১০. গণিকাবৃত্তি

১০. গণিকাবৃত্তি

 যতদিন অবধি সম্মানীয়া রমণিয়া রমণিদের চারিত্রিক পবিত্রতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত করা হবে, ততদিন বিবাহ প্রথাকে আরেকটি অভাবপূরক প্রথা দ্বারা পরিচালিত করা উচিত। প্রকৃত অর্থে যাকে বিবাহের এক অংশ বলা যায়, আমি সেই গণিকাপ্রথার কথা বলতে চাই। সকলেই হয়তো উলফের লেখনির কথা জানে, উনি গৃহের পবিত্রতা এবং আমাদের স্ত্রী-কন্যাদের শারীরিক শুচিতার প্রতিষেধক হিসেবে গণিকাবৃত্তির স্বপক্ষে যুক্তির অবতারণা করেছেন।

এই আবেগ হলো ভিক্টোরিয়ান যুগের। প্রকাশভঙ্গি সুপ্রাচীন কালের, কিন্তু সত্যটিকে অস্বীকার করা যাবে না। নৈতিকতাবাদীরা উলফকে নিন্দা করেছেন, কেননা তার মন্তব্য তাদের ক্ষুব্ধ করেছে, যদিও সেই ক্রোধের কারণ তারা জানেন না। এবং তারা এখনো উলফের মন্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণে সফল হয় নি।

নৈতিকতাবদীরা সঙ্গত কারণেই এই সিদ্ধান্ত পোষণ করে যে, যদি পুরুষরা উলফের মন্তব্যকে অনুসরণ করে তাহলে গণিকাপ্রথার অবলুপ্তি ঘটবে। কিন্তু উফল নিজেই জানতেন পুরুষরা তা করবে না। কাজেই সম্ভাব্য পরিণতির বিষয়টি অম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।

অনেক পুরুষ অবিবাহিত থাকে অথবা ভ্রমনের সময় তাদের স্ত্রীদের সান্নিধ্য পায় না। এই সকল ঘটনা থেকে গণিকাবৃত্তির উদ্ভব। ঐ জাতীয় পুরুষ সংযমের মধ্যে প্রহর অতিবাহিত করতে সক্ষম হয় এবং যেহেতু তারা ঐতিহ্যগতভাবে সম্মানিত গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত, সেই কারণে সম্মানিয়া মহিলাদের ব্যবহারযোগ্য করতে পারেন না।

ঐ পুরুষদের দৈহিক চাহিদা পূরণের জন্য সমাজ একশ্রেণির মহিলাকে পৃথক করে রেখেছে যাদের অনুভূতি লজ্জাজনকভাবে সম্পূর্ণ অতৃপ্তির মধ্যে রক্ষিত হলে ভীতিসঞ্চালক হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে গণিকাদের যথেষ্ট সুবিধা আছে, এক মুহূর্তের প্রয়োজনে সে সাড়া দিতে পারে, জীবিকার বাইরে কোনো জীবন না থাকায় সে সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারে। এবং যে পুরুষ তার সঙ্গ লাভ করেছিল সে আবার নিজের স্ত্রী পরিবার ও ধর্মের কাছে ফিরে আসে সুমহান সম্মান নিয়ে।

একজন গণিকা সম্ভবত গরিব মেয়ে এবং যে স্বীকৃত সেবা করে, স্ত্রী-কন্যাদের পবিত্রতা রক্ষাকল্পে যে ত্যাগ সে স্বীকার করে, ধর্মতাত্ত্বিকদের কাল্পনিক পূণ্য রক্ষার জন্যে সে জীবন বিসর্জন দেয়, তথাপি তাকে সার্বজনীনভাবে ঘৃণা করা হয়।

তাদেরকে সমাজচ্যুত হিসেবে মনে করা হয় এবং ব্যবসা ছাড়া তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারে না। খ্রিস্টধর্মের বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অমানবিক অবিচার শুরু হয়। এবং তখন থেকে এটি চলে আসছে। একজন গণিকার প্রকৃত অপরাধ হলো এই যে সে নৈতিক পেশার প্রতি শূন্যগর্ভ মনোভাব পোষণ করে।

ফ্রয়েডীয় নিয়ন্ত্রণ রক্ষার ভাবনাগুলি অনুসরণ করলে আমরা তাকে অবচেতনা থেকে উৎপাটিত করতে পারি।

তাই বলা যেতে পারে যে, ঐ নির্বাচনের মধ্যেও তার নির্বিকল্প ভাবতন্ময়তার প্রকাশ ঘটাতে পারে

মধ্যরাতের বনে ভ্রমণ করে আমি
শুনেছি যৌবনা গণিকার নাভিপদ্ম
 নবজাত শিশুর কান্না যখন বিস্ফোরণ
তখনই বেজেছে মিলনের বিচিত্র ঝঙ্কার।

আগে বারাঙ্গনা প্রথা আজকের মতো কলঙ্কিত ও গোপনীয় ছিল না। প্রথম যুগে এটি ছিল সুউচ্চ পদ্ধতি। প্রাথমিক যুগে গণিকারা দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিতা হয়ে পুরোহিতের ভূমিকা পালন করত এবং ভ্রাম্যমান অতিথির সেবায় দেবার্চনার অনুভূতি আস্বাদন করত। সে যুগে তার প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করা হত এবং পুরুষরা তাকে শ্রদ্ধা করত। খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা নানা বক্তব্যসহকারে এই পদ্ধতির বিরুদ্ধাচরণ করেছেন এবং তাঁরা প্রমাণ করেছেন, এই প্রথার উৎস হলো পৌত্তলিক উপাসনার মধ্যে এবং তা বিস্তৃত হয়েছে শয়তানদের মারাত্মক কল্পনা প্রবণতায়।

মন্দিরগুলি বন্ধ হয়ে যাবার পর গণিকাবৃত্তি লাভজনক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। অবশ্য গণিকাদের ব্যক্তিগত লাভ হত না কিন্তু লাভ হত সেই সব মানুষদের, তার যাদের ক্রীতদাসী করে রেখেছিল। কিছুদিন আগে অবধি একক গণিকাপ্রথা প্রচলিত হয় নি অথচ বর্তমানে এই ব্যবস্থাই দেখা যায়। সেযুগে তারা দলবদ্ধভাবে গণিকালয়, স্নানাগার অথবা কুখ্যাত পল্লীতে সববাস করত।

ধার্মিক গণিকাবৃত্তি থেকে ব্যবসায়িক বারাঙ্গণা প্রথায় রূপান্তরের পদ্ধতিটি ভারতবর্ষে এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। মাদার ইন্ডিয়া গ্রন্থের লেখিকা ক্যাথারিন মেয়ো (Katherine Mayo) দেখিয়েছেন যে, ভারতে এখনো ধার্মিক গণিকাবৃত্তি রয়ে গেছে এবং এই কারণে তিনি ঐ দেশের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন। দক্ষিণ আমেরিকা ভিন্ন অন্যত্র গণিকা প্রথা অবলুপ্তির পথে। অংশত জীবনযাত্রার পরিবর্তন এর জন্য দায়ী, কেননা আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে ব্যবহারযোগ্য মহিলাদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এবং অংশত এটি নির্ভর করছে এই সত্যের ওপর যে, অনেক বেশি সংখ্যক রমণিরা পুরুষদের সঙ্গে বহিঃবৈবাহিক সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী। সেই আকাক্ষার অন্তরালে আছে শুধুই আবেগ, ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি নেই।

অবশ্য আমি মনে করি না যে, গণিকাপ্রথাকে সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্ত করা সম্ভব হবে। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা পথে যেসব নাবিকেরা ঘর ছেড়েছে তারা যখন ভূখন্ডে উপনীত হয়, তাদের কাছ থেকে নিশ্চয় প্রেমসিক্ত অভিব্যক্তি আশা করা যায় না। চিন্তা করুন, বিপুল সংখ্যক সেই পুরুষদের কথা যারা বিবাহিত জীবনে অসুখি এবং স্ত্রীদের ভয় পায়। বাড়ির বাইরে যাবার সময় এই জাতীয় পুরুষেরা সহজপ্রাপ্য সাহচর্য ও অবসর অন্বেষণ করবে। সেই কারণে তারা মনোবাহ্যিক কর্তব্যেবোধ থেকে মুক্তি পেতে আগ্রহী।

তবে গণিকাবৃত্তিকে তার ন্যূনতম সীমানার মধ্যে সংরক্ষিত রাখার অন্তরালে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি আছে। এটিকে তিনটি কারণে নিন্দনীয় বলা যায়: প্রথমত, জাতির স্বাস্থ্য রক্ষার কথা ভাবতে হবে; দ্বিতীয়, নারীজাতির মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতির কথা চিন্তা করা .. উচিত; তৃতীয়ত, পুরুষ জাতির মনস্তাত্ত্বিক অবনতি সম্পর্কে ভাবতে হবে।

এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাপারটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানত গণিকাদের মাধ্যমে যৌনরোগ বিস্তৃত হয়। সম্পূর্ণ শুদ্ধ চিকিৎসা সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গণিকাদের নামাঙ্কিত করা এবং পর্যায় অনুসন্ধান করার কাজকে যথেষ্ট সফল হিসেবে গণ্য করা হয় নি। কেননা, এ ব্যাপারে রক্ষিবাহিনী ভুল তথ্য সংগ্রহ করে এবং এমন অনেক রমণি আছে যারা ব্যবসায়িক বারাঙ্গণা হওয়ার কোনো ইচ্ছা করে না, কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবে এই আইনগত সংজ্ঞার অন্তর্ভূক্ত হয়। অবশ্য আরও সতর্কভাবে যৌনরোগের সমস্যাটির মোকাবিলা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র পাপবোধের শাস্তি হিসেবে ভাবলে চলবে না।

অগ্রিম নিরাপত্তা গ্রহণ করে এই রোগের ভয়ঙ্করতাকে হ্রাস করতে হবে এবং সেই কারণে পাপবোধের ব্যাপারটিকে বাদ দেওয়াই উচিত। যাদের যৌনরোগ আছে তারা সামাজিক কলঙ্কের কথা চিন্তা করে চিকিৎসা কার্যে গাফিলতি করে। এই জাতীয় যেকোনো রোগকে আমাদের সমাজ সম্মানহানিকর ঘটনারূপে চিহ্নিত করেছে।

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, সমাজ এ সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত শ্রেয় মনোভাব পোষণ করে। এবং যদি সেই মনোবৃত্তির ক্রমোন্নয়ন সম্ভব হয়, তাহলে যৌনরোগকে নিয়ন্ত্রিত করা সহজ হবে। তবে একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, যতদিন গণিকাবৃত্তি প্রচলিত থাকবে, ততদিন এটি হবে যৌনরোগ বিস্তৃতির প্রধান উৎস।

বর্তমানে যে ধরনের গণিকাবৃত্তি প্রচলিত আছে তাকে জীবনের অনভিপ্রেত দিক হিসেব চিহ্নিত করা যায়। রোগের বিপদটি বারাঙ্গণা বৃত্তিকে রোগের মধ্যে কাজ করায় বিপদসূচক ব্যবসায় পরিণত করেছে। তাছাড়া আছে নৈতিকতার অধঃগমনের প্রশ্নটি। এই আসক্তি জীবণকে অলস ও মদ্য পিয়াসী করে দেয়।

সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হলো এই যে, গণিকাদের সাধারণত ঘৃণার চোখে দেখা হয় এবং খদ্দেররা পর্যন্ত তাদের সম্পর্কে কুচিন্তা করে। বারাঙ্গণা জীবন সহজাত প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচরণ করে। যে প্রবৃত্তি সন্ন্যাসিনী সৃষ্টি করেছে তার সঙ্গে এর কোনো সাদৃশ্য নেই। এইসব কারণ বিবেচনা করে বলা যায় যে, খ্রিস্টান দেশগুলিতে এই প্রথাটি হলো সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত ও বর্জনীয়।

আপাততভাবে জাপানে সমস্যাটির স্বরূপ অন্য রকম। সেখানে গণিকাবৃত্তির সামাজিক স্বীকৃতি ও জীবিকারূপী সম্মান আছে। এমন কি পিতা-মাতার সম্মতিসাপেক্ষে তা গ্রহণ করা হয়। বিবাহ সংক্রান্ত পণের টাকা সঞ্চয়ের জন্যে গণিকাবৃত্তির প্রচলিত বিরল নয়। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, সিফিলিসের প্রতি জাপানীদের আংশিক প্রতিষেধক ক্ষমতা আছে। তার ফলে জাপানে গণিকাবৃত্তিকে নৈতিকতার দিক থেকে ঘৃণিত করা হয় নি। যদি বারাঙ্গনা প্রথাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হয় তাহলে জাপানী পদ্ধতি প্রয়োগ করা উচিত, ইউরোপীয় পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য নয়। এ সত্য স্বীকৃত, যেকোনো দেশে নৈতিকতার মূল্যায়ণে যত বেশি দৃঢ়তা অবলম্বিত হবে, গণিকার জীবন হবে ততই অধঃপতিত।

গণিকাদের সঙ্গে সংস্পর্শ যখন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যরূপে প্রকাশিত হয় তখন সেই প্রথাটি পুরুষ চিত্তে অসৎ মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলে। সে এই ধারণা পোষণ করবে যে, তার জীবনের সকল প্রকার যৌনসহবাসকে তৃপ্তিজনক করার মধ্যে কোনো স্বার্থকতা নেই। ধীরে ধীরে সে ও সমগ্র নারীজাতি বিচিত্র মনোভাব পোষণ করবে, যদি সে স্বাভাবিক নৈতিকতার নিয়মনীতিকে সম্মান করে।

বিবাহের ওপর এই জাতীয় মানসিক অবস্থার প্রভাব অতীব দুর্ভাগ্যজনক। যে ক্ষেত্রে আমরা বিবাহের সঙ্গে গণিকাবৃত্তির সংযুক্তিকরণ করতে চাই। এবং যখন আমরা এ দুটি প্রথাকে যতটা সম্ভব পৃথক করতে চাই, তখন এ বোধটি কাজ করবে। কিছু কিছু পুরুষ তার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গমে অংশ নিতে আকাক্ষিত হয় না। ফ্রয়েডবাদীরা এই মনোভঙ্গিকে অডিপাস কমপ্লেক্স নামে অভিহিত করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় এইরূপ মনোভঙ্গি নারীজাতির সঙ্গে গণিকদের পার্থক্য নিরূপণে সহায়তা করে।

চিন্তাশক্তির চরম সীমায় উপনীত না হয়ে, অনেক পুরুষ, বিশেষত প্রাচীন মনোভাবাপন্ন পুরুষ তাদের স্ত্রীদের প্রতি অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শন করে। যা তাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে সতীত্ব ক্রান্তে রূপান্তরিত করে দেয়। এবং যৌন আনন্দ লাভের অভিজ্ঞতা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করে।

যখন কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর সঙ্গে গণিকার একীকরণে মনোনিবেশ করে তখন বিপরীত বিষয়গুলির অবতারণা হতে পারে। এই ধারণার ফলে সে ভুলে যায় যে, উভয় পক্ষের সহযোগিতা ভিন্ন যৌনসঙ্গম সার্থক হতে পারে না এবং তার অন্তরালে প্রেমের নিজস্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সেই পুরুষ তার স্ত্রীর প্রতি কঠিন ব্যবহার করে হৃদয়হীন স্বামীতে পরিণত হয় এবং স্ত্রীর মনে যে হতাশার উদ্রেক করে তাকে আর সরানো যায় না।

যৌনতার মধ্যে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুপ্রবেশের ব্যাপারটি কিছু কিছু মাত্রায় ক্ষতিকারক। কেননা, যৌন সম্পর্ককে পারস্পরিক উপায় হিসেবে গণ্য করা উচিত যা উভয় পক্ষের স্বতোৎসারিত চেতনা থেকে উদ্ভূত হবে। যেখানে এ ধরণের ঘটনা ঘটে না, সেখানে মূল্যবান সম্পদ অনুপস্থিত থেকে যায়। ঘনিষ্ঠতা আছে এমন কোনো মানুষের অন্তরঙ্গ শারীরিক সংস্পর্শে এলে প্রকৃত নৈতিকতা বোধের উন্মোচন ঘটে। বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন কোনো মানুষের কাছে এর কোনো বিপরীত পদ্ধতি আকর্ষণীয় হতে পারে না।

যদি যৌন আকাঙ্ক্ষার অন্তরালে শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদার শিহরিত শক্তির উন্মাদনা থাকে, তাহলে তা অপসৃত হতে বাধ্য। এবং এই ধরনের মনোবৃত্তি মানুষের মূল্যবোধসম্পন্ন বিচারবোধকে বিকৃত করে দেয়। এ ব্যাপারটি শুধুমাত্র গণিকাবৃত্তির সঙ্গে সংযুক্ত নয়, বিবাহের সঙ্গে এর নিবিড় সংযোগ আছে। নারীদের ক্ষেত্রে বিবাহ হলো জীবিকার্জনের সাধারণতম পন্থা। কিন্তু এ চিন্তা করা অনুচিত যে, বিবাহ সম্পর্কে সাবধান থাকা উচিত। এবং নারীচিত্তে অনাকাঙ্ক্ষিত যৌনতার যে পরিমাণ আধিক্য দেখা যায় তা বারাঙ্গনা বৃত্তি অপেক্ষা বিবাহের ক্ষেত্রে অধিক।

কুসংস্কার থেকে মুক্ত যৌন সম্পর্কের নৈতিকতার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার বিষয়টি অপরিহার্যভাবে থেকে যায়। অন্যের যূথবদ্ধ ইচ্ছাগুলিকে সম্মান না করে নিজস্ব আনন্দের জন্যে তাকে ব্যবহার করার মধ্যে যৌনতা বিকাশলাভ করে না। সেই কারণে গণিকাবৃত্তি অবলুপ্ত হবে না। যদিও তা থেকে অহরিত পাপ থেকেই যাবে। এমন কি গণিকাদের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হলে কিংবা যৌনরোগ সম্পর্কে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বিত হলেও এর ক্ষমতা কিছুমাত্র হ্রাসপ্রাপ্ত হবে না।

.

 গণিকাদের সম্পর্কে আকর্ষণীয় গবেষণা করে হ্যাভলক এলিস তার স্বপক্ষে যে যুক্তি প্রদান করেছেন তাকে গ্রহণযোগ্য বলে বিশ্বাস করতে আমার দ্বিধা আছে। তিনি গণিকা-সংক্রান্ত আলোচনা দ্বারা তাঁর রচনার সূত্রপাত করেছেন, যেটির অস্তিত্ব ছিল আদিম সভ্যতায় এবং যে বৃত্তি মানুষের বন্য প্রবৃত্তিকে মেটাতো মাত্র। তিনি মনে করেন গণিকাপ্রথা এই ব্যবস্থার বিস্তৃত রূপান্তর মাত্র এবং পূর্বে এই প্রথা যে উদ্দেশ্য সাধন করতে বর্তমানে গণিকাবৃত্তি সেই উদ্দেশ্য সাধনে ব্ৰতি। তিনি বলেছেন, অনেক মানুষ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সম্পূর্ণ তৃপ্তি পায় না। কেননা ঐতিহ্য সম্পন্ন বিবাহের বিধিনিষেধ ও নান্দনিক অসম্পূর্ণতাগুলি তাকে অতৃপ্তি সঞ্চার করেছে।

হ্যাভলক এলিস মনে করেন যে, এ ধরণের পুরুষরা মাঝে মধ্যে গণিকালয়ে গমন করেন। এবং একে অতৃপ্ত হৃদয়বৃত্তির সর্বাপেক্ষা কম অসামাজিক প্রকাশরূপে পরিগণিত করে। এদিক দিয়ে বিচার করলে তাঁর মন্তব্যের সঙ্গে লিকের চিন্তাধারার সাযুজ্য পাওয়া যায়। যদিও তার মতামত আরও বেশি আধুনিক যেতে পারে।

পুরুষদের মতো যে সমস্ত রমণিদের যৌন জীবনে অতৃপ্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে তারা হ্যাভলক এলিস নির্দেশিত পথে তৃপ্তি অন্বেষণের চেষ্টা করতে পারে এবং যদি নারীদের যৌন জীবনকে স্বাধীন করা হয় তাহলে পুরুষরা তাদের স্পন্দিত তৃপ্তিলাভের জন্যে ব্যবসায়ী মহিলাদের সান্নিধ্য কামনা করবে না।

নারীজাতির যৌন স্বাধীনতার স্বপক্ষে এটি হলো অন্যতম সুবিধা। আমি যতদূর জানি এবং যতোটা পর্যবেক্ষণ করেছি তাতে আমার মনে হয়েছে, যৌনতা সম্পর্কে যেসব রমণি স্বচ্ছ ও নিষেধমুক্ত মনোভাবের অধিকারিণী তারা বিবাহের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত তৃপ্তির সন্ধান দিতে পারে, যা ভিক্টোরিয়ান যুগে বিরল ছিল। যেখানে সুপ্রাচীন নৈতিকতার অবলুপ্তি ঘটেছে সেখানে গণিকাপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

যে সমস্ত পুরুষরা মাঝে মধ্যে গণিকাদের সংস্পর্শে আসত তারা এখন তাদের সমপর্যায়ের মেয়েদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে। এর ফলে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক উপাদান সংযোজিত হয়েছে, যা শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় অসম্ভব ছিল। এবং এই অন্তরঙ্গতা উভয়পক্ষের গ্রহণযোগ্য বাসনা-কামনা সৃষ্টি করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *