সাপ ভয়ঙ্কর – মিজানুর রহমান কল্লোল

সাপ ভয়ঙ্কর

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা ‘মহানগর গোধূলি’ ট্রেন রাত আটটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে পৌছলে হুড়মুড় করে ‘ছ’ বগিতে উঠে পড়লাম আমি। আমাকে টিকেট কেটে দেয় যে ছেলেটি, রুবাইয়েত, একটি ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ, সে উঠবে ভৈরব থেকে। সব টিকেট তার কাছে। আমাকে মোবাইলে মেসেজ পাঠানোর পরেও ফোন করে জানিয়েছে, ‘স্যর, আপনি উঠবেন ছাগলের ছ-তে।’

আমি বললাম, ‘বুঝেছি, ছ।’

সে আবার চিৎকার করে বলল, ‘স্যর, ছ। ছাগলের ছ। চোরের চ না কিন্তু।’

আমি বললাম, ‘আচ্ছা।’

সে চিৎকার করে বলল, ‘চিন্তা করবেন না, স্যর। আমি ভৈরব থেকে উঠব। ৩১ আর ৩২ নম্বর সিট আমাদের। সেকেন্দার স্যরকে ফোনে পাচ্ছি না। আপনি একটু কাইগুলি তাকে ফোন করে বলবেন, তার বগি জ। স্যর, জানোয়ারের জ।’

আমি বললাম, ‘আচ্ছা, বলব।’

রুবাইয়েত আবার চিৎকার করল, ‘স্যর, বেলাল স্যরের টিকেট ম্যানেজ করতে পারিনি। ওনাকে বলবেন, উনি যেন কিছু মনে না করেন। একটা স্ট্যাণ্ড টিকেট কেটে উঠে পড়তে বলেন। পরে সিট দেখা যাবে। আসলে, স্যর, ওনার টিকেট আমি ইচ্ছা করেই কাটি নাই। উনি আমার ওষুধ লেখেন না।’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। ট্রেন চলে এসেছে, আর কথা বলা যাচ্ছে না।’

‘ওকে, স্যর। ছাগলের ছ।’

ট্রেনের সিটে বসতেই আমার ঝিমুনি এল।

ট্রেন বা গাড়িতে চলার সময় কখনওই আমি চোখ খুলে রাখতে পারি না।

ঝিমুনির মধ্যেই বুঝতে পারলাম ট্রেন ভৈরব স্টেশনে থেমেছে, রুবাইয়েত এসে বসেছে আমার পাশে। ঝমঝম করে ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে। আমি রুবাইয়েতের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

হঠাৎ ঝাঁকি দিয়ে ট্রেন থেমে গেল।

আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম।

‘কী হয়েছে?’ আচমকা ঘুম ভেঙে গিয়ে বুঝতে পারলাম না এভাবে ট্রেন থামল কেন।

মানুষের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। রুবাইয়েত বলল, ‘স্যর, আপনি থাকেন। আমি দেখে আসি ব্যাপারটা কী।’

ট্রেন থেকে নেমে গেল সে। প্রায় দশ মিনিট পর ফিরে এল। ‘খুব বেশি মারাত্মক অবস্থা না, স্যর। তবে মালবাহী ট্রেনটা হাইগা দিছে। লাইন থেকে আউট। আমাদের শুধু সামনের বগিটা পড়ছে। মরে নাই কেউ।’

‘কীভাবে?’

‘কোন্ বানচত যেন ফিশপ্লেট খুলে ফেলেছে। কাল অবরোধ আছে, তাই। ভাগ্য ভাল যে ড্রাইভারের চোখে পড়ছিল। তাই বাঁইচ্যা গেছি। শুধু খবিশের খ বগিটা—’

‘পড়ে গেছে?’

‘পুরা পড়ে নাই। কাত হয়ে আছে। গরুর গ. বগিও।’

‘আচ্ছা, চুপ করো। এখন, ঠিক হবে কখন?’

‘মেলা দেরি হবে। ঢাকা থেকে উদ্ধার কর্মীরা আসবে, তারপর।’

‘সে তো ভোর হয়ে যাবে। কিছুদিন আগে সিলেটের পারাবত ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়েছিল, দশ ঘণ্টা লেগেছিল লাইন ক্লিয়ার হতে।’

‘জানি, স্যর, কুত্তার ক বগি এক্কেরে উল্টে গেছিল।’

আমি চোখ বুজলাম।

কিছুক্ষণ পর রুবাইয়েত বলল, ‘এক কাজ করলে কেমন হয়, স্যর? আমরা বরং নেমে যাই। ট্রেন লাইন বাদ দিয়া রাস্তায় ঢুকি। রাত বেশি হয় নাই। বাসে করে ঢাকায় ফিরব।’

‘মন্দ নয়,’ আমি বললাম। ‘সকালে আবার শালার সেমিনার আছে। এখন কোথায় আমরা, বলো তো?’

ট্রেনের জানালা দিয়ে মাথা বের করল রুবাইয়েত। বাইরে কাকে যেন জিজ্ঞেস করল। তারপর মাথা টেনে এনে বলল, ‘মেথিকান্দা। মনে হয় নরসিংদীর মধ্যে।’

‘হুম, নরসিংদীর রায়পুরা থানার থানার একটা গ্রাম মেথিকান্দা।’

‘স্যর, চিনেন নাকি?’ রুবাইয়েত তাকাল আমার দিকে।

‘ঠিক চিনি না। তবে ডা. দীপুর কাছে নাম শুনেছি। ওর বাড়ি নরসিংদী।’

‘এই জন্য বলতে পারছে। নইলে কার ঠেকা অন্য জায়গার নাম মনে রাখার?’

আরও একটু অপেক্ষা করে ট্রেন থেকে নামলাম আমরা। আমার ব্যাগটা রুবাইয়েত হাতে নিয়েছে। ওরটা বাম কাঁধে। আমি বললাম, আমার ব্যাগটা আমিই নিতে পারব। কিন্তু সে কথা শুনল না। দু’জনে সামনে এগোলাম। অনেকদিন পর ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনলাম।

হাঁটছি আমরা। ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে আলো।

আমি বললাম, ‘কই, আমি তো কোন রাস্তা দেখি না। এখনও বিলের মধ্যেই আছি।’

রুবাইয়েত বলল, ‘বিল কই দেখলেন, স্যর? ওই যে বাম পাশে গ্রাম। গ্রামে ঢুকব, নাকি সামনে এগিয়ে যাব বুঝতে পারছি না। মেথিকান্দা কি শেষ হয়েছে?’

‘আমি কীভাবে বলব?’ অনেকটা পথ হেঁটে হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। আকাশে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল চাঁদ। বিরান এক এলাকা। মানুষের কোন চিহ্ন নেই। ‘এভাবে না চিনে না বুঝে ট্রেন থেকে নেমে আসাটা আমাদের ঠিক হয়নি,’ আমি কিছুটা হতাশার সুরে বললাম। ‘কোন জীবজন্তু সামনে এসে পড়লে পালাতেও পারব না।’

‘স্যর, খারাপ চিন্তা করবেন না। এখানে একটা বড় রাস্তা থাকার কথা। বাস চলাচলের।’ রুবাইয়েত বলল।

আমি বললাম, ‘বাস কেন, অন্য কোন বাহনেরও চিহ্ন কোথাও দেখছি না। আদৌ কোন রাস্তা আছে কিনা কে জানে। আমরা কি ভুল পথে এলাম?’

‘স্যর, সামনে মনে হয় বাজার। কয়েকটা ঘর দেখা যাচ্ছে। বাজারের মতই তো মনে হচ্ছে।’

চাঁদের আলোয় দেখলাম, আসলেই তাই। চার-পাঁচটা ছোট-ছোট ঘর। সামনে ফাঁকা জায়গা।

‘স্যর, বাজার যেহেতু একটা আছে, রাস্তাও তাহলে আছে।’ বলল রুবাইয়েত।

‘অনেকদিন এতটা পথ হাঁটিনি,’ আমি বললাম। ‘একেবারে ঘেমে গেছি।’

‘আরেকটু পথ, স্যর।’

বাতাসের ছিটে ফোঁটা নেই।

চাঁদের ঘোলাটে আলোয় কেমন এক ভৌতিক পরিবেশ।

গুনে দেখলাম ছয়টা ঘর একই লাইনে।

ভেতরে আলো নেই।

মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে, অথবা দোকান বন্ধ করে সবাই বাড়ি চলে গেছে।

নেহায়েত সাধারণ ঘর। টিনের চাল। কাঠের দেয়াল।

সামনে ছোট্ট বারান্দা।

সবগুলোর কাঠামো একই।

তবু কেন জানি না আমার শরীর কেঁপে উঠল।

মনে হলো ওগুলোর ভেতর ভয়ঙ্কর কিছু একটা আছে!

রুবাইয়েত বলল, ‘চলেন, স্যর, ওই বারান্দায় বসে একটু বিশ্রাম নিই।’

আমি বললাম, ‘না। ওখানে আমি বসব না। চলো সামনে যাই।’

‘স্যর, আমরা কি পথ হারাইছি?’

‘বুঝতে পারছি না।’

‘অদ্ভুত!’

‘কী?’

‘স্যর কি জায়গাটার নাম খেয়াল করেছেন? ওই দেখেন ভাঙা সাইনবোর্ড।’

আমি একটা খুঁটিতে টানানো সাইনবোর্ডটা পড়লাম: সাপমারা বাজার।

‘হুম, নামটা অদ্ভুত।’ আমি বললাম।

‘স্যর, এখন কী করব? বাঁয়ের রাস্তাটায় যাব? নাকি এখানে বসে থাকব? নাকি রেললাইন ধরে সামনে হাঁটতে থাকব?’

হঠাৎ আমার মনে পড়ল আমার পকেটেই তো মোবাইল ফোন রয়েছে, আমি কাউকে ফোন করছি না কেন?

আমি দ্রুত প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন করতে যাব, দেখি নেটওয়র্ক নেই।

রুবাইয়েতকে বলতে সে-ও তার মোবাইল বের করল।

‘স্যর, আমারটায়ও নেটওয়র্ক নেই। মনে হয় এদিকে মোবাইলের টাওয়ার নেই।’

‘একেবারে অজপাড়া গাঁ।’

‘জি, স্যর।’

‘নাম সাপমারা বাজার।’

‘জি, স্যর, খুবই অদ্ভুত নাম।’

ঘরগুলো পেছনে রেখে সামনে এগোলাম।

আমার পাশে-পাশে হাঁটছে রুবাইয়েত।

আমরা একটা বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।

চারপাশে সুনসান নিস্তব্ধতা। কেবল আমাদের হেঁটে যাবার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

নীল আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। কোন মানুষজনের চিহ্ন চোখে পড়ছে না। অজপাড়া গাঁ, হয়তো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শেয়াল কিংবা কুকুরের ডাকও নেই। এ ধরনের গ্রামে অন্য কোন প্রাণী না হোক, শেয়াল বা কুকুরের ডাক শোনা যাবেই। অবশ্য এমনও হতে পারে, যে গ্রামের মানুষ সন্ধ্যার পরেই ঘুমিয়ে পড়ে সে গ্রামে শেয়াল বা কুকুরও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়। এমনকী ঝিঁঝি পোকারাও।

‘আমরা আসলে কোথায় যাচ্ছি?’ নীরবতা ভঙ্গ করে আমি বললাম।

‘রাতটা কাটাতে হবে কোথাও,’ বলল রুবাইয়েত। ‘আসলে, স্যর, এখন বুঝতে পারছি ট্রেন থেকে নামাটাই আমাদের ভুল হইছে। দেখি সামনে কোন বাড়ি-ঘর পাই কিনা।’

‘অথবা চায়ের দোকান,’ আমি বললাম। ‘টায়ার্ড লাগছে।’

‘জি, স্যর, টায়ার্ড লাগছে। বাতাস কেমন যেন।’ রুবাইয়েত বলল।

হাঁটতে-হাঁটতে কাঁধের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করল রুবাইয়েত। ‘স্যর, পানি খান, ভাল লাগবে।’

আমি বললাম, ‘তুমি খেয়ে তারপর দাও।’

রুবাইয়েত বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেল। তারপর আমার দিকে বাড়িয়ে দিল সেটা। আমি ধরার আগেই মনে হলো সেটা ছোঁ মেরে কেউ নিয়ে চলে গেল। ঠিক এক সেকেণ্ডেরও কম সময়। একটা ছায়া যেন সরে গেল। কেমন গন্ধ লাগল নাকে।

আমরা হতভম্বের ভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই প্রায় দশ ফুট দূরে বোতলটি আছড়ে পড়ল। পেছনে শোঁ-শোঁ একটা শব্দ শুনলাম। তারপর সড়াৎ করে কিছু চলে যাবার শব্দ। ঝট করে পেছনে তাকালাম। কিছু নেই। মনে হলো দূরে ছায়ার মত কিছু একটা হঠাৎ অদৃশ্য হলো। দৌড়ে বোতলের কাছে গেলাম। নিচু হয়ে ওঠাতে যাব, রুবাইয়েত আচমকা চিৎকার করে বলল, ‘স্যর, ধরবেন না ওটা।’

আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কেন?’

‘দেখুন, স্যর,’ বলল সে। ‘ভাল বোতল, অর্ধেকটা পানিতে ভরা ছিল। এখন দোমড়ানো, মোচড়ানো। মনে হচ্ছে গরম পানিতে সেদ্ধ করা হয়েছে। দেখুন গলে গেছে কিছুটা। আমার ভয় লাগছে। কী হয়েছিল, স্যর, একটু আগে? বোতলটা থাবা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কে? চলুন, স্যর, আমরা পালাই।’

আমিও যে অবাক হইনি তা নয়। ভয় আমারও কিছুটা লাগছে। যদিও মাথার ওপরে চাঁদ জ্যোৎস্না বিলাচ্ছে অকাতরে। তবু কেমন ভৌতিক পরিবেশ। মনে হচ্ছে জনমানবশূন্য পরিত্যক্ত এক গ্রাম এটা।

‘ট্রেন থেকে আমাদের নামাটাই ঠিক হয়নি,’ বিড়বিড় করে বলল রুবাইয়েত। ‘খুব ভুল হয়ে গেছে।’

আমি বললাম, ‘চলো, ফিরে যাই।’

পেছনে পথের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, ‘ওই পথেই তো এসেছি। ওদিক দিয়ে গেলে নিশ্চয়ই রেললাইনটা খুঁজে পাব। রেললাইন পেলে আর চিন্তা নেই। ‘

‘ওদিক দিয়ে?’ অনিশ্চয়তার সুরে বলল রুবাইয়েত। ‘কতবার বাঁক নিয়েছি, পথ আর খুঁজে পাব কিনা কে জানে? রাত, স্যর, দুটো বাজতে চলল। সকাল পর্যন্ত যে এখানে অপেক্ষা করব, সে উপায়ও নেই।’

‘তবু তো এখান থেকে যেতে হবে।’

‘জি, স্যর। যেতে হবে।’

‘চলো, ফিরতি পথই ধরি।

‘জি, স্যর। সেটাই ভাল হবে।’

ঘুরে আবার হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। কিন্তু মনে হলো এটা ভিন্ন কোন পথ। কারণ গাছপালা বেশ ঘন হয়ে আসছে ধীরে-ধীরে। চাঁদের আলো ক্রমে ম্লান হচ্ছে। হঠাৎ‍ কোন শিশুর গুঙিয়ে ওঠার শব্দ শুনলাম। থেমে পড়লাম আমরা। আবার নিস্তব্ধতা। তাকালাম সামনে। একসাথে অনেকগুলো ছায়া যেন সরে গেল।

‘আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি,’ একটু কাঁপা গলায় বললাম আমি।

‘জায়গাটা ঠিক স্বাভাবিক না,’ প্রত্যুত্তরে বলল রুবাইয়েত।

‘চুপ, কে যেন আসছে!’

