ছায়া
স্যর, ভীষণ বিপদে পড়ে আপনাকে লিখতে বসেছি। আমার কিছু করার ছিল না। চাইনি আপনাকে এভাবে বিরক্ত করতে। কিন্তু আমার অন্য কোনও উপায় খোলা ছিল না। সমস্যাটার উৎস হচ্ছে আপনার দেয়া নতুন পাণ্ডুলিপিটি, যেটা গত ১৯ তারিখ আপনি আমাকে দিয়েছিলেন। আপনার অনুমতি পেয়ে সেই পাণ্ডুলিপি আমার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম, আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই। হাতে লেখা সেই পাণ্ডুলিপি ত্রিশ মিনিটের মাথায় পড়ে শেষ করেছিলাম। গল্পটা পড়ে অবাক হয়েছিলাম যে একজন নতুন লেখক এত সুন্দর শব্দ চয়ন কী করে করল, আর কী করেই বা এত গুছিয়ে লিখল।
কিন্তু গল্পটা পড়ার পর থেকেই সমস্যার শুরু। এই গল্পটিতে শিলা নামের এক চরিত্র আছে। গল্পে প্রেমিক শিলাকে খুন করে এবং তার পরের সব ঘটনা লেখা ছিল। অসাধারণ জীবন্ত লেখা, পড়ে মনে হচ্ছিল যেন আমি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। এই গল্পটা পড়ে আমি ঘুমাতে গেলাম রাত দেড়টার দিকে। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ করে ঘুমটা ভেঙে গেল, চোখ খুলে মনে হলো আমার ঘরে কেউ আছে। উঠে বাতি জ্বেলে পিছনে ফিরতেই দেখি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচণ্ড চমকে গেলাম, এত রাতে এই মেয়ে কোথা থেকে এল, কোনওভাবেই মাথায় ঢুকছিল না। মেয়েটা লাল শাড়ি পরেছিল, হাতে একগাছি লাল রঙের রেশমি চুড়ি, সঙ্গে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। মেয়েটা কাঁদছিল। হঠাৎ করেই মনে পড়ল সেই পাণ্ডুলিপির ‘শিলা’ চরিত্রের কথা। লেখকের বিবরণ অনুযায়ী যখন শিলাকে তার প্রেমিক খুন করে, তখন শিলার সাজপোশাক এমনই ছিল!
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে মেয়েটিকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলাম, সঙ্গে এটাও জানতে চাইলাম যে, আমার ঘরে সে কীভাবে ঢুকেছে। প্রত্যুত্তরে সে যা বলল, তা হলো: তার নাম শিলা, তাকে যে খুন করেছে, সে আর কেউ নয়, স্বয়ং এই পাণ্ডুলিপির লেখক।
মনে হলো, গল্পের রেশটা আমার মাথায় রয়েই গেছে-এই জন্য আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। তা ছাড়া, সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয়েছিল। হ্যালুসিনেশনের এটাও একটা কারণ হতে পারে। মেয়েটাকে কিছু না বলেই সোজা বিছানায় গিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, টের পাইনি।
পরদিন অফিস থেকে বাসায় গিয়ে দেখি সেই মেয়েটা আমার খাটে শুয়ে আছে। তখন ভয় পেলাম। কারণ সকালেও মেয়েটিকে দেখিনি। আমাকে দেখেই উঠে বসল। শুধু তাই নয়, আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, সে নাকি আসলেই মারা গেছে।
বিশ্বাস করিনি বলে সে আমার দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে বলল, আমি না চাইতেও বাধ্য হলাম তাকে ছুয়ে দেখতে।
আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, মেয়েটাকে আমি কোনওভাবেই ছুঁতে পারিনি। যেন সে হলোগ্রাফিক প্রতিবিম্বের মত, দেখা যায়, কিন্তু ধরা যায় না।
খুব কান্নাকাটি করল মেয়েটা। আমার কাছে আবদার করল, যেন আমি তার খুনের অভিযোগে সেই লেখককে পুলিসে দিই। কিন্তু আমার কাছে কোনও প্রমাণ নেই, তাই কিছু করতে অস্বীকৃতি জানাই।
এবার সে আমাকে বিরক্ত করতে শুরু করল।
সেই রাতেই আমার বাসায় তাণ্ডব চালিয়ে সব জিনিসপত্র ভেঙে চুরমার করল। কীভাবে ভেঙেছে তাও জানি না। আমি সেই মেয়েটাকে বেঁধে রাখার চেষ্টাও করেছি, কিন্তু পারিনি। অবশেষে না পেরে এক হুজুরকে ডেকেছিলাম। সেই হুজুরকেও ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে ওই মেয়েটা।
এখন ওর বক্তব্য হলো, বুড়িগঙ্গায় তার লাশ ফেলেছে লেখক। আমাকে তার লাশ উদ্ধার করে সঠিক উপায়ে সৎকার করে দিতে হবে। কিন্তু আমি এই মেয়ের লাশ কোথায় খুঁজব-কীভাবেই বা জানাজা পড়ে কবর দেব, জানি না। মাথা ভীষণ এলোমেলো হয়ে গেছে, স্যর। আমি এখন একজন মানসিক ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাচ্ছি, তাতে যে খুব একটা উপকার হচ্ছে, তাও নয়। ‘কারণ শিলা প্রতিদিনই আমাকে এসে মনে করিয়ে দিচ্ছে তার কাজের কথা।
এখন কেবল আপনিই এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন।
বিশ্বাস করুন, স্যর, আমি একটুও মিথ্যা বলছি না আপনাকে। নরকের মত হয়ে গেছে আমার জীবনটা। আপনি দয়া করে এই চিঠিটাকে একটু গুরুত্ব সহকারে নেবেন। দয়া করে এই মেয়ের লাশটা খুঁজে বের করে জানাজা পড়িয়ে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। এবং এই মেয়ের আত্মার যেন শান্তি হয়, সেই ব্যবস্থা করবেন।
বিনীত
শান্ত সরকার
.
চিঠিটা পড়ে হাসান সাহেব বেশ গম্ভীরভাবে টেবিলের সামনে বসা মেয়েটার দিকে তাকালেন। যদিও চিঠিটা ডাকযোগে সকালে এসেছে, তিনি চিঠিটা পড়লেন সন্ধ্যায়, কারণ কাজের চাপে সারাদিন চিঠি পড়ার সুযোগ পাননি। কিন্তু মেয়েটা কী করে একদম সঠিক সময়েই অফিসে এল, এটা তিনি মেলাতে পারছেন না। যেই তিনি চিঠির খামটা খুলেছেন, অমনি রুমে ঢুকল মেয়েটা। লাল শাড়ির সঙ্গে লাল চুড়ি পরেছে। লাল লিপস্টিকও লাগিয়েছে। ঠিক যেমন করে চিঠিতে লেখা আছে। একটা ব্যাপার হতে পারে যে, পিওনকে কিছু টাকা খাইয়ে আগেই চিঠি পৌঁছানোর সময়টা জেনে নিয়েছে। কিন্তু তিনি কখন চিঠিটা পড়বেন, সেটা কী করে জানল!
‘দেখে তো ভদ্র ঘরের বলেই মনে হচ্ছে। এই ধান্ধায় কত দিন আছেন?’
এতক্ষণ মাথা নিচু করে ছিল মেয়েটা। হাসান সাহেবের কথা শুনে মেয়েটা চোখ তুলে তাকাল তাঁর দিকে। চোখদুটো লাল, পানিতে ভিজে গেছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মেয়েটা বলল: ‘স্যর, প্লিয, আমাকে বিশ্বাস করেন। আমি আসলেই একজন মানুষ ছিলাম’। কিন্তু এখন আমি মৃত। কিন্তু এ জগতে শান্তি পাচ্ছি না, আবার মৃতদের জগতেও পাচ্ছি না। আপনি দয়া করে আমার লাশের একটা ব্যবস্থা করে দিন।’ বলে আবারও কেঁদে ফেলল মেয়েটা।
এবার বেশ রেগে গেলেন হাসান সাহেব। সেবা প্রকাশনীতে আজকে তিনি চল্লিশ বছর ধরে আছেন। হাজার মানুষ দেখেছেন। অনেক ঘাটের জল খেয়েছেন। তিনি যে- কোনও মানুষকে দেখে তাকে চিনে ফেলতে পারেন। এই লাইনে মানুষ কম দেখেননি তিনি। রাগত স্বরে বললেন, ‘এই, মেয়ে, এই মুহূর্তে তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। নইলে কিন্তু পুলিস ডাকব!’ রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগলেন তিনি।
‘আপনাকে কীভাবে বোঝাব যে মিথ্যা বলছি না। আচ্ছা, আপনি আমার হাতটা একবার ছুঁয়ে দেখুন,’ বলেই মেয়েটা তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল হাসান সাহেবের দিকে।
হাসান সাহেব সেই হাত ধরতে গিয়ে থতমত খেয়ে গেলেন। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি বুকের বাম দিকে খানিকটা ব্যথা অনুভব করলেন যেন। এরপরই তিনি বুঝতে পারলেন তিনি জ্ঞান হারাতে চলেছেন। শুধু জ্ঞান হারানোর আগে তিনি বুঝলেন: এই মেয়েটা এখনও তাঁর সামনে বসে আছে। সে ছায়া ছাড়া কিছুই নয়। তার হাতে হাসান সাহেব হাত রাখতেই পারেননি! ছায়াদের যে ছোঁয়া যায় না সেই কথাটা চিন্তা করতে-করতে তিনি চেয়ারে বসা অবস্থাতেই জ্ঞান হারালেন।
রাজীব চৌধুরী