পরী
এক
সবে ভাদ্র মাস। যতদূর চোখ যায় চারদিকে থৈ-থৈ পানি। আরও অনেক পরে শুকোবে বর্ষার ঢল। এ সময় কাজ থাকে না গ্রামের কৃষকদের। খেয়ে, ঘুমিয়ে আর গল্প-গুজব করে বেশিরভাগ মানুষ কাটায় তাদের সময়।
আবার হাতের কাজ করে কেউ। জাল বোনে, পলো বানায় কিংবা বাড়ির মহিলাদের ফরমায়েশ মত সারায় গৃহস্থালির জিনিসপত্র। কাউকে কাউকে দেখা যায় জাল, ছিপ কিংবা আনতা (মাছ ধরার খাঁচা) নিয়ে মাছ শিকারে মেতে উঠতে। আশ্রাফ আলী এই শ্রেণীর লোক।
বাড়িতে বসে থাকা ধাতে সয় না তার। দিনে ঘুমানোর তো প্রশ্নই আসে না। তার মতে, আল্লাহ রাত দিয়েছেন ঘুমাতে আর দিন হলো কাজ করার জন্য। সুতরাং দিনে ঘুমিয়ে কেন কাজের সময়টাকে নষ্ট করা!
অবস্থাসম্পন্ন না হলেও পরিশ্রমী আশ্রাফ আলীর পরিবার সুখেই আছে। স্ত্রী ময়না, এক ছেলে কাজেম আলী ও দুই মেয়ে হাসনা ও জোছনাকে নিয়ে ভালই কেটে যাচ্ছে তার দিন। নিজের জমিতে কাজ শেষ হলে, তারপর বাড়তি সময়ে পরিশ্রম করে অন্যের জমিতে।
তার আছে হালের একজোড়া পুরুষ্টু বলদ এবং দুটো গাভী। সবসময় দুধ দেয় একটা গাভী। বাড়ির দুধের চাহিদা মেটার পরেও বিক্রি করতে পারে খানিকটা দুধ। সেই টাকায় কিনতে পারে প্রতিদিনকার দরকারি সদাই।
আড়াল-আবডালে নানান কথা বললে বা হিংসা করলেও মুখোমুখি কিছু বলার সাহস পায় না গ্রামের কেউ। কারণ আশ্রাফ আলী অত্যন্ত সৎ মানুষ। কারও সাতে-পাঁচে থাকে না। তার মতে, অন্যের পিছে দৌড়ালে আমার পেট চলবে, কিন্তু পরিবারের পেট চালাতে হলে চাই কাজ করা।
যুক্তি আছে তার কথায়।
যারা মেম্বার-চেয়ারম্যান বা এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কল্কি ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের কারও আর্থিক অবস্থা আশ্রাফ আলীর মত নয়। সে বিশ্বাস করে আল্লার ইবাদতের পর সংসার ধর্মই বড় ধর্ম।
আজ দুপুরে খেতে গিয়ে দেরি হয়েছে তার। আগেই বিলে মাছ ধরতে যাবে ভেবেছিল আশ্রাফ আলী। তাই দেরি হয়ে গেলেও ডিঙি নৌকায় বড়শি ও আনতা তুলে রওনা দিল। এ বেলা জমির আলের পাশে পানির স্রোতে বসাবে সব। আগামীকাল ফজর নামাযের পর গিয়ে তুলে নেবে।
মাঝের এ সময়ে মাছ ধরার গ্রাম্য এসব যন্ত্রে আটকা পড়ে প্রচুর মাছ।
সকালে বাড়িতে যখন ঢেলে দেয়া হবে, এত মাছ দেখে বিরক্ত হবে ময়না। এতই বেশি, একা কেটে শেষ করতে পারে না সে। তখন দা-বটি এনে মাছ কেটে সাহায্য করে আশপাশের বাড়ি থেকে ফজুর বউ, জমিলার মা কিংবা জজির মা। কাটাকুটি শেষে ফেরত যাওয়ার সময় ওদেরকে প্রচুর মাছ দিয়ে দেয় ময়না।
জায়গা দেখে দেখে তার আনতা ও চাঁইগুলো বসায় আশ্রাফ আলী। কোথাও বুক সমান পানি, কোথাও আরও বেশি। কিন্তু জায়গা পছন্দ হওয়া মাত্র নৌকা থেকে টুপ্ করে নেমে যায় সে। কতবার নামল আর কতবার উঠল এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না সে।
কাপড় ভিজে একসা। সব কাজ শেষ হলে এবার সকালবেলা তুলে নেয়া হয়নি এমন দুটো আনতা নৌকায় তুলে নিল আশ্রাফ আলী। প্রত্যেকটাতেই খল্-বল্ করছে মাছ। এগুলো বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর ময়না খুব খেপবে আজ। স্ত্রীর রেগে ওঠা চেহারাটা মনে করে আপন মনে হেসে, ফেলল সে।
কী কম বয়সেই না ময়নাকে স্ত্রী হিসেবে ঘরে এনেছিল? অবশ্য নিজে যে ময়নাকে বিয়ে করে এনেছিল, তেমনটা নয়। আশ্রাফ আলীর বাপ ময়নার বাপকে অনেক আগেই কথা দিয়ে রেখেছিল। নিজেদের ছেলে ও মেয়ের বিয়ে দেবে তারা।
হঠাৎ একদিন সাপের কামড় খেয়ে ময়নার বাপ মারা গেলে আশ্রাফ আলীর বাপ দেরি করেনি। আবার কখন কার কী হয়, বলা যায় না। পরে কথা রাখা না গেলে মৃত মানুষটার কাছে লজ্জিত হতে হবে তাকে।
আশ্রাফ আলী ভেজা কাপড়ে উঠে বসল নৌকায়। আজকের মত তার কাজ শেষ। এখন শুধু নৌকা বেয়ে বাড়ি পৌছানো। আনতা দুটোর মাছ নৌকায় তুলে আনার পর থেমে থেমে লাফাচ্ছে মাছগুলো। দুই আনতায় সব মিলিয়ে পাঁচ-ছয় কেজি মাছ হবে। নৌকা বাইতে বাইতে আশ্রাফ আলী ভাবল, আজকে ময়না এই মাছ কুটতে রাজি না হলে শুঁটকি দিয়ে ফেলতে হবে।
বিলটা পার হয়ে খালে পড়লে বাড়ি পৌঁছাতে আর বেশিক্ষণ লাগবে না। বর্ষার পানিতে ধানি জমি সব ডুবে বিলটাকে দেখাচ্ছে নদীর মত। বিলের চক্-চক্ করা শরীরে নামছে সন্ধ্যা। হাতের লগিটা ঠেলে বিল শেষে ধানখেতে ঢুকবে আশ্রাফ আলী, এসময় শুনল ‘ওয়া’-’ওয়া’ শব্দ। ধারেকাছে কোথাও বুঝি কাঁদছে কেউ।
থমকে গিয়ে চারপাশে তাকাল আশ্রাফ আলী। প্রথমে ভাবল, ভুল শুনেছে।
কারণ বিশাল এই পানিময় জমিনে বাচ্চার কান্না আসবে কোথা থেকে!
তা ছাড়া, গ্রামাঞ্চলে এ সময়টাকে বলে তিন সন্ধ্যা। এ সময়টাতে মাছ নিয়ে যাচ্ছে বলে কি ‘ওঁরা’ তার সঙ্গে কিছু করছে?
আশ্রাফ আলী তিনবার কুলহু আল্লাহ সূরা পড়ে বুকে ফুঁ দিল।
কিন্তু না, আরেকবার শুনতে পেল সে কান্নার শব্দ। তার ভুল হতে পারে না।
এবার লগি দিয়ে ধানখেতে কিছু দেখা যায় কি না চেষ্টা করল।
একটু পর সন্ধ্যা নেমে গেলে কিছুই দেখা যাবে না আর। হঠাৎ দেখল বেশ ক’টা কচুরিপানার ওপর পুটলির মত জিনিসটা।
নৌকাটাকে ওটার কাছে নিল আশ্রাফ আলী।
হ্যাঁ, ন্যাকড়ার ভেতর হাত-পা ছুঁড়ে ওয়া-ওয়া করছে ছোট বাচ্চাটা, আবার থেমে যাচ্ছে।
আশ্রাফ আলী ভাবতে লাগল, এটা এখানে এল কী করে?
সে চলে গেলে এর কী হবে?
ধারেকাছে কোনও বাড়ি নেই। তার মানে, সে চলে গেলে মরে যাবে বাচ্চাটা!
বুকটা কেঁপে উঠল তিন সন্তানের বাপ আশ্রাফ আলীর। মন বলল, বাচ্চাটাকে নিয়ে যা। বাড়িতে নিয়ে যা!
দুই
বাড়িতে মাছ আনলে চেঁচামেচি করবে ভেবেছিল ময়না, কিন্তু আশ্রাফ আলীর কোলে ছোট্ট পুটলিতে বাচ্চাটাকে দেখে বেমালুম ভুলে গেল চিৎকারের কথা। এক দফা চিৎকার শুরু করার আগেই আশ্রাফ আলী ছোট্ট পুটলিটা ধরিয়ে দিতে চাইল তার হাতে।
‘ময়না, কোনও কান্নাকাটি করিস না। আমি এই বাচ্চাটারে বিলে পাইছি। কচুরিপানার মইধ্যে। খোদার কসম, এতে অন্য কোনও কিছু নাই। ওর কী লাগব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা কর। বাচ্চাটারে বাঁচাইতে হইব।’
একটানা কথাগুলো বলে থামে আশ্রাফ আলী। তার কথার ফাঁকে বাড়ির বাচ্চা তিনটাও এসে বাবা-মাকে ঘিরে দেখছে ছোট শিশুটাকে। ময়নার জেগে উঠেছে মাতৃত্ব, সে নিজের কোলে নেয় শিশুটিকে। এতে মহাখুশি হয় আশ্রাফ আলী। যাক, বিতং করে দেরি করিয়ে দেয়নি ময়না। বাকি ঘটনা পরেও বলা যাবে। এখন দরকার এই শিশুকে বাঁচিয়ে রাখা। ময়নার ছোট্ট বাচ্চা জোছনার বয়স আট বছর। তাই ময়নার বুকে এখন কোনও দুধ নেই। তা হলে, এইটুকুন শিশু খাবে কী!
ধ্যাৎ! এখন এসব ভাবনা নয়। আশ্রাফ আলী বাইরের কাজ সেরে আসা পর্যন্তই জানে। ঘরে যে কীভাবে কী হয় সে বিষয়ে তাকে কখনও মাথা ঘামাতে হয়নি। ময়না তার জাদুকরী হাতে সব করে ফেলে। এমনও দেখা গেছে টানা বৃষ্টিতে বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না। বাজার করাও বন্ধ। অথচ ময়না খিচুড়ি, ঘি, বাচ্চা মুরগির মাংসের সঙ্গে চার-পাঁচ পদের ভর্তা রেডি করে খেতে ডাকে।
একবার ঘরে কী আছে বা নেই জানা ছিল না আশ্রাফ আলীর। হঠাৎ তিন-চারজনকে নিয়ে বাড়িতে হাজির হয়ে সে আওয়াজ দেয় যে, তারা খাবে। টু শব্দটিও না করে ময়না কেবল বড় মোরগটা জবাই করে দিতে বলে। ব্যস, এটুকু করেছিল সে।
কিন্তু খাবার খেতে বসে আশ্রাফ আলী তো বটেই, অতিথি চারজনও অবাক হয়েছিল। পোলাও, গরুর গোশ্ত, মুরগির মাংস, বড় মাছ, ডিম ভুনা, দুধের সঙ্গে কলা এবং আশ্চর্যের বিষয় সব শেষে পাতে মিষ্টিও তুলে দিয়েছিল ময়না। যদিও সবগুলোই আশ্চর্যজনক। একজন অতিথি তো বলেই বসেন, ‘মিয়া, সব আয়োজন কইরাই আমগোরে আনতে গেছ তুমি, তাই না!’
এ কথা শুনে আশ্রাফ আলীর মুখে কোনও কথা জোগায়নি। সত্যিই সে কিছু করেনি। সব করেছে ময়না। কোনও কথা না বলে চুপ করেই থাকে সে। এ রকম ঘটনা অনেক আছে। ময়না আসলেই তার সংসারের লক্ষ্মী। কখনও তার কথায় অমত করেনি। সেই ময়না এখন বিলের শিশুটাকে কোলে তুলে নিল মানে ওর আর ভাবনা নেই। আল্লাহর রহমতে শিশুটা এখন বেঁচে গেলেই হয়।
তিন
ময়না শিশুটাকে কেবল কোলেই তুলে নেয় না, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে: আমি ওকে নিজের সন্তানের মত আদর ভালবাসা দিয়ে বড় করে তুলব। কোনও কিছুর কমতি হতে দেব না এর।
ময়নার মত তার তিন সন্তানও সহজভাবেই নেয় নতুন শিশুটিকে। বিশেষ করে হাসনা ও জোছনা তো মেয়ে শিশুটির জন্য পাগল হয়ে ওঠে। তাকে কোলে নিতে হবে, নিজের পাশে নিয়ে ঘুমাতে হবে, আরও কত কী!
প্রথমে নবাগত এই শিশুটিকে বিলের কন্যা, বিলের কন্যা বলে ডাকা হতে থাকে। প্রায় তিন সপ্তাহ কেটে গেলেও কেউ এর দাবি নিয়ে আসা দূরের কথা, অমুক বা তমুকের সন্তান হতে পারে, তেমনটাও জানা যায় না। শেষে এই শিশুর নাম বিলের কন্যা পাল্টে হয়ে যায় পরীর মেয়ে।
হ্যাঁ, এমন দুধ-আলতা গায়ের রঙ, টানা টানা চোখ, মিশমিশে কালো চুল, একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না-এটা পরীর মেয়ে না হয়ে যায়ই না!
আশপাশের গ্রাম থেকে কম মানুষ ওকে দেখতে আসেনি। অথচ কেউ একটাবার এর পরিচয় জানে, বলতে পারেনি। সুতরাং পরীদের মেয়েই এটা। ওরাই বিলে ফেলে গেছে। বিশেষ করে আশ্রাফ আলীর মত একজন দিলদরিয়া মানুষকে লক্ষ্য করেই এ কাজটা করেছে তারা। কারণ পরীরা জানত এই লোকটা বাচ্চাটাকে ফেলে আসতে পারবে না।
এভাবেই পুরো গ্রাম এমনকী ইউনিয়নের ছোট-বড় সকলে জেনে গেল আশ্রাফ-ময়নার ঘরে একটা পরীর মেয়ে আছে। নিজেদের ছোট বোনকে বারবার পরীর মেয়ে, পরীর মেয়ে শুনতে হাসনা ও জোছনার খুব একটা ভাল্লাগে না। ওরা দু’দিন খুঁজে খুঁজে এই শিশুর একটা নাম বের করে ফেলে। ওর নাম রাখা হয় জয়গুন। পরীর মেয়ে জয়গুন।
চার
বাড়ির সবার আদর ভালবাসা আর গ্রামের মানুষের স্নেহে দিন দিন বড় হতে থাকে জয়গুন। নামের মতই গুণবতী হয়েছে মেয়েটা। আর দেখাশোনায় তো অপূর্ব, অতুলনীয়। এমন রূপবতী মেয়ে সারা দেশে আরও একটা আছে কি না সন্দেহ। আসলেই সে পরীর মেয়ে। আড়ালে আবডালে সকলে এটা বিড়বিড় করে বলতে বাধ্য হয়।
অন্য বাচ্চাদের মত জয়গুনও পড়াশোনা করবে। সে বাড়ির কাছের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়ে যায়। তার বড় তিন ভাই-বোন এ স্কুলেই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। সে-ও ‘পড়বে। প্রথম দিন থেকেই পড়ালেখায় মনোযোগী হয়ে ওঠে জয়গুন।
স্কুলের শিক্ষকরা বলাবলি করে, মেয়েটা অসম্ভব মেধাবীও বটে। সে ঠিক মত পড়াশোনা চালিয়ে গেলে তার অন্য ভাই-বোনদের চেয়ে অনেক ভাল ফলাফল করবে নিশ্চিত। শিক্ষকদের অভিজ্ঞ মন্তব্য ভুল হয় না। সত্যি সত্যি জয়গুন কৃতিত্বের সঙ্গে পুরো ইউনিয়নে ভাল ফলাফল করে প্রাইমারি পাশ করে।
গ্রামের অন্য মাথায় হাই স্কুল। সেই স্কুলে মেধাবী মেয়ে জয়গুন পড়বে তা দিনের মত পরিষ্কার। খুব খুশি হয়েই হাই স্কুলের হেডমাস্টার রহিম মিয়া তাকে ভর্তি করে নিলেন। জয়গুন এখন হাই স্কুলে পড়ে। কী আনন্দ তার মনে!
জয়গুন স্বপ্ন দেখে সে অনেক বড় হবে। সমাজের সবচেয়ে মহৎ পেশা হবে তার পেশা। হ্যাঁ, সে ডাক্তার হবে। এটাই মনে মনে ঠিক করে ফেলে ও। তাকে লোকজন পরীর মেয়ে বলে, এটা সে-ও শুনেছে। তবে জয়গুন মনেপ্রাণে আশ্রাফ আলী ও ময়নাকেই তার বাপ-মা বলে জানে। লোকে যা বলে বলুক। হয়তো সে খুব সুন্দরী বলেই তারা এমনটা বলে।
বিলে বাতাস বয়ে যায় প্রতিদিন। গাছের পাতা মর্মর শব্দে হাওয়া দেয়। কাছের ‘মেঘনা নদীতে কুল কুল বয়ে যাওয়া ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাছ ধরে জেলেরা।
জয়গুন বাড়িতে আসার পর আশ্রাফ আলীর সংসারের চেহারা বদলে যায় দ্রুত। সব কিছুতেই তার উন্নতি আর উন্নতি হতে থাকে। এমনকী তার বাড়িতে অর্থও আসতে শুরু করে। সে যা করে, তাতেই টাকা আসে ঘরে। ময়নার বহু দিনের শখ ছিল সাতনরী হার গড়ানোর। অনেকগুলো টাকা জমিয়ে রতনপুর বাজার থেকে আশ্রাফ আলী গোপনে স্ত্রীর জন্য সাতনরী হার গড়িয়ে আনে।
সাতনরী হার গলায় পরে হাসে ময়না। ভুবন ভোলানো হাসি হয়তো একেই বলে। স্বামী-সন্তান-সংসার নিয়ে এমন তৃপ্তির জীবন, সুখের জীবন কয়জন নারীর ভাগ্যে জোটে!
বিয়ে হয়ে গেছে হাসনা ও জোছনার। অবস্থাসম্পন্ন আশ্রাফ আলীর বর্তমান আর্থিক অবস্থা এবং মেয়েরা সুন্দরী ও শিক্ষিত হওয়ায় বড় ঘরেই দিতে পেরেছে ওদেরকে। তা ছাড়া, বিভিন্ন উপলক্ষে জামাইবাড়ির সবার জন্য উপহার- উপঢৌকন পাঠিয়েও সকলের মন জয় করে রেখেছে আশ্রাফ আলী। আত্মীয়-স্বজনরা সামনা-সামনি তার প্রশংসা করলেও আড়ালে এই উন্নতির জন্য হিংসা না করে পারে না।
হাসনার এক ছেলে ও এক মেয়ে, আর জোছনার দুটোই ছেলে। এদিকে বছর তিনেক আগে ডিগ্রি পাশ করে ঢাকায় চাকরিতে ঢুকেছে আশ্রাফ আলীর ছেলে কাজেম। তার জন্যও খোঁজা হচ্ছে পাত্রী। তবে কাজেমের পছন্দ মত মেয়ে না পেলে জোর চেষ্টা করবেন না আশ্রাফ আলী। কারণ ঢাকায় পড়ালেখা করা ছেলের ঢাকাতেই কাউকে পছন্দ থাকতে পারে, বা কথা দিয়ে রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে গ্রামের কোনও মেয়ের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হবে। হিসাবী আশ্রাফ আলী সংসারের বিষয়ে খুবই সচেতন।
স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় জয়গুন। সে অদ্ভুত এক অনুভূতিতে কেঁপে উঠছে বারবার। তাদের স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র মাজিদ গত কয়েকদিন ধরে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে ওর পিছু নিত। ছাত্র হিসেবে ভাল মাজিদ। রোল নম্বরও প্রথম দিকেই ওর। তবুও পিছনে পিছনে ঘুর-ঘুর করাটা বেখাপ্পা ঠেকছে জয়গুনের।
ঘোরাঘুরির কয়েকদিন কেটে গেলে জয়গুনের বান্ধবী বীথি বলেছিল, ‘মাজিদ মিয়া তোর প্রেমে পড়ছে, জয়গুন। তোর প্রেমে পড়ছে।’
সেদিন এ কথাটা শুনে পুরো শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছিল ওর। জয়গুন ভেবেছে মাত্র ক্লাস এইটে পড়ে ও। এসব প্রেম-ভালবাসায় মন গেলে পড়ার ক্ষতি হবে। কোনওভাবেই ওসবে যাবে না ও। জড়াবে না, জড়াবেই না।
মাজিদ যদিও তার পিছু ছাড়েনি, কিন্তু জয়গুন কোনওরকম সাড়া দেয়নি বা অন্য দুষ্টু মেয়েদের মত করে মাজিদকে পেছনে পেছনে ঘোরানোর জন্য দেখানো হাসি হাসেনি। এসব মিথ্যে ছল করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। সে সবসময়ই নিজের কাছে সৎ থাকবে, এমনটাই ছিল ওর নীতি।
বন্ধ দরজার দিকে একবার তাকিয়ে জয়গুন স্কুল ব্যাগের পকেট থেকে বের করল চিঠিটা। ছোট ভাঁজ করা কাগজ। ভেতরের বর্ণগুলো নীল
বর্ণগুলো নীল কালিতে সাজিয়ে লিখেছে পত্রলেখক। এটাই প্রেমপত্র। জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম প্রেমপত্র প্রত্যেক মেয়ের কাছে ভীষণ আগ্রহের, আকর্ষণের। কিন্তু জয়গুন কোনওভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছে না।
রাগ হচ্ছে তার। কান্না করতে ইচ্ছে করছে খুব। মাজিদ প্রেমপত্র পাঠাতে আর কাউকে পেল না। বেছে বেছে তাকেই দিতে হবে এই বিশ্রী চিঠি। বাবা-মা জানলে কী ভাববে ওকে! তা ছাড়া, বড় ভাইয়া, আপুরা আছে। তারা শুনলে কি কখনও বিশ্বাস করবে, ওর কোনও ভূমিকা নেই এই প্রেমপত্রে!
কী করবে জয়গুন! বাবাকে ডেকে দেখাবে চিঠিটা? মাকে পড়ে শোনাবে লেখাটা? কিছুটা সময় ভেবে চলে ও। না, কাউকে কিছু জানাবে না। কাউকে কিছু বলা ঠিক হবে না। সে একাই চেষ্টা করবে মাজিদের সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটাকে এখানেই থামিয়ে দেয়ার।
চিঠিটা খুলে দেখে একবার। ছোট্ট ছোট্ট অক্ষরে হাতে লেখা চিঠি। হাতের লেখাও খুব সুন্দর। চোখ টেনে নেয়। পড়বে না পড়বে না করেও পড়ে জয়গুন। পড়ার পর কেমন এক মিশ্র অনুভূতি ওর ভেতরে খেলা করে যায়। ওকে ভালবাসে একজন। ভালবেসে চিঠি দিয়েছে। এটা জনে জনে না বলে মাজিদকেই সরাসরি জানিয়ে দেবে, তার পক্ষে সম্ভব নয়।
দরজার বাইরে শব্দ হয়। ময়না দরজা ধাক্কা দেয়।
‘জয়গুন, দরজা বন্ধ করলি ক্যান? ভাত খাবি না!’
‘আসি, মা। কাপড় বদলাইয়া আসতাছি।’
জয়গুন আরও অনেকটা সময় পর বের হলেও ভিন্ন অনুভূতিটা তার মন-প্রাণ ছুঁয়ে থাকে। অনেক দীর্ঘ সময় ধরে।
পাঁচ
রাতে ঘুমাচ্ছে পুরো গ্রাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে আশ্রাফ আলী ও ময়না শুয়ে পড়েছে। পড়াশোনার খুব চাপ বলে জয়গুন দেরি করে ঘুমাতে যায়। ও ঘুমিয়েছে, তা-ও ঘণ্টাখানেক হয়। এমন সময় দরজায় শব্দ হলো। একাধিকবার জোরে জোরে শব্দ হলে ঘুম ভেঙে গেল আশ্রাফের। সে চোখ মেলে ময়নাকেও ডেকে তোলে। তারপর দরজা খুলতে উদ্যত হয় আশ্রাফ।
‘এত রাইতে কে না কে! দরজা খুলবা?’
‘এই সময়ে কে আসতে পারে? বুঝতেও পারতাছি না।’
‘দরজা না খুললে কেমন হয়?’
‘না-না, দেখি।’ তারপর আশ্রাফ গলা উঁচু করে বলে, ‘কে? কে দরজার বাইরে?’
‘আমরা। হামিদা আর সুখরান।’
নামগুলো একেবারেই অপরিচিত। কারা এরা? তবে মহিলা কণ্ঠ স্পষ্ট এবং জোরালো। আশ্রাফ ছিটকিনি খুলে দরজার পাল্লা মেলে ধরে।
ভেতরে ঢোকে দু’জন ঝলমলে পোশাক পরা নারী। উচ্চতায় আশ্রাফ আলীকে ছাড়িয়ে গেছে দু’জনেই। চেহারা খুবই সুন্দর। মনে হচ্ছে মুখমণ্ডল থেকে বুঝি বেরিয়ে আসছে আলোর ঝিলিক।
‘আপনারা? এত রাইতে?’
‘আমরা পরী। জয়গুন আমার বড় বোনের মেয়ে।’
‘কী!’
‘জী, সত্যি বলতেছি আমরা।’
‘এখন কেন আসছেন?’
‘আর ছাব্বিশ দিন পর ওর বয়স তেরো হইবো। তার আগেই ওরে আমরা নিয়া যামু।’
‘জয়গুনরে নিয়া যাইবেন! ফাইজলামি পাইছেন! জয়গুন আমার মাইয়া। ওরে আমি কোথাও যাইতে দিমু না।’
হামিদা নামের পরী হাসে। অসম্ভব সুন্দর হাসি। হাসির সঙ্গে তার দাঁতগুলো হারিকেনের হালকা আলোতেও ঝিক্ ঝিক্ করছে।
‘বড় হাসির কথা বললা, আশ্রাফ আলী। তোমার এক ছেলে দুই মেয়ে। ও পরীর মেয়ে জয়গুন। সে তোমাদের মেয়ে হবে কেন?’ হামিদা বলে।
‘শোনো,’ কথা বলে সুখরান, ‘আমার বোন মানুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করায় ওর জন্ম হয়। জন্মের সময় আমার সেই বোন মারা যায়। মানুষের রক্ত ওর শরীরে থাকায় ওরে আমরা পরীস্থানে নিতে পারি নাই।’
‘আর তাই তারে তোমার ঘরে জায়গা করার ব্যবস্থা করি,’ কথা বলে হামিদা। ‘এখন জয়গুনের তেরো বছর পূরণ হওয়ার সাথে সাথে ওরে নিয়া আমরা এক রাক্ষসের সাথে বিয়া দিব। তারপর সে পরীস্থানে ঢুকতে পারব।’
‘সব বুঝলাম। তোমাদের এই গাল-গল্পের কোনও প্রমাণ নাই। অতএব তোমরা ওরে কোনওভাবেই পাইবা না,’ আশ্রাফ আলী যুক্তি দেখায়।
‘শোনো, আমরা আবার আসব। এখন কথাটা জানাইয়া গেলাম।’
কথাটা বলেই ওরা যেভাবে এসেছিল সেভাবে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু হেঁটে উঠানের মাঝ বরাবর গিয়েই হামিদা ও সুখরান হঠাৎ উড়ে চলে গেল। দরজা বন্ধ করার বদলে আশ্রাফ ও ময়না অদ্ভুত দৃশ্যটা হাঁ করে দেখল। দু’জনের পিঠে কি ডানা লুকানো ছিল? এতক্ষণ তো তা দেখেনি ওরা! কিন্তু সত্যি সত্যি হামিদা ও সুখরান নামের দুই পরী অনেক অনেক উঁচুতে উড়ে গেছে।
দরজা বন্ধ করে বিছানায় গেল আশ্রাফ আলী। কী ঘটল এটা ভেবে শরীরে ঘাম এসে গেছে। ময়নার এগিয়ে দেয়া পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক ঢোকে সবটা পানি খেয়ে নিল সে। আরও পিপাসা লাগছে তার। এ মুহূর্তে বোধহয় এক পুকুর পানিও খেয়ে ফেলতে পারবে আশ্রাফ আলী।
ছয়
সর্ষের তেল দিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত মেখে খাওয়াটা আশ্রাফ আলীর খুব পছন্দ। সেই ছোটবেলা থেকেই এভাবে খেতে ভাল লাগে তার। কোনও তরকারি না থাকলে এরকম তেল দিয়ে দুই প্লেট ভাত খেয়ে কাজে বেরিয়ে যেত সে। অভ্যাসটা এখনও রয়ে গেছে। জয়গুন এসে তার পাশে বসে খেতে শুরু করল। সামনে সব সাজিয়ে দিয়ে ময়নাও খেতে বসে গেল। খুব তাড়া না থাকলে একসঙ্গে বসে খাওয়ার আনন্দই আলাদা। আশ্রাফ আলীকে চোখের ইশারায় রাতের ঘটনাটা এখুনি জয়গুনকে বলতে মানা করে ময়না।
খাওয়ার পর্ব শেষ হয়। তারপর বড় জামবাটিতে দই বেড়ে দেয় ময়না। আগে ভাত দিয়ে দই মাখিয়ে খেলেও এখন খালি দই খায় আশ্রাফ আলী। জয়গুন ওর বাটির দইয়ের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে নেয় খানিকটা।
‘জয়গুন।’
‘জী, বাবা।’
‘তোর পড়ালেখা কেমন চলতাছে?’
‘ভালই, বাবা।’
‘কোনও সমস্যা নাই তো!’
জয়গুন ওর প্রেমপত্রের বিষয়টা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যায়, এ ঘটনা এখন পর্যন্ত মাজিদ ও তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। ওর বাবা পর্যন্ত যায়নি। সুতরাং ভয়ের কিছু নেই।
‘না, কোনও সমস্যা নাই।’
দইয়ের খালি বাটি নামিয়ে রাখে আশ্রাফ আলী। পানি খায় এক গ্লাস। তারপর হাতের পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে লুঙ্গিতে হাতটা ঘষে। ‘মা, একটা কথা বলি তোরে।’
গতরাতের ঘটনাটা মোটামুটি আদ্যোপান্ত বলে আশ্রাফ আলী। ময়না মেয়ের চেহারা দেখে বোঝার চেষ্টা করে তার প্রতিক্রিয়া।
সবটুকু বলা শেষ করা মাত্র জয়গুন ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে। কান্না একটু থামলে কথা বলে ও। ‘বাবা-মা, তোমরা ওইসব বিশ্বাস কইরো না। ওরা আমার কেউ না। বিশ্বাস করো। আমি তোমাগো মাইয়া। তোমরা দরকার হয় আমারে মাইরা-কাইট্যা পানিতে ভাসাইয়া দেও। আমি তোমাগোরে ছাইড়া কোথাও যামু না। কোথাও না।’
কাঁদতে কাঁদতে জয়গুন একেবারে আশ্রাফ আলী ও ময়নার পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ে। তারা মেয়েকে নানান কথা বলে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করে যায়।
বিষয়টা অতি জরুরি। এ কারণে আশ্রাফ আলী তার সব ছেলেমেয়েকে দ্রুত বাড়িতে ডাকে। জয়গুন কোনও ঝামেলা করেছে ভেবে দেরি না করে ওরা সবাই ছুটে আসে।
পরদিন ছেলেমেয়েদের একই গল্প বলে আশ্রাফ আলী। হতবিহ্বল কাজেম, হাসনা ও জোছনা কোনও সিদ্ধান্ত দিতে পারল না। হঠাৎ কথা প্রসঙ্গে হাশেম কবিরাজের নামটা আসে। পরে ঠিক হয় দুপুরের পরপরই তাকে ডেকে আনা হবে। হয়তো এই বিপদ থেকে তাদেরকে উদ্ধার করতে পারবে সে।
সাত
হাশেম কবিরাজ। বয়স সত্তরের ওপরে। তবে বয়সের তুলনায় তার কাঠামো বেশ শক্তপোক্ত। মাথার চুল হয়ে গেছে সব সাদা। লম্বা চুলগুলো ছুঁই-ছুঁই করছে কোমর। মাঝারি উচ্চতার লোকটার হাতে সবসময় থাকে একটা লাঠি। ওটার ওপরে মানুষের মুখ আঁকা।
ঘরের দাওয়ায় বসে বিস্তারিত শুনে হাশেম কবিরাজ ধ্যান করার মত চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ। শেষে নড়েচড়ে লাঠিটা হাতে তুলে নেয়।
‘আশ্রাফ আলী…’
‘জী, হাশেম ভাই।’
‘তোমার জয়গুন সত্যিই পরীর মাইয়া।’
‘আর যারা আসছিল, ওরা?’
‘ওরা তার স্বজন।
তাইলে এখন কী করা, ভাই?’
‘রাক্ষসের সাথে বিয়া দিয়া ওরা তারে পরী রাজ্যে নিয়া যাইব এই কথাটা ঠিক না।’
‘কিন্তু ওরা তো এই কথাই কইল।’
‘শোনো, ওগো বোন মানুষের সন্তান পেটে নেয়াতে ওদের মনে প্রচণ্ড আক্রোশ চাপছে। এখন এই মেয়েটারে রাক্ষসের সাথে বিয়া দিয়া ওরা তার সর্বাংশে ক্ষতি করতে চাইতাছে। বুচ্ছো?’
‘কন কী, ভাই!’
‘হ।’
‘এর থাইকা মুক্তির উপায় কী? যেমনে হোক মাইয়াটারে বাঁচাইতে হইব। ওর কিছু হইলে আমরা বাঁচমু না।’
এবার কোনও উত্তর দিল না হাশেম কবিরাজ। সে বড় করে শ্বাস টেনে আবার চুপ হয়ে চলে গেল ধ্যানের গভীরে। বাড়ির সব সদস্য উদ্গ্রীব হয়ে কবিরাজের পাটির চারপাশে বসে আছে। একটু পরে হাশেম কবিরাজ উঠে দাঁড়িয়ে তার হাতে ধরে রাখা লাঠির গোড়াটা দিয়ে উঠানে আঁকল একটা বৃত্ত। ওটা আঁকা হয়েছে ওদের বসে থাকা জায়গাটা ঘিরে। আঁকা শেষে কবিরাজ আবার নিজের জায়গায় বসল।
‘আশ্রাফ আলী।’
‘জী।’
‘জয়গুনরে রাখতে হইলে শক্ত একটা কাজ করতে হইব। খুবই শক্ত কাজ।’
‘কী কাজ, হাশেম ভাই?’
‘পরীগো হিসাব মতে আগামী মাসের দুই তারিখে ওর বয়স তেরো হইব। ঠিক না?’
‘জী।’
‘তার আগে ওর একটা ক্ষতি কইরা দিতে হইব।’
‘এইডা কী কও, ভাই? ওর ক্ষতি!’
‘শোনো, একমাত্র ওর কোনও একটা ক্ষতি হইলেই জয়গুনরে তার খালারা আর নিতে চাইব না। কী করা যায় দ্রুত চিন্তা করো। সময় খুবই কম।’
আট
হাসনা ও জোছনার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। তারা কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিয়ে যার যার স্বামীর বাড়ি চলে গেছে। বিশেষ করে জয়গুনকে ধরে তাদের কান্না যেন থামছিলই না। আসলে কোলে-পিঠে মানুষ করা এই বোনটা ওদের কাছে খুব প্রিয়। জয়গুনকে ওরা কখনওই বাইরের মেয়ে, পরীর মেয়ে এভাবে দেখেনি।
আর সেই মেয়েটার কঠিন বিপদে ওরা কিছু করতে পারছে না, তা যে কী কষ্টের, কীভাবে সেটা বোঝাবে। তবুও বাস্তবতা সবচেয়ে বড় সত্য। একে মেনে নিতে হবে। অবশ্য হাশেম কবিরাজ চাচার কথা মত যদি কিছু করা যায়, তা হলে হয়তো মুক্তি মিলবে ওর।
কাজেম এ বাড়ির ছেলে। ও দু’দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু বাড়িতে যে এমন জটিল অবস্থা হয়ে আছে, তা সে আন্দাজও করতে পারেনি।
এখন এমন এক বিপদে কোনও একটা ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত বয়স্ক বাবা-মা ও প্রাণপ্রিয় ছোট বোনকে ফেলে কোনওভাবেই চলে যাওয়া যায় না ভেবে থেকে গেল ও। আইন-সালিশ বা বিচার আচারের ব্যাপার হলে না হয় সে একাই লড়তে পারত। কিন্তু এটা এমন এক ব্যাপার, যাতে তার হাত-পা একেবারেই বাঁধা। এখানে কবিরাজ চাচা যেভাবে যা করে, তাতেই সম্মতি দিয়ে একটা সুরাহা করতে হবে।
কাজেম আলী বাড়ির দক্ষিণের আম বাগানের ভেতরে একা একা হাঁটছে। এই একটা বিষয়ই সারাক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছে ওর ভাবনায়। এমন সময় তার পেছনে খুট্ করে একটা শব্দ হলো। ঘুরে তাকাল কাজেম। দেখে গুটিগুটি পায়ে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মাজিদ। ওদের বাড়ির ঘটনা এ পাড়া হয়ে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু কেউই কিছু করার উপায় জানে না। এ কারণে পুরোটা গ্রামই কেমন যেন থম মেরে গেছে।
‘কাজেম ভাই….’
‘কী, মাজিদ, কেমন আছ?’
‘ভাল আছি। আপনি?’
‘আছি একরকম।’
‘আপনাদের বিপদের কথা শুনছি। শোনার পর থাইকা আমার খুব খারাপ লাগতাছে।’
‘হ। জয়গুনের জন্য সবারই মন খারাপ রে।’
‘ভাই…’
‘হুম?’
‘একটা বুদ্ধি পাইছি। কমু?’
‘ক।’
‘পরীরা তো জয়গুনরে নিয়া বিয়াই দিব। ওরে, যদি আপনেরা বিয়া দিয়া দেন। তাইলে ওর একটা খুঁত হয় না?’
কথাটা কাজেমের পছন্দ হলো। হ্যাঁ, এমন একটা বিষয়ও হতে পারে। খুঁত বলতে, ওরা জয়গুনের হাত-পা কাটা-ভাঙা এসব ভাবছিল। হ্যাঁ, তা না করে অন্য কিছুও তো করা যেতে পারে।
কাজেম মাজিদকে কিছু না বলে বাড়ির দিকে দৌড়াল। এখনই খবরটা জানাতে হবে। মঙ্গলবার আসতে খুব বাকি নেই।
নয়
জয়গুনের জন্য এলাকা বা এলাকার বাইরে ভাল পাত্রের অভাব হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দুটো কারণে এ বিষয়ে কোনওরকম খোঁজখবর করা গেল না। এক: তারা ওর বিয়ের ব্যবস্থা করছে এটা পরীরা জেনে ফেললে সমস্যা হতে পারে। দুই: জয়গুনকে ওর মা খুব নরম করে তার কোনও পছন্দ আছে কি না জিজ্ঞেস করলে, সে কোনও বাছবিচার না করে মাজিদের নাম বলেছে।
কাউকে না জানিয়ে মাজিদসহ ওর বাবা, মা, কাজীসাহেব ও কবিরাজ এবং এ বাড়ির লোকজনের উপস্থিতিতে হয়ে গেল জয়গুনের বিয়ে। সোমবার বিকেলে ঘরোয়াভাবে সম্পন্ন হলো এ বিয়ে। মাজিদ-জয়গুন নিজেরাও কখনও ভাবেনি এভাবে তাদের বিয়েটা হয়ে যাবে। অথচ হয়ে গেল।
বিয়ে হলো, কিন্তু পরে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা করা হবে এ কথাও মাজিদের বাবা-মা আদায় করে নিল। তাদের আরেকটা দাবি ছিল, সেটা হলো মেয়ে সাবালিকা না হওয়া পর্যন্ত ছেলে-মেয়ের মেলামেশা চলবে না। এসব দাবি- দাওয়ার বিষয়ে কোনও অমত করেনি জয়গুন পরিবার
সন্ধ্যা গড়ালে কী না কী হয় ভেবে আশ্রাফ আলী হাশেম কবিরাজকে বাড়িতে রেখে দিয়েছে। সে-ও বেশ ভাল প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে আজকের জন্য। কবিরাজ জানে, ছেড়ে কথা বলবে না পরীরা। আজ তাদের তৈরি করা এই খুঁত দেখে যদি পরীরা খেপে যায়, তা হলে যে কী করে, সেটা বলা যায় না।
সবাই আগেভাগেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিল। হাশেম কবিরাজ রাতে হুক্কা খায়। সে হুক্কা জ্বেলে গুড়-গুড় করে টেনে চলেছে।
ঠিক এ সময়ে প্রচণ্ড শব্দ হলো টিনের চালে। পরক্ষণেই দরজায় কড়া নাড়ল কেউ।
কাজেম দরজা খুলতে চাইলে আশ্রাফ আলী তাকে বাধা দিয়ে নিজে গিয়ে খুলে দিল দরজাটা।
দরজায় রক্তাভ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হামিদা ও সুখরান।
‘তোমরা!’
‘আমাদের তো আসারই কথা ছিল। কিন্তু তুই এর মধ্যে কথার খেলাফ করে ফেললি।’ হামিদা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কথাগুলো। তার পেছনে পেছনে ভেতরে ঢুকল সুখরান।
ঘরে ঢুকেই প্রথমে ওদের চোখ পড়ল হাশেম কবিরাজের উপর। মেঝেতে চট বিছিয়ে বসে আছে তার জিনিসপত্র নিয়ে।
‘হাশেম! তুই এইসব করাইলি রে! তুই এইসব করাইলি!’ দাঁত কিড়মিড় করে বলল হামিদা। আক্রোশে ফেটে পড়ছে সে।
‘তোরা ওর ক্ষতি করতি। তাই ওরে বাঁচাইলাম। ও আমাদের মেয়ে।’ হাশেম কবিরাজ হুক্কা থেকে মুখ তুলে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল কথাটা।
‘ও তোদের মেয়ে কীসের! ও পরীর মেয়ে। আমরা ওর বিয়ে ঠিক করেছি। পাত্রও বাইরে আছে। এবার তার মোকাবেলা করিস।’ সুখরান পারে তো হাশেম কবিরাজকে যেন চিবিয়ে খেয়ে ফেলে।
‘তোরা চুপচাপ চলে যা। কোনও সমস্যা করলে বোনঝির সাথে তোদেরকেও আজীবন আমাদের সাথে আটকে রাখব।’ হাশেম কবিরাজ তার জিনিসপত্র দেখে নিয়ে বলল কথাটা।
এই কথা, হারামজাদা! তোর বাপ আসছে! পারলে রাখ! হামহাম, ভেতরে আয়!’ হামিদা গর্জে উঠল।
কথাটা বলে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে চোখ রাখল দুই বোন। ঠিক তখুনি গর্জাতে গর্জাতে সাত ফুট লম্বা এক রাক্ষস ঢুকল ঘরে। সন্ধ্যার পর পরই হাশেম কবিরাজ সবাইকে রক্ষাকবচ গলায় পরতে ও পবিত্র পানি দিয়ে শরীর মুছে নিতে বলেছিল। এই রক্ষাকবচের জন্য কোনও অপশক্তি তাদের কারও ক্ষতি করতে পারবে না। পারার কথাও নয়। কুৎসিতদর্শন রাক্ষসটাকে দেখে আতঙ্কিত হলেও নিজেদেরকে সামলে নিল সবাই।
রাক্ষসটা ঘরে ঢুকে কঠিন এক গর্জন ছাড়ল। এতে জয়গুন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাজিদের পাশে। হামহাম নামের সেই কুৎসিত রাক্ষস চাইল হাশেম কবিরাজের দিকে এগিয়ে যেতে। কিন্তু অদৃশ্য এক শক্তিতে বাধা পেল সে। চিৎকার করে উঠল। হাশেম কবিরাজ তার সামনে রাখা বিভিন্ন উপাদান নিয়ে ছুঁড়ে মারল দুই পরীর দিকে। এবার রাক্ষসটাকে মারবার আগেই ক্ষিপ্ত হামহাম তার হাত চালিয়ে আশ্রাফ আলীকে নাগালে পেয়ে পেল।
সন্ধ্যার পর আশ্রাফ আলী তার রক্ষাকবচ খুলে বাথরুমে গিয়েছিল। পরে ফিরে আর তা গলায় দিতে ভুলে গেছে। এ কারণে হামহাম রাক্ষস তাকে ধরতেই পারে। আর ধরতে পেরেই উল্লাসে ফেটে পড়ল সে। হাশেম কবিরাজ খুলবুল শেকড় ছুঁড়ে মারার আগেই ভাঙা পুতুলের মত করে আশ্রাফ আলীকে ঘরের চালায় ছুঁড়ে মারল রাক্ষস।
চোখের পলকে পেঁজা তুলার মত উড়ে গেছে আশ্রাফ আলী।
ঘরের মানুষগুলো ভয়ে ঢেকে ফেলল চোখ। মুহূর্তে বলের মত চালে বাধা পেয়ে সশব্দে মাটিতে পড়ল আশ্রাফ আলীর ভারী দেহ। পড়ামাত্রই নিথর হয়ে গেল সে। কারও কল্পনাতেই ছিল না এমনটা ঘটবে। এবার তার সামনে রাখা বড় একটা হাঁড়ি থেকে নিয়ে দুই পরীকে লক্ষ্য করে মন্ত্রপূত তেল ছুঁড়ে মারল হাশেম কবিরাজ। সেই তেল গায়ে পড়ামাত্র তাদের দু’জনের শরীরে জ্বলে উঠল আগুন। বিকট স্বরে চিৎকার ছাড়ল হামিদা ও সুখরান। ভোজবাজির মত আস্তে আস্তে আকারে ছোট হতে থাকল তাদের দুটো দেহ।
এরপর হাশেম কবিরাজ সেই একই তেল হামহামের দিকেও ছুঁড়ে মারল। দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠল রাক্ষসটা। তারপর একইভাবে আকারে ছোট হতে লাগল সে।
অন্য একটা পাত্র থেকে অষ্টধাতুর মিশ্রণ তুলে ওদের দিকে ছুঁড়ে মারল হাশেম কবিরাজ। এবার অষ্টধাতুর স্পর্শ লাগতেই নিভে গেল তাদের শরীরের আগুন। আকারে ছোট হতে শুরু করে ধীরে ধীরে বিড়াল ছানায় রূপ নিল দুই পরী। আর রাক্ষস হামহাম হয়ে উঠল একটা কুকুর। সবার সামনে দুই বিড়াল ছানাকে দাবড়ে তাড়িয়ে নিয়ে গেল কুকুরটা।
অবশ্য এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী থাকল শুধুমাত্র কাজেম ও কবিরাজ। কারণ জয়গুনের মত আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছে ময়না। আর মাজিদ চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল ভয়ে। যত যাই হোক, ক্লাস টেনে পড়া পনেরো বছরের বালক সে।
পরদিন ধর্মীয় সব অনুষ্ঠান সেরে মাটি দেয়া হলো আশ্রাফ আলীকে। এরপর পরীর মেয়ে জয়গুনকে নিয়ে আর কোনও সমস্যা হয়নি। বাবার মৃত্যুতে কাজেম খুব মর্মাহত হলেও এটাকে একটা দুর্ঘটনা ভেবে মেনে নিয়েছে সে।
দশ
সাত বছর পর।
মাজিদের বাবা-মা তাঁদের কথা রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের ছেলের বউকে তুলে নিলেন ঘরে। সারা গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করা হলো ওই বিয়েতে।
মাজিদ এখন পড়ে মেডিকেলে ফাইনাল ইয়ারে। ক’দিন পরেই হবে পুরোপুরি ডাক্তার। সুন্দরী জয়গুনও কম যায় না। সে-ও মেডিকেলে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ে। ওরা ঠিক করেছে, পাশ করার পর দু’জনেই গ্রামে ফিরবে। তারপর কাজেম আলীর দান করা বিশাল জায়গাটাতে গড়ে তুলবে হাসপাতাল। হাসপাতালের নামও ভেবে রেখেছে জয়গুন।
হাসপাতালের নাম হবে আশ্রাফ আলী মেমোরিয়াল হাসপাতাল।
এগারো
সময়ের হাত ধরে কেটে গেল আরও দশটি বছর।
গ্রামে এখন আছে চমৎকার একটি হাসপাতাল। সেখানে শুধু এলাকার সাধারণ মানুষ চিকিৎসা পায়, তা নয়। বরং এ হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে দূর-দূরান্ত থেকেও আসে লোকজন। বেশিরভাগ মানুষ ভাল চিকিৎসার জন্য এলেও কেউ কেউ আসে পরীর মেয়ে জয়গুনকে দেখতে। অবশ্য ওকে কখনও ডাকা হয় না পরীর মেয়ে হিসেবে। সবাই তাকে বলে ডাক্তার জয়গুন।
.
দুপুর একটা বাজে।
আশ্রাফ আলী মেমোরিয়াল হাসপাতালের গেটে এসে থামল একটা রিক্সা। ওটা থেকে নামল স্কুল ফেরত ক্লাস ফোরের ছাত্র আশ্রাফ মাজিদ। তাকে দেখে অ্যাপ্রন পরা ডাক্তার জয়গুন ছুটে গেল গেটের দিকে।
ছেলেকে কোলে করে হাসপাতাল কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়াল ডাক্তার জয়গুন। এখন স্বামী, সংসার আর ছোট আশ্রাফ ও এই হাসপাতালকে ঘিরেই সুখে কেটে যাচ্ছে তার জীবন।
হাফিজ রাসা