দ্য ম্যান হু লাফস – ৬

ওদের ফেলে একা ইংল্যান্ডে ফিরে আসার পেছনে বিশেষ একটা উদ্দেশ্য আছে বৃদ্ধ রাসেলের। তাঁর ইচ্ছা, ওরা ফিরে আসার আগেই পেমব্রোক হলঘরটা একবার তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখতে হবে।

লন্ডনে না গিয়ে ডোভার থেকে সোজা তিনি পেমব্রোকে চলে এসেছেন। তাঁকে একা ফিরতে দেখে চাকরবাকরেরা অবাক হলেও প্রশ্ন করার তারা কে? আইনজীবীর ক্ষমতা সম্পর্কে তারা জানে, সব টাকা-কড়িই তো তাঁর হেফাজতে। যার হাতে টাকা থাকে, সে-ই ওই টাকার মালিক, চাকরবাকরেরা তাকেই মান্য করে ও ভয় পায়।

কেউ কিছু জিজ্ঞেস না করলেও তাদের অনুচ্চারিত প্রশ্নের একটা দায়সারা গোছের জবাব নিজে থেকেই দিলেন রাসেল। ‘লর্ড ডেভিড হঠাৎ একটা দুর্ঘটনায় পড়ে যায় তো, তাই ওদের ফিরতে দু-একদিন দেরি হবে। ঈশ্বরের কৃপায় রক্ষা পেয়েছে ঠিকই, তবে মানসিক ধাক্কাটা খুব কাহিল করে ফেলেছে তাকে। এই অবস্থায় নতুন আরেকটা দেশে বেড়াতে যাওয়াটা উচিত নয়।

চাকরবাকরদের বিদায় করে দিয়ে হলঘরের প্রকাণ্ড এক টেবিলের পেছনে এসে বসেছেন রাসেল। এই টেবিল সামনে নিয়ে, এই চেয়ারেই বসে পরলোকগত আর্ল গুস্তাভ জমিদারি-সম্পর্কিত লেখালেখির কাজ করতেন। পুরোনো দিনের স্মৃতি তাঁকে কষ্ট দিচ্ছে, প্রথম দশ মিনিট তিনি চুপচাপ মন খারাপ করে বসে থাকলেন। আর্ল গুস্তাভ শুধু যে তাঁর মক্কেল ছিলেন, তা নয়; পরস্পরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন তাঁরা। গুস্তাভ যখন বেঁচে ছিলেন, মাঝখানে এই টেবিল রেখে কতবার মুখোমুখি বসেছেন তাঁরা, ব্যক্তিগত ও বৈষয়িক কত অসংখ্য বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

গুস্তাভ মারা যাওয়ার পর প্রয়োজন না পড়ায় এই হলঘরে বড় একটা আসা হয়নি রাসেলের। জমিদারির খাজনা আদায়ের দায়িত্ব গোমস্তাদের ওপর, তারা নিয়মিত লন্ডনে গিয়ে আদায় করা টাকা জমা দেয়, খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে নিয়ে আসে প্রয়োজনীয় নির্দেশ। হলঘরের এই টেবিলের সঙ্গে জমিদারি পরিচালনার কোনো সম্পর্ক নেই, কাজেই রাসেল বা অন্য কারও এই ঘরে ঢোকার প্রয়োজন পড়ে না।

তবে গুস্তাভ টেবিলের কোন দেরাজে কী কাগজ রাখতেন, তা স্পষ্ট মনে আছে রাসেলের। তাঁকে ধরে নিতে হবে, তিনি মারা যাওয়ার পর সেসব কেউ নাড়াচাড়া করার সুযোগ পায়নি। ঘরের ভেতর ঢোকাই তো সম্ভব নয়, কারণ দরজায় তালা মারা আছে। টেবিলেরও প্রতিটি দেরাজে তালা দেওয়া। ঘরের চাবি অবশ্য হেড বাটলারের কাছে থাকে, তবে দেরাজের চাবি এক রাসেল ছাড়া আর কারও কাছে নেই।

হলঘরে ঢুকেই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। চাকরদের আগেই বলে দিয়েছেন, কোনো অবস্থাতেই তাঁকে বিরক্ত করা যাবে না।

দশ মিনিট চেয়ারে বসে থাকার পর শার্টের পকেট থেকে চামড়ার একটা পাউচ বের করলেন রাসেল। পাউচ থেকে বেরোল এক গোছা চাবি। প্রতিটি দেরাজ খুলতে আলাদা চাবি লাগে।

দেরাজগুলোয় তল্লাশি চালিয়ে গোপন ও চমকপ্রদ কিছু পেয়ে যাবেন, এমনটি রাসেল আশা করছেন না। নিজের বিবেচনায় যেসব জিনিস গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন গুস্তাভ, তার সবই তিনি রাসেলের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন। এখন এখানে শুধু পাওয়ার কথা গুস্তাভের দৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় ও গুরুত্বহীন দু-একটা কাগজ। তবে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে, যার ফলে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে পড়ে থাকা একটা কাগজও রাসেলের কাছে মূল্যবান বলে বিবেচিত হতে পারে।

যেমন একটা ডায়েরি।

নিয়মিত বা ধারাবাহিক নিজের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা লিখে রাখবেন, অতটা ধৈর্য ও নিষ্ঠা আর্ল গুস্তাভের ছিল না। ডায়েরি লেখার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলেও তিনি মনে করতেন না। মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। অবশ্যই তিনি নিষ্ঠুর ছিলেন না, বরং দয়া ও ক্ষমা করার প্রবণতাই তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল। অ্যালারিকের ওপর অন্যায় অত্যাচার করা হয়েছে, এই কাহিনি রাসেল অ্যালারিক ছাড়া অন্য কারও মুখে শুনলে অবশ্যই বিশ্বাস করতেন না যে তাঁর সদা হাস্যময় নম্র-ভদ্র ধর্মভীরু বন্ধুটি কারও পিঠে বিশ ঘা চামড়ার চাবুক মারার আদেশ দিতে পারেন। অভিযোগ যখন স্বয়ং ভুক্তভোগী অ্যালারিকের এবং তার কথা অবিশ্বাস করার কোনো কারণও যেহেতু খুঁজে পাননি, তখন অজুহাত হিসেবে নিজেই একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন তিনি—নিশ্চয়ই কোনো অজ্ঞাত কারণে আর্ল গুস্তাভের মনে ভয়ানক একটা বিপর্যয় ঘটে গিয়েছিল, ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা সাময়িকভাবে হারিয়ে ফেলেছিলেন, তা না হলে অ্যালারিককে তিনি এতটা কঠিন শাস্তি দিতেন না।

একের পর এক দেরাজ খুলছেন রাসেল।

প্রথমটায় ঘোড়দৌড়ের একগাদা টিকিট। দ্বিতীয়টায় বাড়িঘরের কয়েকটা নকশা—শেষ জীবনে আর্ল গুস্তাভ প্রজাদের জন্য সস্তায় ভদ্রোচিত বাসগৃহ নির্মাণের একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন, তবে কাজ শুরু করার আগেই মারা যান। আরেকটা দেরাজে পাওয়া গেল রাজ্যের নথিপত্র। পরেরটায় একগাদা চিঠি। এসব একসময় গুস্তাভের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু রাসেলের জন্য এখন কোনোই গুরুত্ব বহন করে না।

দশ নম্বর দেরাজে পাওয়া গেল লম্বা একটা খাতা। প্রথম সাত-আটটা পাতায় গুস্তাভের হাতের লেখা চিনতে পারলেন রাসেল, খাতার বাকি পাতা সব সাদা। ঠিক সাদা বলা চলে না, অনেক কালের পুরোনো হওয়ায় রং বদলে হলদেটে হয়ে গেছে কাগজে রং।

রাসেল পড়তে শুরু করলেন। স্ত্রীর মৃত্যুতে গুস্তাভ শোকে কাতর হয়ে পড়েন। মনের দুঃখ প্রকাশ করবেন, এমন কাউকে হাতের কাছে পাননি, তাই এই খাতায় দু-চারটা কথা লিখেছিলেন।

কয়েক পাতা পর নিজের সন্তান গিয়েলুমের কথা লিখেছেন আর্ল গুস্তাভ। গিয়েলুমকে তিনি যে কতটা ভালোবাসতেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেল এই লেখায়। ছেলেকে তিনি ক্ষীরের পুতুল, আকাশের চাঁদ, নাইটিঙ্গেলের গান ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করেছেন, তার পরও সঠিক বর্ণনাটি দেওয়া গেল না বলে অতৃপ্তি প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন, ‘পুত্র আমার অফুরন্ত আনন্দের উৎস, পুত্ৰ আমার স্বর্গীয় সংগীতের ঝংকার, আমার পতিত আত্মাকে উদ্ধারের জন্য অবতীর্ণ এ নতুন আরেক যিশু।

পাতা ওল্টাচ্ছেন রাসেল। লিখিত পাতাগুলো শেষ হয়ে এল। মনে মনে হতাশ তিনি, কাজে লাগার মতো কিছুই তো পাওয়া গেল না। এমনকি অস্পষ্ট কোনো সূত্রও কোথাও নেই। রাসেল অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। পরের পাতাগুলোয় কিছু লেখা নেই, তবু খেয়ালের বশে উল্টে যাচ্ছেন। একসময় খাতা শেষ হয়ে এল। আরেকটা পাতা ওল্টালেন তিনি, এটাই বোধ হয় শেষ। আরে, একি! দুই পৃষ্ঠাজুড়ে এসব কিসের দাগ? মনে হচ্ছে কালি দিয়ে ছাপ দেওয়া হয়েছে!

কালির দাগ ভালো করে পরীক্ষা করার আগে নিচের লেখাগুলো পড়লেন রাসেল। আর্ল গুস্তাভ স্পষ্ট অক্ষরে নিজের হাতে লিখেছেন, ‘এগুলো আমার ছেলে গুইনপেলেনের তিন বছর বয়সের আঙুলের ছাপ।’

ওহ্, গড! গিয়েলুমের আঙুলের ছাপ! রাসেলের বুকে গরম রক্ত ছলকে উঠল। হ্যাঁ, তাই তো, আঙুলের ছাপই বটে। বাম দিকের পৃষ্ঠায় পাশাপাশি পাঁচটা আঙুল বাম হাতের। ডান দিকের পৃষ্ঠায় আরও পাঁচটা আঙুলের ছাপ ডান হাতের। পেয়েছেন! পেয়ে গেছেন! তাঁর পরিশ্রম সার্থক! গিয়েলুম যে আর্ল গুস্তাভেরই ছেলে, এর সপক্ষে অকাট্য প্রমাণ খুঁজছিলেন তিনি, ভাগ্যগুণে ঠিক সেটাই পেয়ে গেছেন। আর কোনো চিন্তা নেই। কদাকার চেহারার যে কিশোর উর্সাসের আশ্রয়ে রয়েছে, সে-ই আর্ল গুস্তাভের হারিয়ে যাওয়া ছেলে গিয়েলুম কি না, তা এখন প্রমাণ করা পানির মতো সহজ। বৃদ্ধ রাসেল এত খুশি হয়েছেন, তাঁর নাচতে ইচ্ছা করছে।

গিয়েলুমের এই ছাপের সঙ্গে যদি কদাকার চেহারার ছেলেটার আঙুলের ছাপ মিলে যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে যে এই ছেলেটাই গিয়েলুম। সে ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার থেকে কেউ তাকে বঞ্চিত করতে পারবে না। একেই কি তাহলে প্রকৃতির বিচার বলে? বাপের পাপে নিষ্পাপ শিশুর ভোগান্তি কম হয়নি। অ্যালারিক প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তাকে শুধু অপহরণই করেনি, অপারেশন করে চেহারাটাও চিরকালের জন্য বিকৃত করে দিয়েছে। কিন্তু সেই অ্যালারিকই আবার রাসেলকে ডেকে পাঠিয়ে অতীতের সমস্ত রহস্য খুলে বলেছে। কাকতালীয়ই বটে, রাসেল অ্যালারিকের আস্তানায় উপস্থিত থাকার সময়ই সেখানে উদয় হয় উর্সাস। একটা ছেলের ওপর অন্যায় করা হয়েছে, তার চেহারা বদলে দেওয়া হয়েছে, তাই সুবিচার পাওয়ার আশায় অভিযোগ করতে এসেছে উসাস। অভিযোগ শুনে অ্যালারিক বুঝতে পারেনি, সে হাসবে নাকি কাঁদবে। যে অপরাধ করেছে, না বুঝে তার কাছেই অভিযোগ করতে এসেছে উসাস। সবই কাকতালীয়, কিন্তু মিলিয়ে দেখলে গোটা ব্যাপারটার মধ্যে প্রকৃতির হাত অবশ্যই দেখতে পাওয়া যাবে। গিয়েলুম ছিল শিশু, ফেরেশতা; সে কারও কোনো ক্ষতি করেনি। তার বাপ একটা অপরাধ করেছিলেন, তার শাস্তি একা শুধু বাপ নয়, ছেলেকেও ভোগ করতে হয়েছে। তবে সব শাস্তিরই একটা মেয়াদ থাকে। আল গুস্তাভ মারা গিয়ে শাস্তিটাকে সংক্ষিপ্ত করতে পেরেছেন। হতভাগা গিয়েলুম এত কষ্ট ভোগ করার পরও বেঁচে আছে, মারা যায়নি। তবে তার শাস্তি বা কষ্ট এত দিনে কমল। সামনে এখন তার সুখের দিন। আর তাকে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে হবে না। নিজের কদাকার চেহারা দেখিয়ে লোকজনকে অবাক করতে হবে না। তার বিরতিহীন নিঃশব্দ হাসি দেখার জন্য জাদুকরের তাঁবুতে তারা ভিড় করবে না। সভ্য দুনিয়ার যেকোনো আদালত আঙুলের ছাপ মিলে গেছে দেখে রায় দেবেন যে হতভাগ্য এই ছেলেটাই আর্ল গুস্তাভের পুত্র গিয়েলুম।

কিন্তু যদি আঙুলের ছাপ না মেলে? সে ক্ষেত্রে প্রমাণিত হবে অ্যালারিক মিথ্যা কথা বলেছে, এ ছেলে গিয়েলুম নয়।

রাসেল ভাবছেন, এখন তাঁর কী করণীয়? না, কোনো অস্পষ্টতা নেই, তিনি জানেন তাঁকে কী করতে হবে। মনে মনে তারই একটা ছক তৈরি করলেন। অ্যামেলিয়ারা নিজেদের সময়মতো ফিরে আসুক। ওদের অপেক্ষায় এখানে তিনি বসে থাকবেন না। বরং আপাতত ওদের মুখোমুখি না হওয়াটাই তাঁর জন্য ভালো। এরকম উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে আগের মতো নরম সুরে অ্যামেলিয়ার সঙ্গে কথা বলা প্রায় অসম্ভব।

তাঁর প্রথম কর্তব্য গিয়েলুমের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করা। তাই আজই তিনি লন্ডনে যাবেন। গিয়েই খুঁজে বের করবেন একজন হস্তরেখাবিশারদ। ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে কাল বা পরশু আবার তিনি ফ্রান্সে ফিরে যাবেন। আর্ডেনের বাগিচায়, সেই উসাসের সঙ্গে দেখা করতে হবে তাঁকে।

.

দস্যু অ্যালারিকের আস্তানাতেই আর্ডেন উদ্যানের কথা শোনেন রাসেল। তখন তাঁর ধারণা হয়েছিল, উসাস সম্ভবত ওই বাগিচাতেই থাকে। কিন্তু প্যারিসে দ্বিতীয়বার এসে তাঁর সে ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হলো।

অ্যালারিক তাঁকে এক পুলিশ কর্মকর্তার ঠিকানা দিয়ে রেখেছে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে ওই কর্মকর্তার মাধ্যমে। অবশ্য অন্য কোনো সূত্র থেকেও রাসেল জেনে নিতে পারতেন আর্ডেন বাগিচা কোথায়, তবে তা জানতে চেষ্টা করলে অনেক কৌতূহলী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। লোকে তাঁর পরিচয় জানতে চাইবে। জিজ্ঞেস করবে, জনবিরল একটা জঙ্গলে কী কাজ তাঁর? এসব ঝামেলা এড়ানোর জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন অ্যালারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করাই সব দিক থেকে ভালো।

দ্বিতীয়বার প্যারিসে এসেও সেই হোটেল বোর্বোতেই আবার উঠলেন রাসেল। হোটেলে একা শুধু আঁদ্রেকে পাওয়া গেল, অ্যামেলিয়ারা আজ সকালেই ইংল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে। আজকের দিনটার রুমভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গেছে ডেভিড, তাই ইচ্ছা করলে অ্যামেলিয়ার সম্পূর্ণ স্যুইটটাই রাত বারোটা পর্যন্ত নিজের দখলে রাখতে পারে আঁদ্রে। বর্তমানে সে বেকার, যাওয়ার তেমন কোনো জায়গাও নেই। বিনা খরচায় যতক্ষণ থাকা যায়, থাকবে সে।

রাসেল হোটেলে উঠলেন সন্ধের দিকে। তখনো তিনি জানেন না যে আগে ভাড়া করা স্যুইট এখনো তাঁদের দখলে আছে। নতুন একটা রুম ভাড়া করার জন্য হোটেলের রিসেপশনে ঢুকলেন তিনি। কাউন্টারের কেরানি তাঁকে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়ল। ‘আপনি? আবার?’

‘কাজ থাকলে আসতেই হয়। একটা রুম হবে তো?’

‘হ্যাঁ, কেন হবে না। কিন্তু আগের স্যুইট তো এখনো আপনাদের দখলেই রয়েছে। ওটা আপনারা খালি করে দেবেন রাত বারোটায়। ওরা সকাল আটটার দিকে গেলেন তো, তাই পুরো দিনটার ভাড়াই কেটে রাখতে হলো। আপনাদের একজন এখনো তো রয়েছেন। ইচ্ছা করলে আপনিও থাকতে পারেন। নতুন আরেকটা রুম ভাড়া করে কেন শুধু শুধু খরচ বাড়াবেন। অবশ্য কালও যদি থাকেন, তখন ভাড়া দিতে হবে।’

খুশি হন রাসেল। দু’পয়সা বাঁচছে। কিন্তু কাল পর্যন্ত থাকবেন কি? না, সে সম্ভাবনা কম। আজ রাতেই যদি অ্যালারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়, আর্ডেন বাগিচার ঠিকানা জেনে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়বেন তিনি।

এখন তাঁর প্রথম কাজ পুলিশ কর্মকর্তার বাড়িতে গিয়ে একটা চিঠি রেখে আসা। কিন্তু চিঠি রেখে ফিরে এলে কি কাজ হবে? ভদ্রলোক জবাব দিতে যদি দু-একদিন সময় নেন? তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইবেন বলেও মনে হয় না। দস্যু অ্যালারিকের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রাখেন, স্বভাবতই এটা ফাঁস হওয়ার ঝুঁকি তিনি নেবেন না। তবু সরাসরি দেখা করে অ্যালারিকের ঠিকানা চাইবেন রাসেল, যদি সম্ভব হয়।

কিন্তু না, সম্ভব হলো না। ভদ্রলোক যে দেখা করতে রাজি হলেন না, তা নয়। বাড়িতেই নেই তিনি। সন্ধের দিকে টহলে বেরিয়েছেন, ফিরবেন সেই সকালে। আর কোনো উপায় না দেখে একটা চিঠি লিখে ডাকবাক্সে ফেলে দিলেন রাসেল। খামে অ্যালারিকের একটা ছদ্মনাম ব্যবহার করলেন।

রাস্তায় পড়ল একটা রেস্তোরাঁ। রাতের খাবারটা ওখানে বসেই সেরে নিলেন তিনি। হোটেল বোর্রোতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল।

আর মাত্র দুই ঘণ্টা এই স্যুইটে থাকা যাবে। অর্থাৎ, রুম একটা ভাড়া না নিয়ে উপায় নেই। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, অন্তত দু-একদিন তো থাকতেই হবে প্যারিসে।

রিসেপশনে আবার সেই কেরানির সঙ্গে কথা হলো। সে হেসে উঠে বলল, ‘এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, বলুন তো! রাতটা কাটুক, কাল সকালে সিদ্ধান্ত নেবেন। কথা দিচ্ছি, রাতে আপনাকে স্যুইট খালি করতে বলা হবে না।

একটু দেরিতে হলেও রাসেল বুঝতে পারলেন, কেরানি কিছু বকশিশ চায়। উপরি পাওনার লোভ যে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের ভেতরই সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে আছে, উকিল হওয়ার সুবাদে সেটা খুব ভালো করেই জানেন তিনি। ছোট করে মাথা ঝাঁকিয়ে তিনি বোঝাতে চাইলেন, বকশিশ দিতে তাঁর আপত্তি নেই।

হাতব্যাগ নিয়ে পরিচিত স্যুইটে এসে ঢুকলেন রাসেল। মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে আছে। স্যুইটের রুমগুলো যারা হইচই করে সরগরম করে রেখেছিল, তারা কেউ নেই। লেডি রাচেলের কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে অ্যামেলিয়ার কথা। ওরা না থাকায় নিজেকে তাঁর নিঃসঙ্গ মনে হলো। আঁদ্রেটা আছে বটে, কিন্তু ওটা একটা মানুষ নাকি! ওর সঙ্গ তাঁকে বরং বিরক্তই করবে। রক্ষা এই যে, ওকে এড়িয়ে থাকা সম্ভব। রাত তো কম হয়নি, নিজের ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়লে অভদ্রতা হবে না।

তাকে দেখে একেবারে হকচকিয়ে গেল আঁদ্রে। হড়বড় করে কৈফিয়ত দিতে শুরু করল, কেন সে এখনো এখানে আছে। তারপর নিজেকে তার বোকা মনে হলো, ভাবল আগে তো মি. রাসেল ফিরে আসায় তার আনন্দ প্রকাশ করা উচিত! এরকম দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে একসময় চুপ মেরে গেল সে। রাসেল অবশ্য তার সঙ্গে গল্প জমানোর কোনো আগ্রহ দেখালেন না। শুধু ভদ্রতা দেখিয়ে বললেন, ‘থাকার অন্য কোনো ব্যবস্থা যদি না করে থাকেন, আজ পুরো রাতটাই এখানে আপনি থাকতে পারেন, বারোটার সময় চলে যাওয়ার দরকার নেই। আমি যখন থাকছি, আপনিও থাকতে পারেন।

তাঁকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাল আঁদ্রে। না, অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা এখনো তার করা হয়ে ওঠেনি। যদিও মাত্র দুদিন চাকরি করেছে সে, তবু অ্যামেলিয়া তাকে পুরো মাসের বেতনই দিয়ে গেছে। চাকরিটা ছিল অস্ত্রবিদ্যায় ডেভিডকে পারদর্শী করে তোলার, কিন্তু সেদিকে ডেভিডের আগ্রহ না থাকায় তাকে নিয়ে শহরে ঘুরে বেড়ানোটাকেই কাজ বলে ধরে নিয়েছিল সে। মাত্র দুদিনেই সবার সঙ্গে মধুর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে জন্যই অ্যামেলিয়া পুরো মাসের বেতন দিয়ে তার মস্ত উপকার করে গেছে। অবশ্য স্বীকার করতে হবে যে ডেভিডও সুপারিশ করেছিল। ওদের দুজনের উদারতা সে কোনো দিন ভুলবে না।

এই মুহূর্তে আঁদ্রের পকেটে পঞ্চাশ পাউন্ড আছে ঠিকই, তবে টাকাপয়সার অভাব মানুষকে যে কী কষ্ট দেয়, তা তার চেয়ে ভালো আর কে জানে? ওই পঞ্চাশ পাউন্ডে হাত দিতে সাহস পাচ্ছে না সে। ভেবেছিল, বারোটার পর হোটেল ছেড়ে রাস্তায় বেরোবে, এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে পার করে দেবে রাতটা। এরই মধ্যে মি. রাসেল তাকে এখানে রাতটা কাটিয়ে যেতে বলায় ভারি খুশি হয়েছে সে। বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে ফ্লাস্কভর্তি কফি। রাসেলকে সে বলল, ‘যদি কিছু মনে না করেন, এক কাপ কফি খেতে অনুরোধ করব আপনাকে। রাতে শোয়ার আগে এক কাপ কফি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী, সে তো আপনি জানেনই। সত্যি কথাই বলি, মি. রাসেল, এই দুটো দিন আপনাদের আতিথেয়তায় কী আরামেই না কেটেছে! চাকরি হারানোয় কোনো দুঃখ নেই—কাজ জানা থাকলে চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু লর্ড ডেভিডের উদারতা আর কাউন্টেস অ্যামেলিয়ার আন্তরিকতা কোনো দিন আমি ভুলতে পারব না। দুদিনেই তারা একেবারে আপন করে নিয়েছিল আমাকে। বিশ্বাস করুন, ওরা চলে যাওয়ায় আপনজনকে হারানোর ব্যথা অনুভব করছি।

কে জানে এ তার অন্তরের কথা কি না। কে জানে এ তার অভিনয় কি না। কিন্তু করুণ আবেদনভরা ভাষা আর ভেজা ভেজা চোখ দেখেও অবিশ্বাস আর বিদ্রূপ করতে হলে যে পরিমাণে অভদ্র আর নিষ্ঠুর হতে হয়, বৃদ্ধ রাসেল তা কোনো দিন হতে পারবেন না। সহানুভূতিসূচক মাথা ঝাঁকালেন তিনি।

উৎসাহ পেয়ে গেল আঁদ্রে। বলল, ‘যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’ উত্তরের অপেক্ষায় থাকল না। আবার ফিরে এলেন যে? অবশ্য উকিল মানুষ, নানা কাজে আজ লন্ডন তো কাল প্যারিসে ছুটে যেতে হয়…’

তাকে থামিয়ে দিয়ে রাসেল বললেন, ‘জরুরি একটা কাজেই ফিরে আসতে হয়েছে। তা, সত্যি কফি খাওয়াবেন?’

দ্রুত হাতে কফি পরিবেশন করল আঁদ্রে।

কাপটা হাতে নিয়ে দাঁড়ালেন রাসেল। ‘বড় ক্লান্ত বোধ করছি। কাপটা নিজের ঘরে বসেই খালি করি।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে। কাল সকালেও একবার আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর সুযোগ পাব বলে আশা করি,’ বলতে বলতে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে আঁদ্রেও চেয়ার ছাড়ল।

রাসেল চলে গেলেন। একা বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে আঁদ্রে। বৃদ্ধ আইনজীবীর কথাই ভাবছে সে। ভদ্রলোককে কেমন যেন গম্ভীর মনে হলো। কোনো রহস্য আছে নাকি? দলের সবাইকে পেছনে ফেলে একা লন্ডনে পালিয়েছিলেন। সবাই চলে যাওয়ার পর আবার একা ফিরে এসেছেন। কী মনে করে? নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে। নাকি লন্ডনে তিনি যানাইনি?

যতই ভাবছে আঁদ্রে, ততই দিশাহারা বোধ করছে। সন্দেহ প্রবল থেকে প্রবলতর হলো। বুড়ো উকিল দস্যু অ্যালারিকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র করেননি তো? অ্যালারিকের হাতে বন্দী হলো ডেভিড, তাতে কি রাসেলের হাত ছিল? তিনিই হয়তো ডেভিডকে আটক করার অসৎ পরামর্শ দিয়েছিলেন অ্যালারিককে। সমাজে ভদ্রবেশী ব্ল্যাকমেলারের অভাব নেই। মুক্তিপণের অর্ধেক টাকা ঘুরপথে রাসেলের পকেটে এসে ঢোকেনি তো? হয়তো নিজের ভাগের টাকাটা অ্যালারিকের কাছ থেকে এখনো পাননি রাসেল, সেটা নিতেই প্যারিসে আবার ফিরে এসেছেন। এমনও হতে পারে যে লন্ডনে যানইনি, প্যারিসেই কোথাও গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন। লন্ডনে যাওয়ার কথা বলেছিলেন ওদের সবাইকে বোকা বানানোর জন্য। স্রেফ একটা ধাপ্পা দিয়েছেন। তিনি চলে গেছেন শুনে বাকি সবাইও যাতে প্যারিস ত্যাগ করে।

যত ভাবছে আঁদ্রে, ততই জটিল লাগছে ব্যাপারটা। সেই জটিলতার মধ্যে লোভনীয় কী যেন একটা আছে। একসময় সে উত্তেজিত হয়ে পড়ল। মন থেকে কে যেন বলছে, তার জীবনে সুবর্ণ একটা সুযোগ এসেছে। ধরে নেওয়া যাক ধুরন্ধর উকিল একটা ষড়যন্ত্র করেছেন, এখন যদি তদন্ত চালিয়ে আঁদ্রে সেটা উদ্‌ঘাটন করতে পারে, তাহলেই তো কেল্লা ফতে–বিজয়ী বীর হিসেবে অ্যামেলিয়া ও ডেভিডের কাছে ফিরে যেতে পারবে সে। ওদের চাকরি সে করুক বা না করুক, আঁদ্রের প্রতি চিরকাল কৃতজ্ঞতা বোধ করবে ওরা। তা থেকে টাকা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সম্মান, এরকম আরও অনেক কিছুই তো আসতে পারে।

কফিটুকু খেয়ে পা থেকে জুতা খুলে ফেলল আঁদ্রে। ঘর থেকে বেরিয়ে এল শুধু মোজা পায়ে। হাঁটছে কোনো শব্দ না করে। সামনেই রাসেলের কামরা। দরজার সামনে দাঁড়াল সে। উত্তেজনায় দম আটকে রেখেছে। কামরার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। মনে মনে হতাশ হলো আঁদ্রে। সে জানত, সাধারণত স্যুইটের প্রধান দরজাটাই বন্ধ রাখা হয়, বাকি সব দরজা রাতে শোয়ার সময় ভিড়িয়ে রাখা হয়। আঁদ্রের সন্দেহ আরও জোরালো হলো। যে ষড়যন্ত্র করে, তার মনে নানা ধরনের ভয় থাকে। রাসেল যেহেতু ষড়যন্ত্র করেছেন, নিজেকে তিনি নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। তা না হলে ভেতর থেকে দরজায় তালা দেবেন কেন?

কিহোলে চোখ রেখে কামরার ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল আঁদ্রে। কিন্তু সেখানেও উকিলি প্যাচ কষে রেখেছেন রাসেল। কিহোলে চোখ রেখে ভেতরের কিছুই আঁদ্রে দেখতে পেল না। ভেতরের পর্দাটা টেনে দিয়েছেন রাসেল, ফলে কিহোলের ফুটোর সামনে ওই পর্দা একটা দেয়াল তৈরি করেছে।

আঁদ্রে আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল। রাসেল কি ভেতরে বসে গোপন কোনো কাজ করছেন? নিশ্চয় তা-ই, তা না হলে দরজা বন্ধ করার পর পর্দা টেনে দেওয়ার কী দরকার ছিল?

দরজার গায়ে কান ঠেকাল আঁদ্রে। খসখসে একটা আওয়াজ হচ্ছে না? বুড়ো কি টাকা গুনছে? নাকি কাগজ ওল্টাচ্ছে? লন্ডনবাসী ঘাগু উকিল প্যারিসের হোটেলে বসে এত রাতে কী পড়ছেন?

না, আর কোনো সন্দেহ নেই। রাসেল যে সোজা পথে চলছেন না, বড় ধরনের কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত, বাজি রেখে বলতে পারে আঁদ্রে। এখন তাহলে তার কী করা উচিত? বুড়োকে কড়া নজরে রাখা। তবে আড়াল থেকে। কারণ, রাসেল যদি বুঝতে পারেন যে তাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হয়ে যাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে আঁদ্রের প্ল্যান তো ব্যর্থ হবেই, এমনকি সে বিপদেও পড়তে পারে। যে লোক টাকার লোভে তাকে ও ডেভিডকে দস্যু অ্যালারিকের হাতে তুলে দিতে পারে, সে একা আঁদ্রেকে বিপদে ফেলতে পারবে না কেন?

বিছানায় শুয়েও রহস্যটা নিয়ে অনেকক্ষণ মাথা ঘামাল আঁদ্রে। চোখে ঘুম নামতে ভোর হয়ে এল। সকালে তার জাগার কথা নয়, জাগলও না। স্যুইটের প্রধান দরজায় কড়া নেড়ে ঘুম ভাঙানো হলো তার। ঘড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসে আঁদ্রে দেখে ঘড়িতে নয়টা বাজে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল সে। সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে হোটেলের স্টুয়ার্ড।

স্টুয়ার্ড কর্কশ সুরে বলল, ‘জানতে পারি, আপনি কেমন ভদ্রলোক? মি. রাসেলকে তো কিছু বলতে হয়নি, সেই ভোরবেলা স্যুইট ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। অন্য একদল বোর্ডারও সেই ভোরবেলাতেই এই স্যুইট ভাড়া করেছে। অথচ আপনি কী করছেন? না, নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। এই যে আপনি স্যুইটটা দখল করে রেখেছেন, এর জন্য অন্য একদল ভদ্রলোককে কষ্ট পেতে হচ্ছে। আমাদের হোটেলেরও দুর্নাম হচ্ছে। আশা করি আপনি স্বীকার করবেন, কাজটা ভদ্রতাবিরুদ্ধ?’

কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না আঁদ্রে।

‘আপনার ভাগ্য ভালো যে এক দিনের ভাড়া আমরা আপনার কাছে চাইছি না, বোর্ডার পাওয়ায় বেঁচে গেছেন। সে যা-ই হোক, এখন দয়া করে পায়ে জুতা গলিয়ে আপনি যদি স্যুইট ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, ডালপালা গজানোর আগেই ঝামেলাটা আমরা সামলে নিতে পারব বলে মনে হয়। তা না হলে…’

স্টুয়ার্ডের কথা শোনার জন্য ওখানে তখন আর দাঁড়িয়ে নেই আঁদ্রে। জুতাজোড়া পায়ে গলানোরও সময় দেয়নি নিজেকে, হাতে করে স্যুইট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। করিডরে উবু হয়ে বসল সে, জুতা না পরে তো আর রাস্তায় বেরোনো যায় না। পায়ে ওগুলো গলানোর সময় দেখল ডাইনিংরুম থেকে তার দিকে সকৌতুকে তাকিয়ে রয়েছে নতুন বোর্ডাররা। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো তাদের একজন আবার অযাচিতভাবে এগিয়ে এসে নরম গলায় অনুরোধ করল, ‘এত বেলায় খালি পেটে চলে যাবেন না। ব্রেকফাস্ট রেডি।’

খিদে পেলেও ভদ্রলোকের আমন্ত্রণে সাড়া দিল না আঁদ্রে। তার আত্মমর্যাদায় বাধছে।

রিসেপশনে ঢুকে কেরানির সামনে দাঁড়াল সে। দেরি করে স্যুইট ছাড়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করল, তারপর জিগ্যেস করল, ‘মি. রাসেল হোটেল ছেড়ে চলে গেছেন, নাকি অন্য কোনো রুম ভাড়া নিয়েছেন?

‘না, হোটেলেই আছেন তিনি,’ জবাব দিল কেরানি |

‘তাহলে তাঁর রুম নম্বরটা দিন আমাকে।’

আঁদ্রেকে কেরানি চেনে, কাজেই রুম নম্বর দিতে আপত্তি করল না। হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে নাশতা খেল আঁদ্রে। তারপর এল এক মেকআপম্যানের দোকানে। আবার যখন হোটেল বোবোতে ফিরল সে, কার সাধ্য দেখে চিনতে পারে তাকে! সারা মুখে শোভা পাচ্ছে লালচে চাপদাড়ি। ঠোঁটের নিচে ঝুলছে ঘন ও চওড়া গোঁফ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *