১৬. জনসংখ্যা

১৬. জনসংখ্যা

বিবাহের প্রধান উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীতে মানুষ্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি। কোনো কোন বৈবাহিক পদ্ধতিতে এই উদ্দেশ্য নিরবচ্ছিন্নভাবে সাধিত হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে। এই মতবাদের প্রেক্ষাপটে আমি বর্তমান অধ্যায়ে যৌনমূলক পবিত্রতার আলোচনা করবো।

পৃথিবীতে দেখা গেছে যে, বৃহত্তর স্তন্যপায়ীরা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে অপেক্ষাকৃত বেশি জায়গা চায়। ফলস্বরূপ যেকোনো বৃহৎ বন্য স্তন্যপায়ীর সর্বমোট জনসংখ্যা সাধারণত অল্প হয়ে থাকে। ভেড়া ও গরুর সংখ্যা যথেষ্ট বেশি, তবে এর অন্তরালে মানুষের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ক্রিয়াশীল। যেকোনো বৃহৎ স্তন্যপায়ীর তুলনায় মানুষ্য জাতির সংখ্যা যথেষ্ট বেশি। অবশ্য এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের মেধার জন্যে। তীর ধনুকের আবিস্কার, বন্য স্বভাবের গৃহস্থীকরণ, কৃষিকার্যের সূচনা, শিল্প বিপ্লব–সবকটি ঘটনার সমবেত প্রভাবে প্রতি বর্গমাইল স্থানে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি সম্ভব হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক প্রগতি; যা প্রতিভাত হয়েছে পরিসংখ্যান, থেকে এবং ব্যবহৃত হয়েছে এই উদ্দেশ্য। মানুষের মেধাকে নিযুক্ত করা হয়েছে সবকটি ঘটনার সার্বিক মূল্যায়নে।

একথা মানতেই হবে যে, মিস্টার কার স্যানডারাস দেখিয়েছে যে, মনুষ্য সভ্যতার প্রথমদিকে জনসংখ্যা মোটামুটি স্থিতিশীল স্তরে ছিল। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনারূপে তা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনটি দেখা গেছে ইজিপ্ট ও ব্যাবিলনীয়ার প্রাচীন সভ্যতায় যেখানে জলসেচের ব্যবহার এবং সুনিয়ন্ত্রিত কৃষিকার্যের ব্যবহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাককালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল মোটামুটি স্থিতিশীল, তাই বলা যেতে পারে যে, দ্রুত বর্তমান জনসংখ্যা একটি দুর্লভ ও অনভিপ্রেত ঘটনা। এখন আবার দেখা যাচ্ছে। যে, অত্যন্ত উন্নত দেশসমূহে জনসংখ্যা স্থিতিশীলতার অভিমুখি। এর দ্বারা এই সত্য উন্মোচিত হয় যে, অস্বাভাবিক ঘটনায় জনসংখ্যার আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটে।

মিস্টার কার স্যানডারাসের জনসংখ্যা বিষয়ক পুস্তকটির প্রধান কৃতিত্ব হলো যে, তিনি সর্বযুগে-সর্বদেশে অনুসৃত ঐচ্ছিকবোধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন এবং এই তত্ত্বে উপনীত হয়েছেন যে, সুউচ্চ নৈতিকতার মাপকাঠিতে সুনির্দিষ্ট জনসংখ্যা আবৃত থাকে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার বিশ্লেষণ সঠিক হয় নি। বিশেষ করে ভারত ও চীনের ক্ষেত্রে অতি উচ্চ মৃত্যুহারই জনসংখ্যার দ্রুত পরিপন্থী হিসেবে কাজ করেছে। চীনের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান পাওয়া সহজ নয়, কিন্তু ভারতে ক্ষেত্রে তা সহজই পাওয়া যেতে পারে। সেখানে জন্মহার অত্যাধিক কিন্তু সেখানে জনসংখ্যার বৃদ্ধি ইংল্যান্ডের তুলনায় সামান্য কম গতিশীল। এর প্রধান কারণ হলো শিশু মৃত্যু, প্লেগ এবং অন্যান্য ভয়ঙ্কর রোগের প্রাদুর্ভাব। আমি বিশ্বাস করি যে, পরিসংখ্যান প্রাপ্তব্য হলে চীনের ক্ষেত্রে একই অভিধা চিহ্নিত হতো।

এইসব গুরুত্বপূর্ণ ক্রটি ব্যতিরেকে মিস্টার কার স্যানডারসের গবেষণা অবিসংবাদিতভাবে মূল প্রতিপাদ্যের প্রতি সত্তাবে প্রযুক্ত। জনসংখ্যা রোগের জন্যে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রযুক্ত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে সহজ হলো শিশুহত্যা। ধর্ম যেখানে এই ঘটনাকে সমর্থন করেছে সেখানে এর প্রয়োগ হয়েছে সংখ্যাতীতভাবে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের সময় তারা এই প্রতিশ্রুতি চেয়েছে যে, নতুন ধর্ম যেন তাদের শিশুহত্যার অধিকারকে হরণ না করে।

যখন জার সরকার সকলের জন্যে সমরশিক্ষাকে আবশ্যিক করেছিল তখন ডাক হবরসরা এই আশঙ্কায় এর বিরুদ্ধাচরণ করে যে, মনুষ্য জীবন ক্ষণস্থায়ী বলে মূল্যবান। পরবর্তীকালে তারাই ক্যানাডিয়ান সরকারের সঙ্গে শিশুহত্যার নৈতিক অধিকার নিয়ে আন্দোলনে প্রবৃত্ত হয়।

জনসংখ্যা রোধের অন্যান্য পদ্ধতির মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল গর্ভাবস্থায় এবং শিশু জন্মের দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ী স্তনদানকালে নারীজাতিকে যৌনসহবাস থেকে বিমুক্ত রাখা। এই ঘটনা দ্বারা বিশেষত বন্যনারীদের উর্বরা শক্তি সীমায়িত করা হতো যারা সুসভ্য জাতির রমণি অপেক্ষা দ্রুতলয়ে বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যেত।

অস্ট্রেলিয় আদিবাসীরা এক অত্যধিক কষ্টসাধ্য শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে পুরুষের উৎপাদনশীলতাকে যথেষ্ট মাত্রার হ্রাস করণের প্রয়োগে ব্রতী হতো এবং এইভাবে উৎপাদনশীলতাকে এক গ্রহণযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিল। জেনোসিসের থেকে আমরা জানতে পারি যে, প্রাচীনকালে অন্তত একটি সুনির্দিষ্ট জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চালু ছিল যদিও এই পদ্ধতি ইহুদি কর্তৃক সমর্থিত হয় নি। কেননা তাদের ধর্ম ছিল সব অর্থে ম্যালথুসিয়ান বিরোধী। এইসব প্রক্রিয়ার সফল প্রয়োগশীলতা দ্বারা মনুষ্যজাতির অনাহারজনিত মৃত্যুর বিভীষিকা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল যা হতো তার অনিবার্য পরিণতি যদি সে তার প্রজনন ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ সীমায় ব্যবহার করতো।

অনাহারে মৃত্যুর আশঙ্কাই জনসঙ্কোচনে ক্রিয়াশীল থেকেছে। বিশেষ করে আদিম কৃষিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় এটা ছিল এক করুণ অথচ সুনিশ্চিত পরিণতি। ১৯৪৬-৪৭ সালে আয়ারল্যান্ডে ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা এমন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি একেবারেই রুদ্ধ হয়ে যায়। রাশিয়াতে দুর্ভিক্ষ ছিল এক অতি সাধারণ ঘটনা। বিশেষ করে ১৯২১ সালের দুর্ভিক্ষের কথা অনেকের মনে আছে। আমি যখন ১৯২০ সালে চীনদেশে ছিলাম তখন সেই দেশের এক বিরাট অংশ মানুষ দুর্ভিক্ষকবলিত ছিল যার ভয়াবহতা পরবর্তী বছরে রাশিয়ার ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষের সমতুল্য। কিন্তু দুর্ভিক্ষে মৃত-ব্যক্তিরা ভোলোগা পারের প্রতিবেশিদের তুলনায় কম সহানুভূতি অর্জন করেছিল যে, তাদের দুর্ভাগ্য সাম্যবাদ দ্বারা তালিত নয়। এই ঘটনা দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে, কোনো কোনো সময় জনসংখ্যা সহনশীলতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। অবশ্য এর প্রকাশ ঘটে তখনই যখন প্রাপ্ত খাদ্যের সরবরাহে আকস্মিক ঘাটতি ঘটে।

খ্রিস্টধর্ম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সবকটি রাস্তাকে রুদ্ধ করে দেয়। শিশু হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়, গর্ভপাত অনৈতিক এবং জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতিসমূহ অধার্মিক। যদিও একথা সত্য যে, পাদরি সম্প্রদায় গির্জার যাজক ও যাজিকাবৃন্দ কৌমার্যের উপাসক ও উপাসিকা ছিলেন। কিন্তু আমি একথা বিশ্বাস করি না যে, মধ্যযুগীয় ইউরোপে তাদের সম্মিলিত সংখ্যা বর্তমান ইংল্যান্ডের অবিবাহিতা নারীর তুলনায় বেশি ছিল। এই কারণে তারা সমবেতভাবে উৎপাদনশীলতার গতিরোধক পরিসংখ্যানীয় সূচক হিসেবে কাজ করতে পারে নি।

প্রাচীন যুগের তুলনায় মধ্যযুগে বিভিন্ন কারণ জনিত মৃত্যুর সংখ্যা যথেষ্ট বেশি ছিল। এর ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল খুবই সামান্য। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই হার সামান্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঘটে যায় এক অস্বাভাবিক পরিবর্তন এবং বৃদ্ধির হার সেই শিখরে আরোহন করে যা পূর্বে ছিল অদৃষ্টপূর্ব।

১০৬৬ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে প্রতিবর্গমাইলে ২৬ জন মনুষ্য বসতি ছিল, ১৮০১ সালে সেটা বেড়ে হয় ১৫৩ এবং ১৯০১ সালে তা দাঁড়ায় ৫৬১ তে। এরদ্বারা এই সত্য প্রতিভাত হচ্ছে যে, উনবিংশ শতাব্দীতে বৃদ্ধির গড় চারগুন। যদিও ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের জনবৃদ্ধির এই গতিপ্রকৃতি দ্বারা সার্বিক সত্য উপলব্ধি হয় না কিন্তু এরদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বৃটিশ জনসংখ্যা ঐ সময়ে পৃথিবীর এমন সব দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল যা পূর্বে আদিম বন্যজাতি দ্বারা অধিকৃত ছিল।

জনবৃদ্ধির এই হারকে জন্মবৃদ্ধির সঙ্গে ক্রিয়াশীল মনে করলে ভুল হবে কেননা এর অন্তরালে প্রধান কারণ ছিল মৃত্যু হারের হ্রাসমানতা যা আংশিক নির্ভরশীল চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতিতেএবং অধিকতর নির্ভরশীল শিল্প বিপ্লব দ্বারা আহৃত উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান অনুশীলনে।

.

১৮৪১ সাল থেকে ইংল্যান্ডে জন্মহার লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়। ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত এই হার ছিল মোটামুটি স্থায়ী যা সর্বোচ্চ সীমায় ৩.৫৫-এ অবস্থান করে। ইতিমধ্যে দুটি ঘটনা ঘটে গেছে। একটি হলো ১৮৭০ সালে প্রযুক্ত শিক্ষা আইন। আর একটি হলো ১৮৭৮ সালে নব্য ম্যালথুসিয়ান আন্দোলনের প্রবক্তা ব্রাডলাফের অবমূল্যায়ন। এর ফলে জন্মহারের উল্লেখযোগ্য পতন সূচিত হয়-প্রথমে ধীরে ধীরে, পরে সামগ্রিকভাবে।

শিক্ষা আইন প্রযুক্ত হবার ফলে সন্ততিরা আর লাভদায়ক বিনিয়োগরূপে বিবেচিত হলো না এবং ব্রাডলাফ এর উপায় নির্ধারণ করলেন।

১৯১১-১৫ পঞ্চবার্ষিকীতে জন্মহার ১৬.৫-এ হ্রাসপ্রাপ্ত হলো। এখন ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা চিকিৎসাশাস্ত্র ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের উন্নতিতে ধীরমাত্রার বর্তমান কিন্তু এই সংখ্যা অতি দ্রুত স্থির অঙ্কের অভিসারী। সবাই জানেন যে, ফরাসি দেশে যথেষ্ট সময় ধরে সুনির্দিষ্ট জনসংখ্যা বজায় আছে।

সমগ্র পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে জন্মহারের পতন হয়েছে অতিদ্রুত ও সার্বিক। একমাত্র পর্তুগালের মতো অনুন্নত দেশে এর প্রভাব পড়ে নি এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠী অপেক্ষা নাগরিক জনসমষ্টিতে এর প্রভাব অধিকতর ক্রিয়াশীল। প্রথমে এর সূচনা হয়েছিল অপেক্ষাকৃত ধনী জনগোষ্ঠীর মধ্যে। বর্তমানে এটি ছড়িয়ে পড়েছে শহর ও শিল্পনগরীতে বসবাসকারী সকলের মধ্যে। এখনও পর্যন্ত অর্থনৈতিক দুর্বল শ্রেণির মধ্যে জন্মহার উন্নত শ্রেণির চেয়ে বেশি। কিন্তু লন্ডনের সবচেয়ে দরিদ্র পল্লীর জন্মহার আজ দশ বছর আগের সবচেয়ে ধনী জনগোষ্ঠীর চেয়ে কম। সকলেই অবহিত আছেন (যদিও অনেকে স্বীকার করতে চান না), গর্ভনিরোধরে ব্যাপক ব্যবহার এবং গর্ভপাতই এই হ্রাসের জন্যে দায়ী। কিন্তু জন্মহার যে স্থির জনসংখ্যার সাপেক্ষে এই বিন্দুতে অবস্থান করবে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। হয়তো এমনটি হতে পারে যে, সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী মানবজাতির সম্পূর্ণ অবলুপ্তি না হওয়া পর্যন্ত জন্মহার ক্রমহ্রাসমান থাকবে।

এই সমস্যার সুচিন্তিত অনুধাবনের পূর্বে আমাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সম্যক ধারণা রাখতে হবে। যেকোনো অর্থনৈতিক পদ্ধতিতে, যাকে কার স্যানডারস বলেছেন সংখ্যার সর্বশেষ ঘনত্ব, সেটি হলো সেই ঘনত্ব যা মাথাপিছু সর্বাধিক আয়ের ব্যবস্থা করে। যদি জনসংখ্যা এই সূচকের নিম্ন কিংবা ঊর্ধ্ব অভিমুখী হয় তাহলে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের সাধারণ দিকগুলি অন্তর্হিত হবে। বিস্তারিতভাবে বলা যেতে পারে যে, অর্থনৈতিক পদ্ধতির উন্নতিতে জনসংখ্যা সর্বশেষ বৃদ্ধি পায়। বনচারী মানুষের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমাইলে একজন মানুষের উপস্থিতি ছিল সঠিক ঘনত্বের বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু উন্নত শিল্পসমৃদ্ধ দেশে প্রতি বর্গমাইলে। কয়েকশো মানুষের উপস্থিতিকে অত্যধিক বলা যেতে পারে না। যুদ্ধোত্তরকালে ইংল্যান্ড অধিক জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত কিন্তু ফ্রান্স অথবা আমেরিকার ক্ষেত্রে এই যুক্তি প্রযুক্ত নয়। বিশেষ করে ফ্রান্সে অথবা পশ্চিম ইউরোপের কোনো কোনো দেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি দ্বারা ঐশ্বর্যের বৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। যদি এটাই সত্য হয় তাহলে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করে জনবৃদ্ধিকে সমর্থন না করার কোন কারণ নেই। অনেকে এই মনোভাবের অন্তরালে জাতীয়তাবাদী সমরনৈতিকতার অবদমিত উদ্দীপনার প্রচ্ছন্ন বহিঃপ্রকাশ দেখতে পারেন কিন্তু তাঁদের উদ্দিষ্ট জনবিস্ফোরণকে কখনই চিরন্ততার মোড়কে আবৃত করা যাবে না, এই কারণে যে, যে উদ্দেশ্যে এই জনবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত বা কাম্য তা যেকোনো যুদ্ধোত্তরকালীন পরিস্থিতে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।

.

প্রকৃতপক্ষে বলা যেতে পারে যে, গর্ভনিরোধকের প্রয়োগ অপেক্ষা রণক্ষেত্রে মৃত্যুদ্বারা জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ অধিকতর কাম্য। কিন্তু যৌক্তিক বিচারে এই সম্ভাবনার অসাড়তা সহজেই বোধগম্য হয় এবং তথাপি যাঁরা এই মতবাদে বিশ্বাসী তাদের বৌদ্ধিক চিন্তাধারা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। যুদ্ধ সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা ব্যতিরেকে আমরা এইভাবে আনন্দবোধ করতে পারি যে, জন্মনিয়ন্ত্রক পদ্ধতির সার্বিক জ্ঞানই সুসভ্য দেশসমূহের জনসংখ্যাকে সুস্থির রাখতে সহায়ক হয়েছে।

এই ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত অনুযায়ী হতো যদি আমরা ক্রমহ্রাসমান পদ্ধতির দ্বারা মানুষের সংখ্যাকে এমন অবস্থায় পৌঁছে দিতাম যে, পৃথিবীর বুক থেকে মানবজাতি সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হতো। অবশ্য আমরা কেউই সর্বাপেক্ষা সুসভ্য জাতিগোষ্ঠীর অবলুপ্তি প্রত্যক্ষ করতে চাই না। সেই কারণে গর্ভনিরোধকের ব্যবহারকে সেই নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত স্বাগত জানানো উচিত যা বিশ্বের জনসংখ্যাকে বর্তমান অবস্থায় আবদ্ধ রাখবে। আমি মনে করি না যে, এর প্রয়োগ অত্যন্ত দুরুহ কেননা অর্থনৈতিক কারণেই পরিবারের পরিধিকে সীমায়িত করা হয়। সেই কারণে শিশু জন্মের খরচকে হ্রাস করা গেলে জন্মহারের বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী। বিপরীত ক্রমে বলা যেতে পারে যে, শিশু যদি পরিবারের আয়ের উৎস হয় তাহলে জন্মহার বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান জাতীয়তাবাদী পৃথিবীতে এই ঘটনা ভয়ংকর প্রভাব ফেলতে পারে কারণ এর দ্বারা সমরমুখিতার প্রাদুর্ভাব ঘটবে। আমরা এমন এক অবস্থার কল্পনা করতে পারি যেখানে পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধোন্মাদ জাতি সমরশক্তির বৃদ্ধিকল্পে জনবিস্ফোরণ ঘটে যাবে। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রশাসনের উপস্থিতিই সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। এমন একটি প্রশাসন যুদ্ধোন্মাদ জাতিগুলির জনবৃদ্ধির হারকে নির্দিষ্ট সীমায় সীমায়িত করবে। অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অত্যন্ত দ্রুত, কিন্তু আদিবাসীদের আগমন ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার জনবৃদ্ধির হার অত্যন্ত শ্লথ। এই বিপরীতানুসারী ঘটনার অনুক্রমে দুই দেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া শত্রুতার পরিধি নির্ধারণ করা সহজ নয়। কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকাতে জন্মহার এমন এক সুস্থিত বিন্দুতে অবস্থান করেছিল যে ঐ দেশগুলিতে জনবৃদ্ধির হার ছিল অত্যন্ত সাধারণ। কিন্তু এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী সাময়িক দেশসমূহ নিস্পৃহ হয়ে বসে থাকবে যখন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলি জনবিস্ফোরণ দ্বারা শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তনের প্রয়াসে ব্রতি হবে। এক্ষেত্রে এমন একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক প্রশাসনের উপস্থিতি প্রয়োজন যা যুদ্ধোন্মাদ দেশগলির জন্মনিয়ন্ত্রণকে সীমায়িত করবে। এটি করা সম্ভব না হলে পৃথিবীতে কোনোদিন শাস্তি সুপ্রযুক্ত হবে না।

জনসংখ্যার বিশ্লেষণে দ্বিমুখী প্রভাব মনে রাখতে হবে। একদিকে আমাদের দেখতে হবে যেন জন্মবৃদ্ধির হার খুব বেশি না হয়, অন্যদিকে নজর রাখতে হবে জন্মনিয়ন্ত্রণ যেন অধিকতর মাত্রায় প্রযুক্ত না হয়। প্রথম আশঙ্কাটি সুপ্রাচীন। বিশেষ করে পর্তুগাল, স্পেন, রাশিয়া ও জাপানের মতো দেশে এর প্রভাব সুদূর প্রসারী। কিন্তু দ্বিতীয় বিপদটি অপেক্ষাকৃত নবীন। ইতিমধ্যে কেবলমাত্র পশ্চিম ইউরোপে এর উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকাতেও এর অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে যদি আমেরিকা শুধুমাত্র প্রজনন দ্বারা জনবৃদ্ধির উপক্রম করে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত অভিবাসনের দ্বারাই আমেরিকার জনসংখ্যা তার কাঙ্ক্ষিত দ্রুততা অর্জন করেছে। যদিও আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের জন্মহার অত্যন্ত কম।

ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যার গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা এখনও পর্যন্ত সম্যক অনুভবী নই এই কারণে যে, আমাদের শতাব্দ বাহিত চিন্তাধারায় এর অনুপ্রবেশ ঘটে নি। এর অন্তরালে আছে নৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রচারের বিরুদ্ধাচারণ। বর্তমান পৃথিবীর সমস্ত সুসভ্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে গর্ভনিরোধকের ব্যাপক প্রচলন এক স্বাভাবিক ঘটনারূপে পরিগণিত হয়। বর্তমানে এর প্রভাব থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। যে ক্ষেত্রে এর অন্তরালে প্রশাসন অথবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে সেখানে এর অবলুপ্তি কোনোমতেই সম্ভব নয়। তবে আমি স্থিরভাবে বিশ্বাস করি যে, বর্তমানের তরুণ সম্প্রদায় যারা আগামী দিনে প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে তারা এ বিষয়ে তাদের পিতামহদের চেয়ে স্বচ্ছ ও সদার্থক ভাবনার অনুসারী হবে।

আমরা সহজেই এই অনুমান করতে পারি যে, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম গর্ভনিরোধক ব্যবহার দ্বারা জনসংখ্যার বিরূপ ক্রিয়াশীল হ্রাসমানতা ঘটাবে না। কোনো একটি দেশের ক্ষেত্রে একই তত্ত্বের প্রয়োগ হতে পারে।

এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, একটি বিষয়ে আমাদের নৈতিকতার মানের পরিবর্তন প্রয়োজন। বর্তমান ইংল্যান্ডে পুরুষের চেয়ে বিশ লক্ষ বেশি নারী বাস করে এবং আইন ও প্রথা দ্বারা তাদের আমরা সন্তানহীনা করে রেখেছি যা তাদের অনেকের কাছে মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। যদি সমাজ কুমারী মাতৃত্বকে স্বীকৃতি দেয় এবং কুমারী মাতার অর্থনৈতিক অবস্থাকে সহনশীল করে তোলে তাহলে বর্তমানে যে বিপুলসংখ্যক নারীগোষ্ঠী কৌমার্য রক্ষা করতে বাধ্য হয় তাদের এক বৃহৎ অংশ মাতৃত্বের স্বাদ আস্বাদন করতে চাইবে। সম্পূর্ণ একগামিতা অনুমানের ওপর স্থাপিত যেকোনো সমাজে বিপরীত লিঙ্গের অবস্থিতি সংখ্যাগতভাবে সমান। যেখানে এমনটি ঘটে না সেখানে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ লিঙ্গগোষ্ঠীর মানব অথবা মানবীকে যথেষ্ট নির্মমতার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতে হয়; কারণ সমাজে তারা সঙ্গিহীন অবস্থায় থাকতে বাধ্য হয়। এবং যে সমাজ জন্মহার বৃদ্ধিতে পরামুখ সেক্ষেত্রে এই নির্মমতাকে সার্বজনীনভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে অনভিপ্রেত করতে হবে।

চেতনার উন্মীলন দ্বারা আমরা প্রশাসনিক ক্ষমতার সুপ্রযুক্ত ব্যবহারে এই পরিবর্তন ঘটাতে পারি, এতদিন যা প্রাকৃতিক শক্তির অন্ধ বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হতো। জনবৃদ্ধি হলো এমন একটি ঘটনা। খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসারের ফলে এই ঘটনা আবেগতাড়িত ইচ্ছার অন্ধ বহিঃপ্রকাশরূপে পরিগণিত হচ্ছে। ধীরে ধীরেএই অবস্থার মধ্যে সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকা ক্রমশই প্রভাবশালী হয়ে উঠছে এবং বর্তমান পৃথিবীর শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলির পরিবর্তে এমন এক আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রের উদ্ভব অনুভূত হচ্ছে যা এই ঘটনার সহায়ক হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *