॥ ৫ ॥
মিনিট খানেক পরেই নারায়ণ এক অদ্ভুত প্রাণীকে এনে হাজির করল। পুরোন জুতোর বুরুশের মতো দাড়ি, শুঁয়োপোকার মতো গোঁফ। ঝুলঝাড়ার মতো চুল, পরনে ঢিলে হয়ে যাওয়া গেরুয়া সুট, আর বিশ্রী ভাবে প্যাঁচ দেওয়া সবুজ টাই। ছোটখাটো মানুষ। বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি হবে, যদিও সেই তুলনায় চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম উজ্জ্বল।
ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক দেখে মিহি অথচ কর্কশ গলায় বললেন, ‘তরফদার, তরফদার—হুইচ ওয়ান ইজ তরফদার?’
তরফদার উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললেন, ‘আমিই সুনীল তরফদার।’
‘অ্যান্ড দীজ থ্রী?’ আমাদের তিনজনের উপর দিয়ে একটা ঝাড়ু-দৃষ্টি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।
‘আমার তিন অন্তরঙ্গ বন্ধু’, বললেন তরফদার।
‘নেম্স? নেম্স?’
‘ইনি প্রদোষ মিত্র, ইনি লালমোহন গাঙ্গুলী, আর ইনি তপেশ মিত্র।’
‘অল রাইট। এবার কাজের কথা। কাজের কথা।’
‘বলুন।’
‘আমার নাম জানেন?’
‘আপনি ত টেলিফোনে শুধু আপনার পদবীটাই বলেছিলেন—ঠাকুর। সেটাই জানি।’
‘তারকনাথ। তারকনাথ ঠাকুর। টি এন টি—ট্রাইনাইট্রোটোলুঈন —হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!’
ভদ্রলোকের হাসির দমকে চমকে উঠলাম। ট্রাইনাইট্রোটোলুঈন বা টি এন টি যে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরকের উপাদান সেটা আমি জানতাম।
‘আপনার বাড়িতে কি একজন অসম্ভব বেঁটে বামুন থাকে?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।
‘কিচোমো। কোরিয়ান’, বললেন তারকনাথ। ‘এইট্টি টু সেন্টিমিটারস্। বিশ্বের খর্বতম প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি।’
‘এ খবরটা মাস কয়েক আগে কাগজে বেরিয়েছিল।’
‘এবার গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে স্থান পাবে।’
‘একে আপনি জোগাড় করলেন কী করে?’ প্রশ্ন করলেন জটায়ু।
‘আমি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াই। আমার অঢেল টাকা। এক পয়সা নিজে উপার্জন করিনি, সব বাপের টাকা। উইল করেননি, তবে আমিই একমাত্র সন্তান, তাই সব টাকাই আমি পাই। কিসের টাকা জান? গন্ধদ্রব্য। পারফিউম। কুন্তলায়নের নাম শুনেছ?’
‘সে তো এখনো পাওয়া যায়’, বললেন জটায়ু।
‘হ্যাঁ। বাবারই আবিষ্কার, ব্যবসাও বাবারই। এখন এক ভাইপো দেখে। আমার কোনো ইনটারেস্ট নেই। আমি সংগ্রাহক।’
‘কী সংগ্রহ করেন?’
‘নানান মহাদেশের এমন সব জিনিস যার জুড়ি নেই। একমেবা-দ্বিতীয়ম্। কিচোমোর কথা বললাম। এছাড়া আছে দুহাতে একসঙ্গে লিখতে পারে এমন একটি সেক্রেটারি। জাতে মাওরি। নাম টোকোবাহানি। আরো আছে। একটি ব্ল্যাক প্যারট তিন ভাষায় কথা বলে। একটি দুই-মাথা বিশিষ্ট পমেরেনিয়ান কুকুর, লছমনঝুলার একটি সাধু উড্ডীনানন্দ, মাটি থেকে দেড় হাত উপরে শূন্যে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে ধ্যান করে। তাছাড়া—’
‘ওয়ান মিনিট স্যার’, বলে লালমোহনবাবু বাধা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া হল। হাতের লাঠি মাথার উপর তুলে চোখ রক্তবর্ণ করে তারকনাথ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ইউ ডেয়ার ইনটারাপ্ট মী!’
‘সরি সরি সরি স্যার।’ জটায়ু কুঁকড়ে গেছেন— ‘আমি জানতে চাইছিলুম আপনার সংগ্রহের মধ্যে যারা মানুষ, তারা কি স্বেচ্ছায় আপনার ওখানে রয়েছে?’
‘তারা ভালো খায়, ভালো পরে, ভালো বেতন পায়, আরাম পায় আদর পায়—থাকবে না কেন? হোয়াই নট? আমার কথা আর আমার সংগ্রহের কথা পৃথিবীর অনেক দেশের অনেক লোকেই জানে; তোমরা না জানতে পার। আমেরিকা থেকে একজন সাংবাদিক এসে আমার সঙ্গে কথা বলে দেশে ফিরে গিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসে “দ্য হাউস অফ ট্যারক” বলে এক প্রবন্ধ লেখে।’
এবার তরফদার মুখ খুললেন।
‘অনেক কথাই ত জানা গেল, কেবল আপনার এখানে আসার কারণটা ছাড়া।’
‘এটা আবার বলে দিতে হবে? আমি ওই খোকাকে আমার সংগ্রহের জন্য চাই। কী নাম যেন? ইয়েস—জ্যোতিষ্ক। আই ওয়ন্ট জ্যোতিষ্ক।’
‘কেন? সে তো এখানে দিব্যি আছে,’ বললেন তরফদার। ‘খাওয়া পরার অভাব নেই, যত্নআত্তির অভাব নেই। সে আমার ডেরা ছেড়ে আপনার ওই উদ্ভট ভিড়ের মধ্যে যাবে কেন?’
তারকনাথ তরফদারের দিকে প্রায় আধ মিনিট চেয়ে থেকে বললেন, ‘গাওয়াঙ্গিকে একবার দেখলে তুমি এমন বেপরোয়া কথা বলতে পারতে না।’
‘হোয়াট ইজ গাওয়াঙ্গি?’ প্রশ্ন করলেন জটায়ু।
‘নট হোয়াট, বাট হু,’ গম্ভীরভাবে বললেন তারকনাথ। ‘নট বস্তু, বাট ব্যক্তি। ইউগ্যান্ডার লোক। পৌনে আট ফুট হাইট, চুয়ান্ন ইঞ্চি ছাতি, সাড়ে তিনশো কিলো ওজন। কোনো ওলিম্পিক ওয়েট লিফটার ওর কাছে পাত্তা পাবে না। একবার টেরাইরের জঙ্গলে একটা বাঘকে ঘুমপাড়ানি ইনজেকশনের গুলি মারে, কারণ বাঘটার গায়ে স্পট এবং ডোরা দুইই ছিল। একমেবাদ্বিতীয়ম। সেই বাঘকে কাঁধে করে সাড়ে তিন মাইল বয়ে এনেছিল গাওয়াঙ্গি। সে এখন আমার একনিষ্ঠ সেবক।’
‘আপনি কি আবার দাসপ্রথা চালু করলেন নাকি?’ জটায়ু বেশ সাহসের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন।
‘নো স্যার!’ গর্জিয়ে উঠলেন টি এন টি। ‘গাওয়াঙ্গিকে যখন দেখি তখন তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ইউগ্যান্ডার রাজধানী কাম্পালা শহরে এক শিক্ষিত পরিবারের ছেলে। বাপ ডাক্তার। তাঁর কাছেই শুনি গাওয়াঙ্গির যখন চোদ্দ বছর বয়স তখনই সে প্রায় সাত ফুট লম্বা। বাড়ির বাইরে বেরোয় না। কারণ রাস্তার লোকে ঢিল মারে। ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু ছাত্রদের বিদ্রূপের ঠেলায় বাধ্য হয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনতে হয়। আমি যখন তাকে দেখি তখন তার বয়স একুশ। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। চুপচাপ ঘরে বসে থাকে সারাদিন। দেখে মনে হল এইভাবে সে আর বেশিদিন বাঁচবে না। সেই অবস্থা থেকে তাকে আমি উদ্ধার করে আনি। আমার কাছে এসে সে নতুন জীবন পায়। সে আমার দাস হতে যাবে কেন? আমি তাকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করি। আমাদের সম্পর্ক পিতা-পুত্রের সম্পর্ক।’
‘যাই হোক তারকবাবু’, বললেন তরফদার, ‘আপনার অনুরোধ রাখতে পারলাম না। আমি জ্যোতিষ্ককে চিড়িয়াখানার অধিবাসী হিসেবে কল্পনা করতে পারি না এবং চাইও না।’
‘গাওয়াঙ্গির বিবরণ শোনার পরেও এটা বলছ?’
‘বলছি।’
ভদ্রলোক যেন একটু দমে গিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তাই যখন বলছ তখন এই ছেলেটিকে একবার দেখতে পারি কি?’
‘সেটা সহজ ব্যাপার। আপনি সেই কলকাতার উত্তর প্রান্ত থেকে এসেছেন, আপনার জন্য এতটুকু করতে পারব না?’
নয়ন এসে দাঁড়াতে তারকবাবু তার দিকে ভুরু কুঁচকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার বাড়িতে কটা ঘর আছে বলতে পার?’
‘ছেষট্টি।’
‘হুঁ…’
এবার তারকনাথ উঠে দাঁড়িয়ে তার লাঠির রুপো দিয়ে বাঁধানো মাথাটা ডান হাতের মুঠো দিয়ে শক্ত করে ধরে বললেন, ‘রিমেমবার, তরফদার—টি এন টি অত সহজে হার মানে না। আমি আসি।’
ভদ্রলোক চলে যাবার পর আমরা কিছুক্ষণ কোনো কথাই বললাম না। নয়নকে তার ঘরে পাঠিয়ে দিলেন তরফদার। অবশেষে লালমোহনবাবু ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, ‘চার দিয়ে ত অনেক কিছু হয়—না মশাই? চতুর্দিক, চতুর্ভুজ, চতুর্মুখ, চতুর্বেদ—এই চারটিকে কী বলব তাই ভাবছি।
‘চতুর্লোভী বলতে পারেন।’ বলল ফেলুদা। ‘চার জনই যে লোভী তাতে ত কোনো সন্দেহ নেই। তবে লোভী হয়েও যে কোনো লাভ হল না সে ব্যাপারে সুনীলকে তারিফ করতে হয়।’
‘তারিফ কেন স্যার?’ বললেন তরফদার। ‘এ ত সোজা অঙ্ক। সে ছেলে আমার বাড়িতে মানুষ হচ্ছে সুস্থ পরিবেশে। আমি তাকে দেখছি। সে আমাকে দেখছে। স্রেফ লেনদেনের ব্যাপার। এ অবস্থার পরিবর্তন হবে কেন?’
আমরা তিনজন উঠে পড়লাম।
‘একটা কথা বলি তোমাকে’, তরফদারের কাঁধে হাত রেখে বলল ফেলুদা, ‘আর অ্যাপয়েন্টমেন্ট না।’
‘পাগল!’ বললেন তরফদার। ‘এক দিনেই যা অভিজ্ঞতা হল, এর পরে আবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট!’
‘তবে এটা বলে রাখি—নয়নকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে যদি আমার প্রয়োজন হয়, তাহলে আমি তৈরি আছি। ছেলেটির উপর আমার মায়া পড়ে গেছে।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ! প্রয়োজন হলেই খবর পাবেন।’