ময়নাগড়ের মহারাজ – দীপান্বিতা রায়
মাঘের শেষ৷ কিন্তু বাতাসে এখনও ভালোরকম শীতের আমেজ৷ ভোর বেলা নদীর জলের দিকে তাকালে বোঝা যায়, তার ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে মিহিন কুয়াশার স্তর৷ রাতে গাছের পাতায় জমে থাকা শিশির গড়িয়ে পড়ার টুপটাপ শব্দও শোনা যায়৷ তবে কয়েকদিন আগে যেমন খড়ের বিছানায় শুয়ে কাঁথামুড়ি দিলেও হাত-পা গরম হতে চাইছিল না, এখন আর ততটা হচ্ছে না৷ দিন বড়ো হয়েছে৷ বেলা বাড়লে রোদের তাপও বাড়ছে অনেকটাই৷ তবে সে রোদে জ্বালা-পোড়া নেই এখনও৷ পিঠ পেতে বসলে বেশ একটা মোলায়েম গরম বোধ হয়৷ আরামে চোখে ঢুল আসে৷
ঢুল আসলে খানিকটা এসেই গেছিল পরানের৷ বয়স বেড়েছে তো৷ শরীরটা তাই সময় সময় ছেড়ে দেয়৷ এমনিতে পরানকে দেখলে অবশ্য সেকথা বোঝার উপায় নেই৷ লম্বা ছিপছিপে শরীরখানা যেন পাথরে কোঁদা৷ পেটে-পিঠে কোথাও এতটুকু চর্বি নেই৷ হাড়ে-মাসে জড়ানো শক্ত চেহারা৷ বয়স দু-কুড়ি পেরিয়েছে কোনকালে৷ কিন্তু হাঁক দিলে এখনও যেন বাজ ডাকে৷ হাতে একখানা তেল চুকচুক পাকা বাঁশের লাঠি ধরিয়ে দিলে পরান ডোম আজও দশটা লোকের মহড়া নিতে পারে একাই৷
ডোমের ঘরের ছেলে হলেও মাথাটি পরিষ্কার৷ ময়নাগড়ের রাজা জগদানন্দ তাই পরানের ওপর ভরসাও করেন খুব৷ সব কাজেই শলাপরামর্শ করার জন্য ডাকেন৷ অবশ্য কাজ না থাকলেও পরান বেশিরভাগ সময় কেল্লাতেই থাকে৷ রাতে কোনোদিন বাড়ি গেল কোনোদিন গেল না৷ আগে যখন বউটা বেঁচে ছিল, তখন সারাদিন যেখানে যাই-ই করুক না কেন, সন্ধ্যে নামলেই বাড়ি ফিরত পরান৷ সরমা নাহলে রাগ করত৷ পরদিন গিয়ে দেখত মুখ গোমড়া করে বসে আছে৷ রাতে ভাত খায়নি৷ অনেক সাধ্য-সাধনা করে বউকে ভাতের পাতে বসাতে হত পরানকে৷ সরমা মরেছে এই মাঘের আগের মাঘে৷ সংসার এখন ছেলে আর ছেলের বউয়ের হাতে৷ বউটি ভালো৷ শ্বশুরের যত্নআত্তি করে৷ কিন্তু পরানের যেন কেমন সংসারের ওপর টান কমে গেছে৷
কাল সন্ধ্যেতে যখন রানিমা বললেন, ‘আজ রাতে পাকঘরে সরুচাকলি হবে রে পরান৷ মহারাজের খেতে ইচ্ছে হয়েছে৷ আজ আর বাড়ি যাস না৷ রাতে খেয়ে মালির ঘরে শুয়ে পড়িস৷’ খুশিমনে রাজি হয়ে গেছিল পরান৷ যত না সরুচাকলি খাওয়ার লোভে, তার থেকে বেশি রাজামশাইয়ের কাছে গল্প শোনার ইচ্ছেয়৷ মহারাজ জগদানন্দের অভ্যাস হল সন্ধ্যের পরই রাতের আহার সেরে নেওয়া৷ একবার তিনি অম্লশূলের ব্যথায় বেশ অনেকদিন ধরে কষ্ট পেয়েছিলেন৷ তখন থেকেই কবিরাজ তাঁকে বলে দিয়েছেন অধিক রাতে আহার না করতে৷ তারপর থেকে রানিমা সূর্য ডোবার একটু পরেই আসন প্রস্তুত করে মহারাজকে ডাক দেন৷ আহার সেরে মহারাজ ফরাসের ওপর আলবোলার নলটি নিয়ে বসেন৷ অম্বুরি তামাকের সুগন্ধে চারিদিক ম-ম করে৷ জগদানন্দের মেজাজটিও থাকে খোশ৷ তখন তিনি তাঁর চারপাশে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের নানারকম গল্প শোনান৷ পণ্ডিত মানুষ৷ অনেক দেশের অনেক কথা জানেন৷ তবে পরানের অবশ্য সবথেকে ভালো লাগে জগদানন্দের মুখে এই বাহুবলীন্দ্র রাজবংশের গল্প শুনতে৷
রাজামশাইয়ের মুখে শোনা গল্পের কথা ভাবতে ভাবতে পরান একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল৷ হঠাৎ তার কানে গেল ফিঙের তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ৷ মুহূর্তে ঘুমের ঢুল কেটে গেল পরানের৷ শিরদাঁড়া সোজা, শরীর সতর্ক হয়ে উঠল৷ আবার একটা শিসের শব্দ৷ আবার৷ পরপর তিনটে শিসের পর ফিঙেটা থেমে গেল৷ একটু সময় চারিদিক চুপচাপ৷ তারপর অনেকগুলো চড়ুই উড়ে যাওয়ার কিচমিচ শব্দ৷ আর কোনো সন্দেহ নেই৷ গড়ের ছাদ থেকে নেমে এল পরান৷ মহারাজ বিশ্রাম নিচ্ছেন৷ দরজার সামনে রয়েছে তাঁর খাস পাহারাদার রামা৷ পরান তাকে গিয়ে বলল, ‘নিতাই ঠাকুর এসেছে৷ মনে লাগছে কোনো জরুরি বার্তা আছে৷ আমি ডিঙি নিয়ে চললাম৷ মহারাজ উঠলে বলে দিস৷’
রাজা জগদানন্দের এই ময়নাগড় দুর্গ এককথায় প্রায় দুর্ভেদ্য৷ কংসাবতী নদী যেখানে কেলেঘাইয়ে মিশেছে তার উজানে অল্প একটু দূরে, কেলেঘাই নদীর পশ্চিমধারে ময়নাগড়৷ দু-টি নদী দিয়ে ঘেরা গড়টিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয়, যেন একটা দ্বীপের ভিতর আরও একটা দ্বীপ আর তারই মাঝখানে হাঁটু মুড়ে বসে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করছে মস্ত একটা কালো বাঘ৷ বিশেষ করে যখন বর্ষায় পশ্চিমের আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা থাকে আর মেঘের সেই নিকষ কালো রং দুর্গের প্রাকারের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তখন সে দৃশ্য দেখলে অচেনা মানুষের বুকে কাঁপুনি ধরাও বিচিত্র কিছু নয়৷ এই দুর্গ অবশ্য বাহুবলীন্দ্র বংশের রাজাদের তৈরি নয়৷ ময়নাগড় তৈরি করেছিলেন রাজা লাউসেন৷
দুর্গের ফটক খুলে বেরিয়ে এল পরান ডোম৷ ফটক থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগোলেই কেলেঘাই নদী৷ নদীর ঘাটে ছোটো একটা ডিঙি বাঁধা আছে৷ কেলেঘাই, কংসাবতী দু-টি নদীই কুমির-কামটে ভরতি৷ খুব চওড়া না হলেও তাই সাঁতার দিয়ে পেরোনো অসম্ভব৷ বর্ষায় জলও থাকে খুব৷ এখন অবশ্য স্রোতের তেমন টান নেই৷ কাছি খুলে ডিঙিটিকে পাড়ের আরও কিছুটা কাছে টেনে এনে তাতে চড়ে বসল পরান৷ অভ্যস্ত হাতে বইঠা টেনে দ্রুত পৌঁছোল ওপারে৷ এইখানে কেলেঘাই আর কংসাবতী নদীর মধ্যে ব্যবধান খুবই কম৷ এক নদীর তীর থেকে অন্য নদীর পাড় হেঁটে যেতে মিনিট পনেরোর বেশি সময় লাগার কথা নয়৷ কিন্তু এইটুকু পথ পেরোনো প্রায় দুঃসাধ্য৷ কারণ কেলেঘাইয়ের পাড়ে উঠে দু-চার পা এগোলেই শুরু হয়েছে ঘন বাঁশবন৷ বিশাল লম্বা লম্বা বাঁশ গাছ পরস্পরের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে, তা ভেদ করে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব৷ বাঁশজঙ্গলের নীচের মাটি দিনের বেলাতেও ঘন অন্ধকার৷ বর্ষায় পচা বাঁশ পাতায় পিছল হয়ে থাকে৷ এখন শীতের সময় কাদা নেই৷ সাপের ভয়ও নেই৷ কিন্তু তবু এই বাঁশ বনের ভিতরে ঢোকার সাহস কারুর সহজে হবে না৷
পরানের অবশ্য সে চিন্তা নেই৷ ঘন বাঁশ বনের ভিতরে আছে লুকোনো সুঁড়ি পথ৷ হাতে গোনা দু-চারজন তার খবর রাখে৷ পরান ডোম তাদের মধ্যেই একজন৷ এপথ তার এমন চেনা যে রাতের অন্ধকারে যেতেও অসুবিধা হয় না৷ ডিঙিখানা নদীর ধারে তুলে রেখে, পরান তাই কোমরের গামছাখানা খুলে মাথায় বেঁধে নিল, তারপর ঠিক একটা কাঠবেড়ালির মতো লম্বা শরীরখানা ভাঁজ করে ঢুকে পড়ল সেই সুঁড়ি পথের ভিতর৷ বাঁশ বনের ওপারে খানিকটা খোলা জমি পেরোলেই কংসাবতী নদী৷ ওপারে ঘন জঙ্গল৷ তবে তার ভিতর এদিক-ওদিক বেঁকে যাওয়া পায়ে-চলা পথ দেখে বোঝা যায় মানুষের বসতি আছে আশপাশেই৷ ছড়ানো-ছিটানো গ্রাম৷ কিছুদূরে গঞ্জ৷ চাষবাস করে খেটেপিটে খাওয়া মানুষের বাস৷ সরস মাটি৷ তাই ফসল ফলে ভালোই৷ এই এলাকার সব মানুষই রাজা জগদানন্দের প্রজা৷ জগদানন্দকে তারা দেবতার মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করে৷
নদীর পাড়ে ঝোপের ভিতর একখানা ছোটো নৌকো লুকোনো ছিল৷ সেটিকে বার করে এনে তাতে চেপে কংসাবতী পেরিয়ে এপারে এল পরান৷
চারিদিক শুনশান৷ কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না৷ তাও চারপাশটা একবার সতর্ক চোখে দেখে নিয়ে ময়নাপাখির মতো কিচকিচ কিচকিচ ডাক ছাড়ল পরান৷ অমনি জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা লোক৷ পরনে একখানা পরিষ্কার ধুতি আর পিরান৷ বেঁটেখাটো৷ মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা৷ চেহারায় বুদ্ধির ছাপ আছে৷ জঙ্গল পেরিয়ে কিছুদূর গেলে যে গঞ্জ, সেখানকার পণ্ডিতমশাইয়ের ছেলে নিতাই৷ সংস্কৃত আর ফার্সির পাশাপাশি দু-পাতা ইংরেজিও পড়েছে৷ তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেদিনীপুরের রেসিডেন্টের আপিসে চাকরি জুটেছে৷ কেরানির চাকরি৷ লেখাপড়ার কাজ৷ গ্রামে তাই নেতাইয়ের খাতিরই আলাদা৷ নেতাই আবার জগদানন্দের খুব কাছের মানুষ৷ নেতাইয়ের বাবার কাছে জগদানন্দ নিজেও সংস্কৃত পড়েছেন৷ তাই নেতাই এককথায় জগদানন্দের গুরুভাই৷
নেতাইয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে পরান বলল, ‘গড়ে যাবে তো দাঠাকুর৷’
‘না পরানভাই, আজ যাব না৷ তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে৷ সাহেবকে অনেক বলে-কয়ে একবেলার ছুটি নিয়ে এসেছি৷ কাল সকালেই ফিরতে হবে৷ একখানা জরুরি খবর ছিল, সেটি জগদানন্দকে দিতে হবে৷’
‘কী খবর বলো, আমি গিয়ে রাজামশাইকে বলছি৷’
‘কিছু বলতে হবে না৷ তুমি এই লেফাফাখানা জগদানন্দকে দিয়ো৷ বলবে বাবের সাহেব এই চিঠিটা হেস্টিংসকে লিখেছেন৷ বাবের চিঠির মুসাবিদা করছিল যে কাগজে সেখানা আমি লুকিয়ে সরিয়ে রেখেছিলাম৷ লেফাফাতে সেটাই আছে৷ পড়লেই সব বুঝতে পারবে৷’
‘কোনো বিপদের খবর নাকি দাঠাকুর?’
‘ভালো খবর নয় পরানভাই৷ এই বাবের সাহেব জগদানন্দকে দু-টি চক্ষে দেখতে পারে না৷ নানারকম ভাবে নালিশ করে ওপরওলার কাছে৷ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখন দিনে দিনে শক্তি বাড়াচ্ছে৷ তোমরা সাবধানে থেকো৷ জগদানন্দকে বলো গড় ছেড়ে যেন হুটহাট বাইরে না যায়৷ আমি এখন এগোই৷ অনেকটা পথ তো৷ যেতে যেতেই আঁধার নেমে যাবে৷’
পরানের হাতে লেফাফাটা গুঁজে দিয়ে রওনা দিল নিতাই৷ কাগজের খামটা পিরানের ভিতর ঢুকিয়ে রেখে পরানও ফেরার পথ ধরল৷
পরান যখন গড়ে ফিরল তখনও সূর্য ডোবেনি৷ গড়ের পিছনদিকে পশ্চিমের আকাশ লাল আর সোনালি রঙে মাখামাখি হয়ে নীল সন্ধ্যের প্রহর গুনছে৷ গড়ের ছাদে, আরামকেদারায় বসে জগদানন্দ পরানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন৷ পরান এসে হাতে লেফাফাটা দিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নিতাই এল না?’
‘না, দাঠাকুরকে কাল সকালেই ফিরতে হবে৷ বড্ড নাকি জরুরি চিঠি৷ অন্য কারুর হাত দিয়ে পাঠানো যাবে না৷ তাই নিজেই এসেছিলেন দিতে৷’
‘আচ্ছা ঠিক আছে৷ তুই এখন যা৷ রানিমা তোর খোঁজ করছিলেন৷’
পরান ঘাড় নেড়ে চলে যাচ্ছিল, জগদানন্দ আবার ডেকে বললেন, ‘আজ রাতে আর বাড়ি যাস না পরান৷ থেকে যা৷ নিতাই কী পাঠিয়েছে দেখি৷ দরকার হলে বসে শলাপরামর্শ করতে হবে৷’
পরান চলে যেতে সাবধানে খামটা খুললেন জগদানন্দ৷ ভিতরে একটা ছোটো চিঠি৷ তাতেই নিতাই লিখেছে, মেদিনীপুরের রেসিডেন্ট এডওয়ার্ড বাবের ময়নাগড় সম্বন্ধে চিঠি লিখে নালিশ জানিয়েছেন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে৷ গভর্নর জেনারেলকে লেখা চিঠি বলে কথা৷ স্বাভাবিকভাবেই বাবের বেশ কয়েকবার চিঠির মুসাবিদা করেছেন৷ নিতাই সেই ফেলে দেওয়া কাগজই গোপনে সংগ্রহ করে জগদানন্দকে পাঠিয়েছে৷ চিঠিতে বাবের লিখছেন, তাঁর মতে রাজা জগদানন্দ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে একজন বিপজ্জনক মানুষ৷ আবার আলিবর্দি খাঁয়ের সঙ্গে তাঁর বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল৷ সিরাজ যখন ফোর্ট উইলিয়াম আক্রমণ করেছিলেন, তখন জগদানন্দ তাঁকে সাহায্য করেছিলেন বলেও অনুমান করা হয়৷ তিনি ব্রিটিশের অধীনতা স্বীকার করতে মোটেই প্রস্তুত নন৷ খাজনার টাকা দিতেও তাঁর বিশেষ আপত্তি৷ সমস্যা হল জগদানন্দ ময়নাগড় নামের যে দুর্গে থাকেন সেটি এককথায় দুর্ভেদ্য৷ দু-টি নদী পরিখার মতো কেল্লাটিকে ঘিরে আছে৷ তাই সেনা পাঠিয়ে জগদানন্দকে দমন করা মোটেই সহজ কাজ নয়৷ এই ধরনের মানুষ কোম্পানির পক্ষে শিঃরপীড়ার কারণ৷ তাই গভর্নর জেনারেল যদি বিষয়টিকে বিবেচনা করে জগদানন্দকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করেন তাহলে ভালো হয়৷ বিশেষ করে এই ময়নাগড় কেল্লাটি তাঁর মতে ধ্বংস করে দেওয়াই ভালো৷ কারণ তা না হলে ভবিষ্যতে এটি কোম্পানির শত্রুদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে৷ তিনি এবিষয়ে গভর্নর জেনারেলের সুচিন্তিত মতামতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবেন৷
চিঠিটা পড়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন জগদানন্দ৷ তারপর ধীরে ধীরে উঠে ছাদের প্রাচীরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ জগদানন্দ দীর্ঘদেহী পুরুষ৷ প্রাচীর তাঁরও বুক ছাড়িয়ে উঠেছে৷ তার গায়ে একটু দূরে দূরে গোলাকার ছিদ্র৷ শত্রু আক্রমণ করলে তিরন্দাজরা যাতে কেল্লা থেকেই তির ছুড়ে তাদের বিদ্ধ করতে পারে সেজন্যই এই ব্যবস্থা৷ প্রাচীরের গা বরাবর কিছুটা দূরে দূরে ছোটো ছোটো বুরুজ৷ রাতে সেখানে পাহারার ব্যবস্থা থাকে৷ পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে৷ দিগন্তের কাছে নিবিড় ধূসর একটি মেঘের রেখা৷ তার ওপর অস্তগামী সূর্যের আলো পড়ে মনে হচ্ছে যেন কোনো আগ্নেয়গিরির গুহামুখ৷ ভিতরের সঞ্চিত লাভা এখনও বের হয়ে আসেনি কিন্তু তার উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে৷ জগদানন্দের মনে হল ময়নাগড়ও যেন এরকমই কোনো এক আগ্নেয়গিরির গুহামুখে দাঁড়িয়ে আছে৷ তিনি পরম মমতায় গড়ের কর্কশ পাঁচিলের গায়ে হাত বোলালেন৷ ময়নাগড় শুধু দুর্ভেদ্যই নয়, তার গঠনশৈলীও ভারি চমৎকার৷ এমন একটি নির্মাণ যে কেউ ধ্বংস করে দেওয়ার কথা ভাবতে পারে সেকথা জগদানন্দ কল্পনাও করতে পারেন না৷ কত দীর্ঘ সময়ের, কত মানুষের ইতিহাস লেখা আছে এই প্রাচীরের গায়ে৷
বাংলায় তখন পালবংশের রাজত্ব৷ সিংহাসনে আসীন গৌড়েশ্বর ধর্মপাল৷ তাঁরই অধীনে একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের অধিপতি ছিলেন কর্ণসেন৷ ধর্মপাল তাঁকে স্নেহ করতেন৷ কিন্তু কর্ণসেন ছিলেন অতি দুর্ভাগা মানুষ৷ বাংলার আর এক দুর্দমনীয় বীর ইছাই ঘোষের সঙ্গে যুদ্ধে তাঁর ছয় ছেলের মৃত্যু হয়৷ পুত্রশোক সহ্য করতে না পেরে কর্ণসেনের স্ত্রী বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন৷ স্ত্রী-পুত্র হারিয়ে কর্ণসেন যখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত তখনও কিন্তু বড়ো ভাইয়ের মতো গৌড়েশ্বর ধর্মপালই তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন৷ ধর্মপাল নিজের শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সঙ্গে কর্ণসেনের বিয়ে দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের এই অঞ্চলটি তাঁকে দান করেন৷ সেকালে লোকে তাই এই জায়গাকে কর্ণগড় বলত৷ কর্ণসেন আর রঞ্জাবতীর ছেলে লাউসেন তৈরি করেছিলেন এই ময়নাগড়৷ গড়ের নামেই লোকমুখে বদলে যায় এলাকার নামও৷ লাউসেন ছিলেন বীর, মহামতি পুরুষ৷ তাঁর নাম আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে৷ তবে লাউসেনের মৃত্যুর পর ময়নাগড় কিন্তু আর খুব বেশিদিন কর্ণসেনের বংশধরদের হাতে থাকেনি৷ উৎকলরাজ গোবর্ধন ময়নাগড় দখল করে নেন৷ তারপর থেকেই এই গড় রয়েছে বাহুবলীন্দ্রদের হাতে৷ জগদানন্দের আগে তাঁর ছয় পূর্বপুরুষ এই ময়নাগড়ে রাজত্ব করে গেছেন৷ আর আজ এডওয়ার্ড বাবেরের মতো এক লালমুখো বিদেশি কিনা অনায়াসে এই গড় ধ্বংস করে দেওয়ার কথা বলছে! জগদানন্দের মনে হল ক্রোধে তাঁর সর্বশরীর জ্বলছে৷
কিন্তু এখন ক্রোধের সময় নয়৷ স্থির মস্তিষ্কে পরিস্থিতি বিবেচনা করা দরকার৷ জগদানন্দ অতি বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ পুরুষ৷ যথেষ্ট দূরদর্শীও বটে৷ তাই তিনি নিজে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবদের সঙ্গে তাঁর কখনোই সদ্ভাব হবে না৷ অথচ এর আগে দিল্লির দরবার হোক কিংবা বাংলার নবাব, কারুর সঙ্গেই জগদানন্দের কখনো কোনো মনোমালিন্য হয়নি৷ বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ তো তাঁকে রীতিমতো স্নেহই করতেন৷ করার কারণও ছিল৷ বাংলা তখন বর্গিদের অত্যাচারে বিধ্বস্ত৷ সমুদ্র উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যখন-তখন হামলা চালাত বর্গিরা৷ তাদের অত্যাচারে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হত ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষকে৷ লুঠ হয়ে যেত খেতের ফসল৷ অথচ জগদানন্দের এলাকায় কিন্তু বর্গিরা সুবিধা করতে পারেনি৷ এরজন্য অবশ্য তিনি তাঁর দুর্ধর্ষ ডোমবাহিনীর কাছে ঋণী৷ পরান, মাতন, বিখাইয়ের মতো বেশ কয়েকজন এই বাহিনীর নেতা৷ তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাধারণ যুবকদের অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছে৷ বর্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শিখিয়েছে৷ বর্গিদের আক্রমণের সময় নিজেরা সামনে থেকে লড়েছে৷ এদের শিক্ষায় জগদানন্দের সাধারণ প্রজারাও এমন অস্ত্রচালনায় পটু হয়ে উঠেছিল যে বর্গিরা তাঁর এলাকায় হানা দিতে সাহস পেত না৷ জগদানন্দের এই কৃতিত্বের কথা জানতে পেরে আলিবর্দি খাঁ নিজের গলার মুক্তোর মালা খুলে তাঁকে পরিয়ে দিয়েছিলেন৷ আলিবর্দির নাতি সিরাজ যখন কলকাতা আক্রমণ করেন, তখন জগদানন্দ সাহায্য করেছিলেন তাঁকে৷ কারণ নিজের দূরদর্শিতায় তিনি বুঝতে পারছিলেন এই লালমুখো সাহেবরা এদেশে শুধু ব্যাবসা করতে আসেনি৷ এদের উদ্দেশ্য আরও সুদূরপ্রসারী৷ গোরা সাহেবদের এখনই আটকাতে না পারলে দেশের সমূহ সর্বনাশ৷
আরও একটি বিষয় জগদানন্দ বুঝতে পারছিলেন এবং বুঝে উদ্বিগ্ন হচ্ছিলেন৷ সেটা হল এদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি সাহেবদের এতটুকুও মমতা, সহানুভূতি নেই৷ মোগল সম্রাটের তহশিলদাররাও খাজনা আদায় করত৷ কিন্তু অজন্মার বছরে, বন্যা হলে খাজনা বাকি পড়ত৷ সম্রাট মাপ করে দিতেন৷ তার জন্য বাংলার রাজাদের বিশেষ করে জগদানন্দের মতো সুশাসক বলে পরিচিত রাজাকে কখনো অপমানিত হতে হয়নি৷ প্রজাদের ওপর অত্যাচার করে খাজনা আদায়ে নিষেধ ছিল সম্রাটের৷ অথচ এই ব্রিটিশ বানিয়াদের কাছে কোনো কিছুতেই মাপ নেই৷ পঙ্গপালে যদি শস্য নিঃশেষও করে দেয় তবু টাকার তোড়া রেসিডেন্টের ঘরে পৌঁছোতেই হবে৷ আমিন পাঠিয়ে, চাবুক মেরে খাজনা আদায় জগদানন্দ কল্পনাও করতে পারেন না৷ প্রজারা তাঁর সন্তানের মতো৷ দুর্ভিক্ষের বছরে গড়ের ভিতরকার ধানের গোলা প্রজাদের জন্য খুলে দেন তিনি৷ তাঁর মতো মানুষকে যে এই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোরা সাহেবদের পছন্দ হবে না, এতে আর বিস্ময়ের কী আছে৷
কথাটা ভেবে এই উদ্বেগের মধ্যেও জগদানন্দের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল৷ দুর্গের প্রাকারে হাত রেখে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে তিনি আপনমনেই বলে ওঠেন, লড়াই কতদিন চালাতে পারব জানি না৷ কিন্তু ময়নাগড় সাক্ষী, প্রাণ থাকতে ব্রিটিশের অধীন হব না৷ গড়ের ছাদ থেকে নেমে এসে জগদানন্দ পরানকে বললেন, ‘কাল একবার কপিলকে ডেকে আনিস তো৷ অনেকদিন ধরে ভাবছি রঙ্কিনীদেবীর মন্দিরটা নতুন করে তৈরি করাব৷ ভিতরের দেওয়ালগুলো নষ্ট হয়ে গেছে৷ এখনই ঠিক না করালে কোনোদিন ভেঙে পড়ে যাবে৷’
পরান ঘাড় নাড়ে৷ মনে মনে একটু খুশিও হয়৷ দা-ঠাকুরের চিঠি পড়ার পরও যখন রাজামশাই মন্দির তৈরি করার কথা ভাবছেন, তখন নিশ্চয় তেমন দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই৷ রঙ্কিনী দেবীর মন্দির সংস্কার হবে শুনে রানিমার মুখখানাও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷ ময়নাগড় কেল্লার ভিতরেই রঙ্কিনীদেবীর মন্দির৷ বহু পুরোনো৷ শোনা যায় রাজা লাউসেন নিজে এই মন্দির তৈরি করেছিলেন৷ তবে দেবী ভারি জাগ্রত৷ তাই বিপদে-আপদে রাজপরিবারের মানুষজন তো বটেই, ময়নাগড় এলাকার সব মানুষই তাঁর শরণ নেয়৷ পৌষমাসে ধুমধাম করে রঙ্কিনীদেবীর পুজো করেন জগদানন্দ৷ পুজোর দু-দিন প্রজাদের জন্য কেল্লার ফটক খুলে দেওয়া হয়৷ সবার জন্য পাত পড়ে৷ রাজামশাই এবং রানিমা নিজে খাওয়া-দাওয়ার তদারক করেন৷ নানারকম আমোদ-আহ্লাদও হয়৷ ময়নাগড়ের মানুষের কাছে বছরের এই দু-টি দিন খুবই আনন্দের৷ তবে জগদানন্দ নিজে মোটেই গোঁড়া মানুষ নন৷ তাঁর কাছে হিন্দু-মুসলমান সব ধর্মের প্রজাই সন্তানের মতো৷ কেল্লার কাছেই আছে গড়সাফাত৷ সেখানে বাস করে তাঁর মুসলমান প্রজারা৷ বছরখানেক আগে জগদানন্দের একমাত্র সন্তান ব্রজানন্দ যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তখন হিন্দু প্রজারা পুজো দিয়েছিল লোকেশ্বরের মন্দিরে আর মুসলমানরা গড়সাফাতের পাশে সুফি সাধকদের দরগায়৷ ছেলে সেরে ওঠার পর জগদানন্দের নির্দেশে রানি নিজে ছেলেকে নিয়ে দরগায় গিয়ে আশীর্বাদ নিয়ে এসেছিলেন৷ ধর্মঠাকুর আর লোকেশ্বরের মন্দিরে ষোড়শ উপাচারে পুজো দেওয়া হয়েছিল৷
রাজামশাইয়ের নির্দেশে পরদিন সকালেই পরান ডোম গিয়ে কপিলকে তার বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে এল৷ ভাগ্য ভালো কপিল বাড়িতেই ছিল৷ সাধারণত বছরের এই সময়টায় তার নানা জায়গায় কাজের ডাক পড়ে৷ কপিল সূত্রধর ময়নাগড় শুধু নয়, মেদিনীপুর অঞ্চলের নামকরা স্থপতি৷ বঙ্গদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজা-মহারাজারা নানা কাজে তাঁকে ডেকে পাঠান৷ শোনা যায় এই কপিল সূত্রধরের পূর্বপুরুষই ময়নাগড় কেল্লারও স্থপতি ছিলেন৷ কপিলের একমাত্র সন্তান শুকুল একবার মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল৷ কবিরাজের ওষুধে কোনো কাজ না হওয়ায় জগদানন্দ নিজের খরচে লোকলশকর দিয়ে শুকুলকে কলকাতায় পাঠিয়ে, সাহেব ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তোলেন৷ তারপর থেকে কপিল জগদানন্দকে ঈশ্বরের মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করে৷ রাজামশাই ডেকে পাঠিয়েছেন শুনে সে তক্ষুনি পরানের সঙ্গে গড়ে এসে হাজির হল৷ রাজামশাইয়ের খাসকামরায় দরজা বন্ধ করে জগদানন্দ, কপিল আর পরান তিনজনে মিলে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হল৷ কথা শেষ হলে জগদানন্দ বাইরে এসে সবাইকে জানিয়ে দিলেন, ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমায় ভালো দিন৷ সেদিন থেকে রঙ্কিনীদেবীর মন্দির সংস্কারের কাজ শুরু করবে কপিল৷ জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত কাজ হবে৷ বর্ষার দু-মাস কাজ বন্ধ রেখে আবার শুরু হবে ভাদ্রের গোড়ায়৷ পৌষমাসে দেবীর পুজোর আগে মন্দির সংস্কারের কাজ শেষ হয়ে যাবে৷ কপিলের সঙ্গে কাজ করবে পরান৷ যতদিন কাজ চলবে ততদিন মন্দির বন্ধ থাকবে৷ পরান এবং কপিল ছাড়া আর সকলের সেখানে প্রবেশ নিষেধ৷ রঙ্কিনীদেবীর মূর্তির পায়ের নীচে যে পবিত্র শিলা আছে সেটি বাইরে এনে শুদ্ধ জায়গায় প্রতিষ্ঠা করে সেখানে নিত্যপূজার কাজ চলবে৷
ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমার তখনও প্রায় তিন সপ্তাহ দেরি৷ কপিল বাড়ি ফিরে প্রথমেই তার সহকারি নকুলকে কতগুলি নকশা দিয়ে পাঠিয়ে দিল সপ্তগ্রামে৷ সেখানকার নাম-ডাকওয়ালা বণিক নগেন্দ্রনাথ সিংহ একটি শিবের মন্দির তৈরির বরাত দিয়েছেন কপিলকে৷ নকুল তাঁকে গিয়ে জানাবে, এই বছর কপিল সূত্রধর তাঁর মন্দিরের কাজে হাত দিতে পারবে না৷ নগেনবাবু যদি নকশাগুলি দেখে পছন্দ করে রাখেন, তাহলে আগামী বছরের গোড়াতেই মন্দির তৈরি শুরু হবে৷ নকুলকে সব বুঝিয়ে বিদায় দিয়ে কপিল বসল রঙ্কিনীদেবীর মন্দিরের নকশা নিয়ে৷ প্রায় একসপ্তাহ ঘরের দরজা বন্ধ করে, অন্য কোনোদিকে মনোযোগ না দিয়ে কাজ করলে সে৷ তারপর বড়ো বড়ো বাঁশের চোঙায় তিন-চারটি নকশা নিয়ে ফের হাজির হল গড়ে৷ জগদানন্দ মন দিয়ে নকশাগুলি দেখলেন৷ কপিলের সঙ্গে কথাও হল দীর্ঘক্ষণ৷ তারপর নকশা চূড়ান্ত হওয়ায় কপিলের ফরমায়েশ মতো জিনিসপত্রের বরাত দেওয়া হল৷ বিশেষ ধরনের পাতলা কিন্তু শক্ত ইট দিয়ে মন্দিরের কাজ হবে৷ কেল্লার পিছনে, নদীর পাড়ে ভাঁটি তৈরি করে সেখানে সেই ইট তৈরির ব্যবস্থাও হল৷ সব কিছু ঠিকঠাক করে ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিনে রঙ্কিনীদেবীর মন্দিরের পুজো দিয়ে শিলা বার করে আনা হল৷ মন্দিরের সামনেটা ঘিরে দেওয়া হল প্রায় দু-মানুষ সমান উঁচু চাটাই দিয়ে৷ ভিতরে যাওয়ার অধিকার শুধুমাত্র পরান আর কপিলের৷
মন্দিরের কাজ শুরু হওয়ার আগেই অবশ্য জগদানন্দ, পরান আর ডোমবাহিনীর সর্দারদের নিয়ে তাঁর এলাকার গ্রামগুলি ঘুরে মোড়লদের সঙ্গে কথা বলে এলেন৷ মোড়লদের জানিয়ে দেওয়া হল গোরাদের নজর পড়েছে ময়নাগড়ের ওপর৷ তাই সবাই যেন সতর্ক থাকে৷ লালমুখোদের বাহিনী এদিক পানে আসছে জানতে পারলেই যেন তক্ষুনি রাজামশাইকে খবর দেয়৷ অজানা-অচেনা লোকজনকে হাটে-ঘাটে দেখলে যেন সাবধান হয়৷
এদিকে মেদিনীপুরের রেসিডেন্ট বাবেরের চিঠি পেয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস খুব বেশি উদ্বিগ্ন হননি৷ কিন্তু বাবেরের কথার মধ্যে সারবত্তা কতটা জানতে আগ্রহী হয়েছিলেন৷ ময়নাগড় ধ্বংস করে দেওয়া তো পরের কথা কিন্তু আদতে এই হিন্দু রাজা জগদানন্দ কতখানি শক্তিশালী সেটা তো যাচাই করা দরকার৷ হতেই পারে যে বাবেরের নিজের কোনো রাগ আছে জগদানন্দের ওপর তাই সেই অতিশয়োক্তি করছে৷ হেস্টিংস তাই ঠিক করলেন প্রথমে চর পাঠিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি কী, ময়নাগড় আসলে কতটা দুর্ভেদ্য সেটা জেনে নেওয়া দরকার৷ ব্রিটিশদের বিশ্বস্ত কিন্তু ওই এলাকা ভালোমতো চেনে এমন কয়েকজনকে গোপনে পাঠানোও হল ময়নাগড় এলাকায়৷ কিন্তু তারা বেশ কিছুদিন ঘোরাঘুরি করেও নির্দিষ্ট কোনো খবর দিতে পারল না৷ ময়নাগড়ে প্রজারা নাকি কেল্লার ভিতরে কখনো যায় না৷ প্রয়োজনে মহারাজই বাইরে আসেন৷ দু-টি নদীই কুমির-কামটে ভরতি৷ বাঁশ বনের ভিতর দিয়ে তো শেয়াল-কুকুরও যেতে পারে না৷ মহারাজের বিরাট সেনাবাহিনী আছে৷ তারা কেল্লার ভিতরেই থাকে৷ কত সৈন্য কেউ জানে না৷ তবে রঙ্কিনীদেবী নিজে ময়নাগড় কেল্লা রক্ষা করেন৷ তাই রাত-বিরেতে কেল্লার আশপাশে গেলে মৃত্যু অনিবার্য৷ এই ধরনের কিছু প্রায় অবাস্তব তথ্য ছাড়া বিশেষ কিছুই তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেল না৷ ওয়ারেন হেস্টিংস যথেষ্ট অভিজ্ঞ মানুষ৷ তাঁর পাঠানো চরদের কথাবার্তা শুনে তিনি স্পষ্টত বুঝতে পারলেন, জগদানন্দ শুধু প্রজাদের প্রিয় রাজা নন অত্যন্ত বুদ্ধিমানও৷ ব্রিটিশরা চর পাঠাতে পারে অনুমান করে তিনি আগেভাগেই গ্রামের মানুষদের সতর্ক করে দিয়েছেন৷ ময়নাগড়ে প্রজারা তাই অচেনা মানুষের কাছে মুখ খোলেনি মোটেই৷ হেস্টিংস বুঝলেন ময়নাগড় সম্পর্কে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন৷ এডওয়ার্ড বাবেরও অবশ্য এরমধ্যে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে ছিলেন না৷ তিনি ইতিমধ্যেই রাজস্ব দিতে জগদানন্দ যে কীরকম অনিচ্ছুক এবং ব্রিটিশদের প্রতি তাঁর কী ধরনের বিদ্রোহী মনোভাব তা জানিয়ে গভর্নর জেনারেলকে আরও বেশ কয়েকখানা চিঠি লিখেছেন৷ হেস্টিংসের নির্দেশে এবার বাবের পর পর দু-তিনটি ছোটে বাহিনী পাঠালেন ময়নাগড় রাজাকে সনদ পাঠিয়ে আত্মসমর্পণের জন্য৷ কিন্তু কোনো বাহিনীই কেল্লার ধারপাশেও পৌঁছোতে পারল না৷ প্রতিবারই গ্রামের মানুষদের কাছে ব্রিটিশদের আসার খবর আগেই পেয়ে গেছিলেন জগদানন্দ৷ তাই কেল্লার দরজা বন্ধ ছিল৷ নৌকো পাওয়া যায়নি৷ বাঁশ বন পেরোনোর পথেরও সন্ধান মেলেনি৷
বাবেরের পাঠানো দ্বিতীয় বাহিনী ফিরে যাওয়ার পর হেস্টিংস বুঝতে পারলেন সহজপথে জগদানন্দকে কবজা করা যাবে না৷ তারজন্য যথেষ্ট বন্দোবস্ত দরকার৷ কিন্তু ততদিনে বর্ষা পড়ে গেছে৷ সাপখোপে ভরা মেদিনীপুরের জঙ্গলে সৈন্য পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না৷ বর্ষা যখন শেষ হল তখন বাংলার নানা জায়গায় আরও কিছু বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে৷ সেসব দমন করে হেস্টিংস যখন আবার ময়নাগড় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পেলেন ততদিনে বছর ঘুরে গেছে৷
আশ্বিনের শেষে পুজো ছিল৷ প্রতিবছরের মতোই ময়নাগড়ে পুজো কাটল ধুমধাম করেই৷ মন্দির সংস্কার তখনও চলছে৷ অগ্রহায়ণের শেষদিকে একদিন পরান এসে জানাল কাজ শেষ হয়ে গেছে৷ কিন্তু পুজো শুরুর আগে একবার রাজামশাই নিজে গিয়ে সবকিছু ভালো করে দেখে নিন৷ যদি কিছু খুঁত নজরে পড়ে, তাহলে এখনও ঠিকঠাক করা যাবে৷ পরদিন খুব ভোরে, গড়ের বেশিরভাগ মানুষই তখনও ঘুমন্ত, জগদানন্দ পরানের সঙ্গে চাটাইয়ের বেড়া সরিয়ে ভিতরে ঢুকলেন৷ মন্দিরের ভিতরে কপিল অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্য৷
পৌষমাসে রঙ্কিনীদেবীর পুজো৷ তার আগেই মন্দির খুলে দেওয়া হল৷ নতুন মন্দিরের গড়ন অনেকটাই অন্যরকম৷ আগের তুলনায় গর্ভগৃহে জায়গা বেশি৷ দেওয়ালে সুন্দর কারুকাজ৷ রানিমা এবং গড়ের অন্যান্য সকলেই মন্দির দেখে খুশি হলেন৷ কয়েকদিন বাদেই পুজো৷ তাই সাজানো-গোছানোও শুরু হয়ে গেল তখনই৷ সেবার জগদানন্দ পুজো করলেন ধুমধাম করে৷ পুজোর দু-দিন চিরকালই ময়নাগড়ের প্রজাদের বাড়িতে উনুন জ্বলে না৷ কিন্তু এবার যেন আয়োজন একটু বেশিই৷ চার পদের জায়গায় ছয়-আট পদের ব্যবস্থা৷ মিষ্টিও হরেকরকম৷ রানিমা লক্ষ করলেন পুরোহিত যখন সন্ধ্যারতি করছে, তখন তার সামনে হাতজোড় করে দু-চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন জগদানন্দ৷ কিন্তু তাঁর বন্ধ দুই চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে৷ অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে রানির৷ তাহলে কি কোনো অমঙ্গল ঘনিয়ে আসছে ময়নাগড়ের চারপাশে৷ গোরা সৈন্যরা বার-দুয়েক ঘুরে গেছে৷ কিন্তু ময়নাগড় দখল করা তো তাদের সাধ্য হয়নি৷ তাহলে কেন দুশ্চিন্তায় জগদানন্দ!
মাঘের গোড়ার দিকে নিতাই এল রাজামশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে৷ তার মুখ দেখেই জগদানন্দ বুঝলেন খবর ভালো নয়৷ নিতাই জানাল, হেস্টিংস বিশাল বাহিনী নিয়ে ময়নাগড় আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ ভালো ফসল হয়নি বলে রাজস্ব যাতে এবছর মাপ করা হয়, সেই অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন জগদানন্দ৷ কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি৷ ব্রিটিশরা ময়নাগড়ের রাজাকে শত্রু বলে চিহ্নিত করেছে৷ তাই তাঁকে উৎখাত করে বন্দি করাই তাদের লক্ষ্য৷ হেস্টিংসের কাছ থেকে এই খবর পেয়ে রেসিডেন্ট বাবের এতটাই খুশি হয়েছেন যে তিনি তাঁর উচ্ছ্বাস গোপন রাখতে পারেননি৷ সেজন্যই তার খাস বেয়ারার কাছ থেকে নিতাই খবরটা সংগ্রহ করতে পেরেছে৷ সবকথা শুনে জগদানন্দ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘কলকাতা থেকে হেস্টিংসের বাহিনী কবে রওনা হচ্ছে সে খবরটা কি পাওয়া যাবে?’
নিতাই জানাল সেটা পাওয়া সম্ভব৷ কারণ সেই খবর পাওয়ার জন্যে সে ইতিমধ্যেই বাবেরের বেয়ারাকে টাকাপয়সা দিয়ে হাত করে রেখেছে৷ বাবের নিয়মিত খবর নিচ্ছেন কলকাতায়৷ অন্যান্য সাহেবদের সঙ্গে এবিষয়ে আলোচনাও করছেন৷ তাই জানা কঠিন হবে না৷ তা ছাড়া বাহিনী আসার খবর তো মেদিনীপুর রেসিডেন্টে আসবেই৷
জগদানন্দ বললেন, ‘এই খবরটি আমায় দিয়ো৷ এ ছাড়া তোমাকে আরও একটি গুরু দায়িত্ব দেব৷ সেকথা এখনই বলছি না৷ এই লেফাফাটি নাও৷ এরমধ্যে তোমাকে কী করতে হবে সব লেখা আছে৷ বাহিনী রওনা দেওয়ার খবর আমাকে জানিয়ে তারপর চিঠিটি পড়বে৷’
কথাগুলি শেষ করে বহুদিন পরে জগদানন্দ তাঁর গুরুভাইকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করলেন৷ তারপর নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷ নিতাই খানিকক্ষণ নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে রইল৷ তার অতিপ্রিয় এই মানুষটির মাথার ওপর কত বড়ো বিপদ যে ঘনিয়ে আসছে সেকথা সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে৷ কিন্তু এবিপদ থেকে জগদানন্দকে রক্ষা করার উপায় তার জানা নেই৷ ব্রিটিশদের সঙ্গে কাজ করে নিতাই বুঝেছে এরা অসম্ভব নিষ্ঠুর এবং ক্ষমতালিপ্সু জাতি৷ নিজেদের চলার পথে কোনো বাধা এরা সহ্য করে না৷ জগদানন্দ এদের প্রভুত্ব অস্বীকার করেছে৷ তাই জগদানন্দকে নিজেদের বুটজুতোর তলায় পিষে না দেওয়া পর্যন্ত সাহেবদের শান্তি নেই৷
নিতাই চলে যাওয়ার পর জগদানন্দ সেদিন বহু রাত পর্যন্ত গড়ের ছাদে একলা বসে চিন্তা করলেন৷ প্রবল ঠান্ডা৷ হিমে কাঁপছে চরাচর৷ কিন্তু জগদানন্দের যেন কোনো শীতবোধ নেই৷ তাঁর অন্তরে প্রবল টালমাটাল চলছে৷ তাঁর ডোমবাহিনী সুদক্ষ যোদ্ধা৷ রাজার জন্য তাঁরা প্রাণ দিতে প্রস্তুত৷ কিন্তু যে যুদ্ধে জয়ের কোনো আশা নেই সে যুদ্ধে তাঁর নিরীহ, অসহায় প্রজাদের ঠেলে দেওয়া কি তাঁর উচিত হবে৷ একসময় রাত শেষ হল৷ পূর্ব দিগন্তে দেখা দিল সীমন্তিনীর সিঁথির মতো সরু একটি লালের রেখা৷ সেদিকে তাকিয়ে দু-হাত জোড় করে জগদানন্দ উদাত্ত কন্ঠে উচ্চারণ করলেন,
‘ওঁ জবাকুসুমং শঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম
ধ্বনতারিং সর্বপাপঘ্নম প্রণহতোস্মি দিবাকরম’
মন শান্ত হয়ে গেছে তাঁর৷ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন৷
ফাল্গুন মাসের শুরুতেই নিতাই খবর দিল, লেফটেন্যান্ট রবার্ট বেইলির নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী রওনা দিয়েছে ময়নাগড়ের দিকে৷ হেস্টিংস নির্দেশ দিয়েছেন গড় দখল করে জগদানন্দকে বন্দি করে আনার৷ বেইলি তাই সবরকম বন্দোবস্তই রেখেছেন৷ এলাকার মানুষের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে না বুঝে, একদল সেনাকে পাঠানো হচ্ছে নদী পথে৷ কংসাবতী-কেলেঘাই পারাপারে যাতে সমস্যা না হয় সেজন্যই এই ব্যবস্থা৷ পদাতিক সেনাদের সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীও রয়েছে৷ প্রয়োজনে, নদীর এপার থেকেই কামান দেগে গড় গুঁড়িয়েও দিতে পারবেন বেইলি৷
খবর শুনে মুখ শুকিয়ে গেল মাতন, বিখাই, রামা সকলের৷ জগদানন্দ কিন্তু অবিচল৷ নেতাইয়ের চিঠি থেকে বোঝা যাচ্ছে ব্রিটিশ বাহিনীর পৌঁছোতে এখনও প্রায় এক সপ্তাহ সময় লাগবে৷ বিখাই বলল, ‘আজই গড়ের ছাদ থেকে শিঙে ফুঁকে দিই৷ যে যেখানে আছে সবাই অস্তর নিয়ে তৈরি হোক৷ ওই লালমুখোদের এবার আমরা শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব৷’
হাত তুলে নিষেধ করলেন জগদানন্দ৷ তারপর বললেন, ‘কাল সকালে আমি বেরোব৷ ঘোড়া তৈরি রাখিস৷’
পরদিন সকালে ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরলেন জগদানন্দ৷ মোড়লদের ডেকে জানিয়ে দিলেন ব্রিটিশ সৈন্য ময়নাগড় এলাকায় ঢুকলে কেউ যেন তাদের কোনো বাধা না দেয়৷ তবে সেনাদের যেহেতু অকারণেই মানুষের ওপর অত্যাচার করা অভ্যাস, তাই তাদের ধারপাশে না যাওয়াই ভালো৷ প্রজারা সকলেই তাঁর কথা শুনে খুব আশ্চর্য হল৷ কিন্তু রাজামশাইয়ের নির্দেশ মেনে চলাই তাঁদের অভ্যাস৷ তাই প্রশ্ন করতে সাহস পেল না৷
ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় পরান এসে খবর দিল, ব্রিটিশ সৈন্য ময়নাগড় এলাকায় ঢুকে পড়েছে৷ বিকেল নাগাদ গড়ের কাছে পৌঁছে যাবে৷ জগদানন্দ গড়ের ছাদে উঠে প্রাকারের ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ ফাল্গুন মাস৷ কিন্তু ঈশান কোণে কালো মেঘের ভ্রূকুটি৷ গাছের পাতা নড়ছে না৷ কী এক অজানা আশঙ্কায় ময়নাগড়কে ঘিরে রাখা নদী, জঙ্গল, বাঁশ বন সবই নিশ্চুপ, নিস্পন্দ৷ ছাদ থেকে নেমে এসে গড়ের ভিতরের খোলা চত্বরে এলেন জগদানন্দ৷ ততক্ষণে পরানের ডাকে কেল্লার ভিতরে যারা ছিল, তারা সকলেই সেখানে জড়ো হয়েছে৷ জগদানন্দ বললেন, ‘গোরা সৈন্যরা বিকেলের মধ্যেই পৌঁছে যাবে৷ হাতে আর সময় নেই মোটেই৷ পরান ব্যবস্থা করে রেখেছে৷ তোমরা সবাই এখনই কেল্লা ছেড়ে চলে যাও৷ আকাশের অবস্থা ভালো নয়৷ ঝড় ওঠার আগে সবাই নদী পেরিয়ে ওপারে চলে যাবে৷
জগদানন্দের কথা শুনে বিরখা আর্তনাদ করে ওঠে, ‘রাজামশাই আপনি?’
‘আমি যাব না৷ পরানও আমার সঙ্গে থাকবে৷ রানিমা আর ব্রজানন্দও থাকবে৷ চিন্তা কোরো না৷ আমি ব্রিটিশদের হাতে ধরা দেব না৷’
কথাগুলো বলে একটুক্ষণ চুপ করে থাকেন জগদানন্দ৷ তারপর আবার বলেন, ‘বেইলি গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে আসছে৷ যুদ্ধে আমরা কোনোভাবেই জিততে পারব না৷ আমি জানি আমার জন্য তোমরা প্রাণ দিতে প্রস্তুত৷ কিন্তু আমার কাছে তোমাদের প্রাণের মূল্য অনেক৷ পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনেও আমি তোমাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারব না৷ সেজন্য আমি অন্য ব্যবস্থা করেছি৷ সেকথা তোমরা পরে জানতে পারবে৷ চিন্তা কোরো না৷ ব্রিটিশ আমাকে ধরতে পারবে না৷ কিন্তু যতদিন আমি ফিরে না আসি, তোমরা আমার নিয়ম মেনে চলবে৷ হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে থাকবে৷ ঝগড়া-কাজিয়া যেন না হয়৷ আর কখনো গোরাদের এতটুকুও সাহায্য করবে না৷ সবসময় মনে রাখবে ওরা আমাদের সবথেকে বড়ো শত্রু৷ এ দেশের সর্বনাশ করার জন্যই ওরা এসেছে৷’
বেইলি যখন তার পল্টন নিয়ে নদীর ধারে এসে পৌঁছোল, তখনও বিকেল আছে৷ কিন্তু মেঘের আড়ালে আলো মরে এসেছে৷ গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে শুরু হয়েছে এলোমেলো ঝোড়ো হাওয়া৷ নদীর ওপারে, মেঘের সঙ্গে গা মিলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল ময়নাগড় দুর্গ৷ যদিও মানুষের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না৷ বেইলি প্রথমে নিরাপদ দূরত্ব থেকে চোঙা ফুঁকে ময়নাগড়ের রাজাকে আত্মসমর্পণের জন্য নির্দেশ দিলেন৷ দুর্গের ওদিক থেকে কোনো সাড়াশব্দ এল না৷ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নদীতে নৌকো নামাতে নির্দেশ দিলেন বেইলি৷ নৌকোয় করে নদী পার হতে লাগল সৈন্যরা৷ কিন্তু কেল্লা থেকে গুলি বা তির কিছুই ছুটে এল না৷ এপাশে এসে বাঁশ বন কেটে পথ করতে করতে সন্ধ্যে নেমে এল৷ ঝোড়ো হাওয়াও বইছে ভালোরকম৷ সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি৷ কিন্তু বেইলির নির্দেশ, আজ রাতেই দখল করতে হবে ময়নাগড় দুর্গ৷ তাই সৈন্যদের হাত চলছে প্রাণপণে৷
গড়ের ছাদের পাঁচিলের ফুটো দিয়ে গোরাদের ওপর নজর রাখছিল পরান৷ একসময় অন্ধকার ঘন হয়ে গেল৷ নিকষ কালো চাদরের মধ্যে অনেক অনেক আলোর ফুটকির নড়াচড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে গোরা পল্টনের অস্তিত্ব৷ ছাদ থেকে নেমে এসে পরান বলল, ‘রাজামশাই আর অপেক্ষা করা বোধ হয় ঠিক হবে না৷’
জগদানন্দ নিজের কেদারা থেকে উঠে দাঁড়ালেন৷ চারপাশটা একবার ভালো করে দেখলেন৷ তারপর ছেলের হাতটি ধরে বললেন, ‘চলো, এগোনো যাক৷’
রানিমা প্রস্তুত হয়েই ছিলেন৷ যদিও কী করেন, কোথায় যাবেন কিছুই তাঁর জানা নেই৷ দু-টি ছোটো তোরঙ্গ তুলে নিল পরান৷ গয়নার বাক্স রানিমার হাতে৷ চারজনে এসে দাঁড়ালেন রঙ্কিনীদেবীর মন্দিরের সামনে৷ জগদানন্দ প্রতিমাকে প্রণাম করলেন ভক্তি ভরে৷ তারপর বিগ্রহের পিছনের দেওয়ালে একটি বিশেষ জায়গায় চাপ দিতেই দেওয়াল একপাশে সরে গেল৷ ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে৷
অবাক হয়ে রানি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কী মহারাজ?’
বিষণ্ণ হেসে জগদানন্দ বললেন, গোপন সুড়ঙ্গপথ রানি৷ ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করলে আমার প্রিয় প্রজাদের মৃত্যু হবে৷ সে যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারব না৷ অথচ যুদ্ধ না করে সাহেবদের কাছে আত্মসমর্পণ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ তাই অনেক ভেবে গোরাদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য এই উপায় বার করেছি৷ অবশ্য নকুলের মতো স্থপতি না থাকলে একাজ হয়তো করা যেত না৷ আমি জানতাম, কপিলের পূর্বপুরুষরা এর আগেও অনেক কেল্লায় এমন গোপন সুড়ঙ্গ তৈরি করেছেন৷ কপিলকেও যে তার বাবা হাতে ধরে একাজ শিখিয়ে গেছেন, সেটা অবশ্য জানতাম না৷ পরান কপিলকে সাহায্য করেছে৷ দু-জনে মিলে প্রায় আট মাস ধরে মাটি কেটে গড় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এই লুকোনো পথ তৈরি করেছে৷ আর কেউ এর সন্ধান জানে না৷ কোনোদিন জানতেও পারবে না৷ কিন্তু আর দেরি নয় রানি, ‘চলো আমরা এবার এগোই৷’
লন্ঠন হাতে পরান আগে আগে৷ তার পিছনে বাকিরা৷ সুড়ঙ্গের ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন জগদানন্দ৷
বেইলি যখন তার বাহিনী নিয়ে গড়ের ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তখন প্রায় মধ্যরাত৷ বার বার হুকুম দেওয়া সত্ত্বেও কেউ যখন ফটক খুলল না, তখন বেইলি ফটক ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিলেন৷
বিশাল প্রবেশদ্বার ভেঙে স্রোতের মতো ভিতরে ঢুকে পড়ল গোরা সৈন্যের দল৷ ছড়িয়ে পড়ল কেল্লার আনাচে-কানাচে৷ কিন্তু কী আশ্চর্য, কেল্লা তো ফাঁকা! ভিতরে জনমনিষ্যি নেই৷ কোথায় গেলেন রাজা জগদানন্দ?
সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে জগদানন্দ আর তাঁর সঙ্গীরা যেখানে বেরিয়ে এলেন সেখানটা জনশূন্য প্রান্তর৷ ঝড় তখনও চলছে৷ সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টিও৷ পরান বলল, ‘আমার ঘর এখান থেকে বেশি দূর নয়৷ এটুকু রাস্তা হেঁটেই যেতে হবে রানিমা৷ পালকি আনার কথা সাহস করে কাউকে বলতে পারিনি৷’
নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন রানি৷ বেশ কিছুটা পথ হেঁটে পরানের বাড়ি৷ তার ছেলে-বউ জেগে বসে আছে৷ তাদের সঙ্গে রয়েছে নিতাই৷ জগদানন্দ নিতাইকে দেখেই এগিয়ে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ হয়ে গেছে৷ ঘোড়া দুটোকে গ্রামের বাইরে রেখেছিলাম৷ অন্ধকার হলে নিয়ে এসেছি৷ পালকি বলা আছে৷ ভোর হতেই চলে আসবে৷’
জগদানন্দ এবার রানির কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমাকে এবার বিদায় দাও৷ যত দেরি করবে, তত আমার বিপদ বাড়বে৷’
‘কিন্তু কোথায় যাবে তুমি?’ উদ্বেগে গলা বুজে আসছে রানিমার৷ চোখ থেকে উপচে পড়ছে অশ্রু৷
জানি না৷ কোথাও নিশ্চয় আশ্রয় খুঁজে নেব৷ এমন জায়গায় যেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত পৌঁছোবে না৷ তোমার আর ব্রজানন্দের দায়িত্ব নেবে নিতাই৷ আপাতত কলকাতায় একটা বাড়ি ভাড়া করে তোমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে৷ চিন্তা কোরো না, আমাকে না পেয়ে তোমাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার অধিকার হেস্টিংস সাহেবেরও নেই৷ তবে ময়নাগড়ের দখল যাতে ব্রজানন্দ পেতে পারে, তার ব্যবস্থা নিতাই করবে৷ আমার জন্য চিন্তা কোরো না৷ এই গোরা সাহেবদের ক্ষমতা যেদিন শেষ হবে সেদিন আমি ঠিক ফিরে আসব৷ পরান আমার সঙ্গে থাকবে৷
রানি আর ব্রজানন্দ প্রণাম করলেন৷ ছেলের মাথায় হাত রেখে কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইলেন জগদানন্দ৷ তারপর আর একটি কথাও না বলে বেরিয়ে এলেন বাইরে৷ ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরান৷ দু-জনে দু-টি ঘোড়ায় উঠে বসলেন৷ রাত্রির অন্ধকারে দ্রুত মিলিয়ে গেল দুই অশ্বারোহী৷ ঝড়ের শব্দের সঙ্গে একাকার হয়ে গেল ঘোড়ার খুরের শব্দ৷
জগদানন্দ আর ফিরে আসেননি৷ বহু চেষ্টা করে, চর লাগিয়েও হেস্টিংস সাহেব তাঁর কোনো সন্ধান পাননি৷ ক্রমশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা বেড়েছে৷ সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছে৷
কেটে গেছে আরও প্রায় পনেরো বছর৷ ওড়িশার এক প্রত্যন্ত গ্রাম৷ গ্রামের বাইরে শ্মশানে দাহকার্য চলছে৷ মানুষজন চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাদের চেহারায় শোকের ছাপ৷ অথচ যে মানুষটি মারা গেছেন, তিনি কিন্তু তাঁদের আত্মীয় নন৷ প্রায় পনেরো বছর আগে এক ফাল্গুনের সন্ধ্যায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই গ্রামে৷ তারপর থেকেই গেছিলেন৷ প্রথম প্রথম তাঁকে সকলে সন্দেহের চোখে দেখত৷ কিন্তু ক্রমশ তাঁর বুদ্ধি-বিবেচনায় মুগ্ধ হয়ে ভালোবেসে ফেলেছিল৷ গ্রামের লোকেরা তাঁকে ডাকত রাজাবাবা৷ চিতা যেখানে জ্বলছে তার অদূরে মাটিতে উবু হয়ে বসে আছে একটি মানুষ৷ শক্ত, সোজা, পেটানো চেহারা৷ যদিও মাথার চুলগুলি সব সাদা৷ চিতার আগুনের দিকেই তাকিয়ে আছে সে৷ কিন্তু তার দৃষ্টি যেন সেই আগুন ভেদ করে চলে গেছে বহু দূরে৷ ধীরে ধীরে দাহ শেষ হল৷ আগুন নিভে আসছে ক্রমশ৷ গ্রামেরই এক যুবক সেই মানুষটির কাছে গিয়ে বলল, ‘ওঠো গো এবার দাদা৷ কাল থেকে তো মুখে জল দাওনি৷ এবার ঘরে চলো৷’
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল পরান, ‘নাঃ৷ ও ঘর যার জন্য সেই তো আর রইল না৷ ওই ঘরে আমি আর যাব না৷ আমি এবার নিজের ঘরে ফিরে যাব, ময়নাগড়ে৷’