1 of 2

৪৬. দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে

দ্বিতীয় অভিনয় হয়ে যাওয়ার পরে তিনদিন রিহার্সালে যায়নি দীপা।

তিনদিন আগে এক দুপুরে রাধার দাদা আর মা তার কাছে এসেছিলেন। তখন সরে স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিল সে। আগের রাতেই দ্বিতীয় অভিনয় হয়েছে ঢাকুরিয়ায়। সেখান থেকে বাড়িতে ফিরতে মোটেই রাত হয়নি। কিন্তু একটা কাণ্ড হয়েছে শো-এর পরে। কার্টেন কল-এর পরে সে যখন গ্ৰীনরুমে যাচ্ছিল পোশাক বদলাতে তখন একটি ছেলে এসে বলল, আপনাকে একজন ডাকছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।

কে? দীপা জিজ্ঞাসা করল।

নাম জিজ্ঞাসা করিনি।

সুদীপ যাচ্ছিল পাশ দিয়ে, শুনতে পেয়ে বলল, নাম জিজ্ঞাসা না করে ডাকতে এসেছ কেন? তোমাদের তো বলা হয়েছে উটকো লোক যেন শো-এর পরে ভিড় না করে। চল, আমি দেখছি। সুদীপ ছেলেটিকে নিয়ে এগিয়ে যেতে স্বস্তি পেয়েছিল দীপা। তখন এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে কথা বলার ইচ্ছেও ছিল না। গ্ৰীনরুমের মুখে শমিতের সঙ্গে দেখা, আজ তিনটি জায়গায় একটু বুলেছে। কাল রিহার্সালে এলে বলব।

খুব খারাপ হয়েছে?

খারাপ বলিনি। প্ৰথম রাতে যে হাইটে উঠেছিল তা থেকে নেমেছে। অবশ্য এটাই নিয়ম। সেকেন্ড শো-এ সবসময় এইরকম হয়। যদিও হবার কোন কারণ নেই। যাও, চেঞ্জ করে নাও, বেশী রাত করো না। শমিত কথাগুলো যখন বলছিল তখনই সুদীপ ফিরে এল, যে ভদ্রলোক দেখা করতে চান। তিনি বিখ্যাত চিত্র-পরিচালক সুবিনয় সেনের সহকারী। ওঁরা আগামী ছবির নায়িকা খুঁজছেন। আপনার অভিনয় দেখে খুব ভাল লেগেছে তাই কথা বলত চান।

শমিত বলল, সুবিনয় সেন?

না, ওঁর সহকারী। সুদীপ জানাল।

শমিত জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি দেখা করার আগ্রহ আছে?

দীপা মাথা নাড়ল, না। শমিত আর দাঁড়াল না। সুদীপ বলল, তাহলে কি বলব? আপনার অসুবিধে আছে?

না। বলুন ইচ্ছে নেই। দীপা গ্ৰীনরুমে ঢুকে গিয়েছিল।

সকাল থেকেই এই ব্যাপারটা মাথায় পাক খাচ্ছিল। দলের অনেকেই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেছে। সুবিনয় সেন খুব নামকরা চিত্র-পরিচালক। তাঁর সব ছবিই দর্শকদের ভাল লাগে। এরকম একজনের কাছ থেকে অফার পেয়েও কথা বলতে না যাওয়া মানে বিরাট সংযমের পরিচয়। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গিয়েছে অনেকেই নাটক করতে এত ভালবাসেন যে সিনেমার যান্ত্রিকতায় পা বাড়ান না। এসবই তার ক্ষেত্রে প্রশংসা হয়ে আসছিল। কিন্তু তখন তার মন ছিল না। এতে। আজ সকালে মনে হল ওরা ওকে অযথা বড় করেছে। নাটক করার আগ্রহ তার কখনও ছিল না। দুটো শো কোনমতে করে ফেলেছে। এর মধ্যে একদিন কৌতূহলী হয়ে লাইব্রেরি থেকে অভিনয়ের ওপর লেখা একটা বই নিয়েছিল সে। খানিকটা পড়ে মনে হয়েছিল সে কিছু না জেনেই স্টেজে নেমেছিল। যেন আন্দাজে মশলা দিয়ে হঠাৎ রান্না করতে গিয়ে মোটামুটি সুস্বাদু করে ফেলার মত ব্যাপার। ব্যাপারটা সুদীপকে বলেছিল। সে লক্ষ করেছিল সুদীপের সঙ্গে সহজ গলায় কথা বলা যায়। হোঁচট খেতে হয় না। কিন্তু শমিতের কথাবার্তায় কেমন যেন খোঁচা থাকে, মন খুলে কথা বলতে অসুবিধে হয়।

সুদীপ বলেছিল, অভিনয়রীতি, প্রয়োজনা, সেট, আলো নিয়ে অনেক বই বেরিয়েছে আজকাল। বিখ্যাত সব পরিচালকের অভিজ্ঞতা সেইসব বই-এর মাধ্যমে আমরা পাচ্ছি। ঠিক কথা, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কোনটে বেশী কাজে লাগে? বই-এর শিক্ষা না জীবন থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতা? আমার তো মনে হয় দ্বিতীয়টাই জরুরি।

এই সময় শমিত ঘরে ঢুকে বলেছিল, দুটোই।

অতএর তর্ক উঠল। সুদীপ বলেছিল, গিরিশ ঘোষ কোন বই পড়ে অভিনয় করেছিলেন? দানীবাবু? এঁদের অভিনয় দেখতে হাজার হাজার মানুষ ছুটে যেত।

শমিত হেসেছিল, তুমি আমি যাইনি। কারণ যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু গিরিশ ঘোষের নাটক পড়ে। আজ যদি অভিনয় করতে হয় ওই নাটকগুলো তাহলে অনেক ঝাড়াই বাছাই করতে হবে। যেটি নিবচিত হবে তার ওপর অনেক কলম চালাতে হবে। কারণ পাতায় পাতায় আবেগের বন্যা বইছে, যুক্তি চাপা পড়ে গিয়েছে। তাঁর অভিনয় দেখার সুযোগ পাইনি। কিন্তু লেখা পড়ে মনে হয় অভিনয়ের সময় আবেগ খুব বড় জায়গা নিত। আর কে না জানে একজন অভিনেতাকে আজকাল শুধু আবেগসর্বস্ব বলে ভাবতে পারি না। তাকে সংযত এবং বিশ্লেষণধর্মী হতে হবে। এর জন্যে শিক্ষা দরকার। প্রকৃত অভিনেতাকে অনুশীলন করতে হবে নিয়মিত, পড়াশুনা করে নিজেকে শিক্ষিত করতে হবে। আর সেই সঙ্গে আশেপাশের মানুষ এবং তাদের আচরণকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে। যে অভ্যোস একজন স্কুল শিক্ষকের মধ্যে দেখা যায় তা চায়ের দোকানের বয়ের থাকতে পারে না। আবার এক চায়ের দোকানের বয়ের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে যদি তুমি সেইরকম একটি বাস্তব চরিত্রকে নকল কর তাহলে হাস্যকর হয়ে যেতে পারে। যদি না শিক্ষালব্ধ ভাবনা প্রয়োগ করে তার কোনটা নেবে কোনটা বাদ দেবে স্থির করতে না পারো।

শমিত কথা শুরু করলেই সব তর্ক একসময় থেমে যায়। সেদিনও গিয়েছিল। কিন্তু দীপার ধারণা বদ্ধমূল হল সে অশিক্ষিত অভিনয় করছে। মায়ার সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলেছিল একদিন। মায়া বলেছিল, দুর। অত সময় কোথায় কলেজের পড়া, রিহার্সািল, ইউনিয়ন করার পর আলাদা করে নাটকের ওপর পড়াশুনা করার? শমিত যা দেখিয়ে দেয় তাই করি। ও আমার থেকে অনেক ভাল বোঝে।

হ্যাঁ, শমিত বোঝে। নাটক নিয়ে দিনরাত পড়ে আছে সে। কিন্তু একেবারে অন্ধের মত অনুকরণ করার কোন যুক্তি খুঁজে পায় না দীপা। তাই মনে হচ্ছে এইভাবে অভিনয় করাটা ঠিক হচ্ছে না। দ্বিতীয় শো-এর পরে এইটি বেশী করে মনে হচ্ছে। আর কাল রাত্রে সুবিনয় সেনের সহকারী যে উদ্দেশ্যে এসেছিলেন সেটা ভাবতেই একটা অস্বস্তি প্ৰবল হচ্ছিল। সিনেমায় অভিনয় করতে যাওয়া মানে অভিনয়কেই প্রফেসন হিসেরে নেওয়া। তার দ্বারা সম্ভবত নয়। এসব সত্ত্বেও মনের মধ্যে একটা গুনগুনানি তৈরি হয়েছিল। মনে পড়েছিল অনেককাল আগে এক কাকভোরে শেফালি তুলতে গিয়ে মালবাবুর বাড়িতে আসা এক তরুণ তার দিকে তাকিয়ে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তুলনা করেছিল। সেদিন সুচিত্রা সেনের কোন ছবি সে দেখেনি। কিন্তু কলকাতা শহরে এখন উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন যেভাবে রাজত্ব করছেন তা এড়িয়ে বাস করা মুশকিল। নিজের চেহারার সঙ্গে ভদ্রমহিলার কোন বাহ্যিক মিল নেই। তবু ছেলেটি বলেছিল কেন? আজ সিনেমার পরিচালক খোঁজ নিতে আসায় সেই সকালটা যেন নতুন করে ফিরে এল। ফলে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল দীপার।

চুল আঁচড়ানো শেষ হতেই বারান্দায় শব্দ হয়েছিল। মনে হয়েছিল রাধা এসেছে। গতকাল থেকে ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলেই সে অবাক হল। এখানে আসার পর মাসিমা একদিনও এ-বাড়িতে আসেননি। চোখাচে্যুখি হতেই ভদ্রমহিলা কেমন যেন হয়ে গেলেন। দীপা বলল, আরে, কি আশ্চর্য! আপনি এখানে? আসুন, আসুন। হাত ধরে সে ঘরে নিয়ে আসতে আসতে পেছন ফিরে রাধার দাদাকে বলল, আসুন।

বিছানায় বসিয়ে একমাত্র চেয়ারটি রাধার দাদার দিকে এগিয়ে দিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ভাল আছেন। আপনি?

আর কি করে ভাল থাকব। মা! কপাল তো একবার পুইড়াই ক্ষান্ত হয় না, বারে বারে পোড়ে। কত পাপ যে করছিলাম তার শান্তি পাইতেছি এখন  বলতে বলতে ভদ্রমহিলা ড়ুকরে কেঁদে উঠে আঁচলে চোখ ঢাকলেন।

রাধার দাদা চাপা গলায় বলল, মা, শান্ত হেও।

আর আমারে শান্ত হইয়া থাকতে কইস না তোরা। শান্ত হইয়া করুমটা কি? ভগবান আমার কথা শুনব? শুনব না। তার কান্না থামছিল না।

হকচকিয়ে গিয়েছিল দীপা। নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে মাসিমা?

কি হয় নাই তাই কও। তুমি তো সব জানো, জানো না?

আমি বুঝতে পারছি না মাসিমা।

এবার রাধার দাদা বলল, মা, তুমি আমাকে কথা বলতে দাও।

বল! যত ইচ্ছা বল। আমি আর পারি না! ভদ্রমহিলা নিঃশ্বাস ফেললেন শব্দ করে। দীপা কোন কুলকিনারা ভেবে পাচ্ছিল না।

রাধার দাদা জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে রাধা কিছু বলেছে?

কি ব্যাপারে বলুন!

গৌরাঙ্গ নামের একটি ছেলেকে নিয়ে কোন কথা?

দীপা শক্ত হল। তাহলে ঘটনা এই। তাহলে তার উচিত সত্যি কথা বলা। যা সত্যি তাই বললে রাধার উপকারই হবে। সে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল, হ্যাঁ।

কি বিপদ বলুন তো। আমি সারাদিন ব্যবসা নিয়ে থাকি, কিছুই দেখতে পারি না সংসারের আর এই ফাঁকে ও এমন একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসল!

কি কাণ্ড। রাধার মত মেয়ে কোন অন্যায় করতে পারে না।

আমিও তাই ভাবতাম।

আমি জানি না কাউকে ভালবাসা আপনাদের চোখে অন্যায় কিনা।

রাধার মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে রাধার দাদা বলল, এ নিয়ে তর্ক করতে চাই না। আচ্ছা, আপনার সঙ্গে যেদিন রাধা নাটক দেখতে গিয়েছিল সেদিন গৌরাঙ্গ সঙ্গে ছিল?

বিপদ কোন দিক দিয়ে আসবে ঠাওর করতে পারিছল না। দীপা, তবু সে সত্যি কথাটাই বলল, হ্যাঁ। ওঁর সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে দেখা হয়ে গিয়েছিল।

না, ওটা হঠাৎ দেখা হওয়া নয়।

আমি জানি না। কিন্তু কি হয়েছে বলবেন তো?

আপনার এই ঘরে কখনও গৌরাঙ্গ এসে রাধার সঙ্গে দেখা করেছে?

আমার এখানে? না। কক্ষনো নয়।

রাধার মা অবাক হয়ে তাকালেন ছেলের দিকে। তারপর বললেন, তুমি সত্য কথা বল মা।

বিশ্বাস করুন, এখানে গৌরাঙ্গবাবু কখনও আসেননি। আমি শুনেছিলাম জাত নিয়ে আপনাদের আপত্তি আছে। কিন্তু ওকে পড়াশুনা করার সুযোগ দিয়েছেন, নিজেরটা বুঝতে পারে ও। তখন–।

নিজেরটা যদি বুঝতে পারত তাহলে কোন কথাই উঠত না। পাকিস্তান থেকে যখন এসেছিলাম তখন সব ছেড়ে আসতে হয়েছিল। এ দেশে এ অবস্থায় থেকে জাত নিয়ে কদিন পড়ে থাকতে পারতাম?

রাধার মা বললেন, ওরে সব কথা বল, সব কথা খুইল্যা বল, ও যদি বন্ধুরে বুঝাইতে পারে, আমি তো আর কোন পথ দেখি না।

রাধার দাদা অন্যদিকে মুখ ফেরালো, রাধার বিয়ের জন্যে মা ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ছেলে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু কাল দুপুরে রাধা স্পষ্ট বলে দিল সে গৌরাঙ্গ ছাড়া অন্য ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না। মা মেনে নেয়নি। চিৎকার, বকাঝকা চলছিল। দুপুরে খেতে এসে আমি সব শুনে মাকে বোঝালাম অনেক করে। তার মেয়ে যদি এই করে শান্তি পায়, পাক। নিজের ভবিষ্যৎ নিজে বুঝে নিতে চাইছে। যখন তখন তাই নিক। আপনি নিশ্চয়ই জানেন গৌরাঙ্গরা থাকে বাসস্ট্যান্ডের ও-পাড়ায়। খেয়ে দেয়ে দোকানে যাচ্ছি এমন সময় গৌরাঙ্গর বাবার সঙ্গে দেখা। দু-একটা কথার পর ওঁকে বললাম যে সামনের রবিবার ওঁদের বাড়িতে আমি যাব। তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন বললাম, মনে হয় আপনার ছেলের সঙ্গে আমার বোনের ভাব হয়েছে। দুজনেই যখন প্ৰাপ্তবয়স্ক তখন বিয়েটা দেওয়া দরকার।

তারপর? দীপার মনে হচ্ছিল ভদ্রলোক বেশ আধুনিক। উদার।

উনি কথা শুনে খুব খেপে গেলেন। বললেন, এদেশে এসে আমরা অধঃপতনে গিয়েছি। ছেলে ধরার জন্যে মেয়েকে লেলিয়ে দিচ্ছি, এইসব। আমারও রাগ হয়ে গেল। দু-একটা কথা শুনিয়ে দিলাম। জাতটাতের কথাও এসে পড়ল। উনি বললেন জাত ধুয়ে জল খেতে। জাত-ফাত ছিল পূর্ববঙ্গে। এখানে শুধু টাকা দিয়ে পরিচয় হয়। তার ছেলের জন্যে যেসব সম্বন্ধ আসছে তারা এত দেবে অত দেবে। ওই টাকা পেলে তিনি মেয়ের বিয়ে দেবেন। আর কথা না বাড়িয়ে আমি দোকানে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কাজে মন দিতে পারছিলাম না। বোনটার জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তাই সন্ধের পরে দোকান বন্ধ করে আবার ওঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন কুড়ি ভরি সোনা, বিশ হাজার টাকা নগদ না পেলে ছেলের বিয়ে আমার বোনের সঙ্গে দেবেন না। অনেক অনুরোধেও নরম হলেন না। আমি তখন গৌরাঙ্গর সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। সে এল। সব শুনে বলল, তার বাবা যা বলেছেন তার বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয়। রাধার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মাত্র, তার বেশী কোন ঘনিষ্ঠতা নেই। শুনে আমি হতভম্ব।

তারপর? দীপার গলার স্বর পাল্টে গেল। সমস্ত শরীর রাগে জ্বলতে শুরু করেছে এর মধ্যে। রাধার দাদা বলল, ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে গেলে কিছু বলার ছিল না। বাড়িতে ফিরে এসে সেই যে রাধা ঘরে ঢুকে দরজা দিয়েছে তা এখন পর্যন্ত খোলেনি। কি করব ভাবতে পারছি না!

সে কি! কাল থেকে খাওয়া দাওয়া করেনি?

না। অনেক ডাকাডাকি হয়েছে সাড়া দিচ্ছে না। একটু একটু করে পাড়ার লোক এই নিয়ে ফিসফিসানি শুরু করেছে। তাই মাকে বললাম। আপনার কাছে আসতে। আপনি যদি এই ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারেন।

ও হো, আমাকে খবর দিলেই আমি চলে যেতাম। চলুন। এখনই।

আপনার খাওয়া দাওয়া হয়েছে?

ছেড়ে দিন তো! আগে দেখি রাধা কি করছে?

রাধার মা বললেন, সকাল থিকা তো বাসায় উনান ধরাই নাই। ভাত খাইয়া আইতে কমু তারও তো উপায় নাই।

আপনি ব্যস্ত হবেন না তো! আমার এখানে সব তৈরি আছে।

রাধার দাদা বলল, আপনারা আসুন, আমি এগিয়ে যাচ্ছি।

দীপা বুঝল একসঙ্গে রাস্তায় হাঁটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যেই এই ব্যবস্থা। ভাল লাগল, অন্তত এই সময়ে পাড়ার লোকজনের কৌতূহল না বাড়াতে এটাই দরকার ছিল। মাসিমাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দরজায় তালা দিয়ে কয়েক পা এগোতেই বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা। ভদ্রলোকে মুখ করুণ করে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, কথাটা সত্যি নাকি?

কি কথা? রাধার মা মুখ নামালেন।

আপনার মাইয়ার নাকি অসুখ হইছে?

রাধার মা কিছু বলার আগেই দীপা বলল, ঠিকই শুনেছেন। তবে খারাপ কিছু না, একটু জ্বর সর্দি এই আর কি। চলুন মাসিমা।

জায়গাটা পেরিয়ে এসেই ভদ্রমহিলা কাতর গলায় বললেন, শোনলা তো? তুমি না কইলে কি জবাব দিতাম কি জানি! এখন তো দেখা হইলেই সবাই এক কথা জিগাইবো। ভগবান। কেন মরণ হয় না!

আপনি মন শক্ত করুন মাসিমা। কে কি বলল তাতে একদম কান দেবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। রাধা আপনাকে কষ্ট দিতে পারে না।

 

উঠোনে ঢুকেই দীপা বুঝল বাড়িটা কাঁটা হয়ে আছে। এদের বাড়িতে আরও কিছু মহিলা এবং কাচ্চা বাচ্চা আছে। তাদের মুখ চেনা কিন্তু কথাবার্তা হয়নি। রাধা বলে মাঝে মাঝেই কিছু জ্ঞাতি ট্রানজিটে এখানে আসেন। এরাত উদ্বিগ্ন। দীপা মাসিমাকে ছেড়ে এগিয়ে গেল একটা বন্ধ দরজার দিকে। তারপর সেখানে মৃদু শব্দ করে ডাকল, রাধা, আমি দীপা, দরজা খোল, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

দীপা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। এ বাড়ির সবাই খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে।

মিনিট খানেক গেল। এর মধ্যে দীপা আর একবার ডেকেছে। তার ধারণা হল রাধা দরজা খুলবে না। কী করবে। মাথায় আসছিল না। মরিয়া হয়ে তৃতীয়বার ডাকতে যাওয়ার সময় দরজা খুলল। অল্প। দীপা চট করে ঘরে ঢুকে আবার দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল। একটা তক্তাপোশ ঘর ভর্তি জিনিস। দরজা খুলে দিয়েই রাধা আবার সেই তক্তপোশে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে।

নিঃশব্দে কাছে গিয়ে রাধার পিঠে হাত রেখে দীপা জিজ্ঞাসা করল, তুমি এমন করছ কেন? সত্যি বল তো, তুমি কি চাও?

মরতে। শুকনো গলা, অনেক কান্নার পরে শুকিয়ে যাওয়া গলা।

ওঠ তো, উঠে বসো।

রাধা নড়ল না। একই ভঙ্গীতে পড়ে রইল। দীপা বলল, তুমি ওঠ, রাধা।

এবার একটু সময় নিয়ে ধীরে উঠে বসল সে। দীপা ওর মুখ দেখে চমকে উঠল। বারো তেরো ঘণ্টাতেই এমন শুকিয়ে যায় কেউ? সে পাশে বসে দুহাতে ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, তুমি এত বোকা, ছি! আমি ভাবতে পারিনি। আমি তোমাকে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের থেকে আলাদা বলে জানতাম। এমন করছ কেন?

ঠোঁট কামড়ালো রাধা। তার ডান চোখ দিয়ে একটা জলের ধারা গড়িয়ে এল।

তোমার বন্ধুত্ব গৌরাঙ্গীবাবু অস্বীকার করছে। লোকটার মেরুদণ্ড নেই যে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে সত্যি কথা বলবে। এমন একটা লোকের জন্যে তুমি কষ্ট পাচ্ছ?

রাধা জবাব দিল না মুখে, তার মাথা দুবার নড়ে উঠল।

গৌরাঙ্গ তোমার যোগ্য নয়। তার জন্যে কেন চোখের জল ফেলবে?

আমি, আমি ওকে ভালবাসি! খুব নিচু, কান্না মেশানো শব্দগুলো, রাধার গলা থেকে বেরিয়ে এল।

দীপা বলল, কাকে ভালবাস? একটি স্বার্থপর বিশ্বাসঘাতককে?

রাধা উত্তর দিল না। দীপা সময় নিয়ে বলল, কিছু মনে করো না রাধা, ওর সঙ্গে মিশে, কথা বলে বুঝতে পারোনি ওর চরিত্র কি! ও তোমাকে সত্যি ভালবাসে কিনা! নিজের মন এভাবে মুক্ত করার আগে জানতে চাওনি?

ভাবিনি। কথা কম বলা ওর অভ্যোস। আমি কি করব?

যাক গে। যা হবার হয়েছে। এখন তো সব বুঝতে পারছি। কাল থেকে দরজা বন্ধ করে আছ। তুমি নিজে যেমন কষ্ট পাচ্ছ বাড়ির সবাইকে আরও উদ্বিগ্ন করে রেখেছ। মাসিমার কথা ভাব। ওঠ, বাথরুমে যাও।

না।

কেন?

আমার মরে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই দীপা। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল রাধা। তারপরেই ঘরে দুহাতে দীপাকে জড়িয়ে ধরল।

কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল দীপা। কাঁদতে কাঁদতে রাধা জড়ানো গলায় বলল, আমি মরে গেছি দীপা, আমি মরে গিয়েছি।

মরে গিয়েছ মানে?

ও যদি আমাকে বিয়ে না করে তাহলে আর আমার বিয়ে হবে না। এবার কথাগুলো এমন আর্তনাদ হয়ে বাজল যে কেঁপে উঠল দীপা। আমচকা সমস্ত শরীরে একটা শিহরন বয়ে গেল। এই শিহরন বরফের স্রোতের মত। তবু কোনমতে সে উচ্চারণ করল, কেন, কি হয়েছে? এ কথা বলছি কেন?

ওকে ছাড়া আমি কাউকে ছুঁতে পারব না। কান্না আর থামছিল না।

দীপা পাথর হয়ে গেল। যৌবন শুরু হবার আগেই যে আতঙ্ক শ্ৰীযুক্ত অতুলচন্দ্র একটি রূত্রে তার মনে বপন করেছিলেন তা তো উপড়ে ফেলা হয়নি। শুধু সময়ের ধূলো জমেছে পুরু হয়ে। তারপরে কেউ তাকে বলেনি নরনারীর শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে কোন কথা। কোন বইতেও বিশদ পড়ার অবকাশ হয়নি। কিন্তু শরীর এবং মনের বয়স বাড়ার সঙ্গে কখন কেমন করে এ বিষয়ে সচেতনতা এসে গিয়েছে তা সে জানে না। সেই বোধ থেকেই ওর মনে হল রাধা চূড়ান্ত সর্বনাশ করে বসে আছে। বিয়ের পর যেটা পাঁচজনের কাছে স্বাভাবিক, যা তার নিজের কাছে ভয়ঙ্কর, বিয়ের আগে তার অভিজ্ঞতা মানে অনেক বড় কিছু হারানো।

কবে হয়েছে? দীপা রাধার হাত ছাড়িয়ে তক্তাপোশের ওপর বসে পড়ল।

তিনবার।

কিন্তু কবে?

শেষবার যেদিন তোমার নাটক দেখতে গিয়েছিলাম।

দীপা হতভম্ব হয়ে গেল। নাটক দেখতে যাওয়া এবং আসার সময়ে সে ওদের সঙ্গে ছিল। শুধু সে ভেতরে চলে যাওয়ার পর ঘণ্টা চারেক ওরা আলাদা একসঙ্গে কাটিয়ে ছিল। তারমধ্যে–? ওরা নিশ্চয়ই হল থেকে বেরিয়ে কোথাও গিয়েছিল। কিন্তু রাধা তো নাটকের ব্যাপারে বিস্তারিত বলেছে। গেলে জানবে কি করে?

নাটক দ্যাখোনি তোমরা?

হুঁ। তার মধ্যেই, ওকে মানা করেছিলাম, শোনেনি।

কি বলছি তুমি? ও তোমাকে কি করেছে খুলে বল তো?

আমি বলতে পারব না।

আঃ, না বললে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

একটু সময় নিল রাধা। তারপর বলল, আমার বুকে হাত দিয়েছিল। এর আগে দুবার চুমু খেয়েছে। স্বামী ছাড়া কেউ এসব করে না। আমি ওকে ছাড়া আর কাউকে তাই স্বামী বলে ভাবতে পারব না।

কথা না বলে চুপচাপ রাধার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল দীপা। এবং একই সঙ্গে সেই শীতল স্রোত যেন হুড়মুড়িয়ে নেমে গোল শরীর থেকে। তারপরেই হালকা গলায় বলল, উঃ, তুমি আমাকে এমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।

তার মানে?

দীপা বলল, একসঙ্গে ক্লাস করেছি, কত কথা বলেছি তোমার সঙ্গে কিন্তু তুমি এত সেনসিটিভ কখনও ভাবিনি। ভেবে দ্যাখো, তুমি বোকামি করছ কিনা। এককালে কোন পুরুষ বাঙালি মেয়ের হাত ধরলে তার সতীত্ব যেত। আমি জানি না, তারও আগে অবিবাহিতা মেয়েকে কোন পুরুষ দেখে ফেললে তার বিয়ে হত কিনা! আজ থেকে একশ বছর আগে জন্মালে তুমি কোন ছেলের সঙ্গে করমর্দন করতে না। করলে এই অবস্থা হত।

যাঃ, এই দুটো ব্যাপার এক হল?

না, এক নয়। কিন্তু একজনকে বন্ধু হিসেরে গ্রহণ করেছিলে, সে তোমাকে আদর করেছিল, ওই মুহূর্তে নিশ্চয়ই তোমার আদর বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু পরে দেখলে সেই লোকটা বিশ্বাসঘাতক। একমাত্ৰ মনের ওপর আঘাত দেওয়া ছাড়া সে তোমার কি ক্ষতি করছে? তুমি যেভাবে শুরু করেছিলে তাতে আমি ভয় পেয়েছিলাম নরনারীর সম্পর্কের চূড়ান্ত মিলন তোমাদের হয়ে গিয়েছে, তুমি ওর সন্তানের মা হতে যাচ্ছ। অদ্ভুত। দীপা কথাগুলো বলে হেসে উঠল।

যা, অসভ্য। রাধার মুখ লাল হয়ে গেল, আজেবাজে কথা বলছে।

ওঠ তো! যাও বাথরুম থেকে ঘুরে এসো। চেহারার কি হাল করেছ। আয়নায় দেখলে বুঝতে পারবে। এই করেই বাঙালি মেয়েরা মরল।

কিন্তু আমি যে ওকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারছি না।

কেন? তোমার শরীরে হাত দিয়েছে বলে? আচমকা কঠোর হয়ে গেল দীপা।

না, মানে, সব মিলিয়ে–।

শোন রাধা, তুমি তৈরি হয়ে নাও। তারপর আমার সঙ্গে বের হবে।

কোথায়?

তুমি গৌরাঙ্গর সঙ্গে কথা বলবে।

যদি দেখা না করতে চায়?

করবে। তুমি যেটা দাদার মুখে শুনেছ সেটা সরাসরি জেনে এসো।

রাধার মুখ উজ্জ্বল হল। দীপা ওকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসতেই উদ্বিগ্ন মুখগুলো দেখতে পেল। রাধা বাথরুমে চলে যেতেই ওর মা ছুটে এলেন কাছে, কি বলল?

দীপা হাসল, ঠিক আছে, কোন ভয় নেই।

কোনরকম–? প্রৌঢ়া শব্দটি উচ্চারণ করতে যেন সাহস পাচ্ছিলেন না।

না। নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কোন ধারণা দীপার এর আগে হয়নি।

 

এই ব্যাপারটা নিয়ে দীপা পরে অনেক ভেবেছে। পনের থেকে একুশের মধ্যে বাঙালি মেয়েদের পঞ্চাশ শতাংশ অন্য ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হয়। মায়া বলেছিল বেশিরভাগ রক্ষণশীল বাড়ির মেয়েদের প্ৰেম-ধারণা তৈরি হয় তুতোদাদাদের মাধ্যমে। ওসব ক্ষেত্রে গুরুজনদের সন্দেহ চট করে আসে না। কিন্তু প্ৰথম প্রেমের ক্ষেত্রে এইসব মেয়েরা যেরকম সিরিয়াস হয় তা বিচার করলে কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। এদের তুলনায় ছেলেদের অধিকাংশ অনেক বাস্তব। ফলে সামান্য কারণে মেয়েরা যে আঘাত পায় তা তাদের অনেককেই চিরদিনের জন্যে নড়বড়ে করে দেয়। শরীরের পরিবর্তন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনের হাওয়াবদলের এই ঝাপটা এড়াতে পারে না অনেকেই। চোরাগোপ্তা, লুকিয়ে চুরিয়ে ঘটনা ঘটানোর কারণে দুঃখটা বোধহয় বেশী করে বাজে। রাধাকে নিয়ে গৌরাঙ্গর কাছে গিয়েছিল সে। গৌরাঙ্গ মুখের ওপর অস্বীকার করতে পারেনি। কিন্তু জানিয়েছিল ঠিক ওই মুহূর্তে বাবা মাকে অস্বীকার করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে সম্ভব নয়। নির্জন মাঠে বসে রাধা কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাঁদেনি। উল্টে গালাগাল দিয়েছিল। সেটা মাথা নিচু করে হজম করেছিল গৌরাঙ্গ। ব্যাপারটা সেখানেই চুকে গেল। এই ঘটনাই অন্য চেহারা নিতে পারত যদি সেদিন দীপা না যেত। এখন রাধা স্বচ্ছন্দে উচ্চারণ করতে পারে, আমি কি বোকামি করেছিলাম, না!

তৃতীয় শো হল দক্ষিণ কলকাতার একটি মঞ্চে। এটিও কল শো। এখন মায়া নিয়মিত রিহার্সালে আসছে। যদিও তার শরীর পুরো সুস্থ হয়নি। তৃতীয় শো-এর পরে দীপা আর অভিনয় করবে না জেনে সে অনেক বুঝিয়েছে ওকে। কিন্তু দীপা বলেছে অভিনয় সে মোটেই করতে পারছে না। শুধু মুখস্থ করা সংলাপ আওড়ে যাচ্ছে। দক্ষতা না নিয়ে কোন কাজ করা উচিত না। তা ছাড়া অভিনয় করতে সে কলকাতায় আসেনি। মায়া যখন সুস্থ হয়ে উঠেছে তখন দলের সমস্যাও মিটে যাওয়া উচিত। সে শুধু শূন্যস্থান পূর্ণ করতে এসেছিল। রিহার্সালের দিন তবু ম্যানেজ করা যায়। কিন্তু শো-এর রাতে বাড়ি ফিরতে খুব মুশকিল হয়। দীপা ঠিক করল এটাই তার শেষ অভিনয়। এসব কথা শমিত ভাল জানে। কিন্তু ইদানীং এ নিয়ে কোন কথা বলেনি সে। কাজের কথা বলেছে নির্লিপ্তভাবে। রিহার্সালে কোন কিছু দেখানোর সময় অবহেলা করেনি এই ভেবে যে এটাই দীপার শেষ শো।

আজ রাধাকে নিয়েই গিয়েছিল দীপা। যেহেতু দক্ষিণ কলকাতায় মঞ্চ তাই রাধার দাদাকে অনুরোধ করেছিল শো-এর পরে সেখানে আসতে। নাটক দেখার সময় তার নেই, কিন্তু ওই সময় তার অসুবিধে হবে না। পাড়ায় কয়েকদিন হল বেশ গোলমাল হচ্ছে। জমি নিয়ে ঝগড়া অনেক দূরে পৌঁছেছে। রাত করে একা ফিরতে নিষেধ করেছিল অনেকেই।

রাধা দীপার সঙ্গে গ্ৰীনরুমেই বসেছিল। মায়া সাহায্য করছিল দীপাকে। আজ যেন অনেকেই খুব গম্ভীর হয়ে পড়েছে। এমন কি সুদীপ পর্যন্ত দেখা হলে ভাল করে কথা বলল না। ফার্স্ট বেল পড়ার পর দেবেশদা এসে দেখে গেল। ঠিক আছে ছাড়া তৃতীয় শব্দ উচ্চারণ করেনি। মায়া কথা বলছিল সহজভাবে। দীপা তাকে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে সবার? ঠোঁট ওলটালো মায়া, কি জানি!

আজ প্ৰথম থেকেই অভিনয় করতে ভাল লাগছিল। সংলাপ বলার সময় অথবা যেখানে কথা নেই। সেখানেও সে ছিল অনবদ্য। শো-এর পরে সাজঘরে এলে মায়া উচ্ছ্বসিত প্ৰশংসা করছে। যখন তখন শমিত এল, দীপা, একটু বাইরে এস।

অবাক হয়ে সাজঘরের দরজা পেরিয়ে এসে দীপা দেখল শমিতের পাশে দুজন বয়স্ক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। শমিত পরিচয় করিয়ে দিল, এই হল দীপাবলী আর ইনি সুবিনয় সেন, বুঝতেই পারছি, আর উনি প্রয়োজক।

সুবিনয় সেন নমস্কার করে বললেন, আমার সহকারীর কাছে শুনেছিলাম আজ নিজের চোখে দেখে যাকে বলে মুগ্ধ তাই হয়ে গিয়েছি। অপূর্ব–। খুব ভাল লেগেছে ভাই। তুমি অনেক ছোট, তোমাকে তাই তুমি বলছি।

অনেক ধন্যবাদ। দীপা নিচু গলায় বলল। আমি শুনেছি। তুমি ফিল্মের অভিনয় করতে চাও না। কথাটা কি ঠিক?

হ্যাঁ।

কিন্তু কেন? সুবিনয় সেন বললেন, এ তো ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা। এর ব্যবহার না করার কোন কারণ আছে? তোমার বাড়িতে আপত্তি আছে?

এটা আমিই ঠিক করেছি।

কিন্তু কেন?

এসব নিয়ে আমি কখনও ভাবিনি। আপনারা আমাকে প্ৰশংসা করছেন। কিন্তু আমি জানি যদি কিছু করে থাকি সেটা এমনি হয়ে গিয়েছে, আমি জেনে-শুনে করিনি। এই ঘটনা বারে বারে ঘটে না।

ঠিক আছে, তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমি জানি না তুমি আমার কোনো ছবি দেখেছ কিনা। আমি তোমাকে চরিত্রটি পড়ে শোনাবো। তারপরেও যদি না বলতে ইচ্ছে করে বলো।

আমি আপনাকে কথা দিতে পারছি না। তবে এত করে বলছেন যখন তখন আমি ভেবে দেখব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *