শিবাজির পলায়ন – যদুনাথ সরকার
(শিবাজীর সঙ্গে মুঘলদের প্রথম যে সন্ধি হয় তাহার ফলে শিবাজি জয়সিংহের সহিত আগ্রায় আসেন ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে যান৷ সেখানে তাঁহার অপমানকর অভ্যর্থনা হওয়ায় তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া ওঠেন এবং সে ক্রোধ স্পষ্টই প্রকাশ করিতে থাকেন৷ ইহার পর সম্রাটের আদেশে তাঁহাকে সোজাসুজি নজরবন্দি করা হয়৷ বিদেশে অপরিচিত লোকের মধ্যে এই বিপদের গুরুত্ব যে কতখানি তাহা অনুভব করিয়া শিবাজি ও তাঁহার সঙ্গীরা প্রথমটা অভিভূত হইয়া পড়িলেন৷)
কিন্তু বেশিদিন এইভাবে গেল না৷ শিবাজির অদম্য সাহস ও প্রখর বুদ্ধি শীঘ্রই প্রকাশ পাইল৷ তিনি নিজের মুক্তির পথ নিজেই বাহির করিলেন৷ প্রথমত তিনি সকলের কাছে লোক পাঠাইয়া জানাইতে লাগিলেন যে তিনি বাদশাহের ভক্ত প্রজা, তাঁহার অসন্তোষের ভয়ে কাঁপিতেছেন৷ অপরাধ মার্জনা লাভের আশায়, বাদশাহের নিকট সুপারিশ করিবার জন্য শিবাজি দরবারের অনেক সভাসদকে অনুরোধ করিলেন৷ ইতিমধ্যে তিনি নিজ রক্ষী সৈন্যদলকে দেশে পাঠাইবার অনুমতি চাহিলেন; বাদশাহ ভাবিলেন, ভালোই তো, আগ্রায় যত শত্রু কমে৷ সৈন্যেরা মহারাষ্ট্রে গেল, সেই সঙ্গে শিবাজির সঙ্গীরাও অনেকে দেশে ফিরিল৷ শিবাজি এখন একা-তিনি নিজের পলায়নের পথ নিজেই দেখিলেন৷
অসুখের ভান করিয়া তিনি শয্যায় আশ্রয় লইলেন; ঘর হইতে আর বাহির হন না৷ ব্যাধি দূর করিবার জন্য ব্রাহ্মণ সাধুসজ্জন ও সভাসদদিগের মধ্যে তিনি প্রত্যহ বড়ো বড়ো ঝুড়ি ভরিয়া ফল ও মিঠাই বিতরণ করিতে শুরু করিলেন৷ প্রত্যেক ঝুড়ি বাঁশের বাঁকে ঝুলাইয়া দু-জন করিয়া বাহক বৈকালে বাসাবাড়ি হইতে বাহিরে লইয়া যাইত৷ কোতোয়ালের প্রহরীরা প্রথমে দিনকতক ঝুড়ি পরীক্ষা করিয়া দেখিত, তাহার পর বিনা পরীক্ষায় যাইতে দিতে লাগিল৷
শিবাজি এই সুযোগেরই অপেক্ষা করিতেছিলেন৷ ১৯শে আগস্ট বৈকালে তিনি প্রহরীদের বলিয়া পাঠাইলেন যে তাঁহার অসুখ বাড়িয়াছে, তাহারা যেন তাঁহাকে বিরক্ত না করে৷ এদিকে ঘরের মধ্যে তাঁহার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা হিরাজি ফরজন্দ-দেখিতে কতকটা শিবাজির মতোই-শিবাজির খাটিয়ায় শুইয়া, চাদরে গা-মুখ ঢাকিয়া, শুধু ডান হাত বাহির করিয়া রাখিলেন; তাঁহার এই হাতে শিবাজির সোনার বালা দেখা যাইতেছিল৷ আর সন্ধ্যার সময় শিবাজি ও শম্ভুজি দুইটি ঝুড়ির মধ্যে জড়সড় হইয়া শুইয়া রহিলেন, তাঁহাদের উপর বেশ করিয়া পাতা ঢাকা দেওয়া হইল; আর তাঁহাদের বাঁকের সামনে ও পিছনে কয়েক ঝুড়ি সত্যকার ফল ও মিঠাই ভরিয়া সারিবন্দি হইয়া বাহকগণ বাসা হইতে বাহির হইল; বাদশাহের প্রহরীরা কোনোই উচ্চবাচ্য করিল না,-কেননা ইহা তো নিত্যকার ঘটনা৷
আগ্রা শহরের বাহিরে পৌঁছিয়া একটি নির্জন স্থানে ঝুড়ি নামাইয়া বাহকগণ মজুরি লইয়া চলিয়া গেল৷ তাহার পর শিবাজি ও শম্ভুজি ঝুড়ি হইতে বাহির হইয়া সঙ্গে যে দু-টি মারাঠা অনুচর আসিয়াছিল তাহাদের সাহায্যে তিন ক্রোশ পথ হাঁটিয়া একটি ছোটো গ্রামে প্রবেশ করিলেন৷ সেখানে তাঁহার ন্যায়াধীশ নিরাজি রাবজি ঘোড়া লইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন৷ এখানে মারাঠাদের দল দুইভাগে বিভক্ত হইল৷ পুত্র শম্ভুজি, নিরাজি, দত্তাজি ত্র্যম্বক (ওয়াকিয়ানবিস) ও রাঘব মিত্রকে সঙ্গে লইয়া শিবাজি সন্ন্যাসীর বেশ ধরিয়া সারা অঙ্গে ছাই মাখিয়া মথুরার দিকে অগ্রসর হইলেন, বাকি সকলে দাক্ষিণাত্যের পথ ধরিল৷
আগ্রায় শিবাজির পলায়নের সংবাদ প্রকাশ হইল
এদিকে আগ্রায় ১৯শে আগস্টের সারারাত্রি এবং পরদিন তিন প্রহর বেলা পর্যন্ত হিরাজি শিবাজির বিছানায় শুইয়া রহিলেন৷ প্রাতে প্রহরীরা আসিয়া জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিল,-সোনার বালা পরিয়া বন্দি শুইয়া আছেন, চাকরেরা তাঁহার পা টিপিতেছে৷ বৈকালে তিনটার সময়ে হিরাজি উঠিয়া নিজ বেশ পরিয়া চাকরটিকে সঙ্গে লইয়া বাসা হইতে বাহির হইয়া গেলেন; দরজায় প্রহরীদের বলিলেন, ‘শিবাজির মাথার বেদনা; কাহাকেও তাঁহার ঘরে যাইতে দিয়ো না, আমি ঔষধ আনিতে যাইতেছি৷’ এইরূপে দুই-তিন ঘণ্টা কাটিয়া গেল৷ তাহার পর প্রহরীরা দেখিল, বাড়িটি যেন কেমন খালি খালি ঠেকিতেছে; ভিতরে কোনো সাড়াশব্দ নাই, কোনো নড়াচড়ার চিহ্ন দেখা যাইতেছে না; অন্য দিনের মতো বাহিরের লোকজনও কেহ দেখা করিতে আসিতেছে না৷ ক্রমে তাহাদের সন্দেহ বাড়িল, তাহারা ঘরে ঢুকিল৷ ঢুকিয়া যাহা দেখিল তাহাতে তাহাদের চক্ষুস্থির! -পাখি উড়িয়াছে, ঘরে জনমানব নাই !!!
তখন সন্ধ্যা হইয়াছে৷ তাহারা ছুটিয়া গিয়া কোতোয়ালকে সংবাদ দিল৷ ফুলাদ খাঁ কয়েদির বাসায় খোঁজ করিয়া দেখিয়া বাদশাহকে জানাইল, ‘হুজুর! শিবাজি পালাইয়াছে, কিন্তু ইহার জন্য আমাদের কোনো দোষ নাই৷ রাজা কুঠুরির মধ্যেই ছিলেন৷ আমরা ঠিকমতো গিয়া দেখিতেছিলাম; তথাপি একেলা অদৃশ্য হইয়া গিয়াছেন৷ তিনি মাটির মধ্যে ঢুকিলেন, অথবা আকাশে উড়িয়া গেলেন, বা হাঁটিয়া পালাইলেন তাহা জানা গেল না৷ আমরা কাছেই ছিলাম; দেখিতে দেখিতে তিনি আর নাই! কী জাদুবিদ্যায় এমনটা হইল বলিতে পারি না৷’
কিন্তু আওরঙ্গজেব এসব বাজে কথায় ভুলিবার পাত্র নহেন৷ অমনি চারিদিকে ‘ধর ধর’ শব্দ উঠিল, রাজমধ্যে পথঘাটের সব চৌকি, পার-ঘাট এবং পর্বতের ঘাঁটিতে হুকুম পাঠানো হইল যেন দাক্ষিণাত্যের যাত্রীদের সকলকে ধরিয়া দেখা হয় তাহাদের মধ্যে শিবাজি আছে কি না৷ এই হুকুম লইয়া দক্ষিণ দিকে কত সওয়ার ছুটিল৷ আর আগ্রা বা তাহার নিকটে শিবাজির যত অনুচর ছিল (যেমন ত্র্যম্বক, সোনদের দবির এবং রঘুনাথ বল্লাল কোরভে), তাহাদের ধরিয়া কয়েদ করা হইল৷ মারের চোটে তাহারা বলিল যে, রামসিংহের সাহায্যে শিবাজি পালাইয়াছেন৷ বাদশাহ রাগিয়া রামসিংহের দরবারে আসা বন্ধ করিলেন এবং মনসব ও বেতন কাড়িয়া লইলেন৷
শিবাজির পলায়নের সময়ের নানা আশ্চর্য ঘটনা
চতুর চূড়ামণি শিবাজি দেখিলেন, আগ্রা হইতে মহারাষ্ট্রের পথ দক্ষিণ-পশ্চিম মুখে গিয়াছে, সুতরাং সেদিকে সর্বত্রই শত্রু সজাগ হইয়া পাহারা দিবে৷ কিন্তু উত্তর-পূর্বদিকের পথে কোনো পথিকের উপরই সন্দেহ করিবার কারণ থাকিবে না৷ সেইজন্য তিনি আগ্রা হইতে বাহির হইয়া প্রথমে উত্তরে, পরে পূর্বদিকে-অর্থাৎ ক্রমেই মহারাষ্ট্র হইতে অধিক দূরে চলিতে লাগিলেন৷ প্রথম রাত্রিতে ঘোড়া ছুটাইয়া তাঁহারা দ্রুতগতিতে মথুরায় পৌঁছিলেন; কিন্তু দেখিলেন যে, বালক শম্ভুজি অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে; পথ চলিতে একেবারে অক্ষম৷ আগ্রার এত নিকটে থাকা শিবাজির পক্ষে বিশেষ বিপজ্জনক৷ নিরাজি পণ্ডিত তখন পেশোয়ার শ্যালক তিনজন মথুরাবাসী মারাঠা ব্রাহ্মণকে শিবাজির আগমন ও দুর্দশার কথা জানাইয়া সাহায্য ভিক্ষা করিলেন৷ তাঁহারাও দেশ ও ধর্মের নামে বাদশাহের শাস্তির ভয় তুচ্ছ করিয়া শম্ভুজিকে নিজ পরিবারের মধ্যে আশ্রয় দিতে সম্মত হইলেন৷ আর তাঁহাদের এক ভাই শিবাজিকে সঙ্গে লইয়া কাশী পর্যন্ত পথ দেখাইয়া চলিলেন৷
এই দীর্ঘ পথের খরচের জন্য শিবাজি প্রস্তুত হইলেন৷ সন্ন্যাসীর লাঠির মধ্যে ফুটা করিয়া তাহা মণি ও মোহর দিয়া পুরিয়া মুখ বন্ধ করিয়া দিলেন৷ জুতার মধ্যে কিছু টাকা রাখিলেন, আর একটা বহু মূল্য হীরক এবং অনেকগুলি পদ্মরাগমণি মোম দিয়া ঢাকিয়া তাঁহার অনুচরদের জামার ভিতর সেলাই করিয়া দিলেন, কিছু কিছু তাহারা মুখে পুরিয়া রাখিল৷
মথুরায় পৌঁছিয়া দাড়ি-গোঁফ কামাইয়া, গায়ে ছাই মাখিয়া, সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে শিবাজি পথ চলিতে লাগিলেন৷ নিরাজি ভালো হিন্দি বলিতে পারিতেন৷ তিনি মোহন্ত সাজিয়া দলের আগে আগে যাইতে লাগিলেন৷ তিনিই পথের লোকজনদের প্রশ্নের উত্তর দেন; শিবাজি সামান্য চেলা লইয়া তাঁহার পিছু পিছু চলেন৷ তাঁহারা প্রায়ই রাত্রে চলেন, দিনে নির্জন স্থানে বিশ্রাম করেন, প্রত্যহই এক ছদ্মবেশ বদলাইয়া আর একরকম বেশ ধরেন৷ তাঁহার চল্লিশ জন অনুচর তিনটি পৃথক পৃথক দলে বিভক্ত হইয়া দূরে দূরে পশ্চাতে আসিতে লাগিল, প্রত্যেক দলেরই ভিন্ন ভিন্ন বেশ৷
একবার তিনি ধরা পড়িয়াছিলেন৷ আলিকুলি নামে বাদশাহের এক ফৌজদার সরকারি হুকুম পাইবার আগেই আগ্রা হইতে নিজ সংবাদ-লেখকের পত্রে শিবাজির পলায়নের সংবাদ পাইয়া তাহার সীমানার মধ্যে সমস্ত পথিকদের ধরিয়া তল্লাস আরম্ভ করিয়াছিল৷ শিবাজিও সদলে আটক হইলেন৷ তিনি দুপুর রাত্রে গোপনে ফৌজদারের কাছে গিয়া বলিলেন, ‘আমাকে ছাড়িয়া দাও, তোমাকে এখনই এক লক্ষ টাকা দামের হিরা ও মণি দিব৷ আর যদি আমাকে বাদশাহের নিকট ধরাইয়া দাও, তবে এসব রত্ন তিনি পাইবেন, -তোমার কোনোই লাভ হইবে না৷’ ফৌজদার এই ঘুস লইয়া তখনই তাঁহাদের ছাড়িয়া দিল৷
তারপর গঙ্গা-যমুনার সঙ্গম-এলাহাবাদের পুণ্যক্ষেত্রে স্নান করিয়া সন্ন্যাসীর বেশে শিবাজি কাশীধামে পৌঁছিলেন৷ অতি প্রত্যুষে গঙ্গাস্নান, কেশচ্ছেদ প্রভৃতি তীর্থের ক্রিয়াকলাপ শেষ করিয়া তাড়াতাড়ি শহর হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন৷ তাঁহার রওনা হইবার পরই আগ্রা হইতে অশ্বারোহী দূত আসিয়া শিবাজিকে ধরিবার জন্য বাদশাহের আদেশ চারিদিকে প্রচার করিল৷ অনেক বৎসর পরে সুরতের নাভাজি নামে এক গুজরাটি ব্রাহ্মণ গল্প করিতেন, ‘কাশীতে পাঠ্যাবস্থায় আমি এক ব্রাহ্মণের শিষ্য ছিলাম, গুরু আমার বড়োই খাবার কষ্ট দিতেন৷ একদিন ভোরে অন্ধকার থাকিতে থাকিতেই অন্যদিনের মতো নদীর ঘাটে গিয়াছি, এমন সময় একজন লোক আমার হাতের মধ্যে মোহর ও মণি গুঁজিয়া দিয়া বলিল, মুঠি খুলিয়ো না, কিন্তু আমায় স্নানাদি তীর্থক্রিয়া যত শীঘ্র পার শেষ করাইয়া দাও৷ আমি তাহার মাথা মুড়াইয়া স্নান করাইয়া দিয়া মন্ত্র পড়িতে লাগিলাম; এমন সময় একদিকে শোরগোল উঠিল যে, পলাতক শিবাজির খোঁজে আগ্রা হইতে বাদশাহের পুলিশ আসিয়া ঢোল পিটিয়া দিতেছে৷ তাহার পর পূজার কাজে মন দিয়া যাত্রীটির দিকে ফিরিতেই দেখি, সে ইতিমধ্যে অন্তর্ধান করিয়াছে৷ মুঠির মধ্যে নয়টি মোহর, নয়টি মুক্তা ও নয়টি মণি পাইলাম৷ গুরুকে কিছু না বলিয়া সটান দেশে ফিরিলাম৷ ওই টাকা দিয়া এই বড়ো বাড়ি কিনিয়াছি৷’
কাশী হইতে গয়া পূর্বদিকে; এই তীর্থ করিয়া শিবাজি দক্ষিণমুখে চলিলেন৷ পরে গোণ্ডওয়ানা ও গোলকুন্ডা রাজ্য পার হইয়া পশ্চিম দিকে ফিরিয়া বিজাপুরের মধ্য দিয়া নিজ দেশে আসিয়া পৌঁছিলেন৷ দীর্ঘ পথ হাঁটিতে হাঁটিতে ক্লান্ত হইয়া তিনি একটি টাট্টু (ছোটো ঘোড়া) কিনিলেন; দাম দিবার সময় দেখেন রূপার টাকা নাই, তখন ঘোড়াওয়ালাকে একটি মোহর দিলেন৷ সে বলিল- ‘তুমি বুঝি শিবাজি, নহিলে এই টাট্টুর জন্য এত বেশি দাম দিতেছ কেন?’ শিবাজি থলি খালি করিয়া সব মোহরগুলি তাহাকে দিয়া বলিলেন, ‘চুপ! কথাটি কহিও না৷’ তারপর ঘোড়ায় চাপিয়া তাড়াতাড়ি সেখান হইতে সরিয়া পড়িলেন৷
পলাতক শিবাজি স্বদেশ পৌঁছিলেন
ক্রমে দাক্ষিণাত্যে গোদাবরী-তীরে ইন্দুর প্রদেশ পার হইয়া এই সন্ন্যাসীর দল মহারাষ্ট্রের সীমানার কাছে এক গ্রামে সন্ধ্যার সময় আসিয়া পৌঁছিল৷ তাহারা গাঁয়ের মোড়লের স্ত্রীর (পাটেলিন) বাড়িতে এক রাত্রির জন্য আশ্রয় চাহিল৷ ইহার কিছুদিন আগেই আনন্দরাও-এর অধীনে শিবাজির সৈন্যরা আসিয়া এই গ্রামের সব শস্য ও ধন লুট করিয়া লইয়া গিয়াছিল৷ পাটেলিন উত্তর করিল, ‘বাড়ি খালি পড়িয়া আছে৷ শিবাজির সওয়ার আসিয়া সব শস্য লইয়া গিয়াছে৷ শিবাজি কয়েদ আছে৷ সেইখানে পচিয়া মরুক৷’ বলিয়া সে তাহার উদ্দেশ্যে কত অভিসম্পাত করিতে লাগিল৷ শিবাজি হাসিয়া নিরাজিকে ওই গ্রামের ও তাহার পাটেলিনের নাম লিখিয়া লইতে বলিলেন৷ নিজ রাজধানীতে পৌঁছবার পর পাটেলিনকে ডাকাইয়া লুটে যাহা ক্ষতি হইয়াছিল তাহার বহুগুণ ধন দান করিলেন৷
ক্রমে ভীমা নদী পার হইয়া, আগ্রা হইতে রওনা হইবার পূর্ণ তিন মাস পরে, নিজ রাজধানী রাজগড়ে পৌঁছিলেন (২০শে নভেম্বর)৷ দুর্গের দ্বারে গিয়া জিজাবাইকে সংবাদ পাঠাইলেন যে, উত্তরপ্রদেশ হইতে একদল বৈরাগী আসিয়াছে-তাহারা সাক্ষাৎ করিতে চায়৷ জিজাবাই অনুমতি দিলেন৷ অগ্রগামী মোহন্ত (অর্থাৎ নিরাজি) হাত তুলিয়া আশীর্বাদ করিলেন, কিন্তু পশ্চাতের চেলা বৈরাগী জিজাবাই-এর পায়ের উপর মাথা রাখিল৷ তিনি আশ্চর্য হইলেন, সন্ন্যাসী কেন তাঁহাকে প্রণাম করে? তখন ছদ্মবেশী শিবাজি টুপি খুলিয়া নিজ মাথা মাতার কোলে রাখিলেন৷ এতক্ষণে হারাধনকে মাতা চিনিতে পারিলেন৷ অমনি চারিদিকে আনন্দের রোল উঠিল, বাজনা বাজিতে লাগিল, দুর্গ হইতে তোপধ্বনি হইল৷ মহা-হর্ষে সমগ্র মহারাষ্ট্র জানিল-দেশের রাজা নিরাপদে দেশে ফিরিয়াছেন৷
শিবাজি দেশে ফিরিলেন, কিন্তু সঙ্গে পুত্রটি নাই৷ তিনি রটাইয়া দিলেন যে, পথে শম্ভুজির মৃত্যু হইয়াছে৷ এইরূপে দাক্ষিণাত্যের পথের যত মুঘল-প্রহরীদের মন নিশ্চিন্ত হইলে তিনি গোপনে মথুরার সেই তিন ব্রাহ্মণকে পত্র লিখিলেন৷ তাহারা পরিবারবর্গ লইয়া শম্ভুজিকে ব্রাহ্মণের বেশ পরাইয়া, কুটুম্ব বলিয়া পরিচয় দিয়া, মহারাষ্ট্রে আসিয়া উপস্থিত হইল৷ পথে এক মুঘল কর্মচারী তাহাদের গ্রেফতার করে কিন্তু ব্রাহ্মণগণ তাহার সন্দেহ-ভঞ্জনার্থ শম্ভুজির সহিত এক পংক্তিতে বসিয়া ভোজন করিল, যেন শম্ভুজি শূদ্র নহেন, তাহাদের স্ব-শ্রেণির ব্রাহ্মণ৷ কৃষ্ণাজি কাশীজি ও বিশাজি . . . এই তিন ভাইকে শিবাজি ‘বিশ্বাস রাও’ উপাধি, এক লক্ষ মোহর এবং বার্ষিক পঞ্চাশ টাকার জায়গির পুরস্কার দিলেন৷
শিবাজির পলায়নে আওরঙ্গজেবের মনে আমরণ আপশোস হইয়াছিল৷ তিনি ৯১ বৎসর বয়সে মৃত্যুর সময় নিজ উইলে লিখিয়াছিলেন, ‘শাসনের প্রধান স্তম্ভ-রাজ্যে যাহা ঘটে তাহার খবর রাখা; এক মুহূর্তের অবহেলা দীর্ঘকাল লজ্জার কারণ হয়৷ এই দেখো, হতভাগা শিবাজি আমাদের কর্মচারীদের অসাবধানতায় পালাইয়া গেল, আর তাহার জন্য আমাকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই সব কষ্টকর যুদ্ধে লাগিয়া থাকিতে হইল৷’