আমি আর রুবাইয়েত একে অপরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলাম।

রাস্তাটা ঠিক সোজা নয়, তাই দেখা যাচ্ছে না কে আসছে। শুধু হালকা পায়ের ছুটে আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। এবং দেখলাম তাকে।

একটা কিশোর!

আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়লাম।

চাঁদের আলোয় তার মুখ দেখা যাচ্ছে। ভীত, শংকিত এক মুখ। আমাদেরকে খেয়াল করেনি সে। দৌড়ে আসছে। যেন পেছনে তাড়া করছে কিছু।

কাছে আসতেই আমি খপ করে তার একটা হাত ধরে ফেললাম। সে ‘বাবাগো’ বলে এক চিৎকার দিয়ে আমার বুকের ওপর আছড়ে পড়ল।

আমি বললাম, ‘ভয় পেয়ো না। কে তুমি?’

‘আমি…আমি…’ সে তোতলাতে লাগল। ‘আপনারা কারা? এখানে কী করেন?’

‘তুমি কে সেটা বলো!’

আমাদের দিকে তাকাল সে। এখনও হাঁপাচ্ছে।. হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘মানুষই তো মনে হচ্ছে আপনাদের। চলেন এখান থেকে। একটুও দেরি করবেন না।’

‘আগে বলো তুমি কে!’ ধমক দিলাম আমি। ‘কোত্থেকে আসছ? যাচ্ছই বা কোথায়?’

‘আমি রবিন।’ মনে হচ্ছে রীতিমত কাঁপতে শুরু করেছে সে। ‘ওইখানে আমাদের বাড়ি-’ দূরে অন্ধকারের দিকে হাত তুলে দেখাল। ‘আমি আমার দাদাকে রেখে পালিয়ে এসেছি। দৌলতকান্দি-মামাদের বাড়ি চলে যাব।’

‘কিন্তু এত রাতে কেন? দৌড়াচ্ছই বা কেন? আর দাদাকেই বা রেখে কেন? তুমি তো অনেক ছোট। একা- একা এভাবে-’

‘ওরা-ওরা আমার দাদাকে খেয়ে ফেলবে এখন। আমার বাবাকে যারা খেয়েছে-’

‘তোমার কথা বুঝতে পারছি না আমি, কী বলছ!’

‘বলছি, আমার দাদাকে ওরা এখন খেয়ে ফেলবে। আমি জানি। আমার বাবারও ঠিক এরকম হয়েছিল। আহ্, কী যন্ত্রণা ছিল তার মাথায়। পাগল হয়ে গিয়েছিল! দাদারও এখন একই অবস্থা। ছাড়েন আমাকে।’

‘না, আমি বললাম। ‘চলো, তোমাদের বাড়ি যাব। তোমার দাদাকে দেখব।’

অবাক হয়ে ছেলেটি তাকাল আমার দিকে। বারো কি তেরো বছর বয়স ওর। খালি গা। পরনে হাফপ্যান্ট। পা দুটোও খালি। টিপিক্যাল গ্রামের ছেলেরা যেমন হয়।

‘আপনি কি পাগল নাকি?’ ছেলেটা বলল।

আমি বললাম, ‘না, আমি ডাক্তার। চলো, তোমার দাদার কী রোগ হয়েছে, দেখি।’

‘কোন রোগ হয় নাই,’ একটু শান্ত হলো সে। ‘এটা লোভের ফল। আমি কইছিলাম, দাদা, লোভ কইরেন না। বাবা মরছে, আপনিও মরবেন। আমার কথা শোনে নাই দাদা। এতক্ষণে মনে হয় তারে খাইয়া ফেলাইছে।’

‘তাকে কে খাবে?’ বিরক্ত না হয়ে পারলাম না তারা কথায়।

‘তারা খাবে…যারা আমার বাবারে খাইছিল।’

‘কারা তারা?’

ছেলেটা এবার গলা বাড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘সাপগুলা!’

আমি এবার স্পষ্ট বিরক্ত হলাম। বললাম, ‘সাপে কখনও মানুষ খায়? দেখেছ? আহাম্মক কোথাকার!’

‘হ্যাঁ, দেখেছি,’ সে বলল। ‘আমার সামনে আমার বাবাকে সাপগুলা পুরা খাইয়া ফেলছিল।’

এবার গায়ে কাঁটা দিল আমার। মনে হলো ছেলেটা মিথ্যা বলছে না। এ বয়সী একটা ছেলের মিথ্যা বলার কোন কারণ নেই, তবু আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘আমি থাকতে তোমার ভয় নেই। চলো, তোমার দাদাকে দেখে আসি। একটা মানুষকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে নেই।’

‘কিন্তু ওরা টের পেলে-’

‘কারা?’

‘সাপগুলা!’

‘শোনো, ছেলে, তুমি হয়তো কোথাও কোন সাপের গল্প পড়েছ বা শুনেছ। বাস্তবের সাথে তাকে গুলিয়ে ফেলছ। এধরনের কোন সাপ পৃথিবীতে নেই।’

ছেলেটি এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাহলে ওই ঘরগুলা?’

‘কোন্ ঘরগুলো?’

‘ওই যে রাস্তার পাশে, এখানে ঢোকার মুখে। ছয়টা ঘর।’

কেন জানি না আমি একটু কেঁপে উঠলাম। বললাম, ‘কী হয়েছে ঘর নিয়ে? ঘর তো যেখানে খুশি থাকতেই পারে।’

‘না, ওইগুলা সাপেদের ঘর। ইয়া বড়, তালগাছের মত সব সাপ থাকে ওখানে। মানুষ খায়।’

আমি ছেলেটার দিকে ভাল করে তাকালাম। বললাম, ‘তোমার মায়ের কথা এখনও বলো নাই। ওনাকেও কি সাপে খেয়েছে? নাকি অন্য কোথাও বেড়াতে গেছেন?’

আমার রসিকতাটুকু বুঝল না সে। বলল, ‘আমার জন্মের সময় মা মারা গেছে। ‘

পুরো পথ একটা কথাও বলল না রুবাইয়েত। শুধু মাঝে-মাঝে ছেলেটার দিকে তাকাতে লাগল। আমি ছেলেটার একটা হাত ধরে আছি, পাছে সে দৌড় দেয়, তাই।

সে এমনভাবে এগোচ্ছে যেন পুরো পথ তার মুখস্থ। একসময় হাঁটার গতি থামাল সে। আঙুল তুলে বলল, ‘ওই যে-’

চাঁদের আলোয় দেখলাম একটা কাঠের ঘর। ভেতরে আলো জ্বলছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

‘আপনারা যান, আমি যাব না।’ ছেলেটি বলল।

আমি বললাম, ‘মনে হয় ঘরে কেউ নেই। আলো জ্বলছে না।’

‘তাহলে এতক্ষণে দাদাকে খাইয়ে শেষ করে ফেলছে,’ নির্বিকার গলায় বলল ছেলেটি।

ঠিক তখনই চিৎকারটি শুনতে পেলাম। ঘরের মধ্য থেকে আসছে।

‘আমার দাদা…আমার দাদাজানকে হারামিগুলা খাইয়া ফেলতেছে…’ ছেলেটি আমার কাছ থেকে তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ‘বাঁচান, আমার দাদারে বাঁচান। ভুল করছিল সে। লোভে পড়ছিল, কিন্তু মানুষটা ভাল…

আমি সজোরে ছেলেটার গালে চড় মারলাম। সে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ল।

আমি রুবাইয়েতকে বললাম, ‘ওকে ধরে রেখো, আমি আসছি।’

দৌড়ে ঘরের কাছে গেলাম।

কান পাতলাম দরজায়। ভেতরে কোন সাড়া-শব্দ নেই।

ছেলেটা কি তাহলে বানিয়ে বলেছে সব?

সবটাই শিশু মনের কল্পনা?

উঁকি মারার চেষ্টা করলাম।

ভেতরটা এত অন্ধকার যে কিছুই দেখা যায় না। হঠাৎ মনে হলো পকেটে তো মোবাইল আছে, মোবাইলের টর্চটা তো জ্বেলে দেখতে পারি।

পকেট থেকে মোবাইল বের করে টর্চ জ্বাললাম।

নাহ, আশপাশটা খুব শান্ত, খুব নিশ্চুপ।

দরজায় ফুটো খুঁজতে লাগলাম, ওখান দিয়ে টর্চের

আলো ফেলে ভেতরটা দেখা যায় কিনা।

কোন ফুটো পেলাম না। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ।

আস্তে কয়েকবার ঠেলাও দিলাম। না, দরজা বন্ধ। ঘরের পেছনের দিকটায় চলে গেলাম।

কাঠের দেয়াল মেঝে থেকে চাল পর্যন্ত।

একটা জানালাও কি নেই?

আমি প্রতিটা কাঠে আলো ফেলছি। খুব মনোযোগের সাথে ফাঁক-ফোকর খুঁজছি।

এতক্ষণ খেয়াল করিনি যে ঘরের পশ্চিম পাশে একটা ছোট জানালা রয়েছে! মাটি থেকে দাঁড়ালে আমার গলা সমান উঁচুতে। আমি এগিয়ে গিয়ে জানালাটা আস্তে ঠেলা দিতেই খুলে গেল। মোবাইল উঁচু করে আলো ফেললাম ভেতরে এবং একই সাথে উঁকি দিলাম। আমি চিৎকার দিয়ে উঠেছিলাম কিনা মনে নেই। যে দৃশ্য ভেতরে দেখলাম তা আমাকে মৃত্যু পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। এর চেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য আমি আমার জীবনে দেখিনি। মুহূর্তের মধ্যেই ‘আমার সব দেখা হয়ে গেল।

মনে হয় ওরা জানত! তাই এত নিশ্চুপ ছিল। ওদের সবক’টা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একেকটার সারিবদ্ধ দাঁত। হাঁ করে আছে সবাই। লালা ঝরছে মুখ দিয়ে। এমন বীভৎস, কুৎসিত সাপ পৃথিবীতে আছে আমার জানা ছিল না। আমার বুক সমান উঁচুতে ফণা তুলে সবক’টা দাঁড়িয়ে আছে। কালো, কুচকুচে, ভয়ঙ্কর। বিশাল মুখ। সামনে পড়ে আছে অর্ধেকের বেশি খাওয়া ক্ষত-বিক্ষত একটি লাশ! আমি মোবাইল ফেলে রেখেই দৌড় দিলাম।

পেছনে শিশুদের গোঙানির মত শব্দ। আমি দৌড়চ্ছি প্রাণপণে। দেখলাম, আমাকে দৌড়তে দেখে ওই ছেলেটা আর রুবাইয়েতও দৌড়নো শুরু করেছে। পেছনে তাকানোর সাহস নেই। প্রাণপণে ছুটছি। চারদিকে হিসহিস শব্দ আর শিশুর গোঙানি। দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ মনে হলো পায়ের নিচে আর মাটি নেই, আমি বাতাসে ঝাঁপ দিয়েছি।

পড়ে যাচ্ছি আমি। কতক্ষণ জানি না।

ধপ করে পানিতে পড়লাম।

পড়েই পানির অনেক নিচে তলিয়ে গেলাম। দম বন্ধ হয়ে এল আমার। মনে হচ্ছে বুক ফেটে যাবে। আর সম্ভব নয়। মুখটা খুলতে যাব, ভুস করে ভেসে উঠলাম।

শরীরে শক্তি নেই এক বিন্দু।

শুধু ভেসে থাকার চেষ্টা করলাম পানির ওপর।

মনে হয় কোন মাছ ধরার নৌকা যাচ্ছিল।

আমাকে দেখতে পেয়ে কাছে এগিয়ে এল।

কয়েকটা হাত টেনে তুলল আমাকে।

আমি জ্ঞান হারালাম।

.

যখন জ্ঞান ফিরল, মুখের ওপর রোদ এসে পড়েছে। উঠে বসলাম আমি। সারা শরীরে ব্যথা। দেখলাম আমাকে ঘিরে বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ।

যুবক মত একজন বলল, ‘আমি আপনাকে প্রথমে দেখেছিলাম। আপনি, স্যর, নদীর মাঝখানে আসলেন কোত্থেকে? কী স্রোত, বাপরে বাপ।’

‘হুম,’ আরেকজন বলল। ‘আমি তো দেইখ্যাও বিশ্বাস করি নাই যে ওইটা কোন মানুষ। আপনারে আমরা না দেখলে আপনার বাঁচন লাগত না। মেঘনায় এখন যা স্রোত!’ আমি দুর্বল গলায় বললাম, ‘আমার সাথে আরও দুইজন ছিল। ওদের কি দেখেছ?’

‘না, আমরা শুধু আপনারেই পাইছি।’

‘আমি ঢাকা যাব। আমাকে একটা মাইক্রোবাস ঠিক করে দিলে হবে।’ চট করে নিজের দিকে তাকালাম। একটা লুঙ্গি পরা।

‘স্যর, আপনার প্যান্ট শুকাতে দেয়া হয়েছিল। সব ঠিক আছে।’ একজন বলল।

আমি প্যান্ট-শার্ট পরে নিলাম।

আমার মানিব্যাগটা একজন বাড়িয়ে দিল।

আমি বললাম, ‘ওটা আপনার কাছেই থাকুক।’

‘না, স্যর। আপনার জিনিস আপনি নেন। মেলা টাকা আপনার ব্যাগে। আমাদের অত লোভ নাই।’

লোভ! মাথার ভেতর সেই ছেলেটির কথা বাড়ি খেল।

কী যেন নাম ছেলেটির?

রবিন? হ্যাঁ, রবিন।

ওর আর রুবাইয়েতের জন্য দুশ্চিন্তা হলো আমার। ওরা ভাল আছে তো?

.

এ ঘটনার পর তিন মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে রুবাইয়েতের সাথে আমার আর যোগাযোগ হয়নি। সে-ও ফোন করেনি আমাকে। এখন অন্য একজন আমাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসা-যাওয়ার টিকেট দেয়। প্রতি শুক্রবার সকাল ৬:৩৫ মিনিটের পারাবত ট্রেনে উঠি, ফিরি বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে মহানগর এক্সপ্রেসে। শুধু আমি নই, অনেক ডাক্তার এদিন প্র্যাকটিস করতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যায়। এখন যে ছেলেটি আমাদেরকে ট্রেনের টিকেট দেয়, তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম রুবাইয়েতের কথা। সে মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘ওর কথা আর বলবেন না, স্যর। পিপীলিকার পাখা গজিয়েছে। ছিল ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ, এখন এলিয়নে চড়ে। হাইফাই অবস্থা। কথা কয় না। ফোন নম্বর পাল্টিয়েছে। দেখা হলে চেনে না। আমার মনে হয় স্মাগলিঙের সাথে জড়িত।’

আমি বললাম, ‘মানুষ বদলাতেই পারে।’

‘তাই বলে এমন বদলানো, স্যর? কুত্তা যদি ঘি খায়, পেটে সইবে? সইবে না বলে দিলাম।’

আমি বললাম, ‘সবাই যে যার মত ভাল থাকুক—এটাই তো কাম্য হওয়া উচিত, তাই না?’

সে বলল, ‘ছুঃ। একই সাথে দু’জন এই কোম্পানিতে ঢুকেছিলাম। আমি শালা এখনও ডাক্তারদের ট্রেনের টিকেট কেটেই চলেছি, আর ওই হারামজাদা এলিয়নে চড়ে। বলে, বাপের টাকা। বাপ যেন আর কারও নাই।’

আমি ট্রেনে ফেরার সময়, ট্রেন যখন মেথিকান্দা ঢোকে, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে রেললাইনের বাঁ দিকে তাকিয়ে থাকি, সাপমারা বাজারের কোন সাইনবোর্ড আমার চোখে পড়ে না। যে ছয়টি ঘর আমি দেখেছিলাম সেরকম কোন ঘরও দেখতে পাই না। আমি কয়েকজন ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছি, তারা উত্তরে বলেছে গ্রামগঞ্জে এধরনের অনেক বিচিত্র নাম থাকে-সব চেনা বা জানার কথা নয়। একসময় আমি নিজেও এসব ভুলে যাই।

একদিন বিকেলে আমি শাহবাগ কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে যাচ্ছিলাম একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। বারবার একটা নাম্বার থেকে আমার মোবাইলে কল আসছিল। আমি সাধারণত অপরিচিত নম্বর থেকে কল এলে ধরি না। তাই এ কলটিও কেটে দিচ্ছিলাম। কিন্তু এতবার কল আসছে যে শেষ পর্যন্ত আমি ধরতে বাধ্য হলাম। বেশ বিরক্ত স্বরে বললাম, ‘হ্যালো।’

‘আপনি কি স্যর বলছেন? নাকি তার পিয়ন?’ একটা মেয়েলি কণ্ঠ।

‘স্যর বলছি।’

‘স্যর, আমি রুবাইয়েতের স্ত্রী।’ দ্রুত গলায় বলল ওপাশ থেকে। ‘আপনাকে ক’দিন ধরে ট্রাই করছি। পাচ্ছি না। রুবাইয়েত খুব অসুস্থ। আপনাকে কী যেন বলতে চায়। আপনি আসুন, স্যর।’

‘কী হয়েছে ওর? ও তো আমার সাথে যোগাযোগই করে না।’

ওকে মাফ করে দিন, স্যর। আপনি কোথায় আছেন? আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। ও খুবই অসুস্থ।’

‘ও কোন্ হাসপাতালে আছে বলো। গাড়ি পাঠানো লাগবে না। আমি যাব দেখতে।’

‘হাসপাতালে না, স্যর। বাসায়। উত্তরা ১৪ নং সেক্টর। আমি, স্যর, ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। গাড়ি, স্যর, গুলিস্তানে আছে।’

‘আমি তো শাহবাগে। তুমি তাহলে পাবলিক লাইব্রেরিতে পাঠাও। আমার নম্বর দিয়ে দিয়ো।’

‘ঠিক আছে, স্যর। অনেক ধন্যবাদ।’

পাবলিক লাইব্রেরির অনুষ্ঠানে আমার আর যাওয়া হলো না। আমি গেটের কাছে পৌঁছতে গাড়িও চলে এল। নতুন ঝকঝকে গাড়ি। ড্রাইভার আমাকে চিনল। গাড়িতে তুলেই আর দেরি করল না। হর্ন বাজিয়ে চলতে শুরু করল।

‘একটু আস্তে চালাও,’ আমি তাকে মাঝে-মাঝে সতর্ক করে দিলাম। কিন্তু সে আমার কথা শুনছে বলে মনে হলো না। তার ইচ্ছামত সে গাড়ি চালাচ্ছে।

এসির মধ্যে ঠাণ্ডায় ঘুম চলে এসেছিল প্রায়। ড্রাইভারের ডাকে তন্দ্রা ছুটল। ‘স্যর, চলে এসেছি। নামেন।’

সুন্দর, দোতলা বাড়ি। সামনের লনে সবুজ ঘাস আর বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ। আমি গাড়ি থেকে নামতেই এক তরুণী দৌড়ে এল। ‘স্যর, আমি আপনাকে ফোন করেছিলাম। রুবাইয়েত দোতলার ঘরে আছে, চলুন।’

আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে-উঠতে ভাবলাম, ব্যাটা ভালই কামিয়েছে।

ঘরে ঢুকলাম আমি। চমকে গেলাম রুবাইয়েতকে দেখে। এ কাকে দেখছি আমি! প্রাণচঞ্চল এক যুবক যেন রাতারাতি বৃদ্ধে পরিণত হয়েছে।

চোখে শূন্য দৃষ্টি। এলোমেলো চুল। অর্ধেকের বেশি পেকে গেছে। চোখের নিচে কালি। মনে হয় কতদিন ঘুমায় না। আমাকে দেখে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘স্যর, আমাকে মাফ করে দেন। আপনার পায়ে পড়ি, স্যর, আমাকে মাফ করেন।’

সে সত্যি-সত্যি আমার পা ধরতে এল। আমি দ্রুত পেছনে সরে গেলাম। ‘কী হয়েছে, রুবাইয়েত?’

‘পাপের ফল, স্যর। লোভ করেছিলাম। উফ…’ রুবাইয়েত দু’হাতে তার মাথা চেপে ধরল।

‘যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি।’ মাথার চুল টানতে-টানতে বলল সে। ‘সারাক্ষণ যন্ত্রণা।’

‘ওষুধ খাও না?’

‘ওষুধ!’ হিস্টিরিয়া রোগীর মত হাসল সে। ‘ওষুধ বাইটা খাইলেও কিছু হবে না। আমার মাথা, স্যর, ছিঁড়ে যাচ্ছে।’

‘রুবাইয়েত, শান্ত হও।’ আমি বললাম।

‘কীভাবে শান্ত হব, স্যর। ঘুমাতে পারি না। মাথার মধ্যে খসখস শব্দ হয়। মনে হয় কী যেন নড়ছে। কখনও মনে হয় আমার মাথার মধ্যে, স্যর, সাপ জন্মাইছে।’

‘কী আবাল-তাবোল চিন্তা তোমার!’

‘আমি সত্যি বলছি। হঠাৎ মোচড় দিয়ে নড়ে ওঠে। ব্যথায় আমি প্রায় মরে যাই। কেন যে লোভ সামলাতে পারলাম না।’

‘কীসের লোভ?’

ওই পোলাডারে চাইপা ধরতেই আমারে কইছিল, স্যর, ওই পোলা, যার দাদাকে সাপে খাইছিল!’

‘বলো, শুনছি।’

কথা বলতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে রুবাইয়েতের। ঘন-ঘন শ্বাস নিতে-নিতে বলল, ‘আপনাকে তো, স্যর, খুঁজে পেলাম না। মনে করছিলাম সাপের পেটে গেছেন। আমরা ওই রাতেই দৌলতকান্দি চলে আসি। ওই পোলা শোনাল তার দাদার মরার কাহিনি। সাপদের আক্রোশের কথা। একটা কুয়া আছে ওখানে। বিষ ভর্তি কুয়া। সাপেরা ওখানে তাদের বিষ ঢালে। ওর দাদা ওই বিষ নিয়ে বেচত। জানেন তো, স্যর, কোটি টাকা দাম। আমিও শুনে লোভ সামলাতে পারিনি। এই দেখেন, স্যর, কী দামি বাসায় থাকি। সাপের বিষের টাকায় কেনা। ওই পোলারে সাথে নিয়ে আমি দিনের বেলা গিয়েছিলাম। পানির বোতলে কইরা বিষ নিয়ে আসি। যদি জানতাম ওগুলো সাধারণ সাপ না-’

দু’হাতে জোরে মাথা চেপে ধরল রুবাইয়েত।

‘স্যর, মরে যাচ্ছি, স্যর। এত যন্ত্রণা-মাথাটা, স্যর, ফাইটা যাচ্ছে।’

দেখলাম যন্ত্রণায় মোচড় খাচ্ছে রুবাইয়েতের শরীর। ভাল করে তাকালে মনে হবে যেন একটা সাপ।

ঘাড় বাঁকিয়ে-বাঁকিয়ে সে অদ্ভুত শব্দ করছে। আমি কী করব বুঝতে পারছি না।

তার দিকে এগোতেই সে হাত নেড়ে নিষেধ করল। ‘স্যর-স্যর-স্যর…’ শেষ একথাটাই শুধু বলতে পেরেছিল সে। ঠাস করে একটা শব্দ হলো।

একই সময়ে তার ভেতরে যেন একটা শিশু গুঙিয়ে উঠল।

পড়ে গেল সে।

তার মাথার খুলি চুরমার হয়ে গেছে।

আমি চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলাম। যেখানে মগজ থাকার কথা সেখানে মগজ নেই।

একটা কুণ্ডলী পাকানো সাপ!

ফোঁস-ফোঁস শব্দ করতে-করতে সে রুবাইয়েতের মাথার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। কালো, কুৎসিত। লেজ নাড়ছে। জিভ বের করছে মাঝে-মাঝে। মুখটা হাঁ করল একটু। সারি-সারি দাঁত! আমি পাথরের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

বিশাল ফণা তুলেছে সাপটা।

হিসহিস শব্দ হচ্ছে।

মনে হচ্ছে শব্দের পরিমাণ আরও বেড়ে যাচ্ছে। এখন পুরো ঘর জুড়ে শুধু হিসহিস শব্দ।

আমি দৌড়নোর শক্তি হারিয়ে ফেললাম।

রুবাইয়েত পড়ে আছে মেঝেতে।

সাপটা তার পায়ের কাছে গেল। ছোবল মারার মত ঊরুতে কামড় বসাল। টেনে এক খাবলা মাংস নিয়ে এল। চিবোতে লাগল। আমি বমি করে ফেললাম।

সাপটা ঘুরে তাকাল আমার দিকে। কী বীভৎস দেখতে! জ্বলজ্বল করছে তার চোখ। ঠোঁট গোল করে মনে হলো শিস দিল!

হিসহিস শব্দে ভরে উঠল ঘর। অবাক হয়ে দেখি জানালা দিয়ে ওরা ঢুকছে!

আমি গোনার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। কালো, মাংসল সাপ।

যেন আমার দিকে খেয়াল নেই ওদের।

এগোতে লাগল দল বেঁধে।

তারপর এক যোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল রুবাইয়েতের লাশের ওপর!

মিজানুর রহমান কল্লোল

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *