॥ ১৩ ॥
হিঙ্গোরানিকে যে ডিটেকনীকের গোয়েন্দাই খুন করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ পুলিশের ডাক্তার নানা পরীক্ষা করে বলেছেন খুনটা হয়েছে আড়াইটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে। গোয়েন্দা ভদ্রলোক আমাদের ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন পৌনে তিনটে নাগাত—আর তিনি নিজেই বলেছিলেন সোজা যাবেন হিঙ্গোরানির ঘরে। এও বোঝা যাচ্ছে যে হিঙ্গোরানি তেওয়ারির টাকা ফেরত দিতে রাজি হননি। তাই গোয়েন্দা তার কথামতো অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিয়েছেন। বেডসাইড টেবিলের উপর খুচরো পঁয়ষট্টি পয়সা ছাড়া এক কপর্দকও পাওয়া যায়নি হিঙ্গোরানির ঘরে। একটা সুটকেস ছাড়া আর কোনো মাল ঘরে ছিল না। টাকা নিশ্চয়ই একটা ব্রীফকেস জাতীয় ব্যাগে ছিল; তার কোনো চিহ্ন আর নেই।
ফেলুদা পুলিশকে জানিয়েছে যে আততায়ী যদি টাকা নিয়ে থাকে তাহলে সে-টাকা সে কলকাতায় গিয়ে টি. এইচ. সিন্ডিকেটের মিঃ দেবকীনন্দন তেওয়ারির হাতে তুলে দেবে। এই খবরটা কলকাতার পুলিশকে জানানো দরকার।
ফেলুদাকে হত্যাকারীর চেহারার বর্ণনা দিয়ে বলতে হল যে লোকটার নাম তার জানা নেই। —‘শুধু এটুকু বলতে পারি যে সে সম্ভবত কচ্ছ প্রদেশের লোক।’
মিঃ রেড্ডি খবর পেয়েই চলে এসেছিলেন, আর এখন আমাদের ঘরেই বসে ছিলেন। আমি ভেবেছিলাম তিনি ব্যাপারটা জেনে মূর্ছা যাবেন। তার বদলে দেখলাম নয়ন ছাড়াও কী ভাবে শো টাকে জমানো যায় তিনি সেই কথা ভাবছেন। বোঝাই যায় ভদ্রলোকের তরফদারের উপর একটা মায়া পড়ে গেছে। বললেন, ‘শো বন্ধ না করে যদি আপনার হিপ্নোটিজ্ম-এর আইটেমটা ডবল করে দেওয়া যায়? আমি ম্যাড্রাসের লীডিং ফিল্ম স্টারস্, ডানসারস্, সিঙ্গারস্কে ডাকব ওপ্নিং নাইটে। আপনি তাদের এক এক করে স্টেজে ডেকে বুদ্ধু বানিয়ে দিন। কেমন আইডিয়া?’
তরফদার মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘শুধু আপনার ওখানে খেলা দেখিয়ে ত আমার চলবে না! আমি জানি নয়নের খবর ছড়িয়ে গেছে। সব ম্যানেজার ত আপনার মতো নয়, মিঃ রেড্ডি!—তাদের বেশির ভাগই কড়া ব্যবসাদার। নয়ন ছাড়া তারা আমাকে বুকিংই দেবে না।…একসঙ্গে দুটো দুর্ঘটনা আমাকে শেষ করে দিয়েছে।’
ফেলুদা তরফদারকে জিজ্ঞেস করল, ‘হিঙ্গোরানি কি তোমাকে অলরেডি কিছু পেমেন্ট করেছেন?’
‘কলকাতায় থাকতে কিছু দিয়েছিলেন; তাতে আমাদের যাতায়াতের খরচ হয়ে যায়। একটা বড় কিস্তি আগামী কাল দেবার কথা ছিল। উনি দিনক্ষণ দেখে এসব কাজ করতেন। আগামীকাল নাকি দিন ভালো ছিল।’
মিঃ রেড্ডি কাহিল। বললেন, ‘তোমার অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। এই মন নিয়ে তোমার পক্ষে শো করা অসম্ভব।’
‘শুধু আমি না, মিঃ রেড্ডি। আমার ম্যানেজার শঙ্কর এমন ভেঙে পড়েছে যে সে শয্যা নিয়েছে। তাকে ছাড়াও আমার চলে না।’
পুলিশ আধঘণ্টা হল চলে গেছে। তারা খুনের তদন্তই করবে; মাদ্রাজের বিভিন্ন হোটেল, লজ, ধরমশালায় খোঁজ নেবে আমাদের বর্ণনার সঙ্গে মেলে এমন চেহারার কোনো লোক গত দুদিনের মধ্যে সেখানে এসে উঠেছে কিনা। হিঙ্গোরানির ভাইপো মোহনকে টেলিফোন করা হয়েছিল। সে আগামীকাল এসে লাশ সনাক্ত করে সৎকারের ব্যবস্থা করবে। মৃতদেহ এখন মর্গে রয়েছে। পুলিশ এও জানিয়েছে যে ছোরার হাতলে কোনো আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। নয়নের ব্যাপারে ফেলুদা বলল যে সে নিজেই তদন্ত করবে। তাতে তরফদার সায় দিয়েছেন।
রেড্ডি এবার চেয়ার থেকে উঠে ফেলুদাকে বললেন, ‘আমি কিন্তু আপনার উপরই ভরসা করে আছি, মিঃ মিত্তির। দুদিন যদি শো পোস্টপোন করতে হয় তা আমি করব। এই দুদিনের মধ্যে আপনি জ্যোতিষ্কম্কে খুঁজে বার করে দিন—প্লীজ!’
রেড্ডি যাবার মিনিটখানেকের মধ্যে তরফদারও উঠে পড়ে বললেন, ‘দুদিন দেখি। তার মধ্যে যদি নয়নকে না পাওয়া যায় তাহলে কলকাতায় ফিরে যাব।—আপনি কি আরো কিছুদিন থাকবেন?’
‘অনির্দিষ্টকাল থাকা অবশ্যই সম্ভব নয়’, বলল ফেলুদা। ‘তবে এইভাবে চোখে ধুলো দেওয়াটাও মেনে নেওয়া মুশকিল। দেখি…’
তরফদার বেরিয়ে যাবার পর ফেলুদা হাতের সিগারেটে একটা শেষ টান দিয়ে তার খুব চেনা গলায় একটা চেনা কথা মৃদুস্বরে তিনবার বলল—‘খট্কা…খট্কা…খট্কা…’
‘এটা আবার কিসের খট্কা?’ জটায়ু জিজ্ঞেস করলেন।
‘হিঙ্গোরানিকে বলা ছিল যে অচেনা লোক হলে সে যেন দরজা না খোলে; তাহলে ডিটেকনীক ঢুকলেন কী করে? তাকে কি হিঙ্গোরানি আগে থেকেই চিনতেন?’
‘কিছুই আশ্চর্য নয়’, বললেন জটায়ু। ‘হিঙ্গোরানি কতরকম ব্যাপারে আমাদের ধাপ্পা দিয়েছিল ভেবে দেখুন।’
আমি ফেলুদাকে একটা কথা না বলে পারলাম না।
‘তুমি কি শুধু হিঙ্গোরানি মার্ডারের কথাই ভাবছ, ফেলুদা? আমার কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে যে একটা বাজে লোক যদি খুন হয়েও থাকে তাতে যতটা ভাবনা হয়, তার চেয়ে নয়নের মতো ছেলে চুরি যাওয়াটা অনেক বেশি ভাবনার। তুমি হিঙ্গোরানি ভুলে গিয়ে এখন শুধু নয়নের কথা ভাবো।’
‘দুটোই ভাবছি রে তোপ্শে, কিন্তু কেন জানি মনের মধ্যে দুটো জট পাকিয়ে যাচ্ছে।’
‘এ আবার কী হেঁয়ালি মশাই?’ লালমোহনবাবু বেশ বিরক্তভাবে বললেন। ‘দুটো ত সেপারেট ঘটনা—জট পাকাতে দিচ্ছেন কেন?’
ফেলুদা জটায়ুর কথায় কান না দিয়ে বার দুতিন মাথা নেড়ে বলল, ‘নো সাইন অফ স্ট্রাগ্ল…নো সাইন অফ স্ট্রাগ্ল…’
‘সে ত শুনলুম’, বললেন জটায়ু। ‘পুলিশ ত তাই বলল।’
‘অথচ লোকটা যে ঘুমের মধ্যে খুন হয়েছে তা ত নয়!’
‘তা হবে কেন? জুতো মোজা পরে কেউ ঘুমোয় নাকি?’
‘তা অনেক মাতাল ঘুমোয় বৈকি—কারণ তাদের হুঁশ থাকে না।’
‘কিন্তু এঁর ঘরে ত ড্রিঙ্কিং-এর কোনো চিহ্ন ছিল না।—অবিশ্যি যদি বাইরে থেকে মদ খেয়ে এসে দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে থাকে…’
‘উঁহু।’
‘হোয়াই নট?’
‘টিভি খোলা ছিল, যদিও ভল্যুম একেবারে নামানো ছিল। তাছাড়া অ্যাশট্রের খাঁজেতে একটা আধখানা সিগারেট পুরোটা ছাই হয়ে পড়ে ছিল। অর্থাৎ ভদ্রলোক টিভি দেখতে দেখতে সিগারেট খাচ্ছিলেন, সেই সময় দরজার বেলটা বাজে। হিঙ্গোরানি টিভির ভল্যম পুরো নামিয়ে দিয়ে সিগারেটটা ছাইদানের কানার খাঁজে রেখে উঠে গিয়ে দরজা খোলেন।’
‘খোলার আগে কি জিজ্ঞেস করবেন না কে বেল টিপল?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু চেনা গলা হলে ত আর দ্বিধার কোনো কারণ থাকে না।’
‘তাহলে ধরে নিন যে হিঙ্গোরানির সঙ্গে এই গোয়েন্দার আলাপ ছিল, এবং হিঙ্গোরানি তাকে অসৎ লোক বলে জানতেন না।’
‘কিন্তু সেই লোক যখন ছুরি বার করবে তখন হিঙ্গোরানি বাধা দেবেন না? স্ট্রাগ্ল হবে না?’
‘আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। কী ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব সেটা আপনি ভেবে বের করবেন। যদি না পারেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনার পাঠকদের অভিযোগের যথেষ্ট কারণ আছে। কোথায় গেল আপনার আগের সেই জৌলুস। সেই ক্ষুরধার—’
‘চুপ!’
লালমোহনবাবুকে ব্রেক কষতে হল।
ফেলুদা আমাদের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে এখন দেয়ালের দিকে চেয়ে—চোখে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কপালে গভীর খাঁজ।
আমি আর জটায়ু প্রায় এক মিনিট কথা বন্ধ করে ফেলুদার এই নতুন চেহারাটা দেখলাম। তারপর আমাদের কানে এল কতকগুলো কথা—ফিসফিসিয়ে বলা—
‘বু-ঝে-ছি।—কিন্তু কেন, কেন, কেন?’
দশ-বারো সেকেণ্ড নৈঃশব্দ্যের পর লালমোহনবাবুর চাপা কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
‘আপনি একটু একা থাকতে চাইছেন কি?’
‘থ্যাঙ্ক ইউ, মিস্টার গাঙ্গুলী। আধঘণ্টা, আধঘণ্টা, থাকতে চাই একা।’
আমরা দুজন উঠে পড়লাম।