॥ ৮ ॥
পরদিন সকালে কাগজ খুলে দেখি তরফদার সম্বন্ধে খবর বেরিয়েছে। যে উনি উনিশে ডিসেম্বর দলবল নিয়ে দক্ষিণ ভারত সফরে যাচ্ছেন, পঁচিশে ডিসেম্বর ম্যাড্রাসে ওঁর প্রথম শো।
ফেলুদা চুল ছাঁটাতে গিয়েছিল, দশটা নাগাত ফিরল। ওকে খবরটার কথা বলতে ও গম্ভীরভাবে বলল, ‘দেখেছি।… আত্মপ্রচারের লোভ খুব কম লোকেই সামলাতে পারে রে, তোপসে! আমি একটু নরম-গরম কথা শোনাবো বলে ওকে ফোন করেছিলাম, কারণ—বুঝতেই ত পারছিস—এই খবর বেরোনর ফলে আমার কাজটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ছে।’
‘তরফদার কী বললেন?’
ফেলুদা একটা শুক্নো হাসি হেসে বলল, ‘বলে কি—আজকের দিনে শোম্যানদের পাবলিসিটি ছাড়া গতি নেই, মিস্টার মিত্তির। ও নিয়ে আপনি কাইন্ডলি আমাকে কিছু বলবেন না।…আমি বললাম—যে-তিনজন ব্যক্তি নয়নের দিকে লুব্ধ দৃষ্টি দিচ্ছে, তারা যে তোমার প্রোগ্রামটা জেনে গেল সেটা কি ভালো হল?— তাতে ছোক্রা বলল— আপনি চিন্তা করবেন না। আমি যে ভাবে ওদের বলেছি, আমার বিশ্বাস তাতে ওরা নয়নকে পাবার আশা ছেড়েই দিয়েছে। —-এর পর আর কী বলি বল? সত্যি যদি তাই হয় তাহলে ত আমার আর কোনো প্রয়োজনই থাকে না। কিন্তু আমি ত জানি যে নয়নের বিপদ—এবং সেই সঙ্গে আমার দায়িত্ব—এখনো পুরোমাত্রায় রয়েছে! অর্থাৎ আমার দিক থেকে কাজে ঢিলে দেবার কোনো প্রশ্নই আসে না।’
বাইরে গাড়ি থামার শব্দ, আর তার পরে পর পর দুবার কলিং বেল টেপার শব্দে বুঝলাম জটায়ু হাজির। এখন সোয়া দশটা; ভদ্রলোক সাধারণত নটা-সাড়ে নটার মধ্যে চলে আসেন। আজ কোনো কারণে দেরি হয়েছে।
দেখে ভালো লাগল যে ফেলুদার মুখ থেকে মেজাজ খিঁচড়োনো ভাবটা চলে গেল।
‘খবর আছে মশাই, খবর আছে!’ ঘরে ঢুকেই চোখ বড় বড় করে বললেন জটায়ু।
‘দাঁড়ান, দেখি আমি কতদূর আন্দাজ করতে পারি,’ বলল ফেলুদা। ‘আপনি নিউ মার্কেটে গেস্লেন। ঠিক?’
‘কী করে জানলেন?’
‘আপনার কোটের বুক পকেট থেকে আইডিয়াল স্টোর্সের ক্যাশমেমোর ইঞ্চি খানেক বেরিয়ে আছে। তাছাড়া আপনার কোটের বাঁ দিকের সাইড পকেট এমনভাবে ঝুলে ফুলে রয়েছে যে বোঝাই যাচ্ছে আপনার প্রিয় টুথপেস্ট ফরহ্যানসের একটি ফ্যামিলি সাইজ টিউবের প্যাকেট রয়েছে। ওখানে।’
‘বোঝো! —নেক্সট?’
‘আপনি রেস্টোরান্টে গিয়ে স্ট্রবেরি আইসক্রিম খেয়েছিলেন—তার দু’ ফোঁটা আপনার সার্টে পড়েছে।’
‘সাবাশ! —নেক্সট?’
‘আপনি একা কখনো রেস্টোরান্টে জান না। অর্থাৎ একটি পরিচিত ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছিল, যার সঙ্গে আপনি যান।’
‘জবাব নেই! –নেক্সট্?’
‘আপনি তাকে নিয়ে যান নি, সেই আপনাকে নিয়ে গেস্ল। কারণ আপনাকে এতকাল চিনে অন্তত এটুকু জানি যে আপনার এমন কোনো বন্ধু এখন নেই যাকে আপনি রেস্টোরান্টে নিয়ে গিয়ে আইসক্রিম খাওয়াবেন।’
‘আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে! —নেক্সট?’
‘এ ব্যক্তির সঙ্গে সম্প্রতি আলাপ হয়েছে আপনার। পুরোনো আলাপী বলতে আমরা দুজন ছাড়া আপনার আর কেউ নেই। তরফদার কী? না। তার এত সময় নেই; সে এখন সফরের তোড়জোড় করছে। চতুর্লোভীর কেউ কি? হজসন নন, কারণ সে ইনভাইট করলে আপনি রিফিউজ করবেন—একটানা ইংরিজি বলাটা আপনার পারদর্শিতার মধ্যে পড়ে না। তারকনাথ? উঁহু, তাঁর নিউ মার্কেটে কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে না; উত্তর কলকাতায় দোকানের অভাব নেই। আর তাছাড়া আমার ধারণা তাঁর বাজার করার জন্য মাইনে করা লোক আছে। তাহলে বাকি রইল কে?’
‘ব্রিলিয়ান্ট, ব্রিলিয়ান্ট! আপনি ধরে ফেলেছেন, ফেলুবাবু, ধরে ফেলেছেন! অনেকদিন পরে আপনার চিন্তাশক্তি আর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার নমুনা পাওয়া গেল। থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার!’
‘বসাক ত?’
‘বসাক, বসাক— নন্দলাল বসাক! আজ প্রথম পুরো নামটা জানলুম।’
‘আপনার সঙ্গে তাঁর কী কথা?’
‘কথা ভালো নয়, ফেলুবাবু। ভদ্রলোক তরফদারকে আরো দশ হাজার ডলার অফার করেছিলেন। তার মানে ত্রিশ। আজকাল এক ডলারে কত টাকা?’
‘সতেরোর আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে।’
‘হিসেব করুন, গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠবে।’
‘তরফদার কী বলেন?’
‘তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তার ফলে বসাকের মেজাজ খিঁচড়ে যায়। তরফদারকে কিছু বলেননি, তবে আমাকে বললেন—আপনি ওই ভেলকিরামকে বলে দেবেন যে বসাকের সংকল্পে ব্যাগড়া দেবে এমন লোক এখনো জন্মায়নি। শেষের কথাগুলো আরো সাংঘাতিক; বললেন—বড়দিনে মাদ্রাজে তরফদারের শো ওপ্ন করছে; ইফ মাই নেম ইজ নন্দ বসাক—তাহলে সেই শো থেকে ওই খোকার আইটেম বাদ দিতে হবে। টেল দিস টু ইওর টিকটিকি ফ্রেন্ড।’
ফেলুদার চেহারার সঙ্গে অনেক বাঙালীই পরিচিত, কাজেই বসাক যে তাকে চিনে ফেলবেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবু কেন জানি আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এল।
‘বসাকের হদিস ত তবু পাওয়া গেল, বলল ফেলুদা, ‘তেওয়ারি ইজ আউট অফ দ্য পিকচার। এখন বাকি তারকনাথ আর হজসন।’
‘তারকনাথ কেন—গাওয়াঙ্গি বলুন! তারকনাথ খ্যাপাটে হতে পারেন, কিন্তু তাঁর যা বয়স তাতে তিনি একা কিছু করতে পারবেন না।’
একেই ফেলুদা বলে টেলিপ্যাথি। তারকনাথের কথা ওঠার মিনিট খানেকের মধ্যেই কলিং বেল বাজায় দরজা খুলে দেখি স্বয়ং টি. এন. টি.।
‘মিঃ মিত্তির আছেন?’
‘আসুন, আসুন,’ ভিতর থেকে বলল ফেলুদা। ‘আপনিও দেখছি আমায় চিনে ফেলেছেন।’
‘তা চিনব না কেন?’ ঘরে ঢুকে একটা কাউচে বসে বললেন ভদ্রলোক। ‘আর আপনাকে যখন চিনেছি, তখন আপনার এই ল্যাংবোটটিকেও চিনেছি। আপনিই ত জটায়ু?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘একবার ভেবেছিলাম আপনাকেও আমার আজব ঘরে এনে রাখব, কারণ গাঁজাখুরি গপ্পো লেখায় ত আপনি একমেবাদ্বিতীয়ম্! “হন্ডুরাসে হাহাকার”— হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!’
ভদ্রলোকের এই ঘর-কাঁপানো হাসির সঙ্গে আবার নতুন করে পরিচয় হল।
‘তাহলে আপনার সঙ্গে মাদ্রাজে দেখা হচ্ছে?’ ফেলুদার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন তারক ঠাকুর।
‘আপনি যাওয়া স্থির করে ফেলেছেন?’
‘শুধু আমি কেন? আমার ইউগ্যান্ডার অপোগণ্ডটিও যাবেন! হাঃ হাঃ হাঃ —কেমন? ভালো হয়েছে? জটায়ু?’
‘আপনি ট্রেনে যাচ্ছেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘তাছাড়া ত উপায় নেই। প্লেনের সীটে ত গাওয়াঙ্গি বসতেই পারবে না!’
আরেক দফা হো হো করে হেসে ভদ্রলোক উঠে পড়ে বললেন, ‘আপনাকে একটা কথা বলি মিঃ মিত্তির—এমন অনেক সিচুয়েশান আছে যেখানে শারীরিক শক্তির কাছে মানসিক শক্তি দাঁড়াতেই পারে না। গাওয়াঙ্গির চেয়ে আপনার বুদ্ধি যে অনেক গুণে বেশি তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আপনার ব্যায়ামের অভ্যাস থাকলেও, গাওয়াঙ্গির যে শারীরিক বল, তার শতাংশের একাংশও আপনার নেই। —গুড বাই।’
ভদ্রলোক যেমন হঠাৎ এসেছিলেন, তেমনিই হঠাৎ চলে গেলেন। আমি মনে মনে বললাম—এই গাওয়াঙ্গি বস্তুটিকে একবার চাক্ষুষ দেখতেই হবে।