নীল রক্ত – আফজাল হোসেন

নীল রক্ত

এক

শাহজাহান ঘটক এসেছে। সোফার উপর পা তুলে আসন করে বসেছে। ভরপুর চা-নাস্তার পর এখন সে পান চিবুচ্ছে। একসঙ্গে দুই খিলি পান। গাড়ির টায়ারের মত মোটা ঠোঁট দুটো পানের রসে জবজবে। কুচকুচে কালো চেহারায় পানের রসে ভেজা লাল টুকটুকে ঠোঁট জোড়া দেখতে ভালই লাগছে। থুতনিতে থাকা এক গোছা ছাগুলে দাড়ি বেয়েও পানের রস নেমেছে।

শাহজাহান ঘটকের দেয়া এক গাদা বায়োডাটা ফটো নেড়ে-চেড়ে দেখছেন সুলতানা বেগম। সব বিবাহযোগ্য মেয়েদের বায়োডাটা আর ফটো।

সুলতানা বেগমের একটিও পছন্দ হচ্ছে না। তিনি একেকটা ফটো দেখছেন আর ভুরু কুঁচকাচ্ছেন। তিনি তাঁর একমাত্র ছেলে সুমনের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। যেমন-তেমন মেয়ে হলে চলবে না। রাজকন্যার মত মেয়ে চাই। শুনেছেন সুন্দরী মেয়েদের খোঁজ বের করতে শাহজাহান ঘটকের তুলনা নেই। এজন্যেই শাহজাহান ঘটককে খবর দিয়ে এনেছেন।

সুলতানা বেগম যেসব মেয়ের বায়োডাটা আর ফটো দেখছেন তারা সবাই-ই বেশ সুন্দরী, শিক্ষিত, আর ভাল . পরিবারের। তারপরও আরও কিছু খুঁজছেন তিনি। ছোট পরিবার। তাঁদের যেমন মা-ছেলের ছোট পরিবার, তেমন কোনও পরিবারের একমাত্র মেয়ে পাওয়া গেলে ভাল হত। ছোট পরিবারে ঝামেলা কম থাকে। তাঁর ছেলে সুমন অত্যন্ত নম্র-ভদ্র-লাজুক স্বভাবের। তাঁর একার হাতে মানুষ করা। ঝুট-ঝামেলার মধ্যে কোনও দিনও জড়াতে দেননি। বাইরের মানুষের সঙ্গে মেলামেশাও কম। লেখাপড়া শেষ করে এখন চাকরিতে ঢুকেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। বাসা-অফিসের মধ্যেই তার জীবন সীমাবদ্ধ। এমন নিরীহ প্রকৃতির ছেলের জন্য তেমন একটা মেয়েই দরকার।

সুমনের বাবার অবর্তমানে সুলতানা বেগম অনেক কষ্ট করে তাঁর এই ছেলেকে মানুষ করেছেন। বলা যায় শরীরের সমস্ত রক্ত পানি করে। সারা দিন-রাত সেলাই মেশিনে ঘটর-ঘটর শব্দ তুলে কোনওক্রমে ছেলের পড়ার খরচ, সংসার খরচ চালিয়েছেন। সেই দিন এখন আর নেই। তাঁদের অবস্থা ফিরেছে। আর্থিক অনটন দূর হয়েছে। ছেলে বড় চাকরি পেয়েছে। যা বেতন পায় তাতে খেয়ে-পরে খুব ভাল আছেন তাঁরা। চব্বিশশো স্কয়ার ফিটের বড় বাসা ভাড়া নিয়েছেন। বাসায় ফ্রিজ, টিভি, আলমিরা, সোফা…অভিজাত সব কিছুই কেনা হয়েছে।

এত কিছুর পরও সুলতানা বেগমের বুকের গভীরে একটা কষ্ট রয়েই গেছে। সুমনের বাবার শূন্যতা। সুখের এই দিনগুলো যেন তাঁর কথা আরও বেশি মনে করিয়ে দেয়।

সুমনের বাবা আমজাদ হোসেন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কেরানির চাকরি করতেন। সামান্য ক’টা টাকা বেতন পেতেন। কিন্তু তাতে সুখের অভাব ছিল না। ছোট্ট সুমনকে নিয়ে হাসি-খুশিতে ভরপুর ছিল তাঁদের সংসার।

সেদিনের কথা কখনও ভুলতে পারবেন না সুলতানা বেগম। তাঁদের বিবাহ বার্ষিকীর দিন ছিল ওটা। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে গোসল করে প্রথমেই বিয়ের শাড়িটা পরেছিলেন। সামান্য একটু সাজগোজও করেছিলেন। চোখে কাজল দিয়েছিলেন। ভুরু এঁকেছিলেন। লিপ লাইনার দিয়ে ঠোঁট এঁকে হালকা গোলাপি লিপস্টিক লাগিয়েছিলেন। একমাত্র কানের দুল জোড়াও পরেছিলেন। হাতে কাচের চুড়ি। এরপর রান্নাঘরে ঢুকে চটপট খিচুড়ি আর ডিম ভাজা করেন। এমনিতে প্রতিদিন নাস্তার জন্য আলু ভাজি আর রুটি করতেন। কিন্তু সেই বিশেষ দিনটার জন্য বিশেষ আয়োজন করেছিলেন।

রান্না শেষে ঘুম থেকে জাগান সুমনের বাবাকে। ঘুম থেকে জেগে ড্যাব-ড্যাব করে তাকিয়ে ছিলেন মানুষটি।

অবাক গলায় বলেছিলেন, ‘কোথাও বেড়াতে যাচ্ছ?’ সুলতানা বেগম রহস্যময় হাসি দিয়ে বলেন, ‘না।’

‘তা হলে এত সেজেছ কেন?’

সুলতানা বেগম মুখ ভার করে বলেন, ‘এমনিতেই সেজেছি।’

তখন বোধহয় মনে পড়ল লোকটার। জিভে কামড় দিয়ে, ‘হায়, হায়, সব ভুলে বসে আছি!’ বলতে-বলতে বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলেন। কেমন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। যেন এখনই তাঁকে কিছু করতে হবে।

সুলতানা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। সুলতানা বেগম লাজুক কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘আরে! এ কী করছ তুমি! ছেলে জেগে উঠে দেখে ফেলে যদি?’

আমজাদ হোসেন বলেন, ‘দেখলে দেখুক। দেখে শিখুক। বড় হয়ে ও যখন বিয়ে করবে, তখন তো ওকেও এসব করতে হবে।’

সুলতানা বেগম হাতের চেটো দিয়ে উল্টো ভাবে স্বামীর গালে ঘষা দিয়ে বলেন, ‘যখন শেখার এমনিতেই শিখে যাবে। তোমাকে আর শেখাতে হবে না। যাও, তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢোকো। শেভ করে গোসল করে এসো। আজ কিন্তু পাঞ্জাবি পরবে।’

আমজাদ হোসেন সুলতানা বেগমের কপালে আর একটা চুমু খেয়ে বলেন, ‘অফিসে যেতে হবে না? পাঞ্জাবি পরলে হবে?’

‘পাঞ্জাবি পরেই যাবে।’

‘পাঞ্জাবি পরে অফিসে যাব?!’

‘হ্যাঁ, আজ পাঞ্জাবি পরেই যাবে।’

‘অফিসের কলিগরা কী বলবে?’

‘কী আবার বলবে! কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, আজ তোমার বিবাহ বার্ষিকী। তাই পাঞ্জাবি পরে এসেছ। ব্যস। তাড়াতাড়ি বাথরুমে যাও। আমি সুমনকে উঠিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি করছি। তাড়াতাড়ি এসো। খিচুড়ি রান্না করেছি। গরম-গরম খাবে।’

সে বছরই সুমনকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। সকালে সুমনের বাবা তাঁর সঙ্গেই সুমনকে নিয়ে বেরোতেন। স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তিনি অফিসে চলে যেতেন। স্কুল ছুটির সময় সুলতানা বেগম গিয়ে সুমনকে নিয়ে আসতেন।

সুমনের বাবা খিচুড়ি আর ডিম ভাজা অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে খান। খেতে-খেতে বলেন, ‘সুলতানা, প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি, যখন-তখন চলে যেতে পারে। ভেবে রেখেছি, যদি কখনও সত্যিই চাকরি চলে যায়, তা হলে একটা খিচুড়ির দোকান দেব। তোমার হাতের কয়েক ধরনের খিচুড়ি থাকবে। চাল-ডাল-আলুর সিম্পল খিচুড়ি। সবজি খিচুড়ি। ডিম খিচুড়ি। গরুর মাংসের, খাসির মাংসের, মুরগির মাংসের, হাঁসের মাংসের আলাদা-আলাদা ভুনা খিচুড়ি। পাঁচমিশালি পাতলা খিচুড়ি। দেখবে হু-হু করে চলবে। তোমার হাতের রান্নার যে স্বাদ! লোকজনের লাইন পড়ে যাবে।’

খাওয়া শেষ করে বাপ-বেটায় রওনা দেয়। অবশ্য সুমন সেদিন খিচুড়ি খায়নি। খিচুড়িতে বোম্বাই মরিচ দিয়েছিলেন বলে অনেক ঝাল হয়েছিল। সুমন খেয়েছিল পাউরুটি আর দুধ।

রওনা দেয়ার সময় সুমনের বাবা ছেলেকে এড়িয়ে শেষ বারের মত সুলতানা বেগমের কপালে একটা চুমু খেয়েছিলেন। আর পাঁচশো টাকা সুলতানা বেগমের হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সুমনকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার সময় এই টাকা দিয়ে আধ কেজি গরুর মাংস আর একটা বাচ্চা মুরগি কিনে আনবে। পোলাওয়ের চাল বোধহয় ঘরেই আছে? না থাকলে আধ কেজি পোলাওয়ের চালও আনবে। বাচ্চা মুরগির রোস্ট, ভুনা গরুর মাংস আর পোলাও রান্না করবে।’

সুলতানা বেগম জিজ্ঞেস করেন, ‘অফিস থেকে ফিরবে কখন?’

সুমনের বাবা বলেন, ‘রোজ যে সময় ফিরি। অফিস ছুটি হলেই।’

সুলতানা বেগম মুখ বেজার করে বলেন, ‘আজ একটু তাড়াতাড়ি ফেরা যায় না? সন্ধ্যার আগে। তিনজন মিলে কোথাও ঘুরতে যেতাম।’

সুমনের বাবা বলেন, ‘চেষ্টা করে দেখব। তুমি না হয় সুমনকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে এসো।’

সুলতানা বেগম আরও মুখ ভার করে বলেন, ‘তোমাকে ছাড়া একা কোথাও যেতে আমার ভাল লাগবে?’

‘একা কোথায়, সুমন থাকবে না সাথে?’

‘সুমন তো থাকবেই, তোমার অভাব কি তাতে পূরণ হবে?’

সুমনকে স্কুল থেকে আনার সময় সুলতানা বেগম গরুর মাংস আর বাচ্চা মুরগি কেনেন। আধ কেজি গরুর মাংস আর বাচ্চা মুরগি কেনার পরও হাতে বেশ কিছু টাকা থেকে যায়। ‘সেই টাকা দিয়ে এক পোয়া মুগ ডাল, গরম মশলা আর টমেটো-ক্ষীরা কিনে ফেলেন। ভাবেন, আর একটা পাইটেম বাড়াবেন। বাচ্চা মুরগিটার পাখনা- চামড়া-গিলা-কলিজা দিয়ে মুগ ডালের ঘণ্ট করবেন। আর ওসব খাবারের সঙ্গে সালাদ না হলে চলে? তাই টমেটো-ক্ষীরা দিয়ে সালাদ বানাবেন।

সুলতানা বেগম দুপুরেই সব কিছু রান্না করে ফেলেন। তবে তিনি ওসব রান্নার কিছুই খান না। সকালের খিচুড়ি খানিকটা রয়ে গিয়েছিল। সেই ঠাণ্ডা খিচুড়িই খেয়ে নেন। দুপুরে খাওয়ার জন্য সুমনের বাবাকেও হটপটে খিচুড়ি দিয়ে দিয়েছিলেন। স্বামী যেখানে সকালের খিচুড়িই খাবেন, সেখানে তিনি কী করে একা ওসব ভাল খাবার খান? সন্ধ্যায় সুমনের বাবা ফিরলে একসঙ্গে খাবেন।

সুমনের বাবা রোস্ট-পোলাও জাতীয় খাবার খুব পছন্দ করতেন। বেচারা স্বল্প বেতনের চাকরি করতেন বলে, কোনও উপলক্ষ ছাড়া সাধারণত ওসব খাবার জুটত না। ছেলেও হয়েছে বাবার মত। রোস্ট-পোলাও খুব পছন্দ করে। সেদিন দুপুরে তিনি ঠাণ্ডা খিচুড়ি খেলেও, সুমনকে চার পিস রোস্টের এক পিস দিয়ে পোলাও খাইয়েছিলেন।

সন্ধ্যার পর পরই শুরু হয় সুমনের বাবার ফেরার অপেক্ষা। সুলতানা বেগম জানতেন সুমনের বাবার ফিরতে কমপক্ষে ন’টা-সোয়া ন’টা বেজে যায়। তারপরও তিনি গভীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন। এই বুঝি ফিরবেন। দিনটা অন্যান্য দিনের মত নয়! বিবাহ বার্ষিকীর দিন! নিশ্চয়ই আগে-ভাগেই ফিরবেন। এখনই দরজায় টুক-টুক শব্দ তুলে ক্লান্ত গলায় ডাকবেন, ‘সুলতানা, ও, সুলতানা, দরজা খোলো। সুমন, বাবা, ঘুমিয়ে পড়েছিস? তোর মাকে দরজা খুলতে বল।’

প্রাইভেট কোম্পানির চাকরিতে প্রচুর খাটাত। যে টাকা বেতন দিত তার তিনগুণ খাটিয়ে মারত। লোকটা অফিস থেকে ফিরলে মুখের দিকে তাকানো যেত না। যেন সারাদিন রোদে পুড়ে রিকশা চালিয়ে ফিরতেন।

ন’টা বেজে যায়। আর দেরি নেই, এখনই সুমনের বাবা এসে পড়বেন, এই ভেবে সুলতানা বেগম খাবার গরম করতে লেগে পড়েন। সেই সঙ্গে সালাদ বানাবার জন্য টমেটো-ক্ষীরা কুচাতে থাকেন।

সালাদ বানানো এবং খাবার গরম করা হয়ে গেলে টেবিলে সাজিয়েও ফেলেন। ঘড়ির কাঁটাও সাড়ে ন’টার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু সুমনের বাবা ফেরেন না।

সুলতানা বেগম চিন্তিত মুখে ভাবেন, কী হলো লোকটার-এত দেরি করছেন কেন? আকাশের অবস্থা ভাল নয়। ঘন-ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। যে কোনও মুহূর্তে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। ঝড়বৃষ্টি শুরু হবার আগে ভালয়- ভালয় মানুষটা এসে পৌঁছতে পারবেন তো?

ওদিকে ছোট্ট সুমন ঘুমানোর জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করে। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তে চায়। সুলতানা বেগম ছেলেকে জাগিয়ে রাখার জন্য মন ভোলানো বিভিন্ন কথা বলতে থাকেন, ‘সুমন, বাবা, আমার লক্ষ্মী সোনা, এখনই তোর বাবা চলে আসবে। তখন সবাই মিলে একসঙ্গে খাব। খেয়েই ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়ব। তুই তোর বাবার হাতে খেতে ভালবাসিস না, বল? তোর বাবা নিশ্চয়ই তোর জন্য কোনও খেলনা কিনতে গিয়ে দেরি করছে। দেখতে চাস না সেই খেলনা? তুই একটা প্লাস্টিকের কচ্ছপ আর ডাইনোসরের কথা বলছিলি মনে আছে? নিশ্চয়ই তোর বারা আজ তোর জন্যে কচ্ছপ আর ডাইনোসর নিয়ে আসবে। একটু সবুর কর না, বাবা!’

রাত সোয়া দশটা বেজে যায়। সুমন ঘুমিয়ে পড়ে। তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। বাইরেটা যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে চায়। ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। কিন্তু তখনও সুমনের বাবার দেখা নেই।

সুলতানা বেগম অস্থির হয়ে ওঠেন। ভেবে পান না কী করবেন। আজকালকার মত তখনকার দিনে সবার পকেটে- পকেটে মোবাইল ফোন ছিল না। কী করে সুমনের বাবার খোঁজ নেবেন? সুমনের বাবার অফিসে ফোন ছিল। কিন্তু সেই ঝড়-বৃষ্টির রাতে কোথা থেকে ফোন করবেন? অবশ্য বাড়িওয়ালার বাসায় ফোন ছিল। ভাবেন, বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে একটা ফোন করার জন্য অনুরোধ করবেন। আবার এ-ও ভাবেন, হাড়কিপটে বাড়িওয়ালা কি ফোন করতে দেবেন?

ছলছল চোখে সুলতানা বেগম গিয়ে বাড়িওয়ালাকে একটা ফোন করার জন্য অনুরোধ জানান। কোনও উচ্চবাচ্য না করে বাড়িওয়ালা রাজি হয়ে যান। সুলতানা বেগমের হাতে রিসিভার ধরিয়ে দিয়ে নিজেই ডায়াল ঘুরিয়ে নাম্বার লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।

মাঝবয়সী বাড়িওয়ালার মনে বোধহয় অন্য কিছু কাজ করছিল। সুলতানা বেগমের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ডায়াল ঘুরাতে-ঘুরাতে বার-বার হাতের কনুই সুলতানা বেগমের গায়ে ছুঁইয়ে দিচ্ছিলেন।

বেশ কয়েকবার ফোন করলেন। রিং হয়, কিন্তু কেউ রিসিভার তোলে না। অত রাতে অফিসের ফোনের রিসিভার কারও তোলার কথাও নয়। সুলতানা বেগমের চোখের কোনা বেয়ে পানি নামতে শুরু করে।

বাড়িওয়ালা সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে সুলতানা বেগমের কাঁধে হাত রাখেন। কাঁধে-পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলতে থাকেন, ‘ঝড়-বৃষ্টির রাত। পুরুষ লোকের মন বলে কথা। এমন একটা রাতও কি রোজকার মত নিজের ঘরে স্ত্রীর সঙ্গে কাটাতে ইচ্ছে করে? ঘর কা মুরগা ডাল বরাবর। গিয়ে দেখেন কোনও আবাসিক হোটেলের রুমে বসে কচি মুরগির রান চিবাচ্ছে। ভাবীজান, আপনি চিন্তা না করে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। দেখবেন, সকাল-সকাল ঠিকই চোখ জোড়া লাল করে ফিরে আসবে।’ গলার স্বর একটু নামিয়ে, ‘ভাবীজান, ঝড়-বৃষ্টির অন্ধকার রাত, একলা-একলা ভয় লাগলে বলেন-আমি গিয়ে আপনাকে পাহারা দিই। আমি থাকতে আপনার আবার কীসের ভয়!’

সুলতানা বেগমের চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছিল। তার মধ্যেই তিনি কী করে যেন কড়া গলায় বলে ওঠেন, ‘চাচাজান, আমার স্বামী আপনার মত খাটাস নয় যে, হোটেলে বসে কচি মুরগির রান চিবুবে।’ বলেই গট-গট করে চলে আসার সময় বিড়-বিড় করেন, ‘বুড়া খাটাসটার শখ কত, মুরগি পাহারা দিতে চায়!’

সেই রাতটা যে কীভাবে কাটছিল সুলতানা বেগমের! সারা রাত কেঁদে-কেঁদে বালিশ ভেজান। তিনটার পর ঝড়- বৃষ্টি থামে। ঝড়-বৃষ্টি থামলেও ইলেকট্রিসিটি আসে না। আসেন না সুমনের বাবাও। তখনও তিনি অপেক্ষায় থাকেন, এই বুঝি সুমনের বাবা এসে দরজায় নক করবেন।

অবশ্য কিছুক্ষণ পর-পরই দরজায় নক হচ্ছিল। বাড়িওয়ালা দরজা ধাক্কাধাক্কি করে জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘ভাবীজান, ভাই কি এসেছেন? ভয় লাগলে বলেন, ভয় দূর করে দিই। আহারে! কী সুন্দর টসটসে চেহারার বউডারে ঘরে একলা ফেলে বাইরে রাত কাটায়! পুরুষ লোকের চরিত্র বলে কিছু নাই। ভাবীজানের উচিত একটা কঠিন শিক্ষা দেয়া। সে যদি বাইরে বসে মোরগ-পোলাও খেতে পারে, ঘরের ঘিতে আগুন লাগলে দোষ কী!’

সকাল হয়ে যায়। সুমনের বাবার কোনও খোঁজ নেই। বেলা বাড়তে থাকে। অফিসে, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি, বন্ধু- বান্ধবদের বাড়ি, সব জায়গায় খোঁজ নেয়া হয়। কোথাও সুমনের বাবা নেই। শেষতক বিকেল নাগাদ থানায় মিসিং ডায়েরি করা হয়। সেই সঙ্গে সবক’টা হসপিটাল-ক্লিনিক সহ আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামেও খোঁজ নেয়া হয়। কোথাও সুমনের বাবা নেই। লোকটা যেন একেবারে গায়েব হয়ে গেছেন। না হলে কেউ তাঁকে গুম করেছে।

দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে বছর আসে। একে-একে বাইশটা বছর চলে গেল। ছয় বছরের সুমন এখন আটাশ বছরের। কিন্তু সুমনের বাবা আর ফিরে এলেন না!

সুলতানা বেগম এখনও অপেক্ষায় আছেন। নিশ্চয়ই কোনও এক দিন তিনি ফিরে আসবেন। দরজায় নক করে ডাকবেন, ‘সুলতানা, ও, সুলতানা, দরজাটা খোলো। সুমন, বাবা, সুমন, তোর মাকে দরজাটা খুলতে বল।’

সুলতানা বেগম অপেক্ষায় আছেন সেদিন আবার তিনি রোস্ট, পোলাও আর ভুনা গরুর মাংস রান্না করবেন। গত বাইশ বছরে এই খাবারগুলো তিনি আর মুখে দেননি।

দুই

শেষ পর্যন্ত শাহজাহান ঘটক সুলতানা বেগমের পছন্দসই মেয়ের খোঁজ বের করতে পেরেছে।

মেয়ের নাম ঈশিতা। সমাজ বিজ্ঞানে অনার্স পড়ছে। একমাত্র মেয়ে। শহরতলিতে নিজেদের বাড়ি। বাবা নেই। মা-মেয়ের ছোট্ট সংসার।

ঈশিতার চেহারা অসম্ভব রকমের সুন্দর। মাখনের মত ফর্সা মোলায়েম গায়ের রঙ। গোলগাল আদুরে মুখ। উঁচু নাক। ভাসা-ভাসা বড় চোখ। ঘন আঁখি পল্লব। সবুজাভ চোখের মণি। দিঘল রেশমি চুল। সব সময় বাইরে বেরোয় বোরখা পরে। মুখ ঢাকা থাকে নেকাব দিয়ে। হাতে-পায়েও মোজা পরে। শুধু তার নিষ্পাপ চোখ দুটো বাইরে থেকে দেখা যায়।

অবশ্য ঈশিতাকে সামনা-সামনি দেখা হয়নি। শাহজাহান ঘটক ফটো এনে দেখিয়ে এসব বর্ণনা দিয়েছে। ফটো দেখে শাহজাহান ঘটকের বর্ণনা সঠিক বলেই মনে হয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফটোর চেহারার সঙ্গে সত্যিকারের চেহারার অনেক অমিল দেখা যায়। আর ঘটকরা যে হরহামেশাই নয়-ছয় কথা বলে তা-ও সবার জানা।

ঈশিতাকে সামনা-সামনি দেখার দিনক্ষণ ঠিক করতে বলেছিলেন সুলতানা বেগম। সেটি ঠিক হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় ঈশিতাদের বাসায় গিয়ে দেখবেন। সুলতানা বেগম চেয়েছিলেন কোনও রেস্টুরেন্ট বা পার্কে গিয়ে দেখতে। কিন্তু তাতে ঈশিতা বা ঈশিতার মা রাজি হয়নি। ঈশিতাকে দেখতে হলে তাদের বাসায় গিয়েই দেখতে হবে। ঈশিতা বাসার বাইরে নেকাব তুলে মুখ বের করে না।

অগত্যা ঈশিতাকে দেখার জন্য সুলতানা বেগম তাদের বাসায় যেতে রাজি হয়েছেন। সঙ্গে সুমনকেও নিয়ে যাবেন। তাঁর পছন্দের চেয়েও সুমনের পছন্দটা বেশি জরুরি। যাকে পছন্দ করে বউ বানিয়ে আনা হবে, তাকে নিয়ে সারা জীবন সুমনকেই ঘর করতে হবে। তাই সুমনের ভাল লাগা-মন্দ লাগাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে সুমন যে ধরনের মুখচোরা লাজুক স্বভাবের ছেলে, তাতে সুলতানা বেগমের কথার উপর কোনও দিনও সে টু শব্দটিও করবে না। সুলতানা বেগমের সিদ্ধান্তই সে চূড়ান্ত হিসেবে মাথা পেতে নেবে।

.

সন্ধ্যা সোয়া সাতটা। সুলতানা বেগম তাঁর ছেলে সুমনকে নিয়ে ঈশিতাদের বাসায় এসেছেন। সঙ্গে শাহজাহান ঘটকও রয়েছে। তাঁরা বসার ঘরে বসেছেন। তাঁদের সামনে শরবত থেকে শুরু করে কয়েক ধরনের পিঠা-পায়েস, ফল, মিষ্টি সহ অনেক কিছু পরিবেশন করা হয়েছে। বয়স্কা একজন কাজের মহিলা একটার পর একটা এনে সামনে দিচ্ছে।

সুলতানা বেগম এবং সুমন দু’জনেই হাত গুটিয়ে বসে আছে। এখন পর্যন্ত কিছুই তারা মুখে দেয়নি। পুরানো একটা রীতি আছে, মেয়ে দেখার আগে মেয়ের বাড়ির কিছুই খেতে হয় না। মেয়ে দেখে পছন্দ হলে, প্রথমে মেয়েকে মিষ্টি মুখ করিয়ে খাবার মুখে দিতে হয়। তবে শাহজাহান ঘটক থেমে নেই। সে গপা-গপ চালিয়ে যাচ্ছে।

ঈশিতার মা ইয়াসমিন বেগম তাঁর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন।

ঈশিতার পরনে লাল রঙের শাড়ি। মাথায় ঘোমটা। বেশ লম্বা মেয়েটা। সেই তুলনায় ঈশিতার মাকে খাটই বলা চলে।

ঈশিতাকে দেখে বিস্ময়ে সুলতানা বেগম ঢোক গিললেন। কোনও মেয়ে যে এতটা সুন্দরী হতে পারে তা তাঁর কল্পনায়ও ছিল না। যেন স্বর্গের অপ্সরা! একেবারে নিখুঁত চেহারা। স্বচেয়ে সুন্দর তার চোখ দুটো। ফটোতে চোখের মণি সবুজাভ মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ঘন কালো। ফটোতে তার চেহারা যতটা গোলগাল মনে হয়েছে, এখন ততটা গোল মনে হচ্ছে না। যথেষ্টই মানানসই। ফটোতে গায়ের রঙ শ্বেতী রোগীর মত অতিরিক্ত রকমের সাদা মনে হয়েছে। এখন সেরকম লাগছে না। হালকা গোলাপি আভা রয়েছে। যাকে বলে দুধে-আলতা গায়ের রঙ।

মোদ্দা কথা, ফটোতে তাকে যতটা সুন্দরী মনে হয়েছে, বাস্তবে সে তারচেয়েও হাজার গুণ সুন্দরী।

মা-মেয়ে সুলতানা বেগমদের মুখোমুখি সোফায় বসেছে। সুলতানা বেগম ঈশিতার উপর থেকে চোখ সরিয়ে ঈশিতার মা ইয়াসমিন বেগমের মুখের দিকে তাকালেন। ভদ্রমহিলার চোখে চোখ পড়তেই তিনি ভয়ানক চমকে উঠলেন। মনে হলো ওই চোখ দুটো তাঁর অনেক দিনের চেনা। এর আগেও কোথায় যেন ওই চোখ দুটো দেখেছেন। বহুবার দেখেছেন!

ভদ্রমহিলার চেহারাও সুলতানা বেগমের কাছে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। যেন বহু বছর পর এক সময়ের অতি পরিচিত কারও দেখা পেয়েছেন।

সুলতানা বেগম গলা খাঁকারি দিয়ে ইয়াসমিন বেগমকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার সঙ্গে এর আগে কি কোথাও দেখা হয়েছে?’

ইয়াসমিন বেগম কিছুটা অবাক গলায় বললেন, ‘আপনাকে দেখার পর আমিও সে কথাই ভাবছি। এর আগে কি আপনার সঙ্গে কোথাও পরিচয় হয়েছিল? খুব পরিচিত মনে হচ্ছে আপনাকে!’

শাহজাহান ঘটক এক গাদা খাবার মুখে হাউ-হাউ করে বলল, ‘দুনিয়ার সব ব্যাটা ছেলেই হইছে ভাই-ভাই আর মেয়ে ছেলেরা হইছে বইন-বইন। এই জন্যেই চেনা-চেনা মনে হইতেছে।’

সুলতানা বেগম বললেন, ‘আপনাদের আত্মীয়-স্বজন কাউকে দেখছি না।’

ইয়াসমিন বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমাদের নিকট আত্মীয় বলতে কেউ নেই। আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে ছিলাম। বাবা-মা গত হয়েছেন বহু বছর আগে। আর ঈশিতার বাবার দিকের কোনও আত্মীয়- স্বজনের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই।’

সুলতানা বেগম বললেন, ‘ঈশিতার বাবার সম্পর্কে তো কিছুই জানলাম না? বায়োডাটায় দেখলাম শুধু লেখা বাবা নেই। বাবার নাম-পরিচয় কিছুই দেয়া নেই। বেঁচে থাকতে তিনি কী করতেন সে বিষয়েও কোনও উল্লেখ নেই।’

ইয়াসমিন বেগম থমথমে মুখে বললেন, ‘বিয়ে-শাদির ব্যাপার বলে কথা, কিছুই লুকাব না। সবই আপনাদের জেনে রাখা ভাল। ঈশিতার বাবা আমাদের থেকে আলাদা থাকতেন। মৃত্যুর খবরটা পর্যন্ত লোক মুখে জানতে পারি। আমাদের বিয়ের শুরু থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার বনিবনা হচ্ছিল না। ঈশিতার জন্মের পর পাকাপাকিভাবে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ঈশিতাকে আমি একাই মানুষ করেছি। ও ওর বাবাকে কোনও দিন দেখেওনি। আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় পৈতৃক সূত্রে অনেক ধন-সম্পদ পেয়েছি। তা দিয়ে আমার মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করতে খুব একটা কষ্ট হয়নি।’

সুলতানা বেগম বললেন, ‘ঈশিতা তো এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে। বায়োডাটায় দেখলাম খুবই ভাল ছাত্রী। এস. এস. সি. এইচ. এস. সি.-র রেজাল্ট অত্যন্ত ভাল। পড়াশোনা শেষ করার আগেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?’

ইয়াসমিন বেগম বললেন, ‘দেখছেনই তো আমাদের মাথার উপর কোনও গার্ডিয়ান নেই। এমনিতেই মেয়ে বড় হলে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। তার ওপর মেয়ে যদি সুন্দরী হয় তা হলে তো কথাই নেই। সুন্দরী মেয়েদের বাবা-মায়েরা মেয়েকে সুপাত্রের হাতে তুলে দেবার আগ পর্যন্ত এক ধরনের অনিশ্চয়তার মাঝে দিন কাটায়। এ ছাড়া ঈশিতা আজকালকার অন্যান্য মেয়েদের মত ততটা চালুও নয়। প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকেই বেরোয় না। তা-ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে। আমার যদি কিছু একটা হয়ে যায় তখন ওকে কে দেখবে? তাই আমি থাকতে-থাকতে ওর একটা ব্যবস্থা করে রেখে যেতে চাই।’

সুলতানা বেগম বললেন, ‘আপনার কি বড় ধরনের কোনও অসুখ রয়েছে?’

ইয়াসমিন বেগম সংকুচিত গলায় বললেন, ‘না, তেমন বড় কোনও অসুখ নেই। তবে মাথা যন্ত্রণা আছে। ভয়ানক মাথা যন্ত্রণা। যখন মাথা ব্যথাটা শুরু হয় দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না। নিজের মেয়েকে পর্যন্ত চিনতে পারি না।’

‘ডাক্তার দেখাননি?’

‘দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেছে মাইগ্রেনের ব্যথা। ওষুধ লিখে দিয়েছে। আর বলেছে, মাইগ্রেনের ব্যথা কখনওই পুরোপুরি সারে না। মাঝে-মাঝে ব্যথা উঠবেই। তবে আগে খুব কম উঠত। বছরে একবার কি দু’বার। আজকাল ঘন- ঘন উঠছে।’

সুলতানা বেগম প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার ছেলেকে দেখে আপনার কি পছন্দ হয়েছে?’

ইয়াসমিন বেগম বললেন, ‘চোখের দেখা দেখেই কাউকে কি পছন্দ বা অপছন্দ করা যায়? আপনার ছেলে দেখতে সুন্দর। তাই বলে মানুষ হিসেবে সে কতটা পছন্দসই তা তো আর এক দেখায়ই বোঝা যাবে না। যেমন ঈশিতার বাবার কথাই ধরুন, লম্বা-চওড়া সুপুরুষ ছিল। কিন্তু ভিতরে ভয়ঙ্কর এক কুৎসিত মনের মানুষ!’

সুলতানা বেগম বললেন, ‘তা ঠিক, মানুষকে উপর থেকে দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই। তবে আপনি যেমন বললেন না, আজকালকার অন্যান্য মেয়েদের মত আপনার মেয়ে নয়। তেমনই শত ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আমার ছেলেও আজকালকার অন্যান্য ছেলেদের মত নয়। এমন একটা ছেলে আপনি লাখে খুঁজে পাবেন না।’

ইয়াসমিন বেগম বললেন, ‘এটা ঠিক, আপনার ছেলেকে দেখে তেমনই মনে হচ্ছে। আমি লক্ষ করেছি এতক্ষণে সে একবারও চোখ তুলে তাকায়নি। এমনকী ঈশিতার দিকেও নয়। তেমন ছেলে হলে এতক্ষণে কয়েকবার ঈশিতার দিকে তাকানোর কথা ছিল।’

সুলতানা বেগম হেসে বললেন, ‘আপনার মেয়েও কিন্তু একবারও চোখ তুলে তাকায়নি।’

শাহজাহান ঘটক চায়ের কাপে বিস্কিট ভিজিয়ে খেতে- খেতে বলে উঠল, ‘খাপে খাপে মিইল্যা গেছে। যেমন ছেলে তেমনই মেয়ে। আর দেরি কীসের!’

সুলতানা বেগম বললেন, ‘সত্যিই আপনার মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’ হেসে ফেলে আরও বললেন, ‘আপনাকেও পছন্দ হয়েছে। এখন আপনার কী মত?’

ইয়াসমিন বেগমও হেসে ফেললেন। হাসি মুখে বললেন, ‘আপনাকেও আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’

শাহজাহান ঘটকের যেন আর তর সইল না। সুড়ৎ-সুড়ৎ করে কয়েক চুমুকে কাপের চা শেষ করে, চায়ে ভিজিয়ে খাওয়া বিস্কিটের যে নরম টুকরো কাপের তলায় জমেছে তা আঙুল দিয়ে ঘুঁটে খেতে-খেতে বলল, ‘তাইলে এহনই পাকা কথা হইয়া যাউক।’

সুলতানা বেগম তাঁর হাত থেকে একটা সুন্দর আংটি খুলে ঈশিতার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘দেখি, মা, তোমার হাতটা দেখি।’

ঈশিতা এক মুহূর্তের জন্য তার মায়ের দিকে তাকিয়ে সুলতানা বেগমের সামনে হাত মেলে ধরল। সুলতানা বেগম ঈশিতার অনামিকায় আংটিটা পরিয়ে দিলেন।

শাহজাহান ঘটক মোনাজাত ধরার ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ!’

সুলতানা বেগম হাসি মুখে শাহজাহান ঘটককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শুকুর আলহামদুলিল্লাহ কীসের জন্য? এনগেজমেন্ট হয়ে গেল এই জন্যে, না সব খাবার খেয়ে শেষ করতে পেরেছেন বলে?’

সুলতানা বেগমের কথা শুনে ইয়াসমিন বেগমও হেসে উঠলেন। শাহজাহান ঘটক দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে-খোঁচাতে বলল, ‘এনগেজমেন্ট যহন হইছে, নিশ্চয়ই খাওন-দাওনের আরও ব্যবস্থা হইবে। তহন আবার শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।’

সুলতানা বেগম এবং ইয়াসমিন বেগম দু’জনেই একসঙ্গে হেসে উঠলেন।

শাহজাহান ঘটক বলে উঠল, ‘ছেলে-মেয়েগো নিজেদের মইধ্যে একটু কথা বলার ব্যবস্থা কইরা দেওন উচিত। তাগো নিজেগোও তো একে-অপরের কাছে কিছু জাননের থাকতে পারে।’

সুলতানা বেগম এবং ইয়াসমিন বেগম দু’জনেই গলা মিলিয়ে বলে উঠলেন, ‘ঠিক বলেছেন, শাহজাহান ভাই।’

সুলতানা বেগম বললেন, ‘যান, ভাই, আপনিই ওদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে বাইরের বারান্দায় কথা বলার জন্য রেখে আসেন।’

ইয়াসমিন বেগম বললেন, ‘শাহজাহান ভাই, চিন্তার কিছু নাই, আপনার জন্য আবার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমি আগেই কাচ্চি বিরিয়ানী করে রেখেছিলাম। গরম করেই নিয়ে আসছি।’

শাহজাহান ঘটক জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, ‘আফা, বিরিয়ানীর লগে আচার হইলে আরও বেশি মজা লাগে।’

ইয়াসমিন বেগম বললেন, ‘চিন্তা করবেন না, সঙ্গে জলপাইয়ের আচার, গরুর মাংসের চপ, কষানো মুরগির মাংস, সালাদ, কোল্ড ড্রিংকস, দই-মিষ্টি এসবও থাকবে। যান, আপনি গিয়ে আগে ওদের দু’জনকে কথা বলার জন্য রেখে আসেন। খাবার গরম হতে-হতে ওরাও কথা বলা শেষ করে এসে একসঙ্গে খেতে বসতে পারবে।’

তিন

ঘরোয়া ছোট্ট পরিসরে সুমন আর ঈশিতার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। ঈশিতার সঙ্গে ওর মা ইয়াসমিন বেগমও সুমনদের বাড়ি চলে এসেছেন। ঈশিতা বিয়ের আগেই সুমনকে বলেছিল, তার মাকেও তার সঙ্গে এনে রাখার কথা। কারণ, ঈশিতা ছাড়া এ জগতে ইয়াসমিন বেগমের আর কেউ নেই। এই বয়সের একজন মহিলা কী করে একা-একা থাকবেন?

সুলতানা বেগমও তাতে কোনও আপত্তি জানাননি। ভেবে দেখেন, সত্যিই তো একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়ে, বয়স্কা, অসুস্থ একজন মহিলার পক্ষে একা থাকা সম্ভব নয়। তাঁদের সঙ্গে থাকলে তাতে তো কোনও সমস্যা নেই। বরং সুলতানা বেগম তাঁর সমবয়সী একজন সঙ্গী পাবেন।

ঈশিতার মাকে নিয়ে সুলতানা বেগমদের চারজনের সংসার অত্যন্ত আনন্দেই কাটছে। ইয়াসমিন বেগম আর সুলতানা বেগম যেন মানিকজোড় হয়ে উঠেছেন। সারা দিনই দু’জনকে একসঙ্গে পাওয়া যায়। হয়তো গুটুর-গুটুর গল্প করছেন, নয়তো টিভিতে সিরিয়াল দেখছেন। না হয় বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে একসঙ্গে চা পান করছেন। না হয় দু’জন মিলে নতুন কোনও আইটেম রান্না করছেন। অথবা পিঠা বানাচ্ছেন। না হয় দু’জন মিলে ঘর গোছাচ্ছেন। একসঙ্গে বাজার করতে চলে যাচ্ছেন। খাওয়ার সময়ও তাঁরা একসঙ্গে খেতে বসেন। একজনকে রেখে অন্যজন কখনওই খান না। রাতে ঘুমানও একসঙ্গে। অথচ দু’জনেরই আলাদা- আলাদা রুম আছে। তিনটি বেডরুমের একটি ঈশিতা আর সুমনের। অন্য দুটো তাঁদের দু’জনের।

সংসারের পুরো দায়িত্ব দুই বেয়ান ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। আর ঈশিতা শুধু মাত্র তাঁদের দু’জনের সাহায্যকারী হিসেবে পাশে থাকে। সুমনের দায়িত্ব শুধু সুবোধ বালকের মত আটটা-পাঁচটা অফিস করা। চারজন মিলে মিশে বেশ সুখেই আছে তারা।

প্রথম দেখায়ই সুলতানা বেগমের কাছে ইয়াসমিন বেগমের মুখটা খুব পরিচিত ঠেকেছিল। তখন তিনি ধরতে পারেননি অমন পরিচিত মনে হওয়ার কী কারণ। পরে ধীরে-ধীরে ব্যাপারটা ধরে ফেলেন। ইয়াসমিন বেগমের চেহারার সঙ্গে সুলতানা বেগমের স্বামী আমজাদ হোসেনের চেহারার অনেক মিল রয়েছে। যেন এক মায়ের পেটের ভাই-বোন। শুধু ভাই-বোন বললেও ভুল হবে, যেন যমজ ভাই-বোন। দু’জনের চেহারায় যতটুকু পার্থক্য তা যেন একজন নারী, অন্যজন পুরুষ হওয়ায়।

সুলতানা বেগম তাঁর স্বামীর সঙ্গে ইয়াসমিন বেগমের চেহারার মিল ধরার পর ভেবেছিলেন, হয়তো ইয়াসমিন বেগম তাঁর স্বামীর দিকের কোনও আত্মীয়া। লতায়-পাতায় পেঁচানো দূর সম্পর্কের কোনও আত্মীয়াও তো হতে পারেন। সে কারণেই হয়তো তিনি চিনতে পারেননি। কিন্তু বিষয়টা সম্পর্কে ইয়াসমিন বেগমকে জিজ্ঞেস করে এবং তাঁর স্বামীর দুই ভাইয়ের কাছ থেকে এমন কোনও তথ্য পাননি যে ইয়াসমিন বেগম তাঁর স্বামীর দিকের কোনও আত্মীয়া। তবে ফটো অ্যালবামে আমজাদ হোসেনের ছবি দেখে ইয়াসমিন বেগম কেমন ভাবনায় ডুবে গিয়ে বলেছেন, এই লোকটিকে তিনি কোথায় যেন দেখেছেন। অনেকবার দেখেছেন। কিন্তু মনে করতে পারছেন না, কোথায় দেখেছেন।

চার

সন্ধ্যা হচ্ছে। চারদিকে শান্ত নীরবতা। সমস্ত আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে থমথম করছে। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই বোধহয় প্রবল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবে।

গত কয়েক দিন ধরে খুব গরম পড়ছে। তীব্র তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ। আকাশে কালো মেঘ জমতে দেখে সবার মনে এক ধরনের ফুরফুরে ভাব চলে এসেছে।

সুলতানা বেগম আর ইয়াসমিন বেগম বারান্দায় বসে মেঘে ঢাকা আকাশ দেখতে-দেখতে চা পান করছেন। ইয়াসমিন বেগমের মুখটা মেঘে ঢাকা আকাশের মতই ভার হয়ে আছে।

সুলতানা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘বেয়ান, আপনার মুখটা অমন ভার কেন? কোনও কারণে কি আপনার মন খারাপ?’

ইয়াসমিন বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আকাশে মেঘ জমতে দেখলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়।’

সুলতানা বেগম অবাক গলায় বললেন, ‘আকাশে মেঘ জমেছে বলে আপনার মন খারাপ হবে কেন? তাতে তো মন আরও ভাল হয়ে যাবার কথা। কত দিন পর স্বস্তির বৃষ্টি আসছে।’

ইয়াসমিন বেগম বললেন, ‘একটা সময় ছিল যখন আকাশে মেঘ জমতে দেখলে আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হত না। ঝড়-বৃষ্টি মানেই গ্রামের বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টির ঝম-ঝম শব্দ। উঠানে নেমে বৃষ্টি-স্নান। বাগানে আম কুড়াতে যাওয়া। পুকুরের পাড় বেয়ে উপরে উঠে আসা ডিমওয়ালা কৈ মাছ ধরা। এসব কারণে মায়ের বকুনি শোনা। ঘরে ফিরে ভেজা কাপড় পাল্টে গরম ধোঁয়া ওঠা আদা চায়ের সঙ্গে ঝাল-ঝাল মুড়ি-চানাচুর ভর্তা খাওয়া। খিচুড়ির আয়োজন করা। আরও কত কী!’

সুলতানা বেগম বললেন, ‘এখন তা হলে বৃষ্টি আসতে দেখে মন খারাপ করছেন কেন?’

‘একটা ঘটনার পর ঝড়-বৃষ্টি আমার কাছে অভিশাপ হয়ে গেছে।’

সুলতানা বেগম অবাক গলায় বললেন, ‘কী এমন ঘটনা! ঝড়-বৃষ্টিকে অভিশাপ মনে হবে কেন?’

‘এক ঝড়বৃষ্টির রাতের কথা। রাত দশটা-সোয়া দশটার মত বাজে। রাত দশটা-সোয়া দশটা মানেই গ্রামে অনেক রাত। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে বছরই আমি এস. এস. সি. পাশ করেছিলাম। এস. এস. সি পাশের পর বাবার কড়া নির্দেশ ছিল, আমি যেন আগের মত আর ঝড়-বৃষ্টি দেখলেই আম কুড়াতে না নেমে পড়ি। তাই বাবার ভয়ে দিনের বেলা আম কুড়াতে যেতে পারতাম না। ভাবলাম, সবাই যখন ঘুমিয়ে রয়েছে-এই সুযোগে আম কুড়াতে যাওয়া যায়। চুপি-চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। সে কী ঝড়-বৃষ্টি! বিকট শব্দে আশপাশে বাজ পড়ছে। একেকবার বাজ পড়ার শব্দে যেন পুরো পৃথিবী কেঁপে-কেঁপে উঠছিল। আমি সেই ঝড়-বৃষ্টির মাঝেই গুটি-গুটি পায়ে হেঁটে চলে যাই একটু দূরের পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে। কারণ, ওই বাড়িতে অনেকগুলো বড়-বড় আমগাছ ছিল। অনেক আম পাওয়া যাবে ওখানে।

‘ধারণা সঠিক হয়। সত্যিই জমিদার বাড়ির বাগানে অনেকগুলো আম পাওয়া যায়। সঙ্গে দুটো ঝুড়িও নিয়ে গিয়েছিলাম। দুটো ঝুড়িই ভরে যায়। এত ওজন হয় যে আমার পক্ষে বাড়ি পর্যন্ত বয়ে নেয়া সম্ভব নয়। মাথায় বুদ্ধি আসে, জমিদার বাড়ির কাছারি ঘরটার মাঝে লুকিয়ে রেখে গেলে কেমন হয়। সকালে ধলু কাকুকে পাঠিয়ে আনাব। ধলু কাকু হচ্ছেন আমাদের বাড়ির কামলা। দাদার আমল থেকেই আমাদের বাড়িতে কামলার কাজ করতেন। আমি কিছু বললে তিনি না করবেন না। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আর বাবাকেও জানাবেন না যে, আমি রাতে চুপি-চুপি আম কুড়াতে এসেছিলাম।

‘জমিদার বাড়ির চিহ্ন বলতে একমাত্র ওই কাছারি ঘরটাই ছিল। তা-ও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে কোনও মতে কাঠামোটা দাঁড়িয়ে ছিল। ভিতরে রাজ্যের নোংরা। মাকড়সার ঝুল, ইঁদুর-তেলাপোকার নাদ, বাদুড়ের বিষ্ঠা, উড়ে আসা শুকনো পাতা, এমনকী দিনের বেলায় আশ্রয় নেয়া গরু-ছাগলের মলও রয়েছে।

‘ঝুড়ি দুটোকে টেনে-হিঁচড়ে কোনওক্রমে কাছারি ঘরের দিকে নিয়ে যাই। যেই না প্রবেশদ্বার দিয়ে ভিতরে ঢুকতে গেলাম ভয়ানক চমকে উঠি। ভিতরে কারা যেন রয়েছে! গম-গম শব্দ হচ্ছে। প্রবেশদ্বারের পাশে নিজেকে আড়াল করে ভিতরে দেখার জন্য উঁকি মারি। কী আশ্চর্য! ভিতরে তিনজন মানুষ। মানুষ বললে ভুল হবে, তারা মানুষ নয়-অন্য কিছু। অনেক লম্বা। অস্বাভাবিক লম্বা-লম্বা হাত- পা। পিছনে হনুমানের মত লম্বা লেজ। মুখমণ্ডলও হনুমানের মুখের মত লম্বাটে। চোখ দুটো বিড়ালের চোখের মত জ্বলজ্বলে। সমস্ত গা থেকে সবুজাভ দ্যুতি বেরোচ্ছে।

‘প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই। ভয়ে আঁতকে উঠে ‘ও, মা’ বলে চিৎকার দিয়ে ফেলি। আমার মুখ থেকে চিৎকারটা বেরোবার সঙ্গে-সঙ্গে ওই তিনজন চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যায়। তাতে আমার আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। এক মুহূর্তও দেরি না করে হাত থেকে আমের ঝুড়ি ফেলে ঘুরে দৌড় লাগাই। রুদ্ধশ্বাসে পড়িমরি করে দৌড়তেই থাকি। কিন্তু জমিদার বাড়ির সীমানা পেরোবার আগেই কী যেন হয়। স্পষ্ট মনে নেই। এটুকুই মনে আছে চোখ ধাঁধানো নীলচে আলোর তীব্র ঝলকানি দেখতে পাই। যেন সেই আলোর ঝলকানিতে চোখ দুটো ঝলসে যায়। সেই সঙ্গে কান ফাটানো বিকট ভয়ানক শব্দ। কানে তালা লেগে যায়। নিমিষে সমস্ত অনুভূতি হারিয়ে ফেলি।’

ইয়াসমিন বেগমের বলা থামতেই সুলতানা বেগম অত্যন্ত আগ্রহী গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর, তারপর কী হলো? আপনার ওপর কি বজ্রপাত হয়েছিল?’

ইয়াসমিন বেগম আবার বলতে লাগলেন, ‘হতে পারে। গায়ে বজ্রপাত হওয়ার কী অনুভূতি তা তো আমার জানা নেই। যখন আমার জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে পাই আমার শোবার ঘরের বিছানায়। মা আমার কপালে জলপট্টি দিচ্ছেন। আমাকে ঘিরে রয়েছে আত্মীয়-স্বজন সহ আশপাশের প্রতিবেশীরা অনেকেই।

‘চোখ মেলতেই সবাই কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করতে থাকে, কী হয়েছিল আমার? আমি ওই জমিদার বাড়িতে কখন গিয়েছিলাম? জমিদার বাড়ির কাছারি ঘরের মধ্যে কী কাজ ছিল? কী ঘটেছিল ওখানে? ওখানে এত রক্ত এল কোত্থেকে?

‘আমি সব কিছু বললাম। মানে, আম কুড়াতে গিয়ে যা- যা ঘটেছিল সব।

‘অনেকে দেখলাম ভয় পেয়ে বুকে থু-থু দিল। সবাই বলাবলি করতে শুরু করল, জিনের খপ্পরে পড়েছিলাম আমি। কপাল ভাল বলে বেঁচে ফিরতে পেরেছি।

‘একজন চোখ বড় করে বলে উঠল, জমিদার বাড়ির কাছারি ঘরের মেঝেতে এত রক্ত এল কোত্থেকে? যেন ওখানে গরু জবাই দেয়া হয়েছে! অথচ ইয়াসমিনের গায়ে কোনও কাটা ক্ষত নেই। তা হলে ওই রক্ত কার? জিনের রক্ত না তো?

‘কেউ-কেউ আমাকে শাসাতে শুরু করল, কতবার বারণ করা হয়েছে, রাত-বিরাতে যেন আম কুড়াতে না যায়। শুনল না, কোনও কথা শুনল না। শেষ পর্যন্ত জিনের কবলে পড়ল! কপাল ভাল যে বেঁচে ফিরেছে…

‘উপস্থিত সবাই যে যার মত কথাবার্তা বলতে থাকে। আর মা আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কেঁদে-কেটে ব্যাকুল হয়।’

সুলতানা বেগম বলে উঠলেন, ‘কাছারি ঘরের ভিতরে গরু জবাই দেবার মত রক্ত পড়ে ছিল মানে?’

ইয়াসমিন বেগম বলতে লাগলেন, ‘আমি তো আর দেখিনি, সবার কাছে যা শুনেছি। সেদিন ভোর বেলা আমাকে ঘরে না দেখে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। সারা গ্রামে খোঁজা হয়। শেষতক জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত কাছারি ঘরের ভিতরে গিয়ে অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে পড়ে থাকতে দেখে। পোশাকবিহীন-উলঙ্গ। আমার সারা গায়ে রক্ত মাখা। যেখানটায় পড়ে ছিলাম পুরো জায়গা গরু জবাই দেবার মত রক্তে ভেজা। অথচ আমার গায়ে কোনও কাটা ক্ষত ছিল না। তাই ওই রক্ত কোত্থেকে এসেছে, কীসের রক্ত-সেটা সবার কাছে ভয়ানক রহস্যময় বলে মনে হয়।’

সুলতানা বেগম বললেন, ‘সেদিন ঝড়-বৃষ্টির রাতে আম কুড়াতে গিয়ে অমন একটা ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন বলেই কি আপনার এখন আর ঝড়-বৃষ্টি ভাল লাগে না?

‘সেটা তো আছেই, তার সঙ্গে আরও কিছু ব্যাপার রয়েছে। ওই রাতের ঘটনা ওখানেই শেষ হলে তো আর কোনও কথাই ছিল না। ওই ঘটনার পর আমার জীবনটাই বদলে যায়। আমার চেহারা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ সব কিছু বদলে যায়। যেন আমি অন্য মানুষ হয়ে যাই। আমার চেহারায় পুরুষালী ছাপ আসে। মাথা যন্ত্রণার রোগ দেখা দেয়। প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা! যার কি না আগে মাথা ব্যথা জাতীয় কোনও রোগই ছিল না। যন্ত্রণাটা সব সময় নয়, শুধু ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলেই। ব্যথার তীব্রতা এতই হয় যে আমি পাগলের মত আচরণ করি। উদ্ভট, উল্টো-পাল্টা কথা বলি। যে কথার মানে কেউ-ই বোঝে না। নিজের পরিচয় পর্যন্ত ভুলে যাই। আপনজনদেরও চিনতে পারি না। গলার স্বরও পরিবর্তন হয়ে পুরুষালী হয়ে যায়। নিজেকে নাকি তখন অন্য মানুষ বলে দাবি করি। অবশ্য ওই সময়ের কোনও কিছুই আমার পরবর্তীতে মনে থাকে না। অন্যের মুখ থেকে যেটুকু শুনেছি। এ কারণেই ঝড়-বৃষ্টি আসতে দেখলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়।

সুলতানা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসব ঘটনা কি. আপনার বিয়ের আগের? না পরের?’

‘বিয়ের আগের। গ্রামে আমার সম্পর্কে বিভিন্ন রটনা রটে যায়। আমার উপর খারাপ জিন ভর করেছে, তাই আমার চেহারা পুরুষালী হয়ে গেছে। ঝড়-বৃষ্টির সময় আমার মধ্যে জিনের অস্তিত্বটা আরও প্রকট রূপে জেগে ওঠে বলে আমি অচেনা পুরুষ কণ্ঠে কথা বলি। আরও কত কী! আমার বাবা-মা চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। জিনে আছর হওয়া মেয়েকে কে বিয়ে করবে? বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় বাড়ি-ঘর-সহায়-সম্পত্তির লোভে একটা ছেলে জুটে যায়। ওই ঘটনার দুই মাসের মধ্যেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের দশ দিনের মাথায় আমার শাশুড়ি ধরে ফেলে আমি অন্তঃসত্ত্বা। যেন কেয়ামত নেমে আসে! বিয়ের দশ দিনের মধ্যে কারও অন্তঃসত্ত্বা হবার কথা নয়। হলেও তা কারও বোঝার কথা নয়। আমাকে নষ্টা-ভ্রষ্টা বলে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।

‘গর্ভবতী হওয়ার সাত মাসের মাথায় ঈশিতার জন্ম হয়। বাবা-মা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন ঈশিতাকে নিয়ে তাদের সাথেই ছিলাম। তাদের মৃত্যুর পর গ্রামের জায়গা-জমি, বাড়ি-ঘর বিক্রি করে মেয়েকে নিয়ে শহরে চলে আসি 1 ঈশিতার বাবা আর কোনও দিনও খোঁজ নেয়নি। সে ঈশিতাকে নিজের সন্তান বলেই স্বীকার করত না।’

সুলতানা বেগম কিছুটা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘বিয়ের সাত মাসের মাথায় যে সন্তানের জন্ম হয়, সে সন্তানকে কোনও বাবারই নিজের সন্তান হিসেবে স্বীকার করার কথা নয়।

ইয়াসমিন বেগম ফোঁত-ফোঁত করে কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, ‘বিশ্বাস করুন, বেয়ান, আমার জীবনে একমাত্র পুরুষ ঈশিতার বাবাই এসেছিল!’

সুলতানা বেগম আর কিছুই বললেন না। অপলক চোখে ইয়াসমিন বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই চোখে খানিকটা · বিস্ময়, খানিকটা অবিশ্বাস আর খানিকটা সহমর্মিতার সম্মিলন।

.

রাত সোয়া এগারোটা।

বাইরে ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। ইয়াসমিন বেগমের মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। তিনি পাগলের মত আচরণ করছেন। পুরুষালী গলায় একেকবার আবোল-তাবোল চিৎকার দিয়ে উঠছেন। তাঁর সেই পুরুষালী গলার স্বর শুনে সুলতানা বেগম চমকে-চমকে উঠছেন। কারণ, ওই পুরুষালী গলার স্বরটা তাঁর খুবই পরিচিত। তাঁর স্বামী আমজাদ হোসেনের গলার স্বরও এমন ছিল। যেন ইয়াসমিন বেগম নন, তাঁর স্বামী আমজাদ হোসেন চিৎকার করছেন।

পাঁচ

বৈশাখ মাস পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠ মাস চলছে। দু’এক দিন বাদে- বাদেই ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইয়াসমিন বেগমের মাথা ব্যথা দেখা দিচ্ছে।

মাথা যন্ত্রণার মুহূর্তে ইয়াসমিন বেগমের কিছু আচরণ সুলতানা বেগমকে চরম ভাবিয়ে তুলেছে। তিনি এর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না।

এর মধ্যে একদিন ইয়াসমিন বেগমের মাথা ব্যথা শুরু হবার পর সুলতানা বেগম কাছে গেলে পুরুষালী গলায় বলে ওঠেন, ‘সুলতানা, তুমি এতদিন পর আমাকে দেখতে এসেছ?’

সুলতানা বেগম স্থবিরের মত থমকে গিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন। যেন কথাটা বাইশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া তাঁর স্বামী আমজাদ হোসেন বলেছেন।

ইয়াসমিন বেগম আবার পুরুষালী গলায় বলেন, ‘সুলতানা, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি তোমার আমজাদ, ‘আম’। ভুলে গেছ, তুমি দুষ্টুমি করে আমাকে ‘আম’ বলে ডাকতে। আর আমি তোমাকে ‘সু- লতা’ বলে। সে কথা তোমার মনে নেই?’

সুলতানা বেগম কেঁপে ওঠেন। তাঁর হাত-পায়ের তালু, কপাল ঘামতে শুরু করে। সত্যিই তিনি তাঁর স্বামীকে দুষ্টুমি করে মাঝে-মাঝে ‘আম’ বলে ডাকতেন। আর তাঁর স্বামী তাকে ‘সু-লতা’ বলে ডাকতেন। এ ব্যাপারটা তো কোনওভাবেই ইয়াসমিন বেগমের জানার কথা নয়! কারওই জানার কথা নয়।

শুধু তা-ই নয়, মাথা ব্যথার সময় ইয়াসমিন বেগম নিজেকে আমজাদ হোসেন বলে দাবি করেন। এবং আমজাদ হোসেনের সব কথাই গড়-গড় করে বলতে পারেন। খুব গোপন কথাও। মানে যা কিছু শুধু আমজাদ হোসেনের জানার কথা। যেন সেই মুহূর্তে ইয়াসমিন বেগমের উপর আমজাদ হোসেনের আত্মা ভর করে।

সুলতানা বেগম কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছেন না। ইয়াসমিন বেগম কেন তাঁর স্বামীর মত করে কথা বলবেন? এর পেছনে কী রহস্য?

সুলতানা বেগম ঈশিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এর আগেও কি মাথা যন্ত্রণা শুরু হলে তার মা এই একই গলার স্বরে কথা বলতেন? নিজেকে আমজাদ হোসেন বলে দাবি করতেন?

ঈশিতা বলেছে, হ্যাঁ। এই গলার স্বরেই কথা বলতেন। নিজেকে অন্য একজন বলে দাবি করতেন। তবে আমজাদ হোসেন বলে দাবি করতেন কি না তা কখনও সেভাবে খেয়াল করে দেখেনি। তবে এটা তার মনে আছে, মাথা খারাপের মুহূর্তে সে তার মায়ের মুখে বহুবার সুলতানা, সু- লতা নামটা শুনেছে।

ইয়াসমিন বেগম নিজেকে আমজাদ হোসেন দাবি করার এক মুহূর্তে সুলতানা বেগম তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা, সত্যিই যদি আপনি আমজাদ হোসেন হন, তা হলে বলুন তো বাইশ বছর আগে আপনি কোথায় হারিয়ে গেছেন? কীভাবে হারিয়ে গেছেন? সেদিন কত তারিখ ছিল?’

ইয়াসমিন বেগম আমজাদ হোসেনের মত গলার স্বরে জানান, ‘সেদিন ছিল ১১ই বৈশাখ। আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর দিন ছিল। ভোরবেলায় বিয়ের শাড়ি পরে সেজে- গুজে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়েছিলে তুমি। খিচুড়ি রান্না করেছিলে। আমি পাঞ্জাবি পরে অফিসে গিয়েছিলাম। সঙ্গে সুমনকে নিয়ে, ওকে স্কুলে পৌঁছে দেবার জন্য। তোমার হাতে পাঁচশো টাকা দিয়ে গিয়েছিলাম ভাল-মন্দ বাজার করে রান্না করার জন্য। তুমি আমাকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি আসার অনুরোধ করেছিলে।’

সুলতানা বেগম বিস্ময়ে যেন বোবা হয়ে যান। সেই সঙ্গে বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে ওঠে। দু’চোখ বেয়ে টপ-টপ করে অশ্রু ঝরতে থাকে। তিনি চোখ মুছতে-মুছতে বুজে আসা গলায় কোনওক্রমে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি তা হলে সেদিন কেন তাড়াতাড়ি এলে না? আর কোনও দিনই তো ফিরে এলে না!’

ইয়াসমিন বেগম আবার আমজাদ হোসেনের গলার স্বরে বলতে থাকেন, ‘বরাবরের মত সেদিনও অফিসের বস সোয়া ন’টার আগে ছাড়লেন না। অফিস থেকে বেরিয়েই মার্কেটে চলে গেলাম তোমার জন্য একটা শাড়ি আর সুমনের জন্য খেলনা কিনতে। কেনা-কাটা শেষে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি দমকা হাওয়া ছেড়েছে। ঘন-ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবে। রাস্তা-ঘাট একেবারে ফাঁকা। যাওয়ার জন্য একটা খালি রিকশা বা বেবি ট্যাক্সি কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। জোরে-জোরে পা চালিয়ে হাঁটতে শুরু করি। যে করেই হোক ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবার আগে বাসায় পৌঁছতে হবে। কিন্তু পথের মাঝেই হঠাৎ প্রবল ঝড় শুরু হয়ে যায়। রাস্তার সব ধুলো-বালি, পলিথিনের টুকরো, কাগজের টুকরো ঘূর্ণির মত উড়তে শুরু করে। মুহূর্তের জন্য চোখের সামনে কিছুই দেখতে পাই না। একটু নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় দিগ্বিদিক্ হারিয়ে ছুটতে শুরু করি। এসময় উপর থেকে ইলেকট্রিক তার ছিঁড়ে এসে গায়ে পড়ে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃগী রোগীর মত কাঁপতে-কাঁপতে অনুভূতি হারাই।

‘যখন আবার ক্ষণিকের জন্য নিজেকে ফিরে পাই, তখন দেখি আমি এক অন্ধকার কামরায়। আমাকে ঘিরে অদ্ভুত চেহারার তিনজন মানুষ। অনেক লম্বা। লম্বা-লম্বা হাত-পা। জ্বলজ্বলে চোখ।- পিছনে লম্বা লেজ। তাদের গা থেকে সবুজাভ আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছে। তারা আমার পেটটা চিরে ফেলেছে। বুক থেকে নাভির নিচ পর্যন্ত লম্বালম্বিভাবে চিরেছে। মাথার খুলিও কেটে ফেলেছে। আমার পাশে আরও একজন শোয়ানো ছিল। একজন মহিলা। তারও আমার মত বুক থেকে নাভির নিচ পর্যন্ত চিরে ফেলা হয়েছে। মাথার খুলিও কেটে ফেলেছে। সবই দেখছিলাম কিন্তু নড়াচড়া বা কথা বলার মত কোনও ক্ষমতা ছিল না। তারা তিনজন আমাদের দু’জনেরই চেরা পেটের মাঝে হাত ঢুকিয়ে হাতড়াচ্ছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল আমাদের দু’জনের শরীর। ওসব দেখতে-দেখতেই আবার চেতনাশূন্য হয়ে পড়ি। এরপর আর কিছু মনে নেই। সেই থেকে হঠাৎ-হঠাৎ মাঝে-মাঝে নিজেকে খুঁজে পাই, আবার যেন কোথায় হারিয়ে যাই।’

ছয়

সুমনের এক বন্ধু ডা. জাহিদ হাসান। বর্তমানে গৌরীপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার। সুমন তার শাশুড়ি ইয়াসমিন বেগমের মাথা যন্ত্রণার সমস্যা নিয়ে ফোনে জাহিদ হাসানের সঙ্গে কথা বলে। সুমনের বন্ধু জাহিদ হাসান পরামর্শ দেয় প্রফেসর ডা. আতিকুর রহমানকে দেখানোর। তিনি একজন নামকরা নিউরোলজিস্ট। মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নের সময় ডা. আতিকুর রহমান জাহিদ হাসানের শিক্ষক ছিলেন। সেই সুবাদে জাহিদ হাসানের সঙ্গে আতিকুর রহমানের বেশ সুসম্পর্ক রয়েছে। জাহিদ হাসান সুমনকে আশ্বাস দেয়, সে তার স্যর আতিকুর রহমানকে অনুরোধ করবে, তিনি যাতে সুমনের শাশুড়িকে বাড়তি যত্ন নিয়ে দেখেন।

সুমন ইয়াসমিন বেগমকে ডা. আতিকুর রহমানের কাছে নিয়ে যায়। ডা. আতিকুর রহমান ইয়াসমিন বেগমের মাথা ব্যথার সমস্যা বিস্তারিতভাবে শুনে মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান সহ কয়েক ধরনের রক্ত পরীক্ষা করাতে দেন। পরীক্ষাগুলোর রিপোর্ট নিয়ে আবার তাঁর কাছে যেতে বলেন।

মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান এবং রক্ত পরীক্ষাগুলোর রিপোর্ট বেরোবার পর, রিপোর্ট নিয়ে সুমন একা আতিকুর রহমানের চেম্বারে যায়। ডা. আতিকুর রহমান গভীর মনোযোগের সঙ্গে রিপোর্টগুলো উল্টে-পাল্টে দেখেন। বেশ কয়েকবার দেখেন। রিপোর্টগুলো দেখতে-দেখতে তাঁর ভুরু কুঁচকে যেতে থাকে। তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। এক পর্যায়ে চিন্তিত গলায় বলেন, ‘সুমন, তোমার মাদার- ইন-ল-র মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান দেখে আমি সাংঘাতিক বিস্মিত। একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মস্তিষ্কের গঠন যে এমন হতে পারে তা আমার কল্পনায়ও ছিল না। যে ডাক্তার তাঁর সিটি স্ক্যান করেছেন, আমি একটু তাঁর সঙ্গে কথা বলে নিতে চাই। এই রিপোর্টটা কি সঠিক, না কোথাও বড় রকমের ভুল হয়েছে?’

সুমন বলে ওঠে, ‘স্যর, সিরিয়াস কিছু নয় তো?’

ডা. আতিকুর রহমান হতাশ গলায় বলেন, ‘আমি কিছু বুঝতেই পারছি না। সেজন্যেই যে ডাক্তার স্ক্যান করেছেন, তাঁর সঙ্গে আগে কথা বলে নিতে চাই।’

ডা. আতিকুর রহমান ফোনে অনেকক্ষণ কথা বলেন। কথা বলা শেষে তাঁর চেহারাটা কেমন বিধ্বস্ত মনে হয়। তাঁর সামনে পিরিচ দিয়ে ঢাকা এক গ্লাস পানি ছিল। তিনি গ্লাসের উপর থেকে পিরিচটা তুলে এক চুমুকে পানিটুকু শেষ করেন। এরপর চেয়ারে হেলান দিয়ে ধীরে-সুস্থে বলেন, ‘যে ডাক্তার সিটি স্ক্যান করেছেন তিনিও আমার মত স্তম্ভিত। তিনিও প্রথমে মনে করেছিলেন কোথাও বড় রকমের ভুল হচ্ছে। এ কারণে একবারের জায়গায় বেশ কয়েকবার স্ক্যান করেন। কিন্তু প্রতিবারই একই রকম দেখা যায়।’

সুমন বলে ওঠে, ‘স্যর, সমস্যাটা আসলে কী?’

ডা. আতিকুর রহমান বলতে থাকেন, ‘সমস্যাটা কী, তোমাকে ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। বলা যায় ওনার মস্তিষ্কের গঠন মোটেই অন্যসব মানুষের মত নয়। একেবারেই আলাদা। যেন মানুষের মস্তিষ্কের আদলে নাম না জানা ভিন্ন কোনও প্রাণীর মস্তিষ্ক। তাঁর মস্তিষ্কের সেরিব্রাম, থ্যালামাস, হাইপোথ্যালামাস, সেরিবেলাম, পন্‌স, মেডুলা, মিড ব্রেনের সেরিব্রাল পেডাঙ্কল, কর্পোরা কোয়াড্রিজেমিনা, সেরিব্রাল অ্যাকুইডাক্ট, কিছুই অন্যসব মানুষের মত নয়। নার্ভাস সিস্টেম আর সেনসরি অর্গানও সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন। ক্র্যানিয়াল নার্ভ সাধারণ মানুষের থাকে ১২ জোড়া, তাঁর রয়েছে ২২ জোড়া। সবচেয়ে বড় অস্বাভাবিকতা মস্তিষ্কের সেরিব্রাল আর সেরিবেলামে। মস্তিষ্কের দুটো ভাগ আছে। বাদামের মাঝখান দিয়ে বিভক্ত দুই অংশের মত সমানভাবে দুই দিকে বিভক্ত দুটি অংশ। এই বিভক্ত দুই অংশকে দুই বলয় বলা হয়। ডান বলয়, বাম বলয়। দুই বলয় বিভক্ত থাকলেও স্নায়ুতন্তুর গোছা দ্বারা সংযুক্ত থাকে। যেমন সেরিব্রাল অংশ সংযুক্ত থাকে কপার্স কলোসাম নামে স্নায়ুতন্ত্রর গোছা দ্বারা। মস্তিষ্কের বড় অংশ সেরিব্রাম দুই বলয়ে সংযুক্ত থাকে সাদা স্নায়ুর গোছা দ্বারা। সেরিবেলাম নিউক্লি অংশ সংযুক্ত থাকে ভেরমিস দ্বারা। কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কের দুই বলয় সংযোগহীন-একেবারে আলাদা। কোনও ধরনের স্নায়ুতন্তুর গোছা দ্বারাই সংযুক্ত নয়। যেন দুই বলয় স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে। এটা আদৌ সম্ভব কি না মেডিকেল সায়েন্সে এমন কোনও প্রমাণ নেই। তাঁর মস্তিষ্কের এই অস্বাভাবিক গঠন দেখে আমার পুরো মাথা ঘুরে গেছে। এমনটা কী কারণে হয়েছে? এমন কি হতে পারে, শরীরের অন্য কোনও সমস্যার কারণে, মস্তিষ্কে প্রভাব পড়েছে? অথবা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কোনও ভাইরাসের আক্রমণে মস্তিষ্কের গঠনে ওধরনের পরিবর্তন হয়েছে? এক কাজ করি, তাঁর পুরো বড়ির সব ধরনের মেডিকেল চেক-আপ করিয়ে দেখি সমস্যাটা ধরতে পারি কি না।’

.

ইয়াসমিন বেগমের পুরো শরীরের সব ধরনের মেডিকেল চেক-আপ করানো হয়। সেই রিপোর্ট দেখে ডা. আতিকুর রহমান আরও চমকে যান। রিপোর্ট নির্দেশ করছে, ইয়াসমিন বেগমের শরীরের ভিতরের সমস্ত অর্গান কোনও এক সময় ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়েছিল। লিভার, কিডনি থেকে শুরু করে হার্ট, লাং, গলব্লাডার, প্যানক্রিয়াস-সব! সব কিছু যেন অন্যের শরীর থেকে এনে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। মস্তিষ্কেও অস্ত্রোপচার হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। একেবারেই অবিশ্বাস্য। মেডিকেল সায়েন্স এখনও এতটা অগ্রসর হয়নি যে একজনের দেহের সমস্ত অর্গান আরেকজনের দেহে প্রতিস্থাপন করা যাবে। তবে ইয়াসমিন বেগমের শরীরে কোনও অপারেশনের দাগ পাওয়া যায়নি। যেন অলীক কোনও উপায়ে তাঁর দেহের ভিতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

ডা. আতিকুর রহমান হাল ছেড়ে দেয়া গলায় সুমনকে জানান, ‘তোমার মাদার-ইন-ল-র ব্যাপারটা আমি কিছুই ধরতে পারছি না! সম্ভবত এ দেশের কোনও ডাক্তারই তাঁর রোগ বুঝতে পারবে না। দেশের বাইরে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক অথবা আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে দেখতে পারো। তাদের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। তারা হয়তো বুঝতেও পারে।’

সাত

গত রাতে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। বরাবরের মত ইয়াসমিন বেগমের মাথা ব্যথাও তীব্র রূপ নিয়েছিল। সেই সঙ্গে পাগলামিও। ডা. আতিকুর রহমানের প্রেসক্রাইব করা কড়া ডোজের ঘুমের ইনজেকশন দিয়েও তাঁকে শান্ত করা যাচ্ছিল না। সারা রাত যন্ত্রণাকাতর পশুর মত ছটফট করেন। শেষ রাতের দিকে কিছুটা স্বাভাবিক হন। সেই সুযোগে বাড়ির অন্যরা ঘুমিয়ে পড়েছিল।

সকালে সবার প্রথমে ঘুম ভাঙে সুলতানা বেগমের। ঘুম ভাঙতেই তিনি ইয়াসমিন বেগমের খোঁজ নিতে তাঁর রুমে চলে যান। গিয়ে দেখেন, রুমে ইয়াসমিন বেগম নেই। বাথরুমে, রান্নাঘরে, বসার ঘরে-সব জায়গায় খোঁজ করেন। কোথাও তাঁকে দেখতে পান না। সুলতানা বেগমের চোখ পড়ে বাসার সদর দরজায়। দরজার ছিটকিনি খোলা। দরজা ভেজানো। বুঝতে দেরি হয় না, দরজা খুলে ইয়াসমিন বেগম বাইরে গেছেন। চিন্তিত হয়ে পড়েন, অসুস্থ একটা মানুষ একা-একা কোথায় গেলেন? কখনও তো এভাবে না বলে কোথাও যাননি!

সুলতানা বেগম সুমন আর ঈশিতাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। ইয়াসমিন বেগম যে বাসায় নেই তাদেরকে জানান। দেরি না করে সুমনকে ইয়াসমিন বেগমের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে বলেন।

সুমন তাদের পাশের ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে সম্ভাব্য সব জায়গায় ইয়াসমিন বেগমের খোঁজ করে। কোথাও তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। রাত নেমে আসে। রাত্রি গভীর হয়। সুলতানা বেগমের কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না।

শেষমেশ পরের দিন ভোরে থানায় মিসিং ডায়েরি করা হয়। মাইকিং করে সারা শহরে নিখোঁজ সংবাদ জানানো হয়। খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। বিভিন্ন হাসপাতালেও খোঁজ নেয়া হয়।

এত কিছুর পরও ইয়াসমিন বেগমের কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না। যেন জলজ্যান্ত মানুষটা একেবারে গায়েব হয়ে গেছেন।

আট

ইয়াসমিন বেগম নিখোঁজ হওয়ার পর তিন মাস পেরিয়ে গেছে।

অফিস থেকে ফেরার পথে সুমনের সঙ্গে তার বন্ধু ডা. জাহিদ হাসানের দেখা হয়ে যায়। দুই বন্ধু একসঙ্গে একটা কফি হাউসে ঢুকেছে। তারা দু’জন গরম ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিতে-দিতে গল্প করছে।

জাহিদ হাসান জিজ্ঞেস করল, ‘তোর শাশুড়ির আর কোনও খোঁজই পেলি না?’

সুমন বলল, ‘না, অনেক চেষ্টা করেছি, চেষ্টার কোনও কমতি রাখিনি। কিন্তু কোথাও তাঁর খোঁজ পাওয়া গেল না।’

জাহিদ হাসান সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলল, ‘ভেরি স্যাড!’

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর জাহিদ হাসান আবার বলতে লাগল, ‘তোর শাশুড়ি মেডিকেল সায়েন্সের ইতিহাসে বিরল এক উদাহরণ ছিলেন। আতিকুর রহমান স্যরের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাঁর মত ঘাগু ডাক্তার তোর শাশুড়ির মেডিকেল রিপোর্ট দেখে সাংঘাতিক ভড়কে গিয়েছিলেন। তাঁর মেডিকেল রিপোর্ট যা নির্দেশ করে, বলা যায় এতদিনের অত্যাধুনিক মেডিকেল সায়েন্সকে স্রেফ ভেলকি দেখানো হয়েছে। আতিকুর রহমান স্যর তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহে তোর শাশুড়ির ব্লাড স্যাম্পল দিয়ে আরও একটা পরীক্ষা করিয়েছিলেন। ডি. এন. এ. পরীক্ষা। সেটা তোকে জানানো হয়নি। তাঁর দৈহিক গঠন বৈশিষ্ট্যের মত ডি. এন. এ.-র গঠন বৈশিষ্ট্যও অন্য সব মানুষের চেয়ে আলাদা। প্রত্যেক প্রাণীর ক্রোমোজোমে দ্বি সূত্রক বিশিষ্ট পেঁচানো এই ডি. এন. এ. থাকে। মানে ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড। যেটাকে বংশগতি বৈশিষ্ট্যের বাহক বলা হয়। এর প্রধান গাঠনিক উপাদান, ডি-অক্সিরাইবোজ সুগার, অজৈব ফসফেট ও অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন থায়ানিন নামের নাইট্রোজেন বেস। তাঁর ক্রোমোজোমের ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিডের গঠন উপাদানে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কিছু রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যা পৃথিবীর অন্যসব মানুষ বা কোনও প্রাণীর ক্রোমোজোমে এর আগে পাওয়া যায়নি। জনন কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা ৪৬ জোড়া, যেখানে সাধারণ প্রতিটি মানবদেহের জনন কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা থাকে ২৩ জোড়া, যার মধ্যে ২২ জোড়া অটোজোম আর এক জোড়া সেক্স ক্রোমোজোম। পুরুষদের থাকে XY সেক্স ক্রোমোজোম। আর নারীদের সেক্স ক্রোমোজোম XX। তাঁর ডি. এন. এ. নির্দেশ করে নারী-পুরুষ দুই ধরনের সেক্স ক্রোমোজোমই তাঁর রয়েছে। বলা যায় কেঁচোর মত। একটি কেঁচোর যেমন নারী-পুরুষ দুই ধরনের সেক্স ক্রোমোজোম থাকে। কেঁচোরা অন্য সব প্রাণীর মত আলাদা-আলাদা ভাবে নারী-পুরুষ হয় না।’

সুমন কিছুটা বিরক্ত স্বরে বলে উঠল, ‘এসব আমাকে বলে কোনওই লাভ হচ্ছে না। তোর ওই সায়েন্সের কচকচানি কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। তবে এটা বুঝতে পারছি, আমার শাশুড়ির মধ্যে বড় রকমের কোনও সমস্যা ছিল।’

জাহিদ হাসান বলল, ‘আচ্ছা, বাদ দে, তোর নিজের কথা বল। ভাবী কেমন আছে? তার, মা নিখোঁজ হওয়ায় নিশ্চয়ই সে মানসিকভাবে অনেক ভেঙে পড়েছিল?’

সুমন বলল, ‘হ্যাঁ, অনেক ভেঙে পড়েছিল। এখন অনেকটাই সামলে উঠেছে।’

জাহিদ হাসান বলল, ‘আচ্ছা, তোদের দাম্পত্য জীবন কেমন চলছে?’

সুমন বলল, ‘ভাল। খুব ভাল। ঈশিতা দেখতে যেমন রূপবতী, তেমনি গুণবতীও। রান্না-বান্না সহ সাংসারিক সব কাজেই অত্যন্ত পারদর্শী। তবে ওর কিছু ব্যাপার আছে, যা আমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তোলে।’

জাহিদ হাসান কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী সেই ব্যাপার?’

সুমন কিছুটা ইতস্তত গলায় বলতে লাগল, ‘ওর চোখের রঙ পরিবর্তন হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় সবার মত চোখের মণি ঘন কালো রঙের থাকলেও মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে চোখের রঙও পরিবর্তন হয়। যেমন ধর, ওর যদি খুব মন খারাপ হয়, তখন চোখের মণি নীলচে রঙ ধারণ করে। যদি খুব আনন্দিত হয়, তবে চোখের মণি গোলাপি রঙ ধরে। যদি হতাশ হয়, তবে চোখের মণি সবুজাভ দেখায়। যদি রেগে যায়, তবে গনগনে আগুনের মত লালচে হয়ে যায়। যদি উদাস হয়ে কিছু ভাবে, তবে মেঘের মত ছাই বর্ণ ধারণ করে। যদি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে, তা হলে ফ্যাকাসে হয়ে যায়।’

জাহিদ হাসান চরম বিস্মিত গলায় বলে উঠল, ‘কী বলছিস! তা-ও আবার সম্ভব নাকি? ভাবী চোখে বিভিন্ন রঙের লেন্স ব্যবহার করে না তো?’

‘না, সে কোনও লেন্স ব্যবহার করে না। শুধু চোখের মাঝেই অস্বাভাবিকতা নয়, আরও কিছু রয়েছে।’

‘সেসব কী?’

ওর মধ্যে চৌম্বকীয় কোনও ব্যাপার আছে। মানে ছোট-খাট ধাতব জিনিসের কাছাকাছি গেলে সেগুলো ছুটে এসে ওর গায়ে লেগে যায়। চুম্বকের আকর্ষণে লোহার জিনিস যেমন চুম্বকের গায়ে লেগে থাকে। যেমন ধর, ও খাবার টেবিলে খেতে বসেছে, একটু দূরেই একটা টি-চামচ বা কাঁটা চামচ। দেখা যাবে চামচটা ছুটে এসে ওর গায়ে আটকে রয়েছে। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার, অন্ধকারে ওর সমস্ত গা জ্বল জ্বল করে। গা থেকে যেন সবুজাভ আভা বেরোয়। যেমন রেডিয়ামের প্রলেপ দেয়া টিভির রিমোটের বাটন, ইলেকট্রিক সুইচ, তসবি-এসব অন্ধকারে জ্বল-জ্বল করে। চোখের মণিও বিড়ালের চোখের মত জ্বলে। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছি সেদিন, যেদিন ও আমার সামনে চাকু দিয়ে আপেল কাটছিল। অসতর্কতায় হাত কেটে ফেলে। দর-দর করে রক্ত বেরোতে শুরু করে। রক্তের রঙ দেখে বিস্ময়ে আমার চোখ কপালে ওঠে। রক্তের রঙ অন্য সবার মত লাল নয়, নীল রঙের! ঘন নীল।’

জাহিদ হাসান অবিশ্বাসী গলায় বলে উঠল, ‘এসব তুই কী বলছিস?! অন্ধকারে তার গা জ্বল জ্বল করে! তা হলে কি তার শরীরে অতিমাত্রায় ফসফরাস রয়েছে? ফসফরাস অন্ধকারে জ্বল-জ্বল করে। সেই সঙ্গে শরীরে কি ম্যাগনেটও রয়েছে? যে কারণে ধাতব জিনিস তার গায়ে লেগে যায়! আর রক্তের রঙ নীল কী কারণে? কোনও মানুষের রক্তের রঙই নীল হওয়া সম্ভব নয়। রক্তের রঙ লাল হওয়ায় কারণ, রক্তের ভেতরের হিমোগ্লোবিন নামে একটি উপাদান অক্সিজেনকে ফুসফুস থেকে নিয়ে গিয়ে সরাসরি রক্তের মাধ্যমে কোষে পৌঁছে দেয়। হিমোগ্লোবিনকে ভাগ করলে বিলিরুবিন ও বিলিভারডিন ধরনের উপাদান পাওয়া যায়। সেটার পরিমাণ রক্তকে অন্য রঙে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারে। বিলিভারডিনের পরিমাণ বেড়ে গেলে রক্তের রঙ সবুজ হয়ে যায়। যেমন, পাপুয়া নিউ গিনির স্কিঙ্ক নামের এক ধরনের সরীসৃপের রক্ত সবুজ রঙের। আর রক্তে যদি হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতির পরিবর্তে কপার সমৃদ্ধ প্রোটিন হিমোসায়ানিন কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেবার কাজ করে, তা হলে রক্তের রঙ নীল হয়। গভীর সমুদ্রে এক ধরনের অক্টোপাসের খোঁজ পাওয়া গেছে যাদের রক্তের রঙ নীল ওই অক্টোপাসগুলোর মত ভাবীর রক্তেও কি অতিমাত্রায় কপার সমৃদ্ধ প্রোটিন হিমোসায়ানিনের উপস্থিতি রয়েছে?’

সুমন ক্লান্ত গলায় বলল, ‘জানি না! এসব কথা আমি আমার মাকেও জানাইনি। তিনি অনেক শখ করে ঈশিতাকে বউ বানিয়ে এনেছিলেন। এসব শুনলে মনে অনেক কষ্ট পাবেন।’

পরিশিষ্ট

বাইশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আমজাদ হোসেন এক ঝড়-বৃষ্টির গভীর রাতে ফিরে এসেছেন।

বাড়ির সবাই তখন গাঢ় ঘুমে মগ্ন ছিল। কলিংবেলের শব্দে প্রথমে সুলতানা বেগমের ঘুম ভাঙে। তিনি অবাক হয়ে ভাবেন, এত রাতে কে এসেছে?! ঘন-ঘন কলিংবেল বাজতেই থাকে। তিনি সুমন আর ঈশিতাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। সবাই মিলে বসার ঘরে ঢুকে দরজা না খুলে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কে? কে এসেছে? এত রাতে আবার কে এসেছে?’

তাদের মনে ভয় কাজ করে, অত রাতে চোর-ডাকাতও তো আসতে পারে।

দরজার ওপাশ থেকে আগন্তুকের গলার স্বর শোনা যায়। সুমনের বাবা আমজাদ হোসেনের গলার স্বর।

‘সুলতানা, ও, সুলতানা। সুমন, বাবা, ঘুমিয়ে পড়েছিস? তোর মাকে একটু দরজাটা খুলতে বল।’

ঘরের ভিতরে তারা তিনজন ভয়ানক চমকে ওঠে। ভাবে, নিশ্চয়ই ইয়াসমিন বেগম ফিরে এসেছেন। কারণ, ইয়াসমিন বেগম তো মাঝে-মাঝে আমজাদ হোসেনের গলায় কথা বলতেন। বিশেষ করে ঝড়-বৃষ্টির সময়। আজও সেই ঝড়-বৃষ্টির রাত!

দেরি না করে সুলতানা বেগম দরজা খোলেন। দরজা মেলতেই দেখতে পান, দরজার সামনে ইয়াসমিন বেগম নয়, আমজাদ হোসেন দাঁড়িয়ে। চেহারায় বুড়োটে ছাপ পড়েছে। চুলে পাক ধরেছে। মুখ ভর্তি খোঁচা-খোঁচা পাকা দাড়ি। কপালে একটা কাটা দাগ। বাইশ বছর আগে কপালে ওই দাগ ছিল না। কী আশ্চর্য! ইয়াসমিন বেগমের কপালেও হুবহু ওরকম একটা দাগ ছিল।

আমজাদ হোসেনকে দেখে সুলতানা বেগমের মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মত অবস্থা হয়। তার আগেই সুমন তার মাকে ধরে ফেলে। ধরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসায়।

আমজাদ হোসেন দরদ মেশানো গলায় ‘সুলতানা, ও, সুলতানা, কী হলো তোমার? কী হলো?’ বলতে-বলতে ঘরের ভিতরে ছুটে আসেন।

সুলতানা বেগম ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি পান করে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বলেন, ‘আমার কিছুই হয়নি। তার আগে বলো তোমার কী হয়েছিল? এতদিন কোথায় ছিলে?’

আমজাদ হোসেন অসহায়ের মত গলায় বলেন, ‘জানি না আমি কোথায় ছিলাম! বিশ্বাস করো, আমার কিছুই মনে নেই। এটুকুই মনে আছে, আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর দিন ছিল। রাত সোয়া ন’টার দিকে অফিস থেকে বের হই। তোমার জন্য শাড়ি আর সুমনের জন্য খেলনা কিনতে মার্কেটে ঢুকি। কেনাকাটা শেষে ফেরার পথে ভয়ানক ঝড়- বৃষ্টি শুরু হয়। একটা ইলেকট্রিক তার ছিঁড়ে এসে আমার গায়ে পড়ে। ইলেকট্রিক শকের তীব্র যন্ত্রণায় জ্ঞান হারাই। এরপর কয়েক মুহূর্তের জন্য আবার জ্ঞান ফিরে নিজেকে একটা অন্ধকার ঘরে দেখতে পাই। পাশে আমারই মতন অচেতন আর এক মহিলা। আমাদের ঘিরে অদ্ভুত চেহারার তিনজন মানুষ। তাদের গা থেকে সবুজাভ আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছে। তারা আমাদের দু’জনের বুক থেকে নাভির নিচ পর্যন্ত চিরে ফেলেছে…

ইয়াসমিন বেগম আমজাদ হোসেনের অনুকরণে যা-যা বলেছিলেন, সেই বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

সুলতানা বেগম আহত গলায় বলে ওঠেন, ‘ওই তিনজন কারা ছিল? তারা তোমাদের দু’জনকে নিয়ে কী করছিল?’

আমজাদ হোসেন কেমন ভাবনার অতলে হারিয়ে গিয়ে বলতে লাগেন, ‘জানি না তারা কারা ছিল। তবে আমার মনের ভিতর থেকে কেউ যেন বলে উঠছে, তারা এই পৃথিবীর কেউ ছিল না। পৃথিবী থেকে অনেক দূরের কোনও গ্রহ থেকে এসেছিল। তাদের গায়ের রঙ সবুজ। পিছনে বানরের মত লম্বা লেজ ছিল। অন্ধকারে গা থেকে সবুজাভ আলোর দ্যুতি বের হয়। তাদের দৈহিক আকৃতি মানুষের মত হলেও শরীরের ভিতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, মস্তিষ্কের গঠন মোটেই মানুষের মত নয়। রক্তের রঙ নীল। ওই নীল রক্তের মানুষেরা জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দিক দিয়ে আমাদের থেকে অনেক-অনেক গুণ এগিয়ে। সেই ঝড়-বৃষ্টির রাতে বজ্রপাতে এবং ইলেকট্রিক শকে মৃতপ্রায় আমাদের দু’জনকে তারা বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা দেখতে পায়, আলাদা- আলাদাভাবে আমাদের দু’জনের একজনকেও বাঁচানো সম্ভব নয়। তাই তারা দু’জনকে মিলিয়ে একজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। মানে দু’জনের শরীরের যে-যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার উপযোগী মনে হয় সেগুলোকে প্রতিস্থাপন করে একটি শরীর গড়ে তোলে। হাত-পা থেকে শুরু করে শরীরের ভিতরের লিভার-কিডনি সবই। বলা যেতে পারে দুটো নষ্ট গাড়ির যন্ত্রাংশ মিলিয়ে যেমন একটি সচল গাড়ি বানানো হয়। দু’জনকে মিলিয়ে বাঁচানোর চেষ্টায় সফল হয় তারা। তবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শেষ মুহূর্তে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। তাই উপায় না পেয়ে তাদের শরীরের নীল রক্ত স্থানান্তর করে সম্পূর্ণ রূপে বাঁচিয়ে তোলে। তারা শুধু দুটো দেহকে মিলিয়ে একটি দেহ বানিয়েই শেষ করেনি, দুই দেহের দুই সত্তাকেও নতুন বানানো দেহতে প্রতিস্থাপন করে। যাতে দু’জন মানুষই ওই এক দেহে ভাগাভাগি করে বেঁচে থাকতে পারে।’

সুলতানা বেগম কাঁদতে-কাঁদতে বলেন, ‘ওসব কথা বাদ দাও! আর শুনতে ইচ্ছে করছে না! অত-শত বুঝি না, তুমি যে বেঁচে ফিরেছ, তাতেই লাখ-লাখ শুকরিয়া! তুমি আমাদের এই ঠিকানা পেলে কোথায়?’

‘ঠিকানা কোথাও পাইনি। নিজ থেকেই চলে এসেছি। মনে হয়েছে এই ঠিকানা আমি আগে থেকেই চিনতাম।’

ঈশিতা ইয়াসমিন বেগমের একটা ফটো এনে আমজাদ হোসেনকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি এনাকে চেনেন?’

আমজাদ হোসেন অনেকক্ষণ ধরে ফটোটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন, ‘হ্যাঁ, চিনি। কোথায় যেন দেখেছি। বহুবার দেখেছি। কিন্তু মনে করতে পারছি না, কোথায় দেখেছি!’

সুলতানা বেগম চোখ মুছতে-মুছতে বলেন, ‘তোমাকে আর কিছুই মনে করতে হবে না। সাবান মেখে ভালভাবে গোসল করে এসো। তোমার জন্য পোলাও, রোস্ট, ভুনা গরুর মাংস রান্না করছি। সবাই মিলে একসঙ্গে খাব। গত বাইশ বছরে এই খাবারগুলো আমি ছুঁয়েও দেখিনি।’

আফজাল হোসেন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *