রাজার ধর্ম – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
ন্যায়াধীশ সবিস্ময়ে তাকালেন বিচারপ্রার্থীর দিকে৷
‘কী-কী নাম বললে? কার নামে নালিশ তোমার?’
যে লোকটি নালিশ জানাতে এসেছিল সে কিন্তু ন্যায়াধীশের এই তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বরে বা তাঁর ভ্রূকুঞ্চনে দমল না৷ শুধু আর একবার হাতজোড় করে প্রধান বিচারপতিকে নমস্কার জানিয়ে বেশ ধীর স্থির ভাবেই বলল, ‘মহামান্য পেশোয়ার নামে৷’
আর কোনোরকম চাঞ্চল্য প্রকাশ করলেন না রামশাস্ত্রী, শুধু একবার শান্তভাবে লোকটির আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখলেন৷ অতি দীনহীন চেহারা, বেশভূষাও সামান্য-জীর্ণ বাস, জামাতে তালি দেওয়া-পাগড়ির কাপড় পর্যন্ত যৎপরোনাস্তি মলিন এবং ছিন্ন৷ তবু তার মুখে-চোখে এমন একটা দৃঢ়তার ছাপ, সমস্ত ভঙ্গিতে এমন একটা গাম্ভীর্য যে নেহাত পাগল বলেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷
রামশাস্ত্রীও পারলেন না উড়িয়ে দিতে৷ বললেন, ‘বেশ, বলো কী অভিযোগ৷ এ প্রধান ধর্মাধিকরণ, এখানে তোমার কোনো ভয় নেই-স্বয়ং ছত্রপতির নামে অভিযোগ থাকলেও নির্ভয়ে জানাতে পারো৷’
সে লোকটি জবাব দিল, ‘না, রাজার নামে কোনো অভিযোগ করতে চাই না-কারণ তিনি নামেই রাজা-শাসক নন৷ আমার অভিযোগ সেই আসল শাসকের বিরুদ্ধে৷’
‘আমি অপেক্ষা করছি তোমার বক্তব্যের জন্য,’ শান্তভাবে বললেন ন্যায়াধীশ, ‘আমার দিক থেকে মনোযোগের কোনো অভাব হবে না৷’
‘তা জানি ন্যায়াধীশ, সেই জন্যেই আপনার দরবারে এমন নালিশ নিয়ে দাঁড়াতে সাহস করেছি৷’
তারপর একটু থেমে, আর একটি নমস্কার করে বলল সে, ‘পেশোয়া মাধব রাও এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের শাসক, বহু কোটি লোকের ভাগ্যবিধাতা তিনি৷ এ দেশের ভিতরে অশান্তি দলাদলি ষড়যন্ত্র-এর বাইরে অসংখ্য ঈর্ষাতুর শত্রু৷ কোনো শাসক যদি দিনে-রাতে প্রত্যহ অন্তত সাত প্রহর সময় রাজকার্যে ব্যয় না করেন তাহলে এত সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়৷ গৃহযুদ্ধ বহির্যুদ্ধ সামলানো, অনাচার অরাজকতা দমন, প্রজাদের সুখশান্তি সমৃদ্ধির ব্যবস্থা করা-পেশোয়া বা প্রধান শাসকের বহু কঠিন দায়িত্ব৷ কিন্তু মহামান্য পেশোয়া মাধব রাও ইদানিং তাঁর সে কর্তব্য কর্মে একান্ত অমনোযোগী হয়েছেন, একেবারে পরাঙ্খুখ হয়েছেন বলা চলে৷ দিনরাতের অধিকাংশ সময় পূজা, পাঠ, হোম, ধ্যান-ধারণা ও জপতপেই অতিবাহিত করেন, খুব জরুরি রাজকার্যও দেখবার সময় হয় না তাঁর৷ তার ফলে কতকগুলি দুর্বৃত্তর খুব সুবিধা হয়ে গেছে৷ বিশেষ করে তাঁর পিতৃব্য রাঘোবা এই অবসরে তাঁর সমস্ত পাপ-অভিসন্ধি মিটিয়ে নিতে উদ্যোগী হয়েছেন৷ দেশের আর দেশবাসীর বড়ো সংকটকাল উপস্থিত হয়েছে ন্যায়াধীশ, মারাঠি জাতিই বোধকরি ধ্বংস হয়ে যাবে এমন চলতে থাকলে৷ সেই কারণেই আমি এই ধর্মাধিকরণে মহামান্য পেশোয়া মাধব রাওকে রাজকার্যে অবহেলা, কর্তব্যকর্মে অমনোযোগ, তথা দেশ ও দেশবাসীর পরোক্ষ শত্রুতা সাধনের অপরাধে অভিযুক্ত করছি৷’
রামশাস্ত্রী অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গেই শুনছিলেন লোকটির কথা, তার বক্তব্য শেষ হতেও অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন৷ তারপর বললেন, ‘তোমার অভিযোগ গুরুতর, দেশের প্রায় সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির নামে অভিযোগ তোমার৷ . . . তোমার পক্ষে কোনো সাক্ষী আছে? অথবা কোনো প্রমাণ?’
‘শাস্ত্রীজি, আমি গরিব লোক, আমার হয়ে পেশোয়ার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে এত সাহস কার? আর এ অভিযোগের প্রমাণই বা কী দেব? আমি আপনাকেই সাক্ষী মানছি; শুনেছি আইনে এমন ব্যবস্থাও আছে-গরিব লোকের হয়ে সাক্ষী প্রমাণ এমনকী উকিল দেবার ব্যবস্থাও অনেক সময় ধর্মাধিকরণ থেকে করে দেওয়া হয়৷ আমি সে সব কিছুই চাইছি না, আপনি যদি দয়া করে-একটু অবসর মতো এ বিষয়ে নিজে খোঁজখবর নেন, আমার অভিযোগের সত্যাসত্য নির্ণয়ের ভার নেন তাহলেই আমি কৃতার্থ হই৷ আমার এ অভিযোগ বা আশঙ্কা যদি অমূলক বলে মনে হয় আপনার, আপনি মিথ্যা অভিযোগের জন্য যেকোনো শাস্তি দেবেন আমি তাই মাথা পেতে নেব-কোনো দ্বিরুক্তি, বাকবিতণ্ডা বা সংশয় প্রকাশ করব না৷ আমার নাম-ঠিকানা আমি এখানে রেখে যাচ্ছি, আমিও ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণের কাছে ধর্মাধিকরণে দাঁড়িয়ে শপথ করে যাচ্ছি, আজ থেকে সপ্তাহকাল পরে এই ধর্মাধিকরণে উপস্থিত হয়ে আপনার মতামতের বা আদেশের জন্য অপেক্ষা করব৷ যদি দণ্ডনীয় বলে গণ্য হই-সে দণ্ড অনায়াসেই দিতে পারবেন৷’
লোকটির দৃঢ়তা, কথা বলার ভঙ্গি এবং বক্তব্যে ক্রমশই মুগ্ধ হচ্ছিলেন ন্যায়াধীশ, তিনি বললেন, ‘তাই হবে৷ আমি জানি তুমি মিথ্যা বলছ না৷ আমিও তোমাকে কথা দিচ্ছি-আমি নিজেই এ বিষয়ে অনুসন্ধান করব৷’
লোকটি আর একটিও কথা কইল না, আর একবার, তাঁকে নমস্কার করে নীরবেই বেরিয়ে গেল সে বিচারসভা থেকে৷
পরদিন সকালেই স্নানপূজাদি শেষ করে ন্যায়াধীশ রামশাস্ত্রী পেশোয়ার দরবারের উদ্দেশে যাত্রা করলেন৷ পেশোয়া বিশ্বনাথ রাওয়ের আমল থেকেই এ নিয়ম চলে আসছে-তিনি রাজধানীতে উপস্থিত থাকলে প্রত্যহ প্রথম প্রহরের মধ্যভাগ থেকে দ্বিতীয় প্রহরের মধ্যভাগ পর্যন্ত দরবার করেন৷ সেই সময়ে সকল প্রকার দর্শনপ্রার্থীর জন্যই দ্বার অবারিত থাকে৷ প্রজাসাধারণের যা কিছু অভাব অভিযোগ প্রার্থনা শোনেন তাঁর এই দরবারে, সচিবরাও উপস্থিত থাকেন সকলে-যা কিছু প্রতিকার ব্যবস্থা বা বিহিত নির্দেশ সঙ্গেসঙ্গেই দেওয়া হয়৷ অন্যান্য রাজাদের দূত বা প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন ওইখানে বসে৷
কিন্তু ন্যায়াধীশ সেদিন যথাসময়ে কাছেরি দিওয়ানখানায় (দরবার গৃহে) উপস্থিত হয়ে দেখলেন, পেশোয়া অনুপস্থিত; শুধু তাই নয়, দিওয়ানখানাও শূন্য-কোনো অর্থী প্রার্থী অভিযোগকারী বা সচিব, কর্মচারী-কেউ কোথাও নেই৷
বিস্মিত হলেন রামশাস্ত্রী৷ তবে কি পেশোয়া এখানে নেই? বাইরে কোথাও যুদ্ধযাত্রা করেছেন? কিংবা কোনো জরুরি মন্ত্রণার জন্য অন্য কোনো মারাঠা প্রধানের কাছে গেছেন?
কিন্তু না তো! কালও তো তিনি খবর নিয়েছেন-পেশোয়া এখানেই আছেন৷ আর নিয়ম মতো, পেশোয়া শহরের বাইরে গেলে ন্যায়াধীশকে জানিয়ে যাবার কথা৷ আইনত তিনিই পেশোয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন৷ তবে?
ন্যায়াধীশের পালকি দাঁড়াতে দেখে দ্বারী কয়েকজন ছুটে এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল৷ তারা দূর থেকে ওঁকে প্রণাম করে হাতজোড় করে দাঁড়াল৷ তাদের মধ্যে একজনকে চেনেন রামশাস্ত্রী৷ তিনি হাতে আশীর্বাদের মুদ্রা করে তাকেই প্রশ্ন করলেন, ‘বিঠঠল রাও, আজ দরবার হবে না?’
ম্লান হেসে বিঠঠল রাও উত্তর দিল,’আজ কেন প্রভু, দীর্ঘকাল ধরেই তো দরবার বসছে না৷’
‘তার কারণ?’ শান্ত ভাবেই আবার প্রশ্ন করেন রামশাস্ত্রী৷ বিস্মিত হলেও বিস্ময় প্রকাশ করা তাঁর স্বভাব নয়৷
বিঠঠল রাও জবাব দিল, ‘সময় হয় না মহামান্য পেশোয়ার৷ আজকাল সময়টারই তাঁর একান্ত অভাব৷ পূজা-অর্চনা শাস্ত্রপাঠ হোম আর ধ্যানধারণাতেই তাঁর দিনের অধিকাংশ সময় কেটে যায়৷ কোনোদিন সূর্যাস্তের আগে শেষ হলে হবিষ্য গ্রহণ করেন,-নইলে তাও হয়ে ওঠে না৷ সামান্য চরণামৃত পান করেই দিনটা কাটিয়ে দেন৷’
আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই৷ যা জানতে এসেছিলেন তা সবই জানা হয়ে গেছে৷ শুধু আর একবার প্রশ্ন করলেন, ‘পেশোয়া কোথায় বসে পূজাপাঠ করেন সাধারণত?’
‘তাঁর নিজের মহলে বিশ্বনাথ মন্দিরেই তিনি আজকাল বলতে গেলে দিনরাত যাপন করেন৷ গনেশ দিওয়ানখানায়-যেখানে বিনায়ক মন্দিরে বসে তাঁর পিতা-পিতামহ পূজাপাঠ করতেন, বহু লোকসমাগম হয় বলে তিনি সেখানে বসাটা তত পছন্দ করেন না৷’
আর কিছু বললেন না রামশাস্ত্রী, পালকিতে উঠে পেশোয়ার খাসমহলে যাবার নির্দেশ দিলেন৷
ন্যায়াধীশের সর্বত্র অবারিত গতি, তাঁর পালকির বিশেষ চিহ্নই ছাড়পত্র৷ সুতরাং অবাধেই পেশোয়ার খাসমহল পর্যন্ত পৌঁছোলেন তিনি৷ পালকি থেকে নামতে সে মহলের দ্বারীরাও ছুটে এল, সসম্মানে নিয়ে গিয়ে বসাল বাইরের দিকের বড়ো ঘরটাতে৷ ব্রাহ্মণ গুরু পুরোহিত প্রভৃতির জন্য চন্দনকাঠের কারুকার্য করা চৌকি ছিল দু-টি, তারই একটিতে আসন গ্রহণ করলেন রামশাস্ত্রী৷
পেশোয়ার খাস ভৃত্য নরসিংহ করজোড় এসে দাঁড়িয়েছিল, তাকেই তাঁর অভাবনীয় আগমনের উদ্দেশ্য জানালেন, তিনি একবার পেশোয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান৷
বিপন্ন নরসিংহ একটু এদিক-ওদিক তাকাল, দু-একবার তার মুণ্ডিত মস্তক চুলকোল, তারপর দৌড়ে গিয়ে খবর দিল পেশোয়া-মহিষীকে৷ তরুণ পেশোয়া মাধব রাওয়ের বালিকা বধূ রমাবাই এসে ম্লান নতমুখে রামশাস্ত্রীকে প্রণাম করে দাঁড়ালেন৷ শ্বশুরের গুরুস্থানীয় এই প্রধান বিচারপতিকে সকলেই দেবতার মতো ভক্তি করতেন সুতরাং তাঁর সামনে পেশোয়া-মহিষীরও বেরোতে দোষ নেই৷
এই ছোট্ট অল্পবয়সি মহিষীর দিকে তাকিয়ে রামশাস্ত্রীর দৃষ্টি কোমল হয়ে এল, ব্যস্তও হয়ে উঠলেন তিনি৷ বললেন, ‘তোমাকে কেন খবর দিল মা, তোমাকে তো আমি ডাকিনি৷ আমি শুধু মহামান্য পেশোয়ার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলুম একটু৷ তাঁকে খবর দিলেই তো হত-‘
‘তাঁকেই খবর দিতে গিয়েছিল নরসিংহ কিন্তু তিনি এখন ধ্যানে আছেন দেখে ডাকতে সাহস করেনি, আপনাকে এসে সে কথাটা বলতেও ভরসা হয়নি তার৷ . . .’
‘তা কতক্ষণ পরে দেখা হতে পারে মা, আমি অপেক্ষা করব একটু?’
‘কতক্ষণ পরে দেখা হবে তা ঠিক বলতে পারব না প্রভু, আমার অপরাধ নেবেন না৷ কিছুই ঠিক নেই ওঁর৷ পূজাপাঠ ধ্যানে যখন থাকেন তখন কোনোরকম ব্যাঘাত করা নিষিদ্ধ৷ উনি নিজেও ঘর থেকে বেরিয়ে না এলে খবর দেওয়ার উপায় নেই৷ শুধু আপনি এসেছেন বলেই নরসিংহ তবু গিয়েছিল-ধ্যানস্থ দেখে ভয়ে পালিয়ে এসেছে৷’
‘কখন বেরোন তিনি ও-ঘর থেকে?’ শান্তভাবে প্রশ্ন করেন রামশাস্ত্রী৷
‘কিছুই ঠিক নেই প্রভু৷ কোনোদিন অপরাহ্ন, আবার কোনো কোনো দিন সন্ধ্যাও হয়ে যায়৷ এক-একদিন আহারই করেন না কিছু৷ কারণ সন্ধ্যার পরই আবার সান্ধ্য বন্দনায় বসেন, সেও রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর হয়ে যায় এক-একদিন শেষ হতে৷’
‘তা তুমিও কি ও-ঘরে গিয়ে কোনো খবর দিতে পারো না মা?’
‘না প্রভু, আমার তো যাওয়া সম্ভবই নয়৷ আমার সঙ্গে আজকাল দেখাই হয় পাঁচ-সাত দিন অন্তর-কদাচ কখনো৷’
বলতে বলতেই কেঁদে ফেললেন রমাবাই ঝরঝর করে৷
রামশাস্ত্রী আর কিছু বললেন না, কোনো প্রশ্ন করলেন না৷ যা জানবার তা জানা হয়ে গেছে৷ ছেলেমানুষকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী?
তিনি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নীরবে উঠে চলে গেলেন
পূজাপাঠ শেষ করে মাধব রাও মন্দিরের বাইরে আসতেই খবরটা দিল নরসিংহ৷ খুবই লজ্জায় পড়লেন পেশোয়া৷ স্বয়ং ন্যায়াধীশ দেখা করতে এসে ফিরে গেছেন-ছি ছি! কী লজ্জার কথা৷ একটু উদ্বিগ্নও বোধ করলেন, ন্যায়াধীশ নিজে ছুটে এসেছেন তাঁর খাসমহলে, কোথাও কোনো বিপদ বা বিপর্যয়ের কারণ ঘটল নাকি?
তিনি তখনই এক কর্মচারীকে পাঠালেন রামশাস্ত্রীর কাছে-তাঁর হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে৷ ন্যায়াধীশ মহামান্য পেশোয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখা না পেয়ে ফিরে এসেছেন-সেজন্যে পেশোয়ার ক্ষোভ ও অনুতাপের সীমা নেই৷ নিজেকে অপরাধী বোধ করছেন তিনি৷ ন্যায়াধীশ যদি আগামী কাল কোনো সময় যেতে চান তো কখন যাবেন জানলে পেশোয়া সেই সময় অবশ্য অপেক্ষা করবেন ওঁর জন্য, আর যদি ন্যায়াধীশ ইচ্ছা করেন তো পেশোয়া নিজেই আসবেন ওঁর কাছে-ন্যায়াধীশের সময় ও সুবিধামতো৷
রামশাস্ত্রী সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, ‘কাল সকালে পূজার্চনা সেরে আমিই যাব তাঁর কাছে, বেলা প্রথম প্রহর উত্তীর্ণ হওয়ার সময়ে৷’*
‘যে আজ্ঞা,’ বলে প্রণাম জানিয়ে সে কর্মচারী চলে গেল৷
পরের দিন ন্যায়াধীশের পালকি গিয়ে থামতেই পেশোয়া স্বয়ং ছুটে এসে পালকির দোর খুলে অভ্যর্থনা জানালেন৷ সসম্মানে ভিতরে এনে বসিয়ে প্রণাম করে নিজে কিছু দূরে পাথরের মেঝেতে একটি কুশাসনে বসলেন, তারপর জানতে চাইলেন, কী আদেশ ন্যায়াধীশের৷
রামশাস্ত্রী মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে ভূর্জপত্রে লেখা একটি চিঠি বার করে পেশোয়ার হাতে দিলেন৷
এমনিতেই একটু অবাক হয়েছিলেন পেশোয়া, চিঠিখানা পড়ে তাঁর চক্ষুস্থির৷
এটি সাধারণ কোনো চিঠি নয়, ন্যায়াধীশের পদত্যাগ পত্র৷ তাঁর এই পদ থেকে সবিনয়ে অবসর প্রার্থনা করেছেন তিনি৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁকে ছুটি দেওয়া হোক,-এ প্রার্থনাও জানিয়েছেন৷
‘কিন্তু-প্রভু, আপনার কি কিছু অসুবিধা হচ্ছে?’ ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করেন মাধব রাও৷ ধর্মাধিকরণের সর্বোচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত করার মতো লোক বেশি নেই দেশে-তা তিনি জানেন৷ বিশেষত স্বর্গগত পেশোয়া তাঁর পিতা বালাজি বাজিরাও নিজে ওঁকে ডেকে এনে এই পদে বসিয়েছেন, তিনি গুরুর মতো সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন৷ সেই রামশাস্ত্রী সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকতেও চলে যেতে চাইছেন-তবে কি পেশোয়ার তরফ থেকেই কোনো অপরাধ ঘটেছে?
‘না, অসুবিধা কিছু নয়৷ মনে করছি কাশীতে গিয়ে শাস্ত্রচর্চা আর পূজাপাঠ করে বাকি জীবনটা কাটাব৷ শাস্ত্রের নির্দেশ পালন করব-এই আর কি!’
ব্যাপারটা কী? কী হল হঠাৎ ওঁর? . . .
কিছুক্ষণ মৌন থেকে সেটাই ধরতে চেষ্টা করেন পেশোয়া মাধব রাও৷ ধরতে পারেনও খানিকটা পরে৷ বুঝতে পারেন ন্যায়াধীশের এ আচরণের অর্থ আসলে অভিমান হয়েছে তাঁর৷
তিনি ধীরে ধীরে বিনতভাবে কিন্তু কিছু দৃঢ়তার সঙ্গেই উত্তর দেন, ‘কাল আপনি এসে ফিরে গেছেন-দেখা হয়নি, খুবই ক্ষোভের কথা সেটা৷ কিন্তু ভেবে দেখুন, আমি কোনো অন্যায় কাজ বা বিলাস ব্যসনে সময় কাটিয়ে আপনাকে অবহেলা করিনি৷ পূজাপাঠ ধ্যান যজ্ঞ-এসব তো ব্রাহ্মণের কর্তব্যই৷ নিজে ব্রাহ্মণ হয়ে এটা আপনার বোঝা উচিত৷’
এবার রামশাস্ত্রীও বেশ দৃঢ় কন্ঠেই উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ-ব্রাহ্মণেরই কর্তব্য, যে ব্রাহ্মণ ধর্মে স্বধর্মে নিরত থাকেন-তাঁর ধর্ম সেটা৷ আপনি এই পদ ও পদবি ত্যাগ করে আমার সঙ্গে কাশীতে চলুন, বা অন্য কোনো তীর্থে-সেখানে যদি দিনে রাতের অষ্টপ্রহরই পূজাপাঠে ব্যস্ত থাকেন তাহলেও কোনো ক্ষতি হবে না৷ কিন্তু মহান পেশোয়া ধর্ম গ্রহণ করেছেন; বিপুল এক রাজ্যের শাসনভার আপনার মাথায়, মহারাষ্ট্র দেশ ও সমগ্র মারাঠা জাতির আপনিই অভিভাবক; এখন যদি সেকথা ভুলে পূজাপাঠ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন শুধু-তাহলে আপনি স্বধর্মচ্যুত হয়েছেন এই কথাই বলব৷ যতক্ষণ আপনি এই পদে অধিষ্ঠিত আছেন ততক্ষণ প্রজার সর্বাঙ্গীন উন্নতি ও কল্যাণ কামনাই আপনার ধর্মাচরণ, আপনার পূজা৷ সে কাজ শেষ করে যদি অবসর পান তবেই আপনার পূজাপাঠ ধ্যান-ধারণায় অধিকার জন্মাবে৷ এখন এই সব যজ্ঞ পূজায় ধর্মের চেয়ে অধর্মই বেশি হচ্ছে না কি? আপনি যদি নিজের কর্তব্যের চেয়ে ব্রাহ্মণের স্বধর্ম পালনই শ্রেয় বলে মনে করেন-তাহলে আমিই বা এসব কচকচির মধ্যে থাকি কেন? আমাকে অব্যাহতি দিন, আমিও পরকালের চিন্তা করি!’
মাথা হেঁট করে বসে রইলেন মাধব রাও, বহুকাল অবধি৷ কার্যত তিনিই দেশের রাজা, তাঁকে তাঁরই একজন কর্মচারী এইভাবে কঠোর তিরস্কার করলেন এতে তাঁর ক্রুদ্ধ হবারই কথা-কিন্তু তা তিনি হলেন না৷ বুঝে দেখলেন যে রামশাস্ত্রীর কথাগুলি অক্ষরে অক্ষরে সত্য৷ তাঁকে তাঁর ভুল দেখিয়ে সুপথে চালনা করার চেষ্টা করছেন বলে বরং কৃতজ্ঞতাই বোধ করলেন রামশাস্ত্রীর কাছে৷
অনেকক্ষণ পরে তেমনি নত মস্তকেই দু-হাত জোড় করে বললেন, ‘আমার অন্যায় হয়ে গেছে৷ আমি তা বুঝতে পেরেছি৷ আর কোনোদিন রাজকার্যে অবহেলা করব না৷ প্রজাদের সেবার মধ্য দিয়েই ভগবানকে সেবা করার চেষ্টা করব৷ আমি আপনার সন্তানের মতো, দয়া করে এবার আমাকে মার্জনা করুন, আপনার পদত্যাগ পত্র ফিরিয়ে নিন৷’
রামশাস্ত্রী জানতেন যে মাধব রাও এক কথার মানুষ, যে কথা দিয়েছেন সে কথার নড়চড় হবে না৷ তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে খুশি মনে পদত্যাগ-পত্র ফিরিয়ে নিলেন৷
এরপর থেকে রাজকার্যে আর কোনোদিন অবহেলা করেনওনি মাধব রাও পেশোয়া৷ মাত্র আঠাশ বছর বয়সে যক্ষারোগে ইনি মারা যান৷ লোকে বলে অতিরিক্ত কঠোর পরিশ্রমই তাঁর জন্য দায়ী৷ কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে মাধব রাও সমস্ত পেশোয়ার মধ্যে যোগ্যতম ও সবচেয়ে কর্মদক্ষ শাসক ছিলেন৷
* সাধারণত সকাল ছ-টা থেকে ন-টা প্রথম প্রহর ও ন-টা থেকে বারোটা দ্বিতীয় প্রহর ধরা হয়৷