দ্য ম্যান হু লাফস – ৭

আর্ডেন বাগিচা পেছনে ফেলে প্রায় দেড় শ মাইল দূরে চলে এসেছে উর্সাসের গাড়ি।

হোমো গাড়ি টানছে না, চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে ঠায়, যেন ধ্যান করছে। ছোট্ট মেয়েটা তার সামনের একটা পা ধরে টলতে টলতে সিধে হলো। তাই দেখে একটা বাদামগাছের কাণ্ড বেয়ে তরতর করে নিচে নেমে এল গিয়েলুম, শার্টের দুই পকেট বাদামে ফুলে আছে। এখুনি গাছ থেকে নামার ইচ্ছা তার ছিল না, নামতে বাধ্য হলো হোমোর পা ধরে ডিকে দাঁড়াতে দেখে। সে ভয় পেয়েছে, হোমো যদি অসাবধানে ডির পিঠে ভারী একটা পা তুলে দেয়? পঙ্গু বা প্রতিবন্ধী হওয়ার কী যে জ্বালা আর কষ্ট, গিয়েলুম জানে। সে সারাক্ষণ সজাগ থাকে, তুলতুলে নরম এই সোনা পুতুলটার জীবনে সেরকম কোনো দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে।

উর্সাসের গাড়িতে আশ্রয় পাওয়ার পর জাদুকরের অত্যাচার আর তাঁবুতে বসবাস করার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেয়েছে গিয়েলুম। ওরা তাকে দেখিয়ে দর্শকদের কাছ থেকে বেশ ভালো টাকা কামালেও বিনিময়ে যে তার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতে হবে, এই কথাটা একবারও ভাবত না। সে দেখতে কদাকার, তাই নিষ্ঠুর শারীরিক নির্যাতন আর অপমানই যেন তার পাওনা ছিল। যখন সে কাঁদে তখনো তার মুখ থেকে হাসিটা মুছে যায় না, এটা ছিল জাদুকরের কাছে মহা এক কৌতুককর ব্যাপার। জাদুকর আর তার সহকারীরা সারা দিনে কম করেও দশবার পরীক্ষা নিত, তার পরও তাদের কৌতূহল ও তৃপ্তি মিটত না। কীভাবে কাঁদানো যায় এ নিয়ে গবেষণা করত তারা, নিত্য-নতুন কৌশল বের করত। গায়ে পিন ফোটাত, সামনে থেকে অকস্মাৎ ছিনিয়ে নিত খাবারের প্লেট, কিংবা হয়তো গরম লোহার ছ্যাঁকা দিত পিঠে। বেচারি কিশোর গিয়েলুম স্বভাবতই গলা ছেড়ে কেঁদে উঠত। আর তাতেই সবচেয়ে বেশি মজা পেত তারা। গলা থেকে বেরোচ্ছে কাতর আর্তনাদ, অথচ মুখে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করা হাসি লেগে আছে। গিয়েলুম কাঁদতে কাঁদতে হাসছে, হাসতে হাসতে কাঁদছে। মুখে হাসি, গলায় কান্না। তবে তাঁবুর ভেতর হাসির শব্দের অভাব ঘটত না। জাদুকর আর তার দুই সহকারী গিয়েলুমের হাসি-কান্না দেখে গলা ছেড়ে একযোগে অট্টহাসি হাসত।

এই অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই পালিয়ে এসেছে গিয়েলুম। নেহাত ভাগ্যের জোরেই আশ্রয় পেয়েছে এই নেকড়ে-টানা গাড়িতে। পালানো সহজ, কিন্তু আশ্রয় পাওয়া শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব, এটা সে জানত বৈকি। তাঁবু থেকে পালিয়ে গাড়িটার কাছে চলে আসে ঠিকই, কিন্তু এখানে সে আশ্রয় পাবে বলে আশা করেনি। গাড়ির ভেতর কেউ আছে কি না, থাকলে সে কী ধরনের মানুষ, উঁকি দিয়ে সেটাই সে দেখার চেষ্টা করছিল। তার ধারণা ছিল, গাড়ির ভেতর যে-ই থাকুক, তাকে দেখামাত্র তাড়া করবে। সে-ও তৈরি ছিল, তাড়া করলেই একছুটে জঙ্গলে পালাবে সে, লুকিয়ে পড়বে ঝোপের ভেতর। ঝোপ থেকে ঝাড়ে, ঝাড় থেকে গর্তে, এভাবেই লুকিয়ে থেকে গন্তব্যহীন পথের পথিক হয়ে থাকতে হবে তাকে সারা জীবন। এরকমই সে ভেবেছিল। এটাকেই তার নিয়তি বলে মেনে নেয়। কোনো মানুষ যে তাকে আশ্রয় দেবে না, এটা তো জানা কথাই। আর যদি কেউ আশ্রয় দেয়ও, অবশ্যই তাকে দিয়ে রোজগার করানোর ধান্দা করবে। মানুষ খুব স্বার্থপর, এটা সে বুঝে গিয়েছে। তার দুঃখ ও যন্ত্রণা দেখে কারও মনেই করুণা জাগে না।

কিন্তু গিয়েলুমের এসব ধারণা ও কল্পনা মিথ্যা হয়ে গেল।

তাকে প্রথমবার দেখার পর এক মিনিট স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল উসাস। গিয়েলুমও উসাসকে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। তার কারণও আছে। জাদুকরের খেলা দেখতে কত লোকই তো আসে তাঁবুতে। কেউ আসে শহর থেকে, কেউ গ্রাম থেকে, কেউ অনেক দূরের কোনো দেশ থেকে। অনেক দিন হলো তাঁবুতে রয়েছে গিয়েলুম, লোকজনও সে কম দেখেনি। তাদের মধ্যে অতি সুদর্শন থেকে শুরু করে অতি কুৎসিত চেহারার লোকও আছে। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হয়, জন্তু-জানোয়ারও কম দেখেনি সে। কিন্তু উর্সাসের মুখের সঙ্গে মেলে এমন প্রাণী আজ পর্যন্ত একটাও দেখেনি-তার চেহারা না কোনো মানুষের সঙ্গে মেলে, না কোনো জন্তুর সঙ্গে। তার মনে প্রশ্ন জাগল, আমি কি সত্যি একটা মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে আছি? মানুষ যদি না হয়, তবে কি এ কোনো জন্তু? না, এ মানুষও নয়, জন্তুও নয়—মানুষ ও জন্তুর কাছাকাছি একটা রূপ। লোকটা যেন না-মানুষ না-ভালুক, দুয়ের মাঝামাঝি আজব কোনো জীব।

মানুষের একটা গুণ হলো, নিজেকে মেজেঘষে পরিষ্কার রাখা, যতটা সম্ভব সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে অন্য মানুষের সামনে নিজেকে হাজির করা। অন্তত গিয়েলুমের তা-ই ধারণা ছিল। কিন্তু সে দেখল, তার ধারণা এই লোকটার বেলায় মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে।

নিজের যত্ন নেওয়ার কোনো চেষ্টাই নেই উর্সাসের মধ্যে, বরং উল্টোটা করার দিকেই যেন বেশি ঝোঁক তার। লম্বা দাড়িতে ময়লা জমেছে, কাঁধে স্তূপ হয়ে থাকা একরাশ চুল জট পাকিয়ে গেছে। এরকম চুল-দাড়ি কি কোনো মানুষ রাখে? গায়ে কী পরে আছে, দেখো! এই জামা কোন দর্জি তৈরি করেছে জানতে পারলে প্রশংসা করার জন্য তার সঙ্গে দেখা করতে যেত গিয়েলুম! এটাকে জামা বলা উচিত কি না, তা-ও ভাবার বিষয়। জিনিসটা আসলে ভেড়ার একটা চামড়া দিয়ে তৈরি কম্বল, সেটাকেই সেলাই করে জামা বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। কম্বলটা এতই লম্বা, উর্সাসের গলা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সবটুকু ঢেকে রেখেছে। কোমরে ওটা কী? সাপ? সাপ নয়, সাপের চামড়া দিয়ে বানানো বেল্ট। কিন্তু সেটা এমন কায়দা করে বাঁধা হয়েছে, দেখলেই মনে হয় জ্যান্ত একটা সাপ উর্সাসের কোমর পেঁচিয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে।

উর্সাসের চেহারা আর বেশ দেখে গিয়েলুম যেমন হতভম্ব হয়ে পড়ে, গিয়েলুমের দুই কান পর্যন্ত লম্বা হাসি দেখে উসাসও তেমনি বিমূঢ় হয়ে ওঠে। এ ধরনের বিকৃতির কথা অবশ্য আগেও শুনেছে উসাস, তবে চাক্ষুষ দেখার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। চোর-ডাকাতদের মহলেই কথাটা রটে, সেখান থেকে উর্সাসের কানে আসে। এ হলো নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নেওয়ার পদ্ধতি। ফ্রান্স আর ইতালিতেই এটা প্রচলিত। বংশপরম্পরায় শত্রুতা আছে, এরকম এক পরিবার অন্য পরিবারের কাউকে ধরতে পারলেই হয়, অপারেশন করে চিরকালের জন্য তার মুখটা ধ্বংস করে দেবে। এটা স্রেফ বর্বরতা, কিন্তু অত্যাচারীরা এতেই আনন্দ পায়। গিয়েলুমকে দেখার পর উর্সাসের মনে হলো, এ না দেখাই ভালো ছিল।

হাসিটা এমনই বীভৎস যে দেখামাত্র শিউরে উঠতে হয়। একে ঠিক মানুষের হাসি বলা চলে না। জান্তব ও পৈশাচিক, এই দুই ধরনের হাসি মেশালে তবেই হয়তো তৈরি হতে পারে এই অমানুষিক হাসি। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য, শরীরের এই ছয়টি শত্রু একযোগে তাদের সমস্ত শক্তি প্রদর্শন শুরু করলে বা চূড়ান্ত মাত্রায় উত্তেজিত হয়ে উঠলে তখন কারও পক্ষে এই হাসি হাসা সম্ভব হলেও হতে পারে, তার মুখে বিশেষ কৌশলে ওই অপারেশন না চালানো সত্ত্বেও।

হ্যাঁ, উসাস এই হাসির কথা আগে শুনেছে বলেই স্তম্ভিত বিস্ময়টা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় নেয়নি সে। অবশ্য গিয়েলুম তখনো হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে তখনো ভাবছে, এটা কী ধরনের জীব দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে? সে সিদ্ধান্ত নিল, এই জীবের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

কিশোর গিয়েলুম সত্যি সত্যি ছুটে পালাতে যাচ্ছিল। কিন্তু উসাস বুঝতে পেরে খপ করে তার একটা হাত ধরে ফেলল। তাতে আরও ভয় পেল গিয়েলুম। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করল সে। কিন্তু গায়ের জোরে উর্সাসের সঙ্গে সে কি পারে!

উর্সাস তাকে অভয় দিয়ে বলল, ‘আমাকে তুমি ভয় পেয়ো না। আমি বেশ বুঝতে পারছি, তোমার সাহায্য দরকার। যতক্ষণ দরকার, আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব। জাদুকর আর তার লোকজন চারদিকে খুঁজছে তোমাকে। একবার যদি ধরা পড়ো, তোমাকে নিয়ে কী করা হবে জানো তো? আগুন জ্বেলে ওদের তাঁবুটা তুমি পুড়িয়ে দিয়েছ, আরেকটা আগুন জ্বেলে ওরাও তোমাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে।’

উর্সাসের কথায় যুক্তি আর সত্যতা আছে। একটু শান্ত হলো গিয়েলুম।

উর্সাস আবার বলল, ‘আমি তোমার ভালো চাই। এখন তুমিও যদি নিজের ভালো চাও, আমার গাড়িতে উঠে পড়ো। হোমো গাড়ি টানতে শুরু করলে ওরা ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না যে গাড়ির ভেতর আমি তোমাকে লুকিয়ে রেখেছি।’

এরপর গাড়িতে উঠে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ল গিয়েলুম।

.

প্রথম কয়েক দিন সুযোগ পেলে অবশ্যই পালিয়ে যেত গিয়েলুম। কিন্তু উর্সাস তাকে সে সুযোগ দেয়নি, রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা নজরবন্দী করে রেখেছিল। তারপর ধীরে ধীরে গিয়েলুমের মন থেকে পালানোর ইচ্ছাটা মরে গেল।

উর্সাসের শুধু যে চেহারাটাই অদ্ভুত, তা নয়। তার আচরণও উদ্ভট, স্নেহ করার ধরনটাও আজব। মুখে সে ভুলেও কখনো স্নেহ-ভালোবাসার কথা বলে না। যদি বলত, সেসব কোমল শব্দ তার মুখে সত্যি মানাত না। তবে তার ভাব-ভঙ্গিতে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, স্নেহ-যত্ন থেকে চিরবঞ্চিত হতভাগা এই কিশোরটির প্রতি অকৃত্রিম দরদ অনুভব করে সে। কারও স্নেহ-ভালোবাসা যতই বিচিত্র পথ ধরে আসুক, যাকে ভালোবাসা হয়, সে ঠিকই তা উপলব্ধি করতে পারে। উর্সাসের সহানুভূতি আর দরদও স্পর্শ করে গিয়েলুমকে, আর সে জন্যই গোলাঘরে থাকার সময় পালানোর অনেক সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও পালায়নি সে। বরং সারাক্ষণ একটা অস্থিরতা পেয়ে বসে তাকে। বুড়ো উর্সাসের পথ চেয়ে বসে থাকে সে। মনে মনে চিন্তা করে, বুড়ো ফেরে না কেন! ফেরে না কেন!

সদ্য ফোটা ফুলের মতো একটা মেয়েকে কোলে নিয়ে ফিরে এল উর্সাস। মেয়েটিকে দেখে প্রথম চমক উঠল গিয়েলুম। শিশুর সৌন্দর্য এতই মুগ্ধ করল, তাকানোর পর আর চোখ ফেরাতে পারে না। এই বয়সের শিশু এর আগে আর একটিমাত্র দেখেছে সে। তার নাম ভয়লা, জাদুকরের মেয়ে। কিন্তু ভয়লার সঙ্গে এই মেয়েটির কোনো তুলনাই চলে না। এমনকি দুজনকে একই শ্রেণির প্রাণী মনে করাও কঠিন।

খুব সাবধানে, ভয়ে ভয়ে হাত দুটো সামনে বাড়াল গিয়েলুম। সে দেখতে কদাকার, তার চেহারা দেখে মেয়েটি না ভয় পেয়ে যায়। এক তাঁবুতে দীর্ঘ দিন থাকলেও ভয়লা তো তাকে যতবার দেখত, ততবার কেঁদে ফেলত।

কিন্তু এই অচেনা শিশুটি গিয়েলুমের মধ্যে কী দেখল, একমাত্র ঈশ্বরই তা বলতে পারবেন—অকস্মাৎ কলকল করে হেসে উঠল সে, সবার কানে মধু বর্ষণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল গিয়েলুমের বাড়ানো হাত দুটোর ভেতর। ডাকাতদলের এক লোক তাকে রাস্তা থেকে তুলে আনার পর সেই যে তার কান্না শুরু হয়েছিল, তা আসলে একবারও বন্ধ হয়নি। কখনো কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কখনো দেখা গেছে গলায় আওয়াজ না থাকলেও টপটপ করে পানি ঝরছে চোখ থেকে। আইরিনের আদরভরা কোমল স্পর্শও তার কান্না থামাতে পারেনি। শুধু উসাস যখন তাকে কোলে তুলে নিল, ঠিক এখনকার মতো এভাবেই কলকল করে হেসে উঠেছিল সে। দেখা গেল, উর্সাস আর গিয়েলুমকে দেখলেই সব ভুলে হেসে উঠতে পারে ডি।

সেই শুরু, গিয়েলুম তার পর থেকে সারাক্ষণ কোলে কোলেই রাখে ডিকে। ডি আর হোমো, এদের দুজনকে নিয়েই সারাটা দিন তার খেলা চলে। এখানে তার সময় কী আনন্দে যে বয়ে যাচ্ছে, ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। বিদ্রূপ, নির্যাতন, দুশ্চিন্তা আর ভয়, এসব যেন অতীতের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া দুঃস্বপ্ন। এক মাঠ থেকে আরেক মাঠে, এক বন থেকে আরেক বনে গাড়ি নিয়ে ঘোরে উসাস। গ্রামের ভেতর গাড়ি থামে, রোগীরা ভিড় করে ওষুধ নেয় উর্সাসের হাত থেকে। এই সময়টা ডিকে কোলে নিয়ে গাড়ির ভেতর বসে থাকে গিয়েলুম, নতুন নতুন খেলা দেখিয়ে ভুলিয়ে রাখে মেয়েটিকে। গাড়ির ভেতর ওরা যে আছে, গ্রামের লোকজন তা টেরটিও পায় না। ওষুধ বিলি শেষ হওয়ামাত্র তাড়াতাড়ি গাড়ি ছেড়ে দেয় উসাস, বনের কিনারায় বা মাঠের মাঝখানে সরে আসে। এখানে, লোকচক্ষুর আড়ালে, তার পোষা প্রাণীগুলো মনের আনন্দে হেসে- খেলে সময় কাটাতে পারবে।

অ্যালারিকের আস্তানা থেকে উর্সাস ফিরে এল নতুন এক দৃষ্টি নিয়ে। হতভাগ্য গিয়েলুমকে কোলে তুলে নেওয়ার সময় ভেবেছিল, বংশপরিচয়হীন এক করুণার পাত্র। কিন্তু অ্যালারিক তাকে জানিয়েছে, গিয়েলুম আসলে অভিজাত পরিবারের সন্তান! প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে গেছে। ভাগ্য তাকে বঞ্চিত করেছে, মানবসমাজ নির্যাতন ছাড়া কিছুই তাকে দেয়নি। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এই সাজা নিজের কোনো অপরাধের ফল নয়। এর জন্য দায়ী ছিল তার বাবার নিষ্ঠুরতা। নিষ্ঠুর হওয়ার এই প্রবণতা প্রায় সব জমিদারের মধ্যেই দেখা যায়, সেই বিজয়ী বীর উইলিয়ামের যুগ থেকে। কিন্তু কোনো জমিদারের অত্যাচারের ফল তার ছেলেকে এভাবে ভোগ করতে হয়েছে, এমনটি আগে কখনো শোনা যায়নি। এরকম কোনো ঘটনার কথা উর্সাসের অন্তত জানা নেই।

ভাগ্যবিড়ম্বিত এই অভিজাত বংশের সন্তানটির প্রতি উসাসের মন করুণায় ভরে উঠল। মানুষ নামের অমানুষগুলো তার ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, কীভাবে তার ক্ষতিপূরণ করা যায়, সেই চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে উঠল সে। দস্যু অ্যালারিকের আস্তানা থেকে উর্সাস জেনে এসেছে, গিয়েলুমকে তার জন্মগত অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা করা হবে। ওদের পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে যিনি জমিদারি দেখাশোনা করছেন, সেই আইনজীবী ভদ্রলোকই ওকে ওর মর্যাদার আসন ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

তবে সে চেষ্টা যে সফল হবে, এটা বিশ্বাস করতে সাহস পায় না উসাস। কারণ, ভালো যেকোনো কাজেই মানুষ বাদ সাধে, নানা রকম বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করে। দস্যু অ্যালারিক অপহরণ করেছিল গিয়েলুমকে–সে কি আজকের কথা! সেদিনের শিশু আজ কৈশোর পার হয়ে যৌবনে পা দিতে চলেছে। নিষ্পাপ শিশুর সমস্ত রূপ-সৌন্দর্য কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, বিকলাঙ্গ শরীর আর বিকৃত মুখ নিয়ে বেড়ে উঠছে সে। বাবা বেঁচে থাকলে তিনি একে দেখে ছেলে বলে চিনতে পারতেন না। তিনি মারা গেছেন, তা-ও তো অনেক বছর হয়ে গেল। বংশে আর কোনো সন্তান না থাকায় এক জ্ঞাতি কন্যাকে জমিদারির উত্তরাধিকারিণী ঠিক করে গেছেন তিনি। সেই জ্ঞাতি কন্যা এখনো কিশোরী। তার শিক্ষা-দীক্ষাও ঠিকমতো হয়নি, নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুর মূল্য দিতে জানে না। তার আশপাশে অনেকেই জুটেছে, কিন্তু কেউ তারা সুন্দর মানুষ হওয়ার যোগ্য নয়। অন্তত ডেভিড সম্পর্কে অ্যালারিকের কয়েকটা মন্তব্য শুনে উর্সাসের সেরকমই ধারণা হয়েছে।

উর্সাস ভাবছে, কিশোর গিয়েলুমের জন্য তাকে কিছু করতে হবে। এই অভাগার সাহায্য দরকার। স্নেহ-ভালোবাসা-আদর দরকার। আরও বহু কিছু দরকার। প্রশ্ন হলো, সবচেয়ে যেটা জরুরি দরকার, সেটা কী? কী করলে খুব বেশি উপকার হয় গিয়েলুমের? চিন্তা করতে করতে মাথাটা ভার হয়ে এল উর্সাসের।

এভাবে চিন্তা করতে করতেই প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেল উসাস। সম্ভব! তার দ্বারা গিয়েলুমের মস্ত একটা উপকার করা সম্ভব! শিক্ষা বলতে প্রায় কিছুই পায়নি গিয়েলুম। শেখার মধ্যে শুধু শিখেছে তারের ওপর দাঁড়িয়ে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি সহযোগে নাচতে। জমিদারি ফিরে পেল কি না পেল, তাতে কিছু আসে-যায় না, পৃথিবীর বুকে মানুষ হিসেবে বাঁচতে হলে সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা। গিয়েলুম দেখতে কদাকার হলেও তার চরিত্র আর স্বভাব যাতে মানুষের মতো হয়ে ওঠে, সেই চেষ্টাই করবে উসাস।

সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই গলা ছেড়ে হেসে উঠল উসাস। সে হবে গিয়েলুমের শিক্ষক? সে, উসাস, শিক্ষা দিয়ে তাকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করবে? কিন্তু সে নিজে কী? কী তার পরিচয়? নিজে কি সে মানুষ? এই প্রশ্নটা প্রায়ই জাগে তার মনে। এ ব্যাপারে তার নিজেরই সন্দেহ আছে। মানুষ হলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়, তা কি সে মানে? প্রায় পঞ্চাশ বছর হলো ভদ্র সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ নেই তার, শিক্ষিত ভদ্রলোকের সঙ্গে মেলামেশা করে না। গিয়েলুমকে শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা তার জন্য স্পর্ধা দেখানো হয়ে যায় নাকি? একটা কথা ভুললে চলবে না, এই মূর্খ কিশোরের ভাগ্য প্রসন্ন হয়ে উঠলে ভবিষ্যতে একদিন সে সভ্যতায় শ্রেষ্ঠ এই দেশের অভিজাত সমাজে শ্রেষ্ঠতম সম্মানের আসনটি দখল করে বসতে পারে। তখন বিশেষ মহলে প্রশ্নটা উঠবে বৈকি, কে তার শিক্ষক? কে তাকে মানুষ হিসেবে গড়েছে?

আপন মনে হাসতে হাসতে গাড়ির ভেতর ঢুকল উর্মাস। ইতিমধ্যে গাড়ির আকার-আকৃতি অনেকটাই বদলে ফেলা হয়েছে। ডিকে নিয়ে প্যারিস থেকে ফেরার পর, সেই গোলাঘরে বসে, গাড়ির ওপর একটা হালকা ধরনের দোতলা তৈরি করেছে উসাস। সে জন্য আগের চেয়ে আরও তিন ফুট বেশি উঁচু করতে হয়েছে গাড়িটা, তাতে ওটার ওজনও বেশ খানিক বেড়েছে। রোজই খেয়াল করে উসাস, ভারী গাড়িটা টানতে হোমোর খুব কষ্ট হচ্ছে কি না। তার হিসাবে, হচ্ছে না। রামে ভেজানো প্রচুর মাংস খেয়ে পশুসমাজে রীতিমতো পালোয়ান বনে গেছে হোমো। উসাস সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেদিন দেখা যাবে হোমো হাঁপাচ্ছে, সেদিনই তার একজন সহকারী জোগাড় করা হবে। হোমো একা গাড়ি চালাচ্ছে, তাই এটা এখন এক্কাগাড়ি। যখন তার সহকারী আসবে, তখন হয়ে যাবে জুড়িগাড়ি। নেকড়ে হোমোর সেই সহকারীর নাম কী হবে, তা-ও ঠিক করে ফেলেছে উর্সাস—লোম। লোম শব্দের অর্থ হলো ভূত।

একতলার অনেক বাক্স ও ব্যাগ দোতলায় আনা হয়েছে, ওগুলোর সঙ্গে একটা লোহার সিন্দুকও আছে। এখানে, দোতলায়, গিয়েলুম শোয়

আপন মনে হাসতে হাসতে দোতলায় উঠে সেই লোহার সিন্দুকটা খুলল উসাস। ভেতরে অন্য কিছু নেই, শুধু বই আর বই। কত রকমের বই, বলে শেষ করা যাবে না। মোটা, পাতলা, লম্বা, বেঁটে, সব ধরনের বইই আছে। প্রতিটি বই পুরোনো, কালের আঁচড়ে হলদে হয়ে গেছে পাতা, পোকায়ও কিছু কিছু খেয়েছে। এক একটা বই খোলে উর্সাস, আর দু-চার পাতা উল্টে দেখে।

মাঝেমধ্যেই দীর্ঘশ্বাস ফেলছে উসাস, চোখের সামনে ফুটে উঠছে অতীত দিনের বিচিত্র সব রংচঙে স্মৃতি। প্রতিটি বইয়ের প্রথম পাতায় মালিকের নাম লেখা। এসব বই একজন লোকেরই ছিল। নামটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে উসাস। নামটা তার পরিচিত, এক বিখ্যাত অধ্যাপকের পরিচয় বহন করে, অথচ আজ এই নাম কেমন নতুন আর অচেনা লাগে তার কাছে। সে ছিল এক মহাপণ্ডিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত, তার সঙ্গে নেকড়ে-টানা গাড়িতে বসে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো এই যাযাবর চিকিৎসকের সামান্যতম মিলও সে খুঁজে পায় না।

‘গিলি! গিলি!’ হঠাৎ নিচে থেকে ডাকাডাকি শুরু করে ডি। গিয়েলুমের নামটা সংক্ষেপ করে নিয়েছে সে। ডির চিৎকারে স্মৃতিরোমন্থন থেমে যায়, দ্রুত হাতে সিন্দুক বন্ধ করে নিচে নেমে আসে উসাস।

না, এসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই গিয়েলুমের কোনো কাজে আসবে না। তার তো সম্ভবত অক্ষরজ্ঞানই নেই। তাকে শুরু করাতে হবে বর্ণমালা দিয়ে। অন্য একটা কথা মনে হতে আবার আপন মনে হেসে ফেলে উসাস। ডির বয়স আরও দু-চার বছর বেশি হলে ওদের দুজনকে একসঙ্গে পড়াতে পারত সে।

পরের দিন একটা গ্রামের পাশে গাড়ি থামাল উসাস। এই গ্রামে দু- চারটে দোকানপাট আছে। ওষুধ বিক্রি শুরু করার আগেই খোঁজ নিল উর্সাস। হ্যাঁ, দোকানে শিশুপাঠ্য বই পাওয়া যাবে। বেশ অনেক বেলা পর্যন্ত নিজের কাজ করল সে, রোগীরা সবাই ওষুধ নিয়ে ফিরে যাওয়ার পর গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ল গ্রামের ভেতর। একটা দোকান থেকে বেশ কয়েকটা শিশুপাঠ্য বই কিনল সে।

বই দেখে গিয়েলুম তো হাঁ। অবাক তো হবেই, কারণ বই কী জিনিস তা সে জানে না, আগে কখনো দেখেনি। প্রথমে সে ভাবল কাকা ডির জন্য খেলনা কিনে এনেছে। ‘কাকা’ বলাটা উসাসই ওদের শিখিয়েছে।

গিয়েলুমকে বলা হলো, ওগুলো ডির খেলনা নয়, আনা হয়েছে তারই জন্য। খেলনা? হ্যাঁ, খেলনাই। তবে নাড়াচাড়া করার সময় ছিঁড়ে ফেলা চলবে না। কাকা যেমনভাবে শিখিয়ে দেবে, তাকেও সেভাবে গলা চড়িয়ে আবৃত্তি করতে হবে। প্রথম দিকে কোনোমতে তার মন বসে না। তবে ধীরে ধীরে আগ্রহ জন্মাল। একসময় দেখা গেল, বইগুলো রীতিমতো টানছে তাকে।

.

সময়টা তখন দুপুর!

ছোট্ট এক নদীর ধারে গাড়ি থামিয়ে চুলায় রান্না চড়িয়েছে উসাস। সেডার বনে ঢুকে শুকনো কাঠ কুড়াচ্ছে গিয়েলুম। ডি তার পিছু পিছু ঘুরছে, পায়ে একজোড়া খুদে লাল জুতা। বনে-জঙ্গলে কাঁটা আর কাঁকর থাকে, ছোট্ট নরম পায়ে সেগুলো বিঁধতে পারে, তাই ওই জুতাজোড়া ডিকে কিনে দিয়েছে উসাস। ছোট্ট মেয়েটির সুবিধা-অসুবিধার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে সে।

সবাই যে যার কাজ করছে, এই সময় হঠাৎ একটা ডাক ছাড়ল হোমো।

মুখ তুলে তাকাল উসাস। একটা গাড়ি আসছে। আসছে আসুক, তাতে অস্থির হওয়ার কোনো কারণ নেই। এদিকে নদীতে মাত্র এক হাঁটু পানি। এই ঘাট গাড়ি পারাপারের জন্যই। নদী পেরিয়ে ওপারে উঠবে গাড়িটা, তারপর নিজের পথে চলে যাবে। উসাস আবার রান্নায় মন দেয়।

কিন্তু গাড়িটার নদী পেরোনোর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উর্সাসের গাড়ির কাছাকাছি এসে থেমে গেল সেটা। এবার উসাসকে একটু মনোযোগ দিতেই হলো। কে এল? এখানে থামার কী কারণ?

উর্সাস দেখল, এক মধ্যবয়স্ক লোক নামছে গাড়িটা থেকে। দেখেই বোঝা যায়, সম্ভ্রান্ত কোনো ভদ্রলোকই হবেন। বেশ দামি কাপড়চোপড় পরে আছেন। গাড়ি থেকে নেমে এদিকেই আসছেন তিনি।

ভদ্রলোক আরও একটু কাছে আসতে সিধে হয়ে দাঁড়াতে হলো উর্সাসকে। কী আশ্চর্য, এ ভদ্রলোককে তো সে চেনে! ইনিই তো পেমব্রোক জমিদারদের আইন উপদেষ্টা, মি. রাসেল! ভদ্রলোকের সঙ্গে উর্সাসের পরিচয় হয়েছিল দস্যু অ্যালারিকের গোপন আস্তানায়। ইনি এখানে কী মনে করে? নিশ্চয়ই জরুরি কোনো কারণ ছাড়া আসেননি। হয়তো গিয়েলুম সম্পর্কে ভালো কোনো খবর দিতেই এসেছেন।

দুই পা এগিয়ে দাঁড়াল উসাস, ডান হাতটা কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে সামনে বাড়াল। তার হাত বাড়ানোর এই ভঙ্গি দেখে মুগ্ধ হলেন রাসেল। সাধারণত বিদেশি দূতকে সাক্ষাৎদানে রাজি হয়ে সম্রাটেরাই এই ভঙ্গিতে তাঁর অপেক্ষায় দাঁড়ান। সেই মুহূর্তে রাসেলের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, এই লোক ভবঘুরে যাযাবর হতেই পারে না, তার বর্তমান দৈন্যদশার পেছনে অবশ্যই গোপন কোনো কাহিনি ও রহস্য আছে। ভবঘুরে যাযাবর এত উঁচুদরের আদব-কায়দা কোত্থেকে শিখবে! এই লোকের অতীত কাহিনি নিশ্চয়ই গৌরব করার মতো।

বাড়ানো হাতটা সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে গ্রহণ করলেন রাসেল। ‘আবার আপনার দেখা পেয়ে আনন্দ লাগছে। আপনার পেছনে আজ কয়েক দিন হলো লেগে আছি আমি। লা-মার্তিয়ারে পৌঁছে খবর পেলাম, আপনি ক্লেমকোঁতে আছেন। ক্লেমকোঁতে এসে শুনি আপনি রওনা হয়ে গেছেন, গন্তব্য জার্মেইন…’

‘আপনি কষ্ট পাওয়ায় সত্যি খুব দুঃখিত। কী ব্যাপার বলুন তো? গিয়েলুম সম্পর্কে কোনো খবর নিয়ে এসেছেন? কিন্তু আমার ঠিকানা পেলেন কীভাবে? কে দিল, অ্যালারিক?’

‘দুটো প্রশ্নের একটাই উত্তর—হ্যাঁ।’

‘গিয়েলুমের খবর পরে শুনব। আগে অ্যালারিকের খবর দিন। কেমন আছে সে? আইরিনই বা কেমন আছে?’

‘শরীর-স্বাস্থ্য সব ভালোই ওদের,’ বললেন রাসেল। ‘তবে মনের দিক থেকে খুব ভেঙে পড়েছে। কারণ হলো সেই মেয়েটি…‘

এখান থেকে সেডার বনটা দেখা যাচ্ছে। বনের ঘাসে ছুটে বেড়াচ্ছে ডি, চঞ্চল একটা প্রজাপতি যেন। সেদিকে একটা হাত তুলে রাসেল তার অসমাপ্ত কথার খেই ধরলেন আবার, ‘…ওই মেয়েটিই ওদের মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শত চেষ্টা করেও আইরিন ওকে ভুলতে পারছে না। ডি চলে আসার পর সেই যে তার কান্না শুরু হয়েছে, একবারের জন্য তা আর থামেনি। আইরিনের চোখে পানি দেখে অ্যালারিকও দিশাহারা। ডাকাতি, লুটপাট, খুন-জখম—সব বন্ধ হয়ে গেছে। এক্স, ওয়াই, জেড—অ্যালারিকের শিষ্যরা সময় কাটাচ্ছে চুরুট ফুঁকে।’

এক পলকের জন্য ক্ষীণ একচিলতে হাসি ফুটল উর্সাসের ঠোঁটে, তার পরই তা মিলিয়ে গেল। বিড়বিড় করল সে, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ।’ তারপর গলা সামান্য চড়িয়ে জানতে চাইল, ‘তা, ডিকে নিয়ে যেতে চায় নাকি? কিছু বলেছে?’

প্রবল বেগে মাথা নাড়লেন রাসেল। ‘না না, ঠিক তার উল্টো! সে প্রস্তাব আমিই ওদের দিই। কিন্তু দুজনের কেউই রাজি হলো না। এ ব্যাপারে দুজনই ওরা একমত—দস্যুদের নোংরা আস্তানায় রাখলে মেয়েটা মানুষ হবে না, তাতে তার ভালো করার বদলে মন্দই করা হবে। তার ওপর প্রচণ্ড মায়া পড়ে গেছে আইরিনের, তবে সে অন্ধ হয়ে যায়নি। যাকে সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, তার ক্ষতি করা উচিত নয়, এটুকু সুবুদ্ধি এখনো হারায়নি সে।

সেডার বনের আড়ালে কী দেখা যাচ্ছে ওটা? একটা ঘোড়া না? হ্যাঁ, ঘোড়াই বটে। বন থেকে বেরিয়ে এদিকেই ছুটে আসছে।

ঘোড়াটাকে গিয়েলুমও দেখতে পেল। কাঠ কুড়ানোর কাজ ফেলে ছুটে এসে ডিকে কোলে তুলে নিল সে, তারপর হনহন করে গাড়ির দিকে এগোল। এই প্রথম ওকে দেখছেন রাসেল, পেমব্রোক জমিদারির প্রকৃত অধিকারীকে। এরই নাম তাহলে গিয়েলুম? তার পরলোকগত বন্ধু আর্ল গুস্তাভের একমাত্র পুত্র ও বংশধর?

রাসেলের মাথায় যেন বাজ পড়েছে। বাজ পড়েছে বললেও আসলে তাঁর এখনকার অবস্থার সঠিক বর্ণনা দেওয়া হয় না। যার গায়ে বাজ পড়ে তার হুঁশ থাকে না, বিস্ময়বোধ থাকে না, থাকে না যন্ত্রণাবোধ। রাসেলের বেলায় সেরকম কিছু ঘটেনি। গিয়েলুমকে দেখামাত্র পাথর হয়ে গেলেন তিনি, সেই সঙ্গে তাঁর বুকে যেন গরম ও তীক্ষ্ণ একটা কিছু বিঁধল। তীব্র যন্ত্রণায় অবশ হয়ে এল তাঁর সারা শরীর।

ঘোড়া কাছে চলে এল। পিঠে ঘোড়সওয়ার।

উর্সাসের ইঙ্গিত পেয়ে ডিকে গাড়িতে তুলে দিল গিয়েলুম, তারপর নিজেও উঠে পড়ল।

ওদের কাছে এসে নিচে নামল ঘোড়সওয়ার। বেশভূষা দেখে মনে হলো সাধারণ কোনো ফরাসি ভদ্রলোক। বাদ সেধেছে শুধু চওড়া গোঁফ আর লালচে চাপদাড়ি। ভদ্রই হোক আর অভদ্রই হোক, কোনো ফ্রেঞ্চ যুবক এ ধরনের দাড়ি-গোঁফ রাখে না।

যুবকের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন রাসেল। উর্সাসের দৃষ্টিতে রাজ্যের সন্দেহ।

ঘোড়সওয়ার সহাস্যে এগিয়ে এল, অভিবাদন জানাল ওদের, তারপর জিগ্যেস করল, ‘নদীতে পানি কি খুব গভীর?’

গিয়েলুমকে দেখার পর বিস্ময়ের ধাক্কাটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি রাসেল, তা না হলে ছদ্মবেশী আঁদ্রেকে এতক্ষণে অবশ্যই তিনি চিনতে পারতেন।

বিনা পরিশ্রমে পাওয়া পঞ্চাশ পাউন্ড সম্বল করে অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছে আঁদ্রে। তার উদ্দেশ্য হলো রাসেল কী করেন, কোথায় যান সব খুঁটিয়ে লক্ষ করা। চোখে চোখে রাখলে বুড়োর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে নিশ্চয়ই অনেক তথ্য আসবে তার হাতে, সেসব তথ্য অ্যামেলিয়াকে জানাবে সে। তার বদ্ধমূল ধারণা, রাসেল গোপন ও অসৎ কোনো মতলব নিয়ে ফ্রান্সে ঘোরাফেরা করছেন। তার এই ধারণা আরও জোরালো হয়েছে রাসেল শহর ছেড়ে মফস্বলে চলে আসায়। তারপর, এখন, নির্জন এই নদীর তীরে, অদ্ভুতদর্শন জটাধারী লোকটার সঙ্গে তাঁকে মিলিত হতে দেখে সে ধরে নিয়েছে, কোনো সৎ কাজে এখানে তিনি আসেননি।

তবু তো গিয়েলুমকে এখনো দেখেনি আঁদ্রে। দেখলে সাফল্যের আনন্দ চেপে রাখতে পারত না, ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করত। গিয়েলুমকে না দেখুক, উসাসকে দেখেই তার কল্পনা ডানা মেলতে শুরু করল। যার চেহারা ওরকম দানবীর ও বীভৎস, সে মানুষ হয় কী করে? এ নিশ্চয়ই কোনো অসামাজিক জীব। আর রাসেল যেহেতু অসামাজিক জীবের সঙ্গে মেলামেশা করছেন, তা-ও নির্জন একটা নদীর তীরে এসে, তখন ধরে নিতে হয় যে সমাজের কোনো উপকার করার জন্য এত কষ্ট তিনি স্বীকার করেননি।

তবে মনের ভাব গোপন রেখে মিষ্টি করে হাসল আঁদ্রে। সবিনয়ে জিগ্যেস করল, ‘নদীতে পানি কি খুব গভীর?

সত্যি কথাই বলল উসাস। ‘গভীর কি না বুঝব কীভাবে, আমি তো নামিনি। তবে এখান থেকে মানুষ হেঁটেই ওপারে যায়। কাদার ওপর পায়ের দাগ দেখছেন না?’

‘ওপারেই যাব আমি। আপনার এখানে একটু আগুন পাওয়া যাবে? চুরুটটা ধরাতে পারছি না, দেশলাইটা যে কোথায় পড়ে গেল পকেট থেকে! ওপারে পৌঁছে অনেকটা হাঁটলে তারপর ক্রোভেকুর, তাই না? তার আগে তো কোনো দোকান-টোকান পাচ্ছি না, কী বলেন?’

‘প্রয়োজন মনে করলে এটা রাখতে পারেন, আমার কাছে আরও আছে’, বলে তার হাতে একটা দেশলাই গুঁজে দিলেন রাসেল।

ধন্যবাদ দেওয়ার সময় বিনয়ে নুয়ে পড়ল আঁদ্রে। রাসেলকে সে একটা চুরুট সাধল। ধন্যবাদ জানিয়ে সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন রাসেল। ‘আমি ধূমপান করি না।’

এরপর উসাসকে সাধল আঁদ্রে। সে হেসে শুধু মাথা নাড়ল।

অগত্যা একাই চুরুট ধরাল আঁদ্রে। তারপর জিগ্যেস করল, ‘আপনারা কেউ বোধ হয় ওপারে যাবেন না? গেলে একসঙ্গে যাওয়া যেত গল্প করতে করতে।’

উর্সাস ও রাসেল দুজনই মাথা নাড়লেন।

এখান থেকে কোথায় যাবে ওরা, এখানে এসেছেই বা কেন, এসব জানার প্রচণ্ড কৌতূহল হচ্ছে আঁদ্রের, কিন্তু অচেনা লোকজনকে এসব জিগ্যেস করা একেবারেই শিষ্টাচারবিরুদ্ধ। সব কথা ফুরিয়ে গেছে তার। কথা ফুরিয়ে গেলে এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাও শোভন দেখায় না। আঁদ্রে ভাবছে, এখন তার কী করা উচিত?

বলেছে, নদীর ওপারে যাবে। বলেছে যখন, যেতেই হবে। কিন্তু নদীর ওপারে গিয়ে করবেটা কী সে? ওপারে তো তার কোনো কাজ নেই। নদীর ওপারটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা, এমন কোনো আড়াল দেখা যাচ্ছে না যে সেখানে গা ঢাকা দিয়ে এদের গতিবিধির ওপর নজর রাখবে। ওপারে বন আছে ঠিকই, কিন্তু খুবই হালকা—বিশ-বাইশ ফুট পরপর একটা করে সেডার গাছ। ঘোড়া নিয়ে ওই বনে লুকানো সম্ভব নয়। তাহলে?

নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে আঁদ্রের। ওপারে যাওয়ার কথা বলে বিপদে পড়ে গেছে সে। সত্যি, এমন বোকামি মানুষ করে! অন্য কিছু বললে এখানে আরও কিছুক্ষণ থাকার একটা-না-একটা অজুহাত তৈরি করা সম্ভব ছিল। চুরুট ফুঁকতে ফুঁকতে ঘোড়ার দিকে হাঁটা ধরল সে। আর ঠিক এই সময় তার মাথায় বিদ্যুচ্চমকের মতো একটা বুদ্ধি খেলে গেল।

ঘোড়ার পিঠে হাত রাখল আঁদ্রে, ভঙ্গি দেখে মনে হলো লাফ দিয়ে ওটার পিঠে উঠতে যাচ্ছে। কিন্তু তা না উঠে সে চিৎকার করে বলল, ‘আমার থলেটা কই?’

বাধ্য হয়ে তার দিকে ফিরতে হলো উর্সাস আর রাসেলকে।

আঁদ্রেকে দেখে মনে হলো, কঠিন একটা সমস্যায় পড়েছে সে। চেহারায় রাজ্যের হতাশা ও বিস্ময় ফুটিয়ে তুলে সে বলল, ‘আমার থলেটা জিনের সঙ্গে বাঁধা ছিল। একটা জামা, কিছু টাকা, এই সব ছিল তাতে। মনে আছে, সেডার বনে ঢোকার সময়ও ছিল ওটা। তার মানে, বনের ভেতরই কোথাও পড়েছে।’ ঘোড়াটা ওখানেই একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখল সে, তারপর ছুটে বনে ঢুকল।

বনে ঢুকে ছোটাছুটি করে থলে খুঁজে বেড়াচ্ছে আঁদ্রে। যথেষ্ট সময় নিচ্ছে সে। অনেক খুঁজেও থলেটা পাচ্ছে না। পাবে কীভাবে, সেটার কোনো অস্তিত্ব থাকলে তো!

উর্সাসের দিকে ফিরে রাসেল বললেন, ‘লোকটা কে, বলুন তো? কোনো খারাপ মতলব আছে নাকি?’

‘ভালো করে দেখুন তো’, বলল উসাস। ‘আমার মনে হচ্ছে ওকে আপনি চেনেন। বোধ হয় আপনার খোঁজেই এখানে এসেছে।

‘আমার খোঁজে এসেছে?’ চিন্তিত হয়ে পড়লেন রাসেল, মাথা চুলকাচ্ছেন। ‘কিন্তু আমি এখানে আসব, এ কথা তো অ্যালারিক ছাড়া আর কেউ জানে না। এরকম একটা গোপন কথা অ্যালারিক কাউকে বলবে…না, তা সম্ভব নয়।

‘সে যা-ই হোক, ওকে ওর থলে খুঁজতে দিন, এই ফাঁকে আমরা নিজেদের কাজটা সেরে ফেলি। আপনি সম্ভবত গিয়েলুম সম্পর্কে কোনো খবর নিয়ে এসেছেন, তাই না?’

‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন।’ মাথা ঝাঁকালেন রাসেল। ‘গিয়েলুম আর্ল গুস্তাভেরই সন্তান কি না, সত্য-মিথ্যা যাচাই করার একটা উপায় পাওয়া গেছে। এই যে, দেখুন…’

সেডার বনের দিকে পেছন ফিরলেন রাসেল, তাঁর হাতের খাতাটা লাল দাড়িঅলা লোকটা যাতে দেখতে না পায়। খাতা মানে আর্ল গুস্তাভের সেই ডায়েরি। পাতা উল্টে আঙুলের ছাপগুলো দেখালেন উসাসকে। ‘এগুলো গিয়েলুমের আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলে গেলে আর কোনো সন্দেহ থাকে না যে সে-ই পেমব্রোক জমিদারির প্রকৃত উত্তরাধিকারী। অ্যালারিকের সাক্ষ্য বলুন, শিশু গিয়েলুমের জামা-কাপড় বলুন, বা তার গায়ের জঙুলের কথা বলুন, এসবের চেয়ে অনেক জোরালো প্রমাণ দিতে পারবে এই হাতের ছাপ। আমি তো প্যারিস থেকে লোক নিয়ে আসিনি, কাজেই গিয়েলুমকে নিয়ে আমার সঙ্গে আপনাকেই ওখানে একবার যেতে হবে আঙুলের ছাপ দেওয়ার জন্য।’

‘কিন্তু আমি কীভাবে যাই, বলুন তো!’ হেসে ফেলল উসাস। ‘ডি আর হোমোকে কার কাছে রেখে যাব? ডিকে নিয়ে যেতে কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু হোমো রাজধানী দেখে ভয় পেয়ে যাবে। বেচারি গ্রামেই মানুষ কিনা I জীবনে কখনো শহরে যায়নি। আপনি বললেন, অ্যালারিক সাক্ষ্য দিতে পারে। কিন্তু অ্যালারিককে যদি সাক্ষী করা হয়, বিভিন্ন আদালতে তার বিরুদ্ধে হাজারটা কেস উঠবে, সেটা চিন্তা করে দেখেছেন? প্রথমে সে স্বাধীনতা হারাবে, তারপর জীবনটা। বিচারে যে তার ফাঁসি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

রাসেলকে বিচলিত দেখাল। ‘তাই তো, কথাটা আগে ভাবিনি! অ্যালারিকও বোধ হয় চিন্তা করেনি। সে তো বলামাত্র সাক্ষী দিতে রাজি হয়ে গেল। তা ছাড়া সত্যি কথাটা হলো, সে-ই তো একমাত্র প্রধান সাক্ষী।’

বিচলিত হয়ে পড়লে রাসেলের একটা অভ্যাস হলো, পেছনে হাত বেঁধে পায়চারি করা। রহস্যময় আগন্তুকের কথা ভুলে গিয়ে আজও তা-ই শুরু করলেন তিনি।

উর্সাসের চোখে ব্যাপারটা ধরা পড়ল। নিঃশব্দে ইঙ্গিত করল সে। সঙ্গে সঙ্গে হাত দুটো সামনে আনলেন রাসেল। তারপর দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে সেডার বনের দিকে তাকালেন। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। দাড়িঅলা লোকটাকে বনের কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত থলে খুঁজতে খুঁজতে রাস্তায় গিয়ে উঠেছে।

সতর্ক উসাস ও বুদ্ধিমান রাসেল দুজনই ভুল করলেন। আঁদ্রে রাস্তায় ফিরে যায়নি, বনের ভেতরই একটা মোটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে। উঁকি দিয়ে তাকিয়ে ছিল সে, ফলে রাসেলের হাতের কালো খাতাটা ঠিকই দেখে নিয়েছে। রাসেল বনের দিকে ঘাড় ফেরাচ্ছেন দেখে তাড়াতাড়ি মুখটা লুকিয়ে ফেলল আবার।

আঁদ্রে বুঝল, এই খাতা দেখানোর জন্যই লন্ডন থেকে প্যারিসে, প্যারিস থেকে এই এত দূরের বনে ছুটে এসেছেন রাসেল। খাতায় নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখা আছে।

উর্সাস আবার রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ডিকে নিয়ে গাড়ির ভেতরই থাকল গিয়েলুম, ভুলেও একবার বাইরে বেরোল না। অনুরোধ করায় উর্সাসের হাতের রান্না খেয়ে যেতে রাজি হয়েছেন রাসেল, চুলার ধারে বসে নিচু গলায় কথা বলছেন তিনি। রাসেলের কোচম্যান আগেই গাড়িতে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে।

কতক্ষণ আর জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকা যায়, একসময় ফিরতেই হলো আঁদ্রেকে। চোখ-মুখ বিষাদে ভরে তুলল সে, বলল, ‘আমার আর সামনের দিকে যাওয়া হচ্ছে না, তাই আপনাদের কাছে বিদায় নিতে এলাম। সব টাকা ওই থলের ভেতরই ছিল, ওটা হারিয়ে যাওয়ায় আমি এখন নিঃস্ব। এই অবস্থায় কোথাও যাওয়া যায় না। যাত্রা অসমাপ্ত রেখে বাড়িতেই ফিরতে হচ্ছে।’

মাথা ঝাঁকিয়ে রাসেল সায় দেওয়ার সুরে বললেন, ‘তা তো ঠিকই। গুডবাই।’

যে পথ দিয়ে এসেছিল, সেই পথ ধরেই বিদায় হলো আঁদ্রে। তবে তার এই বিদায় নেওয়া স্রেফ একটা ভান। বন পার হয়ে রাস্তায় পড়ল সে, তারপর রওনা হলো আধমাইল দূরে দেখে আসা একটা সরাইখানার উদ্দেশে। সরাইখানায় পৌঁছে দুপুরের খাবার খেল, তারপর দোতলার একটা ঘর ভাড়া করল। ঘরের জানালা থেকে রাস্তার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে। আঁদ্রের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ছে না। তবে তার ধৈর্যেরও কোনো শেষ নেই যেন। অবশেষে অপেক্ষা সার্থক হলো। নদীর ধার থেকে বন পার হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল একটা গাড়ি। আঁদ্রে চিনতে পারল, এটা রাসেলের গাড়ি। দশ মিনিট পর আরও একটা গাড়ি উঠল রাস্তায়, সেটা উর্সাসের।

.

সরাইখানার সামনে দিয়ে খানিক পরপর গাড়ি দুটো চলে গেল। আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পর রাস্তায় নেমে এল আঁদ্রে। ঘোড়া ছোটাল সে-ও, নেকড়ে-টানা গাড়িটাকে তার ধরতে হবে।

দূরে ওই দেখা যাচ্ছে গাড়িটা। কিন্তু না, খুব কাছাকাছি যাওয়াটা বোকামি হয়ে যাবে। প্যারিসে পৌঁছাতে হলে দুই দিন আর দুই রাত লাগবে ওদের। খাতাটায় কী আছে দেখার জন্য রাত দুটোকে কাজে লাগাতে হবে, সিদ্ধান্ত নিল আঁদ্রে। পথে কোথায় কোন হোটেলে রাসেল উঠবেন, এটা আন্দাজ করা তেমন কঠিন কাজ নয়, কারণ এদিকে ভালো হোটেলের সংখ্যা খুবই কম। সে নিজে আজ হোটেল দ্য ভেন্ডোমে, আর কাল হোটেল সিনক্লিয়ারে রাত কাটাবে বলে ঠিক করল। রুমভাড়া কত চেয়ে বসবে, কে জানে! তার টাকা পানির মতো খরচ হয়ে যাচ্ছে। তবে সে জন্য নিজেকে দুঃখ করতে নিষেধ করল আঁদ্রে। সাত ঘাটের পানি খাওয়া উকিল রাসেল সাহেবের ষড়যন্ত্র ফাঁস করা সম্ভব হলে যা খরচ হচ্ছে অ্যামেলিয়ার কাছ থেকে তার এক শ গুণ আদায় করা যাবে!

আঁদ্রে ভেবেছিল পরপর দুই রাত তাকে অভিযানে বেরোতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, তার সমস্ত প্ল্যান বরবাদ হয়ে গেল। পথে কি উসাস পেছন ফিরে তার ঘোড়াটাকে দেখতে পেয়েছিল? দেখে সাবধান হয়ে গেছে? তা না হলে একটা রাতও কোনো হোটেলে কেন উঠলেন না রাসেল? তাঁর আর উর্সাসের গাড়ি পরপর দুই রাতই এক জায়গায় পাশাপাশি থাকল। রাসেল গাড়ির ভেতরই ঘুমালেন। শুধু কি তা-ই? রাসেল যখন ঘুমালেন, পাহারা দেওয়ার জন্য জেগে থাকল উসাস। উল্টোটাও ঘটল—উসাস ঘুমাতে গেলে পাহারায় থাকলেন রাসেল। দুই রাতই ঘোড়ার পিঠে বসে মশার কামড় খেতে হলো আঁদ্রেকে।

তৃতীয় দিন সকালে প্যারিস শহরে ঢুকল আঁদ্রে। তার প্রথম কাজ হলো ঘোড়াটাকে বিক্রি করা। কেনার সময় দিতে হয়েছে দশ পাউন্ড, বেচার সময় পাওয়া গেল আট পাউন্ড। মাঝে ওটার পেছনে আরও দুই পাউন্ড খরচ হয়েছে। আঁদ্রের নিজের পেছনে ব্যয় হয়েছে চার পাউন্ড। তবে সান্ত্বনা পাওয়ার সেই একটাই উপায়—অ্যামেলিয়ার কাছ থেকে এক শ গুণ ফেরত পাবে।

আঁদ্রের দ্বিতীয় কাজ গোঁফ-দাড়ি খুলে ফেলে দেওয়া। তৃতীয় কাজ? পেমব্রোকের ঠিকানায় লেডি রাচেলের নামে একটা টেলিগ্রাম পাঠানো। তাতে লিখতে হবে : ‘বিপজ্জনক পরিস্থিতি। আপনাদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। সমস্ত খবর নিয়ে আমি আসছি।’

প্যারিসে রাসেলকে ঘাঁটানোর ইচ্ছা নয় আঁদ্রের। কারণ, এখানে দস্যু অ্যালারিক আছে। ফের যদি তার হাতে ধরা পড়ে আঁদ্রে, এবার আর মুক্তিপণ দেওয়ার মতো কাউকে পাওয়া যাবে না।

.

বিরল ঘটনা হলেও মানুষ বদলায় বৈকি। সেই বিরল ঘটনাই কি দস্যু অ্যালারিকের বেলায় ঘটেছে? সে কি সত্যি তাহলে বদলে গেছে? গিয়েলুমকে নিয়ে তার গোপন আস্তানায় হাজির হলো উর্সাস, অনেক দিন পর ভাগ্যবিড়ম্বিত সেই কিশোরকে দেখামাত্র অ্যালারিকের চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল। দুই হাতে মুখ ঢাকল সে, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে পড়ল, বসেই কাঁপতে শুরু করল থরথর করে।

দস্যু সরদারের এই অবস্থা দেখে রাসেলের কানে ফিসফিস করল উসাস, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ। দেখুন, কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।’

আইরিন ইতিমধ্যে ডিকে বুকে চেপে ধরে অন্দরমহলে চলে গেছে।

অ্যালারিক আর উর্সাসের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকে বসলেন রাসেল। আলোচনার শুরুতেই পরিষ্কার হয়ে গেল, ইংল্যান্ডের আইনকানুন সম্পর্কে উর্সাস বিশেষভাবে পরিচিত। এ বিষয়ে তার জ্ঞান লক্ষ করে রাসেল আর অ্যালারিকের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগল, এই ব্যক্তির আসল পরিচয় কী? জীবনযাপনের ধরন দেখে মনে হয় যাযাবর, দুর্গম সব গ্রামে তাঁবু ফেলে বুড়ো-বুড়িদের চিকিৎসা করে, দুই যুগ ধরে নিজের তৈরি ওষুধ বেচছে, অথচ ভুলেও কখনো নিজের অতীত সম্পর্কে একটাও কথা বলে না। তার বাড়ি কোথায়? কেন সে পথকেই নিজের ঠিকানা হিসেবে বেছে নিয়েছে? অ্যালারিক তাকে বহু বছর ধরে চেনে, কিন্তু তার মনেও এ সংশয় অনেকবার জেগেছে যে সমাজে নিজের যে পরিচয়টা তুলে ধরার চেষ্টা করে উসাস, সেটা তার আসল পরিচয় নয়। তবে অ্যালারিক নিজে তো আর শিক্ষিত লোক নয়, সম্ভ্রান্ত সমাজের সঙ্গেও তার কোনো সম্পর্ক কোনো কালে ছিল না, তাই উর্সাসের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য পরিমাপ করা তার দ্বারা সম্ভব হয়নি।

এই মুহূর্তে রাসেল সেটা আঁচ করতে পারছেন।

নামকরা এক হস্তরেখাবিদকে দস্য সরদারের আস্তানায় আনা হলো। অ্যালারিকের শিষ্যরাই তাঁকে আনল। না, ভদ্রলোককে ভয় দেখিয়ে আনা হয়নি, উপযুক্ত দক্ষিণা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে নিজেই তিনি আসতে রাজি হয়েছেন। হাতের ছাপ নেওয়ার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি লাগবে, সব তিনি সঙ্গে করে এনেছেন। এক দস্যুর হাত ধরে অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ পার হয়ে আসতে হয়েছে তাঁকে, চোখে পট্টি বাঁধা ছিল।

হস্তরেখাবিশারদ কয়েকটা কাগজে গিয়েলুমের হাতের ছাপ তুললেন। গিয়েলুমের মুখ দেখার উপায় নেই, তাকে একটা মুখোশ পরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ছাপ তোলার কাজ শেষ হলে ভদ্রলোককে আর্ল গুস্তাভের খাতাটা দেখানো হলো, বলা হলো, সদ্য তোলা ছাপগুলোর সঙ্গে খাতার ছাপগুলো যেন মিলিয়ে দেখেন। দুই প্রস্থ ছাপ পাশাপাশি রেখে দীর্ঘক্ষণ পরীক্ষা করলেন তিনি। তারপর একসময় মুখ তুলে বললেন, ‘আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছি না। এসবই এক ও অভিন্ন হাতের ছাপ।’

‘আপনি পুরোপুরি নিঃসন্দেহ?’ জানতে চাইলেন রাসেল।

‘হ্যাঁ। তবে আমার মতো আরও একজনকে এগুলো দেখান আপনারা। একা শুধু আমার রায়ে সন্তুষ্ট হবেন না। এ বিজ্ঞানে আমার চেয়েও নামকরা পণ্ডিত আছেন প্যারিসে, আমি তাঁদের নাম লিখে দিয়ে যাচ্ছি।

প্রচুর দক্ষিণা নিয়ে বিদায় হলেন ভদ্রলোক। একটু পর রাসেলও দুই প্ৰস্থ হাতের ছাপ নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। নাম ধরে ধরে শহরের সব পণ্ডিতের সঙ্গেই দেখা করলেন তিনি। চারজন তাঁরা। সযত্নে পরীক্ষা করার পর চার পণ্ডিতই রায় দিলেন, কোনো সন্দেহ নেই, সবগুলো ছাপ একই লোকের।

এখন তাহলে করণীয় কী?

রাসেলের অটল সিদ্ধান্ত, প্রাপ্য অধিকার গিয়েলুমকে ফিরে পেতে হবে। বন্ধুবর আর্ল গুস্তাভ তাঁর ওপর যে গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে গেছেন, তা সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হলে গিয়েলুমকে সম্ভাব্য সব রকমভাবে সাহায্য না করে তাঁর উপায় নেই। প্রশ্ন উঠল, গিয়েলুমকে উত্তরাধিকার পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা সফল হলে অ্যামেলিয়ার সাংঘাতিক ক্ষতি হয়ে যাবে নাকি?

মাথা নেড়ে রাসেল জানালেন, আসলে অ্যামেলিয়ার তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। কারণটাও তিনি ব্যাখ্যা করলেন। আর্ল গুস্তাভ যে উইল রেখে গেছেন, তাতে গোপন একটা শর্ত আছে। শর্তটা এরকম—আর্ল গুস্তাভের নিখোঁজ ছেলে যদি কোনো দিন ফিরে আসে, চেষ্টা করতে হবে অ্যামেলিয়ার সঙ্গেই যেন তার বিয়ে হয়। এরপর স্বভাবতই প্রাসঙ্গিক যে প্রশ্নটা উঠল, তার জবাব দেওয়া সহজ নয়। গিয়েলুম তো বিকলাঙ্গ ও কদাকার, অ্যামেলিয়া কি তাকে বিয়ে করতে রাজি হবে?

এর জবাব দিল উর্সাস, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে। ‘বিকলাঙ্গ স্বামীর চেয়ে কি অভাব ভালো? আমার ধারণা, অ্যামেলিয়া এ বিয়েতে রাজি হবে। তবে সুখী হবে কি না, সে আলাদা প্রসঙ্গ।

গিয়েলুম জমিদারি ফেরত পাবে, এতে কিন্তু উসার্স খুশি নয়। সে তার অসন্তোষ চেপেও রাখল না। বলল, ‘জমিদারি পেয়ে কী লাভ হবে তার? জাদুকরের তাঁবুতে কষ্ট পাচ্ছিল, আমার কাছে এসে আরামে আছে। আমি যত দিন বেঁচে আছি, ওর কোনো সমস্যা হবে না। আমি মারা গেলেও আমার গাড়িটা তো সে-ই পাবে। তত দিনে ওষুধ তৈরিটাও শেখা হয়ে যাবে তার। আমি বলতে চাইছি, নিজের খরচ চালাতে তার কোনো অসুবিধা হবে না। তা ছাড়া ডিও তো একদিন বড় হবে, তাই না? ডি যদি ওকে ভালোবেসে বিয়ে করে, তাহলে তো গিয়েলুমের সুখী না হওয়ার কোনো কারণ থাকে না।’ একটু থেমে আবার সে বলল, ‘সভ্য সমাজ কী জিনিস, তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। ওটা আসলে মানুষকে অমানুষ বানানোর কারখানা। কণ্টকশয্যাও বলা যায়। জমিদার আর অ্যামেলিয়ার স্বামী হয়ে যে নির্যাতন ভোগ করতে হবে তাকে, তাঁবুর জীবনের নির্যাতন মনে হবে তুচ্ছ।’

অ্যালারিক? এ ব্যাপারে সে কী ভাবছে?

নিজের মন নিজেই বুঝতে পারছে না অ্যালারিক। আর্ল গুস্তাভের ছেলে যে বেঁচে আছে, এ তো একমাত্র সে-ই প্রথম থেকে জানত। জাদুকরের তাঁবুতে নিজেই সে পাঠিয়েছিল ছেলেটাকে। উদ্দেশ্য ছিল, ডাকাতদের সান্নিধ্য থেকে দূরে রাখা। জাদুকরের তাঁবুতে অনেক দিন ছিল সে, তারপর পালিয়ে গেল। তার পালিয়ে যাওয়ার খবরটা জাদুকর প্রথমে অ্যালারিককেই জানায়। শুনে খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়েছিল অ্যালারিক। স্বস্তিবোধ করল উর্সাস যখন এসে বলল যে গিয়েলুম তার কাছে আছে। খুনিরা নিহত লোকের লাশ নিয়ে যেরকম অস্বস্তি বোধ করে, গিয়েলুমকে নিয়ে ঠিক সে ধরনের একটা অস্বস্তি আছে অ্যালারিকের মনে। সব সময় জানতে ইচ্ছা করে কোথায় আছে সে, কেমন আছে। নিশ্চিত হতে চায়, কেউ যেন তার পরিচয় জেনে না ফেলে। গিয়েলুমকে সে দূরে ঠেলে দিয়েছিল একটিমাত্র কারণে নয়। দ্বিতীয় কারণটি ছিল, ওর সঙ্গে তার যোগাযোগ ও সম্পর্ক কেউ যাতে আবিষ্কার করতে না পারে।

রাসেল মুখ ফুটে কিছু জানতে চাইছেন না, তবে বোঝা যায়, অ্যালারিক কী বলে শোনার অপেক্ষায় আছেন তিনি। কিন্তু তাঁকে অ্যালারিক কী পরামর্শ দেবে? বলবে মামলা করুন? কিন্তু মামলা করলে প্রধান সাক্ষী তো তাকেই হতে হবে, তাই না? আদালতে গিয়ে তার পক্ষে কি বলা সম্ভব যে সে-ই আর্ল গুস্তাভের একমাত্র সন্তানকে চুরি করেছিল, তারপর নাকে-মুখে অপারেশন চালিয়ে ছেলেটার মুখাবয়বে স্থায়ী হাসির ছাপ এঁকে দিয়েছে? এসব স্বীকার করার ফল কী দাঁড়াবে, সবাই তা জানে। অ্যালারিককে সারা জীবন জেলখানার ঘানি টানতে হবে।

আরও নানা দিক বিবেচনায় রাখতে হবে। এমন তো নয় যে জীবনে অ্যালারিক ওই একটামাত্র অপরাধ করেছে। নিজের হাতে তো বটেই, শিষ্যদের দিয়েও অসংখ্য ডাকাতি আর মানুষ খুন করেছে সে। আইনের হাতে নিজেকে একবার তুলে দিলে তার বিরুদ্ধে পুরোনো যত অভিযোগ আছে, সব একে একে বেরিয়ে আসবে। এর মানে হলো, জেল নয়, তার ফাঁসি হবে।

এই যখন পরিস্থিতি, রাসেলের কথা সমর্থন করে অ্যালারিক কীভাবে বলে গিয়েলুমকে অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মামলা করা হোক?

এসব কথা ভেবে রাসেলও গম্ভীর হয়ে আছেন। দস্যু সরদার অ্যালারিককে কীভাবে তিনি বলেন, যাও, ফাঁসির মঞ্চে চড়ো? তাকে কোর্টে গিয়ে সাক্ষী দিতে বলা আর ফাঁসিতে ঝুলতে বলা, একই কথা। প্রশ্ন হলো, অ্যালারিক ফাঁসিতে চড়তে রাজি হবে কিসের আশায়? তাতে তার লাভ কী?

আবার এ কথাও ঠিক যে অ্যালারিক সাক্ষী না দিলে মামলাটা হয়তো টিকবে না।

পরিস্থিতি গুরুতর, সেটা উপলব্ধি করতে পেরেই চুপ করে বসে আছেন রাসেল। অ্যালারিককে কোনো প্রশ্নই করছেন না। অপেক্ষায় আছেন, অ্যালারিক নিজে থেকে যদি কিছু বলে।

চেহারা থমথম করছে, ভুরু কুঁচকে বসে আছে অ্যালারিক। এই সময় পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল আইরিন, হাতছানি দিয়ে অ্যালারিককে ডাকল। তার কোলে ডিকে দেখা যাচ্ছে। আরও একটা জিনিস লক্ষ করল সবাই—আইরিন কাঁদছে, চোখজোড়া ভরে উঠেছে পানিতে।

ঘরের ভেতর অটুট হয়ে থাকল নিস্তব্ধতা। পর্দা সরিয়ে ভেতরে চলে গেল অ্যালারিক। মাত্র পাঁচ মিনিট পরই ফিরে এল সে। সবাই অবাক হয়ে দেখল, তার চোখেও পানি। ঠোঁটের কোণে একচিলতে বিষণ্ণ হাসি লেগে রয়েছে। ‘আইরিন বলছে, মামলা করা হোক। আমি…শুধু আমি নই, আমরা সবাই সাক্ষী দেব। আইরিন বলছে, আমাদের নাকি প্রায়শ্চিত্ত করার সময় হয়েছে।’ কথা শেষ করে গলা ছেড়ে হেসে উঠল অ্যালারিক। ‘বিশ্বাস করবেন, পুঁচকে ওই মেয়েটার জন্যই, ওই ডির জন্যই আজ এই পরিবর্তন আইরিনের? ডির ভূমিকা হলো, সে আমাদের মরা মেয়েটার স্মৃতি জাগিয়ে দিয়েছে। পাষাণ মন নরম করে দিয়েছে। অথচ আমাদের সেই মেয়ে যখন বেঁচে ছিল, কত-না অপরাধ করেছি আমি! আইরিন তখন আমাকে কিছুই বলেনি। মানুষের মন কী কারণে কখন বদলায়, কেউ বলতে পারে না!’

সেদিনই লন্ডনে ফিরে গেলেন রাসেল। ডি আর গিয়েলুমকে নিয়ে উর্সাসও একটা গ্রামের দিকে চলে গেল। সে অবশ্য প্রস্তাব দিয়েছিল, ডিকে আইরিন নিজের কাছে রেখে দিক।

আইরিনের কান্না তাতে আরও বেড়ে গেল। সে বলল, ‘না, আগে যখন ওকে নিজের কাছে রাখিনি, এখনো রাখব না। এখানের বাতাস বড়ই বিষাক্ত, ডি এখানে বাঁচবে না, শুকিয়ে যাবে—ঠিক যেভাবে আমাদের মেয়েটা শুকিয়ে গিয়েছিল।’

কাঁদতে কাঁদতেই ডিকে বিদায় দিল আইরিন।

পরদিন নিজের দলের সব কজন ডাকাতকে ডেকে সভা করল অ্যালারিক। তাদের সে বলল, ‘দল আমি ভেঙে দিচ্ছি। যার যেখানে খুশি চলে যেতে পারো তোমরা, তবে দূর কোনো দেশে গেলেই ভালো করবে। যার যত খুশি টাকাপয়সা আর সোনাদানা নিয়ে যাও। নতুন মহাদেশ আমেরিকা, বিশাল তার আয়তন, অথচ লোকজন নেই বললেই চলে—আমার ইচ্ছা, ওখানেই নতুন জীবন শুরু করো তোমরা। আমি চাই, অতীত ভুলে গিয়ে এখন থেকে সৎ জীবনকেই বেছে নেবে তোমরা। আমি জানি, এখানে থাকলে সৎ হওয়ার সুযোগ পাবে না।

ডাকাতদের কয়েকজন প্রস্তাব করল, ‘সরদার, আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন না!’

বিষণ্ণ হাসি ফুটল অ্যালারিকের ঠোঁটে। ‘কী করে যাই বলো, এখানে তো এখনো আমার কাজ শেষ হয়নি! কিন্তু সে কাজ যখন শেষ হবে, তখন আর আমার যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। সে জন্যই তো সময় থাকতে বিদায় নিচ্ছি তোমাদের কাছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *