০৩. শুক্রবারের কাগজ

৩ ॥

শুক্রবারের কাগজে নয়ন সম্বন্ধে বেরোনর কথা; আজ মঙ্গলবার। বেশ অবাক হলাম দেখে যে, আজই তরফদারের কাছ থেকে টেলিফোন এল। শুধু ফেলুদার দিকটা শুনে ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারলাম না; ফোন রাখার পর ফেলুদা খুলে বলল।

‘খবরটা এর মধ্যেই ছড়িয়েছে, বুঝেছিস তোপ্‌শে। আটশো লোক সেদিন ম্যাজিক দেখেছে; তার মধ্যে কতজন কত লোককে নয়ন সম্বন্ধে বলেছে কে জানে? ব্যাপারটা যা দাঁড়িয়েছে—তরফদার চারজনের কাছ থেকে টেলিফোন পেয়েছে। হেঁজিপেঁজি নয়, বেশ মালদার লোক। তারা সকলেই নয়ন সম্বন্ধে কথা বলতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চায়। তরফদার কাল সকাল ন’টা থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট রেখেছে। প্রত্যেককে পনের মিনিট সময় দেবে। এও বলে দিয়েছে যে, তার সঙ্গে আরো তিনজন লোক থাকবে—অর্থাৎ মিস্টার ফেলু, মিস্টার তপেশ আর মিস্টার লালু। এই খবরটা তুই এক্ষুনি ফোন করে জটায়ুকে জানিয়ে দে।’

‘কিন্তু এই চারজন কারা সেটা তরফদার বললেন না?’

‘একজন আমেরিকান, একজন পশ্চিমা ব্যবসাদার, একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, একজন বাঙালি। আমেরিকানটি নাকি ইমপ্রেসারিও। অর্থাৎ নানা রকম শিল্পীদের স্টেজে উপস্থিত করেন এবং তা থেকে দু’ পয়সা কামান। অন্য তিনজন কী তা গেলে জানা যাবে। আসল কথা যা বুঝলাম—তরফদার বুঝেছে সে একা সিচুয়েশনটা হ্যান্ডল করতে পারবে না; তাই আমাদের ডাকা।’

লালমোহনবাবুকে ফোন করাতে ভদ্রলোক আর থাকতে না পেরে চলেই এলেন। ‘শ্রীনাথ!’ বলে একটা হাঁক দিয়ে তাঁর প্রিয় কাউচটাতে বসে বললেন, ‘একটা চেনা-চেনা গন্ধ পাচ্ছি যে মশাই, কী ব্যাপার?’

‘এখন পর্যন্ত গন্ধ পাবার কোনো কারণ নেই, লালমোহনবাবু। এটা নিছক আপনার কল্পনা।’

‘আমি মশাই কাল থেকে ওই খোকার কথা ভাবছি। কী অদ্ভুত ক্ষমতা বলুন ত?’

‘কিছুই বলা যায় না’, বলল ফেলুদা, ‘একদিন হয়ত দেখবেন হঠাৎ ম্যাজিকের মতো ক্ষমতাটা লোপ পেয়ে গেছে। তখন আর-পাঁচটা ছেলের সঙ্গে নয়নের কোনো তফাত থাকবে না।’

‘কাল তাহলে আমরা তরফদারের ওখানে মীট করছি?’

‘ইয়েস, এবং একটা কথা আপনাকে বলে রাখি—আমি কিন্তু কাল গোয়েন্দা হিসেবে যাচ্ছি না। আমি হব নির্বাক দর্শক। যা কথা বলার তা আপনি বলবেন।’

‘এটা আপনি রিয়েলি মীন করছেন?’

‘সম্পূর্ণ।’

‘ঠিক হ্যায়। জয় মা তারা বলে লেগে পড়ব।

*

একডালিয়া রোডে তরফদারের বাড়ি। মাঝারি দোতলা বাড়ি—অন্তত পঞ্চাশ বছরের পুরোন ত বটেই। গেটে সশস্ত্র দারোয়ান; বুঝলাম ফেলুদার সতর্কবাণীতে ফল হয়েছে।

ফেলুদার নাম শুনে দারোয়ান গেট খুলে দিল, আমরা ভিতরে ঢুকলাম।

ঢুকেই ডাইনে এক ফালি বাগান, তাতে কেয়ারির কোনো বালাই নেই। সদর দরজার দিকে এগিয়ে যাবার সময় ফেলুদা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বলল, ‘দেখবি উইদিন টু ইয়ারস্ তরফদার এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।’

‘কোথায় যাবে?’

‘সাম অট্টালিকা।’

সদর দরজার দারোয়ানও আমাদের সেলাম ঠুকে ভিতরে যেতে দিল।

আমরা যেখানে পৌঁছলাম, সেটা ল্যান্ডিং, বাঁয়ে সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। এদিক ওদিক দেখছি, এমন সময় বেশ ভদ্র পোশাক পরা একজন চাকর-বেয়ারা বলাই বোধহয় ঠিক হবে—আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘আসুন আপনারা’। আমরা চাকরের পিছন পিছন গিয়ে বৈঠকখানায় হাজির হলাম।

‘বসুন; বাবু আসছেন।’

এই ঘরের সাইজও মাঝারি, তবে আসবাবপত্রে বেশ রুচির পরিচয় আছে। দুটো সোফায় ভাগাভাগি করে আমরা তিনজন বসলাম।

‘গুড মর্নিং!’

ম্যাজিশিয়ান হাজির, তবে একা নন। তাঁর পাশে একটি বিরাট অ্যালসেশিয়ান দণ্ডায়মান। আমি জানি ফেলুদা কুকুরের ভক্ত, আর যত বড় যত ভীতিজনক হাউন্ডই হোক না কেন, পোষা জানলে তার পিঠে হাত বোলানোর লোভ সামলাতে পারে না। এখানেও তাই করল।

‘এর নাম বাদশা’, বললেন তরফদার। ‘বয়স বারো। খুব ভালো ওয়চ-ডগ।’

‘এক্সেলেন্ট!’ আবার সোফায় বসে বলল ফেলুদা। ‘আমরা কিন্তু তোমার কথামতো পনের মিনিট আগেই এসেছি।’

‘আপনি যে পাংচুয়াল হবেন সেটা আমি জানতাম’, তৃতীয় সোফায় বসে বললেন তরফদার।

‘তোমার এ বাড়ি কি ভাড়া বাড়ি?’ জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

‘আজ্ঞে না। এ বাড়ি আমার বাবার তৈরি। উনি নামকরা অ্যাটর্নি ছিলেন। আরেকটা বাড়ি আছে—ওল্ড বালিগঞ্জ রোডে। সেটায় আমার দাদা থাকেন। দুই ভাইকে দুটো বাড়ি উইল করে দিয়ে যান। বাবা মারা যান এইট্টি-ফোরে। আমি এই বাড়িতেই মানুষ হয়েছি।’

‘আপনি সংসার করেননি?’ জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।

‘আজ্ঞে না’, মৃদু হেসে বললেন তরফদার। ‘তাড়া কী? আগে শো-টাকে দাঁড় করাই!’

চা এসে গেছে, সঙ্গে সিঙ্গাড়া। ফেলুদা একটা সিঙ্গাড়া তুলে নিয়ে বলল, ‘আজ কিন্তু আমি শ্রোতা। কিছু বলার থাকলে ইনি বলবেন।’ ফেলুদা জটায়ুর দিকে নির্দেশ করল। ‘ইনি কে জান ত?’

‘তা জানি বৈকি!’ চোখ কপালে তুলে বললেন তরফদার। ‘বাঙলার নাম্বার ওয়ান রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক।’

লালমোহনবাবু কোনোদিন চেষ্টা করেও বিনয়ী ভাব প্রকাশ করতে পারেননি; এখন একটা সেল্যুটে বুঝিয়ে দিলেন তিনি চেষ্টাই করছেন না।

ফেলুদা হাতের কাপ টেবিলে রেখে একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল, ‘তোমাকে একটা কথা অকপটে বলছি, সুনীল। তোমার শোয়ে শোম্যানশিপের কিঞ্চিৎ অভাব লক্ষ করলাম। আজকের উঠতি যাদুকরদের কিন্তু ও দিকটা নেগলেক্ট করলে চলে না। তোমার হিপ্‌নটিজ্‌ম, আর তোমার নয়ন—দুটোই আশ্চর্য আইটেম তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আজকের দর্শক জাঁকজমকটাও চায়।

‘জানি। আমার মনে হয় সে অভাব এবার পূরণ হবে। অ্যাদ্দিন যে হয়নি তার একমাত্র কারণ পুঁজির অভাব।’

‘সে অভাব মিটল কী করে?’ ভুরু তুলে প্রশ্ন করল ফেলুদা।

‘সুখবরটা দেবার মওকা খুঁজছিলাম।—আমি একজন ভালো পৃষ্ঠপোষক পেয়েছি, স্যার।’

‘এই সেদিনই বলছিলাম, আর এর মধ্যেই…?’

‘হ্যাঁ স্যার। আপাতত আর কোনো ভাবনা নেই।’

‘কিন্তু কে সেই ব্যক্তি সে কি জানতে পারি?’

‘কিছু মনে করবেন না, স্যার—তিনি তাঁর নামটা উহ্য রাখতে বলেছেন।’

‘কিন্তু ব্যাপারটা ঘটল কী করে সেটা বলাও কি বারণ?’

‘মোটেই না। এই ভদ্রলোকের এক নিকট-আত্মীয় গত রবিবার আমার শো দেখে সেই রাত্রেই ভদ্রলোককে নয়নের কথা বলেন। রাত দশটায় ভদ্রলোকের কাছ থেকে আমি ফোন পাই। তিনি বলেন যে, অবিলম্বে আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান। আমি পরদিনই সকাল দশটায় সময় দিই। উনি কাঁটায় কাঁটায় দশটায় এসে হাজির হন। তারপর বৈঠকখানায় এসে বসে আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন জ্যোতিষ্ককে কী ভাবে দেখা যায়। নয়ন আমার কাছেই থাকে জেনে ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ নয়নকে ডেকে পাঠাতে বলেন। নয়ন এলে পর ভদ্রলোক তাকে দু-একটা এমন প্রশ্ন করেন যার উত্তর সংখ্যায় হয়। নয়ন অবশ্যই ঠিক ঠিক জবাব দেয়। ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ নয়নের দিকে চেয়ে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রস্তাবটা দেন।’

‘কী প্রস্তাব?’

‘প্রস্তাবটা আমাকে হাতে চাঁদ পাইয়ে দিল। উনি বললেন আমার শো-য়ের সব খরচ উনি বহন করবেন। একটা কোম্পানি স্থাপন করবেন যার নাম হবে “মিরাক্‌লস আনলিমিটেড”। এই কোম্পানির মালিক কে তা কেউ জানবে না। এই কোম্পানির হয়েই আমি শো করব। তা থেকে খ্যাতি যা হবে তা আমার, খরচ হয়ে লাভ যা হবে তা ওঁর। আমাকে উনি মাসোহারা দেবেন যাতে আমার আর নয়নের স্বচ্ছন্দে চলে যায়।…আমি অবিশ্যি এ প্রস্তাবে রাজি হই, কারণ আমার মন থেকে সমস্ত চিন্তা দূর হয়ে যাচ্ছে এতে।’

‘কিন্তু এমন সুযোগ উনি হঠাৎ কেন দেবেন সে কথা জিজ্ঞেস করনি?’

‘স্বভাবতই করেছি, এবং উনি তাতে এক অদ্ভুত কাহিনী শোনালেন। ওনার শখ ছিল পেশাদারি যাদুকর হবেন। ইস্কুল থেকে শুরু করে বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত উনি সমানে ম্যাজিক অভ্যাস করেছেন, ম্যাজিকের বই আর সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছেন। বাদ সাধলেন ওঁর বাবা। তিনি ছেলের এই নেশা সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না। একদিন ঘটনাচক্রে জানতে পেরে রেগে আগুন হয়ে ছেলের ম্যাজিকের সব সরঞ্জাম ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জোর করে তাকে ব্যবসায় নামান। অসম্ভব কড়া মেজাজের লোক ছিলেন বাবা, তাই ছেলে তাঁর শাসন মেনে নেন। শুধু তাই নয়, অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ভালো রোজগার করতে শুরু করেন। তা সত্ত্বেও তিনি ম্যাজিকের মোহ কাটিয়ে উঠতে পারেন না। ভদ্রলোক বললেন, “আমি রোজগার করেছি অনেক কিন্তু তাতে আমার আত্মার তৃপ্তি হয়নি। এই ছেলেকে দেখে বুঝতে পারছি এই আমার জীবনে সার্থকতা এনে দেবে।”

‘তোমার সঙ্গে লেখাপড়া হয়ে গেছে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি এখন অত্যন্ত হালকা বোধ করছি। নয়নের মাস্টার, ডাক্তার, জামাকাপড়—সব কিছুর খরচ উনি দিচ্ছেন। একটা প্রশ্ন অবিশ্যি উনি আমাকে করেন, সেটা হল কলকাতার বাইরে ভারতবর্ষের অন্য বড় শহরে শো করার অ্যামবিশন আমার আছে কিনা। আমি জানাই যে সেদিনই সকালে আমি ম্যাড্রাস থেকে একটা টেলিফোন পেয়েছি মিঃ রেড্ডি নামে এক থিয়েটারের মালিকের কাছ থেকে। রবিবার রাত্রে আমার শো দেখে ভদ্রলোকের একজন কলকাতাবাসী সাউথ ইন্ডিয়ান বন্ধু রেড্ডিকে নয়নের কথা টেলিফোনে জানান। তাই পরদিন সকালেই রেড্ডি আমাকে ফোন করেন। খবরটা শুনে পৃষ্ঠপোষক জানতে চাইলেন আমি রেড্ডিকে কী বলেছি। আমি বললাম—আমি ভাববার জন্য সময় চেয়েছি। তাতে পৃষ্ঠপোষক বলেন, “তুমি এক্ষুনি রেড্ডির আমন্ত্রণ অ্যাক্সেপ্ট করছ বলে টেলিগ্রাম কর। দক্ষিণ ভারত সফরে যাবে তুমি। শুধু ম্যাড্রাস নয়, আরো অন্য শহরে শো করবে তুমি। সব খরচ আমার।’

‘তোমাকে খরচের হিসাব দিতে হবে না?’ জিজ্ঞেস করল ফেলুদা। ‘তা ত বটেই’, বললেন তরফদার। ‘সে কাজের ভার নেবে আমার ম্যানেজার ও বন্ধু শঙ্কর। ও খুব এফিশিয়ান্ট লোক।’

পনের মিনিট যে চলে গেছে সেটা টের পেলাম যখন চাকর এসে বলল যে একটি সাহেব, আর তার সঙ্গে একটি বাঙালিবাবু এসেছেন।

‘এখানে নিয়ে এস’, বললেন তরফদার।’

জটায়ু দেখলাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নড়েচড়ে বসলেন, কারণ এখন থেকে ফেলুদা নির্বাক।

সাহেবের মাথায় ধবধবে সাদা চুল হলেও বয়স যে বেশি না সেটা চামড়ার টান ভাব দেখেই বোঝা যায়।

তরফদার উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, আগন্তুকদের বসতে বলে নিজেও বসলেন। ফেলুদা জায়গা করে দেবার জন্য আমাদের সোফাতেই লালমোহনবাবুর পাশে এসে বসল।

‘আমার নাম স্যাম কেলারম্যান’, বললেন সাহেব। ‘আর ইনি আমার ইন্ডিয়ার রিপ্রেজেনটিটিভ মিস্টার ব্যাস্যাক।’

লালমোহনবাবু কাজে লেগে গেলেন।

‘ইউ আর অ্যান ইমপ্রেসোরিয়া-থুড়ি, ইমপ্রেসারিও?’

‘ইয়েস। আজকাল ভারতীয় কালচার নিয়ে আমাদের দেশে খুব মাতামাতি চলছে। মহাভারত নাটক হয়েছে, মুভিও হয়েছে, জানেন বোধহয়। তাতে ভারতীয় ঐতিহ্যের একটা নতুন দিক খুলে গেছে।’

‘সো ইউ আর ইনটারেস্টেড ইন ইন্ডিয়ান কালচার?’

‘আই অ্যাম ইনটারেস্টেড ইন দ্যাট কিড।’

‘ইউ মীন—সান অফ এ গোট?’

আমি এটাই ভয় পেয়েছিলাম। আমেরিকানরা যে মানুষের বাচ্চাকেও কিড বলে সেটা লালমোহনবাবু জানেন না।

এবার মিঃ বসাক মুখ খুললেন।

‘ইনি জ্যোতিষ্কর কথা বললেন; মিঃ তরফদারের শো-তে যে ছেলেটি অ্যাপিয়ার করে।’

‘উনি ছেলেটি সম্বন্ধে কী জানতে চান সেটা বলবেন কি?’ বললেন তরফদার। মিঃ বসাক প্রশ্নটা অনুবাদ করে দেওয়াতে কেলারম্যান বললেন, ‘আমি চাই এই আশ্চর্য ছেলেটিকে আমাদের দেশের দর্শকের সামনে হাজির করতে। এর যা ক্ষমতা তা ভারতবর্ষ ছাড়া কোনো দেশে সম্ভব হত না। অবিশ্যি কিছু স্থির করার আগে আমি একবার ছেলেটিকে দেখতে চাই, এবং তার ক্ষমতারও একটু নমুনা পেতে চাই।’

বসাক বললেন, ‘মিঃ কেলারম্যান পৃথিবীর তিনজন সবচেয়ে বিখ্যাত ইমপ্রেসারিওর একজন। একুশ বছর ধরে এই কাজ করছেন। ছেলেটিকে পাবার জন্য ইনি অনেক মূল্য দিতে প্রস্তুত। তাছাড়া টিকিট বিক্রী থেকেও যা আসবে তার একটা অংশও ছেলেটি পাবে। সেটা চুক্তিতে লেখা থাকবে।’

তরফদার বললেন, ‘মিঃ কেলারম্যান, দ্য ওয়ান্ডার কিড ইজ পার্ট অফ মাই ম্যাজিক শো। তার আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবার প্রশ্নই উঠতে পারে না। সামনে আমার দক্ষিণ ভারত ট্যুর আছে—ম্যাড্রাস দিয়ে শুরু। সেখানে এই ছেলের খবর পৌঁছে গেছে, এবং তারা উদ্‌গ্রীব হয়ে আছে এর অদ্ভুত ক্ষমতা দেখার জন্য। ভেরি সরি, মিঃ কেলারম্যান—আমি আপনার অনুরোধ রাখতে পারলাম না।’

কেলারম্যানের মুখ লাল হয়ে গেছে। তাও তিনি ধরা গলায় অনুরোধ করলেন, ‘ছেলেটিকে একবার দেখা যায়? আর সেই সঙ্গে যদি তার ক্ষমতার…?’

‘তাতে অসুবিধে নেই।’ বললেন তরফদার। তারপর চাকরকে দিয়ে নয়নকে ডেকে পাঠালেন। নয়ন এসে তরফদারের সোফার হাতলে কনুই রেখে দাঁড়াল। দিনের বেলা তাকে এত কাছ থেকে দেখে অদ্ভুত লাগছিল। এমন একটা ক্ষমতা যে ওর মধ্যে আছে সেটা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই—যদিও চাউনিতে বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট।

কেলারম্যান অবাক হয়ে কিছুক্ষণ নয়নের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর মৃদুস্বরে, নয়নের দিক থেকে চোখ না সরিয়ে, বললেন, ‘ওকি আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নম্বর বলে দিতে পারে?’

তরফদার বাংলায় নয়নকে প্রশ্নটা করাতে সে বলল, ‘কোন ব্যাঙ্ক? ওর ত তিনটে ব্যাঙ্কে টাকা আছে।’

কেলারম্যানের মুখ থেকে লাল ভাবটা চলে গিয়ে একটা ফ্যাকাসে ভাব দেখা দিল। সে ঢোক গিলে আগের মতোই ধরা গলায় মার্কিনী নাকী উচ্চারণে বলল, ‘সিটি ব্যাঙ্ক অফ নিউইয়র্ক।’

নয়ন গড়গড় করে বলে দিল, ‘ওয়ান্ টু ওয়ান্ টু এইট ড্যাশ সেভ্‌ন ফোর।’

‘জীসাস ক্রাইস্ট!’

কেলারম্যানের চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।

‘আই অ্যাম অফারিং ইউ টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড ডলারস রাইট নাউ’। তরফদারের দিকে ফিরে বললেন কেলারম্যান। ‘তোমার ম্যাজিক শো থেকে ও কোনোদিন এত রোজগার করতে পারবে?’

‘এ তো সবে শুরু, মিঃ কেলারম্যান’, বললেন তরফদার। ‘এখনো ভারতবর্ষের কত শহর পড়ে আছে; তারপর সারা পৃথিবীর বড় বড় শহর। ম্যাজিক দেখতে ছেলে বুড়ো সকলেই ভালোবাসে। আর এই ছেলেটি যে ম্যাজিক দেখায় তার নমুনা ত দেখলেন আপনি। এর কোনো তুলনা আছে কি? বিশ হাজার কেন—তারও ঢের বেশি যে এ ছেলে আমার শো থেকে আনবে না, সেটা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে?’

‘ওর বাবা আছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন কেলারম্যান।

‘ধরে নিন এখন আমিই ওর বাবা।’

ইন আওয়ার ফিলজফি

এর মধ্যে লালমোহনবাবু হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘স্যার, ইন আওয়ার ফিলজফি, ত্যাগ ইজ মোর ইম্পর্ট্যান্ট দ্যান ভোগ।’

কথাটা বসাক কেলারম্যানকে অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ‘মিস্টার তরফদার, আপনি কিন্তু একটা সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন না। এমন সুযোগ আপনি আর পাবেন না। ভেবে দেখুন।’

বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক যদি নয়নকে কেলারম্যানের হাতে তুলে দিতে পারেন তাহলে তাঁর নিজেরও নির্ঘাৎ মোটারকম প্রাপ্তি আছে।

‘আমার ভাবা হয়ে গেছে’, সহজ ভাবে বললেন তরফদার।

অগত্যা কেলারম্যানও উঠে দাঁড়ালেন। বসাক এবার পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বার করে তরফদারকে দিয়ে বললেন, ‘এতে আমার নাম ঠিকানা ফোন নম্বর সবই আছে। যদি মাইন্ড চেঞ্জ করেন ত আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।’

দুই ভদ্রলোককে দরজা অবধি পৌঁছে দিলেন তরফদার।

‘বসাক ঘুঘু লোক।’ তরফদার ফেরার পরে বলল ফেলুদা, ‘নইলে মার্কিন ইমপ্রেসারিওর এজেন্ট সে হতে পারে না। পয়সার দিক দিয়েও সলিড, হয়ত কেলারম্যানের দৌলতেই। দামী ফরাসী আফটার-শেভ লোশন মেখে এসেছে—যদিও থুতনির নীচে এক চিলতে শেভিং সোপ এখনো লেগে আছে। বোঝাই যাচ্ছে ঘুম ভাঙে দেরিতে, তাই নটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে তাড়াহুড়ো করতে হয়েছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *