সেই রাত কৃষ্ণাচতুর্দশীর – স্বপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
-‘শিবা বেটা৷’
পিছন থেকে ডাক শুনে ফিরে তাকালেন শিবাজি৷
-‘এ কী মা! এত রাতে তুমি দুর্গের ছাতে?’
-‘ঘুম আসছে না বেটা৷’
নক্ষত্রের আলোতেও শিবাজির দেখতে ভুল হল না-মা জিজাবাই-এর দু-চোখে অশ্রুবিন্দু টলমল করছে৷
-‘মা, তুমি কাঁদছ৷ কী হয়েছে আমায় বলো? কার সাহস মহারাষ্ট্র-অধিপতি শিবাজির মাকে দুঃখ দিয়েছে! বলতে বলতে শিবাজি কোমরের তলোয়ার স্পর্শ করে৷
-‘না রে বেটা৷ নতুন করে আমায় আর কে দুঃখ দেবে৷ বরং আজ তো আমার বড়ো সুখের দিন৷ তোর মতো বেটা পেয়েছি যার প্রতাপে দিল্লির মসনদ পর্যন্ত কেঁপে ওঠে, . . .’ বলতে বলতে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলেন জিজাবাই৷
কিন্তু মা না বললেও শিবাজি জানেন তাঁর আসল দুঃখটা কোথায়৷ শিবাজির পিতা শাহজি ছিলেন বিজাপুর সুলতানের এক জায়গিরদার৷ শিবাজি বয়সে তখন খুব ছোটো-শাহজি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে জিজাবাই আর ছোট্ট শিবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন৷ এ দুঃখ কোনোদিনই ভোলেননি জিজাবাই৷ মায়ের এ কষ্ট চিরকাল বহন করেছেন শিবাজিও৷ পিতার এই অবিচার আর অন্যায় শিশুকাল থেকে তাঁর এ সন্তানকে করে তুলেছে প্রতিবাদী৷
-‘শিবা বেটা৷’ মায়ের ডাকে অন্যমনস্কতা ভাঙল শিবাজির৷ মা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দূর গিরিচূড়ায় কোন্ডানা দুর্গের দিকে৷
-‘জানিস শিবা, একদিন ওই দুর্গ ছিল বিজাপুর সুলতানের দখলে৷ তখন তোর পিতা ছিলেন ওই দুর্গের রক্ষক৷ তখনও তোর জন্ম হয়নি৷ তোর পিতার সঙ্গে ওই দুর্গে আমাদের দিনগুলো কত সুখেই না কেটেছিল৷ তারপর কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল৷ তবে আজও ওই দুর্গে অনেক স্মৃতি রয়ে গেছে৷’ বলতে বলতে আর একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলেন জিজাবাই৷
শিবাজি স্থির চোখে তাকিয়ে থাকেন মায়ের মুখের দিকে৷ তিনি বুঝতে পেরেছেন মা কী বলতে চান৷ মায়ের সে-ইচ্ছা অবশ্যই পূরণ করবে শিবা বেটা৷
দুই
ঘোড়ায় চড়ে বেশ দুলকিচালে দুই ভাই গাঁয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিল৷ তানাজি আর সূর্যাজি৷
দুই ভাই-এর মধ্যে খুব মিল৷ দু-জনের মনই আজ খুশি খুশি৷ তানাজি তো আনন্দের আবেগে বেসুরো গলায় গান গেয়েই চলেছে৷ গাইবেই তো৷ তানাজির একমাত্র পুত্র রায়বারের বিয়েটা এতদিনে স্থির করা গেছে৷ কন্যাটি তানাজির ভারি পছন্দের৷ যেমন রূপমতী তেমনই লক্ষ্মীমন্ত৷ হবে না! কত বড়ো বংশের মেয়ে! তার বাবা পাশের রোহিতমাটি গাঁয়ের দেশমুখ৷ গাঁয়ের সবাই তাকে খাতির করে৷ তানাজি তো ভাবী বেয়াইকে কথাই দিয়ে দিয়েছে আগামী কৃষ্ণাচতুর্দশীর শুভ তিথিতে চার হাত এক করে পুত্রবধূ পার্বতীকে নিজে বরণ করে ঘরে নিয়ে আসবে৷
এখন এতবড়ো সুসংবাদটা শিবাজিরাজের কাছে পৌঁছে না দিয়ে শান্তি নেই তানাজির৷ তানাজি শিবাজির সেনাবাহিনীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সেনানায়কই শুধু নয়, তাঁর বাল্য সখা৷ কিশোর বয়সের সবচেয়ে প্রিয় সাথি৷
তানাজি জানে শিবাজিরাজে তাকে যেমন ভালোবাসেন তার পুত্র রায়বারকেও নিজের পুত্রের মতোই মনে করেন৷
রায়গড় দুর্গের তোরণ পার হয়ে দুই ভাই দুর্গে প্রবেশ করল৷
কিন্তু একী! দুর্গের ভেতরে পা দেওয়ার সঙ্গেসঙ্গে একজন সৈনিক এসে তানাজিকে অভিবাদন জানায়৷
-‘কী ব্যাপার সৈনিক৷’
-‘মহারাজ আপনাকে জরুরি তলব করেছেন সর্দার৷’
অবাক হয় তানাজি৷ এমন কী জরুরি ব্যাপার যে তানাজি দুর্গে প্রবেশের পর তাকে এতটুকু বিশ্রামের সুযোগ না দিয়েই ডেকে পাঠালেন শিবাজিরাজে৷ তবে কি রায়বারের বিবাহ স্থির হওয়ার খবরটা তানাজি জানাবার আগেই পৌঁছে গেছে সখা মহারাজের কাছে? কিন্তু . . .
সূর্যাজি দাদার মনোভাব বুঝে বলে, ‘এত ভাববার কী আছে দাদা, তুমি বরং ঘোড়া থেকে নেমে আগে মহারাজের সঙ্গে দেখা করে এসো৷ তাহলেই তো জানতে পারবে মহারাজ কী চান৷’
তাই গেল তানাজি৷ সূর্যাজি অপেক্ষায় রইল প্রাসাদের বাইরে৷
তানাজি প্রাসাদে প্রবেশ করেছিল বিস্ময় আর উদ্বেগ নিয়ে, ফিরে এল একমুখ দুশ্চিন্তা নিয়ে৷
-‘কী দাদা, আমাদের শিবা মহারাজ তোমাকে জরুরি তলব কেন পাঠিয়েছিলেন কিছু বললেন?’
-‘হ্যাঁ সূর্যা, শিবারাজে আমায় এক গুরুতর দায়িত্ব দিয়েছেন৷’
-‘গুরুতর দায়িত্ব!’
-‘হ্যাঁ৷ আগামী কৃষ্ণাচতুর্দশী আমাদের রাজমাতার জন্মদিন৷ ওই রাতের মধ্যেই মুঘলদের হাত থেকে কোন্ডানা দুর্গটা ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের মাকে উপহার দিতে হবে৷ শিবারাজে দায়িত্ব দিয়েছেন আমাকেই এ-লড়াই পরিচালনার জন্য৷’
-‘কিন্তু দাদা, তুমি কি বলনি ওইদিনই তোমার ছেলের বিয়ে৷ কৃষ্ণাচতুর্দশীর রাতে . . .’
-‘না সূর্যা৷ আমি বলার আগেই শিবারাজে তাঁর ইচ্ছের কথা আমায় জানিয়েছেন, আর তুমি তো জানো তানাজির কাছে তার সখা শিবারাজের ইচ্ছের কোনো বিকল্প নেই৷’
-‘তাহলে রায়বারের বিয়ের কী হবে দাদা? তুমি যদি সে-রাতে হাজির না থাকো . . .’
-‘না সূর্যা,’ ছোটো ভাইকে কথা শেষ করতে না দিয়ে তানাজি বলে, ‘আগামী কৃষ্ণাচতুর্দশীর রাত তানাজির জীবনের এক শুভ তিথি৷ ওই রাতে দু-টো কাজই সম্পন্ন হবে৷’
-‘কিন্তু দাদা৷’
-‘হ্যাঁ, ভাই, এখানকার লড়াই ফতে করেই ও-দিন আমি পৌঁছে যাব রোহিতমাটি গাঁয়ে৷ আমি নিজে বরণ করে ঘরে তুলব আমার পুত্র রায়বার আর গৃহলক্ষ্মী পার্বতীকে৷ আমি কথা দিচ্ছি সূর্যা৷’
সূর্যাজি অবাক হয়ে তাকায় তার দাদার মুখের দিকে৷ সে জানে তার দাদা জীবনে কোনোদিন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়নি৷ কিন্তু এ-কাজ কি সম্ভব! একই রাতে এমন দারুণ গুরুত্বপূর্ণ দুটো দায়িত্ব . . .
-‘এখন যাও ভাই, তুমি গাঁয়ে ফিরে যাও৷ রায়বারের বিয়ের সব আয়োজন তো তোমাকেই করতে হবে৷ তবে সাবধান আমাদের আগামী দুর্গ অভিযানের কোনো কথা যেন কেউ জানতে না পারে৷ কারণ, এবারের লড়াইয়ের কৌশল হবে অত্যন্ত গোপনীয় এবং অভূতপূর্ব৷’
-‘বেশ, তোমার হুকুমই পালন করব দাদা৷’ সূর্যাজি এরপর আর অপেক্ষা করে না৷ আবার ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে৷ ফিরে চলে গাঁয়ের পথে৷ এখন থেকে তার দায়িত্বও কম নয়৷
তিন
পশ্চিমঘাট গিরিশীর্ষে কোন্ডানা এক দুর্ভেদ্য দুর্গ৷ চারদিকে খাড়াই পাহাড়৷ দুর্লঙ্ঘ প্রাকৃতিক বাধা৷ এর ওপর দুর্গের বর্তমান রক্ষক উদয়ভানু রাঠোর অত্যন্ত দক্ষ সেনানায়ক৷ অন্তত বিশ হাজার সৈন্য মজুত আছে সে দুর্গে৷ এমন দুর্গ অবরোধ করে সরাসরি যুদ্ধে জেতা খুবই কঠিন কাজ৷ শিবাজি নিজেও তা জানেন, আর সে কারণেই এক কঠিন দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর সবচেয়ে দক্ষ এবং বিশ্বস্ত সেনানায়ক বন্ধু তানাজির ওপর৷ শিবাজীর বিশ্বাস একমাত্র তানাজিই এই কঠিন কাজ হাসিল করতে পারবে৷
কিন্তু কীভাবে হবে এ অসাধ্যসাধন৷ চিন্তায় একটা রাত নিদ্রাহীন কাটে তানাজির৷ তারপরই মনে পড়ে কঙ্কর কথা৷
কিশোর কঙ্ক৷ তানাজির মস্ত ভক্ত৷ তানাজির গাঁয়েরই ছেলে৷ এবারই তো তানাজি যতদিন গাঁয়ে থেকেছে, কঙ্ক বার বার ঘুরে ফিরে এসে আবেদন করেছে, সে মারাঠা সেনাদলে যোগ দিতে চায়৷ তানাজি হেসে বলেছে, ‘দাঁড়া, আগে তোর বয়সটা হোক৷ তোর এ-বয়সে তো শরীরে গাদাবন্দুক আর ঢাল-তলোয়ারের ভারই বইতে পারবি না৷ তার চেয়ে যে বিদ্যেটা তোর জানা আছে, এখন সেটাই চর্চা করে যা৷’
এখন মনে হচ্ছে কঙ্কর সে-বিদ্যেটাই কাজে লাগাবার সময় এসেছে! সেই যে রামায়ণে রামচন্দ্র সাগর পার হতে একটা কাঠবিড়ালিরও সাহায্য নিয়েছিলেন! এখানে কঙ্কর অবদান কিন্তু একটা কাঠবিড়ালির চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে৷ আর তার পোষা যশবন্তী৷ সেই তো হতে পারে কোন্ডানা দুর্গ অভিযানের আসল হাতিয়ার৷
-‘এই, কে আছিস?’ তানাজির ডাক শুনে ঘনিষ্ঠ দেহরক্ষী রাজারাম এসে অভিবাদন করে৷
-‘শোনো রাজারাম৷ তোমায় একটা গোপনীয় কাজ দেব৷’
-‘আদেশ করুন সর্দার৷’
-‘এক্ষুনি রওনা হয়ে যাও আমার গাঁয়ের উদ্দেশে৷ সবচেয়ে দ্রুতগামী ঘোড়াটায় চড়ে যাবে৷ তারপর যা-যা বলব করবে৷ কিন্তু সাবধান! কাকপক্ষী যেন টের না পায়৷’
-‘তাই হবে সর্দার৷’
তানাজি এবার তার বিশ্বস্ত পার্শ্বচরকে তার কর্তব্য কর্ম বলতে থাকে৷ রাজারাম মন দিয়ে শোনে৷
চার
এদিকে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই মারাঠা বাহিনী পুরোদস্তুর তৈরি হয়ে গেল৷
তানাজি শিবাজির সঙ্গে যাকে বলে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বসে আগামী যুদ্ধ পরিকল্পনা রচনা করল৷
না, সামনাসামনি যুদ্ধ নয়, তৈরি হল নতুন যুদ্ধ কৌশল৷
এদিকে কঙ্কও এসে পড়ল৷ সঙ্গে ঝাঁপিতে আছে যশবন্তী৷ কঙ্কর প্রতিটি ইঙ্গিত সে যে- কোনো মানুষের চেয়ে বেশি বোঝে৷ কঙ্ক মহাখুশি৷ সে যে এই বয়সেই এতবড়ো দায়িত্ব ও সম্মান পাবে যেন স্বপ্নেও ভাবেনি৷
এর মধ্যে তানাজি তার গুপ্তচর বাহিনীকে পাঠিয়ে দিয়েছে কোন্ডানা দুর্গের আশপাশে৷ সাধারণ চাষি বা রাখালের ছদ্মবেশে৷ তারা ক-দিন যাবৎ নানা দিক থেকে দুর্গটাকে লক্ষ করছে৷ তারা ফিরে এলে তাদের কাছ থেকে তানাজি দুর্গের বর্তমান অবস্থান এবং হালচালের অনেক খবরই পেল৷
অবশেষে এল সেই রাত৷ কৃষ্ণাচতুর্দশী৷
সে দিনটা আধুনিক ইংরেজি তারিখ অনুসারে ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি৷
গভীর রাত, চারদিকে নিঃসীম অন্ধকার৷ পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে মাঝে মাঝে শুধু জ্বলে উঠছে জোনাকির আলো৷ দূর থেকে হিংস্র নিশাচররা মাঝে মাঝে চিৎকার করে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে৷
নিঃশব্দে খুলে গেল রায়গড় দুর্গদ্বার৷
পরনে কালো পোশাক, মাথায় কালোপাগড়ি, পিঠে ঢাল, কোমরে তলোয়ার-শিবাজির বাহিনীর পাঁচ-শো দুর্ধর্ষ মাওয়ালি উপজাতি যোদ্ধা বেরিয়ে এল দুর্গের ভেতর থেকে৷ ওদের প্রত্যেকের ঘোড়ার পায়ে কাপড় জড়ানো৷ এতটুকু শব্দ নেই হাঁটাচলার৷
এই বাহিনীকে পরিচালনা করছে তানাজি৷ তার পোশাক অন্যান্য সৈনিকদের মতোই৷ তার পাশে কিশোর কঙ্ক৷ তার সঙ্গে একটা বিরাট ঝাঁপি৷ আমরা জানি সেই ঝাঁপির মধ্যে কী আছে-কঙ্কর পোষমানা গোসাপ ‘যশোবন্তী’৷ বিশাল তার আকৃতি৷
এ অভিযানে যশবন্তীর কী ভূমিকা তা আমরা যথাসময়ে জানতে পারব৷
পাঁচ-শো মাওয়ালি সৈনিক তাদের অধিনায়কের নেতৃত্বে কালো অন্ধকারে গা মিশিয়ে দ্রুত অথচ নিঃশব্দে পাহাড় ডিঙিয়ে এগিয়ে চলে কোন্ডানা দুর্গের দিকে৷ ওদিকে কৃষ্ণাচতুর্দশীর রাতের অবগুন্ঠনে ঢাকা কোন্ডানা দুর্গ ঘুমে নিথর হয়ে রয়েছে৷ কোথাও এতটুকু শব্দ নেই৷ নিশাচর শ্বাপদরাও কি এই মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়েছে?
পাঁচ-শো মারাঠা সৈনিক এসে পৌঁছোল কোন্ডানা দুর্গের কাছাকাছি৷ তাদের মধ্যে অর্ধেক অংশ গিয়ে হাজির হল মূল তোরণ দ্বারের কাছে আর বাকিরা পৌঁছোল পশ্চিম দিকের প্রাচীরের নীচে৷
সেখানে দাঁড়িয়ে এবার তানাজি কঙ্ককে বলে, ‘কঙ্ক তুমি প্রস্তুত তো? আর তোমার যশবন্তী . . .?’
-‘সে শুধু আপনার হুকুম শোনার জন্যেই অপেক্ষা করছে সর্দার৷’ বলতে বলতে কঙ্ক তার ঝাঁপি খুলে যশোবন্তীকে বার করল৷
যশোবন্তী এক বিরাট আকৃতির গোসাপ৷ তাকে দিয়ে অনেক চমকপ্রদ কাজই করাতে পারে কিশোর কঙ্ক৷ বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে এটাই ওদের পেশা৷ তবে এ-কাজে কঙ্ক তাদেরও ছাড়িয়ে গেছে, এ-কথা স্বীকার করতেই হবে৷
কঙ্ক যশোবন্তীর গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ‘দেখ যশোবন্তী, অন্যের কাছে তুই শুধুই একটা মূক প্রাণী৷ কিন্তু আজ তোর ওপরই নির্ভর করছে মারাঠাদের সম্মান৷’
কঙ্কের কথাগুলো শুনে তানাজির বুকের ভেতরটাও দুলে উঠল৷ কঙ্কের দিকে তাকিয়ে তানাজি বলল, ‘কঙ্ক, আর দেরি নয়৷ মনে থাকে যেন আজ রাতের মধ্যেই আমাদের বিজয় হাসিল করতে হবে৷’
কঙ্ক এবার তার সর্দারকে একবার অভিবাদন জানিয়ে পোষা গোসাপের গলায় একটা শক্ত লম্বা দড়ি বেঁধে তার মুখটা প্রাচীরের ওপর দিকে রেখে তাকে বসিয়ে দিল প্রাচীরের গায়ে৷ তারপর সংকেত করে বলল, ‘যা রে যশোবন্তী, যেমন ভাবে শিখিয়েছি, উঠে যা প্রাচীরের একেবারে উঁচু মাথা পর্যন্ত৷’
গোসাপ যশোবন্তী তার পালকের ভাষা বুঝতে পারল৷ তরতর করে উঠে চলল অন্ধকার প্রাচীরের গা বেয়ে৷ এ-প্রান্ত থেকে কঙ্ক দড়ি ছেড়েই চলল৷ একসময়ে যশোবন্তীকে আর দেখা গেল না৷ কিন্তু সে যে ক্রমেই উঠছে তা বোঝা গেল দড়ির চলন দেখে৷
একসময় দড়ি আর নড়ল না৷ এর অর্থ-শিক্ষিত গোসাপ যশোবন্তী নিশ্চয়ই দুর্গ প্রাচীরের একেবারে উঁচু পর্যন্ত উঠে প্রাচীরের কোনো গর্ত বা উঁচু দণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে৷
তবু নীচে থেকে দড়ির প্রান্তভাগ টেনে পরীক্ষা করল কঙ্ক৷ হ্যাঁ, দড়ি বেশ শক্ত৷ এ দিকে তানাজি তীব্র উত্তেজনা নিয়ে কঙ্কর দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ কঙ্কের সফলতার ওপরই আজ নির্ভর করছে এ অভিযানের সাফল্য৷
কিশোর কঙ্ক তানাজির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল, তারপর ফিসফিস করে কী বলে তার হালকা শরীরটা নিয়ে দড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল৷
রাত গভীর৷ কোন্ডানা দুর্গের খাড়াই পাহাড়-প্রাচীর বেয়ে দড়ি ধরে উঠে চলেছে কঙ্ক৷ মাঝে মাঝে দড়িটা ধরে টেনে দেখছে৷ এতটুকু অসাবধান হলে কিংবা দড়ির আগা আলগা হলেই কঙ্ক ছিটকে পড়বে নীচে, অনেক নীচে৷ তাহলে সে শুধু নিজেই মরবে না, তার সর্দারের সব পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাবে৷ সুতরাং কঙ্ককে পৌঁছোতেই হবে এই প্রাচীর শীর্ষে৷
অন্ধকারে গা মিশিয়ে কঙ্ক একটু একটু করে উঠে চলেছে৷ একসময় সে পৌঁছে যায় প্রাচীরের ওপর৷ শিক্ষণপ্রাপ্ত� যশোবন্তী তার কাজ ঠিকমতোই করেছে৷ প্রাচীর শীর্ষে একটা শক্ত ধাতব দণ্ড ঘিরে দড়ির পাক দিয়ে ঝুলন্ত দড়িটাকে সে মই-এর মতো শক্ত করে দিয়েছে৷
-‘শাবাশ যশোবন্তী!’ ফিসফিস করে বলে পোষা গোসাপের পিঠে হাত বুলায় কঙ্ক৷
কিন্তু কই! যশোবন্তী তার ডাকে তো সাড়া দিল না৷ এমন তো হয় না কখনো৷ তার প্রিয় যশোবন্তী প্রভুর আদর পেলে আর কিছু চায় না৷
কঙ্ক আবার যশোবন্তীর গায়ে হাত বুলায়৷ একী! ওর শরীরটা নিথর! এবার আর বুঝতে ভুল হয় না৷ এই কঠিন কাজ শেষ করে যশোবন্তী ধাতব দণ্ডে নিজের শরীরটা পাক দিয়ে নিজেও দড়ির ফাঁসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা পড়েছে৷
-‘যশোবন্তী!’ একটা দমক কান্না কঙ্কর বুকের ভেতর থেকে উঠে আসে৷ কিন্তু চকিতে নিজেকে সামলে নেয়৷ কান্নার সময় এখন তার নেই৷ দুর্গ-প্রাচীরের নীচে তারই সংকেতের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে মারাঠা সেনারা৷ কঙ্কর সংকেত পেলেই ওরা এই পথে নিঃশব্দে উঠে এসে প্রবেশ করবে দুর্গের মধ্যে৷ ভেতর থেকে খুলে দেবে দুর্গ দ্বার৷ সেখানে দুর্গে প্রবেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে শিবাজি মহারাজের দুর্দ্ধর্ষ মাওয়ালি সেনাদল৷
আর দেরি না করে কঙ্ক দড়িটা ধরে প্রাণপণে ঝাঁকাতে থাকে৷ এটাই সংকেত৷
পাঁচ
লড়াইটা কিন্তু যত সহজ ভাবা গিয়েছিল তত সহজে ফতে হল না৷
কোন্ডানার দুর্গ রক্ষক উদয়ভানু রাঠোর বেশ তৎপর যুদ্ধনায়ক৷ অন্ধকারেও বোধ হয় তার চোখ জ্বলে৷ তবে মারাঠাদের পরিকল্পনামতো সব কিছুই ঠিকঠাক হয়েছিল৷ কঙ্কর সংকেত শুনে একদল সৈনিক দড়ি ধরে উঠে নিঃশব্দে দুর্গের পাঁচিল টপকে দুর্গে ঢুকে দুর্গদ্বার খুলে দিয়েছিল৷ পাঁচশো মাওয়ালি সৈন্য তোরণ পথে ঢুকেও পড়েছিল৷ তবে সোরগোল তো একটা হয়েছিলই৷ সেই শব্দেই উদয়ভানুর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল৷ সঙ্গেসঙ্গে সে পরিস্থিতি অনুধাবন করে তার বাহিনীকে জাগিয়ে তুলেছে৷ সারা দুর্গে জ্বলে উঠেছে মশালের আগুন৷
তারপর দুর্গ-মধ্যে শুরু হল ভয়ংকর যুদ্ধ-হয় মরো না হয় মারো!
ওদিকে রায়গড় দুর্গের প্রাচীরে দাঁড়িয়ে শিবাজি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন কোন্ডানা দুর্গের দিকে৷ কৃষ্ণাচতুর্দশীর সরু চাঁদ ইতিমধ্যে অস্ত গেছে৷ চারদিকে ঘোর অন্ধকার৷ কিন্তু অন্ধকারের গাঢ় আবরণ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে মাঝে-মাঝেই ওখানে ঝলসে উঠছে আগুনের ফুলকি৷ ভেসে আসছে মরণ আর্তনাদ৷ শিবাজি বুঝতে পারেন এ-সময়ে ওখানে চলছে মরণপণ লড়াই৷ এ-লড়াই ততক্ষণ চলবে, যতক্ষণ না ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’৷ কোমরের কোষবদ্ধ অসিতে হাত রেখে নিশ্চল মূর্তির মতো সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন শিবাজি৷ প্রহরের পর প্রহর অতিক্রান্ত হয়৷
একসময় রাত শেষ হয়৷ অন্ধকারের ঘোমটা খুলে পর্বতশীর্ষে কোন্ডানা দুর্গ আত্মপ্রকাশ করে৷ ভোরের পাখিরা কলকাকলিতে মেতে ওঠে৷
কোন্ডানা দুর্গ থেকে আর কোনো শব্দ ভেসে আসছে না৷ কিন্তু কই, যুদ্ধ শেষে মারাঠা সৈনিকরা তো উল্লাস প্রকাশ করছে না৷ ভেসে আসছে না শিবাজিরাজের জয়ধ্বনি! তবে . . . তবে কি . . .!
হঠাৎ শিবাজির নজর পড়ে পাহাড়ি পথ ধরে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে এক মারাঠা সৈনিক৷ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকে চিনতে ভুল হল না শিবাজীর৷ ওই সৈনিকের নাম রাজারাম৷ তানাজির একান্ত অনুগত দেহরক্ষী৷ ও কী খবর আনছে শিবাজির কাছে? কোনো বিশেষ জরুরি বার্তা না হলে ও একা এভাবে ছুটে আসত না৷
আর এক মুহূর্তের অপেক্ষা করলেন না শিবাজি৷ দ্রুত নেমে যান প্রাসাদ শীর্ষ থেকে৷ দুর্গ প্রহরীকে আদেশ করেন তক্ষুনি রাজারামকে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে৷
হুকুম তামিল হতে দেরি হয় না৷
আহত ঘর্মাক্ত সৈনিক রাজারাম শিবাজির সামনে এসে অভিবাদন জানায়, ‘মহারাজের জয় হোক!’
-‘যুদ্ধের পুরো খবর বলো সৈনিক৷’
-‘আমাদের জয় হাসিল হয়েছে মহারাজ৷ কোন্ডানা দুর্গ এখন আমাদের দখলে৷ কিন্তু…’
-‘কী, কী হয়েছে তানাজির, বলো সৈনিক কেমন আছে সে,’ বলতে বলতে একরাশ উদ্বেগ ঝরে পড়ে শিবাজির কন্ঠ থেকে৷
-‘বড়ো সর্দার অত্যন্ত আহত মহারাজ, উঠে দাঁড়াবার সামর্থ পর্যন্ত নেই?’
শিবাজি স্তব্ধ হয়ে যান৷ এ কী শুনছেন তিনি৷ তানাজি শুধু তাঁর সেনাধ্যক্ষ নয়, তাঁর সখা, ভাই৷
রাজারাম বলে চলে, ‘মহারাজ আমাদের সেনাপতির অসীম সাহসে জয় যখন আমাদের নাগালে এসে পড়েছে কোন্ডানা দুর্গের মুঘল রক্ষক উদয়ভানু হঠাৎ সর্দার তানাজিকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহ্বান করল৷ অত্যন্ত আহত অবস্থাতেও পিছপা হলেন না বড়ো সর্দার৷ প্রচণ্ড যুদ্ধ চলল দু-জনে৷ উদয়ভানু কম দক্ষ তলোয়ারবাজ নয়৷ তবু সে পেরে উঠল না আমাদের বড়ো সর্দারের সঙ্গে৷ উদয়ভানু মারা পড়ল৷ দুর্গ আমাদের অধিকারে এল কিন্তু আমাদের বড়ো সর্দার আহত অবস্থায় ক্রমাগত রক্তপাতে . . .’
আর শোনার ধৈর্য হল না শিবাজির৷ তিনি চিৎকার করে হুকুম দিলেন, ‘এই কে আছিস, এক্ষুনি আমার ঘোড়া তৈরি কর৷ সবচেয়ে দ্রুতগামী ঘোড়া, আমি কোন্ডানা দুর্গে যাব৷’
ছয়
দ্রাম . . . দ্রাম . . . ভোঁপ . . . ভোঁপ . . .!
তানাজির ছোটো ভাই সূর্যাজি ভ্রাতৃপুত্র রায়বার আর নবপরিণীতা পার্বতীকে নিয়ে রোহিতমাটি গ্রাম থেকে শোভাযাত্রা সহকারে নিজের গাঁয়ে ফিরছিল৷ কিন্তু মনটা তার একেবারেই ভালো নেই৷ দাদার কথাতেই সূর্যাজি এ বিবাহের দিন পরিবর্তন করেনি৷ দাদা কথা দিয়েছিল কৃষ্ণাচতুর্দশীর শুভ তিথিতে দাদা দুটো কাজ সারবে-শিবাজির ইচ্ছামতো কোন্ডানা দুর্গ জয় করবে তারপর চলে আসবে গাঁয়ে৷ একমাত্র পুত্রের বধূকে নিজে বরণ করে ঘরে তুলবে৷ কিন্তু রাত শেষ হয়ে গেল৷ পুব আকাশে সূর্যটা অনেকটা উঠে এসেছে৷ আর অপেক্ষা করতে পারেনি সূর্যা৷ শেষপর্যন্ত নিজেই বর-কনেকে সঙ্গে নিয়ে ফেরার পথ ধরেছে৷
শোভাযাত্র গাঁয়ে প্রবেশ করল৷
শোভাযাত্রার প্রথমে সূর্যাজি৷ তারপর ঘোড়ার পিঠে বরসাজে রায়বার, তার পেছনে পালকিতে নববিবাহিতা গৃহলক্ষ্মী পার্বতী৷ গাঁয়ের সব মানুষ ভিড় করে পথের দু-পাশে দাঁড়িয়ে৷ তানাজিকে এ-গাঁয়ে সবাই ভালোবাসে৷ ওরা সবাই তার পুত্র এবং পুত্রবধূকে দেখতে চায়৷
বাড়িতে সামনে এসে অবাক হয়ে গেল সূর্য্যাজি৷ এ কী দেখছে সে? তাদের ঘরের সামনে একদল সশস্ত্র সৈনিক৷ তাদের পিছনে দু-টি সুদৃশ্য পালকি৷
শোভাযাত্রা থমকে দাঁড়াতেই সৈনিকদের মধ্যে থেকে একজন সশস্ত্র পুরুষ এগিয়ে এলেন৷ দেখেই চমকে উঠল সূর্যা-
-‘এ কী? মহারাজ!’
শিবাজীর দু-চোখে বিষণ্ণ দৃষ্টি৷ তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন তানাজির ভাই সূর্যার কাছে৷
-‘সূর্যা৷ তোমার দাদা তানাজি আমার শুধু সেনাধ্যক্ষ ছিল না, সে ছিল আমার ভাই৷ তাই সে যে-কথা দিয়েছিল তা রাখার দায়িত্ব আমার নিজেরও৷’
-‘আপনি কী বলছেন মহারাজ!’
-‘তানাজি কথা দিয়েছিল সে তার কাজ শেষ করে নিজে পুত্রবধূকে বরণ করে তুলবে৷’
-‘হ্যাঁ, কিন্তু . . .’
-‘সে তার প্রথম কাজ শেষ করেছে৷ কোন্ডানা দুর্গ তুলে দিয়েছে আমার হাতে৷ কিন্তু নিজের গাঁয়ে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেনি,’ বলতে বলতে বিষণ্ণতায় ভারী হয়ে ওঠে শিবাজির কন্ঠস্বর৷ ধরাগলায় মারাঠা নৃপতি বলেন, ‘কিন্তু মৃত্যুর আগে সে তার দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিয়েছে৷ রাজা হিসেবে নয়, তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, ভাই হিসেবে৷’
শিবাজির কথার মাঝেই তানাজির প্রাণহীন দেহটা পালকি থেকে নামিয়ে সামনে রাখে কয়েকজন সৈনিক৷
শোভাযাত্রার উৎসব ততক্ষণে স্তব্ধ হয়ে গেছে৷ প্রতিটি মানুষ নিষ্পন্দ৷ সূর্যাজির দু-চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা৷
এই নৈঃশব্দে ভেঙে অন্য পালকিটি থেকে নেমে আসেন এক বয়স্ক নারী-শিবাজির মাতা জিজাবাই৷
তাঁকে দেখে চমকে ওঠে সূর্যা, ‘রাজমাতা আপনি!’
-‘হ্যাঁ সূর্যা৷ আমাদের ঘরের মেয়েকে আমি ছাড়া আর কে বরণ করবে? না-না, এই শুভদিনে কেউ চোখের জল ফেলবে না৷ তবে যে আমার তানাজির আত্মা শান্তি পাবে না৷ সে যে সৈনিকের বীরশয্যা লাভ করেছে৷’ বলতে বলতে নবপরিণীতা পার্বতীর দিকে এগিয়ে যান জিজাবাই৷ বেজে ওঠে মঙ্গল শঙ্খ৷ মারাঠা সৈনিকরা সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে সম্মান নিবেদন করে৷
একদিকে শোক অন্যদিকে আনন্দ৷ বিসর্জন আর আবাহনের সুরে মূর্ছনা একইসঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে আকাশে-বাতাসে৷
কোন্ডানা দুর্গ জয় করে শিবাজি সে দুর্গের নতুন নামকরণ করেছিলেন ‘সিংহগড়’৷ ঐতিহাসিকরা বলেন সিংহগড়ের সিংহ তানাজির স্মৃতিতেই দুর্গের এই নামকরণ করেছিলেন মহারাষ্ট্র নৃপতি৷ মহারাষ্ট্রের ইতিহাসে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে এই ‘সিংহবীর’-এর নাম!