১২. বর্তমান যুগের পরিবার

১২. বর্তমান যুগের পরিবার

পাঠক এখন জেনে গেছেন যে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে মাতৃতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ও যৌন নৈতিকতা সম্পর্ক আদিম মনোভাবের ওপর তাদের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এখন আমরা পরিবার সম্পর্কে আলোচনা করতে চলেছি যাকে যৌন স্বাধীনতার ওপর সীমাবদ্ধতার একমাত্র যৌক্তিক ভিত্তি হিসেবে অভিহিত করা যায়।

আমরা যৌনতা ও পাপ সংক্রান্ত দীর্ঘ বিশ্লেষণের সমাপ্তি রেখায় উপনীত হয়েছি। যে সম্পর্কটিকে প্রাথমিক খ্রিস্টানরা উদ্ভাবন করতে পারে নি কিন্তু তাকে চরমভাবে শোষণ করেছে এবং তাকে নিয়ে গেছে অধিকাংশ মানুষের হৃদয় হতে উৎসারিত স্বতঃস্ফূর্ত নৈতিকচিন্তাধারার দিকে। যৌনতা হলো এমন একটি কুপ্রবৃত্তি যাকে সন্তান উৎপাদনকারী বিকল্প ব্যবস্থা বিনষ্ট করতে পারে। যখন আমরা সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব যা সন্তানদের প্রশ্নে আকাঙ্ক্ষিত যৌন সম্পর্কের স্থায়ীত্ব নিয়ে ভাবিত। একথা বলার অর্থ, আমরা স্থায়ী বিবাদের কারণ স্বরূপ পরিবারের অস্তিত্বকে বিশ্লেষণ করব। এই প্রশ্নটি সহজ নয়, কেননা পরিবারের সদস্য হয়ে একটি শিশু যা লাভ করে তা নির্ভর করছে বিকল্প ব্যবস্থার ওপর। যদি আমরা গ্রহণযোগ্য বিকল্প ব্যবস্থার সৃষ্টি করতে পারি তাহলে অধিকাংশ পরিবারের কাছে সেই ব্যবস্থা হবে পরম আকাক্ষিত। আমাদের আরো চিন্তা করতে হবে, পারিবারিক জীবনে পিতা কোনো অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে কিনা। কারণ তার স্বার্থে নারীত্ব-সূচক পবিত্রতাকে পরিবারের অপরিহার্য উপাদানরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। শিশুর নিজস্ব মনঃস্তত্ত্বের ওপর পরিবারের বিষয়টি পরীক্ষা করতে হবে যে বিষয়টিকে ফ্রয়েড অমঙ্গলকর মানসিকতা দ্বারা আলোচনা করেছিলেন। পিতার গুরুত্ব বাড়ানো অথবা কমানোর জন্য প্রযুক্ত অর্থনৈতিক পদ্ধতিগুলির প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে।

নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে যে, আমরা কি চাই, রাষ্ট্র এসে পিতার স্থান অধিকার করুক, অথবা প্লেটোর প্রস্তাব অনুসারে রাষ্ট্র পিতামাতা উভয়ের স্থান নিক। আমাদের ভাবতে হবে যে, সাধারণ অবস্থায় শিশুকে শ্রেষ্ঠ পরিবেশ প্রদানে আমরা কি বাবা ও মায়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করব? কেননা এমন অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যায় যেখানে তাদের মধ্যে একজন ঐ দায়িত্ব নেবার অনুপযুক্ত। আমরা চিন্তা করব দুজনের মধ্য বিদ্বেষের দিক থেকে কে অধিকতর মাত্রায় ক্ষতিকারক।

এই কারণে যৌন-স্বাধীনতার বিরোধী পন্থিরা বলে থাকে যে, বিবাহ বিচ্ছেদ প্রথা শিশুস্বার্থ বিরোধী কিন্তু এই যুক্তিটি তাত্ত্বিকদের দ্বারা প্রযুক্ত হলেও সত্যরূপে প্রতিভাত হয় না। কেননা এই ব্যক্তিরা বিচ্ছেদ অথবা গর্ভনিরোধক ঔষধিকে সহ্য করতে পারে না। এমনকি বাবা-মায়ের মধ্যে একজনও সিফিলিসে আক্রান্ত হলে শিশুর মধ্যে সেই রোগ হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। তখনও তারা বিচ্ছেদের সপক্ষে যুক্তি দেয় না। এই জাতীয় ঘটনা আমাদের মনে করায় যে, ছোট্ট শিশুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ক্রন্দসি কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত আবেদন আর কিছুই নয়, নিষ্ঠুরতার কৈফিয়ৎ মাত্র। শিশুর স্বার্থ রক্ষায় বিবাদের সংযুক্তির পুরো প্রশ্নটিকে কুসংস্কার ব্যতিত চিন্তা করতে হবে এবং ভাবতে হবে যে, প্রাপ্তব্য উত্তরটি প্রথম থেকে অনিবার্য থাকে না। এই অবস্থায় সংক্ষেপে কয়েকটি শব্দ উচ্চারিত হতে পারে।

পরিবার হলো প্রাক-মানবিক সংস্থা যার জৈবিক যৌক্তিকতা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে গভাবস্থায় শৈশবকালে পিতার সাহায্যের মধ্যে। কিন্তু ট্রাবিয়ান্ট দ্বীপপুঞ্জবাসীদের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, অ্যানফ্রোফয়েড বালকদের ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে, প্রাথমিক পরিস্থিতিতে এই ঘটনাকে সুসভ্য গোষ্ঠীর মধ্যে গ্রহণযোগ্য ভূমিকায় উপস্থাপিত করা হয় নি। আদিম পিতা জানত না যে, সন্তানের সঙ্গে তার কোনো জৈবিক সম্পর্ক আছে। শিশু হলো তার ভালোবাসার নারীর সন্তান। এই সত্যটি সে জানত কেননা সে শিশুটিকে জন্মাতে দেখেছে এবং এই জ্ঞানই সন্তানের প্রতি সহজাত বন্ধন গড়ে তুলতো। এই অবস্থায় সে তার স্ত্রীর পবিত্রতা রক্ষার অন্তরালে কোনো জৈবিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। স্ত্রীর চরিত্র সংক্রান্ত সংবাদ তার কাছে দুঃখজনক মনে হতে পারে। শিশুর প্রতিনিজস্ব অধিকারের সম্যক ধারণা তার ছিল না। সে ভাবতো শিশুর সঙ্গে তার সম্পর্কের ভিত্তি শুধুমাত্র স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ আছে।

বুদ্ধিমত্তার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ক্রমশ জ্ঞানবৃক্ষের সু ও কু ফলগুলি ভক্ষণ করতে শুরু করল। সে অবগত হলো যে, সন্তান তার বীজ থেকে জন্মায় এবং সেই কারণে স্ত্রীর পবিত্রতা সম্পর্কে কঠোর হতে হবে। স্ত্রী ও সন্তান তার সম্পদরূপে বিবেচিত হলো এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নির্দিষ্ট সীমা অবধি এ দুটিকে মূল্যবান সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত করা হত। স্ত্রী-পুত্রের মনে তার প্রতি কর্তব্যবোধ আনার জন্যে সে ধর্মের অবতারণা করল।

শিশুদের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটির গুরুত্ব উপলদ্ধি করা যায়। কেননা শৈশবকালে সে তাদের চেয়ে শক্তিশালী হলেও এমন একদিন আসবে যখন সে হবে অশক্ত ও সন্তানরা পৌরুষের বীর্যে অবস্থান করবে। এই অবস্থায় তার আনন্দকল্পে সন্তানদের সশ্রদ্ধা আনুগত্য অপরিহার্য।

এ ব্যাপারে শাস্ত্রীয় উপদেশে চাতুরীপূর্ণ বাক্যরাজির সমন্বয় দেখা যায়। সেখানে লেখা উচিত ছিল–যাতে তারা ভূপৃষ্ঠে আরো বেশিদিন অতিবাহিত করতে পারেন, সেই কারণে তোমরা তোমাদের পিতা-মাতাকে সম্মান করবে।

আদিম সভ্যতার প্রাপ্তব্য পিতামাতার হত্যার বীভৎসতা যে কি মারাত্মক হতে পারে তা উপলব্ধি করে সেই প্রথাকে অতিক্রমকরার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে। কেননা যে সমস্ত অপরাধ আমরা নিজেরা করতে পারি না যেমন, মানুষের মাংস ভক্ষণ, পারে না সেগুলি আমাদের প্রকৃত আতঙ্কে আতঙ্কিত করতে।

আদিম গ্রাম্য ও কৃষিজীবী গোষ্ঠীগুলির অর্থনৈতিক অবস্থাবলি পরিবারকে তার সর্বোচ্চ উপযোগিতায় পর্যবসিত করেছিল। অধিকাংশ মানুষকে ক্রীতদাস অথবা শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হত। এবং সেই শ্রমিক সংগ্রহের সর্বাপেক্ষা সহজ পন্থা ছিল জন্ম দ্বারা তাদের উৎপাদন করা। যাতে তারা তাদের পিতার জন্যে কাজ করে, সেই কারণে বিবাহ ব্যবস্থাকে ধর্ম ও নৈতিকতার আবরণে পবিত্র করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে জ্যেষ্ঠের উত্তরাধিকার বিধি পারিবারিক ঐক্যকে পার্শ্ববতী শাখা প্রশাখায় বিস্তার করে এবং পারিবারিক প্রধানের অধিকারকে বর্ধিত করে। রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র এই ধরনের মনোভাবের ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু জিউসকে দেব-দেবী ও মনুষ্য জাতির পিতারূপে পরিগণিত করা হয়, তাই বলা যায়, সে স্বকীয়তার মধ্যে এই একই বোধ ক্রিয়াশীল ছিল।

এই অবস্থা অবধি সভ্যতার বিস্তৃতি পারিবারিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে কিন্তু এর পরের সময় থেকে বিপরীতমুখি আন্দোলন শুরু হয়। যার ফলে পশ্চিমা দেশের পরিবার পরিণত হয়েছে অতীতের ছায়ায়। যে সমস্ত কারণে পারিবারিক ধ্বংস শুরু হয় সেগুলি অংশত অর্থনৈতিক এবং অংশত সাংস্কৃতিক। সর্বোত্তম উন্নতির সময় পরিবারকে শাহরিক জনসমষ্টি অথবা সমুদ্র ভ্রমনকারী মানুষের কাছে যথেষ্ট সুপ্রযুক্ত বলে মনে হয় নি।

আমাদের সময় ছাড়া অন্যান্য সকল সময় বাণিজ্যকে সংস্কৃতির প্রধান কারণ রূপে বিবেচনা করা হয়েছে। কেননা এই প্রথা মানুষকে অজ্ঞাত প্রথার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে এবং এভাবে সে উপজাতিকে কুসংস্কার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। তাই আমরা দেখি যে, সমুদ্র ভ্রমণকারী গ্রিকদের পরিবারে তাদের সমকালীনদের অপেক্ষা কম মাত্রায় পারিবারিক ক্রীতদাস প্রথা প্রচলিত ছিল।

সমুদ্রের আলোক প্রদানকারী প্রভাবের অন্যান্য উদাহরণ সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। এখানে একটি কথা বলতে হবে যে, পরিবারের একজন যদি সুদীর্ঘকাল সমুদ্রে ভ্রমণ করে এবং অন্যেরা গৃহে বাস করে তখন সমুদ্র ভ্রমণকারী নিজেকে অনিবার্যভাবে পরিবারে বসবাসকারী অন্যান্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে। এইভাবে সে নিজেকে তার পারিবারিক অধিকার থেকে মুক্ত করে। এর ফলে পরিবারটি আনুপাতিক হারে দুর্বল হয়ে যায়।

যেখানে নিম্নতর সামাজিক অবস্থিতি সংশ্লিষ্ট আছে সেখানে ক্রীতদাস প্রথা হলো আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। ক্রীতদাসরা পারিবারিক কর্তার প্রতি সামান্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন করত। পারিবারিক প্রধান তার ইচ্ছানুসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারত এবং যেকোনো ক্রীতদাসীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারত। একথা সত্যি যে, সমস্ত প্রভাব অভিজাত পরিবারকে দূর্বল করে নি। কেননা সম্মানের আকাঙ্ক্ষায় ও প্রাচীন শহুরে জীবনে প্রতিফলিত শেষ মধ্যযুগে ইতালির জীবনযাত্রায় ধ্বনিত এবং নবজাগরণে অনুভূত মনটেও ক্যাপুলেট ব্যবস্থার সফলতার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।

রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম শতাব্দীতে অভিজাত প্রথা তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে এবং খ্রিস্টানধর্ম ক্রীতদাস ও সর্বহারাদের ধর্ম হিসেবে প্রথম প্রতিষ্ঠা পায়। সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের মধ্যে পরিবার যে দূর্বল হয়ে থাকে তার অন্তরালে একটি কারণ ছিল প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টানত্ব ঐ ব্যবস্থার প্রতি কিছু পরিমাণে শত্রুতা পোষণ করে এবং বৌদ্ধধর্ম ব্যতিরেকে, পূর্বোক্ত নীতিকথায় অপ্রযুক্ত নীতিবাদের উদ্ভাবন করে। যেখানে পরিবারের অবস্থিতি অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ হবে। খ্রিস্টানত্বের নীতিকথায় ঈশ্বরে সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক হলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মানুষে মানুষে সম্পর্ককে কর্তব্যের মধ্যে আনা হয় নি।

ধর্মের অর্থনৈতিক উদ্ভাবনের বিরুদ্ধে প্রথম ও প্রধান প্রতিবাদীরূপে বৌদ্ধধর্ম চিহ্নিত হয়ে আছে। ভারতবর্ষে এই ধর্মটি বহুল প্রচারিত হয়। একক আত্মার অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পর্কে এই ধর্ম যথেষ্ট আলোচনা করেছে।

যতদিন অবধি ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয় ততদিন প্রাথমিকভাবে এটি ছিল মহারাজাদের ধর্ম। এবং অনুমান করা কঠিন নয় যে, পরিবার সংক্রান্ত ভাবাদর্শগুলি তাদের ক্ষেত্রে যত বেশি প্রযুক্ত ততখানি আর কোনো শ্রেণির পক্ষে প্রযুক্ত হতে পারে না। যাই হোক পৃথিবীকে তুচ্ছজ্ঞান করা ও মোক্ষের অন্বেষণ–এ দুটি ছিল সাধারণ ঘটনা। যার ফলে বৌদ্ধিক নীতিবাদে পরিবারকে স্থান দেওয়া হয়েছে।

মহাত্মা কনফুসিয়াস (যদি তাঁকে ধার্মিক বলার অনুমিত দেওয়া হয়) ভিন্ন অন্য সব ধার্মিক নেতারা সাধারণভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন। তারা আত্মশুদ্ধির উপায় হিসেবে একাগ্রতা, ধ্যান ও আত্ম অস্বীকৃতিকে অনুমোদন করেন। যে সমস্ত ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে ঐতিহাসিক কালে তাদের সঙ্গে সেই সমস্ত ধর্মের বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান। যাদের অস্তিত্ব ছিল ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জি শুরু হবার সময়।

সমগ্রভাবে বিচার করলে বলা যায় যে, প্রতিটি ধর্মই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতাবাদী এবং বিশ্বাস করে যে, একজন মানুষ নির্জনতার মধ্যে তার সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে পারে। তারা অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন, যদি কোনো মানুষের সামাজিক সম্পর্ক থাকে এতে তারা অবশ্যই সেইসব সম্পর্কজনিত কর্তব্যগুলি সম্পর্কে অবহিত হয় না। কিন্তু সে নির্দ্বিধায় স্বীয় দায়িত্ব গ্রহণ করবে না।

এই কথাটি খ্রিস্টান সম্পর্কে বিশেষভাবে প্রযুক্ত। কেননা এক্ষেত্রে ধর্ম পরিবার সম্পর্কে গোঁড়া মতবাদকে খন্ডন করেছে। ধর্মকথা পাঠ করে আমরা জেনেছি, যে ব্যক্তি আমার চেয়ে বেশি উদার সেই ব্যক্তি দ্বারা আমার কোনো কার্যসাধন হতে পারে না। প্রথাগত অর্থে এর কারণ হলো একজন মানুষ যা ভাববে তাই করবে। এমন কি যদি তার পিতামাতা সেটিকে অসৎ বলে মনে করে তা সত্ত্বেও। এ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একজন প্রাচীন রোমান অথবা পুরোনো দিনের চীনা কখনই একমত হতে পারবেন না।

খ্রিস্টানত্বের এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার উপাদানটি মন্দাক্রান্তাভাবে কাজ করেছে। কিন্তু এটি ধীরে ধীরে সমস্ত সামাজিক সম্পর্ককে দুর্বল করে তুলেছে। বিশেষ করে যাদের মধ্যে ঐ সম্পর্ক ছিল বেশি মাত্রায় অনুভূত।

প্রোটেস্টান্টবাদে এর প্রভাব যতখানি পড়েছে ক্যাথলিকবাদে ততখানি পড়ে নি। কেননা প্রোটেস্টান্ট মতাদর্শ বিশ্বাস করে আমরা মানুষের কর্তৃত্বকে খর্ব করার জন্য ভগবানকে সম্মান করব।

ভগবানকে মেনে চলার বাস্তব অর্থ হলো নিজের চেতনাকে মেনে চলা। বিভিন্ন মানুষের চেতনার মধ্যে পার্থক্য আছে। এই কারণে চেতনার সঙ্গে আইনের প্রায়শই বিরোধ দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত খ্রিস্টান সেই মানুষকে সম্মান করবে যে আইনের অনুশাসন অপেক্ষা নিজের বিবেককে অধিক গুরুত্ব দেয়। প্রাচীন সভ্যতায় পিতাকে ঈশ্বর রূপে প্রতিপন্ন করা হত। খ্রিস্টান ধর্মে ঈশ্বরই হলো সর্বশক্তিমান। তাই সাধারণ পরিবারে বাবা-মার স্থান দুর্বল হয়ে যায়।

আধুনিক কালে পরিবারিক প্রথার যে ধ্বংস ঘটে গেছে, তার প্রধান কারণ হিসেবে শিল্পবিপ্লবকে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হবার আগেই এই পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়েছিল এবং একে অনুপ্রাণিত করেছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্রমূলক তথ্য, নিজেদের ইচ্ছানুসারে বিবাহ করার মতাদর্শে বিশ্বাস করল তরুণ সমাজ। তারা পিতা-মাতার উপদেশ অনুযায়ী বিবাহ করবে না। পিতৃগৃহে বিবাহিত পুত্রের অবস্থিতি শেষ হলো। শিক্ষা সমাপ্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা গৃহত্যাগ করে জীবিকা অর্জনের কাজে আত্মনিয়োগ করবে এটাই হলো সামাজিক নিয়ম।

যতক্ষণ পর্যন্ত অতিরিক্ত পরিশ্রমে মৃত্যু না হচ্ছে ততক্ষণ কারখানায় কর্মরত শিশুরা তাদের পিতা-মাতার জীবিকা অর্জনের উৎসরূপে বিবেচিত হলো। কিন্তু কারখানা সংক্রান্ত আইন শোষণের এই ধারাটিকে সমাপ্ত করে দেয়। যদিও এই ধারায় উপকৃত মানুষেরা এর বিরোধিতা করে। জীবিকা অর্জনের উপায়রূপে অবস্থিত শিশুর দল পরিণত হলো আর্থিক অভাবে। এই অবস্থায় গর্ভনিরোধক ঔষধের কথা জানা যায় এবং জন্মহার কমতে থাকে। এইকথার উপর গুরুত্ব দেওয়ার অর্থ হলো সর্বযুগের সাধারণ পুরুষ তার পক্ষে গ্রহণযোগ্য শিশুর উৎপাদন করেছে। বেশি অথবা কম করে নি।

অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীর মধ্যে, ল্যাংকাসায়ারের তুলা উৎপাদনকারীদের মধ্যে অথবা বৃটিশদের মধ্যে এই ঘটনাটির সত্যতা স্বীকৃত। আমি মনে করি না যে, এই মতাদর্শকে তাত্ত্বিক সূক্ষ্মতা দ্বারা বজায় রাখা যাবে। কিন্তু একজনের পক্ষে কাল্পনিক কোনো সত্যের ওপর এটি প্রতিষ্ঠিত নয়। আধুনিক যুগে পরিবারকে তার সর্বশেষ অবস্থিতি থেকে বিচ্যুত করেছে রাষ্ট্রিক কর্মধারা। পরিবারের গঠন বৈশিষ্ট্যের সুবৰ্ণ দিনগুলিতে বহু মানুষের অবস্থিতি পরিবারকে ঐতিহ্যমন্ডিত ও স্থিতিস্থাপক করে তুলত। জীবনবোধ সম্পর্কে বিচিত্র অভিজ্ঞতা দ্বারা সঞ্চিত কর্তৃত্বকে কর্তব্যের বেড়াজালে আবদ্ধ রেখে পারিবারিক কর্তা শিশুদের লালন পালন করতেন। সকলেই একই গৃহে বাস করত, একই অর্থনৈতিক ক্রিয়াশীলতায় নিজেদের নিয়োজিত করতে এবং এই নৈতিক সত্তা হিসেবে পারস্পরিক সহযোগিতা করত এবং কোনো আধুনিক দেশের নাগরিকদের মতো বর্হিবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাস করত।

আধুনিক যুগে পরিবার গঠিত হয় পিতামাতা ও তাদের কমবয়েসি সন্তানকে নিয়ে। কেননা রাষ্ট্রের প্রভাবে শিশুরা তাদের অধিকাংশ সময় কাটায় বিদ্যালয়ে। এবং রাষ্ট্র যে সমস্ত বক্তব্যকে সৎ হিসেবে গণ্য করে সেগুলি তাদের শেখানো হয়। এ ব্যাপারে বাবা-মায়ের ইচ্ছার কোনো দাম নেই। অবশ্য এক্ষেত্রে ধর্ম হলো এক আংশিক ব্যতিক্রম।

.

রোমান পিতার হাতে শিশুর জীবন ও মৃত্যুর অধিকার ন্যস্ত ছিল কিন্তু, বৃটিশ পিতাকে নিষ্ঠুরতা অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় যদি সে তার শিশুর সঙ্গে এমন ব্যবহার করে থাকে। শিশুকে একশ বছর আগের অধিকাংশ বাবারা নৈতিক উন্নয়নের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে চিন্তা করত।

রাষ্ট্র চিকিৎসা সংক্রান্ত দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং পিতামাতা যদি দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত হয় তাহলে সন্তানকে খাদ্য দান করে। যেহেতু পিতার অধিকাংশ দায়িত্ব এখন রাষ্ট্র গ্রহণ করেছে তাই পিতার কর্তব্য ন্যূনতম সীমায় আবদ্ধ হয়েছে। সভ্যতার ক্রমোন্নতির সঙ্গে এটি অনিবার্যভাবে ঘটবে। প্রাথমিক অবস্থায় পিতার উপযোগিতা ছিল অনস্বীকার্য। কেনা পক্ষিকুল আর অ্যামফ্রোপয়েড বানরদের মতো তারা অর্থনৈতিক কারণে সংযুক্ত ছিল এবং শিশু ও তার মাকে হিংসার হাত থেকে রক্ষা করত। রাষ্ট্র বহু পূর্বে শেষোক্ত কার্যধারাটি গ্রহণ করেছে।

যে শিশুর বাবা নেই তাকে আর হত্যা করতে পারবে না সেই শিশুটি যার পিতা আছে। বিত্তশালী পরিবারে পিতার অর্থনৈতিক কর্তব্য তার জীবিতকালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। পিতার মৃত্যুর পরবর্তীকালে এটি ক্রিয়াশীল থেকে যায়। সে ক্ষেত্রে পিতা তার উপার্জিত অর্থের সমগ্র অংশ নিজের জন্য ব্যয়িত করে না। এর এক অংশ শিশুর জন্য রেখে যায়। যারা এখনও অর্জিত অর্থের ওপর নির্ভর করে তাদের কাছে পিতার অর্থনৈতিক উপযোগিতা কমে যায় নি। কিন্তু যেখানে শ্রমিকদের প্রশ্ন জড়িত আছে সেখানে এই জাতীয় উপযোগিতাকে ধারাবাহিকভাবে হ্রাস করছে গোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত মানবিক আবেগ।

ঐ আবেগ ও অনুভূতি ঘোষণা করেছে যে, প্রতিটি শিশু কিছু পরিমাণ স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করবেই। এমন কি অর্থ দেবার জন্যে কোনো পিতা না থাকলেও মধ্যবিত্ত সমাজে পিতার গুরুত্ব আছে যদি সে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতে পারে এবং খরচ সাপেক্ষ পদ্ধতি দ্বারা তার সন্তানদের সেইসব সুবিধা দিতে পারে যার সাহায্যে তারা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু যদি শিশুদের শৈশব অবস্থায় পিতার মৃত্যু হয় তাহলে ওরা যে সামাজিক মূল্যায়নের মধ্যে পতিত হবে তার যথেষ্ট কারণ আছে। জীবন বীমা এই ধরনের ঘটনাবলির মতো স্বাধীনতাহীন ব্যাপার অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে যার সাহায্যে সাধারণ শ্রেণিভুক্ত সুবিবেচক পিতা তার নিজস্ব উপযোগিতা কমানোর জন্যে যথেষ্ট করতে পারে।

বর্তমান পৃথিবীতে পিতাদের গরিষ্ঠ সংখ্যা তাদের নিজস্ব সন্তানদের জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করে। সকালে তারা কাজে যাবার আগে সংলাপের জন্যে যথেষ্ট সময় ব্যয় করে। সন্ধ্যাবেলা যখন তারা বাড়ি ফেরে তখন সন্তানরা নিদ্রিত হয়ে পড়ে। একজন এমন শিশুর নিরাপত্তার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব গ্রহিতার কর্তব্যবোধের সহজাত অনুকম্পার আকস্মিক প্রবেশ ঘটে এবং শিশুর প্রতি স্বতঃউৎসারিত কর্তব্যকে ভাগ করে নেয় তার মা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। তবে একথা সত্যি যে; বাবা তার সন্তানদের সঙ্গে যত কম সময়ই কাটান না কেন তাদের প্রতি হৃদয়ে থাকে তীব্র স্নেহবোধ।

লন্ডনের যেকোনো দরিদ্রতম অঞ্চলে, যেকোনো রবিবার দেখা যাবে যে, বিরাট সংখ্যক বাবারা তাদের ছোট ছেলেদের সঙ্গে চলেছে। তারা নিশ্চয়ই ছেলেদের সঙ্গে পরিচিত হবার সংক্ষিপ্ত সময়ের সদ্ব্যবহার করছে। কিন্তু পিতাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই ঘটনার ওপর যতই গুরুত্ব আরোপ করা হোক না কেন শিশুদের কাছে এটা খেলা মাত্র, কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই নয়। উচ্চবিত্ত এবং ব্যবহারিক সমাজে শিশুদের ধাত্রীদের হাতে সমর্পণ তারপর তাদের পাঠানো হয় আবাসিক বিদ্যালয়ে। মা নির্বাচন করে ধাত্রীকে এবং পিতা নির্বাচন করে বিদ্যালয় যাতে সন্তানদের ওপর তাদের পারস্পরিক কর্তৃত্ব বজায় থাকে। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে এর অনুমতি নেই।

যখন অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি আলোচনা করা হবে তখন নিয়ম হিসেবে মাতা-সন্তানদের সম্পর্কে বিচার করতে হবে। এ ব্যাপারে বিত্তশালী পরিবারের সঙ্গে শ্রমজীবী পরিবারের পার্থক্য আছে। ছুটির দিনে পিতা তার সন্তানদের সঙ্গে ক্রীড়ার সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিন্তু তারা প্রকৃত শিক্ষায় শ্রমজীবী বাবার চেয়ে বেশি অংশগ্রহণ করতে পারে না। অবশ্য অর্থনৈতিক দায়িত্ব থাকে তার কাঁধে এবং কোথায় শিশুরা শিক্ষিত হবে সেই স্কুল নিরুপণের ব্যাপারটি তার অধীন। কিন্তু শিশুদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই আলোচনার শেষে আমরা স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পরি যে, পিতা-মাতার যৌথ উদ্যোগের ফলশ্রুতিতে শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে। এক্ষেত্রে শিশুর মানবিক বিকাশে তার পিতা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করে থাকে কিন্তু তার বুদ্ধির বিকাশে সেকোনো প্রভাব রাখতে পারে না।

যখন একটি শিশু কৈশোরে পদার্পণ করে তখন তার চিন্তা ও প্রক্ষোভের রাজ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়। কিন্তু সেই শিশুর মনে স্বতঃউৎসারিত প্রশ্নাবলির যথাযথ অনুধাবনে অক্ষম পিতামাতা তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে অসমর্থ হয়।

এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা বর্তমান পরিবার প্রথার খারাপ দিকগুলির ওপর আলোকপাত করেছি, এখন আমরা এর ভালো দিকগুলি অনুধাবনের চেষ্টা করবো।

বর্তমান যুগেও যে পরিবার প্রথা টিকে আছে তার প্রধান কারণ হলো সন্তান সন্ততিদের প্রতি উৎসারিত আবেগ উচ্ছ্বাস। এখনও পর্যন্ত পিতামাতার হৃদয়ে জাগরিত হয় সেই ভালোবাসা যা পরিবার প্রথাকে সৎ, সুন্দর ও শোভন করেছে। অবশ্য জীবনবীমার অনুপ্রবেশে পিতার কর্তব্যবোধের নৈতিকতার অবমূল্যায়ন সুচিত হয়। কেননা জীবনবীমা মনস্তাত্ত্বিকভাবে শিশুকে দিয়েছে চিরকালীন নিরাপত্তাবোধ। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়টিও সংযোজিত হয়েছে। কারণ সম্পত্তির প্রতি আকাঙ্ক্ষা হলো পিতৃত্বসুলভ মানসিকতার স্বয়ংক্রিয় ও মনস্তাত্ত্বিক বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই প্রসঙ্গে রিভার্স মন্তব্য করেছেন যে, যে কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি হলো পরিবারবোধের পরিচায়ক। তিনি এমন কিছু পাখির কথা উল্লেখ করেছেন যা মিলন ঋতুতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অন্বেষণ করে কিন্তু অন্য সময়ে এ ব্যাপারে বিস্মৃত হয়। মানুষের ক্ষেত্রেও এটি সমভাবে প্রযোজ্য। কারণ সন্তানের জন্মের পরই পিতার হৃদয়ে সম্পত্তির আকাঙ্ক্ষা অধিকতর দৃঢ় হয়। এর অন্তরালে আছে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ যার উৎস স্বতোৎসারিত অবচেতন মানসিকতার ফলশ্রুতি মাত্র। মানবজাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরালে পরিবার অপরিমাপ্য গুরুত্ব অর্জন করেছে। বিশেষ করে যে সমস্ত মানুষ যথেষ্ট উন্নত তাদের অর্থ সংকোচন মনোবৃত্তির অন্তরালে পরিবারের গুরুত্ব প্রশংসনীয়।

এই বিষয়ে পিতা ও সন্তানের মধ্যে এক কৌতূহলোউদ্দীপক ভুল বোঝাবুঝির অবতারণা হতে পারে। যে মানুষ অতি পরিশ্রমী সে তার অলস সন্তানকে বলে থাকে যে, শুধুমাত্র সন্তানের উন্নতিকল্পে সে সারাজীবন ক্রীতদাসের মতো পরিশ্রম করেছে। অপরপক্ষে পিতার মৃত্যুর পর সেই সন্তান লাভ করে সৌভাগ্যের দীপশিখা যার মধ্যে সহানুভূতির অবশেষ নেই। তার দৃষ্টিতে পিতা হলো ব্যক্তিত্বহীন অতিকথন দোষে দুষ্ট এক মানুষ, আবার পিতার চোখে সন্তান নষ্টামির প্রতিমূর্তি মাত্র।

এ ক্ষেত্রে সন্তানের চিন্তায় ত্রুটির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কেননা সে তার পিতাকে দেখেছে মধ্যজীবনে। সে কোনোভাবেই অনুধাবন করতে পারবে না যে, কি ধরনের কঠিন অবচেতন শক্তি দ্বারা তাড়িত হয়ে পিতা তার ইচ্ছাকে গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে। পিতা হয়তো যৌবন অতিবাহিত করেছে দারিদ্র্যের কষাঘাতে তাই প্রথম সন্তানের জন্মমুহূর্তে সে এই প্রতিজ্ঞা করেছে যে, ভবিষ্যতে তার কোনো সন্তান যেন দারিদ্র্যের অভিশাপে অভিশপ্ত না হয়। এই ধরনের দৃঢ় মনোবৃত্তি হলো এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং এর দ্বারাই পিতার ভবিষ্যৎ জীবন প্রভাবিত হয়েছে। এই কারণে পরিবার আজও এক অত্যন্ত শক্তিশালী সত্তারূপে পরিবর্তিত পরিবেশের মধ্যে বিরাজমান।

ছোট শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্নেহই একমাত্র আরাধ্য প্রক্ষোভ, কেননা পিতামাতা ছাড়া সে একমাত্র ভাইবোনদের কাছ থেকে এই স্নেহ দাবি করতে পারে। এই চাহিদার দুটি দিক আছে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা শিশুর মনোবিকাশে পরিবারের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করব। বর্তমানে এ সম্পর্কে আমি অধিক কথনে বিরত থাকছি। শুধু এই কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, শিশুর চরিত্র গঠনে স্নেহের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা বিদ্যমান। যে শিশু পারিবারিক স্নেহলোভে বঞ্চিত হয়ে বড় হয় সে সাধারণ শিশুর চেয়ে অন্যভাবে গড়ে ওঠে। ভিজাত সমাজে, কিংবা যে সমাজ ব্যক্তিগত ঔজ্জ্বল্যের অবস্থিতিকে তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি দিয়েছে সেই সমাজে বিশিষ্ট ব্যক্তিসত্তার বিকাশশীলতার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার অন্তরালে পরিবারের গুরুত্বকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।

পর্যবেক্ষণ দ্বারা এই সত্যে উপনীত হওয়া গেছে যে, যে মানুষের পদবি ডারউইন তিনি বিজ্ঞানে অধিকতর পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। যদি শৈশবে তাঁর পদবি পরিবর্তন করা হতো তাহলে তিনি হয়তো বিজ্ঞান বিষয়ে এতখানি কৃতিত্ব অর্জনে অসমর্থ হতেন।

আমি এই ধারণা পোষণ করি যে, যদি শিশুরা পিতার পরিবর্তে মাতার প্রাকবৈবাহিক পদবি দ্বারা পরিচিত হতো তাহলেও তারা একইভাবে বেড়ে উঠতো। এক্ষেত্রে বংশানুক্রমিকতা ও পারিপার্শ্বিকতার পারস্পরিক গুরুত্বের বিচার এক অসম্ভব কাজ। এই প্রসঙ্গে হয়তো কেউ কেউ স্যামুয়েল বাটলার কর্তৃক উদ্ভাবিত অবচেতন স্মৃতির অন্তরালে লুকিয়ে থাকা পারিবারিক ঐতিহ্যের গুরুত্বের অবতারণা করবেন এবং বংশানুক্রমিকতা সম্পর্কিত নব্যলামার্কীয় তত্ত্বের সূচনা করবেন না। এক্ষেত্রে তিনি হয়তো চার্লস ডারউইনের মতবাদের সঙ্গে একমত হবেন না। কেননা বংশানুক্রমিকভাবে তিনি ডারইউনের তত্ত্বাবলির প্রতি অতি অবিশ্বাস পোষণ করে এসেছেন।

গর্ভনিরোধকের ব্যাপক ব্যবহার সমৃদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে পরিবার যে এখনও বিদ্যমান আছে তার প্রধান কারণ হলো মানুষের মনের মধ্যে সুপ্ত সন্তান উৎপাদনের ইচ্ছা। যদি মানুষ সন্তানকে তার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত না। করতো এবং যদি সন্তানের সঙ্গে তার স্নেহময় সম্পর্কের উপস্থাপনা না হতো, তাহলে সে কখনই সন্তান উৎপাদনে ব্রতি হতো না। হয়তো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপস্থাপনার ফলে অদ্ভুত অর্থনৈতিক সংস্থানসমূহের সক্রিয় ভূমিকার ফলে আগামী দিনের পরিবার শুধুমাত্র মাতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে কিন্তু বর্তমানে আমি এ জাতীয় পরিবারের কথা চিন্তা করছি না। এ রকম এ পরিবার যৌন-পবিত্রতার আধার নয়। এর অন্তরালে দৃঢ় বিবাহ ব্যবস্থার ভূমিকা নেই।

তাই একথা মনে করা অর্থহীন যে, আগামী প্রজন্মের কাছে পিতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা একই রকম থাকবে, কেননা বিত্তশালী ছাড়া অন্যান্যদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র পিতার ভূমিকা অর্জন করবে। এক্ষেত্রে আমরা মনে করছি যে, সমাজতন্ত্র দ্বারা ধন্যবাদের সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটবে না। সেই ক্ষেত্রে রমণি রাষ্ট্রের সঙ্গে সন্তানকে একীভূত করবে, কোনো একক পিতার কোনো প্রয়োজন হবে না। সন্তানের সংখ্যা হবে তার ইচ্ছাধীন এবং এক্ষেত্রে পিতার কোনো দায়িত্ববোধ থাকবে না। এমনকি যদি মাতারা অধিকতর মাত্রায় স্বেচ্ছাচারিণী হয়ে যায় তাহলে পিতৃত্ব নিরুপণের বিষয়টিই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। যদি সত্যি সত্যিই এই ঘটনা ঘটে তাহলে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ও কার্যধারার জগতে ঘটে যাবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কিন্তু তা ভালো বা মন্দ কোনটি হবে সে বিষয়ে এখন থেকে বলা সম্ভব নয়। তবে এ মন্তব্য করা যেতে পারে যে, মানুষ তার জীবন থেকে যৌন ভালোবাসার গুরুত্বকে সম্পূর্ণভাবে অপসৃত করবে। এমনকি মৃত্যুর পরে আর কোনো আকাঙ্ক্ষার জন্ম হবে না।

এই ঘটনা মানুষকে অধিকতর মাত্রায় কর্মবিমুখ করে তুলবে এবং কর্ম জগৎ থেকে তার অবসরের সময় হবে দ্রুত। মানুষ ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতি ঔৎসুক্য হারাবে, ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার চেতনা হবে অবলুপ্ত। বিপরীত ক্রমে এই ঘটনা মানুষের মন থেকে সেই ভয়ংকর জান্তব বোধের অবলুপ্তি ঘটাবে যা তাকে উদ্দীপ্ত করে বাইরের পৃথিবীর আক্রমণ থেকে স্ত্রী ও সন্তানকে রক্ষা করতে। মানুষ হবে যুদ্ধের পরিপন্থী এবং সম্পত্তিলাভে অনিচ্ছুক। যদিও আমরা ভালোমন্দের নিয়ন্ত্রিত সীমানা নির্ধারণে সফল হতে পারি না, তবুও একথা মানতেই হবে যে, বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গিতে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথার গুরুত্ব রয়ে গেছে; যদিও আর কতদিন তা থাকবে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *