1 of 2

৪১. বিছানায় টান টান দীপা

বিছানায় টান টান দীপা ফিস ফিস করে বলল, আমি কি ঠিক করছি? এই বলাটা এমন নিঃশব্দে যে তার শরীরও যেন শব্দগুলো টের পেল না।

ঘর অন্ধকার। হোস্টেলের অন্যত্র একটু হাসির আওয়াজ, চিৎকার করে কোন সিরিয়াস ছাত্রীর পড়া চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা এবং সামনের রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ গাড়ির শব্দ ছাড়া পৃথিবী এখন ঘুমের দিকে ঢলছে। নিজস্ব ঘরে, নিজস্ব বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে দীপা নিঃশব্দে ওই প্রশ্নটি দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করল, করতেই অসীমের মুখ মনে পড়ল এবার।

বিবাহিতা মেয়েরা ইণ্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস পরীক্ষায় বসতে পারবে না! কেন? অসীম খবর নিয়েছে? কেন নিল! কেন নিয়েছে তার জবাব অবশ্যই সরল। মানুষ মানুষকে আটকাতে চায়। সে যদি আই এ এস হতো তাহলে কি অসীম অসুবিধায় পড়ত? হয়তো। তাই খোঁজ নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বুর্ক ফুলিয়ে কথাগুলো বলে ট্রাম থেকে নেমে গিয়েছে। আমার কথায় যখন রাজি হচ্ছে না। তখন মরো গিয়ে। এ কি রকম চাওয়া! কাউকে বাধ্য করে কি ভালবাসা আদায় করা যায়? তোমার চারপাশে সব দেওয়াল তুলে যে ফাঁকটুকু রেখেছি তাই গলে আমার রাস্তায় চলে এসো!

কিন্তু অসীমের কথাবার্তায় মিল থাকছে না কেন? স্পষ্ট মনে পড়ছে প্ৰথম আলাপের দিনগুলোতে অসীম নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনা অন্যরকম বলেছিল। ওরা তিন ভাই। বাবা কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন। বড়বাজারে বড় ব্যবসা আছে। দাদারা সেই ব্যবসা থেকে খুব কালো টাকা রোজগার করছে। অসীমের ওসব ভাল লাগে। লা। সে জীবনটাকে অন্যভাবে দেখতে চায় বলে বাড়িতে তার অবস্থা খুব আদরের নয়। ব্যবসা না করে সে এম এ পড়বে, রুচি, শিক্ষা এবং সৌজন্য দিয়ে একটা জীবন গড়বে।

হ্যাঁ, ঠিক এসব কথা বলেছিল অসীম। কফিহাউস থেকে ফেরার পথে এইসব কথা হয়েছিল। নাকি কফিহাউসে বসেই? সেই অসীম আজ নিজের সম্পর্কে উল্টো কথা বলল। দিল্লী যাচ্ছে চাকরি নিয়ে। সেই চাকরি যিনি দিচ্ছেন তিনি ওই মাইনেতে অসীমকে দিয়ে যাচ্ছেন পারিবারিক বন্ধু হিসেরেই। কেন? চাকরি কেন করবে অসীম পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে? যাদের পৈতৃক ব্যবসায় অত কালো টাকা তাদের তো সাদাও কিছু থাকে। সেই সাদাতে নিশ্চয়ই অংশ রয়েছে অসীমের। সেসব ছেড়ে দিয়ে কেন খামোকা ও দিল্লী যেতে চাইছে? হঠাৎ মনে হল অসীমের এই দিল্লী যাওয়ার ব্যাপারটাই বানানো নয়তো? স্রেফ তার ওপর একটা চাপ তৈরী করার জন্যে অভিনয় করে গেল হয়তো। এতদিন আড়ালে থেকে এমন কথা বলার জন্যে যখন কেউ আসে তখন–! চোখ বন্ধ করেই মাথা নাড়ল দীপা। না, সে যাচাই করবে না। অসীমের বাবা আছেন। কিনা, দাদারা ব্যবসাদার কিনা। এসব যাচাই করে সত্যি জেনে তার কোন লাভ হবে না। সত্যি হলেও যা, না হলেও তা। আজ যার দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল বুকের ভেতরে অনেকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে তার সম্পর্কেই যদি এত তাড়াতাড়ি সন্দেহ গুঁড়ো লঙ্কার মত জড়িয়ে যায় তাহলে চোখ কানের তৃপ্তির কোন দরকার নেই। মানুষ চোখ কান মুখ নিয়ে সারাদিন যুদ্ধ করে যেতে পারে। কিন্তু মনের শান্তি ছাড়া রাতের ঘুম খুঁজে পায় না।

কিন্তু আই এ এস পরীক্ষায় যদি বসার সুযোগ সে না পায় তাহলে কি করবে? বি এ পরীক্ষা দেওয়া পর্যন্ত জীবনটা সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করেও এই কটা দিন কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু তারপর? এম এ পাশ করে একটা স্কুলে অথবা কলেজে চাকরি খোঁজা, ভাগ্য কতটা সাহায্য করবে, পরিস্থিতি কতটা অনুকূলে থাকবে? আজ টিউশনিতে সে একধরনের নতুন শক্তি আবিষ্কার করেছে। যে শক্তি থাকলে জীবনের সবরকম অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়। নিজের ওপর আস্থা আসছে। একটায় না। কুলোলে দুটো, প্রয়োজন হলে আরও বেশী ছাত্রী পড়াবে সে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসে রাধা। যদি এতটা লড়াই করতে পারে তাহলে সে পারবে না কেন? ফুলশয্যার রাত্রে যে লড়াই শুরু হয়েছিল তার বোধ হয় কোন শেষ এ জীবনে নেই। কিন্তু তাকে যেতে হবে জীবনের অনেক ওপর তলায়। যেখানে পৌঁছে মেয়ে হিসেরে কারও অনুকম্পা পাওয়ার বদলে মানুষ হিসেরে নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে। এতকাল তার মনে হয়েছিল আই এ এস পরীক্ষায় পাস করে চাকরিতে ঢোকা সেই ইচ্ছেটাকে সহজ করার অন্যতম পথ। কিন্তু অসীম আজ সবকিছু গোলমাল করে দিয়ে গেল। যেন গভীর জলের মধ্যে ড়ুব সাঁতার দিতে দিতে বুকের ভেতর অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা আবিষ্কার করল দীপা। না, ভেবে কোন লাভ নেই। তাকে যেতে হবে সেই বালকের মত যে পাহাড়ি রাস্তায় চলার সময় শুধু সামনের বাঁকের দিকে চোখ রাখে। বাঁ কিংবা ডাইনে মোড় নিতে নিতে ওপরে ওঠার সময় আগে থেকেই দ্বিতীয় অদেখা বাঁকটির কথা যে চিন্তা করে না। ওপরে ওঠার সেটাই সবচেয়ে বুদ্ধিগ্রাহ্য উপায়। সমস্যা যা আসবে তাই নিয়ে ভাবা, তারই মোকাবিলা করা। সুদূরের কথা আগাম চিন্তা করা বোকামি। কাল প্রথম কাজ হবে খোঁজ নেওয়া, সত্যি সে আই এ এস পরীক্ষায় বসতে অক্ষম কিনা। সেইটো সঠিক জায়গায় না জানা পর্যন্ত কোন চিন্তা নয়।

জীবন মানেই সুখের স্মৃতি বয়ে বেড়ানো, বেঁচে থাকা মানেই দুঃখের সঙ্গে অজান্তেই সহবাস করা। অবিমিশ্র সুখ মানুষের ভাগ্যে কখনই লেখা হয় না। সুখ বাঁচিয়ে রাখতে সবচেয়ে বেশী অস্বস্তি অনুভব করে মানুষ। যে কোন ছলছুতোয় সে দুঃখকে ডেকে নিয়ে আসে। সুখের চেয়ে দুঃখের সঙ্গে বাস করতে মানুষ বড় আরাম বোধ করে। কারণ অতি সুখে হাহাকার থাকে না। সন্দেহ, জ্বালা অথবা নিজেকে বঞ্চিত ভাবার যন্ত্রণা পাওয়া যায় না। কোন এক মুহূর্ত, অথবা কিছু দিনের বুকে খুশির সূচীকর্ম সারা জীবন টাঙিয়ে রাখার নাম জীবন। মানুষ তাতেই অভ্যস্ত। দীপা নিঘুম রাত্রে এমন কোন সুখের কথা ভাবছিল যার স্মৃতি লালন করা যায়। একমাত্র সেই চা-বাগানের ছেলেবেলার দিনগুলো ছাড়া আর কোন সুখের ছবি মনে আসছে না। চোখ বন্ধ করেও একটা ভরাট দিন মনে তুলে আনতে পারছে না। দীপা উঠে বসল। না, সে অসীমকে ভালবাসেনি। আজ পর্যন্ত কোন পুরুষকেই সে ভালবাসেনি। বেঁচে থেকে যদি নারী কোন পুরুষকে ভাল না বাসে অথবা ভালবাসা না পায় তাহলে তার জন্যে কোন সুখের স্মৃতি জমানো থাকে না। তার মানে জীবন মানে এক্ষেত্রে সুখের স্মৃতি বয়ে বেড়ানো নয়। কিন্তু নিয়ম যা তা চিরকালই নিয়ম, তার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হবার কোন কারণ নেই। তাহলে দুঃখ আসার আগে তো যত ক্ষণস্থায়ী হোক, সুখ তুর জীবনে আসবেই আর এলে সে নিশ্চয়ই টের পারে। হেসে ফেলল দীপা, তারপর পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করল।

 

সকালটা কেটেছিল ছটফটানি নিয়ে। দুপুরে সেটা কেটে গেল। কেটে যাওয়ার পর, যেন সমস্ত ময়লা থিতিয়ে যাওয়া টলটলে দিঘির মত হয়ে গেল মনটা। অদ্ভুত আরাম, কারো জন্যে কোন আক্ষেপ নেই। এমন কি সেটা যদি অসীমও হয়, তবু। অসীমকে তার মোটেই খারাপ লাগছে না। একটুও শত্ৰু বলে মনে হচ্ছে না। স্বাধীনতার পর পর ভারতীয় বিবাহিতা মেয়েদের আই এ এস পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হত না, কিন্তু এই অন্যায় নিয়মটা যে তুলে দেওয়া হয়েছে তা অসীম জানত না। জানত না বলেই হাতিয়ার করেছিল। কেউ ভুল অস্ত্র নিয়ে লড়াই করছে জানার পর তার জন্যে একধরনের মায়া হয়।

কলেজ স্ট্রীটে নেমে দীপা একবার প্রেসিডেন্সি কলেজের দিকে তাকাল। এখানে এলেই সত্যসাধন মাস্টারমশাই-এর মুখ মনে পড়ে। ওঁর খুব ইচ্ছে ছিল সে ওই কলেজে পড়ে। ভর্তি হবার সুযোগ পায়নি বলে এখন কোন আফসোস নেই দীপার। কিন্তু একটা কথা খুব মনে পড়ে, মাস্টারমশাই বলতেন, যখন কোন কিছু শুরু করবে। তখন এক নম্বর থেকে করবে। জীবনের যা কাজ তা সেরা জিনিসে দাঁড়িয়ে করবে। এর একটা আলাদা প্রভাবআছে। হয়তো আছে। কিন্তু ভাবনা আর বাস্তবের মধ্যে যে মাঝে মাঝেই কোন সেতু থাকে না। এই কলকাতা শহরে তার একটা নিরাপদ থাকার জায়গার দরকার ছিল।

জীবনে প্ৰথমবার এক কফিহাউসে উঠল দীপা। সমুদ্রের পাশে কোনদিন যায়নি সে। পড়া, শোনা এবং ছবিতে দেখা বর্ণনার সঙ্গে এই আওয়াজটা মিলিয়ে নিয়ে সমুদ্র গর্জন ভাবতে খারাপ লাগে না। ভেতরে ঢুকতেই অনেক টেবিল থেকে তার দিকে নজর ছুটে এল। এবং এইসময় সে অসীমকে উঠে দাঁড়াতে দেখল। কোণের টেবিলে তিনটি ছেলের সঙ্গে অসীম বসেছিল। তাকে দেখে যে খুব অবাক হয়েছে বুঝতে অসুবিধে হল না। দীপা এগিয়ে গেল। অসীম ঠিক বুঝতে পারছিল না কি করা উচিত। দীপা হেসে বলল, তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।

কি ব্যাপার? অসীম কোনক্রমে প্রশ্নটা করল। তাকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল।

কোন ব্যাপার নেই। এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম, মনে হল তুমি গোকতে পার তাই চলে এলাম। বসতে বলতে অসুবিধে আছে? দীপা আবার হাসল।

পঞ্চম চেয়ার নেই। অসীম ব্যস্ত হয়ে পাশের টেবিল থেকে একটা চেয়ার চেয়ে টেনে এনে বলল, বসো। কিন্তু দীপা ততক্ষণে অসীমের খালি চেয়ারটির দিকে এগিয়ে গিয়েছে। আরাম করে সেটায় বসতে অসীমকে পঞ্চম চেয়ারে বসতে হল। এখন দেখলেই বোঝা যায় ওই চেয়ারটি পরে সংযোজিত হয়েছে। অসীমকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে দেওয়া হল।

দীপার দিকে অসীমের বন্ধুরা তাকিয়েছিল। অসীম তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে মুখ খুলতেই দীপা বলল, আমার নাম দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়। স্কটিশে পড়ি। অসীম আমার সিনিয়ার। কিন্তু বন্ধু হিসেরে খুব সিনসিয়ার। আপনারা নিশ্চয়ই ওর বন্ধু?

দীপা লক্ষ্য করল তার এরকম কথা বলার ধরন দেখে তিনজনেই বেশ চমৎকৃত। আর অসীম যেন আরও নিবে গেল। সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্যেই সে জিজ্ঞাসা করল, কফি খাবে?

অসীমের বন্ধু সুজন বলল, কি রে? কফি খাবে কিনা জিজ্ঞাসা করছিস? দীপা মাথা নাড়ল, না ঠিকই করেছে। ও জানে আমি কফি পছন্দ করি না। ঠিক অভ্যেসে নেই বলে রাত্রে ঘুম হয় না। গ্রাজুয়েশনের পর আপনাদের পরিকল্পনা কি?

তিনজন যুবক পরস্পরকে একবার দেখল। একজন বলল, এম এ পড়ব। মনে হল বাকি দুজনেরও একই বক্তব্য। দীপা বলল, অসীম, তুমি কি সত্যি দিল্লী চলে যাচ্ছ? কি দরকার? বন্ধুরা যখন এম এ পড়ছে তখন তোমার চাকরি করতে ভাল লাগবে?

রঞ্জন আতকে উঠল, তুই দিল্লীতে চাকরি করতে যাবি, বলিসনি তো?

দীপা বলল, ওমা আমি কি গোপন খবর ফাঁস করে দিলাম।

হঠাৎ অসীম উঠে দাঁড়াল, দীপা, তুমি একটু বাইরে আসবে?

কেন? এইতো এলাম।

তোমার সঙ্গে আমি কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই। অসীমের মুখ খুব শক্ত, সে একবার ঠোঁট কামড়ে নিল।

এখানে বসে বলা যায় না?

গেলে আমি উঠে দাঁড়াতাম না।

আমার তো মনে হয় না তোমার এমন কিছু কথা আছে যা শুনতে এখান থেকে উঠে যেতে হবে। তুমি বরং বসো। দীপা হাসল।

অন্যান্য টেবিলে অসীমের উঠে দাঁড়িয়ে কথা বলার প্ৰতিক্রিয়া হচ্ছে। অনেকেই এদিকে তাকাচ্ছে। রঞ্জন অসীমের হাত ধরে টানল, বাস। সিন ক্রিয়েট করিস না। তুই আজকাল বড্ড অল্পে রেগে যাচ্ছিস।

খুবই অনিচ্ছা ছিল, ঘাড় গোঁজ করে বসল। অসীম। কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। অসীমের তৃতীয় বন্ধু যার নাম অতীন, জিজ্ঞাসা করল, আপনি আমাদের কথা জিজ্ঞাসা করলেন, নিজেরটা বলেননি।

আমি চাকরি করব।

চাকরি? সুজন চমকে উঠল, কি ধরনের চাকরি?

একদম ওপর থেকে চেষ্টা করব। যা পাই। একটু আগে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। ও অসীম তুমি আমাকে ভুল খবর দিয়েছিলে। আই এ এস-এ বসার ব্যাপারে এখন ওই বিধিনিষেধ নেই। স্বাধীনতার কিছুদিন পরেই উঠে গিয়েছে। যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গীতে কথাগুলো বলে দীপা অসীমের মুখেব দিকে তাকাল। শোনামাত্র অসীমের কপালে ভাঁজ পড়েছে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে।

অতীন বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি আই এ এস দেবেন?

ইচ্ছে আছে।

আই এ এস দিতে গেলে দারুণ পড়াশুনার দরকার হয়। খুব ব্রিলিয়ান্ট না হলে চান্স পাওয়া যায় না। আমার তো কখনও সাহসই হয়নি।

ফর্ম ভর্তি করে পরীক্ষায় বসতে সাহসের প্রশ্ন কেন আসবে। তিন চার মাস নিয়মিত পড়ে পরীক্ষা দিলে ফল খারাপ কেন হবে? আসলে বেশীর ভাগ ছেলেমেয়ে বি এ এম এ পরীক্ষার আগে যা পড়ে তার সিকি ভাগ এসব পরীক্ষার আগে পড়ে না। তাই রেজাল্ট খারাপ হয়। ব্যাপারটা আকাশকুসুম নয়। তার প্রমাণ প্রতিবছর তো অনেকেই পাস করে চাকরি পাচ্ছে।

মেয়েরা আই এ এস হয়েছে? রঞ্জন প্রশ্ন করল।

কেন হবে না? আপনারা খবর রাখেন না। তাই। দীপা চারপাশে তাকল, অসীম, আমাকে একটা ব্যাপারে সাহায্য করতে পার?

অসীম তাকাল। মুখে কিছু বলল না।

ছুটি আসছে। হোস্টেল বন্ধ থাকবে মাসখানেক। এই এক মাস থাকার জন্যে একটা জায়গা চাই। কি করা যায় বলতো? দীপা খুব সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

সুজন জানতে চাইল, কেন, আপনার আত্মীয়স্বজন নেই?

কাছের বলতে কেউ আর নেই এখন, যাঁর কাছে গিয়ে থাকা যায়।

কি বলছেন? এই পৃথিবীতে আপনার আপনজন কেউ নেই? রঞ্জন বলে উঠল।

এক এক সময় সত্যিটা খুব অস্বস্তিকর হয়।

হোস্টেলে আসার আগে কোথায় ছিলেন?

এই রে, এর মধ্যেই আপনারা জেরা শুরু করে দিলেন। দীপা হাসল, তখন সব ছিল, এখন কেউ নেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যে চিরকাল এক থাকবে এমন তো নাও হতে পারে। কলকাতায় আমার তেমন জানাশোনা নেই, তাই আপনাদের বললাম।

অতীন বলল, মুশকিল হল, এক মাসের জন্যে কেউ আপনাকে বাড়ি ভাড়া দেবে না।

বাড়ি ভাডা? ওরে কাবাস, বাড়ি ভাডা দেবার টাকা পাব কোথায়?

তাছাড়া পারেনও না। প্রথম কথা এক মাস আর দ্বিতীয় কথা আপনার সঙ্গে কেউ নেই।

কেউ নেই মানে?

এক মেয়েকে কলকাতা শহরে বাড়ি ভাডা দেওয়া হয় না।

সে ভাড়া দিতে সক্ষম হলেও নয়?

না।

কেন?

হয়তো বাড়ি ওয়ালাব। বিশ্বাস করে না।

কিসের বিশ্বাস?

অতীন থতমত হল, মানে একা মেয়ে দেখলেই লোকে তার চরিত্র সম্পর্কে অনেক কিছু ভাবতে আরম্ভ করে। এদেশে মেয়োবা কখনও একা থাকে না বলেই এটা হয়েছে।

সুজন বলল, আমি শুনেছি হোটেলেও কোন ভারতীয় মেয়ে একা গেলে তার নামে ঘর দেওয়া হয় না। বিদেশিনীদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম নেই।

দীপা বলল, বুঝলাম। এখন এ নিয়ে তর্ক করে কোন লাভ নেই।

অতীন বলল, আপনাকে আমি আগামীকাল একটা খবর দিতে পারি।

কি রকম?

আমার মাসীমার একটা ফ্ল্যাট আছে এলগিন রোডে। ওরা থাকেন সিমলায। চাবি থাকে মায়ের কাছে। মাকে আপনার প্ৰব্লেম বললে তিনি যদি বাজি হন? অতীন কথাগুলো শেষ করল না। বোঝা গেল যে উৎসাহ নিয়ে সে কথা শুরু করেছিল, বলতে বলতে সেই উৎসাহ সে হারিয়ে ফেলছে।

আমি তো ডানডাস হোস্টেলে থাকি। যদি আপনার মায়ের আপত্তি না থাকে তাহলে খবর দিলে খুশি হব। কথাগুলো বলতে বলতে দীপা দেখল মায়া একটি ছেলের সঙ্গে কফিহাউসে ঢুকে এপাশ ওপাশে তাকাচ্ছে। কাউকে খুঁজতে এসেছে কিন্তু পেল না। দীপা উঠে দাঁড়াল, আমি চলি। অসীম, আমরা বন্ধু। এর বেশী পবম্পরের কাছে আশা করা ঠিক নয়। তোমার দেখা পেতে পারি। এমন আশা ছিল বলে কফিহাউসে এসেছিলাম। তোমার বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই, তুমিও আমাকে ভুল বুঝে না। অন্তত আবার যখন দেখা হবে তখন মুখোমুখি যাতে কথা বলতে পারি তেমন সম্পর্কই রাখতে চেষ্টা করা উচিত। দীপা অন্যদের দিকে তাকাল, চলি।

দীপাকে আসতে দেখে মায়া অবাক হল। সে চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, চোখ বড় করে বলল, তুই! এখানে?

এসেছিলাম। কাউকে খুঁজছিস?

হ্যাঁ। আমাদের মেকআপ ম্যান।

মেকআপ ম্যান মানে?

আরো মেকআপের জিনিসপত্র যার কাছে থাকবে। কথা ছিল ও এখানে থাকবে। আর আমরা ষাওয়ার সময় ওকে তুলে নিয়ে যাব। মায়া ঘড়ি দেখল।

রিহার্সাল আছে?

রিহার্সাল নয়, শো। যাবি?

কোথায়?

পাকপাড়ায়। একটা কল শো পেয়ে গেছি। আমরা। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল মায়া। দীপা জিজ্ঞাসা করল, পাকপাড়ায় থিয়েটার হল আছে?

মায়ার সঙ্গী হো হো করে হেসে উঠল। মায়া তাকে ধমকালো, এই শংকর, অমন গাধার মত হাসবি না। দীপা কিছু জানে না বলে জানবে না। এমন মানে নেই।

শংকর বলল, থিয়েটারের হল থাকলেই আমরা শো করতে পারতাম নাকি? হাসলাম তাই। আজ সকালে বোন বলছিল তোমরা হলে থিয়েটার কর না কেন? সেই কথাটাই মনে পড়ে গেল এর প্রশ্ন শুনে।

এতে হাসির কি হয়েছে? দীপার খুব খারাপ লাগছিল।

অক্ষমতা বলে একটা শব্দ আছে, জানেন? শংকর ঘুরে দাঁড়াল, আমাদের চেষ্টা আছে, ক্ষমতাও, কিন্তু পয়সা নেই। ধার করে হল ভাড়া করলে কেউ টিকিট কাটবে না। কয়েকবার সেই চেষ্টা করে এখন হোঁচট খাচ্ছি। মাঠে ঘাটে শো করার সুযোগ না পেলে নাটক রিহার্সাল রুমেই থেকে যেত। শংকরের বলার ভঙ্গীতে যে আন্তবিকতা ছিল তা স্পর্শ করল। দীপাকে। সে জিজ্ঞাসা করল, মাঠে ঘাটে অভিনয় করলে আপনাদের লাভ হয়?

খুব সামান্য। আমাদের ডেকে লোকে বেশী টাকা দেবে কেন? কিন্তু ওই সামান্য লাভ জমিয়ে জমিয়ে যদি থিয়েটারের হলে দু-একটা শো করতে পারি। সেই আশা নিয়ে থাকা।

আপনাদের নাটক লোকে টিকিট কেটে দেখতে চায় না কেন?

মায়া এতক্ষণ শুনছিল কথাবার্তা আর তার চোখ সেই মেকআপ ম্যানের সন্ধানে রাস্তায্য ঘুরছিল। সে বলল, এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে তোমাকে আমাদের নাটক দেখতে হবে। আমরা প্ৰফুল্ল কিংবা দুই-পুরুষ অভিনয় করতে চাই না, বঙ্গে বগী অথবা কেদাব বায করার যুক্তি খুঁজে পাই না। এখনও বাংলাদেশে এইসব নাটকের প্রচুর দর্শক আছে।

কিন্তু নবান্ন, পথিক, রক্তকরবী, বিসর্জন? দীপা নামগুলো মনে করছিল।

এবার জবাব দিল শংকর, বিসর্জন দেখতে কটা দশক যাচ্ছেন? বহুরূপীর মত অত বড় শক্তিশালী অভিনেতাগোষ্ঠী থাকতেও এই অবস্থা। ওই যে এসে গিয়েছে।

দীপা দেখল একটি মাঝবয়সী মানুষ একটা বড় বাক্স নিয়ে হস্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছে। মায়া বলল, যাবে নাকি?

দীপা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। লোকটা ততক্ষণে কাছে এসে গিয়েছে, দেরি হয়ে গেল। তোমরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ, না? খুব দুঃখিত!

আপনার তো দেরি হয় না দেবেশদা? শংকর হাঁটতে শুরু করল।

হুম। তোমার বউদির সকাল থেকে এক শো তিন-চার জ্বর। আমি ছাড়া তো সামলাবার কেউ নেই। মাথায় জল ঢেলে ঢেলে একটু জ্বর কমিয়ে এলাম।

ডাক্তার দেখাননি?

প্রথম দিন তো, প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে। দেবেশবাবু দীপাকে দেখল, এটি কে?

আমার বন্ধু। দীপাবলী।

চমৎকার নাম। উঠে পড়, বাস আসছে।

একটা মাঝারি ভিড়ের বাসে ওরা উঠে পড়ল। লেডিস সিটে এক ভদ্রলোক বসে ছিলেন। ওদের দেখে উঠে পড়তেই দীপা মায়াকে বলল, বসে পড়। তুই অভিনয় করবি।

মায়া মাথা নাড়ল, না। আমি লেডিস সিটের অ্যাডভানটেজ নিই না।

দীপা অবাক হয়ে গেল, ও মা, কেন?

নিজেকে খুব দুর্বল মনে হয়। অন্যের অনুকম্পা নিচ্ছি ভাবতে খারাপ লাগে। মায়া হাসল, শংকরের সঙ্গে আমার কোন ফাবাক নেই, তাহলে ও বসতে পারবে না যেখানে সেখানে আর একটা মানুষকে উঠিয়ে আমি বসতে যাব কেন?

কথাগুলোর মধ্যে জোরালো যুক্তি দেখতে পেল দীপা। সে উঠে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে বলল, আপনি বসুন। আমরা বসব না। বলামাত্র ভদ্রলোক ধপাস করে বসে জানলা দিয়ে চোখ মেলে দিলেন বাইরে। কিন্তু বাসের অন্যান্য যাত্রীরা ঘুরে ফিরে তাদের দেখছে এখন। এমন ব্যাপার যেন কেউ আগে দেখতে পায়নি। আর তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গৈল। বিদেশে নাকি লেডিস সিট বলে কিছুক্ত নেই। আর একজন গলা চড়ালো, বিদেশে কি বলছেন, বম্বেতে গিয়েছিলাম, সেখানেও বাসে লেডিস সিটি দেখতে পাইনি।

মায়া ঠোঁট টিপে হাসছিল, নিচু গলায় বলল, বাঙালি পরের ছেলেমেয়ের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করতে খুব ভালবাসে, বুঝলে!

ংকর বাসের ভাডা দিয়েছিল। বিকেল ফুরাবার আগে ওরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল। অবশ্য এর মধ্যে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করতে হয়েছে শ্ৰীনাথ মুখার্জী লেনটা কোথায়? শেষপর্যন্ত গলি বন্ধ করে তৈরী করা মঞ্চ নজরে পড়ল। সামনে গোটা পঞ্চাশেক চেয়ার পাতা আছে। ছোট ছেলেমেয়েদের ভিড়। ওদের দেখে গুঞ্জন উঠল, হিরোইনরা এসে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আরও কৌতূহলী কিছু মানুষ মুখ বাড়াল।

মঞ্চের পেছনে আসামাত্ৰ শমিতের গলা শোনা গেল, দেবেশদ, আপনাকেও যদি ডিসিপ্লিন শেখাতে হয় তাহলে তো মুশকিল। কাঁটার সময় আসার কথা ছিল আর এলেন কখন? শংকর মায়া না হয় বড় অভিনেতা হয়ে গিয়েছে কিন্তু আপনার কাছ থেকে এটা আশা করিনি। যান, সবাই বসে আছে মেকআপ রুমে।

সেই দাডিওয়ালা ছেলেটি যে মণি কলেজে পড়ে, একদিন যার সঙ্গে মায়া তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, সেই শমিত এবার এগিয়ে এল সামনে, কি ব্যাপার? আপনি?

দেবেশবাবু ততক্ষণে চলে গিয়েছেন চোখের আড়ালে। মায়া দাঁড়িয়েছিল পাশে, কৌতূহল দেখাল, নিয়ে এলাম।

চমৎকার! তোমরা এইসব করছি আর আমরা উনুন জ্বেলে বসে আছি। কাদের নিয়ে নাটক করব? দ্যাখো মায়া, এই জিনিস আর কখনও যেন না হয়। শমিত ঘুরে দাঁড়াল।

দীপার মনে হল সে এসে অন্যায় করেছে। শমিত পছন্দ করছে না। তার এভাবে আসাটা। সে মায়াকে বলল, আমি যাই।

শমিত ঘুরে দাঁড়াল, যাই মানে? যাবেন তো এলেন কেন?

আমার মনে হচ্ছে। আমি এসে আপনাকে বিব্রত করেছি।

নিজেকে এত মূল্যবান ভাবা ভাল, তবে এক্ষেত্রে নয়। আমরা পয়সা নিয়ে নাটক করতে এসেছি। এটা যাত্রার দল নয়। ভাল নাটক করতে হলে প্ৰত্যেকের আচরণ ভাল করতে হয়। এটাই বোঝাতে চেয়েছি। আমি। আমাদের নাটক তো কখনও দ্যাখেননি?

দীপা মাথা নেড়ে না বলল।

বহুরূপীর নাটক দেখেছেন?

সুযোগ পাইনি।

সুযোগ? এইতো গত সপ্তাহে নিউ এম্পায়ারে বিসর্জন হয়ে গেল। আসলে এসব দেখার মত মনই আপনাদের তৈরী হয়নি। যাও মায়া, দাঁড়িয়ে থেকে না। শমিত হস্তদন্ত হয়ে অন্যদিকে চলে গেল। এইসময় সুজয় এল। দীপার মনে পড়ল, সুজয় নাটক লেখে। এই অনুবাদ করেছে সুজয়। তাকে দেখে মায়া জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার বলতো? মাথা গরম হয়ে আছে খুব! কিছু হয়েছে নাকি?

শো-এর সময় এটাই তো। ওর স্বাভাবিক অবস্থা। তার ওপর উদ্যোক্তারা যে টাকা দেবে বলেছিল তা থেকে পঞ্চাশ টাকা কম দিয়েছে আমদানী হয়নি বলে। ইনি?

আমার বান্ধবী, দীপাবলী।

ওহো, আপনার সঙ্গে তো এর আগে একদিন আলাপ হয়েছিল। গ্রুপে জয়েন করলেন? এক মুখ হাসি নিয়ে প্রশ্ন করল। সুজয়।

না। ও আমার সঙ্গে নাটক দেখবে বলে এসেছে। আয় দীপা।

পর্দা টাঙিয়ে মেকআপ। রুম হয়েছে। ছেলেরা সংখ্যায় বেশী, তাদের জন্যে বন্ড জায়গা। নারী চরিত্র একটি। ছোট্ট ঘেরা জায়গায় কাঠের বাক্সের ওপর বসল। মায়া। দেবেশদার কাছ থেকে চেয়ে আনা মেকআপের সরঞ্জাম নিয়ে সে নিজেই নিজের মেকআপ করতে বসে গেল। অবাক হয়ে দেখছিল দীপা। জিজ্ঞাসা করল, এসব শিখলি কোথায়?

সাজগোজ মেয়েদের স্বভাবেই থাকে। কিছু কিছু কায়দা দেবেশদার কাছে জেনেছি।

উনি তখন অত বকুনি খেয়েও শমিতবাবুকে কিছু বললেন না কেন?

কি বলবে?

ওঁর স্ত্রীর অসুখ।

দেবেশদার কাছে এটা কোন যুক্তি নয়। শমিতের কাছে তো নয়ই। নাটক হল প্ৰথম ভালবাসা, তার আগে কিছু নেই। মাস ছয়েক আগে শো-এর দুপুরে শমিতের মা মারা গিয়েছিলেন। বাড়িতে মৃতদেহ রেখে এসে শো করে ফিরে গিয়ে দাহ করেছিল। দেবেশদও একই ঘরানার মানুষ।

তুই?

জানি না। এখনও তেমন সমস্যায় পড়িনি। পড়লে হয়তো একই কাজ করব।

কিন্তু নাটকের জন্যে তোদের এত ভালবাসা কেন?

মা তো মাঝে মাঝে আমাদের পাগল বলে।

শুনেছি। অভিনয়ের একটা নেশা আছে।

হয়তো আছে। কিন্তু দীপা, দেবেশদা কখনও স্টেজে নামেননি। ব্যাক স্টেজের কাজকর্ম নিয়ে থাকেন। ওঁর ক্ষেত্রে কি বলবি?

মায়া মেকআপ করতে লাগল। দীপা চুপচাপ হয়ে গেল। কিছু শিক্ষিত ছেলেমেয়ে কোন উন্মাদনায় এমন কাণ্ড শুরু করেছে তা তার বোধগম্য হচ্ছিল না। শমিত যেভাবে ধমকালো তা একমাত্র মালিকরাই পারে। কিন্তু কেউ কোন প্ৰতিবাদ করল না। অথচ দল থেকে টাকা পাওয়া দূরের কথা পকেট থেকে টাকা দিতে হচ্ছে সবাইকে। এরই নাম কি ডিসিপ্লিন? তাহলে বলতে হবে এই ডিসিপ্লিন মিলিটারির চেয়ে অনেক মূল্যবান। কারণ মিলিটারিরাত মাইনে পায়।

মায়ার মেকআপ নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞাসা করল, খুব চড়া হয়নি তো?

খুব।

আমি কিন্তু কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি না। দর্শকের সঙ্গে আমার ব্যবধান থাকবে অনেকখানি। তার ওপর আলো পড়বে। দূবত্ব বাড়লে যে রেখাগুলো অদৃশ্য হয়ে যায় সেগুলোকে একটু প্ৰমিনেন্ট করতেই হয়। এবার বল।

দীপা হেসে ফেলল, আমি বলতে পারছি না।

মায়া ওই ঘেরার মধ্যে বসেই গলা তুলল, দেবেশদা! একবার আসবেন?

দেবেশদারা গলা পাওয়া গেল, আসছি।

একটু বাদেই পদ সরিয়ে দেবেশদর মুণ্ডু দেখা গেল, ঠিক আছে, বাঁ দিকটা সামান্য মেরে না ও আর কিছু?

মায়া মাথা নেড়ে না বলতে মুণ্ড অদৃশ্য হল। দীপা জিজ্ঞাসা করল, উনি তোর মেকআপ করে দেন না কেন? সেটাই তো ভাল হত।

যারা একদম পারে না। তাদের দেখিয়ে দেন। আমাদের থিয়েটারে পেশাদারী মেকআপ মুনি রাখা সম্ভব নয় বলে সবাইকে এটা শিখুতে হয়। তাছাড়া দেবেশদাকে পােশাকটাও দেখতে হয়। আমরা ঠাট্টা করে বলি লণ্ড্রিবাবু।

উনিও এই কাজের জন্যে পয়সা পান না?

দুর। দেবেশদা দলের মেম্বার। কর্পোরেশনে চাকরি করেন। এর মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে ধাবি নিয়ে দলকে দিয়েছেন।

মায়া পোশাক পালটাতে, শুবৎ কর্বল। ব্যাপারটা এত দক্ষ তার সঙ্গে সে শেষ করল যে দীপার একটুও অশ্লীল বলে মনে হল না। সে জিজ্ঞাসা করল, এই নাটকে স্ত্রী চরিত্র একটাই?

হুঁ। তার বেশী থাকলে নাটক হবে না।

কেন?

মেয়েই পাওয়া যায় না। শমিত বাইরে থেকে ভাডা করে অভিনেত্রী আনবে না। আর সেটা দলের পক্ষে সম্ভবও না। পেশাদারী মানুষদের পক্ষেও আমাদের মত দলের সঙ্গে মানিয়ে চলা সম্ভব নয়। একটা নাটকে দুটো চরিত্র ছিল মেয়েদের। তার একটা কাজের লোকের। আমি ডাবল রোল করেছিলাম। কাজের মেয়ের ঘোমটা ছিল নাক অবধি।

নাটক শুরু হল। এই মায়া চোখের সামনে সম্পূৰ্ণ অন্য মানুষ হয়ে গেল। শমিতকে যেন একটুও রাগী বলে মনে হল না। মানুষের সুখদুঃখ কি সাবলীলভাবে টুকরো টুকরো ছবি একে ফুটিয়ে তুলল ওরা। এই ছবি আঁকাতে কোথাও কোন কিছু জোর করে চাপানো নেই। দীপার মনেই হচ্ছিল না সে থিয়েটার দেখছে। দর্শক ও মঞ্চের মধ্যে ব্যবধান তো থাকবেই। কিন্তু মঞ্চের মানুষগুলো সাজানো গলায় কথা বলছে না, সাজানো সমস্যা নিয়ে দাপাদাপি করছে না। এ তার নতুন অভিজ্ঞতা।

নাটকের শেষেও দলের অনেক কাজ থাকে। হোস্টেলে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে বলে বিদায় নিতে এল দীপা। শমিত তার দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন লাগল।

ভাল। খুব ভাল। দীপা জবাব দিল।

আশ্চর্য! সেটা মুখ ফুটে বলতে পারেন না? শুনলে উৎসাহ পাই। শমিত যেভাবে কথাগুলো বলল তার অভিব্যক্তিটা দীপা বুঝতে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *