রোমশ – নাসির খান

রোমশ

‘বাবু, আজ বাসায় কেউ নেই। আত্মহত্যা করবার জন্য আজকের থেকে ভাল কোন দিন পাব বলে মনে হয় না। কি বলিস? বাবু, তুই তো জানিস গলায় দড়ি দিতে আমি খুব ভয় পাই। তা ছাড়া এটা লজ্জারও। দেখা গেল কোন না কোনভাবে তোরা আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছিস, তখন আমার গলায় গোলাকার একটা ঘায়ের মালা হয়ে থাকবে, যে ঘায়ের মালায় মৌমাছির বদলে মাছি ঘোরাঘুরি করবে। তা ছাড়া আমি চাই না কেউ দেখুক আমি মা কালীর মত জিভ বের করে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছি। তাই তোর খাটের নিচে রাখা ইঁদুর মারা বিষ খেলাম আর হ্যাঁ, আমার লাশ তোর ঘরে খাটের নিচেই পাবি। আমার উপর রাগ রাখিস না। ইতি-তোর বড় ফুপু।’

ঘরে ঢোকার আগেই জমেলা খালা চিঠিটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘আফায় দিছে। কইল তুই ঘরে ঢুকার আগেই যেন তোর হাতে দেই। কাহিনী কী, মামা? ‘

কাহিনী জমেলা খালাকে বলা প্রয়োজন মনে করলাম না। কারণ চিঠি পড়ে উদ্বিগ্ন হবার মত কিছু নেই। আমার বড় ফুপুর মাথায় সমস্যা। সমস্যা বলতে বিরাট সমস্যা। পাবনায় গিয়ে পাগলাগারদে ভর্তি করানোর মত সমস্যা। এমন ঘটনা এর আগে আরও দু’বার হয়েছে। আরও দু’বার বড় ফুপু সুইসাইড নোট লিখে রেখে দিয়েছিল বাবার জামার পকেটে। তার মধ্যে একবার ফুপু ছাদের চিলেকোঠায় লুকিয়ে ছিল। আরেকবার বাড়ির পিছন দিকের জঙ্গলের শেষের দিকটার ডোবায় একহাঁটু কাদা মাখামাখি হয়ে হাতিয়ে মাছ ধরছিল। সেদিন ভর দুপুর বেলায় খুঁজতে- খুঁজতে ডোবার পাশে গিয়ে দেখি শুধুমাত্র পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে কাদার মধ্যে বড় ফুপু দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ইয়াবড় একটি কালো কুচকুচে মাছ। আমি আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ফুপুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড় ফুপু! আপনি মারা যাননি?’

আমার প্রশ্নে খুব বিরক্ত হয়ে বড় ফুপু আমার দিকে বড় বড় চোখ করে চেয়ে বলল, ‘না, মরিনি। তোর কোন সমস্যা? মাছ খাবি? ওইখানে দেখ কাপড় ভরা মাছ।’

আমি অবাক হয়ে দেখলাম ডোবার পাশে রাখা বড় ফুপুর কাপড় ভর্তি মাছ। এত মাছ বড় ফুপু হাত দিয়ে ধরেছে আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমি ফুপুকে জিজ্ঞেস করতে যাব, তার আগেই ডোবা থেকে উঠে এসে, আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই, দুনিয়া কাঁপানো একটি চড় দিয়ে আমাকে অজ্ঞান করে দিল ফুপু।

তাই এমন ঘটনা ঘটানো বড় ফুপুর সুইসাইড নোটে আমাদের তেমন কোন বিকার নেই। হয়তো কোথাও লুকিয়ে

আছে বড় ফুপু। আমরা যখন খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাব, তখন কোন এক জায়গা থেকে বেরিয়ে ফুপু বলবে, ‘দেখলি তো, বাবু, আমি কী সুন্দর অভিনয় করতে পারি!’

মা-বাবা, দাদী, কণা আপা কেউ বাসায় নেই সকাল থেকে। ভবানীপুরে কোথায় নাকি নতুন মাজার শরীফের সন্ধান মিলেছে। তাই পুরো পরিবার গিয়েছে সওয়াব আদায় করতে। বাবা, মা আর দাদীর বুদ্ধি সম্পর্কে আমার জানা আছে। কিন্তু কণা আপা কী মনে করে মাজারে গেল কে জানে।

বাড়ির সবার রুম বাইরে থেকে তালা দেয়া। কেবল আমার আর বড় ফুপুর রুম বাদে। বড় ফুপুর রুমে ঢুকে দেখি কেউ নেই। ফাঁকা রুম। ভর দুপুরে ফুপু কখনও নিজের রুম ছাড়া বাইরে থাকে না। জমেলা খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খালা, ফুপু তো রুমে নাই। কোথায়, জানেন?’

উত্তর নেতিবাচক।

জমেলা খালা সকাল থেকেই নাকি কাপড় ধোয়া আর খড়ি কাটায় ব্যস্ত। বড় ফুপুর খোঁজ রাখার সময় তার নেই। অথচ এখন যদি টিভি ছেড়ে দিই, তার কোন কাজ থাকবে না। সোজা মেঝেতে গেড়ে বসে চলচ্চিত্র সম্পর্কে একান্ত ব্যক্তিগত মতামত দিতে শুরু করবে। ‘এই নায়িকার গায়ে গোশ্ত নাই। এমন চিংড়ি মাছ নায়িকা হয় ক্যামনে?’

শুধু এই না। নায়িকার দুঃখের সিকোয়েন্সে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যে চোখের জল ঝরায় সে আমাদের জমেলা খালা।

আমার রুমে এসে কী মনে হতে একবার খাটের নিচে উঁকি দিয়ে চমকে গেলাম। বড় ফুপু শুয়ে আছে। শুধু পেটিকোট আর ব্লাউজ পরা। মুখ দিয়ে ঘন সাদা ফেনা গড়াচ্ছে। দু’একটি মাছিও ওড়াউড়ি করছে। আমার বুক কেঁপে উঠল। বড় ফুপু সত্যি বিষ খেয়েছে। পাশেই ইঁদুর মারা বিষের প্যাকেট। ঘটনার অবিশ্বাস্যতা আর আকস্মিকতা এমন পর্যায়ে যে আমি কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না। বাইরে থেকে খাটের নিচে হাত বাড়িয়ে দু’তিনবার ফুপুকে নাড়াচাড়া দিয়ে ডাকলাম। নিশ্চিত হলাম ফুপু সত্যি মারা গেছে।

আমি ছেলেটা একটু আলাদা। যে কোন কিছুতে নির্বিকার থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা আমার কাছে কোন ব্যাপার না। শুধু মনে-মনে কয়েকবার বলি, ‘যা হবার সেটা হয়েই গেছে। এখন আর কিছু করার নেই। মাথা কুটে কোন লাভ নেই।’ এই লাভের হিসাব গুনতে গুনতে কলপাড়ে এসে জমেলা খালাকে বললাম, ‘জমেলা খালা, বড় ফুপু মারা গেছে। আমার খাটের নিচে লাশ পড়ে আছে।’

জমেলা খালা কাঁদো-কাঁদো মুখ করে আমার দিকে তাকাল। নিমেষেই খালার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। এবং আমার সাহস জোরাল করতেই বোধহয় ঠিক তখনই বাড়ির সবাই চলে এল। আমাকে কিছু বলতে হলো না। মাকে দেখেই জমেলা খালা এক চিৎকার দিয়ে সব খুলে বলল। সম্ভবত বড় ফুপু মারা গেছে কেউ বিশ্বাস করল না। বাবা এক দৌড়ে আমার রুমে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ছেলেমানুষের মত বাবা কাঁদছে দেখে কণা আপা আর মা-ও কাঁদতে শুরু করল। সম্ভবত এখন থেকে শুরু হলো মৃত বাড়ির মত পরিবেশ।

পাশের বাসার আনোয়ার চাচা এসে অকারণে দৌড়াদৌড়ি করতে শুরু করলেন। অমুক করো, তমুক করো, পুলিসে খবর দাও আরও কত কী। বাবা, আমি আর আনোয়ার চাচা মিলে ফুপুর লাশ বের করার জন্য চেষ্টা করছি, তখন খাটের নিচ থেকে গড়াগড়ি দিয়ে বাইরে এসে ফুপু বলল, ‘বাবু, বিষটা মনে হয় দুই নম্বর ছিল। কতক্ষণ ধরে মরার জন্য শুয়ে আছি! ওয়াক থুহ্।’

আমার বড় ফুপুর পাগলামির ধরন ঠিক এমনই। কিছুদিন পুরো সুস্থ মানুষ। হঠাৎ-হঠাৎ আবার পাগলামি। দাদী কতরকম কবিরাজের কাছ থেকে কতরকম তাবিজ এনে ফুপুর গলায় পরিয়ে দিল, কিছুতেই বড় ফুপু সুস্থ হয় না। তাবিজের সংখ্যা যখন বারো-তেরোটা, তখন একদিন সবগুলো তাবিজ গলা থেকে খুলে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করে কোথায় যেন ফেলে দিল বড় ফুপু।

বিষ খাওয়ার পর থেকে বড় ফুপুর সমস্যা দিন-দিন বাড়তে লাগল। প্রায় রাতেই বড় ফুপু সবাইকে চেঁচিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। গত শুক্রবারের কথা। রাত প্রায় দেড়টার দিকে পাড়া কাঁপানো শব্দে ফুপু চেঁচাতে লাগল। আমি বিছানায় শুয়ে কান পেতে শুনলাম ফুপু ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে আর বলছে, ‘ও, মা, আমারে বাঁচাও। এই শুয়োরের বাচ্চারে এইখান থেকে যাইতে কও। ও, মা, ও, মা, ও, বাবু, আমারে বাঁচা।’

আমি গিয়ে দেখলাম ফুপুর রুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। বাবা দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে ঘেমে গেছে। দাদী বারান্দার মেঝেতে বসে কাঁদছে আর মা কণা আপার পাশে ভয়ার্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার শত অনুরোধেও ফুপু দরজা খুলল না। আমি এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে বললাম, ‘বড় ফুপু, আমি বাবু। প্লিজ, দরজা খোলেন।

বড় ফুপু রাজি হলো। কিন্তু শর্ত হচ্ছে আমি আর কণা আপা ছাড়া রুমে কেউ ঢুকতে পারবে না। আর এখন থেকে আমি আর কণা আপা ছাড়া এই বাড়ির আর কারও সঙ্গে ফুপু দেখা করবে না। সবাইকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আর আপা ফুপুর ঘরে ঢুকলাম। সব কিছু লণ্ডভণ্ড। বিছানার চাদরের নিচে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। সারা চাদর ভরা রক্ত। অথচ ফুপুর শরীরের কোথাও আঘাত লেগে কেটে- ছড়ে যায়নি। কণা আপা ফুপুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপনার রুমে কে এসেছিল, বড় ফুপু?’

বড় ফুপু আবার কাঁদতে শুরু করল। বলল, ‘বিরাট একটা জানোয়ার। সারা গায়ে বড়-বড় ঘন কালো লোম। আমারে শেষ করে দিল। ওই শুয়োরটা আমারে বাঁচতে দিবে না।

আমি আর কণা আপা সে রাতে ফুপুর সঙ্গে ঘুমালাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ফুপু উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। আর ফুপুর পিঠ ঘন কালো বড়-বড় লোমে ছেয়ে গেছে। আমার অবাক হওয়ার সীমা থাকল না। হায়, খোদা, এসব কী দেখছি আমরা!

বড় ফুপুর শত নিষেধ সত্ত্বেও ব্যাপারটা বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দিলাম। কিন্তু বাবার কথামত বাড়ির কয়েকজন ছাড়া যেন বাইরের কেউ এসব জানতে না পারে এ ব্যাপারে সবাই সচেষ্ট থাকলাম। কারণ এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনা জানাজানি হলে প্রতিদিন বাড়িতে লোক আসতে থাকবে। মিডিয়ার লোক এসে বাড়িটাকে চিড়িয়াখানা বানিয়ে দেবে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।

দিন পার হয় আর বড় ফুপুর ঘরে আত্মগোপনের মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। এতদিন আমি ফুপুর ঘরে যেতে পারতাম। কিন্তু ইদানীং ফুপু আমাকে তার ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। জানালা দিয়ে খাবার রেখে আসা হয়। বড় ফুপু কোন উচ্চবাচ্য করে না। লক্ষ্মীর মত খাবার খায়। তারপর চুপ করে ঘুমিয়ে যায়। আর দাদীর জোগাড় করা বিভিন্ন সাইজের তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে রাখে।

বাবার বোনদের মধ্যে বড় বলে আমরা এই ফুপুকে বড় ফুপু বলে ডাকি। বড় ফুপুর বয়স চল্লিশের একটু বেশি হবে। সবার মুখেই শুনেছি, ফুপুর এমন অবস্থা আগে ছিল না। ফুপুর বয়স যখন আঠারো-উনিশ, তখন ফুপুর বিয়ে দেয়া হয়। দাদী আর বড় ফুপুর কাছে যেমনটা শুনেছি, তাতে গল্পটা ছোট্ট করে এভাবে বলা যায়-

ভারতে বসবাসরত সুলতান নামে এক ফরেস্ট অফিসারের সঙ্গে ফুপুর বিয়ে হয়। সুলতান নামের লোকটি আমার এই অপরূপা ফুপুকে নিয়ে যান ভারতে। সেখানে ফুপুর অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসবাস করতে নিয়ে যান মাত্র দুটি ফ্যামিলি থাকে বনবিভাগের এমন এক কোয়ার্টারে।। চারপাশে জঙ্গল আর মাঝখানে মাত্র সাতজনের বসতি। ফুপু নাকি জঙ্গলের মাঝখানে থাকতে একদম পছন্দ করত না। সারাদিন-সারারাত ঘরের মধ্যে থাকা ফুপু একদিন সন্ধ্যায় একাই ঘুরতে বেরোয় জঙ্গলে। ঠিক কী কারণে ফুপুর যেন সাহস, অনেক বেড়ে যায় সেদিন। চারপাশে সারি-সারি গাছের ঘন বন আর বুনোফুলের গন্ধভরা সরু একটি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে বড় ফুপু গহীন বনে চলে যায়। আকাশে তখন হালকা চাঁদের আলো।

অন্যান্য দিন ফুপা সন্ধ্যার পরপর অফিস থেকে বাসায় ফিরে ফুপুকে রুমে পান। কিন্তু সেদিন ফুপুকে তিনি না পেয়ে দক্ষিণের রুমে থাকা আরেক কর্মকর্তার রুমে গিয়ে খোঁজ নিয়েও কিছু জানতে পারেন না। বড় ফুপা সত্যি-সত্যি অবাক হন, সঙ্গে কিছুটা আতঙ্কিতও। যে জঙ্গলের ভয়ে সারাদিন রুমে থাকে, সে এতরাত অবধি কোথায় থাকবে? রাত বাড়তে থাকে, তবু ফুপু ফিরে আসে না। দাদীর মুখে শুনেছি, ফুপু ফিরে আসছে না এই দুশ্চিন্তায় আর ভয়ে ফুপা নাকি সেদিন কেঁদে ফেলেছিলেন।

রাত এগারোটার দিকে লোকজন খবর দিয়ে এনে ফুপুকে খোঁজা শুরু হয়। সারা জঙ্গল জুড়ে জ্বলতে থাকে মশালের আলো। একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাক আর একেকজনের হাতে বনবিভাগের সংরক্ষিত মশালের জ্বলন্ত আগুন। এক অন্যরকম পরিবেশ।

রাত প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে জঙ্গলের পশ্চিম দিকের ডোবার পাশে বড় ফুপুকে পাওয়া যায় অচেতন অবস্থায়। অক্ষত শরীরের অর্ধেক ডোবার পানিতে আর অর্ধেক ডাঙায়। পরনে শুধু ব্লাউজ আর পেটিকোট। আশপাশে কোথাও খুঁজে ফুপুর শাড়ি পাওয়া গেল না।

সেদিনের পর থেকে আমার বড় ফুপুর মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। প্রায় রাতেই নাকি ফুপু দেখত তার শরীরের উপর বিশাল এক জানোয়ার বসে আছে। জানোয়ারটির সারা শরীর লোমে ঢাকা। কত রাত ভয়ে দরজা খুলে ফুপু জ্ঞানশূন্য হয়ে কোথায় চলে গেছে! আবার সবাই মিলে জঙ্গল থেকে ফুপুকে খুঁজে এনেছে। সমস্যা চলতে থাকল বড় ফুপুর। কিন্তু এর দায় মেটাতে হলো ফুপাকে। একদিন রাতে জঙ্গলে ফুপুকে খুঁজতে গিয়ে ফুপাও ফিরে এলেন না। বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তা ভোরের দিকে ফুপুকে পেলেন সেই ডোবার ধারে। আর ফুপাকে পেলেন ডোবা থেকে একটু দূরে মৃত অবস্থায়। এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনা এর আগে কোনদিন সেখানে ঘটেনি। ফুপার সারা গায়ে ছিল নখের আঁচড় আর কামড়ানোর দাগ। বনবিভাগের কর্মকর্তারা এখানে এ যাবৎকালে এমন কোন প্রাণী দেখেননি যেটা এভাবে কোন ঘটনা ঘটাতে পারে। আবার এ ঘটনাকে পুরোপুরি ভৌতিকও বলা যায় না। প্রথমত অনেকের ভূতে বিশ্বাস নেই। তার ওপর কোন ভূত এমন ঘটনা ঘটায়, এমন কিছু কেউ দেখেনি। বড় ফুপুর বিবাহিত জীবনে ভারতের জঙ্গলে বসবাসের গল্প এখানেই শেষ। এমনটিই শুনেছি।

তারপর থেকে বড় ফুপু চলে আসে আমাদের বাড়িতে। শত চেষ্টা করেও বড় ফুপুকে আবার বিয়ে করতে রাজি করাতে পারেনি কেউ। কিছুদিন পরপর রাতের সেই সমস্যা আর আত্মহত্যা করার সমস্যা ছাড়া তেমন কিছু উল্লেখ করার মত ঘটেনি। মাঝে-মাঝে যদিও উন্মাদের মত আচরণ করে ফুপু, সেটা খুব কম।

তিন মাস হয়ে গেল আমরা কেউ বড় ফুপুকে এক নজর দেখিনি। রুমের সব ছোটখাট ফাঁকফোকর ফুপু বন্ধ করে দিয়েছে। সবাই কর্তবার গিয়ে বড় ফুপুকে অনুরোধ করে। ফুপু শুধু খসখসে গলায় বলে, ‘তোমরা যাও। আমি আর এখন তোমাদের কেউ না।’

জমেলা খালা একদিন জানালায় ভাত রেখে আসতে গিয়ে খুব বড় রকম ভয় পেয়ে গেল। ঘটনা কী জানতে চাইলে জমেলা খালা হেঁচকি টানতে-টানতে বলে, সে নাকি জানালার ফাঁক দিয়ে একটুখানি উঁকি দিয়ে দেখেছে ঘরের মধ্যে তিনটে জানোয়ার। একটা ছোট আর দুটো বড়। আজীবন জমেলা খালার বাড়িয়ে বলার অভ্যাস। আমি ধমক দিয়ে বললাম, ‘জানোয়ার-জানোয়ার করছেন কেন? জানোয়ার মানে কী?’

জমেলা খালা তারপরও কাঁদতে-কাঁদতে বলে, ‘কুত্তার মত দেখতে। তিনটা কুত্তা। ও, আল্লা, এইডা তুমার কীয়ের গজব!’

এতদিনে ফুপুর সমস্যা অনেক আত্মীয়-স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী জেনে গেছে। প্রায় দিনই কেউ না কেউ বাড়িতে আসছেই। কোন লাভ নেই। কারও সঙ্গেই ফুপু দেখা করে না। একদিন আমি টানা এক ঘণ্টা ফুপুর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম, যদি ফুপু আমার সঙ্গে একটু দেখা করে। কোন লাভ হলো না। শুধু জানালার ওপাশ থেকে ফুপু ফিসফিস করে ঠিক আগের মত বলল, ‘বাবু, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না রে। জোড় হাত করে বলি আমার উপর রাগ রাখিস না।’

আমিও ফুপুর মত ফিসফিস করে বললাম, ‘প্লিজ, ফুপু, আমার খুব কষ্ট লাগছে। দরজা খোলেন। খুব ইচ্ছা হচ্ছে আপনাকে একবার দেখি।’

‘আমাকে দেখলে তুই খুব ভয় পাবি, বাবু। আমি আর আগের মত নাই।’

আমার এত খারাপ লাগল! আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। কণা আপা এগিয়ে এসে খুব অবাক হয়ে বলল, ‘কাঁদিস না, বাবু। কাল দাদী বড় হুজুরের দেয়া তাবিজ ফুপুকে পরাবে। বড় হুজুর বলেছে তাবিজ নেয়ার সাত ঘণ্টার মধ্যে ফুপু ভাল হওয়া শুরু করবে। দেখিস বড় ফুপু ভাল হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না, ভাই।’

শুক্রবার সকাল বেলা ফুপুকে আমি নিজ হাতে জানালায় তাবিজটা দিয়ে এলাম। ফুপু কথা দিল তাবিজটা ডান কোমরে ঝুলিয়ে পরে নেবে। আমি বিকেল থেকেই বুক ভরা আশা নিয়ে ফুপুর দরজার সামনে ঘুরঘুর করতে লাগলাম।

রাত দশটা মত হবে। এখনও ফুপুর দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। আমি দরজা ধাক্কাতে যাব, ঠিক তখনই জমেলা খালার আর্তচিৎকার। তার ভয়ার্ত চিৎকারে বাড়ির সবাই গিয়ে দেখি কলপাড়ের পাশে ঝোপমত জায়গায় জমেলা খালা রক্তশূন্য মুখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। বাবা আশপাশে টর্চ মারতেই আমার শরীর হিম হয়ে গেল। দেখলাম মানুষের মত মুখ, আর গরিলার মত শরীর নিয়ে তিনটা প্রাণী নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। একটি বড়, একটি মাঝারি, একটি ছোট। যেন একটি মৃত পরিবার। সারা গায়ে লোম। ঘন কালো বড়-বড় লোম। আমি বাবার হাত থেকে টর্চ লাইট নিয়ে আলো ফেলে দেখলাম পশুগুলোকে। মাঝারি আকারের পশুটার মুখে আলো ফেলে চমকে গেলাম। দেখলাম ওটা আমার বড় ফুপু।

নাসির খান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *