নীল চোখের রহস্য – নূরুন নিসা মুন্নি

নীল চোখের রহস্য

শীতের সন্ধ্যা, চারদিকে নামছে অন্ধকার। দূর দিগন্তে শেষ আলোর রেশটুকু মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার মাঝে। প্রকৃতির এই পরিবর্তন বা সৌন্দর্য দেখার মত সময় ঢাকা শহরের ব্যস্ত মানুষের নেই। ইফা দশতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতি এবং শহর দেখে সময় কাটাচ্ছে। ওর একা-একা ভাল লাগে না, তাই সবসময় পছন্দ করে হইচই করতে। কিন্তু কার সঙ্গে হইচই করবে? তাকে সময় দেবার মত কেউ তো নেই! সারাদিন থাকে বাসায় একা। সময় কাটাতে হয় শুয়ে-বসে। বেশিরভাগ সময় কেটে যায় অতীত ভেবে। বাবা-মায়ের আদরের মেয়ে, ভাই-ভাবী, ছোট বোন অন্তু, পুকুর ঘাট, টিনের বাড়ি, উঠানের ফুলগাছ, আরও কত কিছু! কিন্তু এখন, বিয়ের পরে, উঁচু বিল্ডিং-এ ফ্ল্যাট, একাকী সংসার, মস্ত শহর, ব্যস্ত মানুষজন আর ব্যস্ত একজন স্বামী। জুয়েলের সঙ্গে ইফার বিয়ে হয়েছে ছয় মাস আগে। যেদিন বিয়ে হলো, তার পরদিনই ওরা চলে এসেছে ঢাকা শহরে। সেই থেকে ইফার একাকীত্ব শুরু…

জুয়েল খুব করিৎকর্মা মানুষ, পেশা ব্যবসা আর নেশা হলো টাকা রোজগার করা। সবসময় নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে পড়ে আছে। তাই ইফাও সুযোগ পায় না স্বামীর সঙ্গে গল্প করতে। এভাবেই দূরে রয়ে গেছে ওরা, চেনা আর হয়ে ওঠেনি একজন আরেকজনকে। জুয়েলের কথা মনে হতেই ইফা ভাবল, ওকে একবার কল করি।

দেরি হলো না মোবাইল ফোনে কল দিতে।

একবার, দুইবার, তিনবারেও কল রিসিভ করল না জুয়েল।

তার দশ মিনিট পর কল এল ইফার মোবাইলে।

‘হ্যালো!’

‘হ্যালো, হ্যাঁ, কল করেছিলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেন? কোনও প্রবলেম?’

‘না।’

‘তা হলে?’

‘এমনিতেই কল করেছি।’

‘ও, আচ্ছা। আমি এখন একটু ব্যস্ত, পরে…’

‘তুমি কখন আসবে?’

‘ঠিক নেই, তুমি খেয়ে নিয়ো।’

‘আচ্ছা।’

‘ঠিক আছে, রাখি।’

স্বামী-স্ত্রীর কথা শেষ।

মন আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল ইফার।

.

রাত বারোটায় কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙল ইফার। তাড়াতাড়ি গিয়ে খুলে দিল দরজা। জুয়েল এসেছে। সে ঘরে ঢুকতে নাকে বাজে একটা গন্ধ পেল ইফা। দেখল জুয়েলের চোখদুটো লাল। তাই জিজ্ঞেস না করে পারল না, ‘তোমার চোখ লাল কেন? আর এত বিচ্ছিরি গন্ধ কীসের?’

যেন ইফার কথা শুনতেই পেল না জুয়েল, সোজা বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।

‘কই, বললে না যে? তোমার এ অবস্থা কেন?’

জুয়েল এবারও কোনও উত্তর দিল না।

‘আশ্চর্য! কথা বলছ না কেন? তা হলে কি তুমি…এ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’

খুব বিরক্তির সঙ্গে জুয়েল বলল, ‘কী বিশ্বাস হচ্ছে না?’

‘তুমি কি…মদ খেয়েছ?’

খুব জোরে হেসে উঠল জুয়েল, যেন ইফার প্রশ্নটা হাস্যকর। হেসে বলল, ‘হ্যাঁ।’

এ কথা শুনে মাথায় বাজ পড়ল ইফার। পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল। নড়াচড়ার শক্তি পাচ্ছে না। বুঝতে পারছে না, এখন কী করবে। বিয়ের পর এই প্রথম জুয়েলকে এ অবস্থায় দেখছে।

.

সকাল দশটা।

জুয়েল জেগে উঠে দেখল, গতকালকের পোশাক এখনও পরনে। গতকাল রাতের কথা মনে পড়ল ওর। রুমে নেই ইফা। আওয়াজ আসছে রান্নাঘর থেকে। জুয়েল রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। ওকে দেখে সঙ্গে-সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিল ইফা।

‘সরি, আই অ্যাম রিয়েলি সরি,’ বলল জুয়েল।

কিছুই বলল না ইফা। নিজ কাজে মন।

‘আসলে কালকে কিছু লোকের সাথে পরিচয় হয়েছে। তারাই জোর করে খাওয়াল। আমিও কিছু বলতে পারিনি। বোঝোই তো ব্যবসার খাতিরে অনেক কিছুই করতে হয়।’ গিয়ে পিছন থেকে ইফাকে জড়িয়ে ধরল জুয়েল।

ইফাও কোনও বাধা দিল না।

‘সরি…’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু আর কখনও যেন এমন না হয়।’

‘তুমি কষ্ট পেয়েছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘আর এমন হবে না।’

‘তুমি সারাদিন থাকো না, রাতেও আসো দেরি করে। আমার একা-একা খুব কষ্ট হয়।’

‘আসলে একটা নতুন কাজ পেয়েছি। তাই একটু বেশি সময় দিতে হচ্ছে।’

‘যাও, ফ্রেশ হয়ে এসো, নাস্তা দিচ্ছি।’

নাস্তা খেতে বসে জুয়েল বলল, ‘ওহো, তোমাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি।’

‘কী কথা?’

‘আজ রাতে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি।’

এ কথা শুনে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নামল ইফার।

‘আরে, তুমি কাঁদছ নাকি!’

‘কই, না তো!’ ইফা তাড়াতাড়ি মুছে ফেলল চোখের পানি। ‘কেন যাচ্ছ? ব্যবসার কাজে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কোথায়?’

‘চিটাগাং-এ, সেখানে কিছু কাজ চলছে, সেগুলো দেখতে হবে।’

‘কাদের কাজ?’

‘কাল যাদের সাথে পরিচয় হলো।’

‘ক’দিন লাগবে?’

‘এই ধরো, তিন-চার দিন।’

‘ঠিক আছে, তোমার ব্যাগ গুছিয়ে দেব।’

.

ইফা গুছিয়ে দিল স্বামীর ব্যাগ, মনটা খারাপ। কিন্তু রাত নয়টায় যখন জুয়েল চলে গেল, আর পারল না মনটাকে সামলে নিতে। কান্নায় ভেঙে পড়ল ও। একসময় ঘুমিয়ে গেল কাঁদতে-কাঁদতে।

হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভাঙল ইফার।

ঘড়িতে রাত সাড়ে বারোটা।

অস্বস্তি লাগছে ইফার। চারপাশ কেমন নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ। ঘরটাতে যেন বহু দিনের ভাপসা, গুমট একটা ভাব। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল ওর। মনে হলো, খোলা জায়গায় যেতে না পারলে এক্ষুণি মারা পড়বে। ঘরটাতে যেন অক্সিজেনের অভাব। কিন্তু এত রাতে কোথায় যাবে? তা ছাড়া জুয়েলও তো নেই!

হঠাৎই মনে হলো যেতে পারে ছাদে।

কিন্তু এই অন্ধকারে কি যাওয়া সম্ভব?

তা ছাড়া, ও এর আগে কখনওই ছাদে যায়নি।

আরও বাড়তে লাগল ইফার অস্বস্তি। খুব অস্বাভাবিক লাগছে সবকিছু।

নাহ্! আর থাকা যায় না গুমট ঘরে।

বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বেরিয়ে এল ইফা। এত রাতেও জ্বলছে সিঁড়ির লাইট। একা-একা ছাদে যেতে একটুও সমস্যা হলো না। পুরোপুরি অন্ধকার নয় ছাদ। মোটামুটি দেখা যাচ্ছে সবকিছুই। ছাদে এসে কমল অস্বস্তির ভাবটা। ফুরফুরে বাতাসে হালকা হলো মন। রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে দেখল শহরটাকে। এখন কোনও ব্যস্ততা নেই। মনে পড়ল জুয়েলের কথা। আনমনে স্বামীর কথা ভাবতে-ভাবতে চলে এল ছাদের আরেক প্রান্তে। এখানে সারিবদ্ধভাবে আছে অনেকগুলো পানির ট্যাংক। ইফা ঘুরে আরেক দিকে যাবে, এমন সময় দেখল দুই ট্যাংকের ফাঁকে সাদা কী যেন। আরেকটু কাছে যেতেই দেখল, নীল জিন্স প্যান্ট এবং সাদা ফতুয়া পরে রেলিঙে শুয়ে আছে একটা ছেলে।

ইফা ভাবল, চলে যাওয়া উচিত, কিন্তু এমন এক জায়গায় শুয়ে আছে ছেলেটা, যে-কোনও মুহূর্তে অ্যাকসিডেন্ট হবে। তাই এগিয়ে গেল ও। ‘এই যে, শুনছ?’

নারীকণ্ঠ শুনে ইফার দিকে চাইল ছেলেটা।

ইফা দেখল, সে বাচ্চা ছেলে নয়। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক।

একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবারও আকাশে নিষ্পলক চেয়ে রইল।

ইফা দেখল, যুবকটির চোখের মণি নীল রঙের। আগের চেয়ে জোরে বলল ইফা, ‘এই যে, আমি তোমাকে বলছি তুমি কি শুনতে পাও না?

‘জী, ভালভাবেই শুনতে পাই। আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? আমি তো আপনার পরিচিত কেউ নই।

‘তাতে কী? পরিচিত হব। আর তুমি করে বলেছি, কারণ ভেবেছি আপনি আমার থেকে ছোট। রেলিং-এর ওপর শুয়ে আছেন কেন? আপনার ভয় করছে না?’

‘না। বরং ভালই লাগছে।’

ইফা চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। এক পা বাড়াতেই পিছন থেকে যুবকটি বলল, ‘চলে যাচ্ছেন?’

রেলিং-এর ওপর উঠে বসেছে যুবকটি। ইফা বলল,

‘হ্যাঁ। কেন?’

এখানে ভাল লাগছে না?’

‘নাহ্।’

‘আকাশ ভাল লাগছে না?’

‘না।’

‘খোলামেলা এই মুক্ত বাতাস ভাল লাগছে না?’

‘না।’

‘আমাকে ভাল লাগছে না?’

‘আশ্চর্য, আপনি এত প্রশ্ন করেন কেন?’

‘আপনি যে এত প্রশ্ন করছিলেন, আমি কি তখন এত

প্রশ্ন করেছি?’

‘এত প্রশ্ন করেন কেন? আপনি কে?’

‘আবারও প্রশ্ন করছেন?’ হাসল যুবক। এ কথা শুনে হেসে ফেলল ইফা।

.

সকাল আটটা।

প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙল ইফার। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মনে পড়ল গতকাল রাতের ঘটনা। বুঝল না ওটা সত্য না স্বপ্ন। সারাদিন নিজেকে ব্যস্ত রাখাল ইফা। কিন্তু গতকাল রাতের ঘটনাটা দ্বিধায় ফেলেছে ওকে। মনে জমছে হাজারো প্রশ্ন। সব প্রশ্নের শেষ প্রশ্ন হলো, সত্য না স্বপ্ন?

রাত বারোটায় আপনা-আপনি ভাঙল ইফার ঘুম। বিছানায় বসে অস্বস্তিতে ভুগতে লাগল। আবারও গতকাল রাতের মতই মনে হলো, ঘরটা বড় গুমট। লাগছে ভাপসা গরম। বন্ধ হয়ে আসছে দম। শ্বাস নিতে পারছে না। ঘেমে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। একটু ঠাণ্ডা বাতাসের জন্য বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গেল ইফা। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হলো না। দেখল বাইরে ভারী কুয়াশা, তবুও লাগছে গরম। কিছুক্ষণ বারান্দায় থাকার পর বুঝল, এখানে থাকলে স্রেফ দম বন্ধ হয়ে মরবে ও। তাই তাড়াতাড়ি রওনা দিল সিঁড়ির উদ্দেশে।

ছাদে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর কমে গেল ইফার অস্বস্তি। কিছুক্ষণ পর ফিরবে, এমন সময় মনে হলো, যা-ই গিয়ে দেখি সেই যুবক আজকেও ওখানে আছে কি না!

হ্যাঁ, আছে। আগের রাতের মতই শুয়ে আছে রেলিং-এ। ইফা চুপচাপ চলে যাচ্ছিল, পিছন থেকে যুবকটি বলল, ‘চলে যাচ্ছেন নাকি?’

চমকে উঠল ইফা। ‘আপনি কীভাবে জানলেন আমি এসেছি?’

‘আকাশের তারা দেখে।’

‘মানে?’

‘মানে, এখন আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, ঠিক তার ওপরের তারাটিতে আপনার ছায়া পড়েছে।’

ইফা একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কি পাগল?’

‘পাগল হতে যাব কেন? পাগলের কি এই ক্ষমতা থাকে?’

‘তা হলে কী? ম্যাজিশিয়ান?’

‘অনেকটা তা-ই বলতে পারেন,’ এ কথা বলে রেলিং-এ উঠে বসল যুবক। ‘দূরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন, কাছে আসুন। আপনার সাথে একটু কথা বলি। আচ্ছা, আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?’

‘সম্ভবত।’

‘কেন?’

‘আমার মনে হচ্ছে আপনি অদ্ভুত টাইপের মানুষ। রেলিং-এ শুয়ে থাকেন, তা-ও আবার নিশ্চিন্ত মনে। কারও আসার খবর পান, তা-ও আবার আকাশের তারা দেখে।’

এ কথা শুনে হেসে ফেলল যুবক। ‘কাছে আসতে পারেন। কোনও ভয় নেই।’

ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেল ইফা। ‘আপনি কে?’

‘আমি? আমি…হয়তো আপনার, কাছের কেউ, কিংবা হয়তো কেউ ছিলাম না।’

‘মানে?’

‘মানে তো বুঝবেন না। আমাকে পলাশ বলে ডাকতে পারেন।’

‘কী করেন আপনি?’

‘যখন মন যা চায়, তা-ই খুঁজে বেড়াই।’

‘আপনি খুব জটিল কথা বলেন। আচ্ছা, আপনি কি প্রতি রাতে এখানে আসেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেন আসেন?’

‘বন্ধুদের সাথে মনের দুঃখ শেয়ার করতে।’

‘বন্ধু? কোথায় আপনার বন্ধুরা?’

‘এই যে তারা ভরা রাতের আকাশ, খোলা বাতাস, নির্জন রাত-এরাই তো বন্ধু। তা-ই তো ভাল।’

‘আচ্ছা, আপনার দুঃখটা কী?’

‘সরি, এটা পার্সোনাল সাবজেক্ট।’

‘আকাশ, বাতাস, নির্জন রাত-এদের সাথে দুঃখ শেয়ার করলে তারা কি বোঝে?’

‘হ্যাঁ, খুব ভালই বোঝে। জানেন, ইফা, একটা মানুষের দুঃখ একটা মানুষের চাইতে প্রকৃতিই ভাল বুঝতে পারে।’

‘আচ্ছা, আপনি কী করে জানলেন আমার নাম ইফা?’

‘ওই যে বললাম, সম্ভবত আমি ম্যাজিশিয়ান।’

‘হাউ ইন্টারেস্টিং! আপনি আর কী-কী জানেন কিংবা কী-কী পারেন?’

‘বলুন এখন আপনার কী মনে হচ্ছে?’

‘আপনি তো ম্যাজিশিয়ান, আপনিই বলুন দেখি?’

‘আপনার এখন মন চাচ্ছে…’ চুপ হয়ে গেল যুবক। ‘হ্যাঁ, বলুন আমার মন এখন কী চাচ্ছে?’

‘আপনার মন চাচ্ছে…আকাশে উড়তে।’

রীতিমত অবাক হয়ে গেল ইফা। বলল, ‘আপনি কী করে বলতে পারলেন? আপনি সত্যি-সত্যি বলেছেন। পারলেন কী করে? আপনি সত্যি আমাকে আকাশে ওড়াতে পারবেন?’

‘হ্যাঁ, না পারার কী আছে?’

‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’

‘ঠিক আছে, চলুন, আপনাকে নিয়ে ঘুরে আসি।’

‘আপনি ফান করছেন।

‘আপনি এসে হাত ধরেই দেখুন না।’

‘না, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’

পলাশ এগিয়ে যেতেই দু’পা পিছিয়ে গেল ইফা।

‘আরে, পিছিয়ে যাচ্ছেন কেন?’

‘আমার ভয় করছে।

‘ভয়ের কিছু নেই। আমার হাতটা ধরুন।’

ইতস্তত করতে লাগল ইফা।

‘কী হলো, ধরুন আমার হাত।’

খুব সংকোচের পর হাতটা ধরল ইফা।

ইফাকে নিজের কাছে টেনে নিল পলাশ। পিছনে দাঁড়িয়ে নিজের দু’হাতে ধরল ইফার দু’হাত। ‘এবার চোখ বন্ধ করুন,’ ফিসফিস করে বলল ইফার কানে।

কিছু বলতে গিয়েও বলল না ইফা। ভয়ে-ভয়ে চোখ বন্ধ করল। দুই সেকেণ্ড পর অনুভব করল, পায়ের নিচ থেকে যেন সরে গেল ছাত। পায়ের নিচে এখন কিছুই নেই! চোখ খুলতে গিয়েও ভয়ে খুলতে পারল না ইফা। নিজেকে কেমন যেন ওজনশূন্য লাগছে। চোখ বন্ধ করেই বুঝতে পারছে, ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে।

‘ইফা?’

‘হুঁ?’

‘কেমন লাগছে?’

‘জানি না।’

‘চোখ খুলুন।

‘ভয় লাগছে।’

‘ভয় পাবেন না। আমি আছি আপনার সাথে। এই মুহূর্তে আমি আপনার সবচেয়ে আপন।

ধীরে-ধীরে চোখ খুলল ইফা। যা দেখল, সত্যিই অবাক হলো। অনেক নিচে কুয়াশার স্তর এবং তারও অনেক নিচে ঘুমন্ত পৃথিবী! ওপরে আকাশের তারা অনেক কাছে। যেন আরেকটু উঠলে ছুঁয়ে দিতে পারবে হাত দিয়ে। আজ আকাশে কোনও চাঁদ নেই।

‘ইফা, কেমন লাগছে?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল পলাশ।

‘ভয় লাগছে, যদি পড়ে যাই।’

এ কথা শুনে ইফাকে জড়িয়ে ধরল পলাশ। ‘এখন কেমন লাগছে? পড়ে যাবার ভয় পাচ্ছেন?’

‘না। আশ্চর্য রকম ভাল লাগছে।

‘কী মনে হচ্ছে এখন নিজেকে? ‘

‘মনে হচ্ছে পাখির মত স্বাধীন, যার মনে কোনও দুঃখ নেই। যার জীবনে কোনও বাধা নেই। পলাশ, নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে আমার।’

‘চলুন, এখান থেকে আমরা চলে যাই।’

চোখ বন্ধ করল ইফা। নেমে আসছে আস্তে-আস্তে। কতক্ষণ লাগল জানে না, যখন চোখ খুলল, দেখল ওকে জড়িয়ে ধরে রেলিং-এ বসে আছে পলাশ।

নিজেকে ছাড়াতে গিয়েও পারল না ইফা। কিছু বলতেও পারল না। যেন ও-ও চাইছে ওকে ধরে রাখুক পলাশ। চাইল অসহায়ের মত পলাশের দিকে।

চোখ বন্ধ করে আছে পলাশ। ধীরে খুলল চোখের পাতা। ঝিকঝিক করছে নীল মণি।

.

সকালে নাস্তা খেতে-খেতে হঠাৎ গত রাতের কথা মনে পড়ল ইফার। আবারও পড়ে গেল দ্বিধার মধ্যে। একবার মনে হয় স্বপ্ন, কিন্তু এত বাস্তব লাগে, স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর ওসব সত্যি ভাবতে গেলেই শিউরে ওঠে গা। আকাশে উড়ে বেড়ানো কী করে সম্ভব?

যাই, দিনের বেলায় গিয়ে দেখে আসি ছাদটা আসলে দেখতে কেমন, ভাবল ইফা। ছাদে যাবে এমন সময় বেজে উঠল মোবাইলটা।

জুয়েলের ফোন।

‘হ্যালো?’

‘হ্যালো, ইফা; কেমন আছ?’

‘ভাল। তুমি কেমন আছ?’

‘ভাল। তোমার কোনও প্রবলেম হচ্ছে না তো?’

‘না, তবে খুব বেশি একা লাগে।’

‘আর ক’টা দিন ধৈর্য ধরো, তারপর তো আমি চলে আসছি।’

‘আর ক’টা দিন মানে? তুমি দু’দিনের মধ্যে আসতে পারবে না?’

‘অবশ্যই আমি চেষ্টা করব। তোমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?’

‘না, অসুবিধে হচ্ছে না। ‘

‘আচ্ছা, আমি তা হলে এখন রাখি।’

‘তুমি ভাল হয়ে থেকো কেমন?’

‘আচ্ছা।’

সারাদিন জুয়েলের কথা ভেবে কাটল ইফার। কিন্তু রাতে শোবার আগে মনে পড়ল পলাশের কথা। ভয়ে বুক দুরুদুরু কাঁপতে লাগল ওর। ভাবল, নাহ্, আজ বুঝতেই হবে, যা কিছু ঘটছে, তা স্বপ্ন না সত্যি!

ঘরের দরজায় তালা মেরে চাবিটা পানির বোতলে রেখে তা রাখল ফ্রিজে। সহজে মনে পড়বে না ওটার কথা।

.

রাত প্রায় বারোটা বেজে পাঁচ মিনিট

এসময় কিছু একটা পড়ে যাবার শব্দে ঘুমটা ভাঙল ইফার। উঠে বসল বিছানায়। বাইরের বাতির আলোতে ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার নয়। দেখল শোকেস থেকে পড়ে গেছে ফ্লাওয়ার ভাস।

উঠে ভাঙা টুকরো তুলতে গিয়ে শুনল বাতাসে দুলছে বারান্দার দরজাটা। ওটা দেখে খুব ভয় পেল ইফা। ঘুমানোর আগে ওই দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে শুয়েছে। তা হলে কীভাবে খুলল দরজা?

আজ শোবার ঘরে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। ইফা উঠে দরজাটা বন্ধ করবে, এমন সময় কে যেন বারান্দা থেকে ওকে ডাকল।

প্রচণ্ড ভয় পেল ইফা। খাড়া হয়ে গেল শরীরের সমস্ত রোম। কাঁপতে লাগল হাত-পা। অনেক কষ্ট করে সাহস জোগাড় করল ইফা, তারপর ভয়ে ভয়ে উঁকি দিল বারান্দায়। দেখল, পলাশ গ্রিল ছাড়া বারান্দার ওপ্রান্তে বসে আছে রেলিং-এ। খুব অবাক হলো ইফা এবং দ্বিগুণ বাড়ল ওর ভয়।

‘ইফা, ভয় পেয়েছেন?’

ইফা কাঁপতে-কাঁপতে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ।’

‘ভয় পাবেন না। আমি পলাশ, কাছে আসুন।’

ইফা বারান্দায় বেরোল, কিন্তু কাছে গেল না।

‘ইফা, আপনি ঘেমে যাচ্ছেন কেন? আজ ভীষণ কুয়াশা পড়েছে।’

ইফা টের পেল, সত্যি-সত্যি ঘেমে গেছে। ‘আপনি জানলেন কেমন করে যে আমি ঘেমে যাচ্ছি? আপনি তো বাইরে তাকিয়ে আছেন। আমার দিকে তো একবারও তাকাননি!’

‘অনেক কিছু না দেখেও বলে দেয়া যায়। আর অনেক কিছু বুঝে নিতে হয়।’

‘আমি সত্যি খুব অবাক হচ্ছি, আপনি এখানে এলেন কীভাবে? এ-ও কি সম্ভব?’

‘আকাশে ভেসে বেড়ানো যদি সম্ভব হয়, তা হলে এখানে আসাটা কি সম্ভব হতে পারে না?’

‘যা ঘটছে, তা কি আমার স্বপ্ন নাকি সত্যি?’

‘দেখুন, যা কিছু ঘটছে, তা হোক না স্বপ্ন কিংবা বাস্তব-এতে কী যায় আসে? যা ঘটছে ঘটতে দিন। হয়তো অনেক কিছু দেখবেন, হয়তো অনেক কিছু পাবেন কিংবা অনেক কিছু হারাবেন।’

ওর দিকে চাইল পলাশ।

ইফা দেখল নীল চোখদুটো কী সুন্দর, কী অপূর্ব! চঞ্চল করে মনকে। মনে হয়, কী যেন বুঝতে চাচ্ছে ওই নীল চোখদুটো। কিংবা কী যেন বুঝে নিচ্ছে! কী যেন বিনিময় করছে নীরব ভাষায়!

পলাশ তার নীল দু’চোখ দিয়ে ওকে সম্মোহন করছে মনে হলো ইফার। ধীরে-ধীরে ওর পরিচিত জগৎকে ভুলে অজানা এক নতুন জগতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ও।

‘ইফা, ইফা…’

‘হুঁ?’

‘এখনও কি ভয় পাচ্ছেন আমাকে?’

‘না।’

‘কাছে আসুন, ইফা।’

সম্মোহিতের মত পলাশের কাছে গেল ইফা।

‘ইফা, আপনার কেমন লাগছে?’

‘জানি না। আচ্ছা, আপনি কি সত্যি ম্যাজিশিয়ান?’

‘সম্ভবত।’

‘আপনি কি পারবেন আমার মনের দুঃখ দূর করে দিতে কিংবা ভুলিয়ে দিতে?’

‘আপনি তো এখনি অনেক দুঃখ থেকে দূরে সরে গেছেন। জানি, ইফা, আপনার মনে অনেক দুঃখ, অনেক কষ্ট এবং এ-ও জানি, আপনার দুঃখটা কীসের। আপনি আমার আরও কাছে আসুন, আমি আপনার দুঃখ ভুলিয়ে দেব।’

ইফার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পলাশ। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না ইফা। পলাশকে জড়িয়ে ধরল, পলাশও জড়িয়ে ধরেছে ইফাকে।

ইফা উপলব্ধি করছে, অনেকখানি কমে গেছে মনের দুঃখের ভার। অস্থির দেহ-মনে এল পরম এক শান্তি। যেন এই শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছিল বহুকাল থেকে।

.

কিছুক্ষণ পর…

‘পলাশ, তুমি স্বপ্ন হয়ে আমার কাছ থেকে চলে যাবে না তো?’

‘না।’

‘তুমি কি…তুমি কি আমাকে…. ভালবাস?’

‘হ্যাঁ।’

ইফা দেখল, ওর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে পলাশ। নীল অপূর্ব চোখদুটিতে ভালবাসা ও আবদার। চোখ বন্ধ করে নিজেকে পলাশের কাছে সঁপে দিল ইফা।

পলাশ বুঝে নিল ভালবাসায় সাড়া দিচ্ছে ইফা। ওকে কোলে তুলে নিল পলাশ।

ইফা অনুভব করল, ভেসে-ভেসে ওকে নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে পলাশ। এই অনুভব শেষ হতে না হতেই বিছানা স্পর্শ করল ওর শরীর। নিচে নরম তুলতুলে বিছানা ও শরীরের ওপরে পলাশের ঠাণ্ডা শরীরটাকে টের পেল ইফা।

.

সকালে উঠে গত রাতে কী ঘটে গেছে, বুঝতে পারল ইফা। সব মনে পড়তেই ইচ্ছা করল লজ্জায়, অপমানে আত্মহত্যা করতে। ভাবল, আমি তো প্রতারণা করেছি আমার স্বামীর সঙ্গে। অথচ ও আমাকে কত ভালবাসে, বিশ্বাস করে। না হয় সে আমাকে সময় দিতে পারে না, তাই বলে কি আমি তার বিশ্বাস ভঙ্গ করব? আমি কেন নিজেকে এভাবে সঁপে দিলাম? কেন নিজের সম্মান রক্ষা করতে পারলাম না? কেন? কেন? কেন?

সারাদিন কিছু না খাওয়াতে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ল ইফা। লাইট নিভিয়ে শুয়ে আছে পলাশের অপেক্ষায়। হঠাৎ দমকা বাতাসে খুলে গেল বারান্দার দরজা। টেবিল থেকে পড়ে ভাঙল পানির গ্লাসটা। ইফা দেখল, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পলাশ। ভালবাসার তৃপ্তি ও রহস্যময় অদ্ভুত কিছু খেলা করছে তার অপূর্ব নীল চোখে।

‘ইফা, তোমাকে আজ এমন দেখাচ্ছে কেন? তুমি কি অসুস্থ?’

কোনও জবাব দিল না ইফা। কাঁদছে মাথা নিচু করে।

এগিয়ে এল পলাশ।

‘তুমি কে? কেন তুমি স্বপ্নের মত শুধু রাতে আসো? তুমি কী? বাস্তব না অবাস্তব?’

‘তুমি কি দুঃখ পেয়েছ? আমি কি এমন কিছু করেছি, যাতে তোমার দুঃখ, লজ্জা, অপমান হওয়া উচিত? আমার মনে হয় তুমি তেমন কিছুই করোনি।’

‘মানে! কী বলতে চাও তুমি?’

‘আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, যে অপরাধ জুয়েল তোমার সঙ্গে দিনের পর দিন অহরহ করে যাচ্ছে, তা কেবল একবারই করেছ তুমি। যেটাকে আমার মতে অপরাধ বলা যাবে না।’

মুহূর্তে কেঁপে উঠল ইফা। যেন ওর মাথার ওপর ভেঙে পড়েছে সমস্ত পৃথিবীটা। বুকে অনুভব করল প্রচণ্ড ব্যথা। কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘তুমি…তুমি…এসব কী বলছ? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

খুব শান্ত কণ্ঠে পলাশ বলল, ‘ইফা, তুমি জানতে চাও আমি কে কিংবা কী। আমি বাস্তব না অবাস্তব। শুধু এটুকু বলব, তোমার পৃথিবী বড়ই রহস্যময়। বড়ই অদ্ভুত এক জায়গা। দৃশ্য-অদৃশ্যের মাঝে বা বাস্তব-অবাস্তবের মাঝে আছে একটা আজব তরঙ্গ, যা আমাদেরকে কমবেশি প্রবাহিত করে। হয়তো বা সেই তরঙ্গই তোমার আর আমার মাঝে সৃষ্টি করেছে ভালবাসার বন্ধন। জন্ম দিয়েছে রহস্যময় এক ভালবাসার। মনে হচ্ছে, তুমি কিছুই বুঝতে পারছ না। চল, আজ তোমাকে একটা দৃশ্য দেখাষ, যা ছিল আমার অনেক দিনের প্রত্যাশা।

ইফাকে আস্তে করে জড়িয়ে ধরল পলাশ। বাধা দিতে চাইল ইফা, কিন্তু পারল না। খুব কাছ থেকে পলাশের নীল চোখদুটো সম্মোহিত করে ওকে। আজও তা-ই হলো। ইফা ধীরে-ধীরে চোখ বন্ধ করে মাথা রাখল পলাশের বুকে। অনুভব করল, কোথায় যেন যাচ্ছে ভেসে-ভেসে।

এভাবে প্রায় মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর পলাশ বলল, ‘ইফা, চোখ খুলে দেখো জানালা দিয়ে তোমার দেখা সেরা দৃশ্য।’

ধীরে-ধীরে চোখ খুলল ইফা। দেখল অনেক নিচে রাস্তা। এখন ফাঁকা। তারা দাঁড়িয়ে আছে কোনও এক বিশাল বিল্ডিং-এর পাশে। ওটা সম্ভবত বড় কোনও হোটেল। সামনে একটা জানালা দেখতে পেল ইফা। তারা ভাসছে জানালার পাশেই।

জানালার একপাশের পর্দা সরানো। ইফা উঁকি দিতে দেখল, একটা বিছানা এবং একটু দূরে একটা বড় টিভি। টিভিতে সম্ভবত ইংলিশ কোনও সিনেমা চলছে। বিছানায় বসে আছে এক লোক। যদিও তাকে দেখছে সে পিছন থেকে, তবুও একটু ভাল করে দেখতেই চিনল লোকটা কে। সে অপরিচিত কেউ নয়। তার স্বামী জুয়েল। জুয়েলকে দেখতে পেয়ে খুশিতে চিৎকার করে ডাক দিল ইফা। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝল, ওর গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোচ্ছে না। হঠাৎ জুয়েলের পাশে এসে দাঁড়াল অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে। পরনে কিছুই নেই। শুধু একটা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রেখেছে শরীর। মেয়েটি জুয়েলের সামনে দাঁড়িয়ে, তাই টিভি দেখতে পাচ্ছে না জুয়েল। মেয়েটিকে বলল, ‘জান, সরে দাঁড়াও। দেখতে পাচ্ছি না তো।’

মেয়েটি কিছুই বলল না। শুধু ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। জুয়েল আবারও বলল, ‘ডেইজি, লক্ষ্মী মেয়ে, সরে দাঁড়াও। ইন্টারেস্টিং জিনিসটাই দেখতে পাচ্ছি না।’

এবার মেয়েটি আদরমাখা মধুর কণ্ঠে বলল, ‘সিনেমাটি কি তোমার কাছে আমার চেয়েও ইন্টারেস্টিং?’

এ কথা শুনে দুষ্টু হেসে মেয়েটির তোয়ালে ধরে টান দিল জুয়েল।

তোয়ালে খুলে পড়তেই লজ্জায় জুয়েলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটি।

জুয়েলও মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল।

আর এ দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারাল ইফা।

.

ওর জ্ঞান ফিরল দুপুর বারোটায়। এতই দুর্বল, কিছুতেই উঠতে পারল না বিছানা ছেড়ে। খুব কষ্ট করে উঠে প্রথমেই খেল এক গ্লাস পানি। ওর মনে ছিল না কালকে রাতে কী দেখেছে। কিছুক্ষণ পর মনে পড়ল জুয়েলের কথা। ঘৃণায় ঘিনঘিন করে উঠল গা-টা। বিষিয়ে গেছে মন। ইফা সিদ্ধান্ত নিল, আত্মহত্যা করবে। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল। চোখ মুছতে-মুছতে ছাদে উঠবে বলে সিঁড়ি বেয়ে উঠল ইফা। কিন্তু ছাদের দরজায় ঝুলছে ইয়া বড় এক তালা। ওটার ওপর মাকড়সার জাল। দেখলে মনে হয় যেন বহুদিন ধরে এ তালা ঝুলছে।

কিন্তু …

‘কে তুমি, মা?’ হঠাৎ পিছন থেকে জানতে চাইল এক মহিলা।

সিঁড়িতে এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে, দেখল ইফা।

‘আমি ইফা। দশতলার ডানপাশের ফ্ল্যাটে থাকি।’

‘ও, আচ্ছা।’

‘দিনের বেলায় কি ছাদের দরজা বন্ধ থাকে, আণ্টি?’

মহিলাটি বলল, ‘হ্যাঁ। দিনে-রাতে সবসময় এ তালা বন্ধ থাকে। দেখছ না তালার কী দশা হয়েছে?’

এ কথা শুনে মাথা ঘুরে উঠল ইফার। পড়ে যাবে, এমন সময় এসে ধরল মহিলা।

তার বাসা বারোতলায়, নিয়ে গেল ইফাকে নিজের ফ্ল্যাটে। ঠাণ্ডা পানি খেতে দিল ওকে।

ঢকঢক করে পানি খেল ইফা। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘আণ্টি, ওই সময় আপনি কী যেন বলেছিলেন? ছাদের দরজা কি সবসময় বন্ধ থাকে?’

‘হ্যাঁ, আজ প্রায় এক বছর থেকে।’

‘কিন্তু…আমি যে…আচ্ছা, কেন বন্ধ থাকে?’

‘তুমি কি এখানে নতুন?’

‘জী, আমি এসেছি ছয় মাস হবে।’

‘ও, আচ্ছা, তার মানে ঘটনাটা তোমার জানা নেই?’

ইফা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘটনা? কীসের ঘটনা?’

‘ঘটনাটা আমার ছেলের, আমার একমাত্র ছেলের ঘটনা,’ এ কথা বলতে-বলতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল মহিলা। ‘প্রায় এক বছর আগের কথা। আমার একটি ছেলে ছিল। ও লেখাপড়া শেষ করে ব্যবসা শুরু করেছিল। পরিবার বলতে আমি, আমার এক ছেলে আর এক মেয়ে। আমার স্বামী মারা গেছেন অ্যাক্সিডেন্টে। কিন্তু আমরা কোনওরকম বিপদে পড়িনি। কারণ আমার স্বামী ব্যাঙ্কে রেখে যান অনেক টাকা। লেখাপড়া শেষে আমার ছেলে সেই টাকা দিয়ে শুরু করে ব্যবসা। এবং অল্প দিনের মধ্যে খুব উন্নতিও করে। যে পরিমাণ টাকা ছিল, তার তিনগুণ লাভ হলো। এরপর ভাবলাম এবার ছেলেকে বিয়ে দেয়া দরকার। বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই ছেলে খুব লজ্জার সঙ্গে বলল, একটি মেয়েকে খুব পছন্দ করে। তো বললাম মেয়েটিকে একদিন নিয়ে আসতে। কিছু দিন পর মেয়েটিকে নিয়ে এল। মেয়েটি ছিল খুব সুন্দরী। দেখলে মায়া হয়। বিয়ের কথা বলতে মেয়েটি বলল, এখন নয়, সে আরও কিছু দিন সময় চায়। তো মেনে নিলাম। এর কিছু দিন পর আমার ছেলেটা কেমন যেন বদলাতে লাগল। ঠিকমত খায় না, ঘুমায় না, সারাক্ষণ টেনশন করে। তারপর একদিন এল সেই ভয়ঙ্কর দিন, যা এখনও…’ বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেলল মহিলা। ‘সেদিন ভোর পাঁচটায় বাসায় এল পুলিস। এসে আমার ছেলের নাম, আমার নাম জানার পর, আমাকে জানাল নিচে পড়ে আছে আমার ছেলের লাশ… এ কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল মহিলা।

সাধ্যমত সান্ত্বনা দিল ইফা।

মহিলা ফুঁপিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘বিশ্বাস করো, মা, আমি আজও জানি না কেন আমার শান্ত ছেলেটা আত্মহত্যা করল। এর কিছু দিন পর জানলাম, আমাদের ব্যাঙ্কে আর কোনও টাকা নেই। আজও জানি না ছেলেটা এত টাকা কী করল বা কোথায় রাখল।’

ইফা জিজ্ঞেস করল, ‘আর মেয়েটি?’

‘মেয়েটিকে আর কখনও দেখিনি।

‘মেয়েটিও আসেনি? আচ্ছা, আন্টি, আপনার ছেলের কোনও ছবি আছে?’

‘হ্যাঁ, আছে। তুমি একটু বোসো, আমি নিয়ে আসছি।’

কিছুক্ষণ পর ছেলের ছবি নিয়ে এল মহিলা।

সেই ছবি দেখতেই কেঁপে উঠল ইফা। চমকে গিয়ে ভাবল: ‘আশ্চর্য, আমি এ কী দেখছি? এসব কী হচ্ছে আমার সাথে? আমাকে এসব কী শুনতে হচ্ছে? এ কি আমার কোনও দুঃস্বপ্ন? এ কি বাস্তব না অবাস্তব!’

ভেবে কিছুই কূল করতে পারছে না ইফা। ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আন্টি, আপনার ছেলের নাম কী?’

মহিলা বলল, ‘আমার ছেলের নাম পলাশ।’

.

শীতের সন্ধ্যা, কুয়াশায় ঢাকা চারদিক। বারান্দায় বসে আছে ইফা। এখন আর কিছু ভাবছে না। ভাবতে-ভাবতে ক্লান্ত। ভাবনাগুলোর কোনও যুক্তি নেই। সে বাস্তবে যা দেখছে, তাতে বাস্তবতার কোনও চিহ্ন নেই। মনে যেসব প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর কোনও জবাব নেই। যা কিছু এখন দৃশ্য, তা অদৃশ্য, আবার যা কিছু অদৃশ্য, তাই এখন দৃশ্য। বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝে পাকিয়ে গেছে জট। যে পলাশকে চিনত, সে ছিল এই পৃথিবীর বাসিন্দা। কিন্তু সে এখন মৃত। এই পৃথিবী যে পলাশকে চিনত, সে মৃত। কিন্তু ইফার কাছে সে দৃশ্যমান। পলাশ কাছে এসেছে, ভালবেসেছে। কিন্তু সে তো মৃত! তা হলে?

ইফা ভাবছে, শুনেছি যারা আত্মহত্যা করে, অতৃপ্ত হয়ে পৃথিবীতে ঘোরে তাদের আত্মা। আত্মহত্যা করেছে পলাশও। ওর অতৃপ্ত আত্মা এল কেন আমার কাছে? এর সঙ্গে আমি জড়িত কীভাবে? পলাশ আত্মহত্যা করল কেন? সে আমাকে কখনও তার জীবন সম্পর্কে বলেনি। ও কি আসলেই কোনও অতৃপ্ত আত্মা? নাকি সবকিছু আমার দুঃস্বপ্ন?

কলিংবেলের আওয়াজে বাস্তবে ফিরল ইফা। দরজা খুলে দেখল দাঁড়িয়ে আছে জুয়েল। বাসায় ঢুকতে-ঢুকতে প্রশ্ন করল, ‘কেমন আছ? নিশ্চয়ই রাগ করে আছ আমার ওপর?’

ঘৃণায় শরীর ঘিনঘিন করে উঠল ইফার। কোনও জবাব দিল না।

কিন্তু এসব লক্ষ্য করল না জুয়েল। বলেই যাচ্ছে, ‘কী যে করব, বল? কাজের এতই চাপ, তোমাকে ঠিকমত ফোনও করতে পারিনি। জানি, সেজন্য তুমি রাগ করে আছ।’ কথাগুলো বলে ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকল জুয়েল।

বিছানায় মাথা নিচু করে বসে আছে ইফা।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে ইফাকে খেয়াল করল জুয়েল। ওর পাশে গিয়ে বসল সে। হাত ধরতে চাইলে সরিয়ে নিল ইফা। খুব অবাক হয়ে জানতে চাইল জুয়েল, ‘ইফা, কী হয়েছে তোমার? কেন এমন করছ?’

‘তার আগে বল, তুমি এমন কেন করলে আমার সাথে?’ কান্না জড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইল ইফা।

‘কী করলাম তোমার সাথে?’ জুয়েল উদ্বিগ্ন।

‘এই যে তুমি আমাকে একদম ভুলে গেলে?’

‘ওহ্, এ কথা?’ হাসতে-হাসতে ইফাকে জড়িয়ে ধরল জুয়েল।

এবার বাধা দিল না ইফা। তবে ঘৃণায় এল বমি।

জুয়েল আদর মাখানো কণ্ঠে বলল, ‘লক্ষ্মীসোনা, প্লিজ রাগ কোরো না। এই যে আমি এসে গেছি। আর কখনও তোমাকে ফেলে যাব না।’

‘হ্যাঁ, আর তোমাকে যেতে দেব না,’ বলল ইফা।

রাতে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল ওরা।

মাথাব্যথার অজুহাত দেখিয়ে পাশ ফিরে শুয়েছে ইফা।

.

ইফার ঘুম ভাঙল রাত বারোটা ত্রিশ মিনিটে। নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। দরজা খুলে সম্মোহিতের মত চলল ছাদে। আজ খোলা ছাদের দরজা। ইফা সোজা চলেছে পানির ট্যাংকের দিকে।

হ্যাঁ, প্রথম দিনের মতই আজও রেলিং-এ শুয়ে আছে পলাশ। ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল ইফা।

এসো, ইফা, তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।’ উঠে বসল পলাশ।

পলাশের নীল চোখ দেখল ইফা। অপূর্ব নীল চোখে হাজারো রহস্যের খেলা। পলাশের ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি। ইফার চোখেও হাজারো প্রশ্ন।

‘জানি, অনেক কিছু জানতে চাও। কিন্তু কিছুই বলতে পারছ না। তুমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এখন একটা দৃশ্য দেখবে তুমি। ওটা থেকে হয়তো পেতেও পার তোমার প্রশ্নের জবাব।’ ইফার চোখদুটো বন্ধ করে দিল পলাশ।

কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে ইফা দেখল, পলাশের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। দেখতে কেমন চেনা-চেনা লাগছে। হ্যাঁ, এবার ইফার মনে পড়ল: মেয়েটিকে সে দেখেছে গত রাতে একবার। মেয়েটির কী যেন নাম? কী যেন নাম? হ্যাঁ, মনে পড়েছে! মেয়েটিকে ডেইজি বলে ডেকেছিল জুয়েল। মেয়েটির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে পলাশ। মেয়েটিকে দেখাচ্ছে অত্যন্ত শান্ত। কিন্তু খুবই অস্থির পলাশ। খুব আকুল হয়ে মেয়েটিকে প্রশ্ন করল: ‘কেন তুমি আমার সাথে প্রতারণা করলে?’

মেয়েটি বলল, ‘প্রতারণা? কে করেছে? এই আমি? অসম্ভব!’

‘এখনও মিথ্যা বলছ, ডেইজি, ছি! আমি কখনও কল্পনাও করিনি তোমাকে অন্য এক পুরুষের সাথে বিশ্রী অবস্থায় দেখব!’

‘দেখো, পলাশ, তুমি যাকে অন্য পুরুষ বলছ, সে আমার ভালবাসার মানুষ।’

‘তবে আমি কী? তবে কেন ভালবাসার অভিনয় করলে? বল, জবাব দাও!’ রাগী কণ্ঠে জানতে চাইল পলাশ।

ডেইজি হাসতে লাগল। সে হাসি যেন গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল পলাশের। সামনে বেড়ে ডেইজির গলা টিপে ধরল ও। ‘তুমি আমার ব্যাঙ্কে যত টাকা-পয়সা ছিল, সব মিথ্যা কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছ! তার চেয়েও বড় কষ্টের বিষয়, তুমি ভালবাসার অভিনয় করে ভেঙে দিয়েছ আমার মন! তুমি চুরমার করেছ আমার হৃদয়টা! আমি তোমাকে ছাড়ব না!’ জেদের সুরে বলছে পলাশ।

হঠাৎ দৃশ্যপটে এল তৃতীয় এক লোক। পেছন থেকে দেখেও ইফা ঠিক চিনল না মানুষটা কে। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, মানুষটা তার স্বামী-জুয়েল।

জুয়েল?

সে এখানে কী করছে?

ডেইজির ভালবাসার মানুষটা সে?

জুয়েল?

দাঁড়িয়ে আছে জুয়েল। হাতে সিগারেট। খুব শান্ত দেখাচ্ছে তাকেও। মনে হচ্ছে যেন জানত এখানে কী ঘটছে। হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বলল জুয়েল, ‘বন্ধু, পলাশ, যা করছ, তাতে এত তাড়াতাড়ি কেন? তাড়াহুড়োর কিছুই নেই। ডেইজিকে তুমি ছেড়ে দাও। ওর কোনও দোষ নেই। ও যা কিছু করেছে, আমাকে খুশি করার জন্য করেছে।’

ডেইজির গলা ছেড়ে দিল পলাশ। সরে গিয়ে জুয়েলকে জড়িয়ে ধরে চুমো দিল ডেইজি।

অবাক হয়ে চেয়ে আছে পলাশ। ‘তার মানে কী? আমার সাথে এতসব নাটক করলে কেন?’ খুব অবাক হয়ে জানতে চাইল সে।

‘কারণ তুমি আমার শত্রু,’ বলল জুয়েল।

‘আমি তোমার শত্রু? আমি তো তোমাকে কালকের আগে চিনতামও না। আমার সাথে তোমার শত্রুতা কীভাবে?’ আরও বেশি অবাক হলো পলাশ।

‘ব্যবসা করতে গিয়ে আমার অনেক ক্ষতি করেছ,’ বলল জুয়েল। ‘আর তারচেয়েও বড় কথা, তুমি খুব অল্প সময়ে আমার চেয়েও ধনী হয়ে গেছ। বলো, এসব কীভাবে সহ্য করি? চাই না আমাকে টপকে কেউ ওপরে উঠুক। তাই আমার সুন্দরী প্রেমিকাকে কিছু দিনের জন্য তোমাকে দিতে হলো।’

‘আর এ সুযোগে আমার সবকিছু হাতিয়ে নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করলে, তাই না?’

‘কারেক্ট, সবকিছু আমার প্ল্যানের ভেতর ছিল, বন্ধু, হাসতে লাগল জুয়েল।

রাগে পাগলের মত জুয়েলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পলাশ। দু’জনের মধ্যে শুরু হলো ধস্তাধস্তি। এক পর্যায়ে পানির ট্যাংকের সঙ্গে খুব জোরে পলাশের মাথা ঠুকে দিল জুয়েল। কয়েকবার বাড়ি দেয়ার পর জ্ঞান হারাল পলাশ। তখন পলাশকে তুলে রেলিং-এর দিকে নিয়ে যেতে লাগল জুয়েল ও ডেইজি।

এ দৃশ্য দেখে খুব অস্থির হয়ে উঠল ইফা।

রেলিং-এ পলাশকে শুইয়ে দিল জুয়েল ও ডেইজি।

ইফা বুঝল, কী করতে যাচ্ছে ওরা। চিৎকার করে মানা করতে চাইল, কিন্তু কেউই শুনল না ওর চিৎকার।

ডেইজিকে রলতে শুনল, ‘জুয়েল, আমি তোমার সাথে নতুন জীবন শুরু করতে চাই। শুধু তুমি আর আমি।’

‘সে তো তোমার হাতে ডার্লিং। এসো, নিজ হাতে উদ্বোধন করো তোমার নতুন জীবন।’

‘হ্যাঁ,’ এই বলে পলাশকে ধাক্কা মেরে রেলিং থেকে ফেলে দিল ডেইজি।

এ দৃশ্য দেখে চিৎকার করে উঠল ইফা, কিন্তু শুনল না কেউই।

জুয়েলকে বলল ডেইজি, ‘দেখলে, জান, তোমাকে কত ভালবাসি? নিজ হাতে সরিয়ে দিলাম তোমার শত্রুকে পৃথিবী থেকে! এমন ভালবাসা তুমি পৃথিবীর কোথাও পাবে না। হ্যাঁ, ভালবাসা, তার সাথে কোটি-কোটি টাকাও।’

হাসতে লাগল দু’জনই।

জুয়েল ও ডেইজিকে দেখার জন্য তাকাল ইফা, কিন্তু আর দেখতে পেল না কাউকে। রেলিং-এর ওদিকে তাকাল। অনেক নিচে ওখানে কোনও লাশ নেই। আবার ফিরে দেখল, দাঁড়িয়ে আছে পলাশ। অপূর্ব চোখদুটোতে এখন নীলের চিহ্ন নেই। তার বদলে লাল রঙের খেলা। সেই নীল চোখদুটোতে এখন জ্বলছে প্রতিশোধের লাল আগুন।

থমথমে গলায় পলাশ বলল, ‘এতক্ষণ যা কিছু দেখলে, তা এক বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনও এক রাতের ঘটনা। ওরা আমাকে এভাবে শেষ করেছিল। সে রাতের পর থেকে আমি অপেক্ষায় আছি আজকের এই রাতের জন্য।’

পরিশিষ্ট

ডেইজিকে পাওয়া গেল তার ঘরে মৃত অবস্থায়। কে যেন তার বুকে বসিয়ে দিয়েছে ছোরা। ওটার বাঁটে পাওয়া গেল জুয়েলের হাতের আঙুলের ছাপ।

দরজা ভেঙে জুয়েলের ঘরে ঢুকতে হলো পুলিসকে। দেখল, বিছানায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ইফা আর জুয়েল আছে বারান্দায় মৃত। তার বুকেও গেঁথে আছে ছোরা।

এবং বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, ছোরায় পাওয়া গেল ডেইজির আঙুলের ছাপ।

এই দুটি মৃত্যুর রহস্য তদন্ত করে কিছুই বের করতে পারল না পুলিস।

দু’দিন পর জ্ঞান ফিরল ইফার। কিন্তু বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে ও। ইশারায় পুলিসকে বলল: সে কিছুই জানে না। এরপর থেকে ইফা কখনও পলাশ নামের নীল মণির আত্মাকে আর দেখেনি।

নূরুন নিসা মুন্নি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *