॥ ১০ ॥
স্নেক পার্কে বেশিক্ষণ ছিলাম না, কিন্তু এটা বুঝেছি যে জায়গাটা একেবারে নতুন ধরনের। মাত্র একজন লোকের মাথা থেকে যে এ জিনিস বেরিয়েছে সেটা বিশ্বাস করা যায় না। যতরকম সাপের নাম আমি শুনেছি তার সব, আর তার বাইরেও বেশ কিছু এই পার্কে রয়েছে। তাছাড়া, সাপ দেখা ছাড়াও, পার্কে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দও এখানে পাওয়া যায়।
প্রথম দিনের এই আউটিং-এ কোনো উল্লেখযোগ্য বা চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেনি। যদিও হজসনের ছদ্মবেশের কথা জানার জন্যেই বোধহয় দাড়িওয়ালা লোক দেখলেই জটায়ু বসাক বলে সন্দেহ করে নয়নকে একটু কাছে টেনে নিচ্ছিলেন।
সাপ দেখে এদিক ওদিক ঘুরতে হঠাৎ দেখলাম রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা বেশ বড় জলা জায়গায় গোটা পাঁচেক কুমীর রোদ পোয়াচ্ছে। দেখে মনে হল তারা সব কটাই ঘুমোচ্ছে। রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে এ-দৃশ্য দেখছি, লালমোহনবাবু নয়নকে ফিস্ফিস্ করে বলছেন—তুমি আরেকটু বড় হলে তোমাকে আমার ‘করাল কুম্ভীর’ বইটা দেব—এমন সময় দেখি দুহাতে দুটো বালতি নিয়ে গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পড়া একটা লোক কুমীরগুলো থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে গিয়ে দাঁড়াল। কুমীরগুলো এবার একটু নড়েচড়ে উঠল। লোকটা এবার বালতিতে হাত ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে এক-একটা কোলা ব্যাঙ বার করে কুমীরগুলোর দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগল। আশ্চর্য এই যে, প্রত্যেকটা ব্যাঙই কোনো-না-কোনো কুমীরের হাঁ করা মুখের ভিতর গিয়ে পড়ল। কুমীরকে ব্যাঙ চিবিয়ে খেতে আর কোনোদিন দেখিওনি আর দেখব বলে ভাবিওনি।
গোলমেলে ঘটনা যা ঘটে সেটা দ্বিতীয় দিনে, আর সেটার কথা ভাবলেই মনে বিস্ময়, আতঙ্ক, অবিশ্বাস—সব একসঙ্গে জেগে ওঠে।
***
গাইডবুক পড়ে জেনেছিলাম মহাবলীপুরম ম্যাড্রাস থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে। রাস্তা নাকি ভালো, যেতে দুঘণ্টার বেশি সময় লাগা উচিত নয়। কালকের মতোই দুটো ট্যাক্সির ব্যবস্থা করেছিলেন শঙ্করবাবু। এবার নয়ন তরফদারের সঙ্গে না গিয়ে আমাদের সঙ্গে আসতে চাইল। কারণ আর কিছুই নয়, জটায়ুর সঙ্গে ওর বেশ জমে গেছে। ভদ্রলোক নয়নকে তাঁর লেটেস্ট বই ‘অতলান্তিক আতঙ্ক’-র গল্প সহজ করে বলে শোনাচ্ছেন। একবারে ত শেষ হবার নয়, তাই খেপে খেপে শোনাচ্ছেন। গাড়িতে তাই ফেলুদা আর জটায়ুর মাঝখানে বসল নয়ন। আর আমি সামনে।
যেতে যেতে বেশ বুঝতে পারছি আমরা ক্রমে সমুদ্রের দিকে এগোচ্ছি। মাদ্রাজ শহর সমুদ্রের ধারে হলেও আমরা এখন অবধি সমুদ্র দেখিনি, তবে সন্ধেবেলা সমুদ্রের দিক থেকে আসা হাওয়া উপভোগ করেছি।
সোয়া দুঘণ্টার মাথায় সামনের দৃশ্যটা হঠাৎ যেন ফাঁক হয়ে গেল। ওই যে দূরে গাঢ় নীল জল, আর সামনে বালির উপর ছড়িয়ে উঁচিয়ে আছে সব কী যেন।
আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বুঝলাম যে সেগুলো মন্দির। মূর্তি আর বিশাল বিশাল পাথরের গায়ে খোদাই করা নানারকম দৃশ্য।
আমাদের গাড়ি যেখানে এসে থামল, তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে একটা ভ্যান। আর তার পরেই একটা প্রকাণ্ড লাক্সারি কোচ। কোচে একে একে উঠছে এক বিরাট টুরিস্ট দল। তাদের দেখেই কেন জানি বোঝা যায় তারা আমেরিকান। কত রকম পোশাক, কত রকম টুপি, চোখে কতরকম ধোঁয়াটে চশমা, কাঁধে কতরকম ঝোলা।
‘বিগ বিজনেস, টুরিজ্ম,’ বলে জটায়ু নয়নকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন।
ফেলুদা আগে এখানে না এলেও, কোথায় কী আছে সব জানে। ও আগেই বলে রেখেছিল—‘অনেক দূর ছড়িয়ে অনেক কিছু দেখার জিনিস আছে; তবে নয়নকে নিয়ে ত আর অত ঘোরা যাবে না; তুই অন্তত চারটে জিনিস অবশ্যই দেখিস—শোর টেম্পল, গঙ্গাবতরণ, মহিষ মণ্ডপ গুহা আর পঞ্চ পাণ্ডব গুহা। জটায়ু যদি দেখতে চান ত দেখবেন; না হলে নয়নকে সামলাবেন। তরফদার আর শঙ্কর কী করবে জানি না; কথাবার্তা শুনে ত মনে হয় না ওদের মধ্যে শিল্পপ্রীতি বলে কোনো বস্তু আছে।’
আমরা গাড়ি থেকে নেমে সামনে এগোনর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লালমোহনবাবু একটা জটায়ু-মার্কা প্রশ্ন করলেন।
‘এ ত বল্লভদের কীর্তি, তাই না মশাই?’
ফেলুদা তার গলায় একটা বাজখাঁই টান এনে বলল, ‘পল্লব, মিস্টার গাঙ্গুলী, পল্লব। নট বল্লভ।’
‘কোন সেঞ্চুরি?’
‘সেটা খোকাকে জিজ্ঞেস করুন, বলে দেবে।’
লালমোহনবাবু অবিশ্যি সেটা আর করলেন না; খালি মৃদুস্বরে একবার ‘সজারু’ বলে চুপ করে গেলেন। আমি জানি মহাবলীপুরম সপ্তম শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল।
প্রথমেই শোর টেম্পল বা সমুদ্রের ধারের মন্দিরটা দেখা হল। মন্দিরের পিছনের পাঁচিলের গায়ে ঢেউ এসে ঝাপ্টা মারছে।
‘এরা স্পট সিলেক্ট করতে জানত মশাই, ‘ঢেউয়ের শব্দের উপরে গলা তুলে মন্তব্য করলেন জটায়ু।
ডান পাশে দূরে একটা হাতি আর একটা ষাঁড়ের মূর্তির পাশে কয়েকটা ছোট ছোট মন্দিরের মতো জিনিস রয়েছে। ফেলুদা বলল সেগুলো পাণ্ডবদের রথ। —‘যেটা দেখতে কতকটা বাংলার গাঁয়ের কুঁড়ে ঘরের মতো, সেটা হল দ্রৌপদীর রথ।’
মাথা ঘুরে গেল গঙ্গাবতরণ দেখে। এটাকে অবিশ্যি অর্জুনের তপস্যাও বলা হয়। বাইরেই রয়েছে ব্যাপারটা, আর বোঝাই যায় যে একটা বিশাল পাথরের স্ল্যাব দেখে শিল্পীদের এই দৃশ্য খোদাই করার আইডিয়া মাথায় আসে। দুটো বিরাট হাতি, আর তার চতুর্দিকে অজস্র মানুষের ভিড়।
লালমোহনবাবু নয়নকে নিয়ে এখনো আমাদের পাশেই ছিলেন, দৃশ্যটার দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘এত ছেনি-হাতুড়ির কাজ, তাই না?’
‘হ্যাঁ’, গম্ভীরভাবে বলল ফেলুদা। ‘তবে ভেবে দেখুন—হাজার হাজার প্রাচীন ভাস্কর্যের নমুনা রয়েছে আমাদের সারা দেশ জুড়ে, দশ-বার শতাব্দী ধরে সেগুলো তৈরি হয়েছে, অথচ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখলেও তার সামান্যতম অংশেও একটিও হাতুড়ির বেয়াড়া আঘাত বা ছেনির বেয়াড়া অ্যাঙ্গেলের চিহ্ন পাবেন না। এ ত মাটি নয় যে আঙুলের চাপে এদিক ওদিক করে ত্রুটি সংশোধন হয়ে যাবে; পাথরের ত্রুটি শুধরানোর কোনো উপায় নেই। এ যুগে সেই পারফেকশনের সহস্রাংশও আর অবশিষ্ট নেই। কোথায় গেল কে জানে!’
তরফদার আর শঙ্করবাবু এগিয়ে গিয়েছিলেন; ফেলুদা বলল, ‘যা, তোরা গিয়ে পঞ্চপাণ্ডব আর মহিষমণ্ডপ গুহাগুলো দেখে আয়। আমি এটা আরেকটু খুঁটিয়ে দেখছি। তাই সময় লাগবে।’
ফেলুদার কাছ থেকে গাইড বুকটা চেয়ে প্ল্যান দেখে বুঝে নিলাম গুহা দুটো দেখতে কোনদিকে যেতে হবে। লালমোহনবাবুকে মুখে বলে বুঝিয়ে দিলাম। তবে তিনি এখন মহাবলীপুরম ছেড়ে অতলান্তিকে চলে গেছেন, তাই আমার কথা কানে গেল কি না জানি না। না গেলেও, আমি এগোনর আগেই তিনি গল্প শুরু করে নয়নকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
কিছুদূর গিয়ে ডাইনে ঘুরে দেখি একটা কাঁচা রাস্তা পাহাড়ের গা দিয়ে ওপরে উঠে গেছে। প্ল্যান বলেছে এটা দিয়েই যেতে হবে। ঢেউয়ের আওয়াজ এখানে কম; তার চেয়ে বেশি জোরে শুনছি লালমোহনবাবুর গলা। মনে হচ্ছে গল্প ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছচ্ছে।
একটু এগিয়ে গিয়েই দেখি পঞ্চপাণ্ডব গুহায় পৌঁছে গেছি—অন্তত বাইরের সাইনবোর্ডে তাই বলছে। আমি ঢোকার আগেই জটায়ু নয়নকে নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে আরো উপরে উঠে গেলেন। বুঝলাম আশ্চর্য সব শিল্পের নমুনা লালমোহনবাবুর কাছে মাঠে মারা যাচ্ছে।
ফেলুদার আদেশ, তাই পঞ্চপাণ্ডব গুহায় খানিকটা সময় দিলাম। একটা ঘাড় ফেরানো গরু আর তার পাশে দাঁড়ানো বাছুরের দৃশ্য দেখে মনে হল যে ঠিক এই দৃশ্য আজও বাংলার যে কোনো গ্রামে দেখা যায়। শুধু গরু বাছুর কেন, মহাবলীপুরমের হাতি হরিণ বাঁদর ষাঁড় ইত্যাদি দেখে বুঝতে পারি তেরশো বছরেও এদের চেহারার কোনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ পোশাক বদলের জন্য সেযুগের মানুষকে আজ আর চেনার কোনো উপায় নেই।
গুহা থেকে বেরিয়ে কয়েকটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম, যেগুলো কানে। আর চোখে ধরা পড়ল।
এক, সূর্য ঢেকে গেছে ছাই রঙের মেঘে। গুড়গুড়ুনি যে মেঘের ডাক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রোদের তেজটা চলে গিয়ে এখন সমুদ্রের হাওয়াটা আরো বেশি টের পাওয়া যাচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি তফাত ধরা পড়ে কানে। সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া চারিদিকে কোনো শব্দ নেই। আমি গুহাতে পাঁচ মিনিটের বেশি থাকিনি। সামনে মহিষমর্দিনী গুহা। তার ভিতর থেকে লালমোহনবাবুর গলা পাওয়া উচিত। কারণ গল্পের বেশ জমাটি অংশে তিনি গুহায় পৌঁছেছিলেন। অবিশ্যি তিনি গুহাতে না ঢুকেই এগিয়ে গিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু কেন? ওদিকে ত আর কিছু দেখার নেই! কোথায় গেলেন ভদ্রলোক নয়নকে নিয়ে?
কেমন জানি একটা সংশয়ের ভাব আমাকে চেপে ধরল। আমি দেখলাম মহিষমর্দিনী গুহার দিকে আমি দৌড়তে শুরু করেছি।
গুহার পাশে পৌঁছতেই আরেকটা শব্দ আমার আতঙ্ক সপ্তমে চড়িয়ে দিল।
‘হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ—’
টি. এন. টি.-র হাসি!
ঊর্ধ্বশ্বাসে সামনে ছুটে গিয়ে মোড় ঘুরে একটা সাংঘাতিক দৃশ্য দেখে আমার নিশ্বাস মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
দেখলাম একটা লাল-সাদা ডুরে-কাটা জামা আর কালো প্যান্ট পরা এক অতিকায় কৃষ্ণকায় প্রাণী—যাকে দানব বললে খুব ভুল হয় না—এক-বগলে জটায়ু আর অন্য বগলে নয়নকে নিয়ে দ্রুত পা ফেলে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে।
ভয়াবহ দৃশ্য, কিন্তু তখন আমার মাথায় খুন চেপে গেছে, আর তার ফলে শরীরে এনার্জি আর মনে সাহস এসে গেছে। আমি ‘ফেলুদা!’ বলে একটা চীৎকার দিয়ে প্রাণপণে ছুটে গেলাম দানবটার দিকে—আমার উদ্দেশ্য পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার একটা পা জাপ্টে ধরে তার হাঁটা বন্ধ করব।
কিন্তু যা ভেবেছিলাম সেটা করেও কোনো ফল হল না। পা জড়িয়ে ধরতেই প্রথমে দানবটা একটি বিকট চীৎকার দিল—বুঝলাম যেখানে বাদশা কামড়েছিল ঠিক সেখানেই আমি চাপ দিয়েছি। তার পরমুহূর্তে দেখলাম সেই জখম পায়ের ঝট্কানিতে আমি মাটি থেকে শূন্যে উঠে গেছি। তারপর চোখের পলকে দেখি আমি নয়নের সঙ্গে একই বগলের নীচে বন্দী হয়ে হাওয়া কেটে এগিয়ে চলেছি, আমার পা দুটো পেণ্ডুলামের মতো দুলছে। দৈত্যটার মাংসপেশীর চাপে আমার নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এলেও আমি শুনতে পাচ্ছি অন্য বগলের তলা থেকে লালমোহনবাবুর ‘মাগো! মাগো!’ আর্তনাদ।
আর হাসি?
সামনে বিশ হাত দূরে তারকনাথ হাসতে হাসতে লাফাচ্ছেন আর ডান হাত মাথার উপর তুলে লাঠি ঘোরাচ্ছেন।
‘কেমন? গাওয়াঙ্গি কাকে বলে দেখলে?’ তারস্বরে প্রশ্ন করলেন টি. এন. টি।
কিন্তু এখন ত আর তিনি একা নেই! তাঁর পিছন থেকে এগিয়ে এসে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে দুজন লোক। তার মধ্যে একজন অদ্ভুতভাবে সামনে ঝুঁকে পড়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বকের মতো এগিয়ে আসছেন আমাদের দিকে।
চমকদার সুনীল তরফদার।
এবার তরফদার তাঁর গতি না কমিয়ে হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে সাপের ফণার মতো দোলাতে লাগলেন—তাঁর বিস্ফারিত দৃষ্টি সটান আমাদের যিনি বগলদাবা করেছেন তাঁর দিকে।
এই চাউনি, এই ঝুঁকে পড়া, হাতের এই ঢেউ খেলানো—এ সবই আমার চেনা। এ হল তরফদারের সম্মোহনের কায়দা।
তারকনাথ হঠাৎ উন্মাদের মতো লাঠি উঁচিয়ে তরফদারের দিকে ধাওয়া করতেই পিছন থেকে এক লাফে এগিয়ে এসে শঙ্করবাবু বুড়োর হাত থেকে লাঠিটা ছিনিয়ে নিলেন।
এবার বুঝলাম আমাদের গতি কমে আসছে।
আকাশে আবার মেঘের গর্জন।
তারকনাথ এবার দুহাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে ঘড়ঘড়ে গলায় একটা অদ্ভুত অচেনা ভাষায় গাওয়াঙ্গিকে কী জানি বললেন।
গাওয়াঙ্গি আর তরফদার এখন মুখোমুখি।
আমি বগলদাবা অবস্থাতেই কোনোরকমে ঘাড় ঘুরিয়ে গাওয়াঙ্গির মুখের দিকে চাইলাম। এমন মুখ আমি আর দেখিনি। চোয়াল ঝুলে পড়ে দাঁত বেরিয়ে গেছে, আর চোখ দুটো ঠিক্রে বেরিয়ে আসছে।
বগলদাবা করা বিশাল হাত দুটো এবার ধীরে ধীরে নেমে এল। আমার পা এখন মাটিতে। ওদিকে লালমোহনবাবুও মাটিতে।
‘আপনারা গাড়িতে গিয়ে উঠুন!’ চোখের পাতা না ফেলে গাওয়াঙ্গির দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে চেঁচিয়ে বললেন তরফদার। ‘আমরা এক্ষুনি আসছি!’
উল্টোদিকে দৌড় দেবার আগের মুহূর্তে দেখলাম তারকনাথ মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন।
ফেলুদা এখনো গঙ্গাবতরণের সামনে দাঁড়িয়ে। আমাদের তিনজনকে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে আসতে দেখে যেন ও আপনা থেকেই ব্যাপারটা আঁচ করে নিল।
আমাদেরও আগে ও দৌড়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল। আমরা চারজন হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লাম।
‘টার্ন ব্যাক্! টার্ন ব্যাক্! চেঁচিয়ে আদেশ দিল ফেলুদা। এই ড্রাইভার হিন্দি জানে না; কেবল তামিল আর ভাঙা ভাঙা ইংরিজি।
গাড়ি উল্টোমুখো হতেই ফেলুদা আবার বলল, ‘নাউ ব্যাক টু ম্যাড্রাস—ফাস্ট!’
গাড়ি বিদ্যুদ্বেগে রওনা দেবার পর শুধু একজনই কথা বলল। সে হল নয়ন।
‘দৈত্যটার বেয়াল্লিশটা দাঁত।’