দ্য ম্যান হু লাফস – ২

সমুদ্র চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে দেশটাকে। নাম তার ইংল্যান্ড। আসলে প্রকাণ্ড একটা দ্বীপ। এ দেশের আবহাওয়া বড় বিচিত্র, বেশির ভাগ সময় কুয়াশায় ঢাকা থাকে। দেশটার ভেতর দিকে, কিঞ্চার্লি ও পেমব্রোক এলাকায়, এক অভিজাত জমিদারের প্রাসাদ আছে। গ্রাম্য এলাকা, কিন্তু প্রাসাদটা বিশাল। আর্ল হলো জমিদারের উপাধি। বিজয়ী বীর উইলিয়ামের আমল থেকেই ব্রিটিশ অভিজাত সমাজে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছেন তাঁরা।

তবে পেমব্রোক পরিবারে আপাতত কোনো আর্ল নেই। সাবেক আর্লের একটা ছেলে হয়েছিল বটে, ছোট থাকতেই হারিয়ে গেছে। ইংল্যান্ডের পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত দক্ষ, কিন্তু তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেও শিশুটিকে খুঁজে বের করতে পারেনি। সন্তানকে হারিয়ে সবচেয়ে বড় আঘাত পেলেন জননী, অর্থাৎ আর্লের স্ত্রী। শোকে ও হতাশায় মুষড়ে পড়লেন তিনি। কিছুকাল পর ভাঙা মন নিয়ে মারা গেলেন।

সময় ফুরিয়ে এল আর্ল গুস্তাভেরও। প্রথমে হারালেন একমাত্র শিশুসন্তানকে, তারপর জীবনসঙ্গিনী কাউন্টেসও তাঁকে ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন, ফলে জীবনের প্রতি তাঁর আর কোনো মায়া বা মোহ থাকল না। অযত্ন আর অবহেলায় স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল তাঁর। ভদ্রলোক উপলব্ধি করলেন, পৃথিবী নামক রঙ্গমঞ্চে জীবন নামক নাটকে এত দিন যে অভিনয় তিনি করেছেন, এবার তার সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। অনেক তো হলো, আর ভালো লাগে না। এখন বিদায় নিতে পারলেই খুশি হন।

নিঃসন্তান তিনি। তিন কুলে আপনজন বলতেও কেউ নেই। তিনি মারা গেলে তাঁর বিপুল সয়সম্পত্তির মালিক হবে এক জ্ঞাতি কন্যা। সেই কন্যাও আবার নিতান্ত শিশু। আর্লের নিখোঁজ সন্তানের চেয়েও বয়সে দুই বছরের ছোট

সে। নাম অ্যামেলিয়া। বংশ ও পরিবারের প্রতি কর্তব্য আছে আর্লের, সেটা তাঁকে অবশ্যই পালন করতে হবে। মেয়েটিকে নিজের প্রাসাদে আনালেন তিনি। এখন থেকে এখানেই সে মানুষ হবে।

অ্যামেলিয়ার সঙ্গে তার মা-ও এল। বাবা বেঁচে নেই। মেয়েটিরও কপাল, প্রাসাদে আসার কিছুদিন পরই তার মা মারা গেল। আর্ল গুস্তাভ তখনো বেঁচে রয়েছেন।

আর্লের ঘনিষ্ঠ বন্ধু একজন বিখ্যাত আইনজীবী। নাম রাসেল। উইলে এই আইনজীবী রাসেলকেই অ্যামেলিয়ার অভিভাবক করা হলো। উইলে আরও বলা হলো, জমিদারির সমস্ত সম্পত্তিও রাসেল দেখাশোনা করবেন। এর কিছুদিন পর আর্ল গুস্তাভও দেহ ত্যাগ করলেন।

শোক বা দুঃখ করার তেমন কেউ নেই। আইনজীবী রাসেলের তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনায় বিশাল পেমব্রোক জমিদারির একচ্ছত্র অধিকারিণী হলো অ্যামেলিয়া। অথচ তার বয়স মাত্র দশ বছর।

আর্ল গুস্তাভ এক মহিলাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন, তিনিই অ্যামেলিয়াকে দেখেশুনে রাখবেন, লেখাপড়া শিখিয়ে তাকে সম্ভ্রান্ত সমাজে চলাফেরার উপযোগী করে তুলবেন। মহিলা খুব যোগ্য, সবাই তাঁর প্রখর দায়িত্ববোধের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অ্যামেলিয়াও তাঁকে খুব পছন্দ করে।

কিন্তু এই মহিলা প্রাসাদে বেশি দিন টিকতে পারলেন না। তাঁর বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু হলো। অদৃশ্য হাত কলকাঠি নাড়ছে, মহিলার নামে মিথ্যা অপবাদ ছড়াচ্ছে। দিনে দিনে অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে গেল। বাধ্য হয়ে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে একদিন পেমব্রোক ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। যাওয়ার সময় নিজে তো কাঁদলেনই, তাঁকে হারিয়ে অ্যামেলিয়াও কাঁদতে লাগল।

আরেক মহিলা এলেন, নতুন তত্ত্বাবধায়িকা। নাম রাচেল। রাচেল নিজেও অভিজাত পরিবারের ঘরনি। স্বামীর উপাধি লর্ড। তবে সম্পত্তি বা টাকাপয়সা কিছুই লর্ডের ছিল না। লর্ড মারা গেছেন। মারা গেছেন একটা পুত্রসন্তান রেখে

রাচেলের এই ছেলের নাম ডেভিড। বাপের লর্ড উপাধি ছিল, সেই সূত্রে ছেলে ডেভিডও লর্ড হিসেবে পরিচিতি পায়। লোকজন তাকে লর্ড ডেভিড বলেই ডাকে।

কেউ কিন্তু জানল না কোন সূত্র ধরে জমিহীনা এই জমিদারনি অ্যামেলিয়ার তত্ত্বাবধায়িকা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। লোকজন অবশ্য নানা রকম কথা রটাতে শুরু করল। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জড়ালো একটা গুজব—রাসেল আইনজীবী হিসেবে বিচক্ষণ ও অভিভাবক হিসেবে দায়িত্বসচেতন হলেও, তাঁর চরিত্রে একটা দুর্বলতা আছে। সে দুর্বলতা ডেভিডের মা ওই রাচেলকে ঘিরেই। রাচেল তাঁর এই দুর্বলতার সুযোগ পুরোপুরিই গ্রহণ করেছেন। রাসেলকে পটিয়ে-পাটিয়ে পেমব্রোক প্রাসাদে নিজের ও ছেলের স্বার্থে নিরাপদ ও আরামদায়ক চাকরিটা বাগিয়ে নিয়েছেন মহিলা।

অ্যামেলিয়াকে শিক্ষা দিয়ে মানুষ করবেন, সে যোগ্যতা রাচেলের নেই। তাঁর নিজের লেখাপড়াই খুব বেশি নয়। তবে আদব-কায়দা ভালোই শেখাতে পারবেন। কীভাবে সমাজে চলাফেরা করতে হয়, অভিজ্ঞতা থেকে সেটা তাঁর জানা আছে। প্রসাধন ব্যবহারের পদ্ধতি, কোন অনুষ্ঠানে কী রকম সাজগোজ করতে হবে, কাকে কী বলে সম্মান দেখাতে হয় ইত্যাদি দ্রুত শিখে ফেলল অ্যামেলিয়া। রাচেল তাকে গানবাজনা, লেখাপড়া বা চারুকলা শেখানোর কোনো চেষ্টাই করলেন না। সে যোগ্যতা তাঁর নেই।

উপযুক্ত শিক্ষার অভাব অ্যামেলিয়াকে করে তুলল খেয়ালি, বিলাসিনী ও দায়িত্বহীনা এক কিশোরী। দুনিয়ার ভালো কিছুর ওপর তার আকর্ষণ নেই। ভোগবিলাসের জন্য যেটা প্রয়োজন, সেটাই শুধু টানে তাকে। তার ভেতরে না সৃষ্টি হলো নীতিজ্ঞান, না তৈরি হলো শালীনতার গণ্ডি সম্পর্কে সচেতনতা। কাউন্টেস অ্যামেলিয়া হয়ে উঠল অদ্ভুত এক চরিত্র।

ওদিকে ডেভিডেরও বয়স বাড়ছে। অ্যামেলিয়ার চেয়ে দু-তিন বছরের বড় সে। এই যুবক অসম্ভব স্বার্থপর, নিজের ভালোটা ছাড়া আর কিছু বুঝতে চায় না। সে অসম্ভব সুদর্শন আর শৌখিনও বটে। বিনা বাধায় যতক্ষণ খুশি অ্যামেলিয়ার সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ আছে তার, সে সুযোগের সদ্ব্যবহারও করে পুরো মাত্রায়। তার মন্দ রুচি আর মায়ের প্ররোচনা, অ্যামেলিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে উৎসাহ দেয় তাকে। ছেলের কানে ফিসফিস করেন মা রাচেল, ‘তুই তো নিঃস্ব, এক কানাকড়িও নেই তোর। কিন্তু অ্যামেলিয়া বিপুল ধন-সম্পদের মালিক। তার মুঠোয় রাজার ঐশ্বর্য। অ্যামেলিয়া আর তার ধন-সম্পদ দখল করার সুযোগ একা শুধু তোরই আছে। সে সুযোগ কাজে লাগা। আমি মা, তোর ভালো চাই—আমার কথামতো না চললে তোর কপালে খারাবি আছে।’

মনে মনে মায়ের কথা ষোলো আনা সমর্থন করে ডেভিড। অ্যামেলিয়ার মন জয় করার কাজটা আরও জোরেশোরে শুরু করে সে। নিজেকে অ্যামেলিয়ার কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার কোনো চেষ্টাই বাদ দেয় না। স্বার্থ উদ্ধার হবে জানলে লোকের রুচিতে বাধে এমন কাজও আগ্রহ নিয়ে করে, এ ক্ষেত্রে ডেভিডের আগ্রহ কয়েক গুণ বেশি, কারণ স্বার্থ উদ্ধারের পাশাপাশি অ্যামেলিয়াকে নিয়ে ফুর্তি করারও সুযোগ রয়েছে তার।

দিনে দিনে ওদের বয়স বাড়তে লাগল, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রীতি ও ঘনিষ্ঠতার মাত্রাও। ব্যাপারটা সবাই লক্ষ করে। একপর্যায়ে তারা ধরে নিল, সাবালক হওয়ামাত্র পরস্পরকে বিয়ে করবে ওরা। তার আর খুব বেশি দেরিও নেই। মাত্র এক বছর পরই আঠারোয় পা দেবে অ্যামেলিয়া, ডেভিড পা দেবে একুশে।

বিয়ে হতে এক বছর দেরি থাকলেও, সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যে পেমব্রোকের ভাবী আর্ল হিসেবে ডেভিডকে একরকম মেনেই নিয়েছে। সব ঠিকঠাকমতোই চলছে। মাঝেমধ্যে শুধু অ্যামেলিয়ার অভিভাবক আইনজীবী রাসেল লেডি রাচেলকে আভাসে একটা কথা বলে সতর্ক করে দেন। তা হলো, কী যেন একটা ঝামেলা আছে আর্ল গুস্তাভের উইলে। ঝামেলা মানে, অসুবিধাজনক একটা শর্ত। লেডি রাচেল শর্তটা সম্পর্কে বিশদ জানতে চান। কিন্তু রাসেল এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘না না, বিচলিত হওয়ার মতো কিছু নয়। যে পরিস্থিতিতে শর্ত পূরণের প্রশ্নটা উঠবে, সে পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার কোনো সম্ভাবনাই এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না।’

রাসেল সব সময় লেডি রাচেলের মন জুগিয়ে চলেন। শুধু এই একটি বিষয়ে তিনি মন খুলে কথা বলতে রাজি নন। কেন, কী কারণ? ভদ্রলোক কি এত দিন পর বিবেকের দংশন অনুভব করছেন? বাইরে থেকে সবাই দেখছে, বন্ধু আর্ল গুস্তাভ বিশ্বাস করে যে দায়িত্ব তাঁকে দিয়ে গেছেন, সে বিশ্বাসের মর্যাদা পুরোপুরি রক্ষা করেছেন তিনি। দীর্ঘ কয়েক বছর হয়ে গেল জমিদারির ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ রেখেছেন, কোনো রকম ক্ষতি হতে দেননি। একমাত্র উত্তরাধিকারিণী অ্যামেলিয়ার ওপরও তাঁর খেয়াল আছে, লক্ষ রেখেছেন কোনো অমঙ্গল যেন তাকে স্পর্শ না করে। এই তো সেদিনই পেমব্রোকে গিয়েছিলেন তিনি, অ্যামেলিয়া কেমন আছে দেখে এসেছেন।

চেরিগাছের মতো সতেজ ও ঋজু, কিশোরী অ্যামেলিয়া সত্যি মুগ্ধ করেছে বৃদ্ধ রাসেলকে। মেয়েটি ভারি ছটফটে, দেখতেও যেন ডানাকাটা পরি। কিন্তু প্রাণচাঞ্চল্য আর রূপ-সৌন্দর্যই সব নয়। বিশেষ করে, একজন কাউন্টেসের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার শিক্ষাদীক্ষা। অথচ অ্যামেলিয়ার মধ্যে সুশিক্ষার কোনো প্রতিফলনই তিনি দেখতে পাননি। বরং তার আচরণে অশিক্ষার যে পরিচয় পেয়েছেন, লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেছে তাঁর। মনে মনে নিজেকে অপরাধী ভেবেছেন। বন্ধু গুস্তাভের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়ে গেল না তো?

একা অ্যামেলিয়াকে নয়, ডেভিডকেও দেখে এসেছেন রাসেল। ডেভিডের মা লেডি রাচেল ছেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ছেলের গুণের বর্ণনা দেওয়ার সময় গর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তাঁর চোখ-মুখ। কিন্তু বৃদ্ধ রাসেল ডেভিডের আচরণে খুশি হতে পারেননি। স্থুল হাসি-তামাশা আর ভোগবিলাসে যার সময় কাটে, সে হবে পেমব্রোকের আর্ল? ঠেকানোর কোনো পথ নেই, হবেই বলে মনে হচ্ছে। লেডি রাচেল কয়েক বছর ধরে ভিত তৈরি করেছেন। সে ভিতের ওপর এখন ওই নড়বড়ে ইমারত ছাড়া অন্য কিছু তৈরি করার চেষ্টা সফল হবে না। সে চেষ্টা করা হলে তিক্ততাই শুধু বাড়বে।

বৃদ্ধ রাসেল ভয় পাচ্ছেন, বন্ধু আর্ল গুস্তাভ পরলোক থেকে তাঁকে অভিশাপ দিচ্ছেন না তো? মন বলছে, অবশ্যই দিচ্ছেন। এই অভিশাপ তো তাঁর প্রাপ্যই। অ্যামেলিয়ার উপযুক্ত শিক্ষা না পাওয়ার জন্য তিনিই তো দায়ী। আল গুস্তাভ যে শিক্ষিকাকে রেখে গিয়েছিলেন, রাসেল তাঁকে বিদায় করে না দিলে, প্রাসাদে ডেকে এনে অ্যামেলিয়ার দায়িত্ব রাচেলের হাতে তুলে না দিলে মেয়েটি এরকম অপদার্থ হতে পারত না।

আরেক অপদার্থ ওই ডেভিড। লেডি রাচেলকে তিনি পেমব্রোক প্রাসাদে আশ্রয় দিয়েছিলেন বলেই ডেভিড আজ অ্যামেলিয়ার স্বামী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু তাকে কি কোনো অর্থেই সুপাত্র বলা যায়? অসম্ভব, প্ৰশ্নই ওঠে না। জমিদারি হাতে পেতে যা দেরি, দুদিনেই সমস্ত ধন-সম্পদ আর বিষয়- আশয় ধ্বংস করে ফেলবে। ডেভিডের হাতে পড়লে অ্যামেলিয়ারও দুঃখ- কষ্টের কোনো সীমা থাকবে না।

ডেভিড আর অ্যামেলিয়া নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা ইউরোপে বেড়াতে যাবে। ওদের যুক্তি হলো, সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের সন্তানেরা যদি মহাদেশের সব কটা রাজধানী আর বিলাসবহুল পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় বেড়িয়ে না আসে, তাহলে তাদের শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মাত্র এক বছর পর বিয়ে হবে ওদের, হানিমুন উপলক্ষে তখন তো বিদেশে কোথাও যেতেই হবে, তাই না? তখন কোথায় যাওয়াটা ঠিক হবে, সরেজমিনে দেখে এখনই তা স্থির করার সময়। বার্লিন, নাকি প্যারিস? আল্পসের সানুদেশ, নাকি রাইনের তীর? লেক লুসার্ন, নাকি মন্টিকার্লো? প্রতিটি জায়গাকেই তো পর্যটকদের স্বর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখন দেখতে হবে এগুলোর মধ্যে কোন স্বর্গটি ডেভিড ও অ্যামেলিয়ার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়। সময় থাকতে পরখ করে দেখে আসার মধ্যে কোনো ক্ষতি নেই।

লেডি রাচেলকে প্রস্তাব দিল ডেভিড। অনুমোদন পেতে কোনো সমস্যা হলো না। ছেলের সব বিলাসিতাতেই সমর্থন আছে মায়ের, বিশেষ করে তা যদি হয় অ্যামেলিয়াকে ঘিরে। তবে প্রস্তাবে তিনি একটা সংশোধনী আনলেন। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কোনো অভিভাবক ছাড়াই বিদেশে বেড়াতে যাবে, এটা তিনি মেনে নিতে পারেন না। বললেন, তিনিও ওদের সঙ্গে থাকবেন। আসল কথা, এই সুযোগে বেড়ানোর আনন্দ থেকে লেডি রাচেল নিজেকে বঞ্চিত করতে রাজি নন।

বাকি থাকল জমিদারির তত্ত্বাবধায়ক রাসেলের অনুমতি আদায়। প্রস্তাব শুনে তিনি আপত্তি করলেন না। বেড়াতে যাওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই। তবে যা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, লেডি রাচেলের মতো তিনিও একটা শর্ত জুড়ে দিলেন। শর্তটা হলো, ওদের সঙ্গে তিনিও যাবেন। না, অভিভাবক হিসেবে নয়; সঙ্গী হিসেবে। নিজের যেতে চাওয়ার পেছনে আইনজীবী ভদ্রলোকের যুক্তি হলো, সারাটা জীবন মক্কেলদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে সমস্ত জীবনীশক্তি ক্ষয় করে ফেলেছেন। জীবন হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যহীন। নিত্যদিনের একঘেয়ে কাজ ফেলে কয়েকটা দিন দূরে সরে থাকতে পারলে জীবনযুদ্ধে লড়াই করার নতুন শক্তি ফিরে পাবেন। শরীর আর মনের এই উপকার করার সুযোগ ছাড়বেন কেন। অবশ্যই যাবেন, তবে নিজের খরচে। জমিদারি তো অ্যামেলিয়ার, সেখান থেকে একটা পয়সাও নেবেন না। তাতে বিবেকের অনুমোদন নেই।

সঙ্গে উকিলও যাবেন, শুনে ডেভিডের আনন্দ অর্ধেকটাই মাটি হয়ে গেল। উৎসাহে রীতিমতো ভাটা পড়ল তার। জননী লেডি রাচেল উকিল রাসেলের প্রশংসায় যতই পঞ্চমুখ হন না কেন, ডেভিড কিন্তু ভদ্রলোককে সহ্য করতে পারে না। মনে মনে সে ভেবেই রেখেছে, সুযোগ ও সময়মতো অ্যামেলিয়ার এই অভিভাবককে ছেঁড়া জুতার মতোই ছুড়ে ফেলে দেবে। তবে সে দূরদর্শী, মগজে ঘিলুও আছে। মনে মনে যা-ই ভেবে থাকুক, কথাটা কাউকে জানায়নি। অ্যামেলিয়াকে তো নয়ই, এমনকি জননীকেও নয়।

বৃদ্ধ রাসেলের বিরুদ্ধে কিছু করা বা বলার সময় এখনো আসেনি, এটা ভালোই বোঝে ডেভিড। অগত্যা সে চুপ করে থাকল। শুরু হলো ইউরোপ ভ্রমণের প্রস্তুতি। সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে একদিন তারা বেরিয়ে পড়ল। দুজন প্রবীণ, দুজন তরুণ। প্রত্যেকের সঙ্গে থাকছে একজন করে দাস বা দাসী। আগেই ঠিক করা হয়েছে, প্যারিসে পৌঁছালেই অ্যামেলিয়াকে নাচ- গান শেখানোর জন্য এক ফরাসি মহিলা দলে যোগ দেবে। ডেভিডেরও খুব ইচ্ছা তলোয়ার চালানো শিখবে। তাই তার জন্যও অসিবিদ্যায় পারদর্শী একজন শিক্ষকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সে-ও তো অদূর ভবিষ্যতে পেমব্রোকের আর্ল হতে যাচ্ছে, তাই না? কাজেই তলোয়ার চালানো না শিখলে তার চলবে কেন? অভিজাত পরিবারের তরুণদের তো ডুয়েল লড়ার প্রয়োজন প্রায়ই হয়।

রওনা হওয়ার শুরুতে দলে লোকসংখ্যা আট থাকলেও প্যারিসে পৌছানোর পর সেটা বেড়ে দাঁড়াল দশে। লন্ডন ত্যাগ করার আগেই কাগজে বিজ্ঞাপন ছাপার ব্যবস্থা করেছিলেন রাসেল। প্যারিসের যে হোটেলে তাঁরা উঠলেন, সেখানেই নির্দিষ্ট একটা দিনে ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা হলো। তাতে দুই ঘণ্টা সময় লাগল। মাদমোয়াজেল বিয়াঁকা ও মসিয়ে আঁদ্রে শিক্ষিকা ও শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেল। এরা ফরাসি হলেও কাজ চালানোর মতো ইংরেজি জানে। তবে ইংরেজি বলার সময় প্রচুর ফরাসি শব্দ ব্যবহার করে, তা না হলে মনের ভাব ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারে না।

ওঁরা উঠেছেন হোটেল বোর্বোয়। পর্যটকেরা এখানে রাজকীয় বিলাসিতা উপভোগ করছেন। অ্যামেলিয়া বা ডেভিড, এর আগে কেউই প্যারিসে আসেনি। তবে জানে, ইউরোপীয় সংস্কৃতির তীর্থভূমি প্যারিসকেই বলা হয়। বেশ কিছুদিন থাকা হবে এখানে। ঠিক হলো, সময়ের অপচয় না করে আজ থেকেই অ্যামেলিয়া নাচ-গান আর ডেভিড অস্ত্র চালনা শিখবে। সিদ্ধান্ত হলো, বিয়াঁকা ও আঁদ্রে কালবিলম্ব না করে হোটেল বোর্রোতেই ঠাঁই নেবে।

যেকোনো জিনিস শিখতে হলে খাটতে হয়। অ্যামেলিয়া আর ডেভিডের বেলায় সমস্যা দেখা দিল, একটু পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে উঠছে তারা। বিয়াঁকা আর আঁদ্রে চিন্তা করল, ছাত্রছাত্রীকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বেশি খাটালে তার পরিণতি ভালো না-ও হতে পারে। ওরাই তো বেতন দেওয়ার মালিক, শেখার জন্য বেশি চাপ দিলে চাকরি নট হয়ে যাওয়ার ভয় আছে।

ফলে খুব অল্প অল্প শিখছে ওরা। অবশ্য অন্যদিকে খুব দ্রুত উন্নতি ঘটছে। সম্ভ্রান্ত সমাজে মেলামেশা পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। প্রতিদিনই ঘুরে ঘুরে দেখা হচ্ছে অপেরা ও সার্কাস। তারই ফাঁকে এদিক-সেদিক বেড়ানোও চলছে। রাতগুলো ওদের জন্য দারুণ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠল। নাইট পার্টিতে যেতে না পারলে সারা দিন ধরে উপভোগ করা সমস্ত মজা তুচ্ছ ও নগণ্য বলে মনে হয়। সেখানে অভিজাত সমাজের তরুণ-তরুণীরা সমবেত নৃত্যানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে, নাচ না জেনেও তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে যাওয়া চাই অ্যামেলিয়া আর ডেভিডের।

ওদের আবার একজন করে উপদেষ্টা জুটেছে। অ্যামেলিয়ার বিয়াঁকা, ডেভিডের আঁদ্রে। আনন্দের সন্ধানে সবাই যে সব সময় দল বেঁধে বেরোয়, তা নয়। কখনো হয়তো অ্যামেলিয়াকে নিয়ে বেরোয় বিয়াঁকা, আর ডেভিডকে নিয়ে আঁদ্রে। শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীর বয়সের ব্যবধান খুব বেশি নয়, কাজেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে কোনো বাধা নেই। জুটি দুটো বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে এরই মধ্যে।

লেডি রাচেল আর উকিল মহোদয়? আজকাল তাঁরাও একসঙ্গে বেড়াতে বেরোচ্ছেন। সাধারণত পার্কেই যান, সেখানে বসে সম্ভবত ফেলে আসা দিনগুলোর মধুর স্মৃতি রোমন্থন করেন। অন্তত এটুকু বলা যায় যে তাঁদেরও সময় ভালোই কাটছে।

ওদের একটানা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে হঠাৎ একটা ছন্দপতন ঘটল। আঁদ্রের সঙ্গে বেরিয়েছে ডেভিড, ইচ্ছা, একটা সন্ধ্যাকালীন জলসায় ঘণ্টা কয়েক কাটাবে। বেরোনোর আগে অ্যামেলিয়ার সম্মতি নিয়েছে ডেভিড। অ্যামেলিয়া আপত্তি করেনি, কারণ বিয়াকার সঙ্গে তারও প্রমোদভ্রমণে যাওয়ার কথা ঠিক হয়ে আছে।

ডেভিড আর আঁদ্রে বিখ্যাত ক্যাসিনো ভ্যালয়ে ঢুকল। এখানে মনোরঞ্জনের এত সব ব্যবস্থা আছে যে কোথা দিয়ে সময় কেটে যাবে ঠাওর করা মুশকিল। ডেভিডের আজই প্রথম কোনো ক্যাসিনোয় প্রবেশ। আর আঁদ্রে প্যারিসের বাসিন্দা হলেও আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে ক্যাসিনোর মতো ব্যয়বহুল আড্ডায় সে-ও আগে কখনো ঢোকেনি। অর্থাৎ, দুজনের জন্যই ক্যাসিনোর এই নৈশ আসর নতুন অভিজ্ঞতা। মঞ্চে নৃত্যানুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর সময় সম্পর্কে ওদের কোনো হুঁশজ্ঞান থাকল না।

আজকের মতো অনুষ্ঠান শেষ হতে ওদের সংবিৎ ফিরল। ইতিমধ্যে মাঝরাত পার হয়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, এত রাতে হোটেলে ফেরা যায় কীভাবে? আঁদ্রে বলল, ‘হেঁটে ফেরা নিরাপদ নয়। রাস্তায় পুলিশ টহল দিলেও সংখ্যায় তারা খুব কম। এমন কোনো রাত নেই, রাহাজানি বা খুনখারাবি হচ্ছে না। তা ছাড়া ডেভিড, তুমি বিদেশি—গুন্ডা-মস্তানেরা কীভাবে যেন দূর থেকে বিদেশি ট্যুরিস্টদের গন্ধ পেয়ে যায়।’

ডেভিড বলল, ‘কিন্তু গাড়ির তো কোনো অভাব দেখছি না। চলুন, একটায় উঠে বসি। হোটেল বোর্বো কাছে নয়, হাঁটতে হলে রাত কাবার হয়ে যাবে।’ দ্বিধা সত্ত্বেও একটা গাড়িতে চলল আঁদ্রে। কোচম্যানকে ঠিকানা বলল, হোটেল বোবো।’ কোচম্যান লোকটা এমন পাশ ফিরে বসেছে যে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না, গাঢ় ছায়ায় ঢাকা। তবে হোটেলের নাম শুনে মাথা ঝাঁকাল সে।

আঁদ্রে বা ডেভিড মঞ্চে উঠে নাচেনি। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উঁচু মঞ্চের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকাও কম ক্লান্তিকর নয়। গাড়িতে বসেই চোখ বুজল তারা। বোর্বো নামকরা হোটেল, কোচম্যান রাস্তা চিনে সেখানে পৌঁছাতে পারবে না, এ প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া লোকটা তো হোটেলের নাম শুনে মাথা ঝাঁকিয়েছে।

দুজনই চোখ বুজে ঝিমাচ্ছিল, তা না হলে ঠিকই বুঝতে পারত যে গাড়ি হোটেলের দিকে যাচ্ছে না। হোটেল বোর্বো থেকে ক্যাসিনো ভ্যালয়ে যাওয়ার প্রথম রাস্তা হলো অ্যাভিনিউ গ্রাঁ মনার্ক, ওটা পার হয়ে পেলস দ্য লা কনকর্ডে আসতে হবে, তারপর ডান দিকে বাঁক নিলে পাওয়া যাবে রু দ্য লা হেনরি কোয়েত। ব্যস, সব মিলিয়ে এই তো মাত্র তিনটে রাস্তা। প্রতিটি রাস্তাই ঝকঝক করছে, আয়নার মতো মসৃণ, গাড়ি যেন বরফের ওপর হড়কে যায়। কিন্তু এই গাড়ি এমন করছে কেন? এত ঝাঁকি খাওয়ার কী কারণ? কোচম্যান কি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়েছে? প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টকে একটুর জন্য এড়িয়ে যাচ্ছে ওরা, ভাগ্যের জোরে সংঘর্ষ ঘটছে না। আঁদ্রে একবার চোখ খুলে ভাবল, কোচম্যানকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু পরমুহূর্তে তন্দ্রায় আবার আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল সে। ডেভিডেরও ইচ্ছা হলো, কোচম্যানকে কড়া ধমক লাগায়। কিন্তু তারপর আর কিছু মনে থাকল না। দুজনই ঘুমিয়ে পড়েছে। গাড়ি আগের মতোই ঝাঁকি খেতে খেতে এগোচ্ছে।

রাস্তাটা সরু। চারদিকে আবর্জনা। এখানে-সেখানে ছোট-বড় গর্ত। ওরা একবার চোখ মেলে ভালো করে তাকালেই বুঝতে পারত কোচম্যান হোটেলের দিকে যাচ্ছে না।

পরদিন হোটেল বোর্বোর নাশতার টেবিলে ডেভিডের জন্য অপেক্ষা করছে অ্যামেলিয়া। কিন্তু কোথায় ডেভিড? এ নিয়ে দু-একটা রসিকতা করল বিয়াঁকা, ‘হয়তো অনেক রাতে ফিরেছে—ওই আঁদ্রে আর ডেভিড। শিক্ষক তো নয়, একটা শনি; মহামান্য আর্লকে কোন বিপথে নিয়ে যাচ্ছে, কে জানে!’ অ্যামেলিয়াকে খুশি করার জন্য ডেভিডকে এরই মধ্যে আর্ল বলে সম্বোধন করে সে, তোষামোদ করতে খুবই পটু।

.

ভুরু নাচিয়ে অ্যামেলিয়া জবাব দিল, ‘আর আমি যে শিক্ষিকাকে পেয়েছি, তাকে দেবদূতী বললেই হয়, তাই না? মাত্র এই কদিনে সাত-সাতটা স্বৰ্গ দেখিয়ে এনেছে আমাকে—অলিম্পাস, ভালহাল্লা, বৈকুণ্ঠ, বেহেশত আর…ইডেন, হেভেন? প্যারাডাইস?’

খিলখিল করে হেসে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিল বিয়াঁকা, তাকে বাধা দিয়ে উকিল সাহেব রাসেল বললেন, ‘ফিরতে যতই রাত হোক, এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকার তো কথা নয়। আমার নির্দেশে চাকরটা একবার ওদের দরজায় নক করেও এসেছে…’

লেডি রাচেলকে উদ্বিগ্ন দেখাল। ‘আমি না হয় ডেভিডের ঘরে নিজেই একবার যাই। ভাবছি, অসুখবিসুখ করল না তো?’

‘দুজনেরই?’ রাসেলের গলায় অবিশ্বাস, খানিকটা বিদ্রূপও।

হালকা ব্যঙ্গটুকু লেডি রাচেল গায়ে মাখলেন না। শান্ত পদক্ষেপে করিডরে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

চাকর ছেলেটা, চার্লি, তার মনিব রাসেলের পেছনে এসে দাঁড়াল। ঝুঁকল সে, মনিবের কানে ফিসফিস করল, এক লোক আপনাকে চাইছে। চিনি না। বলছে, চিঠি আছে।

‘চিঠি আছে? চিঠি আছে তো নিয়ে এসো!’

চার্লি বলল, ‘আমার হাতে দেবে না। বলছে, আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে দেওয়া মানা।

‘ঠিক আছে, তাকে ড্রয়িংরুমে বসাও।’

চার্লি চলে যাওয়ার পর চেয়ার ছাড়লেন রাসেল। অ্যামেলিয়াকে বললেন, ‘এখুনি আসছি।’ চিন্তিতভাবে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *