॥ ১৪ ॥
আমার মনে যে ইচ্ছেটা ছিল, সেটা দেখলাম লালমোহনবাবুর ইচ্ছের সঙ্গে মিলে গেছে। সেটা হল নীচে কফি শপে গিয়ে চা খাওয়া।
আমরা কফি শপে গিয়ে একটা টেবিল দখল করে বসে চায়ের অর্ডার দিলাম। ‘সঙ্গে স্যান্ডউইচ হলে মন্দ হত না,’ বললেন জটায়ু। ‘শুধু চা বড় চট করে ফুরিয়ে যাবে। আধ ঘণ্টা কাটাতে হবে ত!’ বেয়ারা দাঁড়িয়েছিল; চায়ের সঙ্গে দু প্লেট চিকেন স্যান্ডউইচ যোগ করে দিলাম।
আসার আগে আঁচ পেয়েছি যে ফেলুদা আলোর সন্ধান পেয়েছে। সেটা কম কি বেশি জানি না, কিন্তু বুঝতে পারছি যে শিরদাঁড়া দিয়ে ঘন ঘন শিহরন বয়ে যাচ্ছে।
হাতে সময় আছে তাই লালমোহনবাবু তাঁর সবে মাথায় আসা উপন্যাসের আইডিয়াটা শোনালেন। যথারীতি গল্পের নাম আগেই ঠিক হয়ে গেছে। মাঞ্চুরিয়ায় রোমাঞ্চ। বললেন, ‘চায়না সম্বন্ধে একটু পড়ে নিতে হবে। অবিশ্যি আমার এ গল্পে আজকের চীনের চেহারা পাওয়া যাবে না; এ হবে ম্যান্ডারিনদের আমলের চায়না।’
খাওয়া শেষ, লালমোহনবাবুর গল্প শেষ, তাও দেখি দশ মিনিট সময় রয়েছে।
কফি শপ থেকে লবিতে বেরিয়ে এসে জটায়ু বললেন, কী করা যায় বল ত!’
আমি বললাম, ‘আমার ইচ্ছে করছে একবার বুক শপটাতে ঢুঁ মারি। ওটা ত এখন আমাদের কাছে একটা হিস্টোরিক জায়গা— নয়ন ত ওখান থেকেই অদৃশ্য হয়েছে।’
‘গুড আইডিয়া। আর বলা যায় না— হয়ত গিয়ে দেখব আমার বই ডিসপ্লে করা হয়েছে।’
‘ইডলি দোসার দেশে আপনার বই থাকবে না, লালমোহনবাবু।’
‘দেখি না খোঁজ করে!’
দোকানের ভদ্রমহিলার বয়স বেশি না, আর দেখতেও সুশ্রী। জটায়ু ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ভদ্রমহিলার দিকে এগিয়ে গেলেন।
‘ইয়েস স্যার?’
‘ডু ইউ হ্যাভ ক্রাইম নভেলস্ ফর— ইয়ে, কী বলে— কিশোরস্?’
‘কিশোরস্?’ ভদ্রমহিলার ভুরু কুঁচকে গেছে।
‘ফর ইয়াং পীপ্ল’, বললাম আমি।
‘ইন হোয়াট ল্যাংগুয়েজ?’
‘বাংলি— আই মীন, বেঙ্গলী।’
‘নো, স্যার। নো বেঙ্গলী বুক্স। সরি। বাট উই হ্যাভ লট্স অফ চিলড্রেনস্ বুক্স ইন ইংলিশ।’
‘জানি। আই নো।’
তারপর একটু হেসে ফার্স্ট গিয়ার দিয়ে আরম্ভ করলেন, ‘টুডে— মানে, দিস আফটারনুন, এ ফ্রেন্ড… ইয়ে…নু’
বুঝলাম সেকেন্ড গিয়ারে গাড়ি আটকে গেছে। আমাকেই বলে দিতে হল যে আজই বিকেলে আমাদের এক বন্ধু এই দোকান থেকে দুটো ইংরিজি চিলড্রেনস বুক্স কিনে নিয়ে গেছে।
‘দিস আফটারনুন?’
‘ইয়েস।’ বললেন জটায়ু। ‘নো?’
‘নো, স্যার।’
‘নো?’
ভদ্রমহিলা বললেন গত চারদিনের মধ্যে কোনো ছোটদের বই তিনি বিক্রি করেননি। আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। আমার বুকে ধুকপুকুনি। ধরা গলায় বললাম, ‘দশ মিনিট হয়ে গেছে, লালমোহনবাবু।’
ভদ্রমহিলাকে একটা থ্যাঙ্ক ইউ জানিয়ে আমরা প্রায় দৌড়ে গিয়ে লিফটে উঠলাম। বোতাম টিপে খসখসে গলায় জটায়ু বললেন, ‘এ যে বিচিত্র সংবাদ!’
আমি কোনো উত্তর দিলাম না, কারণ আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না।
চাবি ঘুরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকে দুজনেই একসঙ্গে কথা বলে ফেললাম।
‘ও মশাই—!’
‘ফেলুদা!’
‘ওয়ান অ্যাট এ টাইম’— ফেলুদার গলায় ধমকের সুর।
আমি বললাম, ‘আমি বলছি।— শঙ্করবাবু বইয়ের দোকানে যাননি।’
‘টাট্কা কিছু থাকে ত বল। এটা বাসী খবর।’
‘আপনি জানেন!’
‘আমি সময়ের অপব্যবহার করি না, লালমোহনবাবু। বইয়ের দোকানে প্রায় বিশ মিনিট আগেই হয়ে এসেছি। মিস্ স্বামীনাথনের সঙ্গে কথা বলেছি। খবরটা আপনাদের দিতে গিয়ে দেখলাম আপনারা গোগ্রাসে স্যান্ডউইচ গিলছেন; তাই চলে এলাম।’
‘কিন্তু তাহলে—?’ আমার অসমাপ্ত প্রশ্ন।
‘তরফদার আসছে। এক্ষুনি ফোন করেছিল। বেশ উত্তেজিত বলে মনে হল। দেখি কী বলে।’
দরজায় ঘণ্টা।
তরফদার, মুখ চুন।
‘আমায় বাঁচান, ফেলুবাবু!’ হাহাকার করে উঠলেন ভদ্রলোক।
‘কী হল?’
‘শঙ্কর। ওর ঘরে গেস্লাম। বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। আমার বিপদের কি আর শেষ নেই?’
ফেলুদার কাছ থেকে এই প্রশ্নের এক অদ্ভুত উত্তর এল।
‘না, সুনীল তরফদার; এই সবে শুরু।’
‘মানে? চেরা গলায় বলে উঠলেন তরফদার।
‘মানে অত্যন্ত সহজ, সুনীল। তুমি এখনো নিরপরাধের পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছ; এ পোশাক তোমাকে মানায় না, সুনীল। তুমি যে ঘোর অপরাধী!’
‘মিস্টার মিত্তির, আমাকে এই ধরনের কথা বলার কোনো অধিকার নেই আপনার।’
‘কী বলছ সুনীল? গোয়েন্দা অপরাধীকে ধরে ফেললে তার উপর দোষারোপ করবে না? তুমি এই যে এলে আমার ঘরে, এখান থেকে সোজা চলে যাবে পুলিশের হাতে। তারা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে।’
‘আমার অপরাধটা কী সেটা জানতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই। এক, তুমি হত্যাকারী; দুই, তুমি চোর। সেকথাই আমি পুলিশকে বোঝাব।’
‘আপনি পাগল হয়ে গেছেন। আপনি প্রলাপ বকছেন।’
‘মোটেই না। হিঙ্গোরানি চেনা লোক ছাড়া আর কারুর জন্য দরজা খুলবেন না এটা তিনি নিজেই বলেছিলেন। যাকে আমরা এতক্ষণ খুনী বলে ভাবছিলাম— অর্থাৎ কচ্ছদেশীয় সেই গোয়েন্দা— তাকে হিঙ্গোরানি চিনতেন না। সেই কারণেই গোয়েন্দা হিঙ্গোরানির ছবি সঙ্গে এনেছিলেন, যাতে তিনি শিওর হতে পারেন যে ঠিক লোকের সঙ্গেই তিনি দেখা করছেন। অতএব তার জন্য দরজা খুলে দেওয়া হিঙ্গোরানির পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তোমায় তিনি চিনতেন ভালো করেই, তাই তুমি নিজের পরিচয় দিলে তাঁর পক্ষে দরজা খুলে দেওয়া স্বাভাবিক।’
‘আপনি একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন, ফেলুবাবু। পুলিশ পরিষ্কার বলেইছে হিঙ্গোরানি তার আততায়ীকে বাধা দেবার কোনো চেষ্টা করেননি। দেয়ার ওয়জ নো সাইন অফ স্ট্রাগ্ল। আমি যদি ছুরি বার করে তাঁর দিকে এগিয়ে যেতাম, তিনি কি বাধা দেবার চেষ্টা করতেন না?’
‘একটা বিশেষ ক্ষেত্রে কখনই করতেন না।’
‘কী সেই বিশেষ ক্ষেত্র?’
‘সেটা তোমারই ক্ষেত্র, তরফদার। সম্মোহন। হিঙ্গোরানিকে হিপ্নোটাইজ করে খুন করলে তিনি বাধা দেবেন কী করে?’
‘আপনার পাগলামি এখনো যায়নি, ফেলুবাবু। হিঙ্গারানি আমার অন্নদাতা। তাঁর ব্যাকিং-এর উপর আমার সমস্ত ভবিষ্যৎ নির্ভর করছিল। আমি কি এমনই মূর্খ যে এঁকেই আমি খুন করব? যার শিল, যার নোড়া, তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া? আপনি হাসালেন মিঃ মিত্তির— আপনি হাসালেন।’
‘এই বেলা হেসে নাও, চমকদার তরফদার; এর পরে আর সে অবস্থা থাকবে না।’
‘আপনি কি ইঙ্গিত করছেন যে আমার প্রধান অবলম্বন নয়ন চলে গিয়ে আমি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে খুন করেছি?’
‘না, কারণ তোমার জবানীতেই জানা যায় যে নয়ন সন্ধ্যাবেলা নিখোঁজ হয়, আর হিঙ্গোরানির মৃত্যুর সময় দুপুর আড়াইটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে।’
‘আপনি এখনো উল্টোপাল্টা বলছেন, মিঃ মিত্তির। মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করুন।’
‘আমার মাথায় জল ঢালো, তরফদার— দেখবে তা বরফ হয়ে গেছে।… এবারে একটা খবর তোমাকে দিই। আমি কিছুক্ষণ আগে নীচে বইয়ের দোকানটায় গিয়েছিলাম। যিনি দোকানে বসেন সেই মহিলার সঙ্গে আমার কথা হয়। তিনি বলেন গত চারদিনের মধ্যে তাঁর বইয়ের দোকান থেকে কোনো ছোটদের বই বিক্রি হয়নি, এবং কোনো খদ্দেরের সঙ্গে কোনো ছোট ছেলে আসেনি।’
‘শি-শি মাস্ট বি লাইং!’
‘নো, সুনীল তরফদার— নট শি। মিথ্যাবাদী হচ্ছ তুমি এবং তোমার ম্যানেজার শঙ্কর হুবলিকার। শঙ্করের মাথায় পোর্সিলেনের ছাইদান দিয়ে বাড়ি মেরেছি বলে হয়ত তার মধ্যে কিছুটা চেতনার সঞ্চার হবে— কিন্তু তোমার ঢ্যাঁটামো দেখছি কিছুতেই যাচ্ছে না।’
‘শঙ্করকে আপনিই বেহুঁশ করেছেন?’
‘ইয়েস, সুনীল তরফদার।’
‘কেন?’
‘কারণ সে খুনের কারণ গোপন রাখতে সাহায্য করছিল।’
দরজার বেল বেজে উঠল।
‘তোপশে, মিঃ রামচন্দ্রনকে ভেতরে নিয়ে আয়।’
দরজা খুলতে রামচন্দ্রন ঢুকে এসে ফেলুদার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলেন।
ফেলুদা কিছু বলার আগেই তরফদার রামচন্দ্রনের দিকে ফিরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এই ব্যক্তি বলছেন আমি খুন করেছি, কিন্তু কোনো কারণ বা মোটিভ দেখাতে পারছেন না।’
ফেলুদা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘শুধু খুন নয়, তরফদার। ভুলো না— ডাকাতিও বটে। হিঙ্গোরানির প্রতিটি কপর্দক এখন তোমার হাতে। পাঁচ লাখের উপর— যেটা দিয়ে তুমি নিজের পৃষ্ঠপোষকতা নিজেই করার মতলব করেছিলে।’
ফেলুদা এবার আমার দিকে ফিরল।
‘তোপ্শে— বাথরুমের ভিতরে যে রয়েছে তাকে বার করে আনত।’
আমি বাথরুমের দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখি নয়ন দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে বেরিয়ে ফেলুদার দিকে এগিয়ে গেল।
‘শঙ্কর একে তার বাথরুমের মধ্যে বন্ধ করে রেখেছিল। আসল ঘটনাটা আমার চোখের সামনে ফুটে উঠতে আমি শঙ্করের ঘরে যাই, এবং তাকে অজ্ঞান করে নয়নকে নিয়ে আসি। নয়নের মুখ থেকেই শোন তোমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্ত্রাস এবং তোমার খুন ও চুরির রাস্তা নেবার কারণ।’
তরফদারের দিকে চেয়ে দেখলাম তাঁর সর্বাঙ্গে কাঁপুনি ধরেছে।
‘নয়ন’, বলল ফেলুদা, ‘তরফদার মশাইকে ক’বছর জেল খাটতে হবে বল ত।’
‘তা ত জানি না।’
‘জান না?’
‘না।’
‘কেন, নয়ন? কেন জান না?’
‘আমি ত চোখের সামনে আর নম্বর দেখছি না।’
‘দেখছ না?’
‘না। তোমাকে ত বললাম— সব নম্বর পালিয়ে গেছে।’
***