শ্বাপদতন্ত্র – সৈয়দ অনির্বাণ

শ্বাপদতন্ত্র

এক

ক্ষুধা! বয়স হয়ে গেছে তার, আগের মত উদ্যম আর শক্তি নেই আর। নেই আগের সেই দুর্দমনীয় ক্ষমতা, গতিবিধির স্বাধীনতাও অনেকটাই খর্ব হয়েছে। এক কালের পরাশক্তি এখন পরিণত হয়েছে অতীত গৌরবের ছায়াতে। অক্ষমতার হাত ধরে সঙ্গে জুটেছে খাদ্যের অভাব। আগের মত সাবলীল ঢঙে শিকার করতে পারে না সে আর তাই প্রায় সময়ই অভুক্ত থাকতে হয়। ফলস্বরূপ বুকে তার সব সময়ই দাউ-দাউ করে জ্বলতে থাকে আগুন-তীব্র ক্ষুধার আগুন!

.

বিশাল অরণ্যের কোলে কেউ বহুকাল আগে পত্তন করেছিল এই বসতির। ক্রমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে বিশাল এক জনপদ। তার করাল আগ্রাসনে বনভূমি আজ হুমকির মুখে। তবে হারানো দিনের মহিমা আজও কিছুটা অবশিষ্ট আছে।

বিশাল বিশাল মহীরুহ আর তার ছায়াতে বেড়ে ওঠা ঘন ঝোপঝাড়ে ছাওয়া গহীন বন এবং গ্রামের মাঝে রয়েছে এক চিলতে ঘেসো জমি। সেখানে চরে বেড়ায় গরু-মোষের পাল। স্থানীয় অনেকেরই জীবিকা নির্ভর করে এই চারণভূমির উপর।

পশুপালন নির্ভর জনপদ, আর তাই বাঘ বা চিতাবাঘের কবলে গরু-মোষের মৃত্যু ঘটলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায় পশুপালকের। এমনি একটা গরু অসুস্থ হলে আর কিছু না হোক, জবাই করে ওটার মাংস খাওয়া যায় কাজে আসে চামড়াটাও। কিন্তু বাঘে নিলে লবডঙ্কা। তা ছাড়া, শুধু পশুই না, জানেরও তো ভয় আছে। যদিও মানুষখেকোর দেখা কদাচই মেলে। কিন্তু তবু ঝুঁকি কম নয়।

গবাদি-পশু চরানোর সময় প্রত্যেকেই একটা শিঙ্গা রাখে সঙ্গে। কেউ বিপদে পড়লে ওটা বাজিয়ে অন্যদের সংকেত দেয়া যায়। পর পর তিনবার শিঙ্গা ফুঁকলে সবাই বুঝবে বাঘ এসেছে! ওটাই এই এলাকায় বিপদের সর্বোচ্চ সীমা।

চারণভূমিটা এমনিতে সমতল হলেও উত্তর ধারে একটা ছোট্ট টিলা মত আছে, সেটা পেরিয়ে অন্যপাশে গেলে পাওয়া যাবে অর্ধবৃত্ত আকৃতির ঢালু একটা জমি। ওটা আকারে একর দশেকের মত। চমৎকার ঘাস হলেও সাধারণত কেউ পশু চরাতে যায় না ওদিকে। কারণ টিলার পেছনে বলে গ্রাম থেকে একটু বেখাপ্পা রকমের আড়ালে জায়গাটা। তা ছাড়া, বড় বেশি বনের গা ঘেঁষা। যে-কোনও সময় হিংস্র কোনও শ্বাপদের আগমন ঘটার সম্ভাবনাটাও বেশি ওদিকে।

হাঁটু সমান বয়স থেকেই গরু চরায় নুরু। এখন ও সদ্য কৈশোর পেরোনো তরুণ। চমৎকার স্বাস্থ্য আর সুদর্শন চেহারার সঙ্গে মানানসই অমায়িক ব্যবহারের কারণে গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবার প্রিয় পাত্র ও। তা ছাড়া, অল্প বয়সে এতিম হয়েছে বলে গ্রামের সবাই সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখে ওকে। অন্যসব দিনের মত আজও গরু চরাতে বেরিয়েছিল ও। দুপুরের পর হঠাৎ আবিষ্কার করল, অন্যমনস্কভাবে ঘুরতে ঘুরতে ওর পালটা চলে গেছে টিলার অন্যপাশের ঢালু জমিটাতে। প্রথমেই যে চিন্তাটা ওর মাথায় এল, তা হচ্ছে—এদিকে আসাটা কি ঠিক হলো? বিপদ-আপদ হলে সাহায্য পেতে সমস্যা হবে। কিন্তু একটু পরেই চিন্তাটাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিল ও মাথা থেকে। গত বেশ কয়েক মাসে একবারও হামলা চালায়নি বাঘ বা চিতা জাতীয় কোনও প্রাণী। গ্রামে দু’চারবার শিয়ালে মুরগি নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই খোয়া যায়নি। খামোকাই চিন্তা করে মরে বুড়োরা! মনে মনে পল্লী-সমাজের নীতি নির্ধারকদের প্রতি তাচ্ছিল্য মিশ্রিত বিরক্তি বোধ করল ও।

কেউ না আসায় এদিকের ঘাসগুলো ইচ্ছামত বেড়ে উঠেছে। এই ঘাস পেলে অচিরেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠবে ওর পালের গরু। এখন থেকে এদিকেই আসতে হবে, ভাবল ও।

পশুগুলোকে ইচ্ছামত চরে খেতে দিয়ে একটা মোটা গাছের গুঁড়িতে পিঠ দিয়ে বসল নুরু। কোমরে গোঁজা থলে থেকে তামাকের সরঞ্জাম বের করে বিড়ি বাঁধতে শুরু করল। গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজছে মনের সুখে। ধূমপান আর আলস্য করে বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত করল ও। তারপর আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল। পশ্চিম আকাশ দেখে অনুমান করল, আর দেড় কি দুই ঘণ্টা পর অস্ত যাবে সূর্য। মানে কিছুক্ষণের মধ্যেই গরু-মোষগুলো জড় করে ফিরতি পথ ধরা উচিত।

তামাকের সরঞ্জাম গুছিয়ে কোমরে গুঁজতে গিয়েই ওর হাতে ঠেকল শিঙ্গাটা। এবং হুট করে মাথায় খেলে গেল একটা দুষ্ট বুদ্ধি। আচ্ছা, একটা মস্করা করলে কেমন হয়?

মাথায় চাপা দুর্বুদ্ধিটাকে মনে মনে উল্টে পাল্টে দেখল নুরু। যতই ভাবল, শয়তানিটা করার ইচ্ছা ততই চাগিয়ে উঠল ওর মনে। যেন ওর মাথার ভেতর বসে দুষ্ট বুদ্ধি দিচ্ছে কোনও তৃতীয় পক্ষ!

সব সময়ই দেখা যায় যে সুবুদ্ধি সহজে না খেললেও শয়তানি খুব দ্রুতই খেলে মানুষের মাথায়। বিশেষ করে অল্পবয়সীদের মাঝে মস্করা করার প্রবণতা প্রকট হয়ে থাকে। নুরুও তার ব্যতিক্রম নয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেল ওর। এমন তো না যে কারও ক্ষতি করতে যাচ্ছে-সামান্য একটু মজা করবে মাত্র! যেই ভাবা, সেই কাজ—একটু আগে যে গাছটার গোড়ায় বসে ছিল, সেটা বেয়েই বেশ কিছুটা উপরে উঠে গেল ও। মোটা একটা ডালে আয়েস করে পা ঝুলিয়ে বসে প্রস্তুত হয়ে নিল, তারপর গলায় ঝুলানো শিঙ্গাটা ঠোঁটে তুলে জোরে জোরে ফুঁ দিল তাতে। পর পর তিনবার!

দুই

শিঙ্গার তীব্র, তীক্ষ্ণ আওয়াজ খানখান করে দিল শান্ত বিকেলের নীরবতা। এ ধরনের শিঙ্গা তৈরিই করা হয় বহুদূর থেকে সংকেত দেবার জন্য। তাই এর শব্দ যে জোরালো হবে, সে তো জানা কথা। স্থানীয় লোকজন এই শব্দের সঙ্গে সুপরিচিত। এবং এটা মোটেই তাদের প্রিয় কোনও সুর নয়। বিপদ সংকেত পেলে কারও মন উৎফুল্ল হয় না, বরং শঙ্কাই জাগে। তার উপর নুরু ফুঁ দিয়েছে তিনবার। এর অর্থ এলাকার সবাই জানে। মহা বিপদ সংকেত-বাঘ এসেছে!

বাঘ! হলুদের উপর কালো ডোরাকাটা ভয়ঙ্কর সুন্দর ওই জানোয়ারটাকে সমীহ করে চলে সবাই, ভয়ও পায়। প্রকৃতিপ্রদত্ত অমিত শক্তির অধিকারী ওই শ্বাপদ আক্রমণ করলে প্রাণ নিয়ে ফেরা কঠিন। শিঙ্গাটা তিনবার বেজেছে। তার মানে, হয় খুব কাছে-পিঠেই আগমন ঘটেছে বাঘের। অথবা কপাল খারাপ হলে হয়তো গরুর পালে ঝাঁপিয়েই পড়েছে ওটা। ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ার চিন্তা বাদ, কারণ তা হলে আর শিঙ্গা বাজানোর সুযোগ হত না বাদকের।

সে যা-ই হোক, শব্দটা এসেছে টিলার অন্যপাশ থেকে। এদিকে যারা ওই দিন পশু চরাচ্ছিল, তাদের মাঝে খেলে গেল একটা চাঞ্চল্য। রাখালদের নেতা রহিম সরদার মোষ চরানোর পাশাপাশি লাঠি খেলাতেও পারদর্শী। বিশালদেহী, শক্তিশালী লোক সে। সাহসেরও কমতি নেই। প্রথমে সে-ই করিতকর্মা হলো। হাঁক-ডাক করে নিমিষের মধ্যেই জনা বিশেক লোক জড় করে ফেলল রহিম। উত্তেজনায় বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে, আর সমানে শাপ-শাপান্ত করছে। ‘ওই চুলোয় মরতে গেছে কোন্ ব্যাটা?’ মাটিতে পা দাপিয়ে জব্বার আলী নামের শুকনো মত চেহারার এক বুড়োকে জিজ্ঞেস করল রহিম, ‘জানে না ওই দিকটা ভালা না! মামা ঘোরাফেরা করে ওই দিকে, এইডা কি নতুন খবর?’

স্থানীয়ভাবে বাঘকে মামা নামেই ডাকে ওরা, বাঘ শব্দটা পারতপক্ষে উচ্চারণ করতে চায় না।

পিচিক করে পানের পিক ফেলে মুখ বিকৃত করল জব্বার, ‘এহন কি আর ওইসব চিন্তা করনের সময় আছে? আগে চল গিয়া দেইখা আসি অবস্থাডা কী?’

‘কইলেই কি যাওয়া যায়, মামা বইলা কথা!’ ভীতু প্রকৃতির হারুন মিয়া অন্য পাশ থেকে ফোড়ন কাটে।

‘মামা হইছে তো কী হইছে? আমরা এত্তগুলান লোক-হুদাই ভয় খাইস না!’ বলতে বলতে এক সাগরেদের কাছ থেকে লম্বা একটা বল্লম লুফে নেয় রহিম সরদার, ‘চল, ভাইরা, গিয়া দেখি কার কপাল পুড়ল!’

.

ওদিকে গাছের ডালে আয়েস করে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল নুরু। একটু আগে যে বিড়িগুলো বেঁধেছিল, তারই একটা ধরিয়ে মনের সুখে টানতে টানতে নিজ মনেই হাসছিল। টিলার ঢাল বেয়ে শোরগোল করতে করতে নেমে আসা লোকজন দেখে গাছের গায়ে ঘষে বিড়িটা নিভিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলল ও। দলের মাঝে মুরুব্বি কিসিমের লোক থাকবেই। মস্করা করা এক জিনিস আর বেয়াদবি আরেক। তরতর করে গাছ থেকে নেমে অগ্রসরমান দলটার দিকে এগিয়ে গেল ও।

দূর থেকে ওকে দেখে হেঁকে উঠল রহিম সরদার, ‘ক্যাডারে? নুরা নাকি? ঠিক আছোস তুই?’

‘হ চাচা, ঠিকই আছি।’ একটু ইতস্তত করে উত্তরটা দিল নুরু, মনে মনে একটু ঘাবড়ে গেছে। রহিম সরদারকে দলের পুরোভাগে আশা করেনি ও, কারণ কয়েক দিন আগে শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিল লোকটা। ফিরেছে যে, তা নুরু জানত না। বদমেজাজি লোকটাকে একটু ভয়ই পায় ও। রহিম সরদার ভালর ভাল, খারাপের যম। রেগে গেলে দু’চারটা চড়- থাপ্পড়ও দিয়ে বসতে পারে। ওই লোকের পেল্লায় হাতের চড় খেলে আর দেখতে হবে না। একবার ওর ঝোঁক চাপল যে সত্যিই বাঘ এসেছিল দাবি করে বসে। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নাকচ করে দিল চিন্তাটা। অভিজ্ঞ লোক রহিম সরদার, আর সঙ্গে জব্বার আলী বুড়োও আছে। বাঘের চিহ্ন খুঁজে না পেলে ও যে মিথ্যা বলছে, ঠিকই তা বুঝে যাবে ওরা। আরও বেশি রেগে যাবে। তখন আর শুধু চড়-থাপ্পড় দিয়ে রেহাই দেবে না। কে জানে, গ্রামে নিয়ে হয়তো সালিশই ডেকে বসবে!

বিষয়টা নিয়ে বেশি ভাবনা-চিন্তা করার সুযোগ মিলল না নুরুর। দ্রুতই ওর কাছাকাছি চলে এল দলটা। ‘কী ব্যাপার, নুরা? মামা আইছিল? কিছু নিছে নাকি?’ হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করল হারুন মিয়া। এই মুহূর্তে বাঘের মুখোমুখি হতে হবে না বুঝতে পেরে হম্বিতম্বি বেড়ে গেছে তার।

‘হ, নুরু ভাই, কিছু খোয়া গেছে নি?’ ওর বছর দুয়েকের ছোট আউয়ালও কৌতূহল প্রকাশ করল।

রহিম সরদার অবশ্য প্রশ্ন করার ধার ধারছে না। দলের লোকজনকে নুরুর গরু-মোষগুলো জড় করতে বলল সে। গোটা বারো পশু চরায় নুরু। ও একাই ওগুলোকে সামলাতে পারে। এতগুলো লোকের পক্ষে ওই কটা জন্তু পাকড়াও করা কোনও কাজই নয়। তবু বাঘের উপস্থিতি বলে কথা।

‘আসলে, কাকা,’ রহিমকে অন্যদিকে মন দিতে দেখে হালে পানি পেয়েছে নুরু, জব্বারকে উদ্দেশ্য করে বলল ও, ‘হইছে কী জানেন…

‘কী?’ বকের মত গলা বাড়িয়ে ওর দিকে ঝুঁকে এল বুড়ো। কৌতূহল তারও কম নেই।

‘আসলে…’ আমতা আমতা করতে লাগল নুরু, ঠিক কী বলবে সাজিয়ে নিতে চেষ্টা করছে।

‘ধুর, মিয়া, তাত্তারি কও তো, কোন্ দিকে গেছে মামাডা?’ পাশ থেকে তাড়া লাগাল একজন।

‘আসলে মামা আসেই নাইক্কা!’ হড়বড় করে বলে ফেলল নুরু।

তিন

দিন তিনেক পরের কথা। মেজাজ খারাপ করে সেদিনের ওই গাছটার নিচে বসে আছে নুরু। আসলে গত তিন দিন ধরেই মাথাটা গরম হয়ে আছে ওর। সামান্য একটা মজাও বোঝে না এই গাঁয়ের লোকগুলি। ছেলেবেলায় একবার দূরের এক গঞ্জে বেড়াতে গিয়েছিল নুরু। ওখানে দেখেছে যে মানুষ গাঁটের পয়সা খরচ করে ভাঁড়ামি দেখে। ঠকার জন্য ইচ্ছা করে টাকা ফেলে শহুরে বাবুরা! আর ওর নিজের গ্রামের গেঁয়ো ভূতের দল! একটু তামাশা করেছে বলে ওই দিন ওকে কান ধরে ওঠা-বসা করিয়েছে রহিম সরদার। বলেছে ফের এমন হলে মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেবে! ব্যাটার যেমন মোষের মত শরীর, মারলে হাড় গুঁড়ো হয়ে যাবারই কথা।

বেগতিক দেখে অবশ্য যুক্তি দিয়ে ব্যাটাদের বোঝাতে চেয়েছিল ও। কিন্তু সেকথাও কেউ কানে তোলেনি। তুলবেই বা কেন? কতক্ষণে সাহায্য আসে এটা যাচাই করার জন্য ‘বাঘ এসেছে’ এহেন মিথ্যা সংকেত দেবার যুক্তি ধোপে টেকার কথা নয়।

তবে ওর নামও নুরু! শোধ না নিয়ে ছাড়বে না। আর কিছু না হোক, ওই রহিম সরদার আর তার চেলাদেরকে বেগার খাটাবে ও। তার জন্য যদি নিজের বিপদ হয়, তাও সই! অবশ্য ধরা না পড়লে আবার বিপদ কী! যেমন ভাবা, তেমন কাজ। আজ আটঘাট বেঁধেই এসেছে ও। গরু-মোষ আনেনি আজ। আগের দিন ওগুলো এক বন্ধুকে বুঝিয়ে দিয়ে বলছে, ও দূরের এক গাঁয়ে বেড়াতে যাবে আজ। তারপর ঘুরপথে এদিকে এসে ঘাপটি মেরে বসে আছে। উদ্দেশ্য আর কিছুই না। সন্ধ্যার আগে আগে শিঙ্গা ফুঁকে বাঘ আসার সংকেত দেবে ও। ওই সংকেত পেলে খোঁজ নিতে না এসে উপায় থাকবে না রহিম সরদারের। তবে এইবার আর দেখা দেবে না নুরু। গাছের মগডালে উঠে লুকিয়ে থাকবে। দেখবে, ব্যাটাদের নিষ্ফল ঘোরাঘুরি করে গলদঘর্ম হবার দৃশ্য। ওটাই হবে ওদের জন্য উচিত শিক্ষা!

যেমন ভাবা তেমন কাজ। গাছটার উপরের দিকে ঘন পাতার আড়ালে নিজেকে ভাল মত লুকিয়ে বসল নুরু। তারপর যথারীতি ফুঁকল শিঙ্গাটা পর পর তিনবার!

.

রহিম সরদার বা অন্য যারা মাঠে গরু চরায়, তারা স্বপ্নেও ভাবেনি যে সেদিনের ঘটনার পর আবার কেউ এই বিষয় নিয়ে ফাজলামি করতে পারে। তাই শিঙ্গার আওয়াজ কানে যেতে সেটাকে স্বাভাবিক গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করল সবাই। এবং লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে গেল শব্দ লক্ষ্য করে।

দলটা যখন হাঁপাতে হাঁপাতে নেমে এল টিলা পেরিয়ে, পশ্চিম আকাশে সূর্য তখন অস্ত যেতে বসেছে। কিন্তু কীসের কী! খাঁ-খাঁ করছে গোটা তল্লাট। কোথাও কেউ নেই। থতমত খেয়ে গেল ওরা।

তবে কি কেউ ছিল, কিন্তু বাঘে ধরে নিয়ে গেছে বেচারাকে?

ফিসফাস করে জল্পনা-কল্পনা শুরু করল সবাই।

বল্লমে ভর দিয়ে ভুরু কুঁচকে দাঁড়াল রহিম সর্দার। কী যেন ভাবছে।

‘কী চিন্তা করো, রহিম ভাই?’ জানতে চাইল দলের একজন।

‘শিঙ্গাডা বাজাইল কেডা?’ আপন মনে মাথা নাড়ল রহিম সরদার। তারপর সবাইকে বলল এলাকাটা তল্লাশি করার জন্য। বাঘের পায়ের ছাপ বা অন্য কোনও চিহ্ন চোখে পড়ে কি না দেখতে হবে।

‘ভালা কইরা দেখ, ভাইয়েরা, মামায় নিয়া থাকলে রক্তের দাগ থাইকবো!’ সবাই যাতে শুনতে পায় তাই চেঁচিয়ে বলল জব্বার আলী।

গাছের উপর থেকে ওদের কাণ্ড দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছে তখন নুরু। ও যতটা

ও যতটা ভেবেছিল, বিষয়টাকে তারচেয়েও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে জনতা। দেবেই তো, তারা তো আর জানে না যে বাঘের আগমনের ব্যাপারটা ভুয়া। অবশ্য ওদের ছুটোছুটি করাটাই সার হবে, কারণ বাস্তবে তো আর কোনও বাঘ আসেনি!

‘এইবার মজা বুঝ!’ নিজের মনেই বিড়বিড় করল নুরু। ‘ওই দিন মজা করছিলাম হেইডা ভাল্লাগে নাই, এখন?’ পুরো ব্যাপারটার সার্থকতা চিন্তা করে পারলে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিত ও।

ওদিকে সবাই খোঁজাখুঁজিতে ব্যস্ত হলেও রহিম সরদার কিন্তু তাতে যোগ দেয়নি। সন্দেহ দানা বেঁধেছে তার মনে। এমনিতেই কেউ আসে না এদিকটায়, তাও ধরা যাক কেউ এসেছে, কিন্তু তা হলে তার গরু-মোষ কোথায় গেল? রাখাল ছাড়া অন্য কারও তো শিঙ্গা নিয়ে চলাফেরার করার কথা না। আর গরু চরানো ছাড়া অন্য কী কাজ থাকতে পারে বিজন জায়গাতে?

ওই দিন নুরুর ভাবগতিক ভাল ঠেকেনি তার, হয়তো আবার মস্করা করেছে ছোকরা। যদিও সেই সাহস ওর হবার কথা না, কিন্তু বলা যায় না। নুরু বা অন্য কেউ যদি শয়তানি করে ওই শিঙ্গা ফুঁকে থাকে, তা হলে খুব সম্ভব এদিকেই কোথাও লুকিয়ে আছে সে। কারণ গাঁয়ে ফেরার পথে গেলে দলের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়ে যেত। আর এই ভর সন্ধ্যায় বনের মধ্য দিয়ে ঘুরপথে বাড়ি ফেরাটা যে কারও জন্য অস্বাভাবিক। আর এদিকে যদি কেউ লুকিয়েই থাকে, তার জন্য আদর্শ জায়গা হচ্ছে ওই বড় ঝাঁকড়া গাছটা। সাতপাঁচ ভেবে সিদ্ধান্ত নিল রহিম সরদার। যেই ভাবা, সেই কাজ, বল্লমটা মাটিতে গেড়ে গাছ বেয়ে ওঠা শুরু করল সে।

এদিকে এমন কিছু ঘটতে পারে, সেটা হিসাব করেনি নুরু। ও ভেবেছিল, কাউকে না দেখে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ গজগজ করে বিদায় নেবে দলটা। তার বদলে এমন আতিপাতি করে পুরো এলাকা খুঁজে দেখবে, এমনকী গাছেও চড়বে, তাও আবার রহিম সরদার স্বয়ং, এমনটা ওর মাথায় খেলেনি। নুরু যতটুকু চিনত, তাতে করে ভেবেছিল পেশিসর্বস্ব বোকা কিসিমের লোক রহিম সরদার। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বাস্তবে ঘটে যথেষ্ট বুদ্ধি ধরে লোকটা 1

আর লুকিয়ে থেকে লাভ নেই বুঝতে পেরে পাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ও। মনে মনে নিজেকেই গাল দিচ্ছে। উচিত ছিল শিঙ্গাটা বাজিয়েই ঘুরপথে চম্পট দেয়া। তা হলে আর এই বিপদে পড়তে হত না।

গতবারের সাক্ষাতে যেখানে ছিল উদ্বেগ, এবার সেখানে জায়গা করে নিল রাগ। নুরুকে দেখেই গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকল রহিম সরদার। ওরা গাছ থেকে নামার আগেই নিচে জড় হলো সবাই। হতাশ চোখে লক্ষ্য করল নুরু, একটা মুখও বন্ধুভাবাপন্ন নয়। মনে মনে আবার নিজের বোকামির জন্য শাপশাপান্ত করল ও নিজেকে।

এদিকে রাগে ফেটে পড়েছে জনতা। এই মিথ্যা সংকেত দেয়াটা কী ধরনের ফাজলামি, সেই কৈফিয়ত চাইছে সবাই। নুরু মাটিতে স্থির হয়ে দাঁড়াতেই ওর গালে কষে এক চড় বসিয়ে দিল রহিম সরদার। নুরুর মনে হলো মুগুর দিয়ে বাড়ি মারা হয়েছে ওকে। চোখের কোণ দিয়ে পানি বেরিয়ে এল ব্যথার চোটে। অনুভব করল ফেটে গেছে ঠোঁটের একপাশ।

তবু ওর কপাল ভালই বলতে হবে। ওই একটা চড়ই যা, এরপর আর কেউ গায়ে হাত তুলল না ওর। তবে তাই বলে ভর্ৎসনা করার বেলায় কেউ কারও থেকে কম গেল না। বিষয়টা নিয়ে শীঘ্রিই সালিশ বসবে গাঁয়ে, এই মর্মে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দল বেঁধে বিদায় নিল সবাই। ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে সন্ধ্যা। কিন্তু তবু একবারের জন্যও নুরুকে সঙ্গে যেতে বলল না কেউ।

স্তব্ধ হয়ে বনের প্রান্তে একা দাঁড়িয়ে রইল নুরু। চড় খেয়ে ব্যথায় মুখের বাম পাশ টনটন করছে ওর। কিন্তু মনের মাঝে যে জ্বলুনি হচ্ছে, তার তুলনায় ওটা কিছুই না। নিজের দোষটা সহজে চোখে পড়ে না মানুষের, কথাটা নুরুর বেলাতেও সত্যি। ওর সঙ্গে কী করা হয়েছে, সেটাই নজর কাড়ছে ওর। কিন্তু নিজে কী করেছে, সেটা বেমালুম ভুলে গেছে। আরও বেশ কিছুক্ষণ পর ও যখন গাঁয়ের পথ ধরল, ততক্ষণে আকাশের কোণে দেখা দিয়েছে চাঁদ। তার ম্লান আলোয় পথ চলতে চলতে জেদের সঙ্গে ভাবল নুরু, এখানেই শেষ নয়! আরও নিখুঁত কায়দা করে কাজ সারবে পরের বার। খাটিয়ে রহিম সরদারের হাড় কালো না করলে ওর শান্তি হবে না! কিন্তু এইসব ভাবতে ভাবতে পথ চলার সময় ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করল না, অদূরেই বনের প্রান্তে ঝোপের মধ্য থেকে ওর উপর নজর রাখছে জ্বলজ্বলে একজোড়া চোখ।

প্রচণ্ড ক্ষুধা সেই চোখের মালিকের পেটে!

চার

দুই দিন পরের কথা। আগামীকাল নুরুর বিচারের জন্য সালিশ বসবে। এর আগেই ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলতে হবে ওকে। যদিও এবার আর ধরা পড়ার ঝুঁকি নেবে না। তবুও কোনও কারণে যদি আবার ধরা পড়েও যায়, সালিশের আগে হলেই ভাল সেটা। কারণ একবার রায় দিয়ে দিলে এটা গোটা গ্রামের মাথাব্যথা হয়ে যাবে। এখন ওর এই ‘বাঘ এসেছে! বাঘ এসেছে!’ খেলার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে উত্তম-মধ্যম দেয়ার থেকে বেশি আর কিছু করতে পারবে না রহিম সরদার বা তার দলের লোকেরা, কিন্তু সালিশের কথা ভিন্ন। তাই যা করার আগেই করে নিতে চাইছে নুরু। হয়তো এবারেও ধরা পড়লে শাস্তি কিছু বাড়বে, কিন্তু তাতে এমন কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। এত কিছু ভাবতে পারল অথচ ওই হঠকারী কাজটা করা থেকে বিরত থাকার চিন্তা একবারও এল না ওর মাথায়। সত্যিই মানুষের মতিগতি বোঝা দায়!

আজও সন্ধ্যার কিছু আগে সেই গাছের নিচে এসে দাঁড়াল নুরু। ‘দেখি আজ কে আমাকে ধরে! যত্তসব বেরসিকের দল!’ বিড়বিড় করে কথাটা আউড়ে, অভ্যস্ত ভঙ্গিতে শিঙ্গা ফুঁকল ও। তারপর ঘুরেই দ্রুত পা চালাল বনের দিকে। উদ্দেশ্য: কেউ আসার আগেই বনে ঢুকে যাবে। তা হলে আর ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকবে না। খুঁজতে এসে খামোকাই হয়রান হবে রহিম সরদার আর তার চেলারা। কাজের কাজ কিছুই হবে না। তারা সন্দেহ করতে পারলেও প্রমাণ করতে পারবে না, তা ছাড়া ওর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নতুন করে তেমন কিছু যোগও করবে না। বিচারে তেমন কিছু হবে না ওর। কারণ এই ঘটনার আগ পর্যন্ত গ্রামে বেশ একটা সুনাম ছিল ওর, তার উপর এতিম বলে এমনিতেই মানুষের সহানুভূতি আছে ওর উপর। হয়তো কিছু জরিমানা করা হবে। তা হোক গে। কিন্তু ব্যাটাদের তো খাটিয়ে মারা যাবে!

বনের সীমানার কাছে পৌঁছে একবার ফিরে দাঁড়িয়ে পেছন পানে চাইল নুরু। নাহ্, এখনও কারও টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য যাবার কথাও না। লোকজন জড় হয়ে আসতে যতটা সময় লাগে, ততক্ষণ পার হয়নি এখনও। তবে আর বেশি দেরি করাটাও ঠিক হবে না। ভেবে যেই আবার বনের দিকে ঘুরেছে, অমনি জায়গায় বরফের মত জমে গেল নুরু। অস্ফুট একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল ওর গলা চিরে। ভয়ে, বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে মুখটা।

গজ পঞ্চাশেক সামনে চোখে পড়ছে একটা ঝোপ। সেই ঝোপের ভেতর থেকে ধীর গতিতে বেরিয়ে আসছে কী ওটা!

‘মামা!’ মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ করল নুরু। সমস্ত শরীর যেন জমে গেছে ওর।

বিশালদেহী হলদে জানোয়ারটা পুরোপুরি বেরিয়ে এল ঝোপ ছেড়ে। শেষ বিকেলের রক্তিম আলোয় অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে ওটার ডোরাকাটা দেহটাকে। সবুজাভ চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে নুরুর উপর। সন্তর্পণে ওর দিকে এক পা এগোল ওটা। তারপর আরেক পা।

নুরুর পায়ে যেন শেকড় গজিয়ে গেছে! চেষ্টা করেও নড়তে পারছে না ও। বনের ধারে বাস হলেও আগে কখনও এরকম সামনা-সামনি ৰাঘ দেখেনি ও। বাঘে খেয়ে যাওয়া গরু দেখেছে কয়েকবার। পায়ের ছাপও চোখে পড়েছে। গঞ্জে গিয়ে একবার সার্কাসের খাঁচায় বন্দি বাঘও দেখেছিল। কিন্তু বনের বাঘের সামনে এই প্রথম। কিংকর্তব্য স্থির করতে পারছে না নুরু। এমন সময় হঠাৎ গলায় ঝুলানো শিঙ্গাটা হাতে ঠেকল ওর।

তাই তো! একটু আগেই তো তিনবার ফুঁকেছে ওটা। এতক্ষণে তো চলে আসার কথা রহিম সরদার আর তার দলবলের। একটু আগেই যাদের কাছ থেকে পালাতে যাচ্ছিল, এই মুহূর্তে সেই তাদেরই আগমনের জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা শুরু করল ও। আর কতক্ষণ লাগবে ওদের পৌঁছতে? আবার শিঙ্গা ফুঁকে দেখবে নাকি, যদি তা হলে তাড়াতাড়ি আসে?

বাঘটা এখনও স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কেন যে ওটা সময় নিচ্ছে, তা নুরু জানে না। কিন্তু দেরি করছে বলে মনে কিছুটা আশা জাগছে ওর। হয়তো সময় মত এসে পড়বে রহিম সরদার। খুব ধীরে ধীরে শিঙ্গাটাকে আবার মুখের কাছে তুলল ও। মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্যেও বাঘটার উপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না।

.

পর পর তিনবার শিঙ্গা বাজার মানে বাঘ এসেছে। এই তল্লাটে এটা এক অলিখিত নিয়ম। কিন্তু গত কয়েক দিনে নিয়মের ব্যতিক্রম কম হয়নি। তাই এবারও যখন টিলার অপর পাশ থেকে বেজে উঠল শিঙ্গা, দেখতে যাবার কোনও দরকার নেই বলে সিদ্ধান্ত দিল রহিম সরদার। ‘ওই নুরু ছ্যামড়ার কাম এইডা!’ জোর গলায় ঘোষণা করল সে। ‘হালার বাইচলামি কাইলকা সালিশের সময় বাইর করুম! তোমাগো ওই দিক কান দেওনের কাম নাই!’

অন্য সবাই সমর্থন জানাল তার এই সিদ্ধান্তকে।

কিছুক্ষণ পর একই দিক থেকে আবারও শোনা গেল শিঙ্গার শব্দ। তবে এবারে মাত্র একবার।

‘ওই দ্যাখ, আমরা কেউ যাই নাই দেইখা হালায় আবার বাজায়! বদমাইশ জানি কোনেকার!’ মুখ খিঁচিয়ে গাল দিল সাদেক নামের একজন।

‘কান দিস না!’ অন্য একজনের সংক্ষিপ্ত জবাব।

যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাখালেরা। সন্ধ্যায় সব গরু-মোষ জড় করে গুনতে হয়, তারপর বাড়ি ফেরার পালা। সেদিকে মন দিল সবাই।

.

শিঙ্গার শব্দ কানে যেতেই ভয়ানক বেগে নুরুর দিকে ধেয়ে এল বাঘটা। আঁতকে উঠে প্রাণপণে উল্টো দিকে ছুট দিল নুরু। শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুঁ দেবার আর সুযোগ পেল না।

কথায় আছে জানের মায়া বড় মায়া। এমনিতেই বেশ ভাল দৌড়াতে পারে ও, তার উপর এখন ভয় আর জীবনের প্রতি টান বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে ওর গতি। কিন্তু, বাঘের সঙ্গে দৌড়ের পাল্লায় মানুষের কোনও আশা থাকে না। ওর বেলাতেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ক্রমশ কমে আসতে লাগল দুইয়ের মাঝের দূরত্ব।

বাঘটা যখন আর মাত্র গজ দশেক পেছনে, আর দুই লাফেই ওর নাগাল পেয়ে যাবে, তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত ঘাসের সঙ্গে পা জড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল নুরু। আগের গতিবেগের কারণে বেশ কিছুদূর পিছলে গেল দেহটা। হাঁচড়েপাঁচড়ে ওঠার চেষ্টা করল ও, কিন্তু পারল না। বেকায়দায় পড়ে বাজেভাবে মচকে গেছে ওর ডান পা। কিন্তু এতক্ষণে তো বাঘটার ওর ওপরে এসে পড়ার কথা!

শরীর মুচড়ে বহু কষ্টে চিত হলো নুরু। এবং মুখোমুখি হলো এমন এক দৃশ্যের, যার কোনও ব্যাখ্যা দাঁড় করানো ওর পক্ষে অসম্ভব।

পাঁচ

ক্ষুধা! ইদানীং ক্ষুধার জ্বালায় বড্ড কষ্ট হয় মনসা তান্ত্রিকের। ব্রত গ্রহণের ফলে এবং নিজের অলৌকিক শক্তি ধরে রাখার জন্য একমাত্র মাংসাশী জন্তুর কলজে ছাড়া আর কিছু খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তার জন্য। কিন্তু মাংসাশী জীব টাকায় ষোলোটা মেলে না! এটা ঠিক যে সাধারণ মানুষের তুলনায় তার চাহিদা বহুগুণে কম। সাধনা করে অল্প খাদ্যে জীবন ধারণের ক্ষমতা অর্জন করেছে সে। কিন্তু কমেরও তো একটা সীমা আছে! আগে, বয়সকালে দেহে শক্তি ছিল অফুরান, এখন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তন্ত্রমন্ত্রের শক্তি বাড়লেও দৈহিক শক্তি কমে গেছে তার। আর তার খাবার জোগাড়ের পথে সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান অন্তরায়।

আগে বাঘ-চিতাবাঘ শিকার করা তার কাছে কোনও ঘটনাই ছিল না। বনে ঢুকে খুঁজে বের করাই যা কঠিন, তারপর মেরে নিলেই হলো। কিন্তু এখন আর ওই ভয়াবহ জীবগুলোর সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই করার ভরসা পায় না। শক্তি আর ক্ষিপ্রতা কমে গেছে, শিকার করতে গিয়ে নিজেকেই হয়তো শিকারে পরিণত হতে হবে! তাই ইদানীং ছোটখাট জীব-জানোয়ার, যেমন শিয়াল, খাটাস অথবা পাখি, যেমন চিল, শকুন, এমনকী ঠেকায় পড়লে কুকুর, বিড়াল বা কাকের কলজে পর্যন্ত খেতে হয় তাকে। এই লজ্জা সে কোথায় রাখবে? আর ওইসব পুঁচকে প্রাণীর কলজেতে না আছে স্বাদ, আর না ভরে পেট! তবু, বাঁচতে তো হবে!

আসলে সমস্যাটা পাকিয়ে তুলেছে বনের এক উপদেবতা। বছর দুই আগে তার পেয়ারের একটা বাঘিনীকে মেরে আয়েস করে ওটার কলজে খাচ্ছিল মনসা তান্ত্রিক। সে কি আর ছাই জানত ওটা উপদেবতার প্রিয় জানোয়ার? রেগে গিয়ে তাকে অভিশাপ দিয়েছে ওই দেবতা। বনের মধ্যে এখন আর ওই জাদুশক্তি কাজ করে না। আর তাই হাতাহাতি করতে হয় হিংস্র শ্বাপদের সঙ্গে!

কত দিন হয়ে গেল পেট পুরে খায় না সে!

শুকিয়ে প্যাকাটি মেরে গেছে একদা হৃষ্টপুষ্ট দেহটা!

ক্ষুধা, বড্ড ক্ষুধা।

ওই দিন নুরু ছেলেটার কীর্তি দেখে হঠাৎই একটা চিন্তা মাথায় এসেছে মনসা তান্ত্রিকের। এদিকের বনের ধারে একটা বাঘ থাকে। বেশ বড় একটা মদ্দা বাঘ। ওটার কলজেটা নিশ্চয়ই বিরাট হবে আকারে। ভাবলেই জিভে পানি এসে যায়! কিন্তু বনে ঢুকে ওটাকে মারার মুরোদ নেই মনসার। তবে কোনওভাবে ওটাকে বন থেকে বের করে আনতে পারলে হয়। জাদুশক্তি ব্যবহার করতে পারলে তাকে আর পায় কে? নুরু এদিকে ঘোরাফেরা করে, ওকে দেখে বাঘটা যদি শিকার করতে আসে, তা হলেই হবে। কেল্লা ফতে!

কপালটা ভালই বলতে হবে মনসার। বাঘটা খুব সম্ভব আগেও মানুষ শিকার করেছে। ওটার হাবভাবে মানুষের প্রতি পশুদের সহজাত যে ভয়, তার নজির দেখেনি মনসা তান্ত্রিক। অন্যদিকে নুরু ছোকরা সেদিন খামোকা শিঙ্গা বাজিয়ে নিজের একমাত্র অস্ত্রটা হারিয়ে ফেলেছে।

এই শিঙ্গা নিয়েও চিন্তিত ছিল মনসা। সে জানে যে ওটা বাজালেই এসে ভিড় জমাবে রাজ্যের লোকজন। তখন আর কিছুই তার পরিকল্পনা মাফিক সারা যাবে না। কিন্তু আটঘাট বাঁধা আছে। প্রথম দিন শিঙ্গা বাজিয়ে মস্করা করার পর কাজটা অব্যাহত রাখার জন্য নিজের অশুভ ক্ষমতা খাটিয়ে বারবার নুরুকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ‘ প্ররোচিত করেছে মনসা তান্ত্রিক। আর তাই অবচেতন মনের তাগিদে নুরুও চালিয়ে গেছে ওই হঠকারিতা। ফলে এবারে আর কেউ আসবে না।

.

বাঘটা খুব সম্ভব ঝাঁপ দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এমন সময় পেছন থেকে আক্রান্ত হয়েছে ওটা। আধশোয়া অবস্থায়, বিস্ফারিত চোখে, পায়ের অসহ্য ব্যথা ভুলে নুরু দেখল, বাঘটার পিঠের ওপর লেপটে আছে মানুষ সদৃশ এক জীব।

অশুভ কী যেন একটা আছে ওটার মাঝে। কঙ্কালসার শুকনো ওটার দেহ। সন্ধ্যার ম্লান আলোতেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চামড়ার নিচ থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসা হাড়ের সমষ্টি। চার হাত-পায়ে তীক্ষ্ণ নখ ওটার। আর সেই নখ দিয়ে খামচে ঝুলছে আছে বাঘটার পিঠে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, বাঘটা এই অযাচিত সওয়ারকে তাড়ানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছে না। কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে বিশাল, ভয়াবহ ওই জন্তুটা; ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে আসছে ওটার সবুজাভ চোখ দুটো।

‘হিশ্! হিশ্!’ করে জান্তব একটা ধ্বনি বের হচ্ছে বাঘের পিঠের ওই বীভৎস সওয়ারটার মুখ থেকে। টপ-টপ করে ঝরে পড়ছে লালা। দেখা যাচ্ছে টকটকে লাল এবং অস্বাভাবিক লম্বা একটা জিভ! কাঁচাপাকা, জট পড়া লম্বা চুল তার বাতাসে উড়ছে। নখগুলো যেখানে আঁকড়ে আছে বাঘের শরীর, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে কালো, ঘন ধোঁয়ার মত কী যেন! চামড়া ভেদ করে বাঘটার শরীরেও ঢুকছে ওই জিনিস! তার প্রভাবেই কি না কে জানে, দেখতে দেখতে একেবারেই নিভে গেল বাঘটার চোখের জ্যোতি। ভারসাম্য হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ওটা ঘাসের মধ্যে।

কয়েক মুহূর্ত পর উঠে দাঁড়াল বাঘের পিঠে সওয়ার থাকা সেই বিভীষিকাময় জিনিসটা।

হ্যাঁ, মানুষই ওটা। আবার মানুষও নয়! ওটার দিকে তাকিয়ে একটু আগে বাঘের কবলে পড়ার চেয়েও অনেক বেশি অসহায় বোধ করল নুরু। কাঁপা কাঁপা হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল গলা থেকে বুকে ঝুলন্ত শিঙ্গাটা।

কেউ এখনও আসছে না কেন?

উত্তরটা জানা থাকলেও ওর উত্তপ্ত, ভীত মস্তিষ্ক বিষয়টা অস্বীকার করছে। মনে আশা, ঠিক যেভাবে খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায় ডুবন্ত মানুষ!

.

ঠোঁট চাটল মনসা তান্ত্রিক। ল্যাঠা চুকে গেছে। বিরাট এক বাঘ মেরেছে সে। আজ অনেক দিন পর পেট ভরে খাওয়া যাবে। খাবার নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না আগামী বেশ কিছু দিন। তবে একটা কাজ বাকি আছে। উপদেবতার মন পাওয়ার জন্য তুলা রাশির জাতকের একটা খুলি দরকার তার। লোকালয়ে হানা দিয়ে মানুষ শিকার করাটাকে নীতিগতভাবে ঘৃণা করে বলে এত দিনেও জোগাড় হয়নি জিনিসটা। গোটা দুই ডাকাত আর এক ভবঘুরে অবশ্য তার কবলে পড়েছিল। কিন্তু তাদের কারওই রাশি ঠিক ছিল না।

এই ছেলে কী রাশির, কে জানে!

একটাই উপায় আছে। দেবতার কাছে নৈবেদ্য দিতে হবে খুলিটা। সে অভিশাপ তুলে নিলে বুঝবে রাশি ঠিক ছিল। কোমর থেকে ভোজালিটা টেনে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল সে ভূপাতিত নুরুকে লক্ষ্য করে।

.

বাড়ি ফেরার পথে রহিম সরদার আর তার দলের লোকেরা শুনল, বহুদূরে বাজছে শিঙ্গা।

একবার, দু’বার, তিনবার, চারবার…

সৈয়দ অনির্বাণ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *