প্রাচীন বাংলার দু-টি কাহিনি – দীনেশচন্দ্র সেন
ত্রিপুরাধিপতি ছেংথোম্পা রাজার সময়ে গৌড়ের রাজার এক প্রবল পরাক্রান্ত সেনাপতি ছিলেন৷ তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণাংশ লুন্ঠনাদি করিতে উভয় রাজার মধ্যে যুদ্ধ হইবার উপক্রম হইল৷ সেনাপতি হিরাবন্ত খাঁ গৌড়েশ্বরের দুই-তিন লক্ষ সৈন্য লইয়া ছেংথোম্পার সহিত যুদ্ধ করিতে আসিলেন৷ ত্রিপুররাজ ভীত হইয়া সন্ধির প্রস্তাব করিতে আগ্রহ প্রকাশ করিতে লাগিলেন, কিন্তু ত্রিপুরার মহারাজ্ঞী ত্রিপুরাসুন্দরী স্বীয় কাপুরুষ স্বামীকে বিস্তর ভর্ৎসনা করিয়া স্বীয় সৈন্যদলের নেতৃত্ব করিতে হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন৷ তাঁহার উৎসাহবাক্যে ত্রিপুরাসৈন্যেরা জীবনপণ করিয়া যুদ্ধ করিতে অঙ্গীকার করিল৷ তিনি ত্রিপুরাসৈন্যদিগকে পুত্র বলিয়া সম্বোধন করিয়া বলিলেন,
‘গৌড় সৈন্য আসিয়াছে যেন যম কাল৷
তোমার নৃপতি হৈল বনের শৃগাল৷৷
যুদ্ধ করিবারে আমি যাইব আপনে৷
যেই জন বীর হও চলো আমা সনে৷৷
(রাজমালা-ছেংথোম্পা খণ্ড)
তাঁহাদের অনুকূল প্রতিশ্রুতি পাইয়া মহাদেবী স্বয়ং রন্ধনকার্যের তত্ত্বাবধায়িকা হইয়া মহিষ, গোরু, মেষ, হংস, হরিণ, নানারূপ পক্ষী, অসংখ্য শূকর প্রভৃতির মাংস রন্ধন করাইলেন, ‘সহস্র সহস্র মদ্যের কলস ও দধি-দুগ্ধাদির ভাণ্ড’ আনীত হইল এবং ত্রিপুরায় কুকি ও রাজসৈন্য একত্র হইয়া মহারাজ্ঞীর এই খাদ্যসম্ভার উপভোগ করিয়া তৃপ্ত হইল৷ মহারাজ্ঞীর রণবেশ ও উগ্রচণ্ডী মূর্তি দেখিয়া অগত্যা রাজাকেও রণক্ষেত্রে যাইতে হইল৷ হিরাবন্ত খাঁর খড়্গের কোষ স্বর্ণনির্মিত ছিল এবং মাথায় সোনার পাগড়ি এবং অঙ্গে সোনার ‘জিরা’ (বর্ম) ঝলমল করিতেছিল৷ ত্রিপুরাসৈন্য মহারাজ্ঞীর নেতৃত্বে দুর্জয়বেগে গৌড়সৈন্যকে আক্রমণ করিল এবং হিরাবন্ত খাঁয়ের রাজবেশ লক্ষ করিয়া তাঁহার দিকেই জোরে আক্রমণ চালাইল৷ গৌড়সৈন্য পরিণামে ভঙ্গ দিয়া পলাইয়া গেল৷ কথিত আছে, এই মহাযুদ্ধে এক লক্ষ সৈন্য নিহত হইয়াছিল৷ এই সময়ে রাজা ঊর্ধ্বদিকে দৃষ্টি করিয়া দেখিলেন, একটি মুণ্ডহীন কবন্ধ আকাশে নাচিতেছে, একদণ্ড নৃত্য করিয়া কবন্ধ ধরাশায়ী হইল৷ এক লক্ষ সৈন্যের মৃত্যু হইলে নাকি রণক্ষেত্রে একটি কবন্ধ দেখা দেয়৷ রাজা বুঝিলেন এই যুদ্ধে এক লক্ষ লোক মরিয়াছে৷ ভীরু রাজা চোখে সরিষা ফুল দেখিয়াছিলেন, কিংবা কবন্ধ দেখিয়াছিলেন বলা যায় না৷
যুদ্ধ জয় করিয়া ছেংথোম্পা সেই হতাহত সৈন্য-সংকুল যুদ্ধক্ষেত্রে একতিল স্থান বসিবার উপযোগী পাইলেন না৷ তখন তাঁহার জামাতা রণে পতিত এক অতিকায় হস্তীর বৃহৎ দন্তদ্বয় খড়্গাঘাতে কাটিয়া রাজাকে বসিবার স্থান করিয়া দিলেন৷ রাজা জামাতার বিক্রম দেখিয়া প্রীত হইলেন এবং জামাতাকে সম্মানিত করিলেন৷ তদবধি রাজপুত্রের সঙ্গে ত্রিপুরায় রাজ-জামাতারা একসঙ্গে একাসনে বসিবার অধিকার পাইলেন এবং জামাতারা সেনাপতি পদ প্রাপ্ত হইলেন৷ ইহার পূর্বে তাঁহাদের প্রত্যেকের জন্য রাজসরকারের দৈনিক এক সের মাত্র চাউল বরাদ্দ ছিল৷ ত্রিপুরাসুন্দরী জোয়ান দ্য আর্কের প্রায় দেড় শত বৎসর পূর্বে বিদ্যমান ছিলেন৷ গৌড়েশ্বরের সঙ্গে এই যুদ্ধ বারো-শো চল্লিশ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হইয়াছিল, তখন গৌড়েশ্বর ছিলেন সম্ভবত লক্ষ্মণসেনের বংশধর সুবর্ণগ্রামের কোনো রাজা৷
পতি-ঘাতিনী সতী
বন-বিষ্ণুপুরে রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ মোগলদের পক্ষ অবলম্বনপূর্বক শোভাসিংহ ও রহিম খাঁকে পরাস্ত করেন৷ শোভাসিংহের কন্যাকে তিনি পাটরানি করেন এবং মৃত রহিম খাঁর পত্নী লালবাইকে স্বীয় প্রাসাদে লইয়া আসেন৷ এই রমণী অনিন্দ্যসুন্দরী, সংগীতবিদ্যায় পারদর্শিনী ও সুধাকন্ঠী ছিলেন৷ রাজা ইঁহার অনুরাগে আত্মবিস্মৃত হইয়া পড়িলেন৷ এক বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করিয়া তথায় তাঁহার বাসস্থান নির্দেশপূর্বক তাঁহার নামানুসারে লালবাঁধ নামে এক প্রকাণ্ড দীর্ঘিকা খনন করাইলেন৷ রাজা দিন-রাত লালবাই-এর কাছে পড়িয়া থাকিতেন৷ মহাবৈষ্ণবের বংশে জন্মগ্রহণ করিয়া তিনি লালবাই-এর সঙ্গে মুসলমানি খানা খাইতেন,-রাজ্যশাসন সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ের কোনো খোঁজখবর লইতেন না; মন্ত্রীরাই রাজ্য পরিচালনা করিতেন৷ কিন্তু ইহার পরে এক সর্বনাশের ব্যাপার ঘটিল৷ লালবাই রাজাকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিতে পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন; শুধু তাহাই নহে, রাজ্যসুদ্ধ একদিনে একসময়ে সমস্ত বিষ্ণুপুরবাসীদিগকে মুসলমান হইতে হইবে-এই আবদার করিতে লাগিলেন৷ রাজা তাঁহার প্রগাঢ় আসক্তি সত্ত্বেও এবংবিধ সর্বনাশকর প্রস্তাবে সম্মতি দান করিতে দ্বিধা বোধ করিতে লাগিলেন এবং বিনয়ের সহিত ইহার প্রতিবাদ করিলেন৷ মুসলমানি রাজাকে হাতের মুঠোর ভিতর পাইয়াছিল, সে তাহার নিজ শক্তি সম্পূর্ণরূপে বুঝিয়া একটা অমোঘ অস্ত্র নিক্ষেপ করিল৷ রাজা যদি তাহার প্রস্তাবে সম্মত না হন, তবে সে বিষ্ণুপুর ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে৷ রাজা অকুল চিন্তা-সাগরে পড়িয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইলেন এবং অবশেষে লালবাই-এর আবদার রক্ষা করিতে স্বীকৃত হইলেন৷ বিষ্ণুপুরের শ্মশানঘাটের নিকট নূতন মহলের পশ্চিমে এখনও ভোজনতলা বলিয়া যে স্থানটি বিদ্যমান, তথায়ই রাজ্যসুদ্ধ সকল নিমন্ত্রিত ব্যক্তির আহারের বিরাট আয়োজন হইতে লাগিল৷ ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের বিষ্ণুপুরের শত সহস্র নরনারী আতঙ্কিতভাবে তথায় উপস্থিত হইতে বাধ্য হইল-সেই নিমন্ত্রণ যিনি উপেক্ষা করিবেন, সপরিবারে তাঁহাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হইবে৷
এদিকে রাজপরিবারে গুপ্তভাবে ষড়যন্ত্র চলিতেছিল৷ গোপাল সিংহ ও মহারাজ্ঞী স্বয়ং রাজার প্রধান মন্ত্রীদিগকে লইয়া পরামর্শ ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন৷ লালবাই-এর তত্ত্বাবধানে মুসলমানি খানা পরিবেশনের আয়োজন হইতেছিল৷ হঠাৎ মহারাজ্ঞীর হস্তনিক্ষিপ্ত এক বাণ রাজার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া ফেলিল৷ লালবাইকে পরে লৌহশৃঙ্খল পরাইয়া দিঘিতে নিমজ্জিত করা হইয়াছিল৷ ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে সেই দিঘি হইতে কতকগুলি মুসলমানি ভোজনপাত্র ও একটা নরকঙ্কাল উত্তোলিত হইয়াছিল৷ বিষ্ণুপুরের নুরজাহান-লালবাই-এর ইহাই কি পরিণাম ও শেষ চিহ্ন?
মহারাজ্ঞী স্বামীকে হত্যা করিয়া তাঁহারই চিতায় প্রাণত্যাগ করেন৷ এই ঘটনার পর লালবাই-এর প্রাসাদ ভাঙিয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হইল৷ রাজা ও মহারাজ্ঞী যে স্থানে একত্র দগ্ধ হইয়াছিলেন, তাহা লোকে এখনও দেখাইয়া থাকে৷ এই রাজ্ঞীকে লোকে “পতি-ঘাতিনী সতী” আখ্যা দিয়াছিল৷ রাজার কল্যাণার্থ এবং ধর্মের জন্য তিনি প্রাণপ্রিয় পতিকে হত্যা করিয়া তাঁহারই চিতায় আত্মোৎসর্গ করিয়াছিলেন৷ তিনি তাই একাধারে সতী ও পতিঘাতিনী বটেন৷