১৮. যৌনতা এবং ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য

১৮. যৌনতা এবং ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য

বর্তমান অধ্যায় আমি পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে ব্যক্তিগত সুখ ও সমৃদ্ধির ওপর যৌনতা এবং যৌননৈতিকতার প্রভাব সম্পর্কে যে আলোচনা করেছি তার পুনর্মূল্যায়ন করার চেষ্টা করবো। এক্ষেত্রে আমরা শুধুমাত্র মানুষের ক্রিয়াশীল যৌনজীবনের আলোচনা করবো না অথবা শুধুমাত্র তার প্রকৃত যৌন সম্পর্কের অনুধাবনে প্রয়াসী হবো না। যৌননৈতিকতা মানুষের শৈশব, কৈশোর এমনকি বাৰ্ধক্য অবস্থাকে ঘটনা পরস্পরার অনুক্রমানুসারে সৎ অথবা অসৎ উপায়ে প্রভাব ফেলতে পারে।

ঐতিহ্যশ্রয়ী নৈতিকতা এবং তার কার্যধারা শুরু করে শৈশবাবস্থায় প্রযুক্ত নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে। একটি শিশুকে শেখানো হয় যে, সে যেন কোনো গুরুজনের সামনে তার শরীরের বিশেষ অঙ্গগুলি স্পর্শ না করে। এই শিক্ষা তাকে দেওয়া হয় সে যেন তার রেচনজনিত প্রতিক্রিয়াগুলিকে ফিসফিস শব্দের দ্বারা ব্যক্ত করে এবং রেচন প্রতিক্রিয়াকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার মধ্যে সমাধান করে। শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ এবং বিশেষ শারীরিক প্রক্রিয়া তাদের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য যা শিশুর বাধশক্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে বোধগম্য নয়, তার মনে এক রহস্যাবৃত ঔৎসুক্যের জন্য দেয়। শিশুর উৎপত্তি সংক্রান্ত বৌদ্ধিক প্রশ্নাবলির নীরব উত্তর শিশুর অন্তরে অকারণ কৌতূহলের সৃষ্টি করে, কেননা এই প্রশ্নের উত্তর অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যা অথবা ভুল হয়। আমি এমন অনেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে জানি যারা তাদের শৈশবস্থায় দেহের কোনো গোপন অঙ্গে হাত দিলে গুরুজন কর্তৃক গভীরভাবে তিরস্কৃত হয়েছে। এইভাবে ভবিষ্যতে এমনটি করলে তোমাকে আমি মেরে ফেলবো।

আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে একথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এসব ঐতিহ্যানুসারী নীতিবাগীশদের কার্যকলাপের দ্বারা তাদের পরম কাক্ষিত ও ইঙ্গিত পুণ্যের পথ প্রশস্ত হয় নি। শুধু যে ভীতিবিহ্বল তিরস্কারই করা হতো তা নয়, অনেক সময় একটি শিশু তার অঙ্গছেদনের মতো মারাত্মক কাল্পনিক শাস্তির অভীক্ষায় অভিহিত করা হতো এবং তার এ ধরনের আচরণকে সুপ্তোন্মদ অবস্থার বহিপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করা হতো।

নিউইয়র্ক রাজ্যের বিবেচনায় বলা হয়ে থাকে যে, কোনো আরাধ্য কাজ ঘটিত হওয়া পর্যন্ত তার ক্রিয়াশীলতা বজায় থাকে না। এই শিক্ষার তাৎক্ষণিক ফলশ্রুতি হলো এই যে, অধিকাংশ শিরা তাদের শৈশবাবস্থায় যৌনসংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে সুপ্ত অপরাধবোধ ও ভীতিবিহ্বল সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিন কাটিয়েছে। যৌনতার সঙ্গে অপরাধবোধ ও ভীতির এই সময় এত গভীর ও সার্বিক যে, এটি সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে অবচেতনার রাজ্যে বিচরণ করে। আমি যদি কোনো পরিসংখ্যানিক অনুসন্ধানে প্রয়াসী হই তাহলে দেখবো অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি বাসঙ্কুল মুহূর্তে ঘটিয়ে যাওয়া যৌন অপরাধের অন্তরালে এইসব শৈশবী গল্পের অপচ্ছায়াকে এক এবং একক উৎসরূপে চিহ্নিত করেছে। আমি বিশ্বাস করি যে, এ অপরাধের তাৎক্ষণিক শাস্তি হলো বজ্রপাতে মৃত্যু।

ধর্ষকাম ও মর্ষকাম-এ দুটিকে তাদের কোমলতার অনুপ্রবেশে যৌনমূলক অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হিসেবে গণ্য করা যায়। একজন মর্ষকামী মানুষ হলো সেই ব্যক্তি যে তার যৌন সম্পর্কিত অপরাধ সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল। ধর্ষকামী ব্যক্তিও তার দ্বারা নারীর অবমাননা সম্পর্কে অবহিত। এই দুটি ঘটনা এই সত্যকে প্রমাণ করে যে, শৈশব অবস্থায় অনুপ্রবিষ্ট কঠিন নৈতিক শিক্ষাবলি ভবিষ্যৎ জীবনে কি নিদারুণ আকার ধারণ করে। বিশেষ করে শিশুশিক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তিদের হৃদয়কে আলোকিত না করা পর্যন্ত এই বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার নেই। কিন্তু এখনও পর্যন্ত উত্তরণের কাহিনী মোটেই উল্লেখযোগ্য নয়।

শৈশব ও যৌবন হলো জীবনের এমন দুটি অবস্থা যখন উত্তেজনাপূর্বক কথাবার্তা এবং নিষিদ্ধ ঘটনার আস্বাদন হলো সম্পূর্ণভাবে প্রাকৃতিক স্বতঃস্ফুর্ত এবং এদের বহিঃপ্রকাশকে ততক্ষণ পর্যন্ত নিন্দা হিসেবে পরিগণিত করা উচিত নয় যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নৈতিকতার সীমানার মধ্যে অবস্থান করবে। কিন্তু গুরুজন কর্তৃক আরোপিত যৌন নিষেধাজ্ঞার উন্মাদনায় শিশুমন এ ব্যাপারে সসঙ্কুচিত ও অপরাধপ্রবণ হয়ে থাকে। যদি কোনো শিশু প্রতিবেশির বাগান থেকে ফল চুরি করে তাহলে আমরা তাকে তিরস্কৃত করে থাকি কিন্তু কখনোই সেই তিরস্কারের মাত্রা এমন হয় না যে, মনে হতে পারে এটা একটা সাংঘাতিক অপরাধ। যদি আপনি প্রাচীন ভাবাপন্ন মানুষ হয়ে দেখেন যে, আপনার শিশু হস্তমৈথুনে প্রবৃত্ত আছে তাহলে আপনার কণ্ঠস্বরে যে তীক্ষ্মতা ধরা পড়বে তা ঐ শিশু কোনোদিন ইতিপূর্বে শ্রবন করে নি। এই তীক্ষ্মতা জন্ম দেবে এক অদম্য ভীতির যা ঐ শিশুকে বারবার উদ্দিষ্ট নিষিদ্ধ কার্যে প্রবৃত্ত করবে। আপনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে ঐ শিশুর মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় প্রোথিত হবে যে, হস্তমৈথুন এক অত্যন্ত নিন্দীয় কাজ। কিন্তু সে এই কাজে বারবার প্রবৃত্ত হবে। এই ভাবে তার মনের মধ্যে এক বিষাদের জন্ম নেবে যার প্রভাব বজায় থাকবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। যৌবনের প্রথম প্রহর থেকে সে নিজেকে অপরাধী হিসেবে ভাবতে শিখবে এবং ততই তার মনের মধ্যে এই পাপকে গোপনীয়তার মিথ্যে আবরণে আবৃত করার অভীপ্সার জন্ম দেবে। সে খন্ড হার্দিক প্রশমনে এই চিন্তা করবে যে, কোনো ব্যক্তি তার এই পাপ সম্পর্কে সম্যক অবহিত নয়। তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ অসুখের মধ্যে সে একই অপরাধে অপরাধী অন্যান্যদের প্রতি অতিমাত্রায় প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে তার অসহায় অবস্থার বিনাশ ঘটাবার চেষ্টা করবে। শৈশবে যা তাকে অন্তহীন দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত করেছিল, যৌবনে সেটাই হবে তার নান্দনিক আনন্দের উৎস। এমনভাবে সে পরিগণিত হবে এক অতৃপ্ত আত্মমুখি দ্বিধাগ্রস্ত বিষাদ-সঙ্কুল মান কীটে যা উৎসাহিত হয়েছে তার পিতামাতার কু প্রযুক্ত পুণ্যসূচক চিন্তাধারার মাধ্যমে।

অপরাধবোধ, লজ্জা ও আতঙ্কের বাতাবরণ দ্বারা শিশুর জীবনকে আবৃত করা উচিত নয়। শিব্রা হবে আনন্দিত, স্বতঃ উৎসাহী এবং স্বয়ং প্রযুক্ত, তাদের নিজস্ব প্রক্ষোভজনিত উদ্দীপনার অন্তরালে কোনো আতঙ্কের স্থান নেই; প্রাকৃতিক ঘটনাবলির উন্মোচনে তারা কখনই ভীত কম্পিত চিত্তে প্রাসুখ থাকবে না। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত জীবনের গহন অন্ধকারে নিমজ্জনের কোনো কারণ নেই। তারা নিজেদের সমাহিত করবে না অচেতন প্রক্ষোতের গভীরতায়। যদি তাদেরকে আমরা সঠিক মানব ও মানবী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, বৌদ্ধিকভাবে সৎ, সামাজিকভাবে নির্ভয়, কর্মক্ষেত্রে উদ্দীপ্ত এবং মননে প্রগতিশীল, তাহলে জীবনের শুরু থেকে তাদের আমরা এই শিক্ষায় শিক্ষিত কবো যেন ভবিষ্যতে এই গুণগুলির বিকাশ সঠিকভাবে ঘটতে পারে।

শিক্ষাকে বর্তমানে নৃত্যরত ভালুকের শিক্ষণ প্রণালীর ব্যর্থ অনুকরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তাদেরকে উত্তপ্ত মেঝেতে দাঁড় করিয়ে নৃত্যরত অবস্থায় থাকতে বাধ্য করা হয় কেননা যদি তারা স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে উত্তপ্ত তলের সংস্পর্শে তাদের পায়ের পাতা পুড়ে যাবে। যখন এই নিষ্ঠুর শিক্ষা প্রণালী চালু থাকে তখন অন্তরালে ধ্বনিত হয় এক ছন্দের দ্যোতনা। কিছুদিন পরে তারা তপ্ততলে দাঁড়িয়ে না থেকেও শুধুমাত্র সঙ্গীত শ্রবণে নৃত্যরত অবস্থায় থাকতে পারে।

শিশুদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যখন একটি শিশু তার যৌনাঙ্গ সম্বন্ধে সচেতন হয় এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা তাকে তিরস্কৃত করে তখন কালানুক্রমে এই সচেতনতা তার মনের মধ্যে এই অপরাধবোধের জন্ম দেয় যা অবশেষে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে তার স্বাস্থ্যোজ্জলে অথবা সুন্দর যৌন জীবনের সমস্ত সম্ভাবনাকে।

পরবর্তীকালে কৈশোর অবস্থায়, যৌন সংক্রান্ত নৈতিকতার নির্মমতা অধিকতর ক্রিয়াশীল। বেশির ভাগ কিশোরই তাদের নৈশকালীন রেতঃস্থলনের প্রথম অভিজ্ঞায় ভীত ও সন্ত্রস্ত হয় এবং প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছে তা অনুধাবনে অসমর্থ হয়। তারা আবিস্কার করে যে শিশুকাল থেকে যে সমস্ত উদ্দীপনাকে তারা অত্যন্ত নিন্দনীয় হিসেবে মনে করে এসেছে এখন তাদের হৃদয়ে সেই প্রক্ষোভের পুনঃ পুনঃ উপস্থিতি। এই প্রক্ষোভ গুলির উপস্থিতি এত শক্তিশালী হয় যে, একে দিবা অথবা নৈশকালীন অদম্য ইচ্ছা হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে।

অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিসম্পন্ন কিশোরদের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য ও কাব্যের প্রতি ধাবমান প্রক্ষোভের উদ্রেক হয়, তার থেকে জন্ম নেয় আদর্শ ভালোবাসা যাকে যৌনতা থেকে বিযুক্ত করা হয়ে থাকে। খ্রিস্টধর্মের অন্তর্নিহিত আর্দশ বোধগুলির উন্মেষে কৈশোরকালীন উন্মাদনার দিকগুলি পরস্পরের সঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করে অথবা সৃষ্টি করে অকারণের বৈরীতা। এই প্রসঙ্গে আমার এক বৌদ্ধিক বন্ধুর অকপট স্বীকারোক্তির কথা মনে করা যেতে পারে। আমার নিজস্ব কৈশোরের দিনগুলির কথা মনে পড়ে। সারাদিন ধরে আমি ব্যস্ত থাকতাম শেলীর কবিতাপাঠে এবং আবেগ তাড়িত হৃদয়ে আবৃত্তি করতাম– The desire of the moth for the star of the might for the morrow.

তারপর অকস্মাৎ আমি পড়া ছেড়ে উঠে যেতাম এবং আমার চোখ পড়ে যেত কোনা এক পরিচারিকার অনাবৃত্ত দেহাংশে। এই চেতনা আমার মনের মধ্যে জন্ম দিত এক নিদারুণ লজ্জাবোধ, যদিও এর সঙ্গে যুক্ত ছিল যৌনতা সম্পর্কে অকারণ ভীতি।

সকলেই জানেন যে, কৈশোর অবস্থায় স্নায়বিক কৈবল্য দেখা যায়। এবং যে সমস্ত ব্যক্তি জীবনের সকল অধ্যায়ে নিজেকে সঠিকভাবে সংযত রাখতে পারেন তিনি কৈশোরকালে বিপরীত আচরণ করে থাকেন। এই প্রসঙ্গে মিস মেড তার Coming of Age in Samoa গ্রন্থে এই অভিমত পোষণ করেছেন যে, ঐ দ্বীপবাসীর কাছে কৈশোরকালীন বৈকল্য কখনও ঘটে না এবং এর অন্তরালে তিনি ওখানকার যৌন স্বাধীনতাকে দায়ী করেছেন। একথা সত্য যে, মিশনারীদের কার্যকলাপের ফলে ঐ যৌন স্বাধীনতা কিছু মাত্রায় শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়েছে। মিশনারীদের কাছে যেসব মেয়েরা বাস করে তাদের অধিকাংশ অকপটে স্বীকারোক্তির মাধ্যমে জানিয়েছেন যে, তারা কেবলমাত্র হস্তমৈথুন ও সমকামিতার মাধ্যমে তাদের যৌনক্ষুধার তৃপ্তি ঘটায়, আবার যে সমস্ত মেয়েরা বাইরে থাকে তারা বহুগামিতা দ্বারা আক্রান্ত। আমাদের বিখ্যাত আবাসিক বিদ্যালয়গুলি সামোয়ার মিশনারীদের আবাসস্থলের থেকে বিপরীত বিন্দুতে অবস্থান করে কিন্তু সামোয়ার ক্ষেত্রে এই ঘটনার কোনো মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নেই। কিন্তু একজন ইংলিশ স্কুল ছাত্রের কাছে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় যেহেতু সে অন্তর থেকে ঐতিহ্যানুসারী শিক্ষাব্যবস্থাকে শ্রদ্ধা করে এসেছে। পক্ষান্তরে সামোয়ার অধিবাসীরা মিশনারীদের মনে করে এক অদ্ভুত স্বভাবযুক্ত শ্বেতমানব যাদের আশ্চর্য ইচ্ছাগুলিকে ব্যক্ত করা যেতে পারে।

অধিকাংশ তরুণ তাদের যৌবনের প্রথম বছরগুলিতে যৌনতা সম্পর্কে এক অকারণ বিপদ ও সমস্যার তরঙ্গে নিমজ্জিত হয়। যদি কোনো তরুণ তার কুমারত্ব বজায় রাখে তাহলে সে সাধারণত ভীরু স্বভাবের হয়ে ওঠে, অবশেষে যখন সে বিবাহ করে তখনও সে তার পূর্ববর্তী বছরগুলিতে সযত্নে লালিত বোধগুলিকে ভেঙ্গে ফেলতে পারে না, অকস্মাৎ ঘটে যায় বিস্ফোরণ, ভেঙ্গে যায় কুমারত্বের বাধ, সে কখনই তার স্ত্রীকে প্রেমিকার আসনে বসাতে সমর্থ হয় না।

বিপরীত দিকে যদি সে প্রাগবৈবাহিক শারীর সংস্পর্শে অভিজ্ঞ হয় তাহলে তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত চিন্তাধারা ক্রিয়া করে। সে কোনোভাবেই প্রণয়ের দৈহিক ও নৈতিক দিকগুলির মধ্যে পার্থক্য নিরুপণ করতে পারে না। তাই নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক পরিণত হয় শরীর বিযুক্তিতে অথবা প্রেমের ক্রমিক অবমূল্যায়নে। পক্ষান্তরে তার যৌন অসুখের সম্ভাবনা থেকে যায়। যদি সে তার নিজের শ্রেণিভুক্ত মেয়েদের সঙ্গে শরীর সম্পর্ক বজায় রাখে তাহলে এই সম্ভাবনা অনেকাংশে কম, কিন্তু এক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করা সর্বাংশে সফল নাও হতে পারে এবং চিরস্থায়ী সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে অনেক বাধার অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে।

একজন পুরুষ যে তরুণ বয়সে বিবাহ করে না তার প্রধান কারণ দুটি-প্রথমত উন্নাসিকতা এবং দ্বিতীয়ত বিবাহের অব্যবহিত পরে সন্তান উৎপাদনের বিশ্বাস। বিশেষ যেখানে বিবাহবিচ্ছেদের পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল সেখানে তরুণ-তরুণীরা সহজে এই পথে পা দেয় না, যেহেতু কুড়ি বছর বয়সে যে দুটি মনের মিল সম্ভব সে দুটি মন তিরিশ বছর বয়সে পরস্পরের থেকে দূরে সরে যেতে পারে। একজন মাত্র সঙ্গি বা সঙ্গিনীর প্রতি আজীবন অনুরাগ দুরূহ ঘটনা, যদি না তারা বিভিন্ন অভিজ্ঞতা দ্বারা নিজেদের উদ্দীপ্ত রাখতে সমর্থ হয়।

যদি আমরা যৌনতা সম্পর্কে মুক্তমনের অধিকারী হতে পারতাম তাহলে এ কথা সহজেই ভাবা যেত যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সন্তানহীন অবস্থায় পরস্পরের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হচ্ছে। এমনভাবে তারা যৌন অবসাদ থেকে নিজেদের মুক্তি রাখতে পারতো, যে অবসাদ এখন তাদের প্রাত্যহিক কাজকর্মের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করে চলেছে। এই অবস্থাকে তারা সন্তান-পূৰ্ণ ভবিষ্যৎ বৈবাহিক জীবনের অবতরণিকা হিসেবে গণ্য করতে পারতো। এবং তারা প্রেমের সেই স্বর্গীয় সত্যকে উপলদ্ধি করতে পারতো যার মধ্যে গোপনীয়তা, ভীতিবিহ্বলতা বা ভয়ঙ্কর রোগের অনুপ্রবেশজনিত দুর্ভাবনার মুকুর-ছায়া নেই যা বর্তমানের যৌবনকে বিষাক্ত করেছে।

অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রে, যারা চিরন্তনভাবে অবিবাহিতা থেকে যায়, ঐতিহ্যানুসারী নৈতিকতা নির্মম ও ক্ষতিকারী। আমি বিশ্বাস করি যে, সুদৃঢ় নৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী অবিবাহিতা রমণিরা সমাজে শ্রদ্ধার আসনে আসীনা। কিন্তু এর এক বিপরীত দিক আছে। যে রমণি জীবনে কোনোদিন যৌন অভিজ্ঞতা অর্জন করে নি এবং তার পবিত্রতাকে রক্ষা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে মনে করে এসেছে, সে ঋণাত্মক প্রতিপত্তিক্রিয়ার প্রভাবে ভীরু ও ব্যক্তিত্বশূন্য হয়ে তাকে এবং তার অবচেতন মনের কোণ থেকে উৎসারিত হয় সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত নরনারীর প্রতি অচেতন হিংসা এবং যে সুখানুভূতি থেকে সে বঞ্চিতা সেই অনুভূতি যারা লাভ করেছে তাদের শাস্তি দেরার অদম্য স্পৃহা।

দীর্ঘকালীন কৌমার্যের অনিবার্য ফলশ্রুতি হলো বৌদ্ধিক অবসন্নতা। আমি এই কথা বিশ্বাস করি যে, সামগ্রিকভাবে নারীজাতি যে বুদ্ধিদীপ্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে তার একমাত্র কারণ হলো যৌনতা সম্পর্কে তাদের অনভিপ্রেত কৌতূহলের মীমাংসা না হওয়া। যে সমস্ত রমণিরা জীবনব্যাপী কৌমার্যকে বহন করে এসেছে তারা তাদের এই কাজের ধারা অসুখি অবস্থা এবং সময়ের অপব্যবহারকে ডেকে এনেছে। যেহেতু অপেক্ষাকৃত প্রাচীনকালে বিপরীত লিঙ্গভুক্ত মানব-মানবী মোটামুটিভাবে সমসংখ্যায় বিরাজ করতো, তাই সে যুগে এই সমস্যা বর্তমান যুগের মতো প্রবল আকার ধারণ করে নি। বর্তমানে অনেক দেশে মানব অপেক্ষা মানবীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে যে সমস্যা উদ্ভূত হয়েছে তার একমাত্র সমাধান হলো চিরন্তন নৈতিকতার মানদন্ডকে আধুনিকতার সংস্পর্শে পরিবর্তিত করা।

বিবাহকে আমরা যৌনতার প্রথাগত নিষ্ক্রমণ দ্বার হিসেবে চিহ্নিত করে বলতে পারি যে, এই ব্যবস্থার মধ্যেই প্রথাগত দৃঢ়তার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। শৈশবে আহৃত জটিলতা, তারুণ্যে সঞ্চিত শরীর সম্পর্কে স্মৃতির তাড়না এবং কুমারীদের মনের মধ্যে প্রোথিত যৌনভীতির পদচারণা সব মিলেমিশে বিবাহোত্তর সংরাগের বাধার সৃষ্টি করে। শারীরিকভাবে সুগঠিত কোনো নারী, যার যৌনেচ্ছার চাহিদা প্রবলতর সে পুরুষের প্রতি তার আকর্ষণকে হার্দিক দৌর্বল্য অথবা নিছক যৌন-আকাখার পরিতৃপ্তির মধ্যে পার্থক্য নিরুপণ করতে অসমর্থ হয়। সে অতি সহজেই এমন পুরুষকে বিবাহ করতে চায়, যে তার যৌনক্ষুধার তৃপ্তি ঘটাবে কিন্তু অবশেষে তার যৌন-আকাঙ্খ মিটে গেলে উক্ত ব্যক্তির সঙ্গে জগতের অন্যান্য পুরুষের কোনো তফাৎ খুঁজে পায় না। শিক্ষা তাদের দুজনকে সম্পূর্ণ বিপরীত তাড়নায় তাড়িত করে। রমণি হয়ে উঠে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল, পুরুষ ফেটে পড়ে আকস্মিক বিস্ফোরণে। তাদের দুজনের কারুর মধ্যেই যৌনতা সম্পর্কে স্বচ্ছ, সুন্দর, স্বাভাবিক চিন্তাধারা থাকে না এবং অজ্ঞানতা-জনিত কুসংস্কারের ফলশ্রুতিতে প্রাথমিক ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি বিবাহকে উভয়ের পক্ষেই যৌন অতৃপ্তির দ্যোতক করে দেয়।

শারীরিক ও মানসিক নৈকট্যের যুগলবন্দি এক বিরল ঘটনা। নারীরা সাধারণত যৌন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে অভ্যস্ত নয়। পুরুষেরা একই পথের পথিক যদি না তাঁর সঙ্গিনী কোনো বীরাঙ্গনা হয়। যৌথ জীবনের গভীর গোপন গহনকোণে তারা দুজনেই লাজুক এবং অতিমাত্রায় নৈঃশব্দ্যের পূজারী। এক্ষেত্রে স্ত্রী তার চাহিদা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল না হওয়ায় পরিতৃপ্তির পথ খুঁজে পায় না। অপরপক্ষে স্বামী এ ব্যাপারে স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী বলে প্রথমে অতিমাত্রায় আগ্রাসী, পরে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল, এবং অবশেষে ধীরে ধীরে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে, এবং এই মত পোষণ করে যে, তার বিবাহিতা স্ত্রী অপেক্ষা কোনো বীরাঙ্গনা বোধহয় তার প্রতি অধিকতর মাত্রায় সদয়া হতো। সে তার স্ত্রীর স্ব-আরোপিত শীতলতায় ব্যথিত হয়, স্ত্রীকে উদ্দীপ্ত করার উপায় সম্পর্কে তার জ্ঞান কম থাকায় মাঝে মাঝে অসহায় বোধ, করে। নীরবতা ও পবিত্রতার তত্ত্ব থেকেই এসব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে থাকে।

শৈশবের প্রথম দিন থেকে কৈশোরের আবেগ তাড়িত মুহূর্তের অবসানে, যৌবনের উদগমে, এমনকি বিবাহের পরে সুপ্রাচীন নৈতিকতা প্রেমকে করেছে বিষাক্ত, বিষাদক্লিষ্ট, ভীতিদ্যোতক, যৌনজীবনের পরিপন্থী, স্নায়বিক দৌর্বল্যের উৎস এবং যৌন প্রক্ষোভের শারীরিক শীৎকারকে খন্ডিত করেছে, দ্বি-সত্তায় এবং আদর্শ প্রেমের স্বর্গীয় সুষমাকে কালিমালিপ্ত করেছে একজনের মধ্যে জান্তব প্রবৃত্তির উদগীরণে এবং অন্যকে নিরাসক্তির অন্ধকারে প্রোথিত করে। কিন্তু এমনভাবে বাঁচার নাম তো জীবন নয়। জান্তব ক্ষুধা এবং স্বর্গীয় সুষমার সহাবস্থান কি সম্ভব?

কিন্তু আমরা জানি, এ দুটি চেতনা হলো একে অন্যের পরিপূরক। দুটির সংঘবদ্ধ সম্মেলনের মাধ্যমেই কাঙ্ক্ষিত সুখ আয়ত্ত হতে পারে। মানব-মানবীর ভালোবাসা অবাধ ও নির্ভয় হওয়া উচিত, সেখানে শরীর ও মনের সাযুজ্য থাকবে সমান। সেখানে ভালোবাসা হলো এমন একটি গাছ যার মূল বসুমাতার অন্তরে প্রোথিত। শাখাগুলি হাত মেলেছে স্বর্গের উদ্যানে। কিন্তু সেই ভালোবাসা সম্পূর্ণভাবে বৃদ্ধি পায় না যদি তাকে আক্রমণ করে নৈতিকতা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভয়, নিষেধাজ্ঞা ও আতঙ্কের নীরবতা।

আমাদের আবেগ তাড়িত জীবনের কেন্দ্রীয় ভিত্তি হলো মানব-মানবীর ভালোবাসা এবং পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততির ভালোবাসা। কিন্তু নৈতিকতা এর একটিকে সমূলে বিনাশ করতে চায়, অন্যটিকে সস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরার ভান করে। তাই পিতামাতা যদি পরস্পরকে ভালো না বাসে তাহলে কেমনভাবে তাদের সম্মীলিত হৃদয় ঝরণা থেকে ছেলেমেয়ের প্রতি উৎসাহিত হবে ভালোবাসার স্রোত?

ছেলেমেয়েরা হলো পারস্পরিক তৃপ্তি ও আনন্দের ফলশ্রুতি যাদেরকে আমরা আরও স্বাস্থ্যসম্মত ও সুচারুভাবে ভালোবাসতে পারবো, গড়ে তুলতে পারবো সাধারণভাবে। কিন্তু যদি আমরা আমাদের মধ্যে সবসময় আগ্রাসী মনোভাব বজায় রাখি তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরাও কি সেই অসীম অচেতনার অন্ধকারে নিমজ্জিত করবো না, যা আমাদের জীবনকে বিষাক্ত দহনে জীর্ণ করেছে? ভালোবাসাকে ভয় করার অর্থ হলো জীবনকে ভয় করা এবং যারা জীবনকে ভয় করে তারা তো জীবন্ত অবস্থায় বেঁচে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *