দুঃস্বপ্ন – অরুণ কুমার বিশ্বাস

দুঃস্বপ্ন

লেখাটা প্রায় শেষ করে এনেছি, আর মাত্র দুটো অধ্যায় বাকি। বিষয় মনস্তত্ত্ব, কাহিনীতে অস্পষ্টভাবে হলেও ‘প্যারানরমাল’ কিছু ব্যাপার আছে। সামনে ঈদ, সময়মত ম্যানুস্ক্রিপ্ট জমা দেবার জন্য প্রকাশক বেশ চাপে রেখেছেন। বয়স হচ্ছে, এখন আর আগের মত এক সিটিঙে দু’চার ফর্মা নামানো যায় না। মন ও মগজ দুটোরই যথেষ্ট অধঃপতন ঘটেছে, ও বস্তু আগের মতো ক্রিয়াশীল নয়। এখন অল্পতেই টায়ার্ড হয়ে পড়ি। সত্যি, বয়স কাউকে ক্ষমা করে না।

সন্ধে উতরেছে। ক্ষণিক অবকাশে কফির সঙ্গে টোস্ট নিয়ে বসেছি। কফির নেশা আমার অনেক দিনের। কফিতে পৌরুষের গন্ধ পাই। তাই ওটা ছাড়তে পারছি না। ডাক্তার অবশ্য বলেছেন, মাত্রা না ছাড়ালে চা বা কফিতে হার্টের তেমন ক্ষতি হয় না।

হঠাৎ সেলফোন বেজে উঠল।

লিখেটিখে সামান্য পরিচিতি হওয়ায় ইদানীং লোকে বেশ জ্বালায়। নতুন লেখকরা তালিম নেবার অজুহাতে যেমন আসে, তেমনি অনেকে আসে স্রেফ গুল ঝাড়তে বা আড্ডা মারতে। ‘প্যারানরমাল’ লেখক হিসেবে আমার বেশ খ্যাতি। তাই কেউ কেউ স্রেফ ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’ হয়ে ছুটে আসে আমার কাছে। এমনই কারও ফোন এল সন্ধের মুখে।

ফোনের এপারে আমি কি না নিশ্চিত হয়ে ওপার থেকে বলল, ‘স্যর, আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি? খুব জরুরি।’

যে বা যিনি আমাকে স্মরণ করেছেন, তিনি নারী, বয়স সম্ভবত পঁয়ত্রিশের ওধারে নয়, সুন্দর কি অসুন্দর সেটা অবশ্য স্বচক্ষে না দেখে আন্দাজ করা কঠিন। তবে বেশ গুছিয়ে কথা বলে সে। প্যারানরমালের পাশাপাশি গোয়েন্দা ধাঁচের লেখাও লিখি। সেই সুবাদে অজানা বিষয়ে বা ব্যক্তি সম্পর্কে প্রাথমিক অনুমান করার বিদ্যেটা খানিক রপ্ত হয়েছে আমার। নেপথ্যে বলি, ইদানীং লেখকরা খানিক জাতে উঠেছেন। লোকে এঁদেরকে সম্মানসূচক ‘স্যর’ সম্বোধন করে।

‘কেন, বলুন তো?’ কফির মগে আয়েশি ঢঙে ঠোঁট ছুঁইয়ে অম্ল-মধুর স্বরে জানতে চাইলাম।

কেমন ফ্যাসফেঁসে গলায় মেয়েটি বলল, ‘শুনলে বুঝবেন, ব্যাপারটা সত্যি সিরিয়াস। আপনি দয়া করে একটু সময় দিলে হয়তো বেঁচে যাবে একটি লোকের জীবন।’ ওর নাম রিয়া, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে পড়ছে। রিয়া আরও জানাল, গত ন’ রাত সে ঘুমোতে পারছে না। ভয়ে, কষ্টে, আতঙ্কে।

রিয়ার কথা শুনে মনটা খানিকটা নরম হলো আমার।

আসুক না, কথাটথা বলে ওর মন যদি খানিক নির্ভার হয়, তো ক্ষতি কী!

তা ছাড়া, রিয়া আরও বলল, সে নাকি আমার লেখার খুব ভক্ত। রহস্যপত্রিকায় নিয়মিত আমার মনস্তত্ত্ব বিষয়ক উপন্যাসিকা পড়ে। শুনে বেশ ভাল লাগল। পাঠ্যসূচির বাইরে সাহিত্যটাহিত্য পড়ার অভ্যেস তো এখন বলতে গেলে উঠেই গেছে।

‘কখন আসতে চাও? আমি কিন্তু বিশেষ রাত জাগতে পারি না,’ প্রশ্রয়ের সুরে বললাম।

রিয়া বলল, এক্ষুণি রওনা দিচ্ছে সে সাভার থেকে। আসতে যতক্ষণ লাগে। আমি হিসেব করে দেখলাম, রাত ন’টা, সাড়ে ন’টার কম বাজবে না। বললাম, ‘কাল এলে হয় না! আজ একটু ব্যস্ত। লেখাটা শেষ হয়নি। তা ছাড়া, একটা মেয়ের পক্ষে এত রাতে আসাটা নিরাপদ নয়।’

আমার কথা শুনে কষ্ট পেল রিয়া। আবেগমথিত সুরে বলল, ‘লেখক হয়ে আপনি জেণ্ডার ডিসক্রিমিনেশনে বিশ্বাস করেন! আমি কিন্তু আপনাকে আরও অনেক উচ্চতায় দেখি।’

বোকা মেয়ে! আকাশের দিকে মুখ করে চলে! ওদের কী দোষ, বয়সটাই এমন! মনে মনে হাসি পেল। মুখে বললাম, ‘আমি কী ভাবলাম তাতে কিচ্ছু এসে যায় না, রিয়া। তুমি নিশ্চয়ই আমাকে ডিসেন্ট করবে না, আমরা বড় বড় সব সার্টিফিকেট অর্জন করলেও আদতে শিক্ষিত হচ্ছি না। মেয়েদেরকে আমরা এখনও প্রাপ্য সম্মান দিতে শিখিনি। আমাদের দেশে ওরা এখনও পণ্য। স্রেফ বিজ্ঞাপন সামগ্রী বা ওপরে ওঠার মই।’

রিয়া জেদি গলায় বলল, ‘আমি আসছি। এক্ষুণি। ঠিকানাটা একটু বলুন, প্লিজ। ঢুকতে দিলে দেবেন, নইলে ফিরে যাব। মাঝরাত হলেও আটকাবে না।’

এরপর আর কথা চলে না। আফটার অল, শি’য মাই ভ্যালুড রিডার! একজন লেখকের কাছে এর মূল্য অপরিসীম।

পরে ভীষণ আপসোস হলো। বোকামোর জন্য নিজেই নিজেকে ভর্ৎসনা করলাম। এতক্ষণে খেয়াল হলো, বাসায় আমি একা। স্ত্রী গেছে সন্তানদের নিয়ে মামাবাসায় গিয়ে দুধ-দই সাঁটাতে। ছুটা বুয়া রান্না শেষ করে চলে গেছে অনেকক্ষণ। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে এক যুবতী মেয়েকে বাসায় ডাকার পেছনে আর যাই হোক, যুক্তিগ্রাহ্য কোনও কারণ থাকতে পারে না। তা ছাড়া, সময়টা যখন রাত।

আমি ধন্ধে আছি। কারও মনের ভার লাঘব করতে গিয়ে নিজের ঘর আবার না ভাঙে! মনে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। বলতে নেই, এরপর আর লেখা চলে না। কারণ লেখালেখিটা করপোরেশনের পানির নল নয়, শুধু পড়তেই থাকবে। ইদানীং অবশ্য কেউ কেউ ফরমায়েশি লেখা লেখেন, যার আগামাথা কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। অর্ডারি মাল কি না! মুফতে জাস্ট দুটো পয়সা পাওয়া যায়। অথচ লেখকদের লোভী হলে চলে না।

আমি অপেক্ষমাণ। রিয়া আসবে। বুকে চিনচিনে অপরাধবোধ প্রমাণ করে আমি লোকটা তত স্বচ্ছ নই। মনে গ্লানিবোধ আছে। পাপবোধও।

রিয়া এল বেশ খানিকটা দেরি করেই। রাস্তায় হেভি জ্যাম, এ কথা টপ্পাগানের ধুয়োর মত বারবার না বললেও চলে।

কলিংবেল চাপার শব্দে আগন্তুকের অস্থিরতা স্পষ্ট।

দরজা খোলা মাত্র ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকল রিয়া। অবিন্যস্ত কেশদাম, চোখে-মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পরিষ্কার।

‘কফি চলবে?’

‘আপত্তি নেই। না হলেও ক্ষতি নেই। আমি নাশ্তা করেই এসেছি।’ রিনরিনে গলায় বলল মেয়েটা।

রিয়া সুন্দরী, হাল আমলের চুনকাম ছাড়াও।

আমি শুরুতে খানিক চাতুর্যের পরিচয় দিলাম। সেটা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের প্রয়াস। রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘বাসায় স্রেফ আমরা দু’জন। তবে এমন মনে করার কোনও কারণ নেই, তুমি আসবে, তাই বাসা খালি! আমার বয়স হয়েছে, আমাকে তুমি ভরসা করতে পারো। বার্ধক্যের ভীমরতি এখনও চেপে বসেনি।’

রিয়া লজ্জা পেল।

আমি সেটুকু উপভোগ করলাম। যদিও মনে করি না যে লজ্জা কেবল নারীরই ভূষণ। ওটা সবার থাকা উচিত। লজ্জা পাওয়া মানে বিবেকবোধ এখনও পুরোপুরি উবে যায়নি।

রিয়া আমার কথা শুনে ক্লিষ্ট হাসল।

নিজ হাতে ওকে কফি করে দিলাম। সময় দিলাম, যাতে আরেকটু সুস্থির হয়ে বসতে পারে। একটু পর বললাম, ‘নাও, এবার শুরু করো। তোমার জরুরি কথাটা কী, সেটা শুনি। ইনফ্যাক্ট, লেখার পাট চুকিয়ে তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম।’

ওর পরনে জলপাই রঙ সালোয়ার, পায়ে হাওয়াই চপ্পল। তার মানে, একদম ঘরোয়া পোশাকেই চলে এসেছে। বেশ বদলের সময় পায়নি।

শুরুতেই ভয়ানক এক কথা দুম করে বলল রিয়া, ‘বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, তবে আমার কারণে মৃত্যু ঘটেছে আটজন মানুষের। এরা সবাই আমার পরিচিত। দু’একজন নিকটাত্মীয়ও।’

‘মানে? তোমার কারণে মারা গেছে! কীভাবে! তোমার মত মেয়ে কারও ক্ষতির কারণ হতে পারে?’ আমি বিস্মিত।

‘আপনি আমাকে কতটুকু চেনেন, স্যর? আমি একটা অপয়া!’

ব্যস, হয়ে গেল। মাথায় রক্ত উঠে গেল। কুসংস্কার আমার ভারি অপছন্দ। এখনও কেউ পয়া-অপয়ায় বিশ্বাস করে, তা মেনে নিতে আপত্তি আছে। কো-ইনসিডেন্স বা কাকতাল হতে পারে। তাই বলে কেউ কারও জন্য মারা যায়, এ কথা মেনে নেয়া কঠিন।

আমার কৌতূহল মেটাতে কথার ঝাঁপি মেলে ধরল রিয়া। একে একে বলে গেল সবগুলো ঘটনা।

‘১৩ জুন, ২০১০। মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম। আমার চিৎকার শুনে আব্বু-আম্মু, বড় আপু, সবাই ছুটে এল। ওরা জানতে চাইল কী হয়েছে। আমি ঠিক বুঝলাম না। তবে আবছা মনে পড়ল আমি কোথাও বন্দি। বুকে বড্ড চাপ। আব্বু তক্ষুণি ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছেন। আপু বললেন, অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করতে। আমি ওদের বিরত করলাম। তখনও হাপরের মত বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করছে। আমি কুলকুল করে ঘামছি। বেশ বুঝতে পারছি, জ্ঞান হারাচ্ছি। কান্না জুড়ে দেন আম্মু। আব্বু হতভম্ব! আপু চোখেমুখে পানি ছিটাতেই জ্ঞান ফেরে আমার। তারপর একটু একটু করে সিনেমার রিলের মত চোখের পাতে ভেসে উঠল পুরো ঘটনা।’

‘স্বপ্নে কী দেখলে?’ প্রচণ্ড কৌতূহল বোধ করছি আমি।

এখনও পষ্ট মনে আছে, দেখলাম কোনও এক হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছি। চারপাশে ছোটাছুটি করছে ডাক্তার ও নার্স। নার্সের হাতে ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ, গজ-তুলোর উৎকট গন্ধ। ওরা সব এমন কাণ্ড করছে, যেন তক্ষুণি মারা যাচ্ছি আমি।’

‘তারপর?’

‘আমি আসলে মরিনি। পরের দৃশ্য আরও ভয়ঙ্কর। পথ হারিয়ে ফেলেছি। কেউ যেন তাড়া করছে আমাকে। খুঁজে পেলাম না হাসপাতাল থেকে বেরোবার পথ। ছোট্ট করিডোরের মত প্যাসেজ পেরিয়ে যেখানে গেলাম, সেটা একটা মর্গ। অন্ধকার কুঠরিতে সারে সারে শুয়ে আছে লাশ। সব লাশের চেহারা বীভৎস। অথচ যদ্দূর জানি, মুর্দাখানায় লাশেরা সাদা কাপড়ে ঢাকা থাকে, কারও মুখ দেখতে পাবার কথা নয়। দেখলাম, মোট দশখানা খাট মর্গে। একটা ফাঁকা। কে বা কারা যেন জোর করে আমাকে সেখানে শুইয়ে দিতে চাইল।’

‘সত্যি ভয়ঙ্কর! অবিশ্বাস্য!’ অস্ফুটে বললাম আমি। এমন অদ্ভুতুড়ে ঘটনা জীবনে শুনিনি।

‘এখানেই শেষ নয়, আরও আছে, স্যর। শুনবেন?’

‘শুনব, তবে তার আগে তোমাকে ওই ‘স্যর’ শব্দটি ভুলতে হবে। আমি তো তোমাকে ধরে রাখিনি, রিয়া, যে, বারবার ছাড়তে বলছ!’ হাসার চেষ্টা করলাম। আসলে ওর দুঃস্বপ্নের কথা শুনে বিপন্ন বোধ করছি। হাসি-কান্নার মত ভয়ের ব্যাপারটাও বোধ হয় সংক্রামক।

‘ওকে, স্যর, তাই হবে।’

‘আবার স্যর! দেখো, রিয়া, আমাকে তুমি বন্ধু ভাবতে পারো। অসম বয়সে কি বন্ধুত্ব হয় না! বন্ধু ভাবলে মনের কথা খুলে বলাটা আরও সহজ হবে।’

‘ওকে, তাই হবে।’ রিয়া আবার শুরু করে। ‘আমার স্বপ্নে খুন, মৃত্যু, রক্তারক্তি নিয়মিত ব্যাপার। আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, প্রতিটা রাত যেন শুরু হয় দোজখের কষ্ট নিয়ে। মানুষ ঘুম না পেলে সিডেটিভ বা ট্রাঙ্কুলাইযার খেয়ে ঘুমায়। আর আমি চাই এমন কোনও ওষুধ, যা খেলে জীবনে আর ঘুম আসবে না। আমি ঘুমোতে চাই না। ঘুম আমাকে ক্রমশ খুনির পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।’

‘বুঝলাম না। তুমি স্বপ্নে কী দেখলে, তাতে দুনিয়ায় কার কী এসে যায়!’

‘এসে যায়, স্যর। আমার প্রতিটা দুঃস্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক-একটা মর্মন্তুদ ঘটনা। আমি যে রাতে হাসপাতাল আর মর্গের স্বপ্ন দেখলাম, এর ঠিক পরের দিন রোড অ্যাকসিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি হন আমার সবচে’ কাছের বন্ধুর বাবা হাসমত আঙ্কেল। আপনি হয়তো বলবেন, এর সঙ্গে আমার স্বপ্নের কী যোগসূত্র!’

‘তুমি আমার মনের কথাই বললে, রিয়া!’ সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। ‘সত্যিই তো! এমন নয় যে তুমি দুঃস্বপ্ন না দেখলে হাসমত সাহেব অ্যাকসিডেণ্ট করতেন না!’

‘এর ঠিক আগের দিন হাসমত আঙ্কেলকে নিয়ে আমাদের বাসায় বেড়াতে এল বন্ধু রুবি। সবচে’ ভয়ঙ্কর ব্যাপার কী জানেন, স্বপ্নের সেই মর্গে যাদের চেহারা দেখেছি, তাদের একজনের সঙ্গে হাসমত আঙ্কেলের চেহারার দারুণ মিল।’

‘কী রকম?’

‘হাসমত আঙ্কেলের বাঁ চোখের নিচে আছে কালচে মত আঁচিল। আকারে অনেকটা পেঁপের বিচির মত। আঙ্কেলের কপালটা একটু উঁচু, চোখদুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার মত স্ফীত। ঠিক এ চেহারার একজন লাশ হয়ে শুয়ে ছিল আমার স্বপ্নের মুর্দাখানায়।’

‘বলো কী! এ-ও কি সম্ভব?’

‘এরপরও আপনি বলবেন আমার স্বপ্নের কোনও মাজেজা নেই?’

মুখে কিছু বললাম না। সন্ত্রস্ত বোধ করলাম। এমনভাবে কথাগুলো বলছে রিয়া, বিশ্বাস না করে উপায় নেই। ‘তারপর বলো, হাসমত সাহেবের কী হলো? উনি দ্রুত সেরে উঠে বাসায় ফিরলেন?’ আমার কৌতূহল ক্রমশ সীমা ছাড়াচ্ছে।

‘নো, স্যর, তা হয়নি। চিকিৎসকের ভুলে হোক বা ওষুধে ভেজালের কারণে, হাসমত আঙ্কেলের পায়ে শুরু হলো পচন। সারা শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল ইনফেকশন। ঠিক পনেরো দিনের মাথায় তিনি মারা যান।’

‘সো স্যাড!’ পাঞ্জাবির খুঁটে চোখ মুছলাম। লোক দেখানো নয়, লেখক হিসেবে আমার সমবেদনা অন্য যে কারও চেয়ে বেশি। জানি, এই অনিশ্চিত দুনিয়ায় গর্ব বা অহঙ্কার করার কিছু নেই। আমরা স্রষ্টার হাতে পুতুল মাত্র।

‘আরেকটু কফি খাবে, রিয়া? গলাটা কেমন শুকনো লাগছে!’

‘না, এর পরের ঘটনাটা শুনুন, আবারও শুরু করল রিয়া। এত সুন্দর গুছিয়ে বলে, চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই উঁচু মানের লেখক হতে পারবে। নিখুঁত ওর বর্ণনা, শব্দচয়নেও লালিত্য আছে।

‘শীতের ছুটিতে কক্সবাজার বেড়াতে গেছি। সঙ্গে বন্ধুরা, কয়েকজন বন্ধুর অভিভাবকও আছেন। মায়েরা ওদের একা ছাড়তে চাননি। খুব শান্তশিষ্ট (!) মেয়ে কি না! তারিখটা…’ রিয়া মনে করে বলল, ‘ডিসেম্বরের ৭, ২০১১। বন্ধুরা সবাই মিলে বেশ হৈ-হুল্লোড়, হাসি-ঠাট্টা চলছে। কলাতলি চ্যানেলে হোটেল ঝাউবনে টাটকা তাজা রূপচাঁদা আর লইট্টা ভাজা খাচ্ছি। কথা ছিল কক্সবাজারে দু’দিন কাটিয়ে আমরা যাব টেকনাফ। তারপর দ্বীপসুন্দরী সেন্ট মার্টিন। কিন্তু আমার আর যাওয়া হলো না। মাঝপথে ফিরতে হলো।’

‘কেন, আবার কোনও বিপদ?’

রিয়া স্কুলগামী মেয়েদের মত ওপরে-নিচে মাথা দোলাল। ‘সেদিন বিকেল থেকেই মনটা ভীষণ কু গাইছিল। বুঝতে পারলাম কিছু একটা ঘটবে। সতর্ক হলাম। বন্ধুদের বললাম, আমার বোধ হয় যাওয়া হবে না। তোরা ভাল করে ছবি তুলে আনিস, পরে দেখব। বন্ধুরা খেপে লাল। আমি নাকি সব কিছুতেই বাগড়া দিই। আমি একটা অপয়া! সব অশুভ ঘটনার বার্তাবাহক। মনে খুব কষ্ট পেলাম। অথচ ওরা মিছে কিছু বলেনি। বিকেল থেকেই প্রচণ্ড মাথাব্যথা, দুঃস্বপ্ন পর্বের আগের স্টেজ। চোখে ঝাপসা দেখলাম আমি। ভাবতে চেষ্টা করলাম, পরিচিত কারও অসুখ করেছে কি না, বা কেউ হাসপাতালে ভর্তি আছে কি না। প্রচণ্ড ভয় পেলাম, না জানি কাকে এবার হারাতে হবে!’

রিয়ার কথা শুনে ভীষণ ঘামতে শুরু করেছি আমিও। সম্মোহকের মত কথা দিয়ে আমাকে যেন বেঁধে ফেলেছে ও। অবাস্তব, অযৌক্তিক, অথচ সত্যি। রিয়া যা বলার, বলছে সত্যি।

‘সে রাতে আর কিছু খাইনি, মানে খেতে পারিনি। মাথাব্যথার তীব্রতা এত বাড়ল যে বমি পেয়ে গেল। দুটো অ্যাসপিরিন খেয়ে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়লাম। তবে চোখ বন্ধ করিনি, পাছে ঘুম এসে যায়, স্বপ্ন দেখি!’

রিয়ার কণ্ঠে কান্না।

ওর তখনকার অসহায়ত্ব বুঝতে পারছি। অপরের কান্না নিজের চোখে ধরতে না পারলে কীসের লেখক আমি!

রিয়া বলল, ‘শত চেষ্টা করেও ঘুম আটকাতে পারিনি। তন্দ্রা মানেই দুঃস্বপ্ন। এবারের স্বপ্ন একটু অন্যরকম। দেখলাম, আমি ভাসছি সাগরে। ভেলা নাকি কোনও সাম্পান টাইপ নৌকো, ঠিক মনে নেই। ঢেউয়ের দোলায় ভীষণ দুলছি। কোথাও কেউ নেই, আমি একা। এমনকী দাঁড় বা বৈঠাও নেই যে কূলে ফিরব। কাঁদছি ভয়ে, সহসাই শাঁ-শাঁ শব্দে এল ঝোড়ো বৃষ্টি। একাকার হয়ে গেল আমার চোখের জল-বৃষ্টি আর সমুদ্রের লোনা পানিতে। বাতাসে উল্টে গেল ভেলা, হাবুডুবু খেতে লাগলাম আমি।’

‘তারপর? তোমার কী হলো, রিয়া!’ ওর বয়ান শুনে রুদ্ধশ্বাস হয়ে গেছি।

‘রাত তখন বারোটার কম নয়। ভাসছি সাগরে। ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে ভেঙে গেল ঘুম।

এটুকু বলে রিয়া একটু থামল। পরক্ষণে বলল, ‘না-না, একটু বাকি রয়ে গেছে। সাগরে যখন হাবুডুবু খাচ্ছি, হঠাৎ দেখি দুটো লাশ ভেসে যাচ্ছে আমার পাশ দিয়ে। সাদা কাফনে মোড়া, সম্ভবত বাচ্চার। কফিনের আকার আড়াই ফুটের বেশি নয়। বিশ্বাস করবেন না, স্যর, মুহূর্তে বুঝলাম কারও খারাপ কিছু হয়েছে। সবার আগে মনে এল সুমন আর ছোটনের কথা। ওরা আমার খালাত বোন ঈষিকার দুই ছেলে। গাঁয়ে থাকে। আমি চটজলদি ফোন করলাম ওদের বাসায়। জানতে চাইলাম, ভাল আছে তো সুমন-ছোটন? গাঁয়ে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। তাই মোবাইলে চার্জ থাকে না। বাসা থেকে কিছু জানাতে পারল না। বোন ঈষিকার ফোন সুইড্ অফ। তাতে সন্দেহ বদ্ধমূল হলো আমার।’

‘তারপর? বলো, রিয়া, আমি পুরোটা শুনতে চাই।’

‘আর কী! পরদিন সকালেই কক্সবাজার থেকে ফিরলাম ঢাকায়। বাসায় গিয়ে দেখি সবার মুখ থমথমে। ওরা আমাকে দোষ দিল। তত দিনে সবাই জেনে গেছে আমার স্বপ্নতত্ত্ব। মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘ওরে, সর্বনাশী, সুমন-ছোটন আর নেই রে! তুই স্বপ্নে কী দেখেছিস বল্! ওরা দু’ভাই মাছ ধরতে গিয়ে ডুবে মরেছে বিলের পানিতে।’’ দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকল রিয়া। ওর কষ্টের যেন অবধি নেই। ওর মা-ও দোষারোপ করছেন। রিয়া অপয়া!

‘হুম!’ এবার কী বলা উচিত বুঝলাম না। তা-ও জানতে চাইলাম, ‘তোমার বোনের ছেলেদের বয়স কত? উচ্চতা?’

‘আট আর দশ বছর। উচ্চতা আড়াই ফুটের মত, যেমনটা উত্তাল সাগরের সেই ভেসে যাওয়া সাদা কাফনে দেখেছি আমি।’

রিয়া কাঁদতে থাকল।

টের পেলাম, ওর বুকটা ভেঙে যাচ্ছে কষ্টে নুড়ি-পাথরের মত। খুব কাছের লোকেরা রিয়াকে ‘অপয়া’ মনে করে ওর স্বপ্নের জন্য। আমার ভেতরে শীতটা আরও জেঁকে বসল। অথচ এখন মিডসামার! গরমে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ!

রিয়া ফোঁৎ-ফোঁৎ করে কাঁদছে। কান্নার বেগ কমলেও আবেগে কমতি নেই।

ওর কষ্ট আমার বুকেও বাজল। বেচারি রিয়া, ওর কী দোষ! আমি কফি বানালাম। দার্শনিকের মত নিরাসক্ত গলায় বললাম, ‘ছি, রিয়া, কাঁদে না। এই নাও কফি। খেয়ে দেখো ঠিক আছে কি না চিনি। আর কিছু? ওহ্! ডিনার খাবে আমার সঙ্গে? যা আছে, বেশ হয়ে যাবে দু’জনের। কোরালের কোপ্তা, বেগুনভাজা আর ঝো-ঝা-চি।’

‘ঝো-ঝা-চি?’ বিস্ময়ভরা চোখে রিয়া তাকাল।

যাক, থেমেছে বেচারির কান্না।

‘ঝো-ঝা-চিটা আমার অবিষ্কার। লণ্ডনে পড়ার সময় এক হাতে সব করতে হত। ওখানে সবচে’ সস্তায় পাওয়া যায় গমের রুটি, মুরগির ডিম আর ফার্ম-কক্। ঝো-ঝা-চি মানে ঝোল-ঝাল চিকেন। একবারে মশলা দিয়ে কষিয়ে বসিয়ে দিই সসপ্যানে। ব্যস, দশ মিনিটে রান্না শেষ। গরম ভাতের সঙ্গে ঝাঁঝাল চিকেন। আর কী চাই!’

‘আপনি রান্নাও জানেন?’ রিয়ার বিস্ময়ের অবধি নেই।

‘কেন, যে চুল বাঁধে, সে কি রাঁধে না! লেখক বলে কিন্তু কুঁড়ে নই। আই’ম আ সেল্‌ফ-মেড ম্যান, বুঝলে? তুমি বরং এক কাজ করো, মুরগি আর কোরালটা মাইক্রোওভেনে গরম করে আনো। দু’জনে বসে খাই।’

আমার একদম খেয়াল ছিল না, রাত প্রায় একটা। রিয়া ফিরবে কী করে! বয়স যত হোক, বদনামের সময় এখনও পেরোয়নি। লোকে শুনলে বলবে কী! আমি শিহরিত হলাম, শঙ্কিতও। রিয়া অবশ্য আমার কোনও কথাই কানে তুলল না। কফিতে একবার মাত্র চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করল তার তৃতীয় ঘটনা।

আরও একবার আতঙ্কিত হবার জন্য মনটাকে প্রস্তুত করলাম।

‘এই তো সেদিন। তারিখটা ১৫ এপ্রিল, ২০১২। আমার সেকেণ্ড ইয়ার ফাইনাল এক্যাম চলছে। পড়াশুনোর খুব চাপ। রাত জেগে পড়ছি। অনেক দিন দুঃস্বপ্নের ব্যাপারটা ছিল না। ভাবলাম, স্রেফ কাকতালীয়। ওটা কেটে গেছে। কিন্তু জানি, আমি অভিশপ্ত।’ এটুকু বলেই কান্নার পাঁয়তারা শুরু করল রিয়া।

আমি ওর কাঁধে আলতো হাত রাখলাম বড় ভাইয়ের মত। ‘তোমাকে আর ওসব বলতে হবে না। চলো, খেয়ে নিই।’

রিয়া নাক টানল। স্কার্ফে চোখ মুছে নিজেকে সামাল দিল। তারপর আবার শুরু করল বলতে: ‘আমাদের ইউনিভার্সিটির ভেতরটা একটু জঙ্গুলে, আপনি জানেন। বেশ তপোবনের মত মনে হয়! সেবার মাঝরাতেরও পরে শুরু হলো আমার মাথাব্যথা। তারপর বিবমিষা। ব্যথার তীব্রতা এত বেশি, একবার মনে হলো কিছু একটা খেয়ে মরে যাই। আর সহ্য হয় না।’

বাংলা ভাষাকে ভালবাসি, তাই ‘বিবমিষা’ শব্দের মানে জানা ছিল। বমির ভাব। মেয়েটা সত্যি বাংলা জানে। ওর লেখক হওয়া উচিত। ইদানীং অশিক্ষিত লেখকের প্রাদুর্ভাব বেশ দেখছি। বইমেলায় ফি-বছর চার হাজার বই বেরোয়, যার অধিকাংশ পাঠের অযোগ্য। ভাব ও ভাষা দুটোরই আকাল। প্রকাশকেরও যেন দায় নেই। লেখকের টাকায় ভুলে ভরা বইয়ের এক শ’ কপি ছেপেই তিনি প্রকাশক। পত্রিকায় সচিত্র সাক্ষাৎকার ছাপে! লেখকের পকেটের টাকা নেন, প্রকাশকের তাই লেখার গুণগত মান দেখা বা বোঝার সুযোগ থাকে না।

জটিল ভাবনা থেকে রিয়ার কথায় মাটিতে ল্যাণ্ড করলাম। আশ্বাসের সুরে বললাম, ‘ও কথা বলতে নেই, রিয়া। মানব জীবন খুব প্রার্থিত। বড় মূল্যবান। এ নিয়ে ছেলেখেলা করতে নেই।’

বুঝমানের মত মাথা নেড়ে আবার শুরু করল রিয়া: ‘ব্যথা সইতে না পেরে অ্যাসপিরিন খেলাম। আমার রুমমেট এশা দুঃস্বপ্নের কথা জানে না। জানলে হয়তো তক্ষুণি ছুটে বেরিয়ে যেত, বা প্রোভোস্ট ম্যাডামকে বলে আমাকে বের করে দিত রুম থেকে। এশা মেয়েটা বড় ভাল। দিনাজপুর বাড়ি, আমার জন্য প্রয়োজনে জীবন দেবে। এশা এত রাতে হলের ফার্মেসিতে গিয়ে অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট নিয়ে এল। ও জানে, কাল আমার পরীক্ষা। বলল, ‘আপু, তুমি বরং এবার একটু ঘুমাতে চেষ্টা করো। কাল সকালে বাকিটুকু পড়ে একযাম হলে যেয়ো।’ ওর কথা শুনে বাধ্য মেয়ের মত শুতে যাই। এশা আমার টেবল-ল্যাম্প অফ করে মশারি খাটিয়ে দেয়। আমার দু’চোখে তখন কান্নার ঢল। আমি এশার কথা ভাবছিলাম। এই ‘অপয়া’ মেয়েটার কারণে এশার না জানি কোন্ ক্ষতি হয়! রুমের ভেতর আবছা আঁধারে দেখলাম এশাকে। ওর মুখটা যেন কেউ সুপার গ্লু দিয়ে সেঁটে দিয়েছে আমার চোখে। আমি কেঁপে উঠলাম ভয়ে। অ্যাসপিরিনের প্রভাবে ব্যথাটা কমে গিয়ে কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। এই প্রথম বুঝলাম, এবার বিপদ এশার। নিশ্চিত ওকেই স্বপ্নে দেখব। মৌসুমী ভৌমিকের সেই ‘স্বপ্ন দেখব বলে’ গানটা মনে এল। দুটোই স্বপ্ন, অথচ কত তফাৎ! সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। শুধু এটুকু মনে আছে, আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এশা, তাতে বড্ড আরাম হচ্ছে আমার। হারিয়ে যাচ্ছি ঘুমের অতলে। বিড়বিড় করে বললাম, এশা মেয়েটা সত্যি ভাল!’

‘তারপর, রিয়া? কী ঘটল?’ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে জানতে চাইলাম। আমাকে যেন টানছে রিয়ার কথা। আমি অসহায়! ওর পুরো গল্প না শুনে নিস্তার নেই!

‘স্বপ্নে শুধু রক্ত, রক্ত আর রক্ত। তাজা চটচটে রক্তের ভেতর হামাগুড়ি দিই আমি। আশ্চর্য! এবারে আমার ভূমিকা টোকাইয়ের। আমার কাঁধে প্লাস্টিকের থলে। পানি ও কোমলপানীয়ের বোতল খুঁজে খুঁজে থলে ভরি আমি। সহসাই এক আবাসিক এলাকা সংলগ্ন সুয়েরেজ লাইনের ধারে দেখলাম চটের একটা থলে। নিশ্চয়ই ভেতরে দামি কিছু আছে। ত্রস্ত হাতে থলের মুখ খুলে দেখি…’ থেমে গেল মেয়েটা।

‘কী দেখলে, রিয়া!’ আমার যেন তর সইল না। স্পেলবাউণ্ড। নির্নিমেষ চেয়ে আছি রিয়ার দিকে

‘বিশ্বাস করুন, করুন, স্যর, থলের ভিতর শুধুই রক্ত। রক্তভেজা লাশ।’

‘কার লাশ! চিনতে পারলে?’

‘পেরেছি, স্যর। পেরেছি। আমার সবচে’ প্রিয় একজন মানুষ! একটু আগেও যে আমার চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দিল!’ আবার কাঁদতে লাগল রিয়া।

‘কে, তোমার রুমমেট এশা?’

‘ঠিকই ধরেছেন। বস্তার ভেতর রক্তস্নাত একটি মেয়ের লাশ। অনেক চুল। তাকিয়ে দেখি এশা। কেউ ঘাড় মটকে রক্ত খেয়েছে ওর। ঘোলা চোখে যেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে এশা। কী করুণ সে চাহনি! কী নিদারুণ!’

শ্বাস বন্ধ করে শুনছি। বুকের ভেতর হচ্ছে ঢিব-ঢিব শব্দ। কেবলই মনে হচ্ছে, কী শুনব এবার! এশা মেয়েটা সত্যি মরে গেল! নাকি মরেনি! হে, স্রষ্টা, রিয়ার এই স্বপ্নটা যেন অন্তত মিথ্যে হয়! এশার মত ভাল মেয়ের অনেক, অনেক দিন বেঁচে থাকা দরকার। দুনিয়াটা দিনকে দিন চিড়িয়াখানা বা ল্যাবরেটরি হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মনে এতটুকু মায়া-মমতা নেই! মানুষ কেটে এক শ’ উনিশ টুকরো করা হয়!

আমি রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। অথচ আমাকে শোকের সাগরে ভাসাল ও। জান্তব গোঙানির মত করে বলল, ‘এশা বাঁচেনি। অনেক মেয়ের হাঁকডাকের শব্দে ঘুম ভাঙল আমার। ঘুম নয়, এ যেন মরণঘুম। ওরা আমাকে ডেকে তুলে এশার কথা জানতে চাইল। এশা কোথায়! লেডিস হলের পেছনে ড্রেনে পাওয়া গেছে একটা মেয়ের লাশ। দেখতে এশার মত। কিন্তু এশা সেখানে যাবে কেন! এই কেন’র জবাব কেউ জানে না, শুধু আমি জানি, স্যর। হলের সব রুম, ওয়াশরুমে খুঁজেও পাওয়া গেল না এশাকে। ওর চেহারাটা এমন বীভৎসভাবে থেঁতলে গেছে, চেনার উপায় নেই। অনুমান করা যায়, কোনও এক রহস্যময় কারণে ভোর রাতে পাশের ভবনের ছাদে গিয়েছিল এশা। সেখান থেকে পা ফসকে পড়ে ঘাড় মটকে মরে গেছে ও। উপুড় হয়ে পড়েছিল, তাই থেঁতলে গেছে পুরো মুখমণ্ডল। উহ্, কী ভয়ঙ্কর সেই চেহারা! স্যর, আমি অপয়া! আমি অভিশপ্ত! এখন কী করব বলুন, বলে দিন প্লিজ!’

কান্নায় ভেঙে পড়ল রিয়া। এই কান্নার যেন কোনও শেষ নেই।

শীতের অনুভূতিটা আরও বেড়েছে আমার। ডিনারের কথা ভাবলাম। রিয়াকে কিছু খেতে দেয়া দরকার। বড্ড ক্লান্ত মেয়েটা। এমন কিছু ওকে দিতে হবে, যাতে ঝিমিয়ে না পড়ে।

.

এখন কাকভোর।

নিতান্ত স্বার্থপরের মত ডক্টর ফয়সালকে ফোন করে জাগিয়ে তুললাম।

ফোন পেয়ে ভয়ার্ত স্বরে বলল সে, ‘কী ব্যাপার, ভাই, কোনও বিপদ! এত রাতে ফোন করেছ?’

‘বিপদ, ভীষণ বিপদ আমার।’

‘তোমার বিপদ! কী হয়েছে, বলো?’

‘আচ্ছা, ফয়সাল, এমন কোনও ওষুধ কি আছে, যা খেয়ে দু’দশ দিন ঘুমটাকে আটকে রাখা যায়?’

‘তুমি কি পাগল হলে? এমন ওষুধ দিয়ে কী হবে! মানুষ ঘুমানোর জন্য ওষুধ খায়, জেগে থাকার জন্য খায় বলে তো শুনিনি!’

‘তার মানে অ্যান্টি-স্লিপ জাতীয় ওষুধ নেই, যাতে আর ঘুম আসবে না?’ হতাশায় ভেঙে পড়লাম আমি। যেমন, করে হোক, রিয়াকে জাগিয়ে রাখতে হবে। কিছুতেই ঘুমোতে দেয়া চলবে না। আমি মরে যাব, ঘুমোলেই ও স্বপ্ন দেখবে, আমি ফিনিশ!

আমার ভয়ের যথেষ্ট কারণ আছে! সেটা গাণিতিক!

রিয়ার বলা তিনটি ঘটনা রিপ্লে করে দেখলাম, সে প্রথম স্বপ্ন দেখেছে ১৩ জুন, ২০১০ সালে। ১৩ জুন (ইংরেজি ক্যালেণ্ডারে সিক্সথ মাস) মানে মাস ও তারিখের সংখ্যাটা যোগ করলে দাঁড়ায় ১৯।

দ্বিতীয় ঘটনার (সুমন-ছোটনের পানিতে ডুবে মৃত্যু) তারিখ ৭ ডিসেম্বর, এক্ষেত্রেও যোগফল ১২+৭ = ১৯।

লাস্ট ঘটনা এশার মৃত্যু দিন ১৫ এপ্রিল। যোগফল

কত! ১৫+৪ = ১৯!

ভাবতেই ভয়ে কণ্ঠনালীতে উঠে এসেছে হৃৎপিণ্ড! আজ কত তারিখ!

১১ আগস্ট!

যোগফল ১৯!

তার মানে আমার মৃত্যু অবধারিত!

ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খাচ্ছি!

রিয়া বোধ হয় বুঝল আমার মনের কথা। কণ্ঠে বৃষ্টির ঘ্রাণ মেখে নিয়ে বলল, ‘ভয় পাবেন না, স্যর। আপনার ক্ষতি হোক, তা চাই না। আমি আপনাকে ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। আপনি আমার খুব প্রিয় লেখক। জানি, আমি সবার জন্য বিপদের কারণ। বিশেষ করে আমার প্রিয়জনদের জন্য। যাকেই ভালবাসি, আমার দুঃস্বপ্ন তাকে পাঠিয়ে দেয় ওপারে। আমি আজ তাই তৈরি হয়েই এসেছি।’

‘মানে? এসব তুমি কী বলছ, রিয়া?’

‘মানে, আমি আর বেশিক্ষণ নেই। একটু পর চিরবিদায় নেব দুনিয়া থেকে। শুরু হয়ে গেছে ওষুধের প্রতিক্রিয়া 1 মরে যাচ্ছি, স্যর। ভাববেন না, পুলিশ যাতে আপনাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া না করে, তাই সুইসাইড নোট লিখে রেখেছি। ভাল থাকবেন, স্যর, অ…নে…ক…ভা-ল…’

জ্ঞান হারাল রিয়া।

লোকাল থানা ও হাসপাতালে ফোন করলাম। এখনও লোপ পায়নি আমার ইন্দ্রিয়!

অরুণ কুমার বিশ্বাস

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *