধু তো তাঁর ছিল না ছিল সমগ্র মানব সমাজের জন্য। জীবন মৃত্যুর মাঝের সব যন্ত্রণার তিনি অবসান চাইছিলেন।
তপস্যার সময় পরিবেশের সব উপদ্রবের হাত হতে তিনি আত্মরক্ষা করতে চাইছিলেন। অতীতের সব ভোগ ও পরিবেশের কথা ভুলে যেতে চাইছিলেন। তিনি চাইছিলেন তাঁর মন ও শরীর যেন অন্য কোনও চিন্তায় আকৃষ্ট না হয়। প্রকৃত সত্য লাভ করাই ছিল তাঁর একটা মাত্র লক্ষ্য। মানুষ কষ্ট পায়? কীভাবে এই কষ্ট হতে পরিত্রাণ পাওয়া যায় এটুকুই ছিল তাঁর জিজ্ঞাস্য আর এই প্রশ্নে সমাধানই ছিল তাঁর অভিপ্রেত লক্ষ্য। রাজকুমার সিদ্ধার্থ তখন ছিলেন একজন তরুণ যুবক মাত্র। তাঁর বয়স তখন মাত্র বত্রিশ বছর। মাঝে মাঝেই তাঁর পিতা তাঁর জন্য যে সব যৌবনোচিত আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা করেছিলেন এ সবই তাঁর স্মরণে আসছিল। এই সব ভোগ লালসার চিন্তা হতে তিনি মনকে মুক্ত করে আনতে চাইছিলেন। এই সব নর্তকীদের ছায়া ছায়া আকার তাঁকে উত্ত্যক্ত করছিল। তাঁকে আগের ভোগজীবনে ফিরে যাবার জন্য প্রলুব্ধ করতে চাইছিল। তারা তাকে রাজপ্রাসাদে রাজার মতো ভোগসুখের মধ্যে জীবন কাটাবার জন্য বার বার প্রলোভন দেখাচ্ছিল। কিন্তু সেই সময় তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথাও তাঁর বারবার মনে পড়ছিল। প্রবল মানসিক শক্তি প্রয়োগ করে সিদ্ধার্থ এই সব প্রলোভনকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছিলেন। অবশেষে তাঁর ইচ্ছাশক্তির জয় হল। তাঁর মন প্রশান্ত হল। তাঁর মন সুস্থির ও সুস্থিত হল। বাতাস না থাকলে যেমন সরোবরের জলতল স্থির থাকে ঠিক তেমনি তিনি হয়ে গেলেন সুস্থির ও প্রশান্ত। তিনি গভীর সমাধিতে মগ্ন হলেন। সমাধির এই সুস্থির মুহূর্তে সিদ্ধার্থ অন্বেষণ করতে চাইলেন তাঁর নিজের জীবনের সূত্রপাত কীভাবে ঘটছিল। এই সময়ে তিনি তাঁর পূর্ব পূর্ব জীবনের সব কিছু জানতে পারলেন। যখন আরও সক্ষমতা লাভ করলেন এল আরও অন্তর্দৃষ্টি ও পরিজ্ঞান (দিব্যচক্ষু) তিনি দেখতে পেলেন তাঁর ভবিষ্যৎ জন্মের যাবতীয় ঘটনাগুলির সকল প্রাণীর পুনর্জন্মের কথাগুলি তিনি সবই জানতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারলেন জন্ম ও মৃত্যুর এই চক্রের মূলে রয়েছে মানুষের কর্ম যার ফল হল বারবার জন্মগ্রহণ এ মৃত্যুবরণ। কর্ম কি মানুষের চিন্তা ও কার্যের সমাষ্টি। কারও কারও জীবনে যে সুখ ও শান্তি দেখা যায় তার কারণ হল তার পূর্বজন্মের কার্যকলাপ। আবার যাদের জীবনে দেখা যায় অসুখ যন্ত্রণা ও অতৃপ্তি তাও তাদের পূর্বজন্মে কৃত পাপ দুষ্কর্মের ফল। পূর্বজন্মে তারা অনেক অসৎ কর্ম করেছে অপরাধ করেছে তাই তাদের এই শাস্তি এ জন্মে প্রাপ্য হয়েছে। অবশেষে সিদ্ধার্থ বুঝলেন মানুষের যাবতীয় দুঃখকষ্টের একমাত্র কারণ হল জন্ম এবং মৃত্যু। জন্মগ্রহণের পর হতেই মানুষ মায়ার অধীনে পড়ে। ফলে নানান পার্থিব সুখ ভোগের লোভ জন্মায়। এই লোভপূরণ হলেও শান্তি নাই। আরও নানা লোভ লিপ্সা সৃষ্টি হতে থাকে। ভোগ লিপ্সা দূর না হলে মনে শান্তি আসে না। কিন্তু মানুষ চিন্তাতেই আনতে পারে না যে পার্থিব সকল ভোগ তৃষ্ণা মায়ার কারণে উৎপন্ন হয় এবং এই ভোগলালসা জীবনের একটা ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। এর মূলে আছে মোহ। এই মোহ এবং তার কারণ হতে মুক্তি পেলে মানুষের দুঃখকষ্টের অবসান হতে পারে। এই অবস্থা হল ‘আস্রভক্ষ’ (Asravaksya) সিদ্ধার্থ অবশ্য নিজে এই ভোগ লালসা হতে মুক্তি পেয়েছেন। এগুলির ভ্রান্তি সম্পর্কে তিনি অবহিতও হয়েছেন। তিনি জেনেছেন জীবনের দুঃখকষ্ট হতে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। তবে কি বোধি লাভ হয়েছে? এই প্রাপ্তি ঘটেছে এক বৈশাখী পূর্ণিমায়। শাক্যবংশের সিদ্ধার্থ এক বোধি বৃক্ষতলে বসে হয়ে উঠলেন বুদ্ধ অর্থাৎ পরম জ্ঞানের জ্ঞানী। তখন তাঁর বয়স মাত্র উনচল্লিশ। নিরঞ্জনা নদীতীরে বোধিবৃক্ষের তলদেশে বসে বুদ্ধ তাঁর উপলব্ধির কথা জানতে পারলেন। পৃথিবী সেদিন পেরেছে এক উজ্জ্বল জ্যোতি বিশিষ্ট আলোকবর্তিক্য। সিদ্ধার্থ হলেন বুদ্ধ অর্থাৎ জ্ঞানপ্রাপ্ত।