ইতিহাস গল্প বলে – সংকলন ও সম্পাদনা : অশোককুমার মিত্র
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : চন্দন বসু
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি, ২০১৮
প্রকাশক : শিশু সাহিত্য সংসদ প্রা. লি.
.
উৎসর্গ
দিদি,
সুভদ্রা গুহমজুমদারের পুণ্যস্মৃতিতে
.
ইতিহাসের উপাদান নির্ভর ছোটো গল্প নিয়ে এই সংকলন৷ এখানে ঐতিহাসিক তথ্য যত না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার গল্পের মালমশলা৷ এই জন্য ধর্ম নয়, ওল্ড টেস্টামেন্ট পাঠকের কাছে তার ছোটো ছোটো গল্পের জন্য আজও প্রিয়, গ্রিক ঐতিহাসিক, ইতিহাসের জনক নামে যিনি খ্যাত, সেই হেরোডটাসের Histories গ্রন্থে এরকম ছোটো ছোটো গল্পের বিপুল সমাবেশ দেখা যায়-এক্ষেত্রে ইতিহাস নয়, গল্প লেখার মুনশিয়ানায় হেরোডটাস এক শ্রেণির পাঠকের মন জয় করেছেন৷ যদিও তাঁরা (ওল্ড টেস্টামেন্টের লেখকরা ও হেরোডটাস) তখনও জানতেন না ছোটো গল্প সাহিত্যের একটি রূপ৷
এইরকম ইতিহাসের আখ্যানধর্মী অংশকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে সাহিত্যের কারিগররা আধুনিক যুগে গল্প, উপন্যাস লিখে আমাদের সাহিত্য-পিপাসা মেটাচ্ছেন৷ এতে অ্যাডভেঞ্চার, শৌর্যবির্য, দেশাত্মবোধ, আত্মত্যাগের গৌরবময় মানবগুণের সমাহার ঘটেছে৷ এই সমাহারের শক্তিতেই ইতিহাসের গল্প অতীতের অন্ধকার থেকে উঠে এসে বর্তমানকে আলোকিত করতে, প্রাণ-প্রণোদনায় উজ্জীবিত করতে তাই অতুলনীয়৷
এই সংকলন এমনই সব ঐতিহাসিক গল্প অনেক পরিশ্রমে সংগ্রহ করে এনেছেন শ্রীঅশোককুমার মিত্র মহাশয়৷ সংকলনটির একটি সার্থক রূপ দিতে তাঁর উৎসাহ ও উদ্দীপনার কোনো অভাব দেখিনি৷ তাঁকে ধন্যবাদ৷ পাঠকের দরবারেও তাঁর ধন্যবাদ পাওনা হলে আমাদের শ্রম সার্থক৷
দেবজ্যোতি দত্ত
.
ইতিহাসের আভিধানিক অর্থ হল-অতীত কাহিনি, মানে পুরোনো দিনের কথা৷ কিন্তু আমরা যে কথা শোনাতে চাইছি তা কত পুরোনো? যখন এই পৃথিবী গ্রহের সৃষ্টি হল সেই সময়ের? নাকি, অত পুরোনো কথা নয়৷ তবে কি যেদিন এ গ্রহে প্রথম প্রাণের দেখা মিলল, সেই দিনের? না, তাও নয়, তবে যেদিন প্রথম মানুষ নামক প্রাণীটির আবির্ভাব হল২-নানা বিবর্তনের ফলে হাজার হাজার বছর আগে-সেদিনের কথাও নয়৷ এ সব নাহয় প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা৷ তবে কি যেদিন সভ্যতার উদয় হল আগুন জ্বালিয়ে, পাথরের চাকা গড়িয়ে, নদীতে ভেলা ভাসিয়ে? না এ গল্পমালায় সেদিনের গল্পও নেই৷ পাথর ঘষে তীক্ষ্ণ অস্ত্রধারী মানুষের কথাও নয়৷ ধাতু আবিষ্কার করা, চাষ-আবাদ করা, সমাজবদ্ধ উন্নত মানুষের কাহিনিও এই ইতিহাসের গল্পে নেই৷ অথচ সেসবকালের কত গল্প তো এখন মানুষের ঝুলিতে জমেছে৷ এমনকী গোটা বিশ্বের ইতিহাসের গল্প গাঁথার উচ্চাকাঙ্খা আমাদের নেই, অন্তত এই প্রকল্পে তো নেই-ই৷ এখানে রয়েছে বৃহত্তর ভারতের ভৌগোলিক সীমানার চৌহদ্দিতে বুদ্ধদেবের জীবনকালের কথাতে শুরু হয়ে ভারতে নৌবাহিনীর বিদ্রোহ-এই সময়কালের মধ্যে ঘটে যাওয়া গল্পের টুকরো৷
এই সীমার সীমাবদ্ধতার ভেতরে আমাদের গল্প-সন্ধান করতে হয়েছে, নির্বাচন করতে হয়েছে৷ আর, এই কাজ করার সময়ে আমরা রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস ভাবনার কথা মনে রেখেছি৷ ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন-ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি . . . তাহা নিশীথকালের এক দুঃসহ কাহিনিমাত্র৷ কোথা হইতে কাহারা আসিল, কাটাকাটি মারামারি করিয়া গেল . . . এই রক্তবর্ণে রঞ্জিত পরিবর্তমান স্বপ্ন দৃশ্যপটের দ্বারা ভারতবর্ষকে দেখিলে যথার্থ ভারতবর্ষকে দেখা হয় না৷ . . . ঝড়ের দিনে ঝড়ই যে সর্ব প্রধান ঘটনা, তাহা তাহার গর্জন সত্ত্বেও স্বীকার করা যায় না- সেদিনের সেই ধূলি সমাচ্ছন্ন আকাশের মধ্যে পল্লির গৃহে গৃহে যে জন্ম মৃত্যু-সুখদুঃখের প্রবাহ চলিতে থাকে, তাহা ঢাকা পড়িলেও মানুষের পক্ষে তাহাই প্রধান৷
এই সংকলনে গল্প নির্বাচনে চিন্তক রবীন্দ্রনাথের ভাবনা সতত আমাদের পথ নির্দেশ করেছে৷ ইতিহাসের গল্প হলেও অস্ত্রের ঝনঝনানি কখনো প্রাধান্য পায়নি, যতখানি পেয়েছে সাধারণ মানুষের কথা৷ বুদ্ধদেব রাজমহিষীর আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন প্রত্যাখ্যান করে পথের ভিক্ষুণী পুণ্যাদেবীর ভিক্ষা নেবেন ভগবান তথাগতের এ ব্যবহার প্রত্যাশিত, কিন্তু মৃগয়াবিলাসী আকবর অরণ্য মধ্যে হরিদাস স্বামীর সংগীতের মূর্ছনায় আবিষ্ট হয়ে তাঁর বাঞ্ছিত শিকার ছেড়ে ভিন্ন জগতে পৌঁছেছিলেন৷ সে কাহিনি পাঠ, পাঠকের অভিনব প্রাপ্তি৷ আবার রণনিপুণ আকবরের সুনিপুণ ও বলশালী হস্তী বাহিনীকে কৌশলে পরাভূত করার সরস কাহিনিও এ গল্পমালার একটি রত্ন৷ আর আছে প্রবল প্রতাপান্বিত ঔরঙ্গজেবের এক মানবিক কাহিনি, যা মনকে প্রসন্ন করে৷
তবে কি এতে প্রকৃত যুদ্ধের গল্প নেই? অবশ্যই রয়েছে৷ রয়েছে ভারতের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনানী ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়ের শৌর্যদীপ্ত প্রত্যাঘাতের কথা৷ রয়েছে শিবাজির সহযোগী অসম সাহসী সেনাপতি তানাজির কর্ণগড় জয়ের কথা৷ রয়েছে সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত বনবাসী সাঁওতালদের কথা-যারা দেশি-বিদেশি লোাভি হাঙরদের নিরন্তর শোষণে দিশেহারা হয়ে বিদ্রোহ করেছিল, সেই শাল পাতার ডাক-এর গল্প৷ আর আছে ভারতের শেষ স্বাধীনতা সংগ্রাম আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াইয়ের একটুকরো ছবি৷
আছে রামধনু আঁকা জীবনের পরতে পরতে কত রঙের খেলা৷ বাংলার সমাজ জীবনে ও রাষ্ট্রীয় শাসনে একদা নৈরাজ্যেরকালে সুরাজের আশায় দেশের মানুষ গোপালকে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের পর, তাঁর কৃতিত্বে দেশে সুশাসনের ফুল ফুটলে তিনি স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করে সাধারণ জীবনে ফিরে যান৷ এই অনুপম কাহিনি, যা মনে করিয়ে দেয় আবহমান বাঙালি জীবনের সারল্যের কথা৷ বাংলার ডাকাতের একাধিক গল্প সংকলিত হয়েছে যাতে তাদের নৃশংস, ভয়াল জীবনের কথা নেই, রয়েছে তাদের মানবিকতার কাহিনি৷ বুঝি-বা সত্যিকারের রবিন হুড!
নির্দিষ্ট কাল সীমাকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করে ইতিহাসের গুরুত্বে সেই পর্যায়ের গল্প সংখ্যা গ্রন্থিত করা ছিল আমাদের লক্ষ্য৷ তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছু গল্প আমরা সংকলিত করতে পারিনি৷ আর, একজন লেখকের একটিমাত্র গল্প আমরা গ্রহণ করব এই নীতিও একাধিক গল্প গ্রন্থিত করার ক্ষেত্রে একটি বড়ো বাধা হয়েছে৷
তবে, যখন পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত সম্পূর্ণ হয়েছে তখন লেখক তালিকার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়েছি এ কথা ভেবে যে, এতজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক, অধ্যাপক, গবেষক, প্রবীণ ও সদ্যনবীন সাহিত্যিকদের রচিত ইতিহাসের গল্প হয়ে উঠেছে এক রত্নমালা, দু-মলাটের ভেতরে আমরা তা বন্দি করেছি৷
রচনা বিন্যাসের পদ্ধতিটি সংকলন গ্রন্থের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ ‘ইতিহাস গল্প বলে’-এ সংকলনে রচনা সমূহ বিন্যস্ত হয়েছে গল্পের ঘটনার কালক্রমে৷ ফলে কোনো অখ্যাত তরুণের গল্পও প্রথম দিকে চলে এসেছে, প্রবীণ ও প্রখ্যাতদের পিছনে ফেলে৷
আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন৷ কোনো কোনো রচনা বিরাট আখ্যান থেকে প্রয়োজনীয় অংশ তুলে দেওয়া৷ যেমন অগ্নি মিত্রের লেখা নীলকর ফেডি ও ডাকাত বিশ্বনাথ৷ এই আখ্যানটি অগ্নি মিত্রের বিখ্যাত উপন্যাস ‘আপোষ করিনি’-র একটি অধ্যায়৷
এই সংকলনের কথা প্রথমে আমায় বলেন শিশু সাহিত্য সংসদের অন্যতম কর্ণধার শ্রীমতী চন্দনা দত্ত৷ ব্যক্তিগত কারণে সে সময় এ কাজে হাত দিতে পারিনি৷ এখন তা শেষ করে তৃপ্তি ও সোয়াস্তি বোধ করছি৷ আরও বলতে হয় প্রায় আবিষ্কারই করেছি যে বর্তমান প্রজন্মের নবীন লেখকেরা ইতিহাসের গল্প লেখার মতো অনিসন্ধিৎসু ও পরিশ্রমসাধ্য প্রয়াসে নিজেদের ব্রতী করেছেন৷ যদিও, তাঁদের অনেকের লেখা আমরা অনিবার্য কারণে সংকলনভুক্ত করতে পারিনি৷ বস্তুত শ্রীমতী দত্তের প্ররোচনায় ছোটোদের গল্পের এই বিভাগে নিবিড় অনুসন্ধানের সুযোগে আমার এমন অভিজ্ঞতা লাভ হল, এজন্য তাঁর কাছে ব্যক্তিগতভাবে আমি কৃতজ্ঞ৷ আর, প্রকাশক দেবজ্যোতি দত্ত যে যত্ন নিয়ে তাঁর প্রকাশনার প্রতিটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন তা গ্রন্থের প্রতি তাঁর ভালোবাসারই প্রকাশ৷ এমন মানুষকে ভালোবাসা জানাতে কোনো কুন্ঠা নেই৷
আরেকটি কথা৷ সংকলিত গল্পের রচয়িতা বা তাঁদের উত্তরাধিকারীরা এ সংকলনে রচনা প্রকাশের অনুমতি দিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞ করেছেন৷ আন্তরিক প্রয়াস সত্ত্বেও উত্তরাধিকারী কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি, এজন্য আমরা ক্ষমা প্রার্থনা করছি৷
পরিশেষে বলি, বাংলার কিশোর-কিশোরীদের জন্য ইতিহাসের গল্পের এমন সংকলন গ্রন্থ আর নেই৷ তাই পাঠকেরা এ বই হাতে পেলে খুশিতে তুলে নেবে-এমন আশা আমরা করতেই পারি৷
অশোককুমার মিত্র
১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭
Leave a Reply