দ্য ম্যান হু লাফস – ৩

লোকটাকে রাস্তায় কোথাও দেখলে রাসেল তাকে গাইড বলেই ধরে নিতেন। এ লোক নিশ্চয়ই বিদেশি ট্যুরিস্টের খোঁজে শহর চষে বেড়ায়, তাদের দর্শনীয় স্থানগুলোতে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার বিনিময়ে দুই পয়সা রোজগার করে। ড্রয়িংরুমে ঢুকে তিনি দেখলেন, লোকটা হাতে হ্যাট নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁকে দেখে এক পা এগোল, বলল, ‘আশা করি আপনিই মি. রাসেল? গুড মর্নিং।’

‘গুড মর্নিং,’ বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন রাসেল। অভিজ্ঞ আইনজীবী তিনি, দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করছেন। নাশতার টেবিলে ডেভিড আর আঁদ্রে অনুপস্থিত, ব্যাপারটা রহস্যময়। আরেক রহস্য এই লোক আর তার নিয়ে আসা চিঠি। দুই রহস্যের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি?

‘আপনার জন্য একটা চিঠি আছে,’ বলল লোকটা। রাসেলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বিশেষ গ্রাহ্য করছে না।

লোকটা মধ্যবয়সী, মুখে ঝুলে পড়া গোঁফ আর ছোট করে ছাঁটা দাড়ি। কপালের ডান কোণে বাঁকা একটা পুরোনো ক্ষতচিহ্ন। লোকটা যেন মারামারি করতে অভ্যস্ত। আচরণ মারমুখী না হলেও চেহারায় বন্য একটা ভাব আছে। ভীত স্বভাবের যেকোনো লোক একে দেখলেই চমকে উঠবে। আর সাহসী হলে অপছন্দ করবে। ‘চিঠি থাকলে দিন, আমিই তো রাসেল,’ শান্ত সুরে বললেন তিনি।

‘চিঠিটায় অবশ্য তেমন কিছু লেখা নেই,’ বলল লোকটা। ‘বলতে পারেন, ওটা আমার পরিচয়পত্র।’ পকেট থেকে বের করে চিঠিটা রাসেলের দিকে বাড়িয়ে ধরল সে।

খাম খুলে সেটা পড়লেন রাসেল। সত্যিই কিছু বোঝা গেল না। মাত্র তিন- চারটে লাইন। লেখা হয়েছে, ‘মি. রাসেল, পত্রবাহক জরুরি একটা খবর নিয়ে যাচ্ছে। ওর মুখে আমার নাম শুনলেই বুঝতে পারবেন, সম্ভাব্য যেকোনো বিপদ থেকে ওকে উদ্ধার করার ক্ষমতা আমার আছে। আমি জানি, প্যারিসে আপনি নতুন, তবু আমার নাম আপনি শোনেননি, এ হতেই পারে না।’ ব্যস, এইটুকুই লেখা। চিঠির শেষে কোনো নাম নেই।

রেগে গেলেন রাসেল। ‘এর মানে কী? সম্ভাব্য বিপদটা আপনার কী হতে পারে? আভাসে আমাকে হুমকি দেওয়ারই বা কী মানে? কার চিঠি এনেছেন আপনি? যা বলার তাড়াতাড়ি বলে বিদায় হন, টেবিলে আমার নাশতা পড়ে আছে…’

‘টেবিলে কি শুধু আপনার নাশতা পড়ে আছে, মি. রাসেল?’ ক্ষীণ বিদ্রূপের সুরে বলল আগন্তুক লোকটা। ‘লর্ড ডেভিড আর মসিয়ে আঁদ্রের নাশতাও কি পড়ে নেই?’

এতক্ষণে সত্যি শঙ্কিত বোধ করলেন রাসেল। রাস্তা থেকে উঠে আসা ভয়ানক চেহারার এই লোক জানে ডেভিড আর আঁদ্রের জন্য টেবিলে নাশতা পড়ে আছে? আসলে ঘটনাটা কী? ‘কী বলবেন পরিষ্কার করে বলুন দেখি। ইচ্ছা হলে বসতেও পারেন।

‘আমি বসছি না। তবে আপনার বোধ হয় বসা প্রয়োজন। শুনুন তাহলে। লর্ড ডেভিড আর মসিয়ে আঁদ্রে কাল বেশ রাত করে ক্যাসিনো ভ্যালয় থেকে বেরোন। আপনি নতুন, তাই হয়তো প্যারিসের একটা বৈশিষ্ট্যের কথা জানেন না। লর্ড ডেভিডেরও জানার কথা নয়। কিন্তু মসিয়ে আঁদ্রে তো দীর্ঘদিন হলো প্যারিসেই বাস করছেন, তাই না? সব জেনেও উনি কেন যে অমন বোকার মতো অসতর্ক হলেন…সত্যি, ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক।

হঠাৎ ডাইনিংরুম থেকে চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে এল। সবাই উত্তেজিত, একসঙ্গে গলা চড়িয়ে কথা বলছে। অ্যামেলিয়ার গলা চিনতে পারলেন রাসেল, কানে তীক্ষ্ণ আর্তনাদের মতো বাজল।

ড্রয়িংরুম থেকে ছুটে বেরিয়ে যাবেন রাসেল, হাত লম্বা করে দিয়ে তাঁর পথ রোধ করল আগন্তুক। ‘যেতে চাইলে যান আপনি। কিন্তু গিয়ে কী বলবেন ভেবেছেন? লর্ড ডেভিড সম্পর্কে যে কথা শুনলে ওরা দুশ্চিন্তামুক্ত হবে, সে কথা এখনো তো আমি আপনাকে বলিনি। একটু ধৈর্য ধরুন, কথাটা শুনে যান।’

ডাইনিংরুমের শোরগোল আরও বাড়ছে। রাসেল হতভম্ব হয়ে পড়েছেন। ‘কী কথা? দেখছেন না, ওরা…’

‘অস্থির হয়ে পড়েছেন, এই তো? তা তো হবেনই। তবে কি জানেন, আমি কিন্তু ঠিক সময়েই পৌছে গেছি। যান, গিয়ে বলুন, যাদের জন্য এত চিন্তা তারা নিরাপদেই আছেন। এমন লোক তাদের দেখাশোনা করছেন, বাধ্য না হলে দুই ভদ্রলোকের কারও এতটুকু ক্ষতি করবেন না। আপাতত এটুকু বলে ওদের আশ্বস্ত করুন, তারপর আমার কাছে ফিরে আসুন। আপনি ফিরে এলে ব্যাখ্যা করে বলতে পারব ঠিক কী করলে লর্ড ডেভিড আর মসিয়ে আঁদ্রেকে আপনারা বহাল তবিয়তে আবার দেখতে পারেন।’

রাসেলের ইচ্ছা হলো, এক ঘুষিতে লোকটার সব কটা দাঁত ফেলে দেন, তারপর পুলিশ ডাকেন। পরক্ষণে ভাবলেন, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। এই লোকের পেছনে আরও লোক আছে, সন্দেহ নেই তারা খুবই ক্ষমতাবান। তা ছাড়া ঝোঁকের মাথায় তাড়াহুড়ো করে কিছু করা তাঁর স্বভাবও নয়। রাগ চেপে রেখে ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি

ডাইনিংরুমে ঢুকে হকচকিয়ে গেলেন রাসেল। ছেলের অমঙ্গল আশঙ্কায় লেডি রাচেল এতটাই মুষড়ে পড়েছেন, যেকোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন বলে মনে হলো।

লেডি রাচেল ডেভিডের ঘরে গিয়েছিলেন। সেখানে ডেভিডকে তো পানইনি, ঘরের অবস্থা দেখে বুঝতে বাকি থাকল না যে রাতে সে এখানে ছিলই না। বিছানার চাদরে কোনো ভাঁজ পড়েনি, শেরির বোতল এতটুকু খালি হয়নি। ডেভিডের খাস চাকর ডিক্সনকে জিজ্ঞেস করতে সে জানাল, মনিবের অপেক্ষায় অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বসে ছিল সে, তারপর করিডরের মেঝেতেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙে সকালে, তাই ভাবল, ঘুমাতে দেখে মনিব তাকে জাগাননি, নিজেই জামাকাপড় খুলে চুপচাপ শুয়ে পড়েছেন। মনিব দাড়ি কামাতে চাইবেন, তাই তাড়াতাড়ি পানি গরম করে আনে সে, ভেবেছিল ঘুম ভাঙার পর ডাক দিলেই বলতে পারবে পানি গরম করে রেখেছে সে। লেডি রাচেলকে পানিভর্তি পাত্রটা দেখাল সে, বলল, ‘এই দেখুন, বাটি আমার হাতেই রয়েছে।

ডিক্সনই তাঁকে বুদ্ধি দিল, আঁদ্রের ঘরে একবার উঁকি দিয়ে দেখা দরকার। উঁকিটা অবশ্য সে নিজেই দিল। আঁদ্রের ঘরেও যে কাল রাতে কেউ শোয়নি, লক্ষণ দেখে সেটাও পরিষ্কার হয়ে গেল। এরপর ছুটে ডাইনিংরুমে ফিরে আসেন লেডি রাচেল! তাঁর মুখ থেকে দু-একটা আশঙ্কার কথা শুনেই অ্যামেলিয়া বুঝতে পারে তার ভাবী স্বামী কাল রাতে হোটেলে ফেরেনি। সাংঘাতিক ভয় পেয়ে যায় সে। তার ধারণা হয়, গুন্ডারা ডেভিডকে মেরেই ফেলেছে। তখনই সে আর্তনাদ করে ওঠে। ড্রয়িংরুম থেকে তার সেই আর্তনাদই শুনতে পেয়েছেন বৃদ্ধ রাসেল।

রাসেল ডাইনিংরুমে ঢুকতেই আরামকেদারা থেকে লাফ দিলেন লেডি রাচেল। বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। অ্যামেলিয়াও ফুঁপিয়ে উঠল, তবে রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে। বিয়াঁকা অবশ্য আগে থেকেই অ্যামেলিয়ার নাকে স্মেলিং সল্টের শিশি ধরে আছে। অ্যামেলিয়া নাকে রুমাল চেপে ধরায় শিশিটা নিজের ঠোঁটের ওপর রেখে সশব্দে ঘন ঘন শ্বাস টানতে লাগল সে।

টেবিলের নাশতা টেবিলেই পড়ে থাকল। ওখানে ছয়জনের নাশতা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন এই মুহূর্তে গুন্ডাদের হাতে বন্দী, দুজন অবিরাম কাঁদছে, একজন স্মেলিং সল্টের গন্ধ শুঁকে জ্ঞান না হারানোর চেষ্টায় গলদঘর্ম হচ্ছে। বাকি একজন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

বিমূঢ় বোধ করলেও রাসেল ভাবছেন, আন্তরিক শোক তিনি অনুভব করুন আর না করুন, লেডি রাচেল আর অ্যামেলিয়ার খাতিরে অভিনয় করতে হবে তাঁকে, সবাই যাতে বিশ্বাস করে যে তিনিও কম আঘাত পাননি। কিন্তু অভিনয় করতে হলেও শক্তি থাকা দরকার, খালি পেট সে শক্তি জোগান দিতে অপারগ। কাজেই প্রথমে কিছু খাওয়া দরকার। খিদেতে তাঁর পেট জ্বলে যাচ্ছে, শোক প্রকাশক একটা শব্দও মাথায় আসছে না। পেটের সঙ্গে মস্তিষ্কের সম্পর্ক মোটেও তুচ্ছ নয়।

এক হাতে রাচেলকে ধরে আছেন তিনি, খালি হাতটা বাড়িয়ে প্লেট থেকে বেশ বড় সাইজের একটা কেক তুলে নিলেন। কেকটা মুখে পুরে গিলে ফেলার চেষ্টা করছেন, একই সঙ্গে রাচেলকে আরামকেদারায় বসিয়ে দিয়ে মুখ খুলে সান্ত্বনা ও অভয় দেওয়ার চেষ্টা চালালেন। কথা বলছেন, তারই ফাঁকে পালা করে রাচেল ও অ্যামেলিয়ার দিকে তাকাচ্ছেন। কেক কিন্তু গলা থেকে নামছে না। লেডি রাচেল, কোঁত, ব্যাপারটা, কোঁত, কিছুই নয় আসলে। কোঁত, কী বলছি শুনছ তো, কোঁত, অ্যামেলিয়া? আমি একটা সুখবর পেয়েছি, কোঁত। ওরা, কোঁত, নিরাপদেই আছে, কোঁত।’

অবশেষে মুশকিল আসান হলো, কেকের সবটুকু গলা থেকে নেমে গেল পেটে, রাসেল সাহেবও স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে পট থেকে গরম কফি ঢাললেন কাপে। কিন্তু আবার শুরু হলো নতুন বিপত্তি। কফি অসম্ভব গরম! ঠান্ডা না করে গলায় ঢালাটা উচিত হবে না। কিন্তু তাঁর সময় কোথায়? ড্রয়িংরুমে কে অপেক্ষা করছে, মনে নেই? তা ছাড়া কাপে ফুঁ দিয়ে কফি ঠান্ডা করা ভদ্রোচিত কোনো কাজ নয়। কিন্তু আর কোনো উপায়ও তো নেই! কী হবে, এক-আধবার ফুঁ দিলে? ‘শোনো, রাচেল, ফুঁ-ফুঁ, নিরাপদেই আছে ওরা দুজন। উঃ, কী সাংঘাতিক গরম রে বাবা, ফুঁ-ফুঁ, ওই ঘরে যে লোকটা এসেছে, ফুঁ-ফুঁ, সে-ই বলল আমাকে কথাটা, ফুঁ-ফুঁ। ঠিক কোথায় আছে, ওর কাছে ফিরে গিয়ে, ফুঁ-ফুঁ, শুনতে পাব।’

কফি আরেকটু ঠান্ডা হতেই চোঁ চোঁ করে গিলে ফেললেন রাসেল, দেখতে অসুন্দর হলেও গ্রাহ্য করলেন না। ‘তোমাদের চিৎকার আর কান্নাকাটি শুনে ছুটে এলাম। জরুরি কথাটা, আসল কথাটা, এখনো শোনা বাকি। তোমরা বসো, নাশতা সারো, আমি যাই, সব কথা শুনে আসি। আমার তো কিছুই খাওয়া হলো না, নাশতাটা যেন থাকে। ডেভিডের কথা ভেবে মনটা এত উতলা হয়ে আছে…’

টেবিলে সাজানো উপাদেয় নাশতার দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে ড্রয়িংরুমে ফিরে এলেন রাসেল। ভেতরে ঢোকামাত্র তাঁর মুখ থেকে পটকা ফাটার মতো কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এল, ‘মাই গড! বাই জোভ! হোলি ভার্জিন!’ কী আশ্চর্য, ঘর একেবারে ফাঁকা, কেউ নেই! ভীতিকর চেহারার লোকটা একদম হাওয়া হয়ে গেছে। সে নেই, তবে তার বদলে টেবিলে পড়ে রয়েছে একটা চিঠি।

এটা সেই আগের চিঠি নয়। খাম নেই, শুধু ভাঁজ করা কাগজ একটা। তবে আগেরটার চেয়ে লম্বা। হাতের লেখাও এক নয়।

রাসেল পড়তে শুরু করলেন।

‘খবর পেলাম ব্যাংক অব লন্ডনের প্যারিস শাখায় আপনার সঞ্চয় মাত্র পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড। হিসাব কষে দেখলাম, আপনারা যদি দু-একদিনের মধ্যে লন্ডনে ফিরে যান, তাহলে এখানকার হোটেল বিল, পথখরচ, ওষুধ কেনা ইত্যাদি খাতে খুব বেশি হলে পাঁচ শ পাউন্ড খরচ হতে পারে। তার মানে, আপনার অ্যাকাউন্টে থাকবে উনপঞ্চাশ হাজার পাঁচ শ পাউন্ড। এই টাকাটা ব্যাংক থেকে তুলে রাত ঠিক বারোটায় শ্যেন নদীর তিন নম্বর ব্রিজের উত্তর প্রান্তে কালো একটা ওভারকোট গায়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন একা আপনি, ওভারকোটের বাটনহোলে সাদা একটা ফুল অবশ্যই থাকা চাই। আমার একজন লোক আপনার সামনে হাজির হবে। বিনা দ্বিধায় তার সঙ্গে যাবেন, যেখানেই সে নিয়ে যেতে চাক আপনাকে। ভয় পাবেন না। তবে ভয় দেখানোর চেষ্টা ও করবেন না। পুলিশে খবর দেওয়াটা নেহাতই বোকামি হবে, কারণ তাহলে ডেভিডকে আর কোনো দিন দেখতে পাবেন না। অ্যালারিক দ্য গথ।’

সর্বনাশ! অ্যালারিক দ্য গথ! এই ভয়ানক দস্যুর হাতে পড়েছে ডেভিড? ভয়ে-আতঙ্কে একেবারে অবশ হয়ে গেলেন রাসেল, চেয়ারে ধপ করে বসে দরদর করে ঘামতে শুরু করলেন।

গোটা ফ্রান্সে, বিশেষ করে রাজধানী প্যারিসে, ছদ্মবেশী এই পাষাণহৃদয় সন্ত্রাসী ত্রিশ বছর ধরে রাজত্ব চালাচ্ছে। ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর দস্যু হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছে সে। ফ্রান্সে রাজশক্তিকে সে ভয় পায় না, বরং চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। এই লোক সন্ত্রাসী হিসেবে এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি পুলিশও হাল ছেড়ে দিয়েছে। দস্যুদের উচিত শাস্তি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা। কিন্তু অ্যালারিক দ্য গথকে ফাঁসিতে ঝোলানোর কথা আজকাল আর কেউ ভাবতেও সাহস পায় না। সবাই জানে, যার ওপর এই দস্যুর কুনজর পড়বে, তার জীবন শেষ।

পেশায় রাসেল আইনজীবী, দেশ-বিদেশের অনেক খবরই তাঁকে রাখতে হয়। বিশেষ করে, অপরাধজগতের খবর নিয়মিতই সংগ্রহ করেন তিনি। অ্যালারিক দ্য গথের সমস্ত কুকীর্তির কথা তাঁর জানা। তবে ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি যে প্যারিসে এসে এত থাকতে এই দস্যুর সংস্পর্শে তাঁকে আসতে হবে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে!

দস্যুটা এ খবরও রাখে যে ব্যাংকে তাঁর পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড জমা আছে। এই টাকা যে তাঁর নয়, তাঁর নামে গচ্ছিত রাখা হয়েছে পেমব্রোক জমিদারির টাকা, তা-ও কি সে জানে? জানে, এই টাকা কাউন্টেস অ্যামেলিয়ার ইউরোপ ভ্রমণের খরচ মেটানোর জন্য?

রাসেল সিদ্ধান্ত নিলেন, যথেষ্ট বেড়ানো হয়েছে, এবার অ্যামেলিয়াকে নিরাপদে ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নেহাতই ভাগ্যের জোর যে ডেভিডের সঙ্গে অ্যামেলিয়াও দস্যুটার হাতে পড়েনি। তাহলে আর সর্বনাশের কিছু বাকি থাকত না। দস্যু অ্যালারিক হয়তো মুক্তিপণ হিসেবে পেমব্রোকের জমিদারিটাই চেয়ে বসত।

কোনো উপায় নেই, ডেভিডের মুক্তিপণ হিসেবে এই সাড়ে উনপঞ্চাশ হাজার পাউন্ড দস্যুটার হাতে তুলে দিতে হবে। পুলিশের সাহায্য চেয়ে কোনো লাভ নেই। এত দিন ধরতে পারেনি, আজ তারা অ্যালারিককে কীভাবে ধরবে? না, পুলিশে খবর দিয়ে ডেভিডের প্রাণের ওপর কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।

টাকাটা দেওয়ার আগে অ্যামেলিয়াকে কথাটা জানানো দরকার। এ তো তারই টাকা। তবে ভাবী স্বামীকে মুক্ত করে আনার জন্য এই বিপুল অর্থ পানিতে ফেলতে অবশ্যই রাজি হবে সে, এ ব্যাপারে রাসেলের মনে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি জানেন, ডেভিডকে সত্যি খুব ভালোবাসে অ্যামেলিয়া।

চিঠি হাতে নিয়ে ডাইনিংরুমের দিকে এগোলেন রাসেল।

.

নটর ডেমের গির্জায় ঢং ঢং করে ঘন্টা পড়ল। রাত বারোটা। কাছেই শ্যেন নদী, তিন নম্বর ব্রিজের উত্তর প্রান্তে কালো ওভারকোট গায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রাসেল। নির্দিষ্ট জায়গায় ঠিক সময়েই পৌঁছেছেন তিনি, পকেটে কড়কড়ে নোটের বান্ডিল, সব মিলিয়ে সাড়ে উনপঞ্চাশ হাজার পাউন্ড। গভীর রাতে এত টাকা নিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছেন, ভয়ে বুকটা তাঁর কাঁপছে। অ্যালারিক ছাড়াও তো এ শহরে আরও অনেক ডাকাত আছে, এখন যদি তাদের কেউ টাকাটা কেড়ে নিয়ে যায়? তাহলে টাকাও যাবে, ডেভিডও উদ্ধার হবে না।

তবে নিজেকে তিনি যুক্তি দিলেন, অ্যালারিকের লোকজন নিশ্চয়ই দূর থেকে তাঁর ওপর কড়া নজর রাখছে, সম্ভবত সেই যখন তিনি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বেরিয়ে আসেন, তখন থেকে। এ কথা চিন্তা করে ভয় একটু কমল। টাকাটা এখন অ্যালারিকেরই, সেটা অন্য কোনো দস্যু ছিনিয়ে নিলে অ্যালারিকেরই ক্ষতি।

ঘণ্টা থেমে গেছে। রাসেলের সময় কাটছে না। নেই কাজ তো খই ভাজ, তিনি জাহাজের আলো গুনতে শুরু করলেন। প্রতিটি জাহাজের মাস্তুলে একটা করে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ…এগারো… সতেরো…একুশ…

‘গুড ইভিনিং। আজ রাতের আবহাওয়া বেশ সুন্দর, কি বলেন?’ কথাগুলো শুনে চমকে উঠলেন রাসেল, কেউ তাঁর কানের কাছে ফিসফিস করছে। আচ্ছা, অ্যালারিকের লোক তাহলে পৌঁছে গেছে! সাহসী হওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। ভাবলেন, লোকটা কি এখুনি টাকা চাইবে? চাইলে তিনি দিতে আপত্তি করবেন না। আপত্তি করলেই বা কী, কে তাঁর কথায় কান দেবে? তবে টাকার বিনিময়ে ডেভিডকে ফেরত পেতে হবে। ডেভিডকে, আঁদ্রেকেও। কিন্তু কই, লোকটার সঙ্গে তারা কেউ তো নেই। লোকটা একটা প্রশ্ন করেছে, রাসেলের মনে হলো উত্তরে কিছু একটা বলা দরকার। ‘বসন্তের রাত, সুন্দরই তো হবে, ‘ বললেন তিনি।

‘চলুন তাহলে, একটু হাঁটা যাক। বেশি না, বন্ধুর বাড়ি পর্যন্ত। কোন বন্ধুর কথা বলছি বুঝতে পারছেন তো? আজ সকালে যে বন্ধুর চিঠি পেয়েছেন আপনি।’

ও রে, ব্যাটা! দস্যু অ্যালারিক আমার বন্ধু, কেমন? মনে মনে যা-ই ভাবুন রাসেল, মুখে বললেন, ‘তা বেশ তো, চলুন। কিন্তু কতটা হাঁটতে হবে?’

‘না না, বেশি হাঁটতে হবে না, এই ধরুন ঘণ্টা খানেক। তবে কষ্ট হবে না, আপনাকে আমি হাত ধরে নিয়ে যাব। চোখ তো কোনো কাজে আসবে না, হাত না ধরলে যাবেন কীভাবে?’

‘চোখ কোনো কাজে আসবে না? মানে?’ আতঙ্কিত বোধ করলেন রাসেল। লোকটা কি তাঁর চোখ কানা করে দেবে?

‘মানে খুব সহজ। আমরা যাকে দাওয়াত দিই, নিয়ম হলো তাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া।’ কথা শেষ করেই লোকটা রাসেলের চোখে কালো একটা পট্টি বেঁধে দিল, কোনো লাভ নেই বুঝতে পেরে রাসেল বাধা দিলেন না।

শুরু হলো পথচলার কষ্ট ও বিড়ম্বনা। খুবই বাজে রাস্তা। কোথাও গর্ত, কোথাও পড়ে আছে ছোট-বড় পাথর। প্রতি পদে হোঁচট খেয়ে পড়ার অবস্থা। তবে লোকটা তার কথা রেখেছে, বৃদ্ধের হাত ধরেই নিয়ে যাচ্ছে সে। মাঝেমধ্যে সাবধানও করে দিচ্ছে, অবশ্য শুধু যখন নিজে সাবধান হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। অন্ধকার রাত, পথের সবখানে আলোও নেই। হোঁচট খেতে খেতে রাসেলের পা দুটো ব্যথায় অবশ হয়ে এল।

পথটা শেষ হয়েছে এক প্রস্থ সিঁড়ির মাথায়। লোকটা বলল, ‘নামুন।’ তার সঙ্গে পাঁচ ধাপ নামলেন রাসেল। সিঁড়ির নিচে রাস্তা, ঢালু হয়ে নেমে গেছে। এদিকে বাতাস সচল নয়, থেমে আছে। চোখে পট্টি বাঁধা রাসেলের মনে হলো, তাঁকে সম্ভবত কোনো পাতালপুরীতে নামিয়ে আনা হয়েছে।

ফিসফাস আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। চাপা স্বরে কথা বলছে কারা যেন। বোধ হয় হাসাহাসিও করছে। পট্টি ভেদ করে চোখে আলো লাগছে। হঠাৎ থামল লোকটা, রাসেলের চোখের বাঁধন খুলে দিল। আকস্মিক উজ্জ্বল আলো পড়ায় তাঁর চোখজোড়া ধাঁধিয়ে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে চারদিকটা দেখলেন রাসেল। দুদিকে দুটো আলো দেখা যাচ্ছে। পেমব্রোক প্রাসাদের বিশাল হলঘরে বড় সাইজের যে শৌখিন আলো রাসেল দেখেছেন, এ দুটো আলোর দীপ্তি তার চেয়েও যেন বেশি। ঘরের ভেতর যেন দুপুরের সূর্য ঢুকে পড়েছে, তা-ও এক জোড়া। চোখ- ধাঁধানো সেই আলোয় দামি সব ফার্নিচার দেখা যাচ্ছে—হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি এক সেট সোফা, আবলুস কাঠের আলমারি, পালিশ করা ওক কাঠের ভারী কেদারা। কামরার ছাদ ও দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে সোনালি ও নীল রং। মেঝেতে মার্বেল পাথরের চৌকো ফলক গাঁথা, কালো আর সাদা রঙের।

পাতালের গভীরে এরকম বিলাসবহুল আয়োজন দেখে যতটা বিস্মিত হলেন রাসেল, তার চেয়ে অনেক বেশি অবাক হলেন আইভরি দিয়ে তৈরি সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসা মানুষটিকে দেখে। দীর্ঘদেহী ও মধ্যবয়স্ক পুরুষটিকে বোর্বোদের রাজসিংহাসনে বসিয়ে দিলেও চমৎকার মানিয়ে যাবে। চেহারায় যেমন পৌরুষ আর আভিজাত্য আছে, তেমনি মূল্যবান পরিচ্ছেদেও শৌখিনতা ও সুরুচির কোনো অভাব নেই।

পরিবেশটা নিঃসন্দেহে কোনো ফরাসি মার্কুইসের বসতবাটির উপযোগী, তবে এটা যে একজন দস্যুর আস্তানা, তার একটা নমুনাও রাসেলের চোখে ধরা পড়ল। দস্যু সরদারের সামনে, রৌপ্যখচিত কালো আবলুস টুলের ওপর ছোট্ট একটা পিস্তল।

হাত ধরে যে লোকটা এখানে তাঁকে নিয়ে এল, চোখের বাঁধন খুলে দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেছে সে। চারদিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে রাসেল দেখলেন, দস্যু সরদার আর তিনি ছাড়া ঘরে অন্য কেউ নেই।

অদ্ভুত কাণ্ড! দস্যু সরদার আসন ছেড়ে রাসেলকে অভ্যর্থনা জানাল। ‘গুড ইভিনিং, মি. রাসেল। গুড মর্নিং বলাটাই বোধ হয় উচিত, কারণ রাত প্রায় একটা বাজে। বসুন, এই চেয়ারটায় আরাম করে বসুন। গদিমোড়া একটা আসন দেখাল সে, সোফা থেকে বেশি দূরে নয়।

রাসেল বসলেন, বসল দস্যু সরদারও।

‘করমর্দনের জন্য হাতটা আমি বাড়াইনি। ভাববেন না এটা আমার অভব্যতা। সন্দেহ হলো, একটা দস্যুর সঙ্গে আপনি হয়তো হাত মেলাতে না- ও চাইতে পারেন। তবে এসব বাজে প্রসঙ্গ থাক। আগে টাকাটা দিন, তারপর আলোচনা হবে।’

পকেট থেকে টাকার বান্ডিলগুলো বের করলেন রাসেল। জিজ্ঞেস করলেন, ‘লর্ড ডেভিড ও মসিয়ে আঁদ্রেকে দেখছি না যে? ওদের আমি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারব তো?’

‘আপনি যদি চান,’ হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিয়ে বলল দস্যু সরদার। ‘যদি চান অবশ্যই নিয়ে যেতে পারবেন। তবে আমার পরামর্শ হলো, ওদের সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়াটা আপনার উচিত হবে না। ওরা দুজন নিতান্তই অপদার্থ যুবক, আপনার মতো প্রবীণ ভদ্রলোকের উপযুক্ত সঙ্গী হওয়ার যোগ্যতা ওদের নেই। ভোররাতে রাস্তায় ওদের দেখলে পুলিশ আটক করতে পারে। আমার ইচ্ছা নয় ওদের সঙ্গে আপনিও পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। আপনি আপত্তি না করলে আমি বরং আমার লোকদের বলি, তারা ওদের হোটেল বোবোতে পৌঁছে দিয়ে আসুক। চিন্তা করবেন না, আপনার আগেই ওরা হোটেলে পৌঁছে যাবে।’

কথা শেষ করে টুলের ওপর থেকে সোনার তৈরি একটা ঘণ্টা তুলে বাজাল দস্যু সরদার অ্যালারিক। সঙ্গে সঙ্গে পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল পরমাসুন্দরী এক রমণী। তার বাড়ানো হাতে টাকার বান্ডিলগুলো তুলে দিল অ্যালারিক। ‘আমার সেক্রেটারি, আইরিন,’ বলল দস্যু সরদার। ‘আইরিন, রাত একটু বেশি হয়ে গেছে ঠিকই, তবু মেহমানের আপ্যায়নের ব্যবস্থা তো করতে হয়, কী বলো?’

‘দেখছি,’ বলে স্মিত হাসল আইরিন। চলে যাচ্ছিল, কী মনে করে থামল। ‘আমাদের তরুণ দুজন মেহমান। ওদের বিদায় দেওয়ার ব্যবস্থা কি এখুনি করতে হবে?’

‘জিজ্ঞেস করে দেখো, রাতটা ওরা ওখানেই কাটাতে চায় কি না। শোনো, ওয়াইকে ওদের সঙ্গে যেতে নিষেধ করবে। সে তো এইমাত্র ঘুরে এল বাইরে থেকে।

আইরিন চলে যাচ্ছিল, কিন্তু আবার ফিরে এল। ‘সাত নম্বর কামরায় এক্স অপেক্ষা করছে, একটা শিশুকে নিয়ে।’

‘শিশু?’ দস্যু সরদারের ভুরুজোড়া কুঁচকে উঠল। ‘কিন্তু আমি তো নিষেধ করে দিয়েছি যে…আচ্ছা, ঠিক আছে, মি. রাসেলের সঙ্গে কথা শেষ করি আগে, তারপর এক্সের সঙ্গে বোঝাপড়া হবে। তাকে কোথাও যেতে নিষেধ করে দাও। আর বাচ্চাটার ওপর নজর রাখো, তার যেন কোনো কষ্ট না হয়…’

আইরিনের চোখে রহস্যময় দৃষ্টি, তবে আর কিছু না বলে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। মেয়েটির চোখের দৃষ্টি দস্যু সরদার ঠিকই লক্ষ করেছে। রাসেলের দিকে ফিরে বিষণ্ন একটু হাসল সে। বলল, ‘আইরিন অনেক দিন হলো আমার কাছে আছে। পুরোনো দিনের অনেক কথাই সে জানে। আগে আমি শিশুদের দুঃখ-কষ্ট গ্রাহ্য করতাম না। রাগে বা লোভের বশে অনেক শিশুকে কষ্টও দিয়েছি। সে কী রকম কষ্ট, আপনি কল্পনা করতেও শিউরে উঠবেন…. ‘

কথা শেষ করতে পারল না, মাথা নিচু করে বসে থাকল দস্যু সরদার। রাসেল কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। তাই তিনিও কথা বলছেন না। তাঁর মাথায় ব্যাপারটা ঢুকছে না—কী কারণে এখানে তাঁকে বসিয়ে রেখে অপ্রাসঙ্গিক কথা শোনাচ্ছে অ্যালারিক?

একটু পরই ফিরে এল আইরিন। সোনার তৈরি রেকাবে মার্মালেড এনেছে সে। ধূমায়িত কফি, তা-ও সোনার কাপে। ‘অনেক খাবারই বাড়িতে আছে, কিন্তু প্রবীণ মেহমানকে দিতে সাহস হলো না, যদি হজম না হয়! শেরি বা শ্যাম্পেন, যেটাই খেতে চান, সব এই ঘরেই পাবেন।’

‘ঠিক আছে, ওসব আমিই দিতে পারব,’ দস্যু সরদার হাসিমুখে জানাল। আইরিন চলে যেতে রাসেলকে সে বলল, ‘নিন, কফিতে চুমুক দিন। এই ফাঁকে আপনাকে আমি একটা গল্প শোনাই, মি. রাসেল।’

‘গল্প?’ হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন রাসেল।

‘হ্যাঁ, গল্প। শোনানোর গরজটা আমারই। সে জন্যই তো আপনাকে এত কষ্ট দিয়ে ডেকে আনালাম রাতদুপুরে। টাকাটা তো আমার লোক শ্যেন নদীর ধার থেকেই নিয়ে আসতে পারত।’

‘সে কথা ঠিক। কিন্তু আমাকে আপনি কী গল্প শোনাবেন?’ বিস্ময়ের ঘোর এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছেন না রাসেল, তবে সামনে খাবার পড়ে আছে দেখে নিজেকে সংযত রাখাও তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াল। কাঁটা চামচ দিয়ে এক টুকরো মার্মালেড তুলে মুখে ভরলেন তিনি। রাতের ঠান্ডা বাতাসে অনেকক্ষণ হাঁটায় তাঁর খিদে পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

‘কী গল্প, শুনলেই বুঝতে পারবেন,’ শুরু করল দস্যু সরদার অ্যালারিক। ‘প্রথম জীবনে আমি সৎ মানুষ ছিলাম। সৎ কিন্তু গরিব। সমুদ্রের ওপারে, মস্ত এক জমিদারের ব্যক্তিগত বনভূমিতে চাকরি করতাম। ছয় মাইল লম্বা, চার মাইল চওড়া সুরক্ষিত বন। সব মিলিয়ে চব্বিশ বর্গমাইল এলাকা, কাঁটাতারের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা। ভেতরে শুধু হরিণ আর হরিণ, হাজার দুয়েক তো হবেই। অথচ পাহারাদার আমরা মাত্র চব্বিশ জন। আমাদের দায়িত্ব ছিল হরিণ-চোরদের ঠেকানো। ব্যক্তিগত বনভূমি, সেখানে মালিক ছাড়া আর কারও ঢোকার অনুমতি ছিল না। আর হরিণ শিকার যে দণ্ডযোগ্য অপরাধ, সে তো আপনি জানেনই।

‘একদিন হলো কি, আমাদের মাথায় কুবুদ্ধি জাগল। কী একটা উৎসব উপলক্ষে আমরা পাহারাদাররা গোটা চারেক হরিণ মেরে খেয়ে ফেললাম। কপাল খারাপ, ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। স্বভাবতই প্রত্যেকের চাকরি নট হয়ে গেল। কিন্তু আমি ছিলাম গার্ডদের লিডার, শুধু চাকরি হারিয়ে রেহাই পেলাম না। মালিকের নির্দেশে বিশ ঘা চাবুক মারা হলো আমাকে।

‘চাবুকের মার কী জিনিস, কোথাও হয়তো তার বর্ণনা পড়ে থাকবেন আপনি। তবে চাক্ষুষ করেছেন কখনো? না করলে বুঝবেন না ব্যাপারটা কী রকম ভয়াবহ আর বীভৎস হতে পারে। কাত করা একটা কাঠামোর গায়ে উপুড় করে বাঁধা হলো আমাকে। পরনের সমস্ত কাপড়চোপড় খুলে নেওয়া হলো। হাঁটুর পেছন থেকে ঘাড়ের নিচে পর্যন্ত চাবুকের ঘা পড়তে লাগল সপাং সপাং। চামড়ার তৈরি চাবুক, চাবুকদার মাথার ওপর শাঁই শাঁই শব্দে ঘোরায়, তারপর অপরাধীর গায়ের ওপর আছড়ায়। চাবুকের চামড়ায় বিঁধে কাটা মাংস উঠে আসে। শরীরের দুপাশ থেকে ঝরঝর করে রক্ত ঝরে। বেশি চাবুক খেলে অনেকে মরেও যায়।

‘আমার শরীরটা ছিল শক্ত। মরলাম না। তবে ছয় মাস বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি। ধীরে ধীরে সুস্থ হলেও পিঠের দাগগুলো চিরকালের জন্য রয়ে গেল, মুছল না। দেখবেন নাকি? বলেন যদি তো কোট খুলে পিঠটা আপনাকে দেখাতে পারি।’

আঁতকে উঠে বৃদ্ধ রাসেল তাড়াতাড়ি বললেন, ‘না না! দেখানোর দরকার নেই!’

অ্যালারিকের ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি ফুটল। ‘ওগুলো পঁচিশ বছরের পুরোনো চাবুকের দাগ, অথচ আপনি দেখতে ভয় পাচ্ছেন? মনটা দেখা যাচ্ছে আপনার খুবই নরম। আশ্চর্যই বলতে হবে, এই নরম মন নিয়ে পেমব্রোক আর্লদের চাকরি করছেন কীভাবে?’

প্রায় লাফ দিয়ে আসন ত্যাগ করলেন রাসেল। ‘কী বললেন? পেমব্রোকের আর্ল? মানে?’ উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।

একটা হাত তুলে তাঁকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করল দস্যু সরদার। ‘নামটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। এখনি বলার ইচ্ছা ছিল না। বসুন, গল্পটা শুনুন। শুনলে আপনারই লাভ। তা ছাড়া শোনাটা আপনার কর্তব্যের মধ্যেও পড়ে।’

কী কর্তব্য? রাসেল ভাবছেন। আবার আসন গ্রহণ করে নিচু গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, অনেক অজানা কথা জানতে পারছি। পেমব্রোক জমিদারদের বহু পুরোনো উকিল হলেও এসব কথা আমার কানে আগে কখনো আসেনি।’

‘আসার কথাও নয়,’ তিক্ত স্বরে বলল অ্যালারিক। ‘আপনি তো লন্ডনবাসী উকিল, জমিদারের ব্যক্তিগত বনভূমিতে অজ্ঞাতপরিচয় কোনো এক হরিণ- চোর কীভাবে মার খেতে খেতে মরতে বসেছিল, এক হাতুড়ে চিকিৎসক দয়া করে কীভাবে তাকে বাঁচালেন, আপনাকে তা শোনাতে গিয়ে সময় নষ্ট করবে কোন গাধা?’

রাসেল বুঝতে পারছেন, দস্যু সরদার উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।

অ্যালারিক আবার শুরু করল। তার উদ্দেশ্য এখনো পরিষ্কার নয়। সে কি বিবেকের দংশনে অস্থির হয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করছে? নাকি রাসেলের কাছে প্রমাণ করতে চায়, সে কোনো অপরাধ করেনি?

‘এবার সেই হাতুড়ে ডাক্তার প্রসঙ্গ। সব ওষুধই তাঁর নিজের হাতে তৈরি। তা-ও লতা-পাতা, শিকড়, ফুল ইত্যাদি দিয়ে বানানো। ওই ওষুধ লাগিয়ে আমার দগদগে সমস্ত ঘা সারিয়ে ফেললেন তিনি। থাকতেন একটা গাড়িতে, সেই গাড়িতে আমাকেও জায়গা দিলেন। ওটায় শুয়ে ব্যথায় ছটফট করতাম আমি—এক-দু মাস নয়, ছয় মাস।’

‘লোকটা কোথায় থাকত? গাড়িতে?’

‘হ্যাঁ, গাড়িতেই থাকতেন। তাঁর বাড়ি-ঘর কিছুই ছিল না। গাড়িটা এক জানোয়ার টানত, তাতে বসে দেশটার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত চষে বেড়াতেন তিনি। আমার সেই জীবনদাতাটিকে খানিকটা পাগলাটেই বলতে হবে। কী ঘটেছিল, বলি। যেদিন আমাকে চাবুক মারা হয়েছে, ঘটনাচক্রে সেদিনই ওই বনভূমির পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন ওই হাতুড়ে ডাক্তার। আমার সঙ্গে যাদের চাকরি যায়, তারা আমার ক্ষত-বিক্ষত শরীরটা ধরাধরি করে কাঁটাতারের বাইরে এনে ফেলে দিল। দেখতে পেয়ে ওই গ্রাম্য চিকিৎসক তাঁর গাড়িতে তুলে নিলেন আমাকে। গ্রাম্য বলছি, হাতুড়ে বলছি, সে জন্য ধরে নেবেন না যে তাঁর ওপর আমার অশ্রদ্ধা আছে। নামটা যে তাঁর কী, কোনো দিন জানা হয়নি। ছয় মাসের বেশি ছিলাম তাঁর আশ্রয়ে, তাঁকে আমি ডাক্তার বলেই ডাকতাম। আর তিনি আমাকে খোকা বলতেন।’

মাথা ঝাঁকালেন রাসেল। ইতিমধ্যে কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। কেক শেষ হয়েছে অর্ধেকেরও কম।

আমি মরতে মরতে বেঁচে গেছি, এ নিয়ে দেশে নানা রকম গুঞ্জন উঠল। অনেকেই আড়ালে বলতে লাগল, আর্ল অত্যন্ত নিষ্ঠুর কাজ করেছেন। এসব নিশ্চয়ই তাঁর কানে গিয়ে থাকবে। ডাক্তারকে একদিন হুমকি দিলেন তিনি, ‘রোগী নিয়ে দেশ ত্যাগ করো, তা না হলে তোমার বারোটা বাজাব।’

‘আমার জীবনদাতা সম্ভবত নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবেননি, আমিই ছিলাম তাঁর দুশ্চিন্তার কারণ। যা-ই হোক, আমাকে নিয়ে সত্যি সত্যি দেশ ত্যাগ করলেন তিনি। তখন আমি কাজ বলতে হরিণের দেখাশোনা করতে জানি শুধু। পেমব্রোকে হরিণ চুরি করায় কে আমাকে চাকরি দেবে, বলুন? তাই আমাকে নিয়ে ইংল্যান্ড ছাড়লেন ডাক্তার, সোজা চলে এলেন ফ্রান্সে। এরপর খুব বেশি দিন তাঁর সঙ্গে আমি ছিলাম না। তবে ওই কদিনেই কাজ চালানোর মতো ফরাসি ভাষা শিখিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে।’

‘সত্যি, খুব আশ্চর্য মানুষ,’ বললেন রাসেল। ‘তিনি এখন কোথায়?’

‘আমি তাঁর কোনো খবর পাই না। প্রথম দিকে ক্ষীণ একটা যোগাযোগ ছিল। কিন্তু দস্যু হিসেবে আমার নাম যতই ছড়াতে লাগল, তিনিও একটু একটু করে যোগসূত্র ছিঁড়ে ফেললেন। কে জানে, এ দেশেও হয়তো গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি, অবশ্য যদি বেঁচে থাকেন আর কি। আবার এমনও হতে পারে, আমার মতো কোনো অভাগাকে জীবনদান করতে গিয়ে ধনী কোনো লোকের বিরাগভাজন হয়ে এ দেশ থেকেও তাঁকে চলে যেতে হয়েছে।’

শোনার কথা শুনলেন রাসেল। তাঁর তো বলার কিছু নেই। অবশিষ্ট কেকের ওপর পিঁপড়ের দল হামলে পড়েছে, ঘাড় কাত করে সেই দৃশ্যই দেখছেন একমনে।

‘ভূমিকা শেষ, এবার আসল গল্প শুনুন,’ বলল অ্যালারিক দ্য গথ ‘জানেন, গল্পটা আপনাকে শোনানোর কথা কেন মনে হলো আমার? অপদার্থ লর্ড ডেভিড আমার লোকদের হাতে ধরা পড়ল, তাই।’

‘মানে?’

‘ছোকরা একটা ভাঁড়, বুঝলেন। সার্কাসের দলেই ভালো মানাত ওকে।‘ অ্যালারিকের চেহারা থমথম করছে।

রাসেল তর্কে যেতে রাজি নন। তা ছাড়া ডেভিড সম্পর্কে তিনি তো এই একই অভিমত পোষণ করেন।

‘ছোকরা কী সব হাস্যকর কথা বলেছে, তা যদি আপনি শুনতেন।’ হঠাৎ নিজেই হেসে ফেলল অ্যালারিক। ‘সে যেন এখনো পেমব্রোক জমিদারিতেই বসে আছে।’

‘হ্যাঁ, খুবই বোকা,’ মন্তব্য করলেন রাসেল।

‘আমার অবশ্য তাতে কিছু আসে-যায় না। তবে পরিচয় জানার পর আমি খুশিই হই। সাধারণ ইংরেজ তরুণ হলে মুক্তিপণ চাই খুব বেশি হলে পাঁচ শ পাউন্ড। কিন্তু যখন শুনলাম ছেলেটা পেমব্রোক কাউন্টেসের ভাবী স্বামী, অমনি চেয়ে বসলাম পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড। এদিক থেকে দেখলে আমার খুব লাভ হয়েছে। তবে একটু চিন্তাও হচ্ছে।’

রাসেলের চোখে প্রশ্ন।

‘ডেভিড যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে, মেয়েটি কে?’

‘আর্ল গুস্তাভের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী। আর্ল নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেছেন। অ্যামেলিয়া তাঁর নিকটতম জ্ঞাতি কন্যা।’

‘কী বললেন?’ দস্যু সরদার অ্যালারিকের ভারী গলা ঘরের ভেতর গমগম করে উঠল। ‘কে আপনাকে বলল যে আর্ল গুস্তাভ নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেছেন?’

হঠাৎ থতমত খেয়ে গেলেন রাসেল। তাঁর মনে হলো, ভয়ানক কোনো গোপন কথা শুনতে হবে তাঁকে। রীতিমতো ভয় লাগছে তাঁর, আবার প্রবল কৌতূহলও জাগছে। তিনি মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘না, ঠিক নিঃসন্তান বলা যায় না। আর্লের একটা ছেলে ছিল বটে। কিন্তু সে ছেলে হারিয়ে গেছে সেই শিশুকালে। অনেক খুঁজেও কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি। তাই…’

অ্যালারিক কর্কশ গলায় বাধা দিল, ‘তাই আপনারা ধরে নিলেন নিখোঁজ সেই ছেলে মারা গেছে? বাহ্! তারপর কোথাকার কোন এক জ্ঞাতি কন্যাকে ধরে এনে খাঁচায় পোষা ময়নার মতো মানুষ করতে লাগলেন। শুধু কি তা-ই! তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য একটা ভাঁড়কেও জোগাড় করে ফেললেন। ছি, মি. রাসেল! আপনি একজন বিচক্ষণ আইনবিদ হওয়া সত্ত্বেও একবার ভেবে দেখলেন না যে এই আয়োজনের ভেতর কত বড় একটা গলদ রয়েছে? আপনাদের আইন কী বলে? একজন মানুষ নিখোঁজ হলেই কি তাকে মৃত বলে ধরে নেওয়ার বিধান আছে?’

‘সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে ধরে নেওয়ার বিধান আছে,’ বললেন রাসেল। ‘তবে নিখোঁজ মানুষ যদি কোনো দিন ফিরে আসে, ফিরে এসে যদি প্রমাণ করতে পারে যে সে-ই আসল মানুষ…’

‘আমি যদি বলি, নিখোঁজ মানুষটা ফিরে আসবে? যদি বলি, প্রমাণ ও পাওয়া যাবে? শুনুন তাহলে। আমার কাছে সত্যি প্রমাণ আছে। আর্ল গুস্তাভের ছেলেকে আমিই চুরি করেছিলাম। কী নাম ছিল শিশুর? গুইনপেলন বা গিয়েলুম। শরীরের তিন জায়গায় তিনটে জড়ুল আছে। ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর আর্ল বিজ্ঞাপনেও এই তিনটে জঙুলের কথা উল্লেখ করেছিলেন। নিখোঁজ হওয়ার সময় শিশুর পরনে যেসব কাপড়চোপড় ছিল, সবগুলোতে পেমব্রোকদের বংশপরিচয় জোড়া সিংহের ছাপ মারা ছিল। সেসব কাপড়ও আছে। আছে আমার সেই জীবনদাতা ডাক্তারের কাছে…’

রাসেল নিষ্প্রাণ মূর্তির মতো বসে আছেন। চোখের পলক পড়ছে না, তাকিয়ে আছেন অ্যালারিকের দিকে।

‘ছেলেটার কপাল খারাপ। রাগের মাথায় আমি তার এমন ক্ষতি করেছি, সমাজে ফিরে গিয়ে কোনো দিনই সে নিজের যোগ্য আসনটি দাবি করতে পারবে না। তবে তাকে আমি আটকে রাখার পক্ষপাতী নই। আমি চাই, বানরসদৃশ মুখ নিয়ে ইংল্যান্ডের সম্ভ্রান্ত সমাজে চলাফেরা করুক সে। অভিজাত মহলের বহু লোকই যে স্বভাব-চরিত্রে বানরের সমতুল্য, তাতে হয়তো এই সত্যটা দুনিয়ার মানুষ জানার সুযোগ পাবে।’

রাসেল মনে মনে শিউরে উঠলেন। বানরসদৃশ মুখ মানে? অ্যালারিক কী বলতে চায়? কি-না-কি শুনতে হয়, এই ভয়ে জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না তাঁর। তবে অ্যালারিক নিজেই সব ব্যাখ্যা করল।

শিশু গিয়েলুমের মুখে অপারেশন করিয়েছিল অ্যালারিক। উদ্দেশ্য ছিল, বাপের নির্যাতনের বদলা ছেলের ওপর নেওয়া। অপারেশনের ফলে দুর্ভাগা বালক গিয়েলুমের মুখ সাংঘাতিক বিকৃত হয়ে গেছে। সারাক্ষণ যেন বত্ৰিশ পাটি দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে সে। যত চেষ্টাই করুক বেচারা, সে হাসি কোনোভাবেই মুখ থেকে মুছে ফেলতে পারে না। না, একটু ভুল হলো—নিজের ভুল নিজেই সংশোধন করল অ্যালারিক। ইচ্ছাশক্তি যদি প্রচণ্ড হয়, বানরসদৃশ মুখবিশিষ্ট এই অভাগারা মাঝেমধ্যে অল্প সময়ের জন্য হাসিটা মুছে ফেলতে পারে, কিন্তু তখন তাদের আরও ভয়াবহ, আরও বীভৎস লাগে দেখতে।

গলা শুকিয়ে গেছে, রাসেল কোনো রকমে উচ্চারণ করতে পারলেন, ‘সে এখন কোথায়?’

চোখে বিষাদের ছায়া, মাথা নাড়ল অ্যালারিক। ‘এই প্রশ্ন কিছুদিন আগে করলে আপনাকে আমি সঠিক জবাব দিতে পারতাম। কারণ, এক জাদুকর আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে গেছে তাকে। যেখানে লোকসমাগম হয়, সেখানেই সে তাঁবু ফেলে, পাঁচ রকম খেলা দেখায়। ওসব খেলার সঙ্গে বীভৎস চেহারার ছেলেটাকেও হাজির করে দর্শকদের সামনে, তাতে তার দুই পয়সা বেশি আয় হয়। কিন্তু কাল হঠাৎ জাদুকর কাঁদতে কাঁদতে এসে হাজির। কী ব্যাপার? না, ছেলেটা নাকি তার তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।’

‘পালিয়ে গেল? কোথায়?’ রাসেল দ্রুত জানতে চাইলেন। ‘জাদুকর কোন এলাকায় তাঁবু ফেলেছিল?’

‘এল-আর্ডেনের উদ্যানে,’ বলল অ্যালারিক। তারপর জানতে চাইল, ‘এ প্রশ্ন কেন করছেন? আপনি কি তাকে খুঁজে বের করতে চান?’

‘চাইব না?’ অবাক হয়ে অ্যালারিকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন রাসেল।

‘চাওয়াটাই স্বাভাবিক,’ স্বীকার করল অ্যালারিক। ‘আপনার বিবেক নিশ্চয়ই আপনাকে তাগাদা দিচ্ছে—দেখতে সে যতই কুৎসিত হোক, স্বভাব তার যতই পশুর মতো হোক, সে-ই যখন আর্ল গুস্তাভের ছেলে, অবশ্যই তাকে আইন মোতাবেক পেমব্রোক জমিদারি ফিরিয়ে দিতে হবে।’

‘হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন। আমার বিবেক সে কথাই বলছে। কিন্তু আপনার ব্যাপারটা কী? আপনিও কি বিবেকের কথা শুনেই ছেলেটার খবর আমাকে জানালেন?’

খানিক চিন্তা করে অ্যালারিক জবাব দিল, ‘না। সত্যি কথা বলতে কি, আমার মনে সেদিন যে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলেছিল, সেটা এখনো নেভেনি। ভাঁড় ডেভিড যখন আমাকে বলল যে সে-ই হতে যাচ্ছে পেমব্রোকের আর্ল, আমার খুব রাগ হলো। ক্লাউনটার বিদ্যাবুদ্ধি না থাকলেও চেহারা দেখে ভদ্ৰ সন্তানই মনে হয়। একবার আর্ল সেজে বসলে বেমানান ঠেকবে না। অর্থাৎ, পেমব্রোকের নাম শুনে তখন আর সমাজের লোকজন হাসাহাসি করবে না। এর অর্থ, আমার প্রতিহিংসা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কিন্তু ভয়ালদর্শন গিয়েলুমকে যদি আপনার হাতে তুলে দিতে পারি, সেই সঙ্গে প্রমাণ করতে পারি যে সে-ই আর্ল গুস্তাভের ছেলে ও উত্তরাধিকারী, ভাবতে পারেন তাহলে কী ঘটবে?’

ম্লান গলায় রাসেল বললেন, ‘পরলোকে লজ্জায় মাথা নত করবেন আর্ল গুস্তাভ। তাঁর আত্মা নরকযন্ত্রণায় ভুগবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেচারা গিয়েলুমকে খুঁজতে আমি বাধ্য। আপনি বলে দিন কোথায় খুঁজলে আমি তাকে পাব। ফ্রান্সের কোন দিকে সেই উদ্যান?’

‘আপনাকে কষ্ট করে সেখানে যেতে হবে না,’ বলল অ্যালারিক। তার খবর এখানে বসেই জানতে পারব আমি। আমি জানলে আপনিও জানবেন। আপনার লন্ডনের ঠিকানাটা রেখে যান।’

পর্দা সরিয়ে এই সময় ঘরে ঢুকল ওয়াই। সবিনয়ে বলল, ‘ওস্তাদ! এক বুড়ো এসেছে, নাম বলছে উর্সার্স। সে নাকি আপনাকে চেনে, আপনার চিকিৎসা করেছে…’

‘উর্সাস? আমার জীবনদাতা?’ অ্যালারিক একেবারে লাফিয়ে উঠল। ‘এত দিন পর! উসাস! ও রে, তাঁকে তোরা কোথায় পেলি? কোথায় তিনি?’

‘আমি এখানে, দস্যু সরদার অ্যালারিক! সত্যি খুশি হলাম, এত বছর পরও সেই হাতুড়ে ডাক্তারকে তুমি মনে রেখেছ তাহলে!

‘কী বলছেন আপনি, ডাক্তার! আপনাকে কি আমি ভুলতে পারি? জীবনদাতাকে কেউ কোনো দিন ভোলে?’ ছুটে এসে উসাসকে বুকে জড়িয়ে ধরল অ্যালারিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *