পোর্ট্রেট – ধ্রুব নীল

পোর্ট্রেট

এক

রাত সাড়ে দশটা।

বছর দশেক হবে মেয়েটার বয়স। মায়াবি চোখ। কোঁকড়া চুল। চোখে ঘুম ঘুম ভাব। ঘুণে ধরা টেবিলের সামনে নড়বড়ে এক চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে কারও জন্য। ছোট্ট ঘরটায় অল্প পাওয়ারের বাতির মিটমিট আলো তার ঘুমটা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে যেন। যে করেই হোক জেগে থাকতে হবে।

অপেক্ষার পালা শেষ হলো আধঘণ্টা পর। দরজা খোলার শব্দ শুনেই বুঝল, চুপিসারে ঢুকেছে কেউ একজন। মেয়েটা সচকিত। ড্রয়ার খুলে পেনসিল আর খাতা নিয়ে টেবিলে রাখল ঝটপট। পেনসিলের ডগাটা পরখ করে নিল। একদম তৈরি ওটা। শার্পনার আর ইরেজারও হাতের নাগালে। মেয়েটার পেছনে এসে দাঁড়াল লুঙ্গি আর পুরনো সোয়েটার পরা মধ্যবয়সী লোকটা। যে কিনা একটু আগেই ঘরে ঢুকেছে। কোনও কথা না বলে হাতের মোবাইল ফোনটা রাখল মেয়েটার সামনে। স্ক্রিনে এক যুবকের ছবি। ঘাড় বাঁকিয়ে ছবির দিকে তাকাল মেয়েটা। তাকিয়েই রইল। চোখ আর ফেরাল না। খাতার ওপর চলতে শুরু করল পেনসিল। কখনও খসখস শব্দ, কখনও আলতো করে ঘষছে পেনসিল আর ইরেজার। আলো-ছায়ায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে অবয়ব। মিনিট দশেকের মধ্যেই শেষ হলো আঁকা। দুটো ছবি মিলিয়ে দেখল পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা। মুখের হাসিই বলে দিল, একদম নিখুঁত হয়েছে পোর্ট্রেটটা। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘এইবার হারামি বুঝব কব্বরের আযাব কারে কয়।’

মেয়েটা হাসল না। তার চোখে ঘুম।

‘আমি ঘুমাই, চাচাজি?’

‘ঘুমা রে, মা, ঘুমা। কাইল তোরে এক প্যাকেট চকলেট কিনা দিমু। এখন আরাম কইরা ঘুম দে।’

দুই

‘তুই রহস্য গল্প লিখিস বলে ঘটনা তোরে কইলাম। খুব বেশি লোকে কিন্তু জানে না। জানলে বিশাল ঘটনা বেধে যাবে।’

‘গুড। ভাল করেছিস আমাকে বলে। এখন এটা নিয়ে একটা গল্প লিখি আর বলে বেড়াই, সত্য ঘটনা অবলম্বনে। তখন গোটা দেশ জেনে যাবে। হা-হা-হা।’

রহস্য গল্প লেখক তুষার ইশতিয়াক এসেছে তার বন্ধু মিলনের গ্রামের বাড়ি নিশিন্দাপুরে। মাথায় ঘুরছিল একটা থ্রিলারের প্লট। কিন্তু মিলন নাছোড়বান্দা। সে তার গল্পটা নিয়েই আছে। নিশিন্দাপুরে তিনকোনার মাথা বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে আসমা নামের বছর দশেকের এক মেয়ের কী এক গোপন রহস্য জেনে ফেলেছে ও। এসেই বলে বসল অদ্ভুত কথাটা: ‘মেয়েটার ভয়ানক ক্ষমতা আছে। ছবি এঁকে মানুষ মেরে ফেলতে পারে।’

‘শুধু মানুষ? গরু-ছাগল এসব মারতে পারে না?’

‘তোদের মত অতি শিক্ষিতদের নিয়ে এই এক সমস্যা। আমিও দু’চার কলম বিজ্ঞান পড়েছি। স্কুলে বাংলা পড়াই বলে যে ফিজিক্স কিস্তু বুঝব না এমন ভাবার কারণ নাই। তুই দেখতে যাবি কি না বল! আর হ্যাঁ, যার ছবি আঁকে, সে-ই মারা যায়। এটা ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে, কেউ ভয়ে কিছু বলে না। যদি আবার তার ছবি এঁকে ফেলে?’

‘কী দেখব? মেয়েটা ছবি আঁকছে আর মানুষ মরে যাচ্ছে?’

‘দেখ, ঘটনা কিছু আছে এর মধ্যে। মেয়েটা স্কুলে যায় না। কেউ তার সঙ্গে মেশেও না। ওর হাতে কাগজ-কলম দেখলে লোকে এক শ’ হাত দূর দিয়ে হাঁটে।’

‘কী ভয়ানক!’

‘অবশ্যই ভয়ানক!’

‘আমি মেয়েটার কথা বলছি না! সবাই ওর প্রতি যে আচরণ করছে, সেটা ভয়ানক।’

‘তোর মাথা! আগে দেইখা আয় নিজের চোখে।’

মিলনের চেহারা দেখে আর কথা বাড়াল না তুষার। মনের খচ-খচানিও আছে বৈকি। ভুতুড়ে রহস্য ছাড়া গ্রামে ঘোরাঘুরিটা ঠিক জমে না।

দুপুরে খেয়ে বের হলো দুই বন্ধু। মাইলখানেকের হাঁটাপথ। পথে যেতে কানে এল কান্নার রোল। আশপাশে মারা গেছে কেউ।

‘মোটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট। লোকাল এক নেতার ছেলে,’ বলল মিলন। ‘চৌধুরী সাবের পোলা। নাম বকুল। বদের হাড্ডি ছিল। যদিও মারা গেছে, তারপরও না বইলা উপায় নাই। ওর যন্ত্রণায় গ্রামের কয়েকটা মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আরও অনেক কেস। চল, একটু দেখে আসি।’

‘নাহ, আমার ইচ্ছা নাই।’

‘আরে, ভয়ের কারণ নাই। ধাক্কা লেগে শুধু মাথার খুলি খানিকটা ফেটেছে। ভয়ানক কিছু না।’

তুষার জানে, বাধা দিয়ে লাভ নেই। মিলনের সব কিছুতেই অতি আগ্রহ।

লাশের চেহারা স্বাভাবিক। বয়স ত্রিশের ঘরে। লাশ দেখা শেষে দু’জনে চলে গেল তিনকোনার মাথার একপ্রান্তে পড়ে থাকা ছোট টিনের চালার বাড়িটায়। উঠোন ভর্তি গাছগাছালি। কলতলার আশপাশে ঝোপঝাড়। ভুতুড়ে আবহ তৈরির জন্য যথেষ্ট।

‘রইসু ভাই আছেন?’

অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর এক নারীকণ্ঠ শুনতে পেল দু’জন। ‘উনি বাড়ি নাই। পরে আসেন।’

‘আমার সঙ্গে ঢাকা থেকে সাংবাদিক এসেছেন। তিনি আসমার আঁকা ছবি দেখতে চান। শহরের পত্রিকায় ছাপবেন। আমরা উঠোনে বসলাম।’

মিলনের অবলীলায় মিথ্যে বলার ক্ষমতা দেখে অবাক হলো না তুষার। এসব না বললে সম্ভবত দেখাই হবে না।

‘আপনারা পরে আসেন। আসমার শরীর ভাল না।’

‘আমরা হাজিপাড়া থেকে আসছি। দুই মাইলের হাঁটাপথ। এখন কেমনে কী করি?’

কিছুক্ষণ নীরবতা। এরপর উঠোনে দুটো চেয়ার পেতে দিল ওই নারী।

‘রইসু ভাই আমার পরিচিত। আপনার লগে আমার খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয় নাই।’

‘আমি আসমার চাচী।’

তুষার চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়লেও মিলন বারবার উঁকি দিচ্ছে ভেতরে। আসমার মুখটা এক ঝলক দেখেওছে।

‘আমি জানি আপনারা কেন আসছেন।‘

আসমার চাচীর গলার ক্ষোভটা কান এড়াল না তুষারের।

তবে উনি আর কথা বললেন না।

রইসু নামের মধ্যবয়সী লোকটা এল একটু পর। মিলন ও তার বন্ধুকে দেখে চমকে উঠল। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিতে সময় নিল না।

‘কী চান আপনেরা?’

‘আসমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’

‘কী কাম তার লগে?’

এবার মুখ খুলল তুষার। ‘তার ছবি আঁকার বিষয়টা নিয়ে গ্রামে একটা গুজব রটেছে। এটা ভেঙে দেয়া জরুরি। তা না হলে…’

রইসু স্থির। ঢিলটা জায়গামত লেগেছে দেখে খুশি তুষার। মিলনও আমতা আমতা করে বলল, ‘হুম। আসলে এটা যে একটা গুজব, সেটা না জানলে পরে আসমা গ্রামেই থাকতে পারবে না। ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এ নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি দরকার।’

রইসু কিছু বলতে যাবে, তার আগেই স্ত্রীর ইশারায় ভেতরে গেল। সম্ভবত আসমার চাচী তাকে বুঝিয়ে দিল যে তুষারদের কথাই ঠিক।

‘আইচ্ছা, ঠিকাছে। এখন কী চান?’

তুষার বলল, ‘আমি শুনলাম, আসমা যার ছবি আঁকে, সে নাকি মারা যায়। হে-হে, তো, আমার একটা ছবি আঁকুক না?’

‘ফাইজলামি করেন?’

স্ত্রীর চোখে চেয়ে আবার শান্ত হয়ে গেল রইসু। ওদিকে দরজার আড়ালে দাঁড়ানো আসমাকে ইশারায় ডাক দিল মিলন। আসমার হাতে পেনসিল ও খাতা।

তিন

গ্রামে খবর ছড়াতে সময় লাগে না। এর জন্য অবশ্য মিলনের দোষ নেই। চালাকিটা তুষারেরই। রইসুর সঙ্গে তাদের কথাবার্তা শুনছিল পাশের কয়েকজন ছেলে আর বয়স্ক মহিলা। তুষার তাদের শুনিয়ে শুনিয়েই বলেছে, আসমা তার ছবি আঁকবে ভরা মজলিসে। গ্রামের অনেকেই থাকবে। এবং সে দেখিয়ে দেবে আসমাকে নিয়ে ঘটনাটা গুজব ছাড়া কিছুই নয়।

আসমাকে নিয়ে এরমধ্যে বেশ ক’টি গল্প শোনা হয়ে গেছে তুষারের। গ্রামের লোকজনই বলেছে।

‘আসমার বয়স যখন পাঁচ। তখন থেকে আচমকা ছবি আঁকা শুরু। যা দেখে হুবহু আঁইকা ফালায়। আমরা তো খুশি। এমুন এক গুণবতী আমাদের গেরামে! কিন্তুক, একবার সে আমার ছাগলটার ছবি আঁইকা ফেলল। ওই দিন রাতেই তড়পাইতে তড়পাইতে ছাগলটা আমার মইরে গেল।’

আরেকজন বলল, ‘ক্যান! আসমার বাপের কথা কও!’

নড়েচড়ে বসল তুষার। বেড়েছে মনের খচ খচানি। -’ওর বাপও আপনার মত বাজি ধরসিল। গেরামে সবাই কয় আসমার উপরে একটা কিছু ভর করসে। কিন্তুক, হের বাপে বিশ্বাস করত না। আসমারে ধমকাইয়া-টমকাইয়া কইল, বেটি, তুই এখন হগ্গলের সামনে আমার ছবি আঁকবি! হুবহু আঁকবি!’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কী! রাইত না পার হইতেই বেডা কাইত!’

‘কীভাবে মারা গেলেন উনি?’

‘রাইতে মসজিদ থেইকা আসার পথেই সাপে কাটল। আহা রে, জোয়ান মানুষটা। মা তো আগেই গেছে। এরপর বাপ। তারপর থেইকা রইসুর কাছে থাকে আসমা। কেমুন জানি চাচা লাগে তার।’

‘আচ্ছা।’ হাঁফ ছাড়ল তুষার। কাকতালীয় শব্দটাকে বেশ ক্ষমতাধর মনে হচ্ছে।

মিলনের আগ্রহের কমতি নেই। সে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আরও গল্প আদায় করে নিতে ব্যস্ত।

.

সময় ঠিক হলো বিকাল চারটা।

গ্রামের অনেকেই এসেছে। সবার মাঝে উৎসবের আমেজ। এর মধ্যে চা-মুড়ি পর্বও হয়েছে। আসমা সেজেগুজে বসে আছে উঠোনে। তার হাতে পেনসিল আর ড্রয়িং বোর্ডে লাগানো সাধারণ একটা কাগজ। মুখোমুখি চেয়ারে সটান বসে আছে তুষার। এরমধ্যে নিজের ক্যামেরায় আসমার একটা ছবিও তুলে নিল।

শুরু হলো ছবি আঁকা। বসে আছে তুষার। দশ মিনিটের মধ্যেই আঁকা শেষ। সবাই তাকাল তুষারের দিকে। পিনপতন নীরবতা। আচমকা বুকে হাত দিয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল তুষার।

লাফিয়ে উঠল মিলন। ‘তুষার! তুষার!’

হই-হই রব উঠল দর্শকদের মধ্যে।

আসমা মাটির দিকে তাকিয়ে আছে চুপচাপ। কেমন যেন রাগে ফেটে পড়ছে তার চোখ। বোর্ড থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল কাগজটা।

অভিনয়টা বেশিক্ষণ জারি রাখল না তুষার। বাচ্চা মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে তিরস্কার করল। সবার দিকে তাকিয়ে সলজ্জ হেসে বোঝানোর চেষ্টা করল, আসমার বিষয়টা কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আসমার রাগী চেহারাটা কিছুতেই তাড়াতে পারছে না মন থেকে। কুড়িয়ে নিল ছবি আঁকা কাগজটা। অবাক হলো। মেয়েটা অসাধারণ আঁকে। একদম যাকে বলে ফটোরিয়েলিস্টিক। ছবিটা ভাঁজ করে বুকপকেটে রেখে দিল তুষার।

সন্ধ্যা ঘনাতেই খালি হয়েছে রইসুর উঠোন। কাউকে তেমন অবাক বা হতাশ হতে দেখা গেল না। মিলন অস্থির চিত্তে পায়চারি করছে আর বারবার একই কথা আওড়াচ্ছে, ‘সঙ্গে সঙ্গে কেউ মারা যায়নি। চব্বিশ ঘণ্টার মামলা আছে। এখন মাত্র একঘণ্টা গেছে। তুই কাজটা ঠিক করিস নাই! আমি এখন তোরে কই নিয়া যাই রে, বন্ধু!‘

‘কোথায় নিয়ে যাবি?’

‘ঢাকা এখান থেকে দশ ঘণ্টার পথ। তোর এখন কিছু হলে হাসপাতালে নিতে হইব।’ আহত দৃষ্টি মিলনের। যেন চোখের সামনে জলজ্যান্ত বন্ধুটাকে মরতে দেখছে।

হাসি খেলে গেল তুষারের চোখে। ‘তুই আমার অভিনয়টাকে সত্যি ভেবেছিলি! হা-হাহ্-হা! আর ছবি আঁকলে যদি মারাই যাব, তো হাসপাতাল আমাকে বাঁচাতে পারবে?’

‘শোনেন! এদিকে আসেন!’

ধমকের সুরে কথাটা বলল আসমা। তার সঙ্গে মাথায় আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রইসুর স্ত্রী।

‘আসমা, আমি সরি! মানে দুঃখিত। তুমি কষ্ট পেয়েছ। তবে আমি যে বেঁচে আছি, এটা মনে হয় ভালই হলো, নাকি!’

তুষারের কণ্ঠে কৌতুকের ছাপ ধরতে পেরেছে কি না বোঝা গেল না। তবে আসমা তার সামনে আরেকটা কাগজ বাড়িয়ে ধরল। ছবিটা দেখল তুষার ও মিলন। চেনা চেনা মনে হলো।

চলে গেল আসমা ও তার চাচী।

সুনসান নীরবতা।

একে অন্যের দিকে তাকাল তুষার আর মিলন। চিনতে পেরেছে ওরা ছবির মানুষটাকে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া বকুল!

চার

‘ছবিটা পুড়িয়ে ফেলা দরকার।’ মিলনের গলা কাঁপছে।

‘অবশ্যই না। সুন্দর পোর্ট্রেট।’ নির্বিকার তুষার।

‘তুই এখনও বিশ্বাস করছিস না?’

‘কাকতাল বলে একটা ব্যাপার আছে। না হয় অ্যাক্সিডেন্টের পরেই এঁকেছে ও। অবশ্য, এটার কথা জানানো ঠিক হবে না কাউকে। মেয়েটা বিপদে পড়বে। গ্রামের মানুষ তো।’

‘গ্রামের মানুষ তো কী? আমিও তো গ্রামের মানুষ। তো?’

‘না কিছু না। তুই একটু বাড়াবাড়ি করছিস, মিলন। ছেলেটা ওই ছাগলের মত ছটফট করে মরেনি। মদ খেয়ে নিশ্চয়ই বাইক চালাচ্ছিল।’

‘কিন্তু আসমা সেটা আগেই জানে, এবং সে ছবিও এঁকে ফেলেছে।’

‘হুম। সেটাই কাকতাল। কে জানে, হয়তো গ্রামের সবার পোর্ট্রেট সে আগেই এঁকে রেখেছে। যখন মারা যাবে, তারটা বের করে দেখাবে।’ তুষারের কঠিন যুক্তি।

পাল্টা জবাব দিতে পারল না মিলন। তুষারের লেখক মগজের যুক্তি মেনে নিয়ে আপাতত চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিল। তবে বারবার বন্ধুকে পরখ করে নিতে ভুল করছে না। সেটা দেখে বিরক্ত হলেও কিছু বলল না তুষার। তার আচমকা মরে যাওয়া নিয়ে মিলন যে টেনশনে আছে, এটা ভাবতে বরং ভালই লাগছে তার।

বাড়ির পথ ধরল দু’জন। ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তুষার। গ্রামের সবার পোর্ট্রেট আগেই করে রেখেছে মেয়েটা, নিজের কানেই কথাটা অবিশ্বাস্য লেগেছে তার। ছবিটা দেখেই মনে হয় সামনাসামনি নয়, কোনও একটা ছবি দেখেই এটা এঁকেছে আসমা।

অর্ধেকটা পথ এগিয়েছে সবে, এমন সময় দুই বন্ধুর পথ আগলে দাঁড়াল রইসু।

‘ভাইজানেরা, একটু দাঁড়ান।’

খানিকটা ভড়কে গেলেও সামলে নিল দু’জন।

‘আসমা মাইয়াডা একটু অইন্যরকম। একটু আলাভোলা। লোকে নানান কথাবার্তা কয়। আমগো শত্রুও অনেক। অনেকেই ডরায়। তয়, বাবাজি, আপনে শহর থেইকা আসছেন। মিলনের বন্ধু। আপনের কাছে অনুরোধ, আপনে এইডা নিয়া কিসু লিখতে যাইয়েন না।’

‘না-না, প্রশ্নই আসে না! গুজবে ঘি ঢালব কোন্ দুঃখে?’

কথাটা শুনে কেমন যেন আহত দেখাল রইসুকে।

‘তয়, বাবাজি, ছবিটা আমারে দিয়া দেন। আসমা যেটা দিসে।’

‘এই নিন।’

আবারও সেই খচ-খচে অনুভূতি। তুষার স্পষ্ট বুঝতে পারল, ছবিটা নিতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিল রইসু। তার সঙ্গে নিহত ওই যুবকের কোনও সম্পর্ক নেই তো?

বাসায় ফিরেই আবার বেরিয়ে গেল মিলন। তার চলাফেরা এখন অনেকটা দুদে গোয়েন্দাদের মত। তুষারকে একটা কিছু বিশ্বাস করিয়ে ছাড়া পর্যন্ত থামবে না ও। গ্রামের মানুষের কাছ থেকে কথা বের করতে সময় লাগল না তার। রাতের মধ্যেই জেনে নিল ঘটনা। নিহত যুবকের নাম বকুল। বেশ ক’দিন ধরেই নাকি রইসুর স্ত্রীকে বিরক্ত করে আসছিল সে।

পাঁচ

হাই তুলতে গিয়ে মাঝপথে আটকে গেল তুষার। বিছানার পাশে বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে মিলন। বন্ধুকে হাই তুলতে দেখে হাঁফ ছাড়ল।

‘সারারাত ঘুমাসনি?’ ভ্রূ কুঁচকে জানতে চাইল তুষার।

‘না, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে বসে ছিলাম,’ খুশি হলেও বিরক্তির ভান করল মিলন।

‘তুই কি হতাশ? আমি মরিনি দেখে?’

মিলন কিছু বলল না। নাস্তার টেবিলেও কথা হলো না খুব একটা। ঘুরতে বের হলো দু’জন। কথাবার্তা বিশেষ হচ্ছে না। তুষারের মনে হলো আসমাকে দিয়ে নিজের ছবি আঁকানোটাই ভুল হয়েছে।

‘চব্বিশ ঘণ্টা এখনও পার হয় নাই,’ বিড়বিড় করে বলল মিলন। একটা শাখা নদীর কাছে চলে এসেছে। তুষার কিছু বলতে যাবে, এমন সময় হই-চই কানে এল। আসমাদের বাড়ির দিক থেকে। ছুট লাগাল দু’জন।

তুষারের আশঙ্কাই সত্যি হলো। রইসুর বাড়ির সামনের রাস্তা ও পাশের খালি জমিতে গ্রামবাসীর ভিড়। মুখে কাপড় পেঁচানো লাঠি হাতে একদল লোকও আছে। ঘটনা পরিষ্কার হলো মুখে কাপড় পরা একজনের কথায়।

‘ওই পিশাচিনীরে আমি মাইরা ফালামু। তুই আমারে চিনস নাই। ঘরে দুধকলা দিয়া তুই পিশাচ পালতেছিস, রইসু! সাবধান! এই গেরামের কাউরে সে বাঁচতে দিব না। তুই মাইয়াডারে বাইর, কর, আইজকাই শেষ কইরা দিমু! আমার পোলারে মারছস তুই! আমার পোলারে!’

‘বকুলের বাপ! খবর ফাঁস হয়ে গেছে রে।’ ফিসফিস করে বলল মিলন।

‘ওরা মুখোশ পরে আছে কেন?’ জানতে চাইল তুষার। ‘বুঝলি না! ওদের ছবি যদি আবার আসমা এঁকে ফেলে!’

‘উফ্। কী থেকে কী! পুলিশ ডাক দে। মেয়েটার তো ভালই বিপদ!’

এদিকে নিহত যুবক বকুলের বাবা চেঁচিয়েই যাচ্ছে। ‘তোকে মোবাইল হাতে ঘুর-ঘুর করতে দেখসে আমার লোক। তুই আমার পোলার ছবি তুলছস। তোর ঘর তল্লাশি করুম আমরা।’

রইসুও কম যায় না, ‘আপনে কিন্তু বাড়াবাড়ি করতাসেন। আমি মামলা করুম কইলাম! পোলা মরসে দেইখা কিছু কইলাম না। কিন্তু গেরামের দশজনরে জিগান, আপনের পোলা কেমুন আছিল। সে যাউকগা। অ্যাক্সিডেন্টে মরসে, এটা সবাই জানে। ক্যান শুধু শুধু আমার মাইয়ারে দোষ দেন!’

ও তোর মাইয়া কেডা কইসে! তুই ওর পাতাইন্না চাচা। ওই মাইয়া তার বাপরে মারসে! এখন তুই কালসাপ পুষতেছিস! খবরদার! আমি ওরে দেইখা লমু!’

এরপর হুট করে ঘটল কতগুলো ঘটনা। বাড়ির ভেতর থেকে সামনের রাস্তায় হুড়মুড় করে বের হলো আসমা। হাতে পেনসিল আর কাগজ। তাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে হম্বিতম্বি করতে থাকা লোকগুলো আচমকা পিছিয়ে গেল। ভয় জিনিসটা দারুণ ছোঁয়াচে। সঙ্গে সঙ্গে ভিড় জমানো লোকগুলোও চলে গেল। বকুলের বাবা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কাপড় দিয়ে মুখ-চোখ ঢাকতে ব্যস্ত। পড়ে গেছে কারও কারও হাতের লাঠি। শাসাতে শাসাতে একপর্যায়ে চলে গেল প্রত্যেকে। আসমাও হনহন করে আবার ঢুকে পড়ল ঘরে। সবাই চলে যাওয়ায় এগিয়ে গেল তুষার। অনিচ্ছাসত্ত্বেও পিছু নিল মিলন।

‘রইসু ভাই। একটু আসমার সঙ্গে কথা বলব।’

‘না, কোনও কথা নাই। আপনে যান! বাইর হন!’

মিলন ইশারায় কী যেন বোঝাতে চাইল রইসুকে। সাংবাদিক শব্দটা শুনে ঘাবড়ে গেল।

‘দেখেন, মেয়েটা বহুত পেরেশানিতে আছে,’ বলল রইসু।

‘হুম। কিন্তু মোবাইলে ছবি তোলার বিষয়টা তো সত্য। পেরেশানি তো আপনিই তৈরি করেছেন!’ এবার উল্টো রইসুকে শাসাল তুষার।

মুহূর্তে মিইয়ে গেল লোকটা। মিনমিন করে কী যেন বলতে চাইল। কিন্তু অনেকটা জোর করেই ঘরে ঢুকে গেল তুষার। পিছু নিল মিলন। সোজা চলে গেল আসমার ঘরে। রাগ নয়, মেয়েটার চোখে কেমন যেন হতাশার ছাপ।

‘আসমা, শোনো।’

‘আমি জানি আপনি কী কইবেন।’

‘কী বলব?’

‘আমি ঠিক আছি। পিশাচিনী না। তয় আমি কারও ছবি আঁকতে চাই না।’

‘তুমি অবশ্যই আঁকবে। সবার ছবি আঁকবে।’

‘আমি কাউরে মারতে চাই না। চাচায় আমারে বলসে লোকটা বদ। চাচী আর আমারে মাইরা ফেলবে কইসে। এইজন্য আঁকসিলাম।’

‘আমি সেটা বলিনি। তুমি আঁকলে মানুষ মারা যাবে, এটা ডাহা মিথ্যে কথা। তুমি এসব বিশ্বাস করবে না। তুমি চমৎকার ছবি আঁকো। তোমার উচিত বেশি বেশি আঁকা।’

আসমাকে এবার আহত দেখাল। মনে হচ্ছে যেন তুষারের কথা সত্য হলেই সে খুশি হত।

তুষার বলল, ‘তা হলে আমাকে বলো, তুমি আমার ছবি এঁকেছ, আমি মারা যাচ্ছি না কেন? আমাকে তুমি পছন্দ করো, তাই?’

আসমা নীরব।

‘আচ্ছা, তোমার চাচা কি তোমাকে মাঝে মাঝেই ছবি আঁকায় নাকি?’ প্রশ্নটা নিজের কানে বেখাপ্পা শোনালেও না জিজ্ঞেস করে পারল না তুষার।

পেছনে ততক্ষণে রইসু এসে দাঁড়িয়েছে।

‘ভাইজান, আপনেরা যান। বহুত পেরেশানিতে আছি। আর না। আমরা ভিটা ছাইড়া ভাগব।’

‘কেন! আপনার হাতে তো ব্যাপক ক্ষমতা। কেউ কিছু বললে তার ছবি আঁকিয়ে নেবেন আসমাকে দিয়ে, হা-হা-হা! পালাবেন কেন?’

মিলন অনেকটা জোর করেই তুষারকে টেনে বের করল আসমার রুম থেকে। এরপর একটা ভ্যানে করে দু’জনে চলে এল বাড়িতে।

শীতের রাত। কুয়াশাও বেশ। এর মধ্যে কোথা থেকে যেন খই জোগাড় করেছে মিলন। গুড় দিয়ে ওটা চিবিয়ে চলেছে দু’জনে। তুষারের পোর্ট্রেট আঁকার চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। মিলনকে বেশ নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে। বলা যায় নিজের আগের রূপে ফিরে গেছে ও।

‘চল, দোস্ত, খেজুরের রস চুরি করি। এই অ্যাডভেঞ্চার তুই আর কখনও পাবি না।’

‘হুম। চুরি করব ভাবছি। তবে রস নয়। আরেকটা জিনিস।’

মিলন সতর্ক।

‘আসমার টেবিলের নিচে রাখা একটা বাক্সে একটা স্কেচ খাতা দেখেছি। আমরা যাব ওটা চুরি করতে।’

ছয়

শীতের রাতে গ্রামে আটটা বাজতেই লেপমুড়ি দেয় সবাই। তবে রিস্ক নিল না দুই বন্ধু। দশটা বাজতেই রাতের গ্রাম দেখার নাম করে চাদর মুড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। উত্তেজনার কারণে গায়ে লাগছে না হাড়কাঁপানো শীত। রইসুর বাড়িতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সবাই ঘুমিয়ে। মিলনের চালচলনে জেমস বণ্ডের ভাব। চিকন তার দিয়ে দরজার খিল খুলতে গিয়ে দু’বার শব্দও করেছে। তবে তাতে ভাঙেনি কারও ঘুম। ধরা পড়লে কী করবে, সেটাও ঠিক করে আসেনি তুষার। একটাই ভরসা: রইসুর টাকা-পয়সা বিশেষ নেই। তাই তুষার আর মিলনকে ছিঁচকে চোরও দাবি করতে পারবে না। এতসব আপাতত ভাবছে না দু’জন। খিল খুলতেই আলতো করে দরজায় ধাক্কা দিল। নিজেরা সেঁধিয়ে গিয়ে টেনে দিল দরজা। খিল লাগাল না। পাছে আবার যদি জলদি পালাতে হয়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমেই বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল রইসুর ঘরের। আসমা সামনের দিকে একটা ঘরে চৌকিতে একা ঘুমায়। রইসুর নাক ডাকার হালকা শব্দ পাচ্ছে ওরা। সেলফোনের টর্চের আলো ফেলল আসমার পড়ার টেবিলের নিচে। স্কেচের খাতাটা দেখতে পেল না। মিলন দাঁড়িয়ে আছে অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে। কেউ জেগে গেলে যেন তাকে ধাক্কা দিয়ে পালানো যায়। কিন্তু আপাতত সেই আশঙ্কা নেই মনে হচ্ছে।

তুষার খুঁজেই চলেছে।

মিলন তাকিয়ে আছে সদর দরজার দিকে। খসখস শব্দ শুনে কান খাড়া। তুষারের খেয়াল নেই। মিলন ইশারা করল। পাত্তা দিল না তুষার। ক্যাচ-ক্যাঁচ করে খুলে গেল সদর দরজা। সাহস উবে গেল মিলনের। তুষারকে ইশারা করায় সে-ও চুপ। টর্চ নিভিয়ে দু’জন আসমার চৌকি ঘেঁষা দেয়ালে একেবারে সিঁটিয়ে রইল। কেউ একজন ঢুকেছে। এবং সে-ও যে চুরি করতেই ঢুকেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু রইসুর ঘরে চুরি! মুহূর্তে মাথা খেলে গেল তুষারের। বুঝে ফেলল ঘটনা। মুখে কাপড় পেঁচানো লোকটা সতর্ক চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। চাঁদের আলোর প্রতিফলনে হাতের রামদাটা ক্ষণিকের জন্য চকচক করে উঠল।

ভয় প্রথমে কাবু করে। পরে মগজ তার নিজের মত করে বানিয়ে নেয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। দুই বন্ধুর মগজেই চালু হয়ে গেছে ডিফেন্স মেকানিজম।

ঘুমিয়ে থাকা আসমার দিকে এগিয়ে আসছে রামদা ধরা লোকটা।

স্ট্যাচু হয়ে আছে তুষার আর মিলন। সামান্য ভুলচুক হলে নিজেদেরও কোপ খাওয়ার আশঙ্কা। এদিকে কোনও শব্দ না হলেও নড়েচড়ে উঠল আসমা।

ঘুমের ঘোরে বিপদও টের পায় না তো মেয়েটা?

শুকিয়ে গেছে মিলনের মুখ। একটা কিছুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তুষার তাকিয়ে আছে আসমার পায়ের কাছে থাকা লেপটার দিকে।

দ্রুতই ঘটে গেল ঘটনাগুলো। লোকটা রামদা উঁচু করেছে কোপ দেয়ার জন্য। এমনসময় চোখ মেলে তাকাল আসমা। চিৎকার দিল না মেয়েটা।

তুষার এক ঝটকায় লেপটা তুলে ঝাঁপ দিল রামদা ধরা লোকটার ওপর। লেপ থাকায় ধারাল দা নিয়ে ভাবতে হলো না তাকে। তবে আলগোছে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ভ্যাবাচেকা খাওয়া লোকটা। পরের কাজটা করল মিলন। লাইটটা অন করে দিয়েই পেছন থেকে গলা আঁকড়ে ধরল লোকটার। আসমা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তুষার নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটার মুখে আনাড়ি হাতে ঘুষি বসাল। বিশেষ সুবিধা হয়নি। তাগড়া লোকটা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে দুদ্দাড় করে। একপর্যায়ে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে দিল মিলনকে। আসমা ততক্ষণে উঠে চৌকির অন্যপাশে চলে গেছে। মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিল একটা স্কুলব্যাগ। তুষার ক্ষণিকের জন্য আসমার দিকে তাকাতেই অঘটনটা ঘটল। তুষারের কপালের ডানপাশে দড়াম করে ঘুষি বাগাল লোকটা। মাথা দুলে উঠল তুষারের। কাজ করছে না মাথা। কপালে হাত রেখে চৌকিতে বসে পড়ল ও। লোকটা এদিক-ওদিক তাকিয়ে রামদাটা খুঁজছে। মিলন তার সর্বশক্তি দিয়ে আবারও পেছন থেকে ঝাপটে ধরল। তুষার চিৎকার দিয়ে রইসুর ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করল। কিন্তু গলা দিয়ে বেরোচ্ছে না শব্দ। আর ঘুম ভাঙলেও লাভ নেই। বাইরে থেকে সে নিজেই ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে। আসমার ওপর রাগ হলো খুব। সে-ও শব্দ করছে না। এরকম ভয়াবহ সময়ে হাতে খাতা আর পেনসিল নিয়ে করছেটা কী মেয়েটা!

’তুষার, ওঠ! শালারে মার!’

‘রইসুকে ডাক দে!’

‘আগে শালারে সাইজ কর্। পরে! নইলে পুলিশি ঝামেলা!’

আততায়ীকে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারবে না মিলন। তুষার উঠে গিয়ে আরেকটা ঘুষি পাকানোর চেষ্টা করল। তবে পারল না।

কানে আসছে আসমার পেনসিলের খসখস শব্দটা। হঠাৎ পুরো শরীর দুলে উঠল তার। বসে পড়ল মেঝেতে। শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি যেন। লোকটার মুখে ক্রূর হাসি। মিলন তার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। রামদাটা দেখতে পেয়েছে ওরা দু’জন। টেবিলের পায়ার সঙ্গে লেগে আছে। ছাড়া পেলে নিশ্চিত কাউকে আস্ত রাখবে না আততায়ী। পেরে উঠল না মিলন। এক ঝটকায় তাকে ছুঁড়ে ফেলল লোকটা। চোখের কোনায় তুষার সব দেখছে। সামনে এগোতে যাবে, অমনি মেঝেতে পিছলে দড়াম করে পড়ল লোকটা। থরথর করে কিছুক্ষণ কাঁপল বিশাল দেহটা। এরপর কোনও নড়চড় নেই। কসরত করে ফের উঠে দাঁড়াল দুই বন্ধু। নিচে ভেজা ভেজা কী যেন। রক্ত!

রামদাটার চোখা মাথা লোকটার চোখ এ-ফোঁড় ও- ফোঁড় করে ঢুকে গেছে!

চৌকির ওপাশে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে থাকা আসমা। ওর হাতের কাগজে চোখ পড়ল দু’জনের। আততায়ীর পোর্ট্রেট!

সাত

অনেকগুলো ফোনকল, বানানো গল্প আর শেষমেশ আসমার জবানবন্দি; এসবের কারণে এ যাত্রা বেঁচেই গেল তুষার ও মিলন। তাদের গল্পটাও বিশ্বাসযোগ্য। রইসুর কাছেই এসেছিল আসমার গল্প শুনতে। এসে দেখে দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে দেখে রামদা হাতে এক লোক আসমাকে মারতে যাচ্ছে। কিন্তু নিজেই চিৎপটাং হয়ে পড়ে যায় রামদার ওপর। ওরাই গিয়ে পরে রইসুর দরজা খুলে দেয় আর পুলিশকে খবর দেয়। এদিকে নিহত লোকটা ছিল তিন-চারটা খুনের মামলার পলাতক আসামী। পুলিশের খাতায় দুইয়ে-দুইয়ে চার। তবে ছাড় দেয়ার পাত্র নয় বকুলের বাবা। ক্ষমতার পুরো দাপট কাজে লাগানোর চেষ্টায় আছে। যথারীতি ঘটনাস্থলে এসেছে মাংকি টুপি পরে। তুষার আর মিলনকেও একহাত দেখে নেয়ার কথা বলেছে এক ফাঁকে।

আসলে ঝামেলা পাকিয়ে দিয়েছে আসমার আঁকা ছবিটা। এত কিছুর মধ্যে আততায়ীর পোর্ট্রেট আঁকল কখন? রইসুর উত্তর, ‘ছবি মরার পরেই এঁকেছে ও। চোখের সামনে যাকে দেখে, তাকে আঁকে। মাইয়াডার একটু মাথায় সমস্যা আছে, স্যর।’

পুলিশের ওসি আমুদে লোক। কুখ্যাত আসামীকে এভাবে ঘায়েল হতে দেখে ভেতরে ভেতরে তিনিও খুশি। আসমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তা, মামণি, আমার একখান ছবি আঁইকা দাও তো দেখি।’

তুষারের একবার ইচ্ছা হলো বলে, না থাক দরকার নেই। কিন্তু চুপ মেরে রইল। আততায়ীর মৃত্যুটা দুর্ঘটনাই। বাধা দিল বকুলের বাবাও। ‘খবরদার, আঁকবি না। আঁকলে তোরে…না মানে… ওসি সাব, ও যার ছবি আঁকে, সে মারা যায়। আপনে ভুলেও আঁকাইয়েন না। আর নাটের গুরু হইল ওই রইসু। সে এই মাইয়াডারে ব্যবহার করে। সে এই মাইয়ারে দিয়া অনেকরে মারসে। সে একটা খুনি।’

‘তাই নাকি! হো-হো-হো! আচ্ছা, আচ্ছা। কিন্তু গতরাতের খুনের চেষ্টার মোটিভ তো পাচ্ছি না। তা, চৌধুরী সাহেব, আপনার ছেলে না ক’দিন আগে মারা গেল? আপনি এখানে কেন? আপনার তো বাড়িতে থাকার কথা। যান, যান, রেস্ট নেন।’

‘শোন, আসমা! তুই বহুত মানুষরে মারছস! তুই আমার পোলার খুনি! আমি তোর এই চাচা-চাচীরে খতম কইরা দিমু!’

লোকটার কথাগুলোকে পাত্তা দিল না পুলিশ। ওসি ইশারা করতেই কয়েকজন কনস্টেবল বকুলের বাবাকে নিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দিল।

আপাতত বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পেল তুষার আর মিলন। রাতেই থানায় খবর দিয়েছিল তারা। এ কারণে পুলিশের সুনজরে আছে দু’জন। তবে থানা আর আদালতে ডাক পড়তে পারে, এমনটাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

যাওয়ার সময় আসমার সঙ্গে দেখা করতে চাইল তুষার। মিলনের বাধা ডিঙিয়ে সোজা চলে গেল ঘটনাস্থলে। রক্তের দাগ তখনও শুকায়নি। স্কেচ খাতা বুকে জড়িয়ে একপাশে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আসমা। তুষারকে দেখে মুখ তুলে তাকাল। এরপর তাকে অবাক করে স্কেচ খাতা বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘আফনে এটা লইয়া যান। আফনেরে দিলাম এটা। ছাপাইয়া দিয়েন পত্রিকায়।’

আসমার কথাগুলো বুকের মধ্যে খচ করে বিধলেও স্বাভাবিক থাকল তুষার। ‘আচ্ছা, আপাতত নিয়ে গেলাম। পরে আবার ফেরত দেব তোমাকে।’

মিলন হ্যাঁচকা টানে তুষারকে নিয়ে রীতিমত হনহন করে হাঁটা দিল।

রইসুও স্ত্রীকে ইশারা করল।

পুলিশের কাজ শেষ হলেই তারা চলে যাবে কোনও এক আত্মীয়ের বাড়ি।

.

বিকেল।

জমেছে বেশ কুয়াশা।

আসমার স্কেচ খাতার একটা করে পাতা ওল্টাচ্ছে তুষার, আর হড়বড় করে বর্ণনা করছে মিলন।

‘আসমার সঙ্গে পড়ত। অনেক আগের ঘটনা। মাইয়াটা পানিতে ডুইবা মরসে।’

তুষার পাতা ওল্টাচ্ছে। কোনওটা সামনা-সামনি আঁকা পোর্ট্রেট। কোনওটা আবার গ্রামের পরিবেশে।

‘এটা খুড়ুম মিয়া। আসল নাম জানি না। লোকটাও বদের হাড্ডি। ডাকাত দলে যোগ দিসিল। মরসে ডাকাতি করতে গিয়া। আর এইটা নিতুনের মা। ওর একটা রোগ হইসিল। সারা গায়ে পচন ধরছিল। আমি শুনছিলাম ও-ই নাকি আসমার কাছে গিয়া বলছিল, তার যেন একটা ছবি আঁইকা দেয়।’

‘উনি মারা গেলেন কী করে? পচন ধরেই?’

‘আরে, নাহ্। ছবি আঁকছে কি সাধে! মহিলা রাস্তা পার হইতেছিল, সোজা বাসের চাকার তলে। এক সেকেণ্ডে শেষ।’

‘হুম। ব্যতিক্রম তা হলে আমি। হা-হা-হা। ভাল কথা, সবাই কি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেছে? নাকি আমার হাতে এখনও মরার মত সময় আছে?’

মিলনের কঠিন চেহারা দেখে হাসি থামাল তুষার।

‘আমি আরেকটা পরীক্ষা নিতে চাই। ব্যবস্থা করে দে।’

‘কোনও কাম নাই। বহুত বড় বিপদ থেকে বাঁচছি। এখন তুই ভালয় ভালয় ঢাকা যা।’

‘উঁহুঁ। এর একটা বিহিত করতে হবে।’

‘কীসের বিহিত করবি! তুই বাঁইচা গেছস, এটাই বড় কথা। এখন এসব বাদ দে।’

‘ওর খাতাটা ফেরত দেব। এত সুন্দর সব পোর্ট্রেট। আমি এমনি এমনি নিয়ে যেতে পারি না।’

‘ফেরত দিয়া দে। আমারও তাই মনে হয়। এসব অলক্ষুণে জিনিসপত্র….

‘একমিনিট!’

তুষারের গলায় ভয় আর বিভ্রান্তির মিশেল।

উবু হয়ে দেখল মিলন। ঘাবড়ে গেল ভীষণ।

শেষ পৃষ্ঠায় নিজের একটা ছবি এঁকেছে আসমা!

আট

আসমাদের বাড়ির সামনে ভিড়। কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যেও গ্রামবাসীর ভিড়। সবাই কেমন যেন ভয়ে ভয়ে আছে। রইসুকে দেখা গেল না। এক কোনায় আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে দেখা গেল আসমার চাচীকে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল মিলন। জানল, আসমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কাউকে না বলে বের হয়ে গেছে। গতরাতের ঘটনার পর গ্রামবাসীদের যারা বিশ্বাস করেনি এতদিন, তারাও বলাবলি করছে, ‘এইবার না জানি কার ছবি আঁইকা ফালায়, গো! আল্লাহ গো, কী পিশাচিনীর কবলে পড়ল নিশিন্দাপুর!

তুষারের মাথা কাজ করছে না। স্কেচ খাতাটা নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। এটা দেখলেই একটা হই-চই কাণ্ড ঘটবে।

হুট করে খাতাটা কেড়ে নিল মিলন। তারপর এগিয়ে গেল আসমার চাচীর দিকে।

‘এই যে দেহেন, ভাবী।’

গ্রামবাসীও দেখল। রব উঠল, আসমা তা হলে মরে গেছে!

এবার আফসোসের কমতি নেই কারও গলায়।

‘আহারে! ফালাইল।’

মাইয়াটা। শেষতক নিজেরেই মাইরা

এমনসময় ছুটে এল রইসু। পায়ে কাদার ছোপ। নদীর দিকে গিয়েছিল সম্ভবত। শীতেও গায়ে চাদর নেই। এসেই চিৎকার জুড়ে দিল। ‘চান্দুয়ে দেখসে ওরে। নদীর ধারে যাইতে! মাইয়া আমার নদীতে ডুইবে গেল না তো!’

সবার সঙ্গে ছুট লাগাল তুষার ও মিলন। চান্দু নামের লোকটা নদীর যে প্রান্তে আসমাকে দেখেছে, সেখানেই শেল সবাই। কিন্তু খোঁজার সুযোগ নেই। দু’পাশে ধু-ধু চর। আর একদিকে পানি। অন্ধকারে পানিতে লাশ থাকলেও তা দেখার উপায় নেই। টর্চের আলোয় তুষারই খুঁজে পেল পায়ের ছাপ। গুটি গুটি গেছে পানির দিকে। বুক কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল তুষারের। একসময় ইস্তফা দিল খোঁজাখুঁজিতে। দুই বন্ধু ফিরে এল নিজেদের ঘরে।

নয়

ঢাকার ফ্ল্যাটে নিজের রুমে বসে আসমার স্কেচবুকটা বুকে রেখে চোখ বুজে আছে তুষার। গল্পটা লিখবে কি লিখবে না, ভাবছে।

শুরুটা করবে কী করে?

মেয়েটার মায়াবি দু’চোখ আর কোঁকড়া চুল দিয়ে?

ভাবতেই হুট করে কী যেন ধরা পড়ল মনের রেইডারে। কোথায় যেন একটা খটকা। সেই পুরনো খচ-খচে অনুভূতি। ড্রয়ার থেকে নিজের স্কেচটা বের করল তুষার। ভাল করে খুঁটিয়ে দেখল ওর পোর্ট্রেটটাকে। ডান চোখের নিচে কালো একটা তিল। বাম কানের লতিও নেই আসমার আঁকা ছবিতে। আয়নায় দেখল নিজেকে। কানের লতি ঠিকই আছে। ডান চোখের নিচে কোনও তিলও নেই তার। এবার দ্রুত আসমার স্কেচবুকটার শেষ পাতা ওল্টাল। নিজের ক্যামেরায় তোলা আসমার ছবিটা জুম করল কম্পিউটারের মনিটরে। খুঁটিয়ে দেখল স্কেচ আর ক্যামেরায় তোলা ছবি। ধীরে-ধীরে হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলের মাঝে এক রহস্য ঘেরা আনন্দের অনুভূতিতে ছেয়ে গেল তুষারের মন।

ক্যামেরায় তোলা ছবিতে আসমার ডান চোখের নিচে তিল দেখা যাচ্ছে।

স্কেচে নেই!

ধ্রুব নীল

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *