দ্য ম্যান হু লাফস – ৪

‘অ্যালারিক, আমি তোমার কাছে এসেছি ক্ষমার অযোগ্য একটা অন্যায়ের বিচার চাইতে!’

উর্সাসের কথা শুনে বিচলিত হয়ে উঠলেন রাসেল। রহস্যময় এই হাতুড়ে ডাক্তার সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল প্রবল, কিন্তু সে যখন অ্যালারিকের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলতে চাইছে, তখন এখানে তিনি উপস্থিত থাকেন কীভাবে!

অথচ এই ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ারও উপায় নেই। আক্ষরিক অর্থে অ্যালারিকের আস্তানায় তিনি বন্দী হয়তো নন, তবে নজরবন্দী নিশ্চয়ই I আসন ত্যাগ করে দস্যু সরদারের মনোযোগ আকর্ষণ করলেন তিনি, বোঝাতে চাইলেন এখানে থাকতে অস্বস্তি বোধ করছেন।

অ্যালারিক কী বুঝল কে জানে, বলল, ‘আপনার সঙ্গে আরও কথা আছে আমার। আমি আমার জীবনদাতার সঙ্গে আলাপটা সেরে এখনি ফিরে আসছি। ততক্ষণ আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন।’

উর্সাসের হাত ধরল অ্যালারিক, তারপর পর্দা সরিয়ে অন্দরমহলের দিকে চলে গেল। একা বসে বসে অনেক কথা ভাবছেন রাসেল। ডেভিড ও আঁদ্রে এই আস্তানায় আছে, তার কোনো প্রমাণ এখনো তিনি পাননি। ওদের কি হোটেল বোবোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে? ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই, তার আগেই হোটেলে ফিরে যেতে পারলে সকল পক্ষের জন্যই সেটা ভালো হতো। দিনের আলোয় রাস্তায় বেরোলে লোকজনের চোখে পড়তে হবে, এমনকি পুলিশের নজরেও পড়তে হতে পারে। পুলিশ তো কোনো উপকারে আসবেই না, শুধু শুধু ঝামেলা সৃষ্টি করবে। আইনের দোহাই দিয়ে একের পর এক এমন সব প্যাচ কষবে, ফ্রান্স ত্যাগ করা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।

চিন্তায় বাধা পড়ল পর্দা সরিয়ে আইরিন ভেতরে ঢুকতে। ছোট্ট এক শিশুকন্যার হাত ধরে আছে সে।

রাসেলকে দেখে অপ্রস্তুত হলো আইরিন। ‘ও, আপনি এখনো আছেন! আমি ভেবেছিলাম ডেভিড আর আঁদ্রের সঙ্গে আপনিও বোধ হয় নিজেদের আস্তানায় ফিরে গেছেন।

‘ফিরে যেতে পারলে তো ভালোই হতো,’ ম্লান সুরে বললেন রাসেল। ‘তবে ডেভিড আর আঁদ্রে চলে গেছে শুনে খুশি হলাম।’

‘তারা বেশ কিছুক্ষণ আগেই রওনা হয়েছে। সঙ্গে সাবধানী লোকজন আছে, কাজেই চিন্তার কিছু নেই, নিরাপদেই হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসবে। মেয়েটি ভারি সুন্দর, তাই না?’

মেয়েটিকে ভালো করে দেখলেন রাসেল। সত্যি অসাধারণ সুন্দরী। এমন রূপবতী মেয়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসেও খুব বেশি দেখা যায় না। একেবারেই শিশু, বছর দুয়েক বয়স হবে। খানিক আগে অ্যালারিক কি এই শিশুর কথাই বলছিল?

শিশুটির পরনে মূল্যবান পোশাক। সন্দেহ নেই, কোনো ধনীর দুলালী। অনেকক্ষণ ধরে কান্নাকাটি করায় তার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। আইরিনের হাত ধরে টলমল পায়ে ভেতরে ঢুকেছে সে, চারদিকে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। অভিমানে ফুলে আছে ঠোঁটজোড়া, গলা থেকে মাঝেমধ্যেই অস্ফুট আওয়াজ বেরোচ্ছে, ‘মা! মা!’

‘আমাদের এক্স লোকটার মাথায় গোবর ভরা। ছোট বাচ্চাদের আস্তানায় তুলে আনার কর্মসূচি যে বাতিল করা হয়েছে, এটা সে বেমালুম ভুলে বসে আছে। দেখুন তো দেখি এখন একে নিয়ে কী ঝামেলায় পড়লাম আমরা! এক্স বলছে, মেয়েটিকে একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখে তুলে এনেছে। ও কোথায় থাকে, ওর মা-বাপ কে, এসব কিছুই সে জানে না। কী ফ্যাসাদেই না পড়া গেল!’

‘ফ্যাসাদ মনে করলেই ফ্যাসাদ,’ একটু রসিকতা করলেন রাসেল। ‘মেয়েটিকে তো পরি বললেই হয়, আপনিই ওকে মানুষ করুন না!’

আঁতকে উঠে আইরিন বলল, ‘অসম্ভব! আমরা ডাকাত, কোথায় কখন থাকি তার কি কোনো ঠিক আছে? নাহ্, মেয়ে পোষা আমাদের কাজ নয়। আগের দিন হলে সমস্যা হতো না, চাওয়ামাত্র বিক্রি হয়ে যেত। কিন্তু সে নিয়ম উঠে গেছে। অন্য কোনো উপায় নেই, রাস্তার মেয়েকে আবার রাস্তাতেই রেখে আসতে হবে।

‘বিক্রি করার নিয়ম উঠে গেল কেন?’ প্রশ্ন শুনে আইরিনের চেহারা ম্লান হয়ে গেল দেখে রাসেল বুঝতে পারলেন ভুল করে ফেলেছেন তিনি। অ্যালারিকের সেক্রেটারি না কেঁদেই ফেলে!

ভুলটা কীভাবে সংশোধন করবেন বুঝতে পারছেন না রাসেল। তবে তিনি কিছু বলার আগে আইরিনই মুখ খুলল, ‘শুধু বিক্রি নয়, বাচ্চা ছেলেমেয়েকে ধরে আনার সমস্ত কর্মসূচিই বাতিল হয়ে গেছে—আমার সন্তানটি মারা যাওয়ার পর থেকে।‘

রাসেল ভাবছেন, আইরিনের সন্তান মারা যাওয়ার সঙ্গে লাভজনক একটা ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার কী সম্পর্ক থাকতে পারে? আইরিনের কী এমন গুরুত্ব, সে তো দস্যু সরদার অ্যালারিকের সেক্রেটারি মাত্র! নাকি…

রাসেলের সন্দেহ হচ্ছে। আইরিন হয়তো শুধু সেক্রেটারি নয়। অ্যালারিকের সঙ্গে তার হয়তো বিয়ে হয়েছে। ওরা হয়তো স্বামী-স্ত্রী। তা যদি হয়, আইরিনের সন্তান মানে অ্যালারিকেরও সন্তান। এভাবে চিন্তা করলে গোটা ব্যাপারটার যুক্তিসংগত একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আইরিনের সন্তান মারা গেছে, শোনার পর দুঃখ প্রকাশ না করাটা অমানবিক হয়ে যায়। ‘সত্যি শুনে খুব দুঃখ পেলাম।‘

আইরিন শিশুটিকে নিয়ে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে তাকে কোলে তুলে নিয়েছে সে। কোলের আরাম পেয়ে শিশুটি আরও দু-একবার মাকে ডাকল, তারপর হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল।

চোখাচোখি হতেই আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ক্ষীণ একটু হাসল আইরিন। যে আইভরির তৈরি সিংহাসনে একটু আগে গা এলিয়ে বসে ছিল দস্যু সরদার অ্যালারিক, শিশুটিকে আলতোভাবে সেই সিংহাসনের নরম গদিতে শুইয়ে দিল সে, তারপর পাশে দাঁড়িয়ে নিশ্চলক চোখে তাকিয়ে থাকল লাবণ্যমাখা ঘুমন্ত মুখটির দিকে। শিশুমাত্রই ফেরেশতা, চেহারা থেকে স্বর্গীয় আলোর একটা আভা সারাক্ষণ বিচ্ছুরিত হয়। আইরিনের মনে হলো, প্রকাণ্ড একটা শ্বেতপদ্মের মতো লাগছে শিশুটিকে।

কিছুক্ষণ পর আবার সেই উসাসের হাত ধরেই ফিরে এল অ্যালারিক। জীবনদাতাকে প্রায় জোর করেই একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল সে, তারপর বলল, ‘শোনো আইরিন, মজার একটা ঘটনা বলি। ইনি আমার কাছে বিচার চাইতে এসেছেন। বেশ ভালো কথা। কিন্তু কার বিরুদ্ধে আন্দাজ করতে পারো? আমার বিরুদ্ধে!’ কৌতুক করার ভঙ্গিতে শুরু করলেও শেষ দিকে তার কণ্ঠস্বর আবেগে বুজে এল।

চোখ তুলে তাকিয়ে থাকল আইরিন। অ্যালারিকের আবেগ লক্ষ করে সে যেন বোবা হয়ে গেছে।

‘উনি একটা ছেলেকে কুড়িয়ে পেয়েছেন,’ নিজেকে সামলে নিয়ে নিজেই ব্যাখ্যা দিল অ্যালারিক। ‘ছেলেটার মুখের ওপর নিষ্ঠুর অপারেশন করা হয়েছে। ওনার জানা ছিল না যে কুকীর্তিটি আমারই। অন্য কোনো শয়তান এর জন্য দায়ী ভেবে আমার কাছে এসেছেন উনি, আমি যাতে সেই শয়তানকে ধরে এনে বিচার করি, জেরা করে জেনে নিই হতভাগ্য ছেলেটির আসল পরিচয়।’

অ্যালারিক এবার রাসেলের দিকে তাকাল। ‘ছেলেটার পরিচয় আমি জানি—ওঁকেও বলব, আপনাকেও বলব। বুঝতে পারছেন তো, মি. রাসেল, কোন ছেলের কথা বলছি আমি? খানিক আগে এর কথাই আপনাকে বলছিলাম—আর্ডেনের উদ্যানে জাদুকরের তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।

‘সে কি তবে…সে কি তবে….’ প্রবল উত্তেজনায় ও আবেগে প্রশ্নটা শেষ

করতে পারলেন না রাসেল।

অ্যালারিকের গম্ভীর কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল, ‘হ্যাঁ, সে-ই।’

নিজের সিংহাসন শিশুর দখলে, অ্যালারিককে বসতে হলো একটা সোফায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সে, তারপর হঠাৎ শুরু করল, ‘অভিশপ্ত ওই পেমব্রোক বংশের কথা আমি একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। বড়াই করে অপদার্থ ডেভিডটা নিজের পরিচয় দিতে আবার সব মনে পড়ে গেল। ভাবলাম, এরকম একটা সুদর্শন ভাঁড়কে আর্লের উঁচু পদে তুলে না দিয়ে গুস্তাভের নিখোঁজ ছেলেটাকে বাপের আসনে বসালে সব দিক থেকে সেটাই হবে উত্তম কাজ। মি. রাসেল, সে জন্যই আপনাকে এখানে ডেকে আনা হয়েছে। খানিক আগে বলেছি বটে যে নিখোঁজ ছেলেটার সন্ধান দিন কয়েক আগে হলে দিতে পারতাম আপনাকে, আজ পারি না। কথাটা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি। এখন বলছি….

‘এখন আপনি বলছেন যে সেই ছেলেটা আপনার জীবনদাতা মি. উর্সাসের কাছে আছে, এই তো?’ অ্যালারিককে থামিয়ে দিয়ে বললেন রাসেল। ‘আপনি আরও বলতে চাইছেন, ছেলেটার নাক-মুখ-ঠোঁট কাটা, কিংবা ওগুলো হয়তো তার নেইই। এবং আপনি চাইছেন ছেলেটাকে আমি যেন পেমব্রোকের আর্ল হিসেবে অভিষিক্ত করি। এই দায়িত্ব আমাকে দিলে সত্যি আমি কৃতজ্ঞবোধ করব। মি. অ্যালারিক, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ কথাগুলো বেশ গুছিয়ে বললেন তিনি, তবে বলার ভঙ্গিতে তিক্ততার সুর চাপা থাকল না।

অ্যালারিকের ঠোঁটের কোণে ক্রূর একটু হাসি ফুটল। ‘ভেবে দেখুন তো, মি. রাসেল, এই সুখবরটা আগেই যদি শোনাতাম আপনাকে, আপনি কি তাহলে মুক্তিপণের টাকাটা আমাকে দিতেন?’

রাসেল রীতিমতো চমকে উঠলেন। ব্যাপারটা এভাবে তিনি চিন্তা করে দেখেননি। কথাটা তো মিথ্যে নয়! এখন তো পেমব্রোকের সঙ্গে ডেভিডের কোনো সম্পর্কই নেই। নেই অ্যামেলিয়ারও কোনো সম্পর্ক। গিয়েলুম বেঁচে থাকায় ওদের আর কোনো গুরুত্বই রইল না। ইশ্, পেমব্রোক জমিদারির এক রাশ টাকা স্রেফ পানিতে ফেলা হলো!

তাঁকে অ্যালারিকই সান্ত্বনা দিল। ‘আপনি ধরে নিন ডেভিডের মুক্তিপণ দেননি, দিয়েছেন গিয়েলুমের মুক্তিপণ, তাহলেই আপনার মনে আর কোনো খেদ থাকবে না।

রাসেল গম্ভীর সুরে বললেন, ‘গিয়েলুমের এত বড় অপূরণীয় ক্ষতি করলেন, তারপর আবার মুক্তিপণ চান কীভাবে?’

‘কিন্তু আমার যে ক্ষতি আর্ল গুস্তাভ করেছিলেন, সেটা কি পূরণীয় ছিল, মি. রাসেল?’ হঠাৎ রেগে উঠে জিজ্ঞেস করল অ্যালারিক

অ্যালারিককে রাগিয়ে দেওয়া রাসেলের উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ, এখনো তিনি অ্যালারিকের হাতে বন্দীই বলা যায়। দস্যু সরদারকে হঠাৎ এভাবে গর্জে উঠতে শুনে হতভম্ব হয়ে পড়লেন তিনি, প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন।

তাঁকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এল উসাস। গলা চড়িয়ে নয়, ঠান্ডা নীরস স্বরে অ্যালারিককে সে বলল, ‘অন্যায় দিয়ে অন্যায়ের, অত্যাচার দিয়ে অত্যাচারের বিহিত হয় না। আর তা ছাড়া, কোনো শিশুর ওপর নির্যাতন করা হলে কেউ তা সমর্থন করবে না। বুঝলাম, তোমার ওপর অত্যাচার হয়েছিল। কিন্তু তা যতই ভয়ানক হোক, অপূরণীয় ছিল না। শার্ট খুলে দেখো, অস্পষ্ট কয়েকটা দাগ ছাড়া সে অত্যাচারের আর কোনো চিহ্ন তুমি খুঁজে পাবে না। আর বেচারা গিয়েলুমের কথা চিন্তা করো। তার ওপর এমন নির্যাতন তুমি করেছ, মানুষের সমাজে ফিরে যাওয়ার অবস্থাও রাখোনি। অথচ সে তোমার কোনো ক্ষতি করেনি। ক্ষতি যা করার করেছিল আর্ল গুস্তাভ, তার বাপ। বাপের অপরাধের শাস্তি ছেলে ভোগ করবে, এটা কোনো যুক্তির কথা নয়। আমার তো মনে হয় না, ঈশ্বর তোমার এই অপরাধ সহজে ক্ষমা করবেন।’

যে দস্যুর নাম শুনলে ফ্রান্সের লোকজন ভয়ে কাঁপতে থাকে, সেই অ্যালারিক দ্য গথ ধীরে ধীরে মাথা নত করল। একটা কথাও সে বলতে পারছে না। কে বলবে লজ্জায়, নাকি অনুতাপে।

শুরু করার পর উসাস থামছে না। এতক্ষণে তার নজর পড়েছে সিংহাসনে ঘুমন্ত শিশুটির ওপর। ‘ওই দেখো, আরেকটা! অ্যালারিক, তুমি না জানিয়েছিলে বাচ্চাদের তুলে এনে বিক্রি করার ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছ? তাহলে এই শিশু এখানে কেন? অ্যালারিক! ওহ্, অ্যালারিক! সেবা-যত্ন ও চিকিৎসা দিয়ে তোমাকে সুস্থ করে তোলাটা তাহলে কি আমার ভুল হয়েছে? সত্যি আমার অনুতাপ হচ্ছে, অ্যালারিক!’

উর্সাসের কথাগুলো চাবুকের চেয়েও যেন নির্মম। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হচ্ছে অ্যালারিক, কিন্তু এক চুল নড়ছে না। তার হয়ে কথা বলার জন্য এগিয়ে এল আইরিন। উর্সাসের পাশে এসে দাঁড়াল সে, হাত রাখল তার চেয়ারের পিঠে। গলাটা নরম, বলার ভঙ্গিতে মিনতিভরা আবেদন। ‘আমাদের সরদার আপনাকে সত্যি কথাই জানিয়েছিলেন। বাচ্চাদের নিয়ে ব্যবসা করা পাপ, তাই আমাদের দল এই ব্যবসা অনেক দিন আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু আমাদের এক বোকা সদস্য সেই নিষেধাজ্ঞার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে রাস্তায় একা কাঁদতে দেখে এই মেয়েটিকে আস্তানায় নিয়ে এসেছে। চুরি করে আনলে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হতো। কিন্তু তা সে আনেনি। সে যা-ই হোক, এখন মেয়েটিকে নিয়ে আমরা কী করব…’

অনেকক্ষণ পর অ্যালারিক মুখ খুলল। সে কথা বলছে হৃদয়ের গভীর থেকে। ‘আইরিন, এ নিয়ে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না। তোমাকেও না, আমাকেও না। বিশ্বাস করো, সব সমস্যার সমাধান পাওয়া গেছে। যিনি নিরাশ্রয়ের আশ্রয়, তিনি স্বয়ং যখন আমার আস্তানায় হাজির হয়েছেন, তখন আর চিন্তা কী। চাবুকের আঘাতে মুমূর্ষুকে যিনি আশ্রয় দেন, কুৎসিত হাসির ছাপমারা চেহারা নিয়ে পালানোর সময় কোনো ছেলেকে যিনি কোলে টেনে নেন, এই নিষ্পাপ শিশুটিও তাঁর কাছে নিরাপদে মানুষ হবে। আমি? আমার কথা তোলো না। একজন দস্যুর জীবনের নিশ্চয়তা কী? পুলিশের হাতে ধরা পড়লে আজই আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হতে পারে। তা ছাড়া দস্যুর প্রাণে স্নেহ কোথায়? স্নেহ ছাড়া কি একটা শিশু বাঁচতে পারে? মহৎ প্ৰাণ উসাস, মেয়েটিকে দয়া করে আপনিই সঙ্গে করে নিয়ে যান। আপনার গাড়িতে মানুষের সংখ্যা বেশি হয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আর্ল গিয়েলুম কয়েক দিনের মধ্যেই ইংল্যান্ডে চলে যাবে জমিদারির দখল নেওয়ার জন্য, তখন আর কোনো অসুবিধা হবে না।

.

উর্সাসের গাড়ি রয়েছে আমেন্ডিয়ায়, একটা গোলাঘরে। গোলাঘরটির মালিক জ্যাকস। সে নানাভাবে উর্সাসের কাছে ঋণী। লোকটা উর্সাসের কোনো উপকার করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে। উসাসের গাড়ির সঙ্গে গিয়েলুমও রয়েছে।

গিয়েলুমকে দেখে ভয় ও বিস্ময়ে পাথর হয়ে গিয়েছিল জ্যাকস। সে ভয় আর বিস্ময় এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার বিশ্বাস, এমন কুৎসিত জীব কখনো মানুষ হতে পারে না। এ নিশ্চয়ই মানব ও দানব, উভয়ের সংমিশ্রণে তৈরি কোনো আজব প্রাণী। তার ধারণা হলো, এই বিদঘুটে প্রাণীর নিশ্চয়ই অলৌকিক অনেক গুণ বা শক্তি আছে।

উর্সাসকে নিয়ে গোটা এলাকায় অনেক প্রশ্ন, অনেক রহস্য আছে। অনেকেই তাকে ভয় পায়। সামনে পড়ে গেলে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে। তার পরিচয় সম্পর্কে কারোরই পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। কে লোকটা? কী কারণে সারা দেশ চষে বেড়ায়? স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই তার? আত্মীয়স্বজন, ছেলেপুলে, স্ত্রী—কিছুই কি নেই? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায় না। ফলে উসাসকে ঘিরে রহস্য শুধু বাড়তেই থাকে। সেটা নতুন করে আরেক দফা বাড়ল উর্সাসের সঙ্গে গিয়েলুমকে দেখে। গিয়েলুম—যার মুখের চিরস্থায়ী হাসি নরকের রাজা লুসিফারের বীভৎস হাসির কথাই মানুষকে মনে করিয়ে দেয়।

জ্যাকসের গোলাঘরটা বেশ বড়ই। গাড়ি রাখার পরও অনেকটা জায়গা খালি পড়ে আছে। গিয়েলুম অবশ্য গাড়ির ভেতরই শোয়। খাবার বলতে দুটো রুটি আর এক কলস পানি রেখে এসেছে উসাস, সঙ্গে অল্প কিছু ফলমূল।

তবে হোমোর কথা আলাদা। তার মাংস না হলে চলবে না। সে ব্যবস্থাও করে রেখে গেছে উসাস।

গাড়ি ছেড়ে কখনো কোথাও যায় না উর্সাস। এবার বাধ্য হয়েই প্যারিসে আসতে হয়েছে তাকে। গাড়ির সঙ্গে সবই ফেলে এসেছে সে, শুধু একটা জিনিস বাদে। এই জিনিসটার জন্যই চোরকে ভয় পায় উসাস। ছোট একটা পোঁটলা। পোঁটলায় আছে কিছু কাগজ আর কাপড়। কাপড়গুলো শিশুর পোশাক। আমেন্তিয়া থেকে প্যারিসের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় গাড়ির গোপন খুপরি থেকে পোঁটলাটা বের করে বুকের কাছে লুকিয়ে রাখে সে।

এবার অ্যালারিকের কাছ থেকে উর্সাসের বিদায় নেওয়ার পালা। বুকের কাছে লুকিয়ে রাখা পোঁটলাটা বের করল সে। ‘অ্যালারিক, স্মরণ করো। এই কাপড়ের কথা মনে পড়ে তোমার? বহু বছর আগে এগুলো আমার কাছে জমা রেখেছিলে তুমি।’

পোঁটলাটা দেখেই কেমন যেন চমকে উঠল অ্যালারিক। তারপর ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। ‘হ্যাঁ, কেন মনে পড়বে না! পুলিশের তাড়া খেয়ে কখন কোথায় পালাতে হয় তার ঠিক নেই, তাই ওগুলো আমার কাছে রাখা নিরাপদ নয় ভেবে আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। গিয়েলুম যে গুস্তাভেরই সন্তান, ওগুলো তারই প্রমাণ। তখন অবশ্য ভাবিনি গিয়েলুমের কাজে লাগাব। ওগুলো রেখেছিলাম ভবিষ্যতে মুক্তিপণ আদায়ে কাজে লাগবে ভেবে। কিন্তু তারপর গুস্তাভ মারা গেলেন, ফলে আমার আর মুক্তিপণ আদায় করা হলো না। মুক্তিপণ না পেয়ে ছেলেটার অঙ্গহানি ঘটিয়ে আমি আমার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করলাম।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। অ্যালারিক যে অপরাধবোধে কষ্ট পাচ্ছে, তা তার চেহারা দেখেই বোঝা গেল।

‘এগুলো কি এখনো আমার কাছে থাকবে?’ জানতে চাইল উসাস।

‘না। যার কাছে এই প্রমাণগুলো সবচেয়ে নিরাপদে থাকবে, ওগুলো যার কাছে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান, নেহাত ভাগ্যগুণে তিনি নিজেই আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন। হ্যাঁ, আমি মি. রাসেলের কথাই বলছি। পোঁটলাটা ওঁর হাতে দিন। গিয়েলুমকে আর্ল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ওগুলো তাঁর খুবই প্রয়োজন।’

হাত বাড়িয়ে পোঁটলাটা নিলেন রাসেল। তাঁর চোখে-মুখে সন্দেহ। পোঁটলাটা উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করছেন। তারপর তিনি থেমে থেমে বললেন, ‘অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটছে যে আমি আমার বুদ্ধি আর বিচারশক্তি ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারছি না। এখন আমার কী করণীয়? করণীয় যখন স্থির করতে…’

অ্যালারিক বাধা দিয়ে বলল, ‘আপনি সমস্যায় পড়ে দিশেহারা বোধ করছেন, এটা খুবই স্বাভাবিক। এরকম উল্টাপাল্টা ঘটনা ঘটলে কে-ই বা সুষ্ঠুভাবে চিন্তা করতে পারে! ডেভিড অপদার্থ হলে কি হবে, সে সুদর্শন। নাচ জানে, তলোয়ার চালানো শিখছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, অ্যামেলিয়া তাকে বিয়ে করতে রাজি। একবার তাকে যদি আর্ল হিসেবে ঘোষণা করা যায়, বেমানান হয়েছে বলে অভিযোগ করতে পারবে না কেউ। আর গিয়েলুম? তার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উল্টো। কুৎসিত, হাস্যকর, ভয়াবহ একটা মুখ। মানুষ বলে তাকে ভাবাই যায় না। লেখাপড়া? ডেভিডের তুলনায়ও কম জানে সে, আকাট মূর্খই বলতে হবে। জাদুকরের কাছে যখন ছিল, নাচ হয়তো শিখেছে, তবে শুধু বোধ হয় তারের ওপরই নাচতে পারে। কিন্তু ক্লাব, হোটেল বা পার্টিতে লর্ড আর লেডিরা যে নাচ নাচেন, তা তো আর তারের নাচ নয়! সবাই জানে, ডেভিডকে বাদ দিয়ে গিয়েলুমকে বিয়ে করতে কোনোভাবেই রাজি হবে না অ্যামেলিয়া। কাজেই যা সব দিক থেকে সুন্দর ও মানানসই, তা ঘটতে না দিয়ে উল্টোটা ঘটাতে হবে শুনে মি. রাসেল স্বভাবতই ঘাবড়ে গেছেন।

এত কথা বলে অ্যালারিক যে তাঁকে খানিকটা বিদ্রূপ করল, রাসেল সেটা বুঝতে পারলেন। রাগ হলো তাঁর। পরিবেশ ভুলে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন, এই সময় তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এল উসাস।

কঠিন সুরে অ্যালারিককে সে বলল, ‘তোমার সত্যি লজ্জা হওয়া উচিত, অ্যালারিক। যে অপরাধ তুমি করেছ, তার ক্ষমা হয় না। নিষ্পাপ একটি শিশুর জীবন তুমি ধ্বংস করে দিয়েছ। সেই চুরমার হওয়া জীবনটাকে জোড়া লাগিয়ে আবার স্বাভাবিক করার দায়িত্ব নিতে যেকোনো মানুষ ভয় পাবে। মি. রাসেলের সন্দেহ আর দ্বিধার মধ্যে নিন্দনীয় আমি কিছু দেখি না। এসব তিনি ঝেড়ে ফেলে সততার পরিচয় দেবেন, তার চরিত্রে সে দৃঢ়তা আছে, এটা আমি বিশ্বাস করি বলেই প্রমাণগুলো তাঁর হাতে তুলে দিয়েছি। এরপর দেখা যাবে গিয়েলুমের ভাগ্যে কী আছে।’

আর কারও কিছু বলার নেই। বিদায় নেওয়ার সময় রাসেল জানালেন, দু-একদিনের মধ্যে করণীয় স্থির করার পর অ্যালারিককে তিনি খবর দেবেন। একটা কাগজে বড় এক পুলিশ কর্মকর্তার নাম-ঠিকানা লিখল অ্যালারিক, কাগজটা রাসেলের হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, এই ভদ্রলোকের মাধ্যমে খবর পাঠালে যথাসময়ে পেয়ে যাবে সে। তবে কর্মকর্তা ভদ্রলোকের নামে কোনো চিঠি লিখতে নিষেধ করে দিল। তার বাড়িতে ঝুড়িভর্তি উপহার পাঠালেই ভালো হয়, ঝুড়ির গায়ে এক টুকরো কাগজ সাঁটা থাকবে, তাতে লিখতে হবে : ‘সেইন্ট গিয়েলুমের আশীর্বাদ গ্রহণ করুন’। তাহলেই হবে। ঝুড়িটা ভদ্রলোক নিজের জন্য রাখবেন, কাগজটা পাঠাবেন অ্যালারিকের এক ইনফরমারের কাছে, এই ইনফরমার তথ্য সংগ্রহের জন্য রোজই একবার দেখা করে তাঁর সঙ্গে। কাগজটা অ্যালারিকের হাতে পৌঁছালে সে জানবে গিয়েলুমকে পেমব্রোকের আর্ল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছেন রাসেল।

‘দায়িত্ব নিলেই যে খুব তাড়াতাড়ি সফল হব, সে আশা না করাই ভালো, ‘ বললেন রাসেল। ‘এ এক কঠিন সমস্যা। কাজে নামতে হবে আটঘাট বেঁধে, অত্যন্ত সাবধানে। মাঝখানের সময়টা গিয়েলুমকে নিরাপদে রাখার দায়িত্ব আপনারা নিন। আমি যত দিন না সবুজ সংকেত পাঠাই, ওর অস্তিত্ব বা ওর সম্পর্কে কোনো তথ্য বাইরে যেন প্রকাশ না পায়। লোকে যদি জানতে পারে গিয়েলুম ইংল্যান্ডের অতি সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত বংশের সন্তান ও উত্তরাধিকার, তাহলে তাঁর জীবনের ওপর হামলাও হতে পারে।’

অ্যালারিকের শিষ্য জেড চোখ বেঁধে আবার সেই শ্যেন নদীর তিন নম্বর ব্রিজের ওপর পৌঁছে দিল রাসেলকে।

বিদায় নিল উসাসও, তাকে সুড়ঙ্গপথ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এল আইরিন। তার আসার কারণ হলো, উর্সাসের সঙ্গে সেই শিশুকন্যাটি রয়েছে। বিদায় দেওয়ার সময় নিজের মৃত কন্যার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এল তার।

উর্সাসের কোলে তাজা ফুলের মতো সুন্দর শিশুটিকে দেখে গোলাঘরের মালিক লোকটা তো অবাক। শুধু যে বিস্মিত হলো তা নয়, আনন্দিতও হলো। জানতে চাইল, ‘এটাকে কোত্থেকে নিয়ে এলেন? এর নাম কী?

‘আপাতত আমি ওর নাম রেখেছি ডি। ডি মানে কী, জানো? দেবতা। আমাদের মধ্যে একজন পশু আছে, সে আমি—উসাস মানে ভালুক। একজন মানুষও আছে, সে হলো ওই নেকড়েটা–হোমো মানে মানুষ। আর দেবতা হলো এই মেয়েটি—ডি মানে দেবতা। কিন্তু তুমি? তুমি যে কী, এখনো তা আমার জানার সুযোগ হয়নি। হলে তোমারও একটা উপযুক্ত নাম ঠিক করব।‘

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *