1 of 2

৪৭. কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায়

কলোনি থেকে কলেজ পাড়ায় যাতায়াতে প্রচুর সময় যাচ্ছিল। তার ওপর বৃষ্টি হলে কথাই নেই। আজকাল ঘরে ফিরে এত কাহিল। লাগে যে তারপর আর বই নিয়ে বসতে ইচ্ছে করে না। পড়াশুনায় অবহেলা এসেই যাচ্ছে এই কারণে। কি করবে বুঝতে পারছিল না দীপা। হোস্টেল খুলছে শিগগিরই। যদি সিটি ছেড়ে দেয়। তবে সেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। আজ লাইব্রেরি হয়ে লাবণ্যকে পড়াতে যাবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু সকালে উঠেই বেশ জ্বর জ্বর লাগল। সেইসঙ্গে গলায় ব্যথা। মুখটুখ ধােওয়ার পর নিজে যে চা বানাবে সেই ইচ্ছেটাও হল না। গায়ে চাদর টেনে চুপটি করে শুয়ে থাকতে বেশ আরাম লাগছিল। দীপা বুঝতে পারল আজ কোথাও বেরুতে পারবে না।

আধো ঘুম আধো জাগরণে সকাল কাটল। রাধা এলে ওকে না হয়। কিছু ওষুধ নিয়ে আসার কথা বলা যেত। কিন্তু সেই ঘটনার পর জোর করে নিয়ে না গেলে মেয়েটা বড় একটা বাড়ি থেকে বের হয় না। সকালে মুখ ধুতে যাওয়ার সময় বাড়িওয়ালা তাকে দেখে তাঁর দৈনিক হাসিটি হেসে ফেলেছেন। অতএর তিনিও আর এদিকে আসবেন না। বেলা যত বাড়তে লাগল জ্বরও যেন তার সঙ্গে পাল্লা দিতে লাগল।

ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে পড়েছিল দীপা। হঠাৎ মনে হল ব্যস্তসমস্ত হয়ে অমরনাথ ঘরে ঢুকলেন। খাটের পাশে বসে কপালে হাত রেখে চমকে উঠে বললেন, হাত পুড়ে যাচ্ছে যে। ওষুধ না খেয়ে শুয়ে আছিস? কি ভেবেছিস তুই? সবাইকে ছেড়ে একা এক থাকবি? আমাকে একটা খবর দেবারও প্রয়োজন মনে করিসনি?

সেই গলায় এমন স্নেহ জড়ানো যে পাশ ফিরে কেঁদে উঠল দীপা। তার ঘুম ভাঙ্গল এবং তখনই একটা মোটক টিকটিকি দেওয়ালের গা ধরে টিকটিক করে উঠল। কান্নাটা থেমে গিয়েছিল আচমকা। ধড়মড় করে উঠে বসেছিল সে। শূন্য ঘর। কেউ কোথাও নেই। ব্যাপারটা যে স্বপ্ন তা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। অমরনাথ যে আর কখনও আসতে পারে না। এই বোধস্পষ্ট হওয়া মাত্র আর এক ধরনের যন্ত্রণা তাকে অধিকার করল। এই সময় টিকটিকিটা দ্বিতীয়বার ডেকে উঠল।

কেউ নেই। এই বিশ্বচরাচরে সে একা। এই মুহূর্তে অসুস্থতা যদি আরও বেড়ে যায়, যদি সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকে তাহলে কেউ তার কপালে হাত রাখবে না। এই চার দেওয়ালের মধ্যে মুখ গুজে পড়ে থাকা যে কি যন্ত্রণার তা সে টের পাচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে। শরীর সুস্থ থাকলে তবু এই একাকিস্তৃত্ব নস্যাৎ করা যায়। ইচ্ছে মত বাইরে বেরিয়ে পাঁচজনের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফেরা যায়। তখন রাতটা কিভাবে কাটবে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। কিন্তু এখন? বাইরের লোক আর ঘরের লোকের প্রভেদ বড্ড স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিঃসঙ্গ এই চার দেওয়ালের মাঝখানে থেকে মনে হয়। সে যেন একটা জেলখানায় রয়েছে যেখান থেকে কখনও মুক্তি পারে না। ঈশ্বর মানুষকে চরম শাস্তি দেন যখন তিনি তাকে নিঃসঙ্গ করেন।

সারাদিন একইভাবে পড়েছিল। মাথায় যন্ত্রণা, গলায় ব্যথা আর সেইসঙ্গে ধূম জ্বর। কলোনিতে রাত্রে মশারি না টাঙিয়ে শোওয়া যায় না। আগের রাতের টাঙানো মশারি সকালে তোলার ইচ্ছে না হওয়ায় শাপে বর হল এখন। একটা সময় এল যখন জ্বর এবং কষ্টগুলো একটু একটু করে নেশার মত হয়ে গেল। আজ আর ওই শারীরিক কষ্টগুলো খুব বড় হয়ে উঠছিল না।

মধ্যরাত্রে একবার চোখ মেলল সে। ঘরে আলো জ্বলছে। কয়েকটি মুখ। একটা দুটো। এরা কারা? চোখ বন্ধ করল সে। কপালে আরাম। একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা স্পর্শ। কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল, এই দীপা, এখন কেমন লাগছে?

সে ঘাড় নাড়ল, ভাল। খুব ভাল আছে। কি আরাম। আবার যেন নরম তুষারে পা রাখা। ধীরে ধীরে তুষার খাদে তলিয়ে যাওয়া, মাথার ওপরে আশেপাশের সব তুষার জড়ো হয়ে আড়াল করে দিল পৃথিবীটাকে।

প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা বেহুঁশ হয়ে কাটানোর পর যখন দীপা চোখ খুলল। তখন সামনে একটি গম্ভীর মুখ দেখতে পেল। শোকসংবাদ পেয়ে যে মুখ নিয়ে মানুষ মৃতের বাড়িতে আসে অবিকল সেই মুখ। দীপা হেসে ফেলল।

সঙ্গে সঙ্গে সে মায়ার গলা পেল, কিরে, কেমন আছিস? এই দীপা?

দীপা মুখ ঘোরালো। এবার সে মায়াকে চিনতে পারল। মায়ার পাশে রাধা। ঘাড় নেড়ে বাচ্চা মেয়ের মত ভাল বলল নিঃশব্দে।

রাধা বলল, উঃ, যা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। দাদা কাল রাত্রে ডাক্তার ডেকে এনেছেন। তিনি আজ সকালেও এসেছিলেন। বলেছিলেন যদি দুপুরের মধ্যে জ্ঞান না আসে তাহলে হাসপাতালে পাঠাবে।

দীপার চিন্তাশক্তি কাজ করছিল না। মায়া এখানে কি করে এল তা সে ভাবতেই চাইল না। সে মুখ ফিরিয়ে সামনে বসা গভীর লোকটিকে দেখল। ঝাপসা লাগছে মুখ। অমরনাথ? না। এত শক্ত মুখ অমরনাথের না। এইসময় মুখটা কাছে এগিয়ে এল, ভয় নেই, আমরা এসে গিয়েছি। এখন তুমি ভাল হয়ে যাবে।

গলাটা চিনতে সামান্য সময় লাগল। কিন্তু আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছিল না। মায়া দেখল ওর চোখ আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

রাধার দাদা দাঁড়িয়েছিল দরজায়। এবার এগিয়ে এসে বলল, আমার মনে হয় ওঁকে এখানে ফেলে না রেখে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।

মায়া মাথা নাড়ল, না। আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। মা আছেন, ভাল ডাক্তারও আছে পাড়ায়।

রাধার দাদা বলল, আমাদের এতে কি আপত্তি থাকবে? তবে অতদূর যেতে পারবেতো! আর ওর আত্মীয়স্বজনদেরও এই খবরটা দেওয়া দরকার।

রাধা বলল, কলকাতায় আত্মীয়স্বজন থাকলে কেউ ঘর ভাড়া করে একা থাকে?

রাধার দাদা বলল, কলকাতায় না থাকুক কোথাও না কোথাও আছে তো। আমি বলছি, এর যা অবস্থা তাতে পরে ওঁরা যেন কোন অভিযোগ না করেন।

হাসপাতাল নয়, দীপা বুঝল সে মায়াদের বাড়িতে শুয়ে আছে। কয়েকঘণ্টা তার চেতনা সক্রিয় ছিল না। নতুন ডাক্তারবাবু সযত্নে পরীক্ষা করে প্রেসক্রিপশন লিখে চলে গেলেন। এখন মায়ার মা আর মায়া তার পাশে বসে আছে। মায়া তার মাকে বলল, এবার তুমি যাও। এতক্ষণ ঠায় বসে আছ। ডাক্তারবাবু তো বললেন আর ভয্যের কোন কারণ নেই।

মায়ার মা বললেন, চিঠিটা তুই লিখবি না আমি লিখব?

তুমিই লেখ। আর একটা দিন অপেক্ষা করলে অবশ্য ভাল হত।

কেন?

মনে হয় আগামীকাল ও মোটামুটি কথা বলতে পারবে। তখন ওকে জিজ্ঞাসা করে না হয় লেখা যেত। মায়া বলছিল।

ঠিক আছে, যা ভাল মনে হয় কর। ভদ্রমহিলা উঠে গেলেন পাশ থেকে। এসবই এখন স্পষ্ট টের পাচ্ছিল। বাড়িটা মায়াদের এবং সে নিরাপদ এমন একটা বোধ তাকে বেশ আরাম দিচ্ছিল। মায়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। সে ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই মায়া বুকে এল, কেমন লাগছে এখন?

ভাল। ফিস ফিস করে বলল দীপা।

উঃ, যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। কাল তোকে আনার পর ডাক্তারবাবু দুবার এসে দেখে গিয়েছেন। কি করে বাধালি এত বড় অসুখ?

দীপা জবাব দিল না। সে খুব নিস্তেজ চোখে তাকাল।

মায়া বলল, শোন, তোর অসুখের কথা রাধার দাদা এসে জানাতে আমরা তোকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছি। ওখানে জিনিসপত্র পড়ে আছে শুধু জামা-কাপড় আর টাকা পয়সা নিয়ে এসেছি। তুই অত টাকা ওই ঘরে রাখতিস? পাগল। নে, এখন ঘুমো। আর কোন চিন্তা নেই।

মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। ঘরে সে এখন একা। একটা গা গুলানো ভাব ছাড়া শরীরে কোন অস্বস্তি নেই। জ্বর এখনও ছেড়ে যায়নি। মাথা তুলতেই ঘুরে যাচ্ছিল। সে ঘরটাকে দেখল। এই ঘরে সে আগে কখনও আসেনি। হঠাৎ আর একটি সমস্যার কথা মনে এল। শেষবার কখন বাথরুমে গিয়েছিল মনে পড়ছে না। কিন্তু এ বাড়ির বাথরুম সে ব্যবহার করবে কি করে? অন্য শরিকরা তো ছোঁয়াছুয়ির বাদ বিচার করবেন। সুস্থ অবস্থায যে কারণে সে এখানে আসতে চায়নি অসুস্থ অবস্থায় তো সেটা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এর চেয়ে হাসপাতালে গেলে ভাল হত, সেখানে ভালবাসা না থাক বাদবিচার নেই।

আবার ঘুম। আবার জাগরণ। এবার মায়ার মা সামনে বসে। সে চোখ খুলতেই প্রশ্ন হল, কেমন আছ দীপাবলী?

ভাল।

তুমি উঠতে পারবে?

কেন?

বাথরুমে যেতে হবে।

দীপার চোখে মুখে অস্বস্তি ফুটল।

মায়ার মা বললেন, তোমাকে বেশীদূরে যেতে হবে না। এই ছাদের ঘরের পাশে একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরনো বাথরুম। ব্যবহার করা হত না। এখন কাজে লাগবে। আমাকে ধরো।

দুপুরের পরে যখন ঘুম ভাঙল তখন বাইরে রোদ্দুর। মাথাটা বেশ হালকা লাগছে। একটা কাক সমানে ডেকে যাচ্ছে কাছেই। এই ঘর ছাদের ঘর। খুব ভাল লাগল। ঘরে অনেক জিনিসপত্র রয়েছে ছড়ানো। খাটে বিছানা সম্ভবত তার জন্যেই পাতা হয়েছে। পায়ের দিকে যে জানলাটা তার ওপারেই আকাশ। এরকম একটা ঘর মায়াদের বাড়িতে আছে তা সে জানতো না। দুপুরে মাসীমা সুপ জাতীয় কিছু খাইয়ে গিয়েছেন। রাধার কথা খুব মনে পড়ছিল। এরা সবাই তার জন্যে এত করছে অথচ সে নিজেকে এক ভাবছিল। শরীর এত দুর্বল যে উঠে বসতে ইচ্ছে করছে না। অথচ শুয়ে থাকার আরামটাও চলে গিয়েছে। বিকেল চারটের সময় ওষুধ-খাওয়ার কথা। মায়ার মা বলছেন তার মধ্যেই ফিরে য়াসবে মায়া।

এইসময় বাইরে মাসীমার গলা পেল, না, আর জ্বর বাড়েনি। অল্প একটু খাওয়াতেও পেরেছি। মুখের স্বাদ তো থাকার কথা নয়। বেশী কথা বলো না। এসো।

দীপা দেখল মাসীমার পেছন পেছন শমিত ঢুকছে। চোখাচে্যুখি হতেই শমিত হাসল, কি খেলটাই না দেখালে। জেদি মেয়েদের এমন ভোগান্তি মাঝে মাঝে ভোগা উচিত।

মায়ার মা বললেন, আচ্ছা, অসুস্থ মেয়েটাকে এমন কথা বলতে আছে? বসো।

খাটের পাশের চেয়ারটাতে বসে শমিত জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ এখন?

খুব খারাপ। সরু গলায় বলল দীপা।

খারাপ? কেন? কি অসুবিধে হচ্ছে? চিন্তিত হল শমিত।

আপনি এসেছেন, তাই। মুখ ঘোরাল দীপা, চোখ বন্ধ করল। মাসীমা হেসে উঠলেন, বাঃ, কেমন জব্দ। আর ওর পেছনে লাগবে! তুমি বসো, মায়া এখনই ফিরবে, তখন সবার চা একসঙ্গে করব। দরজার দিকে যেতে যেতে তিনি থমকে দাঁড়ালেন, ওকে বেশী কথা বলিও না। এখনও জ্বর একদম চলে যায়নি।

মাসীমা চলে গেলেই শমিত অন্তত মিনিট তিনেক চুপচাপ বসে থাকল। দীপা তাই দেখে হেসে জিজ্ঞাসা করল, কি হল? নিবকি কেন?

হঠাৎ শমিত অন্যরকম গলায় জানতে চাইল, আমি আসি তা তুমি চাও না?

আপনার কি মনে হয়?

আমি তোমাকে বুঝতে পারি না।

আপনার অক্ষমতার দায় আমার ওপর চাপাচ্ছেন কেন?

শমিত অবাক হয়ে দীপার মুখ দেখল। তারপর হেসে বলল, উঠি। কেন?

এই দুপুরেও কি রিহার্সাল রেখেছেন?

এখন আর দুপুর নেই। আচ্ছা, তুমি কি আমাকে নাটক-রিহার্সাল এসবের বাইরে ভাবতে পারো না? আমি আড্ডা মারতেও যেতে পারি।

তাহলে জানলাম আমার সঙ্গে আড্ডা মারা যায় না।

বাঃ, মাসীমা একটু আগে বলে গেলেন আমি যেন তোমাকে বেশী কথা না বলাই। এর মধ্যেই সেই অন্যায়টা করে ফেলেছি।

না, আপনি একটু বসুন।

বেশ। বসছি, কিন্তু তুমি কথা বলবে না। শমিত ঠিক করল যতটা সম্ভব কথা না বলে দীপার। পাশে বসবে। সে দেখল। দীপা তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে। ওর ফ্যাকাশে মুখ, রুক্ষ চুল অসুস্থতাকে ধরে রাখলেও চোখ দুটিতে হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠছে। কথা না বলে থাকতে পারল না সে, হাসছ কেন?

এটা তো মানা নেই!

শমিত নিঃশ্বাস ফেলল। ক্রমশ তার অস্বস্তি হল। একজন নিঃশব্দে হেসে গেলে তার সামনে চুপচাপ বসে থাকা যায় না। বিছানায় নেতিয়ে পড়ে থাকা দীপার হাতের আঙুলগুলোর দিকে তাকাল সে। নখগুলো যেন বড্ড বেশী সাদা। নখপালিশ ব্যবহার করেনি নিশ্চয়ই অনেকদিন। কিংবা আদৌ ব্যবহার করে না।

কি ভাবছেন?

তুমি আমাকে এখনও আপনি বল কেন? তোমার বন্ধু মায়া কিন্তু তুমি বলে। বয়সে তো খুব বেশী বড় নই। একসঙ্গে কাজ করলে তুমি বলাটাই স্বাভাবিক।

ভেতর থেকে আসেনি, এলে বলতাম।

আমি উঠি। তোমার যদি খুব অসুবিধে না হয় কাল আসব। শমিত উঠে দাঁড়াল দীপা চুপ করে রইল। কিন্তু কিন্তু করেও শমিত ডান হাত বাড়িয়ে জ্বর দেখার ভঙ্গীতে দীপার কপাল স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করল দীপা। পায়ের শব্দে বুঝল শমিত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সে চোখ খুলিছিল না। হঠাৎ ওই স্পর্শের কথা মনে আসায় সা.া গায়ে কাঁটা ফুটল তার। এই রোগক্লিষ্ট শরীরে ক্লান্তি ছাপিয়ে অন্য এক নবীন অনুভূতি। বন্ধ চোখ খুলিছিল না সে। যেন ওই অনুভূতি চোখ খোলামাত্র হারিয়ে যেতে পারে। কয়েক সেকেণ্ড বাদে তার বিী চোখ উপচে বন্ধ পাতার কোণ দিয়ে একটা অবাধ্য। জলের ধারা গড়িয়ে গেল। কানের দিকে। দীপা মোছার চেষ্টা করল না।

কোন স্থির ভাবনা মনে নেই, কিছুক্ষণ। এইভাবে থাকার পর একসময় মাথার ভেতরটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল চুপচাপ। এইসময় তার বোধশক্তিও কাজ করছিল না। অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ যেন এক মুহূর্তে লয় পেয়ে গিয়েছিল। এইসময় কেউ যেন তাকে গভীর জলের তলা থেকে টেনে তুলল। চোখ খুলল দীপা। খুলতেই দেখল মায়া তার মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে।

তাকে চোখ মেলতে দেখে মায়া দুই কাঁধ-আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোর? কখন থেকে ডেকেই যাচ্ছি, সাড়া দিচ্ছিস না কেন?

দীপা তখন শব্দ খুঁজছিল। কথা বলতে গেলে পরিচিত শব্দ দরকার। অথচ ওই মুহূর্তে সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। মায়া ওকে প্ৰায় জড়িয়ে ধরে মুখের কাছে মুখ নিয়ে এল, কি ভাবছিস? খুব কষ্ট হচ্ছে?

মাথা নাড়ল দীপা, তার বন্ধ ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে শব্দ এল, না। এবং সেই মুহূর্তে তার নাকে তেলের গন্ধ লাগল। পরিচিত গন্ধ কিন্তু তার সঙ্গে শারীরিক সুবাস মিশে থাকায় সেটা বেশ অস্বস্তির হল। মায়া তাকে যেভাবে দুহাতে জড়িয়ে রেখেছে। এইসময় তাতেও তার স্বস্তি হচ্ছিল না।

কষ্ট না হলে কেউ কাঁদে? তোর চোখের কোণ থেকে একটা জলের দাগ এখনও শুকিয়ে আছে। তুই খুব ভাল মেয়ে। দীপার গালে গাল রাখল মায়া, রেখে বলল, না, জ্বর বোধহয় নেই। আমার মুখে ছাঁকা লাগছে না।

ঠিক আছে। দীপা নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করল।

কি ঠিক আছে? মুখ তুলল। মায়া, কিছুই ঠিক নেই। মায়ের কাছে শুনলাম শমিত এসেছিল। কি বলেছে ও? তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে?

না তো। দীপা ওই অবস্থায় মাথা নাড়ল।

তাহলে কাঁদছিলি কেন?

দীপা এ প্রশ্নের জবাব দিল না। মায়া ওর কাঁধে আবার চাপ দিল। মায়াকে যেন এইসময় আর মেয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। সে জবাব দিল, কাঁদিনি, কখন জল বেরিয়েছে। আমি নিজেই জানি না।

বাঃ। এটা কোন কথা হল। দ্যাখ। দীপা, আমি তোর বন্ধু তোকে সাবধান করে দেওয়া আমার কর্তব্য। শমিতকে দেখে যে কোন মেয়ে টালমাটাল হয়, ওর মধ্যে এমন একটা সর্বনাশা ঝড়ের স্বভাব আছে যে না হয়ে পারে না। তুই যেন এই ভুল করিস না। শমিত তোর জন্যে নয়। বুঝলি?

দীপা মাথা নাড়ল। নেড়ে চোখ বন্ধ করল। আর তখনই সে দুই ঠোঁটে চাপ অনুভব করল। চুমু খেয়েই মায়া উঠে বসল, গুড গার্ল। লক্ষ্মী মেয়ে।

ঠিক পনের দিন পরে জান এবং ভাত খেয়ে দীপা এক বিকেলে ছাদে গিয়ে দাঁড়াল। মায়া তখনও কলেজ থেকে আসেনি। ক্লাস হয়ে গেল বেশ কিছুদিন। এবার এখান থেকে তার যাওয়া উচিত। কলোনির ঘরে তালা দেওয়া রয়েছে। রাধা এসেছিল তিন দিন। সে অবশ্য বলেছে ও ব্যাপারে কোন চিন্তা না করতে। চাবি আছে তাদের বাড়িতে। রাধার দাদা প্রতি রাত্রে সেখানে শুতে যায়। শমিত যেভাবে সহজ হয়ে এই বাড়ির অনেক সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে ছাদের ঘরে আসতে পারে রাধার দাদা তা পারে না। কারণ একদিন নাকি বোনের সঙ্গে এসেও নিচে অপেক্ষা করেছে। তখন দীপা মোটামুটি আচ্ছন্ন ছিল, পরে শুনেছে। এই মানুষটিকে তার খুব সহজ বলে মনে হয়। দীপা ভেবেছিল হয়তো একদিন দেখা করতে আসবে। এলো না।

কলোনির ঘরে অবশ্য এমন কিছু দামী সম্পত্তি নেই যে পাহারা দিতে একজনকে রাত্রে সেখানে শুতে হবে। তার বিছানায় একজন অনাস্ত্রীয় পুরুষ রোজ রাত্রে শুচ্ছে ভাবতে ভাল লাগছিল না। এবার সেই ঘরে ফিরে যেতে হবে। এখানে মাসীিমার মেহ, মায়ার যত্ন আর মাঝে মাঝে শমিতের গল্প করে যাওয়ার সঙ্গে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। এরা কেউ তাকে চলে যেতে বলেনি। কিন্তু সুস্থ হবার পর প্রত্যেকের দুশ্চিন্তা চলে গিয়েছে বোঝা যাচ্ছে। এর বেশী থাকলে হয়তো বোঝা হয়ে যাবে।

এই বাড়ি মায়াদের একার নয়। এই ঘরটিও। দীপার কারণে মায়ার মা কিছুদিন ব্যবহার করার অনুমতি পেয়েছেন। কাল সন্ধেবেলায় অবশ্য অন্য কারণে এ বাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ দাপাদাপি হয়ে গিয়েছে। নারী এবং পুরুষকণ্ঠে অনেকক্ষণ আস্ফালন গর্জন চলছিল একনাগাড়ে। মায়া হেসে বলেছিল ওটা জল নিয়ে বিবাদ। সেই বিবাদের জের ছাদেও উঠে এসেছিল। ঘরের দরজা বন্ধ ছিল দীপার। কিন্তু মনে হয়েছিল যে কোন মুহূর্তে ছাদে কেউ খুন হয়ে যেতে পারে। ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল সে।

এখন এই বিকেলে এবাড়ির নির্জনতায় গতকালের উত্তাপ ধরা পড়বে না। কিন্তু তার উচিত অবিলম্বে সরে যাওয়া। হঠাৎ পায়ের শব্দ হল। একজন বয়স্ক মহিলা ছাদে উঠে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। ফরসা লম্বা, গায়ে জামা নেই, থান জড়ানো রয়েছে। মহিলা হাসলেন, ও, তুমি বুঝি ওঘরে আছ?

মাথা নাড়ল দীপা। একি ফ্যাসাদ হল।

শুনেছি। একটা মেয়ের খুব অসুখ। ওঘরে আছে। মেমগিন্নি বলে কয়ে ঘরটা কদিনের জন্যে নিয়েছে। তা এখন কেমন আছ?

একটু ভাল।

অবশ্যি আমি বুঝতে পারলাম না। এত চুলো থাকতে এই ঘরে কেন? তিন কুলে কোন আত্মীয়স্বজন নেই?

না বলতে গিয়ে সামলে নিল দীপা, অনেক দূরে থাকেন।

অ। অনেকটা টেনে উচ্চারণ করলেন বৃদ্ধা, তা এখানে থাকা হয় কোথায়?

হোস্টেলে।

তাই বল। মাথার ওপর লাঠি ঘোরাবার কেউ নেই। শুনেছি হোস্টেলের মেয়েদের নানান বদ অভ্যোস থাকে। মাথার ওপর ব্যাটাছেলে না থাকলে মেয়েছেলের যা হয়। আর কি। অবশ্যি কাকে আর বলব। এই বাড়িই তো এখন রাধাকৃষ্ণের কুঞ্জবন হয়ে গিয়েছে। হুটহাট দামড়া ছেলে বাড়িতে ঢুকছে। স্নান করে যে স্বস্তি নিয়ে বের হব তার উপায় নেই। কান পেতে পায়ের আওয়াজ শুনতে হয়। কি জানি বাবা, আমাদের বাড়িতে এর আগে কেউ কলেজেও পড়েনি। তাই অসভ্যতাও করেনি।

দীপা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। বৃদ্ধ একটা টেকুর তুললেন, জ্বলে গেল, বুক জ্বলে গেলে। উঃ, এই হল আমার রোগ। সারাদিনে একবার খাই তবু অম্বলে বুক জ্বলে যায়। হিন্দু বেধবা তো, যমেরও অরুচি। হ্যাঁ, তা যে কথা বলছিলাম, এই বাড়ির হাল এমন হয়েছে বছর দশেক হল। যখন কতা বেঁচেছিলেন তখন তো আর ভাগাভাগি ছিল না। কারো ট্যাঁ ফুঁ করার ক্ষমতা ছিল না। বাইরের লোক কি ঘরের ব্যাটাছেলেরাই অন্দরে ঢুকত না। আমার শাশুড়ি তো গায়ে জামা রাখতে পারতেন না, মাঝে মাঝে কাপড়ও ফেলে দিতেন, কিন্তু ব্যাটাছেলেরা কেউ সেটা দেখতে পেয়েছে? কেউ না। তিনি গিয়ে আমাকে মেরে দিলেন। একবার বুঝলে সৌদামিনী নামে এক উঠতি বয়সের ঝি এল কাজে। রাত বেরাতে ছাদে আসত। আমার সন্দেহ হয়েছিল। যখন জানলাম তখন ছয়মাসের পেট। মেরে ফেলতে তো পারি না। তা সেই মেয়ে চারমাস ভাঁড়ার ঘরে থেকে বাচ্চা বিইয়ে সেই বাচ্চা নিয়ে দেশে চলে গেল। কাকপক্ষীতেও কি টের পেল? পেল না। তা তুমি ছাদে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

এমনি, ঘরে বসে থাকতে থাকতে–।

উহুঁ। মেমসাহেব শুনলে হয়তো বলবে অন্য শরিকের লোক হয়ে আমি নাক গলাচ্ছি, কিন্তু তোমাকে বলি, ছাদে দাঁড়িও না। এ ছাদের হাওয়া বড় খারাপ। কখন গায়ে লেগে যাবে টের পারে না। আমারই এত বয়স হল তবু ছাদে উঠলে আশে পাশের ব্যাটাছেলে যেন গিলে খায়। আর চুল খুলে দাঁড়ানো হয়েছে, মরণ! কথা শেষ করে বৃদ্ধ টুকু টুক করে ছাদের কোণে চলে গেলেন। সেখানে একটা ছোট টবে আধমরা তুলসী গাছ দাঁড়িয়ে আছে। বৃদ্ধ সেখানে পৌঁছে কাক পাখিদের কোপান্ত করতে লাগলেন। দীপা চলে এল ঘরের মধ্যে। এবং তার মনে পড়ল সেই কথাগুলো, বাঙালি নারী জাতির সবচেয়ে বড় শত্ৰু নারীরাই। নিজের জীবনের অপ্রাপ্তি হতাশা তাঁহারা বুকে বহন করিয়া চলেন যতদিন না। আর কোন নারীর ওপর তাহা বর্ষণ করিতে সক্ষম হইতেছেন।

অথচ এই বাড়িতেই মায়া মানুষ হয়েছে। বৃদ্ধা তার মাকে মেমসাহেব বলে ব্যঙ্গ করলেন। মায়ার মধ্যে এসবের প্রভাব বিন্দুমাত্র পড়েনি। সেটা অবশ্যই ওর মায়ের কৃতিত্ব।

মায়ার কথা মনে পড়তেই অন্য ধরনের অস্বস্তি এল। সেদিন তাকে চুমু খাওয়ার পর মায়া যেন বড় বেশী তার গায়ে পড়ছে। কথায় কথায় তাকে জড়িয়ে ধরছে। ওর এই ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না দীপার। খাটের ওপর পা মুড়ে বসে হাঁটুতে মুখ রেখে এই ছায়া ছায়া ঘরে সে হেসে উঠল নিঃশব্দে। আমাদের সম্পর্কগুলো ভারি মজার। প্রেমিক প্রেমিকা, স্বামী স্ত্রী মনের তাগিদে বা শরীরের আকাঙক্ষায়আলিঙ্গন বা চুম্বন করলে সেটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু ভারতীয় ধারণায় ওসব করতে হবে তৃতীয় মানুষের চোখের আড়ালে। চুপি চুপি। যুক্তি দুটো। একটি, যা তোমাদের নিজস্ব ব্যাপার তা কেন পাঁচজনকে দেখাবে। দ্বিতীয়টি প্ৰকট, আইনের সাহায্য নিয়েও নরনারী প্ৰকাশ্যে ওরকম আচরণ করলে পাঁচজনের কাছে অশ্লীল বলে মনে হবে। ওদের ক্লাসের একটি মেয়ে বাবার সঙ্গে মেট্রো সিনেমায় ইংরেজি ছবি দেখতে গিয়েছিল। সেখানে আচমকা নায়ক নায়িকাকে জড়িয়ে ধরে যখন চুম্বন করে তখন মেয়েটির কান লাল হয়ে গিয়েছিল। আড়চোখে সে দেখেছিল তার বাবা চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। ওই দৃশ্য মেয়ের সঙ্গে বসে তিনি দেখতে চাননি অথবা পারেননি। এক যা উপভোগ করতেন। পাঁচজনের সঙ্গে মেয়ে সঙ্গে থাকায় তা অীল বলে মনে হয়েছিল তাঁর। দীপার মনে হল, যদি কোন স্বামী-স্ত্রী অনেক বৃদ্ধ বয়সে, যখন তাঁদের হাঁটা চলার ক্ষমতাও লোপ পেতে চলেছে, পরস্পরকে আলিঙ্গন চুম্বন করেন তাহলে তাঁদের ছেলেমেয়ে নাতি নাতনীরা সেটা কি চোখে দেখবে? তার মন বলল, ব্যাপারটা তাদের কাছে কখনই গ্ৰহণযোগ্য হবে না।

আবার একই ব্যাপার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেমন পাল্টে যায়। যারা বলেন, স্নেহ ভালবাসা কোন ঘাত-প্ৰতিঘাত ছাড়া এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, তাঁরা অন্ধ। মায়ের ভালবাসা তার সন্তানের ওপর শৈশব থেকে বাল্যকাল পর্যন্ত যে অবস্থায় থাকে। পরে তা থাকে না। পাঁচ বছর বয়স হয়ে গেলে মা কেন তার সন্তানকে আর ঠোঁটে চুম্বন না খেয়ে গালে বা কপালে ঠোঁট ছোঁয়ান? সেই মা কেন ওই সন্তানের বিশ বছর বয়সে চুম্বনের কথা ভাবতে পারেন না। শরীরের পরিবর্তন তাঁর সোচ্চার ভালবাসার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়? যা ছিল অত্যন্ত মধুর তা হয়ে দাঁড়ায় অশোভনীয়। তাহলে মেহ খোলস পাল্টায়। এক মাত্র কন্যাকে যে পিতা শৈশবে বা বাল্যকালে প্রতিদিন চুম্বনের মাধ্যমে স্নেহ প্ৰকাশ করেন যৌবন এলে তিনিও তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে সঙ্কোচ বোধ করেন। মানুষের এ এক অদ্ভুত অসহায়তা এবং মানুষ যেহেতু সামাজিক প্রাণী তাই সেটা মেনে নেয়। মায়া তাকে চুম্বন করেছে এই অভিযোগ কাউকে করলে সে হাসবে। এদেশে এখনও নারীর সঙ্গে নারীর এমন ঘনিষ্ঠতায় কেউ দোষ দ্যাখে না। অথচ মায়ার বয়সী কোন পুরুষ যদি ওই কাণ্ড করত তাহলে—! হঠাৎ মুখ চোখ লাল হয়ে গেল দীপার। ব্যাপারটা ভাবতেই তার রোমাঞ্চ হল। কেন এমন হচ্ছে ভেবে পাচ্ছিল না, ভাবতে আর ইচ্ছেও করছিল না। সে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর তখনই এই ঘরে এতদিন চুপ করে থাকা টিকটিকিটা শব্দ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিল।

বিকলে শেষ হবার আগেই মায়া এল, সঙ্গে শমিত। খাটের একপাশে সরে বসল দীপা। মায়া পাশে চলে এল, কেমন আছিস?

ভাল হয়ে গিয়েছি। আজ ছাদে বেড়িয়েছি কিছুক্ষণ।

শমিত বলল, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

মায়া বলল, ভাল হয়ে গেছি মানে পুরোপুরি সুস্থ তা ভাবিস না। তুই যদি ওই কলোনির ঘরে আবার গিয়ে একা থাকিস তাহলে অসুস্থ হয়ে পড়তে বেশী সময় লাগবে না।

বাঃ, আমি থাকব। কোথায়? যেখানেই থাকি একাই থাকতে হবে।

কেন? এই ঘরটিকে কি খুব খারাপ মনে হচ্ছে?

পাগল! অসুস্থ অবস্থায় এখানে এতদিন থাকলাম সুস্থ হয়ে এই ঘরে বন্দী থাকব নাকি? আর এখানে যে আমার পাকাপাকি থাকা সম্ভব নয় তা তোরাত জানিস। হওয়ার হলে তুই আগে বালতিস না?

বেশ পাকাপাকি না সম্ভব হলে মাঝেমাঝে হতে পারে। হোস্টেলে এখনও তোর নাম আছে। তুই ওখানেই থাকবি। ছুটিছাঁটায় এই ঘর রইল। আপত্তি আছে?

শমিত এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার বলল, দীপা, রাধাের পক্ষে যেটা সম্ভব তুমি সেটা করতে পারো না। তাছাড়া রাধাকে বাড়িতে ফিরে রান্না করতে হয় না, মা-মাসী পাশে থাকে। ওই বাড়ি থেকে অতটা হেঁটে বাসস্ট্যান্ড, তারপর এতটা সময় রোজ দুবার গাড়িতে বসে থাকার ধকল তোমার শরীরের পক্ষে বেশী হয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি হোস্টেলেই তোমার থাকা উচিত।

সেটা ভুল বলেননি। মুশকিল হল বছরে দুবার দুমাস বন্ধ থাকে হোস্টেল। তখন কোথায় যাবো? মায়াদের এখানে কি বারবার আসা যায়?

কোন যায় না? গলা তুলল। মায়া।

শমিত হাত তুলল, কলেজ হোস্টেল ছাড়াও তো এখানে মেয়েদের থাকার জায়গা আছে। সেগুলোকেও তো হোস্টেল বলে।

ওয়ার্কিং গার্লস হোস্টেল। কিন্তু আমি তো চাকরি করি না।

মানলাম। কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি। ওরকম একটা জায়গা পেলে পরেও কোন অসুবিধে হবে না। অন্তত একই সঙ্গে তোমার শরীর আর আত্মসম্মানে কোন চিড় ধরবে না। বুঝলে খুকী?

এখন শুধু ক্লাস লাইব্রেরি। আর হোস্টেল। গত একমাস দীপা অন্য কোনদিকে তাকায়নি। অসুস্থতার কারণে সে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল পড়াশুনায়। শুধু বিকেলে লাবণ্যকে পড়াতে যায় নিয়ম করে। অসুস্থতার সময় একরকম অন্ধকারেই রেখেছিল সে ওদের। সেইসময় মনেও পড়েছিল। লাবণ্যর কথা। সে অসুস্থ ওই খবরটা ওদের দেওয়া দরকার মনে করেছিল। কিন্তু কাকে দিয়ে দেবে? যাকেই যেতে বলল সে-ই ফিরে এসে চোখ কপালে তুলল।

অসুখের পর প্রথম দিন যাওয়ামাত্র লাবণ্য হই। হই শুরু করে দিয়েছিল। বাচ্চা মেয়েটা চোখ ঘুরিয়ে গাল ফুলিয়ে অভিমান জানিয়েছিল। কথা শুনতে হবে এমন ধারণা নিয়ে গিয়েছিল দীপা।

দেখা হওয়ামাত্র ওর দিদিমা চোখ বড় করে বলেছিলেন, একি চেহারা হয়েছে তোমার? কি করে এমন হল?

অসুখ করেছিল। দীপা অপরাধীর মত হেসেছিল।

কি অসুখ? বসো বসো। দুহাত ধরে চেয়ারে বসিয়েছিলেন বৃদ্ধা, এবার আমি তোমায় বকব। ওইটুকু শরীরে এত কষ্ট করা পোষায়? সেই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে গিয়ে বাসা নিলে। মেয়েটা আসছে না দেখে গেলাম হোস্টেলে খবর নিতে। সেখানে কেউ নেই। ছুটি হয়ে গিয়েছে। তারপর হোস্টেল খুলতে সব মেয়ে এল, তুমি এলে না। আর নাতনীতো হেদিয়ে মালো তোমার জন্যে।

এখন আমি হোস্টেলেই ফিরে এসেছি। দীপা লাবণ্যর হাত ধরল।

আমি একটা কথা বলব?

বলুন। বলতে খুব সঙ্কোচ হয়। না, থাক। লাবণ্যর দিদিমা কথা ঘোরালেন, শরীর ঠিক না। হওয়া পর্যন্ত এখানে রোজ আসতে হবে না।

আপনি কি বলবেন বলেছিলেন?

ও কিছু না। দাঁড়াও আসছি। খুব দ্রুত সামনে থেকে সরে গেলেন মহিলা। লাবণ্য জিজ্ঞাসা করল, তোমার খুব অসুখ করেছিল??

হ্যাঁ। খু-উ-ব।

মন কেমন করছিল তখন? মেয়েটি বড় চোখে তাকল, আমার কথা ভাবতে?

হঠাৎ খোঁচা খেল দীপা। মিথ্যে কথাটা বলতে পারল না। সত্যি কথাটা বলতে জিভে আটকাল। সে হাসল। হঠাৎ লাবণ্য ছুটে গিয়ে টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে এল, তুমি এই বইটা পড়েছ? দীপা চমকে উঠল, কোথায় পেলে তুমি?

আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে দিয়েছে। ওদের বাড়িতে ছিল। এখানে না। আমার নামের একটা মেয়ে আছে, তাই। আমি বইটা পড়ব?

শেষের কবিতা হাতে নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল দীপা, এখন পড়লে তুমি বুঝতে পারবে না।

লাবণ্য মাথা নাড়ল, আমার বন্ধুও বলছিল। তুমি বুঝতে পারো?

দীপা ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল, না। ভাল পারি না। কেমন রক্তমাংসহীন লাগে লাবণ্যকে। এভাবে জড়িয়ে ধরা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *