০৮. মানবজীবনে ভালোবাসার মূল্যায়ন

০৮. মানবজীবনে ভালোবাসার মূল্যায়ন

প্রেম সংক্রান্ত ব্যাপারে অধিকাংশ জাতিপুঞ্জের প্রযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বিস্ময়। উদ্রেককারী দ্বৈত সত্তা বিদ্যমান। একদিকে এই অনুভূতি হলো কবিতা, উপন্যাস ও নাটকের প্রধান প্রেরণা, অন্যদিকে এই আবেগকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিকেরা। এবং অর্থনৈতিক অথবা রাজনৈতিক পরিবর্তনের পক্ষে অপরিহার্য সামাজিক অবস্থিতিরূপে এর কোনো মূল্যায়ন করা হয় নি। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই মতামতকে সুপ্রযুক্ত বলে মনে করি না। আমার মত হলো, মানব জীবনের সর্বাপেক্ষা মধুর অনুভূতি নিচয়কে যেসব ব্যবস্থা দ্বারা মধূরতর করে তোলা যায় তার প্রশান্তি করার চেষ্টা করাই শ্রেয়।

ভালোবাসা শব্দটি যখন সত্তাবে প্রযুক্ত হয় তখন তার সঙ্গে যৌনতার কোননা সম্পর্ক থাকে না। থাকে এক অনাস্বাদিত আবেগ, থাকে মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরিক আৰ্তিজনিত সম্পর্ক। চরম অবস্থায় এই আবেগ উন্মত্ততায় পরিণতি লাভ করতে পারে। এই ধরনের আবেগকে বিবৃত করা হয়েছে শীর্ষক গ্রন্থে অসংখ্য পুরুষ ও নারীর পরস্পরিক সম্পর্ক উপস্থাপনার মাধ্যমে। ভালোবাসার অনুভূতিকে শৈল্পিকতায় রূপান্তরের ক্ষমতা বিরল। কিন্তু অনুভূতির অবস্থিতি ইউরোপে বিরল নয়। কয়েকটি সমাজে এর উপস্থিতি অন্য সমাজ অপেক্ষা বেশি এবং আমার বিশ্বাস তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট জনগণের প্রকৃতির ওপরে নয়, তাদের রীতিনীতি ও প্রথার ওপর। চীনদেশে এই অনুভূতি অপ্রযুক্ত। ইতিহাসের আলোচনায় আমরা দেখেছি ভ্রষ্টা রক্ষিতাদের দ্বারা বিচলিত হওয়াটা ছিল অসৎ সম্রাটদের বৈশিষ্ট্য। ঐতিহ্য সম্পন্ন চীনা সংস্কৃতি সকল প্রকার আবেগকে নিন্দা করেছে এবং এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, পুরুষ সর্ব অবস্থায় তার যৌক্তিকতার সাম্রাজ্যকে রক্ষা করবে। এক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায়।

আমরা রোমান্টিক আন্দোলন, ফরাসি বিপ্লব এবং মহাযুদ্ধ এই ত্রয়ীকে যদি বিস্মরণের অতলে নিমজ্জিত করতে পারি তাহলে মানব জীবনের সেই তার্কিক দিক অপরিহার্য অনিবার্যতা সম্পর্কে সম্যক লাভে সক্ষম হব যা মহারানী এনির সুপ্রযুক্ত ছিল। যুক্তিই বিশ্বাসঘাতককে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মতাদর্শ স্থাপনকারী মানবসত্তায় উদ্ভাসিত করতে পারে। আধুনিক জীবনের তিনটি অযৌক্তিক কার্যধারা হলো ধর্ম, যুদ্ধ ও ভালোবাসা। এই তিনটি অতিমাত্রায় অযৌক্তিক। কিন্তু ভালোবাসা যুক্তিবিরোধী নয়। একথা বলার অর্থ এই যে, যুক্তি অন্বেষণকারী মানুষ তার্কিক বিচারে ভালোবাসার অস্তিত্বে আনন্দ লাভ করতে পারে।

পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে আমরা যেসব আলোচনা করেছি তার পরিপ্রেক্ষিতে একথা মনে হতে পারে যে, আধুনিক পৃথিবীতে ভালোবাসা নামক অর্থহীন অনুভূতির আবেগ অনেক কমে গেছে। খ্রিস্টানধর্মের তার্কিক যুক্তি বুদ্ধি ভালোবাসার স্বর্গীয় পবিত্রতার সুমহান অগ্নিশিখাকে নির্বাপিত করার চেষ্টা করেছে। আধুনিক পৃথিবীতে ভালোবাসার ক্ষেত্রে ধর্ম অপেক্ষা শক্তিশালী আরও একটি প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব হয়েছে। তার নাম হলো কার্যধারা ও অর্থনৈতিক সফলতার মতবাদ। সাধারণভাবে মনে করা হয়, বিশেষ করে আমেরিকায় একজন পুরুষ তার জীবনের উন্নতির সঙ্গে ভালোবাসাকে সংযুক্ত করার অনুমতি দেবে না এবং যদি সে ওই অনুমতি দেয়, তবে তাকে মূর্খ বলে অভিহিত করা উচিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এবং অন্যসকল ক্ষেত্রে মানবীয় বিষয়গুলির মধ্যে সমতা রক্ষা করা উচিত। প্রেমের জন্যে উন্নয়নের নিষ্ফল আত্মনিবেশকে বোকামি ও বিস্বাদিত বিরক্তব্যঞ্জক বলা যেতে পারে। কেননা এটি চারিত্রিক মূখামির পরিচায়ক এবং এর সঙ্গে একবিন্দু সাহসিকতার সংযুক্ত নেই।

তা সত্ত্বেও এটি ঘটে, ঘটে অনিবার্যভাবে। যে সমাজ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত সেই সমাজে এই জাতীয় ঘটনার একাধিক উদাহরণ পাওয়া যায়।

আধুনিক যুগের এক ব্যবসায়ী মানুষের জীবনধারার কথা চিন্তা করুন। বিশেষ করে আমেরিকায়, যে ভদ্রলোক তার যৌবনের প্রথম প্রহর থেকে নিজের সর্বোত্তম চিন্তা ও সর্বশ্রেষ্ঠ কার্যক্ষমতাকে নিয়োজিত করেছেন অর্থনৈতিক সফলতার জন্যে। এছাড়া যা কিছু আছে তার প্রতি তিনি পোষণ করেছেন সাধারণ আনন্দ সঞ্চায়ী প্রভাব। যৌবন অবস্থায় তিনি মাঝে মধ্যে গণিকাদের সান্নিধ্যে তার শারীরিক চাহিদা মিটিয়েছেন। বর্তমানে তিনি বিবাহিত কিন্তু তাঁর সঙ্গে স্ত্রীর মনোগত প্রকাশভঙ্গির সার্বিক বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়। তিনি কখনও প্রকৃত অর্থে স্ত্রীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা প্রকাশ করতে পারেননি। তিনি অফিসের কাজে ক্লান্ত হয়ে অধিক রাতে বাড়ি ফেরেন এবং স্ত্রীর ঘুম ভাঙ্গার আগে কাজে চলে যান। অর্থ আহরণকারী যুদ্ধে যে পক্ষই জয়ী হোক না কেন তাকে অপরিহার্য আহার্যের সন্ধানে চিরন্তন গতিশীল থাকতেই হবে। জীবন ধারণের মৌলিক চাহিদা তাঁর কাছে অনিবার্যভাবে প্রকট হয়ে উঠবে। অর্থনৈতিক আনুগত্য ছাড়া সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষমতা আনয়ন করা সম্ভব নয়। বৈবাহিক ভালোবাসা ভিন্ন পরকীয়া প্রেমে অতিবাহিত করার মতো সময় তাঁর নেই। যখন তিনি ব্যক্তিগত কোনো কাজে গৃহালয় থেকে দূরে থাকেন তখন হয়তো মাঝে মধ্যে গণিকালয়ে যান। সম্ভবত স্ত্রী তার কাছে যৌনশীলতার প্রতীক। এবং এ ব্যাপারে তিনি মোটেই বিস্মিত নন, কেননা স্ত্রীকে উজ্জীবিত করার মতো যথেষ্ট সময় তার হাতে নেই, স্বভাবতই তিনি দৈনন্দিন দিনযাপনের গ্লানিতে ক্লান্ত ও অতৃপ্ত, যদিও সেই অতৃপ্তির আসল কারণ তার অজানা।

তিনি চিন্তা করেন যে, তার অতৃপ্তির কারণ মূলত ব্যবসাগত। কিন্তু অন্যভাবে হয়তো তিনি তৃপ্তি পাবার চেষ্টা করেন। ধর্ষণকামী আনন্দ অর্জনের দ্বারা অথবা নানা ধরনের অসৎ ক্রীড়া থেকে সেই ভদ্রলোক সুখ অন্বেষণ করতে থাকেন। তার স্ত্রী অতৃপ্ত হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির সংস্কৃতিতে মনোনিবেশ করেন এবং যে সমস্ত মানুষের জীবন মহৎ ও স্বাধীন তাদের প্রতি ঈর্ষা ভাব পোষণ করেন। এইভাবে যৌনতৃপ্তির অভাব স্বামী ও স্ত্রীকে মানব বিদ্বেষীতে পরিণত করে। অথচ সেই বিদ্বেষ ঢাকা থাকে সার্বজনীন উদ্দেশ্য এবং উচ্চশ্রেণির নৈতিক মানের মধ্যে, এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা প্রবাহের অন্তরালে মূলত কাজ করছে যৌন চাহিদা সম্পর্কে আমাদের ত্রুটিপূর্ণ ধারণা।

সেইন্ট পল চিন্তা করেছিলেন যে, বিবাহের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো যৌন সহবাসের সুযোগ করে দেওয়া এবং এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মনে রেখে খ্রিস্টান নৈতিকতাবাদীরা উৎসাহিত হন। যৌনতার প্রতি তাদের ঘৃণা যৌন জীবনের সূক্ষ্মতর বিষয়গুলিকে তমসাচ্ছন্ন করেছে। এর ফলে তাদের শিক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত যুবসমাজ জগৎ সম্পর্কে অন্ধবিশ্বাস পোষণ করে তাদের নিজেদের কার্যক্ষমতাকে অবদমিত করে থাকে। প্রেম হলো এমন একটা অনুভূতি যা যৌনসহবাস অপেক্ষা সুদূরপ্রসারী। জীবনের দীর্ঘতর অনুভূতির অন্তরালে আবদ্ধ যে নিদারুণ নিঃসঙ্গতা, তার মূল হলো উদ্দেশ্যবিহীন ভালোবাসা। শীতল পৃথিবী সম্পর্কে একজন আধুনিক দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের নিজস্ব বিশ্বাসের মূল প্রথিত আবহ-শঙ্কাজনক অনুভূতির মধ্যে। মানুষ শক্তিমদমত্ততার সম্ভাব্য নিষ্ঠুরতা সম্পর্কিত কঠিন ও ধ্বংসকারী ভবিষ্যতের অবলোকনে স্নেহের কাঙ্গাল কিন্তু সেই বোধকে আবৃত করে পুরুষচিত্তের কাঠিন্য, ঋজুতা অথবা কর্কশতা এবং নারীচিত্তের কোমলতা ও যুক্তিহীনতা।

কামনাময় পারস্পরিক ভালোবাসা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে এ ধরনের অনুভূতির সমাপ্তি ঘটতে পারে। ঐ প্রেম আত্মচেতনার শক্ত প্রাচীরকে ভেঙ্গে দিয়ে উভয়ের সম্মিলনে গড়ে তোলে একীভূত সত্তা। প্রকৃতিগতভাবে মানুষ একক অবস্থায় বাঁচতে পারে না। কেননা আরেক জনের সাহায্য ব্যতিরেকে প্রকৃতি তার জৈবিক উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে না। সুলভ্য মানুষ ভালোবাসার অনুভূতিতে তাদের যৌন আকাক্ষ নিখুঁতভাবে তৃপ্ত করতে অপরাগ। যতক্ষণ অবধি পুরুষের সমগ্র অনুভূতি, মানসিক নীরবতা এবং শারীরিক আকর্ষণ সমগ্রভাবে সম্পর্কের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে না পারে ততক্ষণ তার সহজাত প্রবৃত্তির সম্যক তৃপ্তি আসে না। যারা এই ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গতার বিষয়ে অজ্ঞ এবং সুখ সমৃদ্ধ যৌন ভালোবাসার কোমল সাহচর্যের কথা জানে না, তারা জীবন কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ সম্পদকে লাভ করতে পারে না। অবচেতন ভাবে, হয়তো বা চেতনার মধ্যে তারা এই অবস্থাকে অনুভব করে এবং পরিশেষে হতাশা জন্ম দেয় ক্রোধ, বিকৃতি ও নিষ্ঠুরতার।

কামনাময় ভালোবাসার যথাযোগ্য মূল্যায়ণে সমাজতাত্ত্বিকদের তৎপর হওয়া উচিত। কেননা এই অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হলে পুরুষ অথবা নারী তাদের পূর্ণ অনুভূতিকে গ্রহণ করতে পারবে না এবং তাদের চিন্তাধারায় পৃথিবীর অবশিষ্ট অংশ কখনই মহান উষ্ণতা নিয়ে প্রতিভাত হবে না। তার ফলে তাদের সামাজিক কাজকর্ম ক্ষতিকারক হতে বাধ্য। অধিকাংশ নারী ও পুরুষ যারা জীবনের দৈনন্দিনতার মধ্যে এই ঘনিষ্ঠ প্রেমের স্বাদ অনুভব করেছে তাদের কাছে পরিপূর্ণ ভালোবাসা ও কর্তব্যব্যঞ্জক দাম্পত্য জীবনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে এই অবস্থাটি ঘটে যুবতী অবস্থায় উপনীতি নারীদের ক্ষেত্রে। কেননা তাদের শেখানো হয়েছে যে, পুরুষ তাদের ভালো না বাসলে তাকে যেন তারা চুম্বন না করে।

বিবাহের সময় যদি কোনো রমণি তার কুমারীত্বে অবস্থান করে তাহলে দেখা যায় যে, তাকে মোহাচ্ছন্ন ক্ষণস্থায়ী যৌনতার ফাঁদে ফেলা হয়েছে কিন্তু যৌন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন যেকোনো নারী অতি সহজেই এই অনুভূতিকে ভালোবাসার আবেগ হতে পৃথক করতে পারবে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এই ঘটনাই অধিকাংশ অসুখি বিবাহের কারণ। এমন কি যেখানে পারস্পরিক ভালোবাসার অস্তিত্ব আছে, সেখানেও কোনো এক পক্ষের বিশ্বাসকে বিষাক্ত করা হয় অন্য পক্ষের ওপর পাপবোধের উপস্থাপনায়। অনেক ক্ষেত্রে এই বিশ্বাসের অন্তরালে যুক্তি আছে।

উদাহরণ দিয়ে পারনেলের কথা বলা যায়। সে চরিত্রহীনতার কাজে লিপ্ত ছিল কেননা এই কারণে সে আয়ারল্যান্ডের আশা পূরণে দীর্ঘসূত্রিতা অবলম্বন করে। কিন্তু যে ক্ষেত্রে পাপবোধের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই সেখানেও ভালোবাসাকে বিষাক্ত করতে পারে। ভালোবাসা থেকে তার সবটুকু সুস্থানকে গ্রহণ করতে হলে তাকে স্বাধীন, মহান, অনিয়ন্ত্রিত ও সর্বপ্রসারী হতে হবে।

চিরন্তন শিক্ষাব্যবস্থা পাপবোধের সঙ্গে ভালোবাসাকে সংযুক্ত করেছে। এমনকি বৈবাহিক ভালোবাসার ক্ষেত্রেও নারী ও পুরুষের অবচেতন মন ক্রিয়াশীল থাকে। যারা সুপ্রাচীন ঐতিহ্যর প্রতি আস্থাশীল এবং যাদের মধ্যে নতুন ভাববোধের উন্মেষ ঘটেছে তারা একইভাবে এই মনোভঙ্গির অনুকরণ করে থাকে।

যুবক-যুবতীর জীবনে নানা ধরনের অনুভূতির প্রভাব আছে। তারা সহজ প্রেমের ব্যাপারে সব সময় সম্যক স্থিতিশীল হতে পারে না এবং নিজেদের আবেগকে যথাযথভাবে উন্মোচিত করতে পারে না, আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা চরম আকাক্ষিত মুহূর্তের পক্ষে একান্ত অপরিহার্য ধারাবাহিক আবেদনে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যুবকরা বুঝতে পারে না যে, রমণিরাও তৃপ্তির অন্বেষণ করবে এবং এ ক্ষেত্রে যদি নারীরাও অতৃপ্তা থেকে যায় তার কারণ হলো সে নিজে।

যে সমস্ত মহিলা ঐতিহ্যবাহী প্রথায় শিক্ষিতা, তারা শীতল গোপনীয়তার মধ্যে পারস্পরিক অভিব্যক্তি সংযোজিত করে। শারীরিকভাবে তারা থাকে যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ন্ত্রিতা এবং সহজসাধ্য দৈহিক ঘনিষ্ঠতার প্রতি বিমূর্খতা প্রতিভাত হয়। একজন চতুর প্রেমিক পুরুষ সম্ভবত এই সমস্যাবলিকে অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু যে পুরুষ এদের শ্রদ্ধা করে পুণ্যবতী রমণির চিহ্নরূপে সে এগুলিকে অতিক্রম করতে পারে না। তার ফলে বিবাহের বহু বছর পরেও স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে আন্তরিকতার প্রবেশ ঘটে না এবং তা মোটামুটিভাবে বাহ্যিক সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়।

আমাদের ঠাকুরদাদার আমলে স্বামীরা কখনোই তাদের স্ত্রীদের নগ্ন অবস্থায় অবলোকন করতে চাইত না এবং এই জাতীয় প্রস্তাবে তাদের স্ত্রী নিশ্চয়ই শিহরিতা হত। এই মনোভঙ্গিকে অনেক সরলীকৃত করা হয়েছে, এবং এ ব্যাপারে তারা অনেকখানি অগ্রসর হয়েছে; তাদের মধ্যে প্রাচীন প্রথার কিঞ্চিৎ অবশেষ দেখা যায়।

আধুনিক যুগে ভালোবাসার সার্বিক পরিণতির বাধাস্বরূপ আছে আরেক মনস্তাত্ত্বিক প্রাচীর। অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে যে, এর ফলে তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে। এটি মূর্খতার পরিচায়ক মাত্র। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের কোনো প্রবল প্রচারকও প্রেমের সঙ্গে যুক্তিবোধের সংযুক্তির চেয়ে গভীরে স্থাপিত কোনো পৃথক সত্তার অন্বেষণে মগ্ন থাকবে। এ হলো নিরাপত্তার আধারে সুরক্ষিত ব্যক্তিসত্তা। এর যথাযথ ও সম্যক বিকাশের জন্য প্রয়োজন সংবেদনশীল মানুষের উপস্থিতি।

একক মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর অবশিষ্ট অংশের সংযোগ স্থাপনে ভালোবাসা সন্তানাদি এবং জীবিকা মহৎ উৎস স্বরূপ কাজ করে। সাধারণত কালানুক্রমিক তালিকায় ভালোবাসাকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া হয়। তাছাড়া বাবা-মার স্নেহবর্ধনের জন্যে এই অনুভূতির অপরিহার্যতা বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ। কেননা, যেহেতু একটি শিশু তার বাবা-মার বৈশিষ্ট্যগুলিকে রূপ দিতে ব্যস্ত তাই যদি তাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা না থাকে, যদি প্রত্যেকই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলি বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর হয়, তাহলে শিশুচিত্তে পৃথক পৃথক সত্তার বিচ্ছিন্ন প্রতিফলন ঘটবে। কাজের দ্বারা কোনো মানুষ বাহির পৃথিবীর সঙ্গে সফল সংযোগ রক্ষা করতে পারে না। এটি কার্যক্ষম হবে কি হবে না, তা নির্ভর করে এর প্রয়োগ প্রযুক্তির ওপর।

আর্থিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন কাজ এই শক্তি সাধন করতে পারে। কিন্তু যে ধরনের কাজের মধ্যে অনন্ত কিছু নিবেদন থাকে, মানুষ, বস্তুপুঞ্জ কিংবা শুধুমাত্র স্বপ্নের প্রতি আত্মনিবেশ, সেখানে এই উদ্দেশ্য হয়তো সাধিত হতে পারে, ভালোবাসা যখন শুধুমাত্র আর্থিক মানের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা যে ধরনের মূল্যায়ণ করতে চাই তার জন্যে ভালোবাসাকে প্রিয়জনের নিজস্ব ইচ্ছাপূরণের মাধ্যমরূপে গণ্য করতে হবে এবং নিজের ভালো লাগার প্রতি যে শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব আছে, অন্যের পছন্দকে সেই শ্রদ্ধা দ্বারা উদ্ভুত করতে হবে। নাহলে আমাদের হৃদয়ের স্বাভাবিক শুভেচ্ছারাশিকে দমন করতে হবে।

এর অর্থ এই নয় যে, ঐ অনুভূতির মধ্যে সহজাত প্রবৃত্তির কোনো ভূমিকা নেই। আমাদের দেখতে হবে যে, আবেগতাড়িত চেতনার অনুভূতি যেন পারস্পরিক মূর্খতায় পর্যবসিত না হয়। আমাদের কলহপ্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজে এই অবস্থাগুলি সহজসাধ্য নয়। এবং প্রোটেস প্যানটিজম থেকে আংশিক গৃহীত ও রোমান্টিক আন্দোলন থেকে আংশিক উদ্ভূত ব্যক্তিত্ব তাদের অযৌক্তিক আদর্শ দ্বারা এটিকে সংকুচিত করেছে।

আধুনিক যুগের জাগরিত মানুষ বিশ্বাস করে যে, সঠিক অর্থে ভালোবাসা হলো নতুন বিপদের জ্বালা-যন্ত্রণা। যখন মানবসমাজ যৌনসহবাসের বিরুদ্ধে কোনো নৈতিক প্রাচীরের অবস্থানকে অস্বীকার করে তখন তার অনুভূতির মধ্যে সংযুক্ত হয়। সংবেদনশীল আবেগ। হয়তো তারা গুরুত্বপূর্ণ উন্মাদনা ও স্নেহার্দ্র অনুভূতির জগৎ থেকে যৌনতাকে বিসর্জন দেয়। হয়তো তারা এর সঙ্গে ঘৃণার কাঠিন্যকে সংযুক্ত করে। এ জাতীয় মনোভঙ্গির নিখুঁত ছবি আছে আলডস হাক্সলীর উপন্যাসগুলিতে। তার চরিত্র সেইন্ট পলের মতো বিশ্বাস করে যে, যৌন-সহবাস হলো শুধুমাত্র শরীরবৃত্তির তৃপ্তির পথ। এর সঙ্গে সংযুক্ত উচ্চতর মূল্যগুলি তাদের কাছে অজানা থেকে যায়। অনেকে এই ভাবাবেগ থেকে স্বর্গীয় পবিত্রতার পুনরায়ণের দিকে এক পদক্ষেপ অগ্রসর হয়।

ভালোবাসার নিজস্ব সার্থক ও ব্যক্তিগত অন্তঃস্থ নৈতিক মান আছে। খ্রিস্টান শিক্ষণে এবং তরুণতর প্রজাতির অধিকাংশ অংশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া যৌন নৈতিকতা বিরোধী অপ্রতিরোধ্য বিপ্লবী মানসিকতায় এই বিষয়গুলি অস্পষ্টরূপে প্রকাশিত। প্রেম থেকে বিচ্ছিন্ন যৌনসঙ্গম দ্বারা সহজাত তৃপ্তির সূচনা হতে পারে না। আমি বলছি না যে, তৃপ্তি কখনোই আসবে না। কেননা এই ব্যবস্থার জন্যে অপরিহার্য সুকঠিন বা নিষেধ আরোপ করার বিষয়টি একটি কল্পনা মাত্র।

স্বাভাবিক প্রেম ব্যতীত যৌনসঙ্গমের আনন্দকে প্রাথমিকভাবে ঘৃণা করতে হবে। মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসার স্বাভাবিক অনুপ্রকাশকে স্থায়ী ও সুচিন্তিত করা প্রয়োজন। স্বীকৃত সত্তাস্বরূপ ভালোবাসার অপ্রকাশিত বিশালতাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু ভালোবাসা হলো এমন একটি বন্যশক্তি যে, মুক্ত অবস্থায় তাকে কোনো আইন বা রীতিনীতি দ্বারা বন্দি করা যায় না। এই প্রশ্নের সঙ্গে শিশুরা জড়িত না থাকলে একে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু শিশুদের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ পৃথক সীমানায় উপনীত, যেখানে ভালোবাসা শুধুমাত্র স্বশাসিত হয় না কিন্তু তার মধ্যে মানব প্রজাতির জৈবিক উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে। শিশু সংক্রান্ত ব্যাপারে সামাজিক মূল্যবোধ থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে বিতর্কের সময়ে ঐ মূল্যবোধ কামনার্ত ভালোবাসাকে অস্বীকার করতে পারবে না। উপযুক্ত নীতিবোধ অবশ্যই এই বিদ্বেষকে যতটা সম্ভব কমিয়ে দেবে। কেননা ভালোবাসা যে শুধু সৎ তাই নয়, বাবা-মা যখন পরস্পরকে ভালোবাসবে তখন সেই বোধ শিশুচিত্তে শক্তিদায়ী উৎসরূপে কাজ করে।

উপযুক্ত যৌননৈতিকতার প্রধান উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে অন্যতম হলো শিশু স্বার্থে ভালোবাসার সামান্য সংযোজনা। কিন্তু পরিবার সংক্রান্ত আলোচনার পূর্বে আমরা এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে পারব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *